নওরিনের সাথে আমার প্রেমটা হয়েছিল অন্য একটা কারণে। আমি বলতে চাচ্ছি যে প্রেম ভালোবাসা যেভাবে বা যে কারণে হয়ে থাকে তেমন ভাবে নয়। আমার বাড়ি বিক্রমপুর এই কারণে। আমি মোটামুটি শতভাগ নিশ্চিত যে যদি আমার বাড়ি বিক্রমপুর না হয়ে অন্য কোথাও হত তাহলে নওরিনের সাথে আমার ভাব ভালোবাসা হত না।
নওরিনকে আমি চিনতাম আমার ক্লাসমেট হিসাবেই। প্রথম বর্ষে আমাদের খুব একটা কথা হয়েছে বলে আমার মনে পড়ে না। তবে দ্বিতীয় বর্ষে ওঠার পরে একদিন নওরিন নিজ থেকেই আমার সাথে কথা বলতে এল। আমাকে জিজ্ঞেস করল, তোমার বাসা বিক্রমপুরে?
আমি মাথা নাড়ালাম।
-বিক্রমপুরের কোথায়?
-আমার টঙ্গিবাড়ি।
আমি নওরিনের চোখে মুখে একটু যেন হতাশা দেখতে পেলাম। পরে সে জিজ্ঞেস করল, তোমাদের ওখান থেকে সিরাজদিখান কত দুরে?
-কাছেই। বেশি দুরে না। আমার নানার বাড়ি ওখানে।
তারপরেই আমি নওরিনের চেহারায় একটা দ্বিধা দেখতে পেলাম। কিছু যেন ও বলতে চাইছে কিন্তু বলতে পারছে না। আমি তখন নিজ থেকে এগিয়ে এসে বললাম, সিরাজদিখানে কে থাকে তোমার?
নওরিনের চেহারায় বিষণ্ণ ভাবটা যেন হঠাৎ বেড়ে গেল। আমি একটু অবাক হলাম এই ভাবের পরিবর্তন দেখে। মনে হল যে খারাপ কিছু কি বলে ফেললাম? নওরিন নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, তোমাদের ওখান থেকে কত সময় লাগে?
-খুব বেশি সময় লাগে না। বাসে একরে এই আধা ঘন্টার মত লাগে।
-আমি যদি তোমার সাথে টঙ্গিবাড়ি পর্যন্ত যাই আমাকে সিরাজদিখানের বাসে তুলে দিতে পারবে?
-হ্যা কেন পারবে না? তুমি এর আগে কখনও যাও নি?
নওরিন মাথা নাড়াল। আমি বললাম, কোন চিন্তা নেই। আমি বাসে তুলে দিব।
-তুমি আবার বাড়ি যাবে কবে?
-কাজ না থাকলে আমি প্রতি সপ্তাহেই যাই।
-এই সপ্তাহে?
-হ্যা এই সপ্তাহেও যাব।
-আমাকে তাহলে একটু নিয়ে যেও প্লিজ।
বৃহস্পতিবার বিকেলে নওরিনকে নিয়ে রওয়ানা দিলাম। যখন টঙ্গিবাড়ি পৌছালাম তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বাসস্ট্যান্ডে নেমেই নওরিন বলল, এখান বাস ছাড়বে?
আমি একটু হেসে বললাম এখান থেকেই ছাড়বে। আমরা যে বাসে এলাম সেটাই যাবে সিরাজদিখান।
-তাহলে আমি নামলাম কেন?
-কারণ এখন ওখানে যেতে হবে না। কাল যাবে। এখন আমাদের বাসায় চল।
নওরিন প্রবল ভাবে মাথা নাড়তে লাগল। আমি তখন বললাম, তোমার ওখানে কে আছে বল? তাকে বল এখানে আসতে। বেশি সময় লাগবে না এখানে আসতে। সে যদি এখানে আসে তাহলে আমি তোমাকে যেতে দিব। এর আগে না।
দেখলাম নওরিন কোন কথা বলল না। তবে আমাদের বাসায় সে যেতেই চাচ্ছিল না । তবে একটু পরে বাজারে আব্বাকে দেখতে পেলাম। সে এগিয়ে এল আমাদের দিকে। আমি আগেই আব্বাকে জানিয়েছিলাম আমি একজন বন্ধুকে নিয়ে আসব। সে সিরাজদিখান যাবে। আব্বাই মূলত আমাকে বলেছিল যে মেয়ে মানুষের সন্ধ্যা বেলা একা একা যেতে হবে না। রাত টুকু আমাদের বাসায় থেকে সকালে গেলেই হবে।
আব্বাকে সামনে আসতেই আমি সালাম দিমাল। নওরিনকে পরিচয় করিয়ে দিল। দেখলাম নওরিন তাড়াহুড়া করে সালাম দিল আব্বাকে। আব্বা যখন বলল বাসায় যেতে তখনও নওরিন একটু নাহুনাহু করছিল তবে আব্বা একটু ধমক দিতেই নওরিন আর কোন কথা না বলে রাজি হয়ে গেল।
আমাদের বাসার ঠিক সামনেই বড় একটা পুকুর রয়েছে। বাসার ঝুল বারান্দা একেবারে পুকুরের পাড়ে গিয়ে পড়েছে। বর্ষাকালে যখন সব জায়গাতে পানি উঠে যায় তখন এই ঝুল বারান্দার নিচ পর্যন্ত পানি চলে আসে। এই দক্ষিনমুখী বারান্দা আমার বেশ পছন্দ। দেখলাম নওরিন সন্ধ্যার পরে সেখানেই বসে ছিল। আমি আসতেই নওরিন একটু নড়েচড়ে বসল। তারপর বলল, এই জায়গাটা সুন্দর অনেক।
-হুম। বর্ষাকালে আরও সুন্দর লাগে। আর কদিন পরেই তো বর্ষা তখন এসো একবার।
নওরিন আমার দিকে ফিরে বলল, এখানে আসার দরকার ছিল না।
-আমি কিছু জানি না। আব্বা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে। এই সময়ে কোণ ভাবে তোমাকে ওখানে না যেতে দিতে।
-তোমার বাসায় জানানোর দরকার ছিল না কোনো।
-মাথা খারাপ নাকি? আমি একজন মেয়েকে নিয়ে বাস থেকে নেমেছি এই কথা যদি আমি বাসায় না বলতাম পুরো এলাকা রাষ্ট্র হয়ে যেত।
-তোমাকে ঝামেলায় ফেলে দিলাম, তাই না?
-আরে না কী যে বল । এটা কোন ঝামেলা না। তা তুমি তো বললে না যে সিরাজদিখানে কে আছে তোমার?
নওরিন কিছুটা সময় চুপ করে রইলো। আমি তাকিয়ে দেখলাম পুকুরের শেষ পাড়ের দিকে সে তাকিয়ে রয়েছে। সেদিকে তাকিয়ে থেকেই নওরিন বলল, ওখানে আসলে কেউ নেই।
-তাহলে কেন যেতে চাইছো?
-আসলে …
আমি চুপ করে রইলাম। আমার মনে হল যে নওরিনকেই সব টুকু বলতে দেওয়া উচিত। নওরিন আরো কিছুটা সময় ইতস্তর করে বলল, ওখানে আমার বাবার কবর আছে।
-ও সরি! আমি জানতাম না তোমার বাবা নেই। সরি।
-না ঠিক আছে। সরি বলতে হবে না।
আমার যেন ঠিক মত বুঝতে পারলাম না। আমি বললাম তুমি না বললে তোমাদের বাসা রাজশাহী। তাহলে তোমার বাবার কবর এখানে কেন?
দেখলাম নওরিন তখনও চুপ করেই আছে। আমার মনে হল আমি যেন একটু বেশি অনিধিকার চর্চা করতে চাইছি। আমি তাড়াতাড়ি করে বললাম, না বলতে চাইলে আমি প্রশ্ন করব না। ঠিক আছে । কাল সকালে তোমাকে সিরাজদিখান নিয়ে যাবো। ওকে?
নওরিন আরও কিছু সময় চুপ থেকে বলল, রাজশাহীতে আমার নানা বেশ সম্ভ্রান্ত মানুষ। অনেক টাকা পয়সা জমিজমা আছে। সেই তুলনায় আমার বাবা সাধারণ ছিলেন। শুনেছি বিয়েটা হয়েছিল আমার নানার ইচ্ছেতেই। আমার দাদার নাকি অনেক ঋণ ছিল নানার কাছে। সেই ঋণের বদলে বাবার সাথে মায়ের বিয়ে হয়। এই কথাটা আমার মা খুব ভাল করেই জানতেন। কোন দিন বাবাকে ঠিক দাম দিতেন না। আমার বাবাও কেমন যেন দম বন্ধ মত অবস্থা হয়েছিল। তাই তিনি চাকরি নিয়ে ঢাকা আসেন। সেখান থেকে পোস্টিং এই মুন্সিগঞ্জেই। মা তার সাথে আসে নি। বাবা অনেকবার তাকে আনতে চেয়েছেন। এক সময় সময় বাবা হাল ছেড়ে দিয়ে চাকরিতে মন দেন। এই সব আমি আমার দাদীর কাছ থেকে শুনেছি। উনি মারা যাওয়ার আগে আমাকে বলেছিলেন।
নওরিন একটু চুপ করল। আমি কোন কথা বলা সমীচীন মনে করলাম না। মনে হল নওরিন যতখানি ইচ্ছে বলুক। আমি শুনে যাই।
এক সময় বাবা আর গ্রামে আসতেন না। আমার বয়স যখন ছয় তখন আমি জানতে পারি যে বাবা মারা গেছেন। এইখানেই নাকি তার কবর হয়েছে। আমার মা নানা কখনই এখানে আসে নি। এর কারণ আমি পরে জেনেছি। এখানে থাকার সময় নাকি বাবা একজনকে বিয়ে করেছিলেন। সেই খবর মা জানতে পেরে রাগে আর বাবার কাছে আসেনই নি। আমারও প্রথম প্রথম খুব কষ্ট পরে রাগ উঠেছিল বাবার উপরে। কিন্তু পরে একটু যখন বড় হয়েছি তখন বুঝতে পেরেছি বাবা আসলে কেন আরেকটা বিয়ে করেছিল। একজন পুরুষ তার স্ত্রীর কাছে যা চায়, যে ভালোবাসা যে সম্মান সেটা সে মায়ের কাছ থেকে কখনই পান নি।
নওরিন চুপ করে রইলো অনেকটা সময়। আমরা বারান্দায় মেঝেতে বসে ছিলাম। আমি একটু তার দিকে সরে গেলাম। তারপর নওরিন হাত ধরলাম। বললাম, আমি বুঝতে পারছি।
-আমি কখনও এই কথা কাউকে বলি নি। আজকে কেন জানি তোমাকে বলতে ইচ্ছে হল। কাউকে বল না কেমন!
-কাউকে বলব না।
আমরা আরও বেশ লম্বা সময় সেখানে বসে রইলাম। সন্ধ্যার পেরিয়ে ঘন রাত হয়ে এল। আমার কাছে ভালই লাগছিল।
রাতের খাওয়ার সময় দেখলাম বাবা নওরিনকে অনেক কথা জিজ্ঞেস করলেন। নওরিন তার মায়ের কথা নানার কথা সব জানাল। তার বাবা এখানে সরকারি চাকরি করতেন, এখানেই মারা গিয়েছিলেন। বিয়ের কথাটা নওরিন এড়িয়ে গেল। নওরিন সেই কবরটাই দেখতে যাবে।
সকালে ঠিক হল নওরিনের সাথে আমিও যাব। বাবা ফোন করে ছোট মামাকে সব ব্যবস্থা করে রাখতে বললেন।
সিরাজদিখান পৌছে আমরা নানা বাড়ি গেলাম প্রথমে। সেখান থেকে ভূমি অফিসে গিয়ে হাজির হলাম। প্রায় পনের বছর আগের কথা। সেই সময়ে যারা অফিসে কাজ করতো তাদের অনেকেই এখন অন্য কোথাও চলে গেছে। তবে একজন পিয়নের খোজ পাওয়া গেল। সে নওরিনের বাবাকে চিনল। সেই আমাদের জানালো যে নওরিনের বাবার কবর কোথায় পাওয়া যাবে। আমরা তাকে খানিকটা জোড় করেই নিয়ে গেলাম সেই কবরস্থানে। সেখানে গিয়ে একটু অবাকই হলাম। কারন কবরটা বাঁধাই করা। কেউ এটার যত্নও নিয়েছে সময়ে সময়ে।
নওরিনকে সম দিলাম বাবার কবরের সামনে নিজের মত করে সময় কাটানোর। আমি ছোট মামাকে নিয়ে বাইরে চলে এলাম। কিছু সময় পরে নওরিন বের হয়ে এল।
দুপুরে নানা বাড়ি খাওয়া দাওয়া করছি এমন সময় একটা ঘটনা ঘটল। একজন মাঝ বয়সী মহিলা নানাদের বাসায় এসে হাজির হলেন। নওরিনের খোজ করছিলেন তিনি। আমরা সবাই বেশ অবাক হলাম।
ইনি এখানকার স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। কিন্তু সে নওরিনের খোজ করছে কেন?
নওরিনকে নিয়ে যখন তার সামনে দাড়ালাম তখন দেখলাম তিনি গভীর চোখে নওরিন দিকে তাকিয়ে আছেন। তারপর একটু হেসে বললেন, তুমি নিয়াজের মেয়ে? তোমার কথা ও অনেক বলতো।
আমি তখনই বুঝে গেলাম এই মহিলা কে! সম্ভবত নওরিনও বুঝে গেল যে এই মহিলা কে।
তারপর অনেকটা অর করেই তিনি নওরিনকে তার বাসায় নিয়ে গেলেন। সাথে আমিও গেলাম।
নওরিনের বাবা এই মহিলার সাথেই বিয়ে করেছিলেন। এই পরিবারেও তার একটা মেয়ে আছে। নওরিনের থেকে কয়েক বছর ছোট। নওরিনের বাবার কবরটার যত্ন কে নেয় সেটা আমি বুঝতে পারলাম।
আমি ভেবেছিলাম নওরিন বেশ অস্বস্তিতে পড়বে। কিন্তু আমি ওর চোখে মুখে কেন জানি একটা আনন্দময় মনভাব দেখতে পেলাম। নওরিন সেই বাসাটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। তার বাবা এই বাসাতেই জীবনের শেষ সময়গুলো কাটিয়েছেন। এটাই ছুঁয়ে দেখতে লাগল সে। আমার মনে হল এই অনুভূতিটা নওরিনকে শান্তি দিচ্ছে। ও যেন ওর বাবাকে কাছে পাচ্ছে।
নওরিনের সৎ মা তার ওখানে অনেক করে থাকতে বললেন তবে নওরিন জানালো যে ক্লাস কামাই করার উপায় নেই। তবে সে আবার আসবে। কথা দিয়ে গেল।
নওরিনকে নিয়ে ফিরে আসার সময় বাসের সিটে সে আমার কাধে মাথা রেখেছিল। ছোট ছোট কথা বলছিল আমার সাথে। নওরিন বলল, জানো শেষ সময়ে বাবা ভাল ছিলেন। আমার মায়ের কাছ থেকে যে ভালোবাসা যে সম্মান সে কোন দিন পায় নি আন্টির কাছ থেকে সেটা পেয়েছিলেন। কেন জানি এটা জানার পর থেকে বাবার উপরে আমার আর কোন রাগ নেই। সত্যিই নেই। আমার কথা অনেক বলতেন তিনি ।
আমি অনুভব কছিলাম নওরিন কাঁদছে। আমার দিকে আরেকটু এগিয়ে এল সে। আমি নিজেকে সরিয়ে নিলাম না। সত্যি বলতে আমার ভাল লাগছিল নওরিনের এই ঘনিষ্ঠতা।
তারপর নওরিনের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। প্রায়ই সপ্তাহেই সে আমার সাথে বিক্রমপুরে হাজির হত। কখনও আমাদের বাসায় আবার কখনও বা তার সৎমায়ের বাসায়। আমরা যদিও একে অন্যকে বলি নি যে আমরা কোণ সম্পর্কে আছি। তবে আমাদের ব্যাপারটা দূর থেকে দেখলে যে কেউ বলে দিবে আমরা একে অন্যের সাথে আছি।