প্রোটেক্টিভ জ্যাকেট পরে আমি ফেডারেল কারাগারের প্রাঙ্গণের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছি। আজকে আমি এই জেলখানার প্রথম মহিলা চ্যাপলিন হিসেবে কাজ শুরু করব। আমার ইউনিফর্মের মধ্যে হাতকড়া, পেপার স্প্রে এবং একটি রেডিও আছে। যদি কোনো বিপদ হয় তবে এই রেডিওতে থাকা বোতাম চেপে আমি এলার্ম চালু করতে পারব।
আমি কদিন আগেই ত্রিশে পা দিয়েছি। আর কদিন আগেই আমার বিয়ে হয়েছে।
জেলখানার পুরুষ কর্মীরা হাউজিং ইউনিট থেকে বেরিয়ে ক্যাফেটেরিয়ার দিকে যাচ্ছিল, তাদের দেখে আমি আমার বুটের মধ্যে অস্বস্তি বোধ হতে লাগল। আমি তাদের থেকে চোখ সরিয়ে ওয়াচটাওয়ার এবং কাঁটাতারের সারির ওপারে পাহাড়ের দিকে তাকালাম।
একজন অফিসার আমার কাছে এসে বলল, “আপনাকে একটা প্রশ্ন করি? এখানে এই বন্দীদের মধ্যে কতজনকে আপনি সাহায্য করতে পারবেন বলে মনে করেন? আপনার কাজের ফলে কতজন তাদের জীবন সত্যিই বদলাবে?”
“খুব বেশি নয়,” আমি বললাম। “হয়তো পাঁচ-ছয়জন।”
“আগের চ্যাপলিনকেও আমি একই প্রশ্ন করেছিলাম। সে এখানে আট বছর ধরে ছিল। সে আমাকে কতজন বলেছিল জানেন?”
“দশ?”
“একজন। মাত্র একজন। আপনি এদের বদলাতে পারবেন না। এদের জন্য চিন্তা না করাই ভালো। আপনি চ্যাপলিন বলে হয়তো বন্দীদের ঘৃণা করবেন না, তবে যতটা সম্ভব ঘৃণার কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করুন।”
জেলখানা সম্পর্কে আমি যে উজ্জ্বল ধারণা নিয়ে এসেছিলাম — বড় কোনো পরিবর্তন আনার ধারণা — তা দ্রুত ম্লান হয়ে গেল।
কারাগারে ১,০০০-এর বেশি বন্দী পুরুষ ছিল। এদের ভেতরে বেশিরভাগই ছিল সুবিধাবঞ্চিত। বাধ্য হয়ে গ্যাং-এ যোগ দিয়েছিল। প্রায় সবাই জীবনের কঠিন পরিস্থিতি এবং অন্যায়ের সম্মুখীন হয়েছিল। এদের সাথে এমন কোন খারাপ কাজ নেই যে করা হয় নি। আমার আসার কয়েক বছর আগে এখানে একজন অফিসার নৃশংসভাবে খুন হয়েছিল। এতো অস্থির পরিবেশে মাঝে আমি ভাবলাম, আমি কী বা দিতে পারব।
এমনকি চ্যাপেলও নিরাপদ ছিল না। এটি ছিল মাদক পাচার এবং গ্যাং-এর কাজকর্ম পরিচালনার জন্য পরিচিত স্থান। যে কোন সময় এখানে মারামারি লেগে যেত। আমার কাজের ঘরটি বেশ ফাকা ছিল, পালিশ করা মেঝে, ফ্লুরোসেন্ট আলো, কংক্রিটের দেয়াল। ঘড়ে বড় ধাতব দরজা ছিল। মারামারি শুরুর হলেই এই দরজায় তালা দিয়ে বসে থাকতাম। প্লাস্টিকের চেয়ার এবং বহনযোগ্য পালপিটের মাঝে একটি গ্র্যান্ড পিয়ানো ছিল। একটা অসুন্দয় জায়গায় সৌন্দর্যের প্রতীক ছিল এটি।
প্রথম রবিবার উপাসনা পরিচালনার পর, একজন বন্দী আমার কাছে এসে বলল, “আমাদের একটা কয়্যার (গায়কদল, বিশেষ করে যারা গির্জার সেবায় অংশ নেয়) ছিল, আমি ছিলাম পরিচালক। আমরা কি আবার শুরু করতে পারি?”
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। জেলে আসার আগে এই লোক তার স্ত্রীকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল এবং তাকে বেশ কয়েকবার গুলি করেছিল। অবিশ্বাস্যভাবে, সে বেঁচে গিয়েছিল।
তার উপস্থিতি আমাকে অস্বস্তিতে ফেলল। তবুও, আমি তার সঙ্গে কয়্যার শুরু করতে রাজি হলাম।
আমরা দুজনেই জানতাম না আমরা কী করছি। অপটু ভাবে, অনভ্যাসের কারণে, আমার আঙ্গুলগুলো পিয়ানোতে সুরে ট্রিপ করছিল। আমি “ঈশ্বর” কাছে সাহায্য চাইলাম।
“যদি আমি তাকে পছন্দ করতে না পারি,” আমি নিঃশব্দে প্রার্থনা করলাম, “অনুগ্রহ করে আমাকে তাকে ভালোবাসতে সাহায্য করুন।”
আমরা “What a Beautiful Name” গানটি দিয়ে শুরু করলাম। যখন প্র্যাকটিসে আসা পাঁচজন পুরুষ কয়েদী আমাকে বলল যে তারা কেউ গানের নোট পড়তে পারে না তখনই বুঝতে পারলাম এটা আমাদের কর্ম নয়। কয়্যার পরিচালকও পারত না। যেহেতু সে নোট পড়তে পারে না, সে তাল রাখতে ব্যর্থ হল, এবং ব্রিজে পৌঁছানোর সময় গ্রুপটি ভুল নোটে শুরু করল। আমরা বারবার চেষ্টা করলাম। আমি মাথা নাড়িয়ে তাদের সময়মতো নোটে আঘাত করার জন্য ইশারা দিতে লাগলাম।
রবিবার এই ছোট কয়্যার দল কয়েক ডজনের কয়েকদীর সামনে দাঁড়াল। ভয়ে ভয়ে প্রথম স্তবক বেসুরো ভাবে গাইলো। খুব আওয়াজ শোনা গেল না। পরে পরিচালক সবার দিকে ইশারা করে গাইতে বলল — “আমাদের সঙ্গে যোগ দাও!”
তারা গানের লিরিক জানত না।
পরের সপ্তাহে, আমি গানের লিরিক কপি ছাপিয়ে সবার মাঝে বিলি করলাম। কয়্যার এবং সামনে দাঁড়ানো কয়েদীর দল গানের স্তবকগুলোর মাধ্যে হোঁচট খেল, কোরাসের সঙ্গে কণ্ঠ আরও জোরালো হল। যখন আমরা ব্রিজে পৌঁছলাম, কয়্যার পরিচালক আবারও নোট মিস করল। সবাই আবার দেরিতে গাইতে শুরু করল।
এবার অল্প সময়ের জন্য আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। তবে সেটা অল্প সময়ের জন্য। আমাদের না পারারর জন্য হতাশা মুহুর্তেরর ভেতরে রূপান্তরিত হল আনন্দে। আমি পিয়ানো বাজাচ্ছি আর নিজের হাসি চেপে রাখার চেষ্টা করছি, তারপর ফোঁস করে উঠে হেসে দিলাম। নোট বাজিয়ে এবং হাসতে হাসতে, আমি মুহূর্তের ভেতরে অন্যরকম জাদু অনুভব করলাম। আমার মনে হল যে এসব আসলে এতো গুরুত্বসহকারে নেওয়ার দরকার নেই। চ্যাপেলের বাইরের অবস্থায় না, যে কোন সময় মারামারি লেগে যেতে পারে। কিন্তু আমরা এখানে গান গাচ্ছি, যেন স্কুলের বাচ্চারা একটি ওরাটোরিও ঠিক করার চেষ্টা করছে।
আমি পুরুষ কয়েদীদের দিকে তাকালাম — পরিচালক, কয়্যারদল — এবং তাদের প্রতি ভালোবাসা অনুভব করলাম।
“ঠিক আছে!” আমি পরে বললাম। “আমরা পরের বার আবার চেষ্টা করব।”
“আমরা পরের সপ্তাহে ঠিক করে ফেলব,” কয়্যার পরিচালক হেসে আমাকে বলল।
কয়েক সপ্তাহ পরে, আমার জীবনটা নাটকীয়ভাবে বদলে গেল। বিবাহের মাত্র পাঁচ মাস পরে, আমার স্বামী আমাকে বলল যে সে ডিভোর্স চায়।
পরের সকালে আমি কাজের জন্য ঘুম থেকে উঠলাম, আমার চোখ ফোলা ছিল। আমি ঠান্ডা জলে মুখ ধুলাম। দুঃখের প্রমাণ মুছে ফেলে সামনে আসা অসম্ভব কাজের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার চেষ্টা করলাম — যে আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতে সে আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে, তবুও আমাকে অন্যদের জন্য উপস্থিত থাকতে।
আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। বারবার কেবল তার কথাই মনে হচ্ছিল। আমি আমার দৈনন্দিন কাজের ভেতরেও তাকে ভুলে থাকতে পারলাম না। বারবার মনে হচ্ছিল সে কোথায়, কী করছে, কী ভাবছে। সে কি কষ্টে আছে? নাকি আমার থেকে দুরে গিয়ে শান্তিতে আছে? এই ভাবটা আমার জন্য আরো খারাপ ছিল।
এক রবিবারের পর আরেক রবিবার, কয়্যার এবং গানের দল ফিরে আসতে থাকল। আমাদের সংখ্যা বাড়ল। কয়্যার আর কখনো একা পারফর্ম করার চেষ্টা করল না; তারা কেবল সবার সামনে দাঁড়াল, সবাইকে একসঙ্গে গাইতে উৎসাহিত করল।
একসঙ্গে থাকার সেই মুহূর্তগুলোতে কিছু পরবর্তন ঘটল। পুরুষ কয়েদীরা খুলে কথা বলতে শুরু করল, তাদের দুঃখ আর ভয় ভাগ করে নিল: “আমি আমার বাচ্চাদের জন্য চিন্তিত, কারণ আমি তাদের বাবা হিসেবে সেখানে নেই।” “আমার আসক্তির মুখোমুখি হতে সাহায্য দরকার।” “গত সপ্তাহে জানলাম আমার বোন মারা গেছে।”
এক গ্রীষ্মের সন্ধ্যায়, আমি জেলখানার প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে আছি, আমার শরীরে ব্যথা, স্ট্যাব ভেস্ট বুকে চেপে ধরছে, বাহু ঘামে ভিজে, বুট পায়ে ফোলা পায়ে শক্ত হয়ে আছে। সূর্য নিচে নেমে গেল, জেলখানার উঠোনে সোনালি আলো ছড়িয়ে দিয়েছে, তাপে পোড়া একটি দিনের শেষকে নরম করল।
“হেই, কার্সন,” একজন অফিসার বলল। “ওই ঐ কয়েদীকে দেখেছেন?”
আমি দূরে একজন পুরুষকে দেখার জন্য চোখ ছোট করলাম। লোকটার শরীরে পুড়ে বিকৃত হয়ে গিয়েছে।
“আমি তাকে ‘ডেডপুল’ বলে ডাকি,” সে বলল। “এটা তাকে রাগিয়ে দেয়।”
সেই পুরুষ কয়েদী পরের রবিবার চার্চে এল। তার শরীরের উন্মুক্ত অংশগুলো ছিল বাদামী, গোলাপী এবং সাদা রঙের টুকরো টুকরো, চুলহীন। সে একটি বাইবেল তার বুকের কাছে ধরে রেখেছিল।
তাকে দেখলে ব্যথা অনুভূত হত।
তাই আমি সবার দিকে তাকালাম এবং পোড়া শরীরের কয়েদী বা অফিসার তাকে ডেডপুল বলে ডাকার কথা, এই সবের নিষ্ঠুরতা নিয়ে ভাবতে চাইলাম না।
উপাসনার পর, আমি তার কাছে গিয়ে বললাম, “আপনাকে এখানে পেয়ে ভালো লাগল। আপনি কি পরের রবিবার শেষ প্রার্থনা করতে ইচ্ছুক হবেন?”
“হ্যাঁ,” সে বলল।
পরের রবিবার, শেষ ভজনের পর, তার চোখ পিছনের সারি থেকে আমার চোখের সঙ্গে মিলল, অনিশ্চিত এবং খোঁজার মতো। আমি মাথা নাড়লাম, তাকে উৎসাহ দিয়ে।
কাগজ শক্ত করে ধরে সে পালপিটে হেঁটে গেল। তারপর বলল, “ঈশ্বর এই ঘরের সবাইকে শান্তি, ভালোবাসা, সুখ, বোঝাপড়া এবং ক্ষমা দিয়ে আশীর্বাদ করুন। ঈশ্বরের সঙ্গে মিলিত হতে, পাপী এবং শত্রু থেকে তার সামনে ধার্মিক হতে, আমাদের অবশ্যই আমাদের পাপ এবং ভুলগুলো স্বীকার করতে হবে, এবং ক্ষমা চাইতে হবে, তাহলে আমরা ঈশ্বরের সঙ্গে মিলিত হব। কারণ আমাদের প্রেমময় ঈশ্বর একজন ক্ষমাশীল ঈশ্বর।”
আমার কপালে একটি শিহরণ অনুভূত হল।
তার প্রার্থনার পর, কয়েক সেকেন্ডের জন্য নীরবতা ধরে রাখল। তারপর প্লাস্টিকের শব্দ হল যখন শরীরগুলো নড়ল, শ্রদ্ধা ঘুরে গেল এবং সবকিছু দৃশ্যত স্বাভাবিক হয়ে গেল। শুধু এটুকু ছাড়া — লোকটা হাসছিল। “আমি কখনো,” সে বলল, “এমন কিছু করিনি।”
বাড়ি ফিরে এই গল্পগুলো আমি আমার স্বামীকে বলতাম — জেলখানার কয়্যারের তাল, দিনের জটিলতা, আমাদের সব পুরুষের প্রার্থনা, অপ্রত্যাশিত সৌন্দর্য এবং অনুগ্রহের মুহূর্ত। যখন সে চলে গেল, আমি সেই ব্যক্তিকে হারালাম যে জানত এই মুহূর্তগুলো আমার কাছে কী ছিল।
এখন আমি তাকে ছাড়াই এই ভয়ংকর জায়গায় আছি, এর সব বিপদ নিয়ে ভাবছিলাম, আমরা মানুষেরা একে অপরের প্রতি যে ভয়ানক কাজগুলো করি, সেই কথাগুলো ভাবছিলাম। এবং যদিও এটাও সত্য যে ভালোবাসা বিপজ্জনক, কারণ আমরা যাদের ভালোবাসি তারা আমাদের সবচেয়ে বেশি আঘাত করার ক্ষমতা রাখে, তবুও কখনো না ভালোবাসার চেয়ে এটা ভালো।
আমি প্রায়ই সেই অফিসারের কথা ভাবি যিনি আমাকে বলেছিলেন আমার উচিত বন্দী পুরুষদের ঘৃণা করার চেষ্টা করা। অন্যরাও একই ধরনের কথা বলেছিল। “আপনি তাদের চ্যাপেলে দেখেন,” একজন বলেছিল। “আমি তাদের হাউজিং ইউনিটে দেখি। এবং তারা সেখানে আপনার জন্য যেমন, তেমন নয়।”
আমি এটা বিশ্বাস করি। চ্যাপেলে, আমরা কিছু ভিন্ন কিছু ঘটার জন্য জায়গা তৈরি করেছিলাম, যতই ছোট হোক, যতই সাময়িক হোক। এমনকি রবিবার মাত্র এক ঘণ্টার জন্য হলেও, আঘাতপ্রাপ্ত পুরুষরা স্বস্তি পেতে পারত। তারা গাইতে পারত। আমরা গাইতে পারতাম।
নিউইয়র্ক টাইমসের মর্ডন লাভ স্টোরী সেকশন থেকে গল্পটা অনুবাদ কৃত