চিতংবুড়া (৩য় পর্ব)

4.8
(17)

নীতু সময় নিয়ে হাটছে। ও খুব ভাল করেই জানে যে যদি সে বিপদে পড়ে তাহলে তাকে উদ্ধার করতে কেউ আসবে না। তাই এমন কিছু করা যাবে না যেখানে বিপদে পড়ার সম্ভবনা আছে। যদিও পুরো ব্যাপারটাই বিপদের। এভাবে পাহাড়ি নির্জন রাস্তায় এভাবে চলে আসাটা নীতুর মোটেই ঠিক হয় নি, হচ্ছে না । কিন্তু ওভাবে বাসায় চুপ করে বসেও থাকতে পারে নি সে। ঋদ্ধ রায়হানের কী হয়েছে সেটা তাকে চিন্তিত করে তুলছে।
নীতু বেশ সাবধানে এগোচ্ছে। সবার আগে ওর চিন্তা যেই পথে সে যাচ্ছে ঠিক সেই পথেই যেন ফিরে যেতে পারে । এমন হওয়ার সম্ভবনা বেশি যে সে ঋদ্ধ রায়হানের দেখা পাবে না। তখন তাকে এই একই পথে ফিরে যেতে হবে। সেই সময়ে ওকে কেউ রক্ষা করতে আসবে না। ওকে নিজে নিজেই ফিরে আসতে হবে।
এখনও পর্যন্ত সোজা রাস্তায় চলেছে। পাহাড়ের বেশির ভাগ রাস্তাই সোজা হয়ে থাকে। সোজা বলতে এক রাস্তা থাকে। প্যাচগোজ কম। নীতু এগিয়ে যেতে থাকল । হাটতে ওর খারাপ লাগছে না। বরং অন্য রকম একটা আনন্দ লাগছে । সেই সাথে একটা দুঃচিন্তাও লাগছে। ঋদ্ধ রায়হানের আসলে কী হল?
হয়তো দেখা যাবে তার কিছুই হয় নি । যে কাজের জন্য সে গেছে সে নিশ্চিত সেখানে প্রস্তুতি নিয়েই গেছে। এতোদিন ধরে সে পাহাড়ে আছে। বলা যায় প্রায় একাই রয়েছে। নিশ্চয়ই তার সব ধরণের প্রস্তুতি রয়েছে। নীতু হয়তো খামোখাই চিন্তা করছে। এবং এই চিন্তা থেকে নিজের বিপদ ডেকে নিয়ে আসবে!! আচ্ছা এই পাহাড়ে তার অন্য কী কাজ থাকতে পারে লেখালেখি ছাড়া? নীতু শুনেছে পাহাড়ে অনেকেই চোড়াচালানীর সাথে যুক্ত । ঋদ্ধ রায়হানও কি এমন কিছু করতে পারে? চিন্তাটা মাথাটা থেকে দূর করে দিল । মানুষের ব্যাপার খারাপ কিছু চিন্তা করাটা একটা স্বভাব হয়ে গেছে ওর ।
তবে এখনও পর্যন্ত চিন্তা কোন ব্যাপার দেখছে না নীতু। কারণ যে পথে সে এসেছে সেই পুরো পথটাই একটা একক পথ। পায়ে হাটা একটা পথ পাহাড়ের মধ্য দিয়ে গেছে আর নীতু সেটা ধরেই এগিয়েছে। দেখলেই বোঝা যায় যে এই পথে কেউ বা কারা নিয়মিত আসে। সাং বলেছিল যে এই দিকে ওদের পাড়ার কেউ আসে না। সেই হিসাবে ঋদ্ধ রায়হান এই পথে নিয়মিত আসে ! কেন আসে কে জানে ! সেই একক পথ ধরেই নীতু এসেছে। তারপরেও যেখানে ওর একটু সন্দেহ হয়েছে সেখানেই সে একটা চিহ্ন রেখে এসেছে। তাই ভয়ের কোন কারণ দেখছে না। আশা করছে যে ঋদ্ধ রায়হানের সাথে দেখা না হলেও সে একা একা ফিরে যেতে পারবে বলে সে আশা করছে। তবে এই অচেনা স্থানে কোন দিক দিয়ে কোন বিপদ আসে সেটা তো আর বল যায় না।
দুপুরের কিছু আগে নীতু পাহাড়ের একটা কোণে এসে হাজির হল । এতো সময় যে পায়ে হাটার পথটা সে দেখতে পাচ্ছিল সেটা আর সামনে দেখতে পেল না। ডান দিকে পাহাড়ের বড় দেয়াল আর বাম দিকে নেমে গেছে খাঁদ । সামনেও দেয়াল । পেছনে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। নীতু একটু দম নেওয়ার জন্য থামল । পথের উপরেই বসে পড়ল হাত পা ছড়িয়ে। নীতু ঠিক করল যে একটু বিশ্রাম নিবে। তারপর ফিরে যাবে । যদি আজকে ঋদ্ধ রায়হান ফিরে আসে তো ভাল, তাহলে আজকে রাতে কিংবা কাল সকালেই ইন্টারভিউটা নেওয়া যাবে। আর যদি না আসে তাহলে সাংয়ের সাথে ফিরে যাবে। চাকরি আর কপালে নাই থাকে তাহলে আর কী করা ! ভাগ্যের কাছে পরাজয় মেনেই নিবে !
ব্যাগ থেকে পানি বের করে দুই ঢোক খেল। এরপরে শুকনো খেজুর খেল দুটো। একটু দম নিয়ে নিজের চিন্তা শান্ত করল । তারপর যখন ফিরে যাওয়ার জন্য উঠতে যাবে ঠিক সেই সময়ই খাদের দিকে চোখটা পড়ল । একটা মোটা দড়ি। নীতু এগিয়ে গেল সেদিকে। একটা বড় গাছের সাথে দড়িটা আড়াল হয়ে রয়েছে। গাছে হাত দিয়ে একটু ঝুকে নিচে তাকাতেই বড় দড়িটা ভাল করে চোখে পড়ল । তারপরেই বুঝতে পারল আসলে এখন থেকে খাঁদের কাছে নেমে গেছে সেটা । রাস্তা এবার নিচে। নীতুকে বলে দিতে হল না যে ঋদ্ধ রায়হান নিচে গেছে !
নীতুর মস্তিস্ক ওকে বারবার বলছিল নিচের নামার কোন দরকার নেই। এখান থেকেই ফিরে চলে যাওয়া উচিৎ ওর । কিন্তু নীতু নিজেও জানে যে শুধু মস্তিস্কের কথা শুনলে আজকে সে এখানে এতোদুর আসতো না। ব্যাগটা উপরে রেখে, কোমরের সাথে দা টা দড়ি দিয়ে বেঁধে নিল । আস্তে আস্তে দড়ি ধরে নামতে শুরু করল নিচে। খুব সাবধানে পা ফেলতে লাগল ।
নিচে নামতে প্রায় ১৫ মিনিট সময় লাগল ওর। খাঁদের কাছে নেমেই নীতু মনে হল ও যেন অন্য কোন জগতে নেমে এসেছে। পাহাড়ের গহীনে সূর্যের আলো কম আসে এটা সত্য। আর খাদের ভেতরে নামতে সেটা অনেকটাই কমে আসে। অন্ধকার মনে হয় । এই দুপুর বেলাতেও চারিদিকটা কেমন অন্ধকার মনে হচ্ছে। সেই সাথে একটা অশুভ অনুভূতিও যেন নীতু মনে জেগে উঠছে । এই অনুভূতিটা ওর গতদিন হয়েছিল যখন নীতু গোসল করছিল, যখন ওর মনে হচ্ছিল যে কেউ হয়তো ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
নীতু কয়েক কদম এগোতেই দেখতে পেল গুহার মুখটা। অন্ধকার হয়ে আছে। নীতুর মনের ভেতরে একটা ভয় এসে জড় হল। মনে হল যে এই গুহার ভেতরে সে ভয়ংকর কিছু দেখতে পাবে। এর ভেতরে ঢুকলে বিপদে পড়বে। কিন্তু তবুও সে এগিয়ে গেল। গুহার কাছে আসতেই একটা উটকো গন্ধ এল নাকে। কোন প্রাণীর মাংস পঁচা গন্ধ । নীতু সেই গন্ধ নাকে চেপেই গুহার ভেতরে ঢুকল।
টর্চ জ্বেলে ভেতরে আলো ফেলতেই পুরো ঘরটা আলোকিত হয়ে গেল । একেবারে উল্টো দিকের দেয়ালে চোখ পড়তেই নীতু পুরো শরীরটা জমে গেল ।
পুরো দেয়াল জুড়ে একটা বড় মুর্তি বসানো । এবং মূর্তিটা দেখতে গতদিন সন্ধ্যার সময় সে আয়বয়টা দেখেছিল সেটার মত। ঠিক মানুষ নয় তবে মানুষের মত অয়বয়। নীতু যদিও সন্ধ্যার সময় স্পষ্ট ভাবে কিছু দেখে নি কিন্তু এই মূর্তির আকারের কিছু একটা যে দেখেছিল সেটা নিশ্চিত । কোন উত্তর খুজে পেল না যে। মূর্তির ঠিক সামনে কাঠের একটা বেদির মত রয়েছে। বেদির চারদিকে চারটা আংটা দেখতে পেল । এই জিনিস এখানে কিভাবে এল ঠিক বুঝতে পারল না সে।
আলো ফেলে মূর্তির দিকে ভাল করে তাকাল । বানরের মত বসে রয়েছে হাটু ভাজ করে এবং পায়ের উপরে ভর করে । হাত দুটো সামনের দিকে রাখা। নীতু এক ভাবে সেদিকে তাকিয়ে রয়েছে। এখন কী করবে সেটা বুঝতে পারল না। ঋদ্ধ রায়হান এখানে কি এসেছিল?
পুরো ঘরে তার কোন চিহ্ন নেই। এখানে আসলে সামনে গেল কোথায়? ভেতরে এই গন্ধটা কিসের ?
মূর্তিটার আরো একটু কাছে যেন এগিয়ে গেল নীতু তখনই একটা ভয়ংকর জিনিস চোখে পড়ল ওর। মূর্তিটার ঠিক সামনে একটা মানুষের হাত পড়ে রয়েছে। পচাগলা ! এবং গন্ধটা সেখান থেকেই আসছে!
বমি চলে আসল ওর । এবং সাথে সাথেই ওর মনে এই অনুভূতি এসে হাজির হল যে ভয়ংকর কোন বিপদ আছে এখানে। ওকে এখনই এখান থেকে চলে যেতে হবে। কিন্তু কেউ একজন যে ওর পেছনে চলে এসেছে সেটা নীতু টের পায় নি। ঘরে যাওয়ার আগেই একটা রুমাল ওর নাকের কাছে চেপে ধরল কেউ । কিছু সময়ের ভেতরেই নীতু জ্ঞান হারাল !
**
কত সময় পরে নীতুর জ্ঞান ফিরল সেটা নিতু বলতে পারবে না। অন্ধকার ছাদের দিকে কিছু সময় তাকিয়ে রইলো কেবল। তারপরই সব কিছু মনে পড়ল । একবার মাথা ঘুরানো চারিদিকে । গুহার সেই দরজাটা দেখতে পেল । অন্য দিকে মুখ ঘোরাতেই সে বানরমুখো মূর্তিটা চোখে পড়ল ওর। সাথে সাথে সব কিছু একেবারে পরিস্কার হয়ে গেল। কিন্তু যখন সে উঠতে যাবে তখনই অবাক হয়ে দেখল যে সে উঠতে পারছে না। তাকে সেই বেদির উপরেই শুইয়ে রাখা হয়েছে। ওর দুই হাত এবং দুই পা বেদির সেই আংটার সাথে দড়ি দিয়ে আটকানো। নীতু আর কিছু যেন ভাবতেই পারছিল না। বিশ্বাস করতে পারছিল না যে ওর সাথে এই ঘটনা ঘটছে। নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে নীতু নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল কিন্তু কোন কাজ হল না। এক সময় হাল ছেড়ে দিল সে।
গুহার দিকে তাকিয়ে বুঝল সময়টা এখন সন্ধ্যা। একটু পরেই অন্ধকার নেমে আসবে। নীতুর নিজের কাছে বড় অসহায় মনে হল ! কান্না এল । কিন্তু সে খুব ভাল করেই জানে যে কান্না এলেও ওর আসলে কিছুই করার নেই। ওকে কেউ এখানে আর রক্ষা করতে আসবে না।
এক সময়ে গুহাটা পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে এল । নীতুর কোন কিছুই করার নেই এখন অপেক্ষা করা ছাড়া । যে বা যারা ওকে এভাবে এখানে আটকে রেখেছে তারা যা ইচ্ছে তাই করতে পারে ওর সাথে। নীতুর বাধা দেওয়ার কোন উপায় নেই।
এমন সময়ে কারো আওয়জ শুনতে পেল সে । কেউ ঘরে ঢুকল । নীতুর ভেতরে ভয়টা আবারও মাথা চাড়া দিয়ে উঠ। একটা মনে হল জিজ্ঞেস করে যে ওকে এভাবে আটকে রাখার মানে কি ! কিন্তু কোন কথাই বের হল না মুখ দিয়ে।
তবে ওকে বেশি সময় অপেক্ষা করতে হল না। নীতু অনুভব করতে পারল যে মানুষটা ওর খুব কাছে চলে এসেছে। তারপরেই ম্যাচের কাঠি জ্বলে উঠল । নীতু অবাক হয়ে দেখল যে সেই মানুষ আর কেউ নয়, স্বয়ং ঋদ্ধ রায়হান । ওর দিকে হাসিমুখে । তবে এই হাসি নীতু কাছে বড় ভয়ংকর মনে হল । নীতুর অবাক চোখে দেখে ঋদ্ধ রায়হান বলল, তোমার এখানে আসায় ভালই হল। আমাকে আর আলাদা ভাবে তোমাকে নিয়ে আসতে হল না।
-মানে?
-মানে তুমি যদি নিজ থেকে না আসতে তাহলে আজকে রাতে তোমাকে এমনিতেই নিয়ে আসা হত এখানে?
-কেন?
-কেন? হাহাহা ! কী অদ্ভুত তুমি জানোই না কেন!

নীতুর মনে সেই ভয়টা আবার জেকে বসল। নীতু জানেই ওর সাথে কী হতে চলেছে।
ঋদ্ধ রায়হান নীতু ঠিক সামনের একটা কুপি রাখল । কুপির আগুণে গুহার ভেতরটা আরও যেন ভুতুড়ে হয়ে আসছে। ঋদ্ধ রায়হান বলল, তুমি জানো আমার প্রথম উপন্যাস ছাপার আগে আমি আরও ১০টা উপন্যাস লিখেছি। একটাও কোন প্রকাশক কোন ছাপে নি। আসলে আমিও জানি যে সেগুলো ছাপার যোগ্য ছিল না । তারপর হঠাৎ করেই আমি এতো ভাল লেখক হয়ে গেলম কিভাবে !!
নীতু কোন কথা বলল না।
-এরজন্য আমাকে কী করতে হয়েছে জানো? জানো জানো ! ….. বলি দিয়ে হয়েছে ! মানুষের বলি !
নীতুর মনে হল সে ভুল শুনল ।
-এই দেখছো না!!
ঋদ্ধ রায়হান মূর্তিটার দিকে ইশারা করল ।
-অপদেবতা চিতংবুড়া !! আমি যত মানুষ বলি দিই তত আমার লেখা উন্নত হয় !!! এবার বই মেলায় আমার লেখা আবার বেস্ট সেলার হবে !! থ্যাংঙ্কস টু ইউ ! তুমি যদি না আসতে এখানে তাহলে আমার এতো উপকার হত না। আদিবাসিদের মেয়ে ধরে আনা বেশ কষ্টের । ঝামেলারও বটে ! তবে তোমার মত বোকা মেয়ে পাওয়া যায় প্রায়। নিজের চাকরি বাঁচাতে কত কিছুই না করে তারা !
নীতুর চেহারায় তীব্র বিস্ময় দেখে ঋদ্ধ রায়হান হো হো হেসে ফেলল । তারপর বলল, হ্যা ঠিকই ধরেছ , তোমার পত্রিকার সম্পাদক তোমাকে এখানে ইচ্ছে করেই পাঠিয়েছে। আমার সামনের ৫টা বই তার প্রকাশনা থেকে বের হবে এই শর্তে !
নীতুর যেন কথাটা একেবারে বিশ্বাস হল না । বারবার মনে হল এটা হতে পারে না । কোন ভাবেই হতে পারে না !

আগের পর্বপরের পর্ব

ফেসবুকের অর্গানিক রিচ কমে যাওয়ার কারনে অনেক পোস্ট সবার হোম পেইজে যাচ্ছে না। সরাসরি গল্পের লিংক পেতে আমার হোয়াটসএপ বা টেলিগ্রামে যুক্ত হতে পারেন। এছাড়া যাদের এসব নেই তারা ফেসবুক ব্রডকাস্ট চ্যানেলেও জয়েন হতে পারেন।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.8 / 5. Vote count: 17

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →