নীল নয়না

4.5
(36)

নাইরার প্রতি আমাদের ক্লাসের সবাই একটা টান অনুভব করতো। তাকে পছন্দ করতো। আসলে নাইরা এমনই এক মেয়ে ছিল। ওর চেহারার ভেতরেই একটা অন্য রকম ভাব ছিল। এটা আসলে কোন ভাবে ভাষায় ব্যাখ্যা করা যায় না। থাকে না এমন কিছু মেয়ে যাদের দেখলেই কেবল কাছে পেতে ইচ্ছে করে, নাইরা ছিল ঠিক তেমন একজন মেয়ে।
প্রথম ক্লাস থেকে আমাদের সবার চোখ ছিল তার উপরে। একেবারে ওরিয়েন্টেশ থেকেই। শুধু যে আমাদের চোখ ছিল তার ছিল তার উপরে সেটাও না। আমাদের কয়েকজন ইয়াং লেকচারার তার আশে পাশে ঘোরাফেরা করত। আমাদের যে একটু রাগ হত না সেটা না তবে আমাদের সহ্য করে নেওয়ায় ছাড়া আর কিছু করার ছিল না।
কিন্তু যেদিন আমরা জানতে পারলাম যে নাইরার একজন বয়ফ্রেন্ড আছে সেদিন আমাদের ক্লাসের সবার মন ছিল খুব খারাপ। আমরা যেন এটা মেনেই নিতে পারছিলাম না । আমাদের বারবার কেবল মনে হচ্ছিল যে নাইরার মত মেয়ের কেন বয়ফ্রেন্ড থাকবে। ওর তো এমন বয়ফ্রেন্ড থাকতে পারে না, থাকা উচিত না। এমন মেয়ের সব সময় সিঙ্গেল থাকবে।
আমরা অবশ্য সবাই জানতাম যে নাইরা আমাদের সবার আওতার বাইরের একজন মানুষ। আমরা তাকে কেবল দূর থেকে দেখেই সুখী হতাম। কালে ভাদ্রে আমাদের কারো সাথে তার কথা হত। সে ক্লাসে আসতো একটা কালো সেডান গাড়িতে চেপে। ক্লাস শেষ করে আবার সেই গাড়িতে করেই চলে যেত।
নাইরার সাথে আমার প্রথম কথা হল যেদিন আমাদের ডিপার্টমেন্টের হেদ ফ্যাকাল্টি রামন স্যার মারা গেলেন। আমি সেদিন ক্যাম্পাসে পৌছেই দেখি সবার মুখ খানিকটা থমথমে। একটু পরেই জানতে পারলাম রামন স্যার মারা গেছে। আরও ভাল করে বললে তাকে নাকি কেউ খুন করেছে। স্যারের শরীরে নাকি কোন রক্ত ছিল নেই। কিছু একটা দিয়ে সেই শরীরের সমস্ত রক্ত শুষে নেওয়া হয়েছে।
স্যারের স্ত্রী বেশ কিছুদিন ধরেই তার বড় ছেলের কাছে আমেরিকাতে গিয়েছিলেন। এই কদিন স্যার একাই থাকতেন বাসায়। প্রতিদিন একজন কাজের মানুষ এসে রান্না বান্না করে দিয়ে যেত। তার কাছে আলাদা চাবি ছিল। সে নিজের মত এসে কাজ করে দিয়ে চলে যেত। আজকে সকালে একই ভাবে যখন সে দরজা খুলে ভেতরে ঢোকে। প্রতিদিনের মত কাজ শুরু করে। তখনও সে কিছু টের পায় নি। কিন্তু যখন স্যারের দরজার দিকে তাকাল তখন খানিকটা অবাক হল। দরজাটা খোলা ছিল। সকালের এই সময়টা স্বাধারণত এমনটা থাকে না। স্যার অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকতেন বলে আমরা জানি। তাই সকালে তার দেরিতে ঘুম ভাঙ্গত। এই সময় তার শোবার ঘরের দরজা বন্ধই থাকত । আজকে দরজা খোলা দেখে সে কৌতুহল নিয়ে দরজার কাছে এগিয়ে গেল। ভেতরে উকি দিয়েই তার শরীর ঠান্ডা হয়ে এল। সে দেখল রামন স্যার বিছানার উপরে উপুর হয়ে পড়ে আছেন। তার পরণে কোন পোশাক নেই। যদিও কোন রক্ত বা ক্ষতের চিহ্ন কাজের মহিলাটা দেখতে পায় নি তবুও বিছানার উপরে এমন ভাবে পড়ে থাকতে দেখে তার মনে হল যে খুব খারাপ কিছু ঘটেছে। সে এক চিৎকার দিয়ে দৌড় দিয়ে বের করে গেল রুম থেকে। সোজা চলে গেল নিচের রিসিপশনের কাছে। সেখানে থাকা কেয়ারটেকারকে নিয়ে এল। কেয়ারটেকার সব কিছু দেখে দ্রুত পুলিশে খবর দিল।

সব থেকে চিন্তার ব্যাপার কে তাকে এভাবে খুন করেছে সেটার ব্যাপারে কেউ জানে না। কোন ধারণাই করতে পারে না। শরীরটা অনেকটাই ঢুমড়ে মুচড়ে ছিল। শরীরের ভেতরে কোন রক্ত ছিল না। রামন স্যার যে বিল্ডিংয়ে থাকতেন সেখানে চাইলেই যে কেউ আসতে পারত না। পুরোবাড়ি সিসিটিভির আওতায়। অথচ তার বাসায় গতকাল রাতে কেউ আসে নি। পুলিশ তাই সন্দেহ করছে বিল্ডিংয়ের ভেতরে কেউ কাজটা করেছে কিন্তু কিভাবে কাজটা করেছে সেটার ব্যাপারে কারো কোন ধারণা নেই। কারো শরীর থেকে কিভাবে এমন করে রক্ত বের করে নেওয়া যায় সেটার ব্যাপারে কারো কোন ধারণা নেই। পুলিশ এবং ফরেনসিক আরও তদন্ত করছে।
ক্যাম্পাসে গিয়ে আমি এসব জানতে পারলাম। এছাড়া আমাদের আরও জানানো হল যে আজকে আর কোন ক্লাস হবে না। আমি বাসায় চলে যাবো কিনা ভাবছি সেই সময়েই আমি নাইরাকে দেখতে পেলাম। আমি একাই বসে ছিলাম । আমাদের ক্লাসের প্রায় সবাই চলে গেছে। আমিও উঠব উঠব করছিলাম তখনই নাইরাকে আমার দিকে এগিয়ে আসতে দেক্ষলাম। সে সরাসরি আমার পাশে এসে বসল খুব স্বাভাবিক ভাবে। তারপর বলল, আমাকে একটু হেল্প করতো!
আমার বিস্ময় তখনও পুরোপুরি কাটে নি। নাইরা সরাসরি আমার কাছে এসে হেল্প চাইছে। আমি কোন মতে বললাম, কী হেল্প?
-আজকে আমার সাথে গাড়ি নেই। তুমি আমাকে একটু হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারবে?
-কী হয়েছে তোমার?
-ঠিক বুঝতে পারছি না। মাথাটা একটু ঘুরছে। আর দেখো আজকেই আমার সাথে গাড়ি নেই। একেই বলে কপাল।

আমি এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম। আসলে রাজি না হওয়ার কোন কারণই ছিল না। আমি নাইরার সাথে সময় কাটাতে পারব এর থেকে ভাল আর কী হতে পারে? এই প্রস্তাবে রাজি না হওয়ার কি কোন কারণ আছে?
দিনটা আমার কাছে কেমন যেন স্বপ্নের মত মনে হল। আমরা একসাথে একটা রিক্সা নিলাম। নাইরার এতো কাছাকাছি বসার সুযোগ এই প্রথম পেলাম। আমাদের ক্যাম্পাসের কাছে এপোলো হসপিতাল। সেখানেই নিয়ে গেলাম নাইরাকে। ইমার্জেন্সীতে ডাক্তার দেখলো, কয়েকটা ঔষধ লিখে দিল। আমি আবারও ওকে নিয়ে রিক্সায় উঠলাম। এরপর সোজা ওর বাসার সামনে সামনে নামলাম।
তবে নাইরা যখন আমাকে ওর বাসায় আমন্ত্রন জানালো তখন আমি যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলাম। নাইরা বলল, আসলে এমনটা আমার প্রায়ই হয়। এই সময়ে আমার একা থাকতে ইচ্ছে করে না। জারিফ রাতে আসবে। তুমি থাকবে একটু প্লিজ।
জারিফ সম্ভবত নাইরার বয়ফ্রেন্ডের নাম। ইনস্টাগ্রামে যে ছেলেটার সাথে ওকে আমরা দেখেছি সেই সম্ভবত জারিফ। আমার মন একটু খারাপ হল বটে কিন্তু আমি নাইরার আকর্ষণ থেকে বের হতে পারলাম না। এই মেয়ের আকর্ষণ থেকে বের হওয়া সম্ভব না কোনো ভাবেই।

নাইরার ফ্ল্যাটে ঢুকেই আমি একটা ব্যাপার আবিস্কার করলাম। এই ফ্ল্যাট কেন জানি একটু নোংরা মনে হল। সেই সাথে একটা অদ্ভুত গন্ধ নাকে এসে লাগল। গন্ধটা আমার কাছে একেবারেই অপরিচিত মনে হল। এটাকে আমি ঠিক দূর্গন্ধ মনে বলব না তবে এটা আমার কাছে একেবারেই অপরিচিত।
আমি সোফার উপর বসলাম। নাইরা একটু ভেতরে চলে গেল। আমি এই সময়ে কী করব ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। নিজের ফোন বের করে ব্রাউজ করতে লাগলাম। আমাদের ফেসবুকে রামন স্যারের মৃত্যু নিয়ে অনেকগুলো পোস্ট এসেছে। নানান মানুষ নানান রকম কথা বলছে। তখনই আমার কাছে একটা ব্যাপার একটু অবাক লাগল । এই যে আমি এতো সময় ধরে নাইরার সাথে রইলাম নাইরা একবারও আমার সাথে রামন স্যারের কথাটা বলল না। আমরা যখন রিক্সা করে যাচ্ছিলাম তখন নাইরা আমার ব্যাপারে অনেক কথাই জানতে চাইল। আমি কোথায় থাকি কী করি এই সব। অথচ আমাদের ক্যাম্পাসের একজন স্যার মারা গেল এটা নিয়ে নাইরার কোন কৌতুহলই নেই। ব্যাপারটা আমার কাছে একটু অবাকই মনে হল।
একটু পরেই নাইরা ফিরে এল। দেখলাম এরই ভেতরে সে পরণের পোশাকটা বদলে ফেলেছে। এমন কি মুখেও পানি দিয়ে এসেছে। আমি ওর দিকে একটু চমকালাম। চমকানোর কারণ হচ্ছে নাইরার চোখ। নাইরার চোখ নীল। এই দেশের মেয়েদের চোখের রঙ সাধারণত নীল হয় না। কালো কিংবা বাদামী হয়। কিন্তু নাইরার চোখ নীল। নাইরাও বুঝতে পারল যে আমি ওর চোখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। নাইরা একটু হাসল। তারপর বলল, সারপ্রাইজড?
-কন্ট্যাক্ট লেন্স?
নাইরা আবারও হাসল। তারপর বলল, এটা আসল। তোমরা যেটা দেখো সেটা হচ্ছে কন্ট্যাক্ট লেন্স!
আমি এবার সত্যিই অবাক হলাম। বললাম, কেন ? তোমার এতো সুন্দর চোখ তোমার!
-আসলে এই নীল চোখ মানুষকে আকর্ষণ করে বেশি। আমি এটা চাই না।
আমি হেসে বললাম, তোমার দিকে মানুষ এমনিতেই আকর্ষিত হয়। তবে নীল চোখ হলে সেটা আরও বহুগুণ বাড়বে।
-তাই সবাই আকর্ষিত হয়? তুমিও?
আমি চট করেই জবাব দিতে পারলাম না। কারণ এই প্রশ্নের জবাব আমি কী দিব? আমি কী বলব যে আমি তোমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। তুমি তোমার ঐ বয়ফ্রেন্ডকে ছেড়ে আমার সাথে প্রেম করো। কিন্তু চাইলেই তো আর এই কথা কাউকে বলা যায় না। আমাকে চুপ থাকতে দেখে নাইরা আবারও হাসল। তারপর বলল, আচ্ছা বাদ দাও, কী খাবে বল?
-আরে এখন কিছুই খাবো না। তোমার তো শরীর খারাপ, এখন কিছুই করতে হবে না।
-আরে চিন্তা কর না। আমি কিছুই করবো না। আমার ড্রাইভার আছে, ও নিয়ে আসবে। এতো সময়ে গাড়ি ঠিক করে নিয়ে এসেছে সম্ভব।
এই বলেই নাইরা নিজের ফোন বের করল । তারপর একটা নম্বরে ফোন দিল। প্রায় সাথে সাথেই ফোনটা রিসিভ হল। নাইরা একটু নির্দেশের সুরেই বলল, আমাদের জন্য নাস্তা নিয়ে এসো। চারটা নান আর শিক কাবাব।
আমি আবার একটু চমকালাম। নান আর শিক কাবাব আমার পছন্দের একটা খাবার আর নাইরা সেই পছন্দের খাবারই অর্ডার দিল? এটা কি কাকতালীয় কোন ব্যাপার? ফোন টা রেখে আবার আমার দিকে তাকাল। ওর সেই নীল চোখের চাহনীতে আমি যেন অন্য সব কিছু আবার ভুলে গেলাম।
নাইরা আমার এতো কাছে চলে এলো যে আমার বুকের ভেতরটা ধকধক করতে লাগল। এর আগে কোন মেয়ে আমার এতো কাছে আসে নি। আমি একভাবে নাইরার ঐ চোখের দিকে তাকিয়ে রয়েছি। আমি যেন কোন কথা বলতে পারছি না। আমি একেবারে আটকে গেছি ঐ চোখের মায়াতে। আমার যেন আর মুক্তি নেই। কত সময় আমি নাইরার দিকে তাকিয়ে ছিলাম আমার মনে নেই তবে এক সময় আমাদের তন্ময় ভাঙ্গল দরজার কলিংবেলের শব্দে। নাইরা উঠে চলে গেল দরজা খুলতে। ফিরে এলে একটু পরেই। হাতে খাবারের প্যাকেট।
আমার বুকের ধুকধুকানি তখনও কমেনি। একটা লজ্জার আভা আমার পুরো শরীর জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে নাইরাকে দেখলাম একেবারে স্বাভাবিক।
খাওয়া দাওয়া করলাম এক সাথে। অনেক গল্প করলাম। এমন সময়ে আবারও কলিংবেল বেজে উঠল। নাইরা আবারও আমাকে রেখে উঠে গেল। একটু পরে ফিরে এল। সাথে একজন সুদর্শন যুবক। আমার বুঝতে কষ্ট হল না এই ছেলেটার নাম জারিফ। সে নাইরার বয়ফ্রেন্ড। আমার দিকে ইশারা করে নাইরা বলল, ও হচ্ছে সুমন। আমার ফেন্ড। আজকে ক্যাম্পাসে একটু খারাপ লাগছিল, তাই ওকে নিয়ে এলাম।
জারিফ হাসল আমার দিকে তাকিয়ে। তারপর নিজেই হাত বাড়িয়ে দিল। আমি জারিফ। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ নাইরাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য।
আমি তার হাত ধরলাম। হাতটা ধরলেই আমার পুরো শরীর যযেন একটু কেঁপে উঠল। মনে হল যেন একটা বিদ্যুতের প্রবাহ জারিফের শরীরে থেকে। তবে তার মুখের হাসি অমলিনই রইলো।

আমি আরও ঘন্টাখানেক পরে নাইরার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে এলাম। যখন রিক্সায় করে ফিরছি তখন একটা ব্যাপার আমার কাছে বেশ অদ্ভুত মনে হল। আপনার প্রেমিকার সাথে একজন ছেলে তার ফ্ল্যাটে ছিল কয়েক ঘন্টা, এই ব্যাপারটা প্রেমিক হিসাবে আপনার কাছে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। আমি এমন হলে ব্যাপারটা মোটেই স্বাভাবিক ভাবে নিতাম না। এটা নেওয়া সম্ভব? কিন্তু জারিফের মুখের ভাব দেখে মনে হল এই ব্যাপারটা সে একেবারে স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছে। সে তাহলে নাইরাকে খুব বেশি বিশ্বাস করে নাকি এর ভেতরে অন্য কোনো ব্যাপার আছে?

এরপর নাইরার সাথে আমার বেশ কয়েকদিন দেখা হল না। আমি ক্যাম্পাসে গেলেও নাইরা ক্যাম্পাসে এল না। সেদিন ওর বাসা থেকে আসার সময় আমি ওর ফোন নম্বর নিয়ে আসি নি। আসলে এই ফোন নম্বর নেওয়ার কথা আমার মনেই ছিল না। ভেবেছিলাম যে পরের দিন তো আমাদের ক্যাম্পাসে আবার দেখা হবেই। কয়েকবার মনে হল যে নাইরার বাসায় গিয়ে হাজির হই। তবে সেটা করা থেকে নিজেকে সংবরন করলাম। নাইরা যদি নিজ থেকে না দেখা করতে চায় আমার আগ বাড়িয়ে যাওয়া মোটেই ঠিক হবে না।

প্রায় সপ্তাহ খানেক পরে আমার ফোনে একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন এসে হাজির। আমি ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে নাইরার কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম। আমার নম্বর নাইরার কাছে ছিল জেনে আমি অবাকই হলাম। নাইরা আমাকে জানালো যে তার শরীর একটু খারাপ। আমি এখন তার বাসায় আসতে পারব কিনা?

সত্যি বলতে কি আমার মনে আর কিছু কাজ করলো না। আমি তখনই বললাম যে আমি আসছি। যদিও আরও দুইটা ক্লাস ছিল আমার। পরে আবার একটা টিউশনিও ছিল এই দিকে। আমার এসব মনেই রইলো না। আমার মনের ভেতরে কেবল এই কথাই মনে হল যে আমাকে এখন নাইরার বাসায় যেতে হবে যেকোন ভাবেই।
আমি ঘন্টা খানেকের ভেতরেই নাইরার বাসায় গিয়ে হাজির হলাম।
যদিও নাইরা বলেছিল যে সে খানিকটা অসুস্থ তবে তার চেহারা দেখে আমার মোটেই তাকে অসুস্থ মনে হল না। বিশেষ করে নাইরার পোশাক দেখে আমি একটু খাবি খেলাম। নাইরা একটা সর্টস পরে আছে। সেই সাথে একটা টিশার্ট। তবে এর ভেতরে সে কিছুই পরে নি সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। আমি তীব্র একটা অস্বস্তিবোধ করতে লাগলাম।
তবে একটু পরে নাইরা যে আচরণ শুরু করলো তাতে আমি সত্যিই অবাক না হয়ে পারলাম না। আমার মন বলছি যে এখানে আজকে কিছু একটা ঠিক হচ্ছে না। এখনই আমার এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত তবে নাইরার চোখের মাদকতা উপেক্ষা করে চলে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।

নাইরা আমাকে তার শোবার ঘরে নিয়ে গেল। সেদিনের সেই অদ্ভুত গন্ধটা আমি এবার আরও তীব্র ভাবে পেলাম। অবশ্য এই ব্যাপারটা আমার মধ্যে আর বেশি সময় রইলো না। নাইরা যখন আমার ঠোঁটে নিজের ঠোঁট চেপে ধরলো আমার আর কিছুই মনে রইলো না। আমি যেন অন্য জগতে চলে গেলাম।

আমি যখন পুরোপুরি হুস ফিরলো তখন অনুভব করলাম আমি বিছানাতে শুরু আছি। আমার পুরো শরীরে ভেজা ভেজা। কিছু একটা তেল চটচটে জিনিস আমার শরীরে লেগে আছে। আমি হাত দিয়ে সেই জিনিসটা নেড়ে নিজের নাকের কাছে আনতেই সেই অদ্ভুত গন্ধটা পেলাম । আমার শরীর গুলিয়ে এল। এই জিনিস আমার শরীরে লাগল কিভাবে?
আমি কিছুই ঠিক মত মনে করতে পারলাম না। কেবল আমার মনে আছে যে আমি নাইরাকে চুমু খাচ্ছি। তারপর আর কিছু মনে নেই।

আমি আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে দাড়ালাম। পাশের ওয়াশরুমে গিয়ে সবার আগে শরীর থেকে এই তরল পদার্থগুলো ধুয়ে পরিস্কার করলাম।
ড্র‍য়িংরুমে ফিরে এসে আমি নাইরার খোজ করতে লাগলাম। কিন্তু তাকে কোথাও দেখতে পেলাম না। পাশে আরেকটা শোবার ঘর রয়েছে। ওটার ভেতরেও কেউ নেই। রান্না ঘরেও উকি দিলাম। সেখানেও নেই। মেয়েটা গেল কোথায়?
রান্না ঘরের পাশেই একটা ছোট স্টোর রুম রয়েছে। সেদিন নাইরা আমাকে বলেছিল। আমি সেটা দেখার কোন প্রয়োজন মনে করলাম না। কিন্তু আরেক কদম এগিয়েছি তখনই আওয়াজটা শুনতে পেলাম।
ঐ স্টোর রুমের ভেতর থেকে। কিছু একটা গোঙ্গানীর মত আওয়াজ।
নাইরা?
আমি কিছু সময় স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে রইলাম। এবং আবারও সেই আওয়াওটা শুনতে পেলাম। এবার আর দেরী না করে আমি দ্রুত দরজাটা খুলে ফেললাম।
ঘরট অন্ধকার ছিল। দরজা খোলার কারণে ড্রয়িংরুমের আলো সেখানে প্রবেশ করল। আর সেই আলোতেই আমি দেখতে পেলাম তাকে।

মেঝেতে একটা নগ্ন নারী দেহ পড়ে আছে। তবে সেটা পুরোপুরি মানুষের মত নয়। মানুষের মত হাত পা হলেও সেগুলো আরও একটু লম্বা মনে হল। তার গলাটা বেশ লম্বা। মুখমন্ডল মাথাটা মিলিয়ে অনেকটা লাউয়ের মত দেখতে। তবে সেই লম্বা মুখের ভাবটা আমার কাছে বেশ পরিচিত মনে হল। বিশেষ করে সেই নীল চোখ।

নাইরা?
সেটাও আমার দিকে ফিরে তাকিয়েছে। তার চোখে একটা তীব্র বিস্ময়। সে আমাকে এখানে আশা করে নি। কিছু একটাআ মুখ দিয়ে বলতে চাইছিল কিন্তু তার আগেই নিজের পেট ধরে সে আবারও চিৎকার ব্যাথায় গোঙানীর মত আওয়াজ করে উঠল। আমি অবশ্য আর কিছু ভাবলাম না। আমার কেবল মনে হল যে এটার থেকে আমাকে এখন দুরে যেতে হবে। এটার থেকে আমাকে পালিয়ে যেতে হবে।
আমি সর্ব শক্তি দিয়ে দরজা আটকে দিলাম। বাইরে থেকেই সেটা বন্ধ করে দিলাম। তারপর আর চিন্তা না করে সোজা দৌড় দিলাম। আমার আর কোনো দিকে তাকানোর খেয়াল ছিল না। সদর দরজা কিভাবে খুলে সিড়ি দিয়ে নেমেছি আর তারপর কিভাবে সেটা শুধু আমিই জানি।

এরপর নাইরাকে আমি আর দেখি নি। নাইরা আর কখনও ক্যাম্পাসে আসে নি। আমি অবশ্য নাইরার সাথে যোগাযোগের কোনো চেষ্টাও করি নি।
তবে নাইরার ব্যাপারটা আমাকে একেবারে ছেড়ে গেল না। দুই মাস পরে আমি ক্লাস শেষ করে বাসার দিকে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ একদম লোক আমাকে ঘিরে ধরল। আমি তাদের ভাব দেখেই বুঝতে পারলাম যে তারা সরকারি মানুষ। পুলিশ কিংবা গোয়েন্দা সংস্থার মানুষ । আমাকে গাড়িতে তুলে নিল তারা।
প্রায় ঘন্টা খানেক পরে আমাকে একটা ইন্টারোগেশন রুমে নিয়ে বসালো। আমি চুপচাপ বসে বসে ভাবতে লাগলাম যে আমাকে এখানে এরা কেন নিয়ে এসেছে? আমি এমন কোন কাজ তো করি নি। ফেসবুকে সরকারের বিরুদ্ধে যায় এমন অনেক মন্তব্য করি। সেই জন্য আমাকে তুলে আনতে পারে।
আরও পনের মিনিট করে দরজা খুলে দুজন মানুষ ঢুকল। দুজনের বয়স কাছাকাছি। তবে একজন বস বলেই মনে হল । তার ভাবসাবে কর্তৃত্বে ভাব স্পষ্ট। অন্যজন তার জুনিয়রই হবে। জুনিয়র অফিসারটা আমার সামনে কিছু কাগজপত্রের ফাইল রাখল। সেই ফাইল থেকেই একটা ছবি আমার সামনে তুলে ধরল।
-এটা আপনার ব্যাগ তাই না?

আমি চোখ বড় বড় করে তাকালাম ছবিটারর দিকে। এটা আমারই ব্যাগ। এবং এই ব্যাগটা আমি সেদিন নাইরার বাসায় রেখে এসেছিলাম। এরা এই ব্যাগ কিভাবে পেল? তাহলে সেই ফ্ল্যাটে গিয়েছিল ওরা? আমি ঠিক করলাম যে আমি যা জানি সব এদের সত্যি সত্যি বলে দেব। এরা হয়তো আমার কথা বিশ্বাস করবে না তবে আমি একদমই মিথ্যা কথা বলব না। কিন্তু এরপর জুনিয়র লোকটা আমাকে যে প্রশ্নটা করল সেটা শুনে আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম।
সে আমার দিকে আরেকবার একটা ছবি বাড়িয়ে দিল। ছবিটা নাইরার।
-একে তো নিশ্চয়ই চিনেন?
-জ্বী।
-কতদিন ধরে চিনেন?
-প্রায় এক বছর। নাইরা আমাদের ডিপার্টমেন্টে পড়ে আমাদের সাথে।
-আমি ঐ চেনার কথা বলছি না। আমি জানতে চাইছি ঘনিষ্ঠতা কতদিনের?
আমার মুখে একটু বিস্ময় ফুটে উঠল। লোকটা আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলল, যেদিন আপনার ডিপার্টমেন্টের রামন স্যার মারা গেলেন সেদিন থেকেই? তাই না?
এবার আমি তীব্র অবাক হয়ে গেলাম। এই তথ্য এদের কাছে কিভাবে গেল?
-মিস্টার সুমন এবার সত্যি করে বলুন দেখি আপনি কি নাইরার সাথে মিলিত হয়েছিলেন?
আমি আসলে জীবনে এতো অবাক কখনও হই নি। এরা এসব তথ্য কিভাবে জানলো? তার মানে নীরার ব্যাপারেও এরা ঠিক ঠিক জানে সব। আমাকে এদেরকে সব কথাই বলে দিতে হবে।
আমি মাথা ঝাকালাম।
-আপনি আসলেই ভাগ্যবান।
-ভাগ্যবান বলতে?
-এই যে এখনও বেঁচে আছেন। আপনার রামন স্যার বাঁচে কি কিন্তু আপনি দিব্যি বেঁচে আছেন।
-আপনারা আসলে কী বলছেন আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদেরকে শুরু থেকে সব কিছু বলুন। কিছু বাদ দিবেন না।
আমি একটু চুপ থেকে একেবারে আগাগোড়া সব কিছু বলে গেলাম। এমন কি সেদিন স্টোর রুমের ভেতরে আমি যা দেখেছি সেটাও।
আমার কথা শুনে তারা দুজনের চুপ করে রইলো কিছু সময়। এবার বস মত লোকটা বলল, আপনাদের সেক্সের ঠিক কত সময় পরে আমি ঘুম থেকে জেগে উঠেছিলেন?
-আমি একেবারে সঠিক সময় বলতে পারব তবে ঘন্টা চার সাড়ে চার ঘন্টা হবে। হিসাব মত।
এবার সে তার জুনিয়রের দিকে তাকিয়ে বলল, তার মানে তিন ঘন্টা সেফ টাইম। এরভেতরেই ধরতে হবে।

আমি বোকার মত চুপ করেই রইলাম। আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। আমার দিকে তাকিয়ে মনে হল বস লোকটার একটু মায়া হল। সে বলল, শুনুন মিস্টার সুমন, আপনাকে যা বলছি তা হয়তো আপনার ঠিক বিশ্বাস হবে না তবে আপনি যেহেতু নিজ চোখে দেখেছেন তাই আপনার পক্ষে ব্যাপারটা মেনে নেওয়া সহজ হবে।
লোকটা একটু থামল। তারপর বলল, আপনি যে প্রাণীর সাথে মিশেছেন সে এই গ্রহের কোন প্রাণী নয়। অন্তত আমরা জানি না। এই প্রাণীর ভেতরে অদ্ভুত এক শক্তি আছে যা মানুষকে তীব্র ভাবে তার দিকে আকর্ষিত করে। সেক্সুয়্যালি। এই প্রাণী প্রথমে তার ভিক্টিমের সাথে মিলিত হয় তারপর তার শরীর থেকে সমস্ত রক্ত শুষে নয়। আপনার রামন স্যারের বেলাতে যেমন হয়েছিল। ঢাকায় এই রকম আরও চারটা খবর আছে আমাদের কাছে। এছাড়া চট্টগ্রাম এবং বান্দরবানেও ঘটেছে আরও দশ কি এগারোটা।
আমি তীব্র বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছি। আমি যদিও নিজ চোখেই দেখেছি তবে আমার এই গল্প অবিশ্বাস ঠেকছে। বস লোকটা আবারও বলা শুরু করল, ওটা ফিলেইল প্রোডাক্টিভ অর্গান। সে একে একে বাচ্চা উৎপাদন করছে। আমরা জানিও ইতিমধ্যে কত বাচ্চা উৎপাদন সে করে ফেলেছে। আপনিও একমাত্র মানুষ যে এখনও বেঁচে আছেন। আপনাকে আমাদের আবারু দরকার হবে। আশা করি তখন আমাদের সাহায্য করবেন।
স্টেশন থেকে ছাড়া পেলাম । আমার কাছে সব কিছু কেমন অবিশ্বাস মনে হচ্ছিল। এটা কি আদৌও সম্ভব?

পরিশিষ্ট

তারপর বেশ কয়েকটা বছর কেটে গেল। পড়াশোনা শেষ করে আমি চাকরিতে ঢুকলাম। আমি আমার মন থেকে নাইরার কথা মুছেই গিয়েছিল । কিন্তু আবারও সে ফিরে এল। তবে এইবার সে ফিরে এল অন্য ভাবে। সেদিন অফিস থেকে বাসায় ফিরেছি। গোসল করে একটু বিশ্রাম নিচ্ছি এমন সময় দরজায় কলিংবেল বেজে উঠল। আমি দরজার কাছে যেতেই একটা গন্ধ আমার নাকে এল। এবং সাথে সাথেই আমি গন্ধটা চিনতে পারলাম। নাইরার ঘরে থাকা সেই অদ্ভুত গন্ধ। পুরো শরীর কেঁপে উঠল আমার।
আমার তখনই সে পুলিশ অফিসারের কথা মনে পড়ল। সে আমাকে যোগাযোগের জন্য একটা কার্ড দিয়েছিল। এতোদিন ব্যবহার হয় নি বলে সেটা হারিয়ে গেছে কোথায় কে জানে। আমি ভুলেই গেছি। এখন আমি কী করবো?
আরও বার কয়েক কলিংবেল বাজল। শান্ত এবং স্থির ভাবে। যেন কোণ তাড়াহুড়া নেই। আমি রান্নাঘর থেকে বড় ছুড়িটা নিয়ে দরজার সামনে এলাম। তারপর বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে দরজার খুললাম।
তবে অবাক হয়ে খেয়াল করলাম যে সামনে নাইরা দাঁড়িয়ে নেই। তার বদলে ১০ কি বারো বছরের একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটার সব কিছু স্বাভাবিক কেবল একটা জিনিস বাদ দিয়ে। মেয়েটার চোখ।
নীল ! এই এতোদিন পরেও এই নীল চোখ চিনতে আমার অসুবিধা হল না।
বাচ্চা মেয়েটা হাসল আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কেমন আছো বাবা?

ফেসবুকের অর্গানিক রিচ কমে যাওয়ার কারনে অনেক পোস্ট সবার হোম পেইজে যাচ্ছে না। সরাসরি গল্পের লিংক পেতে আমার হোয়াটসএপ বা টেলিগ্রামে যুক্ত হতে পারেন। এছাড়া যাদের এসব নেই তারা ফেসবুক ব্রডকাস্ট চ্যানেলেও জয়েন হতে পারেন।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.5 / 5. Vote count: 36

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →