তৃষা আমার দিকে বেশ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে । আমার মুখ থেকেই কথাটা শুনতে চাচ্ছে । একটু যেন ও মজাও পাচ্ছে । আমার কাছে অবশ্য ব্যাপারটা বেশ বিরক্ত লাগছে । কিন্তু তৃষাকে কে বোঝাবে ! আমি বললাম, তোমার ঐ বন্ধু আমার প্রেমে পড়েছে কি না, জানি না । তবে সে আমাকে ইম্প্রেস করার চেষ্টা করছে । এই টুকু আমি নিশ্চিত ভাবেই বলতে পারি । কিন্তু আমি ঠিক বুঝতে পারছি না যে ও আমার পছন্দের ব্যাপার গুলো কিভাবে জেনে যাচ্ছে? তুমি বলছো না তো ?
তৃষা নিজের জিহ্বাতে কামড় দিয়ে বলল, আমি কেন নিজের পায়ে কুড়াল মারবো বল ? আমি ওকে কিছুই বলি নি ।
-তাহলে জেনে যাচ্ছে কিভাবে ?
-একটা ব্যাপার অবশ্য আছে !
-কি ?
তৃষা কিছুটা সময় নিজের ভেতরেই কি যেন ভাবলো । তারপর বলল
-ছোট থেকেই আমি জেরিনের সাথে বড় হয়েছি তো একটা ব্যাপার জানি যে ও কিভাবে যেন ছেলেদের খুব সহজেই আয়ত্ত্বে নিয়ে নিতে পারে । কয়েকবার তো এমনও দেখেছি অন্যের প্রেমিকেও ছিনতাই করে নিয়েছে । তবে ও আমার খুব কাছের বন্ধু । ও তোমার সাথে এমন কিছু করবে না ।
আমি বললাম, তুমি রাগ কর আর যাই কর, তোমাকে একটা কথা না বলে আমি পারছি না ।
-কি ?
-তোমার এই বন্ধুর মধ্যে কিছু অস্বাভাবিকতা আছে । দেখলেই বোঝা যায় ! আমার ঠিক পছন্দ না ।
আমি ভেবেছিলাম আমার এই কথা শোনার পরপরই তৃষা রেগে উঠবে কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম ও সেরকম কোন আচরন করলো না । বরং খানিকটা সময় চুপ করে থেকে বলল
-আমি মানছি ওর ভেতরে কিছু অস্বাভাবিকতা আছে । যখন আমেরিকাতে ছিলাম, অনেককে বলতে শুনেছি, অনেকের ধারনা ছিল যে ও আসলে ব্ল্যাক ম্যাজিক প্রাক্টিস করে ! দেখবা ওর গলাতে একটা ক্রস ঝুলানো আছে । উল্টো ক্রস । ওখানে যারা শয়তানের উপাসনা করে তারা সবাই এমনটা করে ।
আমার বিরক্তি আরও খানিকটা বাড়লো । আমি বললাম
-আর তুমি আমাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই মেয়ের সামনে নিয়ে আসছো ? বাহ !
তৃষা এই প্রশ্নের উত্তর দিল না । আমার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময় । বলল
-আরে বাবা এমন কেন কর ! ও তো আমাদের কিছু করছে না । ছোটবেলার পুরোটা সময় আমি ওর সাথে কাটিয়েছি । ওকে আমি চিনি ভাল করে । আচ্ছা বাদ দাও । আমাকে আগে বল তোমার কেন মনে হচ্ছে যে জেরিন তোমাকে ইম্প্রেস করার চেষ্টা করছে ?
-আমি তোমাকে বলি, আমি ঠিক যে যে জিনিস গুলো পছন্দ করি তোমার ঐ ফ্রেন্ড ঠিক সে সে কাজ গুলোই করছে। আজকে তো সে আসছে দেখবা সে আমার পছন্দের পোশাক পরে আসবে।
তৃষা খুব ভাল করেই জানে আমার পছন্দের পোশাক কি । আমি আবার বললাম
-দেখবা সেটা পরেই আসবে । আমি জানি না সে কিভাবে এতো কিছু জেনে যাচ্ছে তবে সে এমন সব কাজ করছে যেটা আমি পছন্দ করি !
আমি আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলাম ঠিক এই সময়ে গাড়ির হর্ণের আওয়াজ শুনতে পেলাম । দুজনেই তাকিয়ে দেখি জেরিনের লাল রঙয়ের গাড়িটা গেট দিয়ে ঢুকছে। গাড়িটা থেমে যেতেই জেরিনকে বের হতে দেখলাম। জেরিন বের হতেই তৃষা আমাকে ছেড়ে দিল । তারপর আমার দিকে তাকালো। ওর চোখে আমার জন্য বাহবাহ দেওয়ার ভঙ্গি দেখতে পেলাম। কারন আমার ধারনা সত্যি হয়েছে ।
জেরিন আজকে সত্যি সত্যি সাদা কামিজ পরে এসেছে সেই সাথে সাদা ল্যাগিংস। হাতে দেখা যাচ্ছে গাঢ় করে মেহেদি দিয়েছে। সেই চোখে কাজল দেওয়া। সব আমার পছন্দের। আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে জেরিন হাসি দিল । সাথে সাথেই আমার মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করে উঠলো । আমার মনের ভেতরে কে যেন বলে উঠলো, দেখো এই মেয়েটা কি চমৎকার !
জেরিন তখনও আমাদের দিকে তাকিয়ে বলছে হাসছেই । আমার মাথার ভেতরে আবারও সেই একই কথা কেউ বলে উঠলো । আমি খানিকটা অবাক হলাম । এমনটা হওয়ার কথা না মোটেই ।
তৃষার সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকে আমার এখনও পর্যন্ত অন্য কোন মেয়ের দিকে সেই দৃষ্টিতে তাকাই নি । আরও ভাল করে বললে তাকাতে পারি নি । তাহলে ? আমার মনে এই কথা কেন মনে হচ্ছে ?
তখনই জেরিনের গলার উল্টো ক্রসের দিকে আমার চোখ গেল । আচ্ছা তৃষা আমাকে যা বলল তা সত্যি হতে পারে ? সত্যিই কি জেরিনের হাত থাকতে পারে ? আমার মাথায় অন্য চিন্তা এসে ভর করতে লাগলো । এই মেয়ের থেকে সাবধান থাকতে হবে ।
জেরিন আমাদের কাছে এসে হাসি দিল আমাদের দুজনেত দিকে তাকিয়ে। তারপর বলল
-তো রেডি? চল যাওয়া যাক ।
এই জন্যই আজকে আমরা এখানে এসেছি। আজকে আমাদের তিনজনের বাইরে যাওয়ার কথা। যদিও আমার যাওয়ার কোন ইচ্ছে নেই। কিন্তু তৃষার জন্য আমাকে আসতে হল। তৃষা আমাকে কিছু বললে সেটা আমাকে করতেই হয়। কোন ভাবেই সেটা মানা করার উপায় নেই।
জেরিন দেশে এসেছে খুব বেশি দিন হয় নি । আর কদিন পরেই সে আবার চলে যাবে । এই কদিনে সে ঘুরাঘুরি করে কাটাতে চাচ্ছে । তৃষার সাথে ওর পরিচয় সেই আমেরিকা থেকেই । এখানে এসে তাই তৃষা ওকে ঘুরাঘুরিতে সাহায্য করছে । সেই হিসাবে ওদের সাথে মাঝে মাঝে আমাকেও আসতে হচ্ছে । আজকে যেমন হয়েছে । আজকে তৃষাদের ফার্ম হাউজে একটা বারবিকিউ করার প্লান করা হয়েছে। সেখানে যাওয়ার জন্য আমাদের এখানে আসা !
আমার দিকে চোখ পড়তেই জেরিন হাসল। তারপর বলল, কি ব্যাপার অপুর মুখ বেজার কেন ?
তৃষা বলল, আর বলিস না । সকালে ঘুম থেকে উঠতে হয়েছে না ? মেজাজ তো খারাপ থাকবেই৷ মাঝে মাঝে আমার মনে হয় আমার থেকে ওর ঘুমটাই বেশি প্রিয় ।
আমি কিছু বলতে গিয়েও বললাম না । জেরিন বলল, আচ্ছা ঠিক আছে চল তো । অপুর মন ভাল করে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি ।
জেরিনের মুখের হাসিটা সত্যিই সুন্দর কিন্তু আমার কেন জান পছন্দ হল না । ওকে প্রথম থেকেই আমার ঠিক পছন্দ হয় নি । নিজের মনের ভেতরের কেউ যেন বলছে এই মেয়ের কাছে যাওয়া যাবে না । এর থেকে একটু দুরে দুরে থাকতে হবে । কিন্তু পরিস্থিতি এমন ভাবে যে আমাকে বারবার ঐ মেয়ের আশে পাশেই যেতে হচ্ছে ।
আমরা যখনই বের হতে যাবো তখনই তৃষার ফোনে ফোন এসে হাজির । অবশ্য তৃষার ফোনে সব সময় ফোন আসতেই থাকে । কিন্তু এই ফোন পেয়েই দেখলাম ওর মুখটা কালো হয়ে গেল । বারবার বলতে লাগলো, কি এখনই , না না ।
তৃষা আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, শোন ড্যাড ফোন দিয়েছে । এখনও আমাকে যেতে হবে । আমি না গেলে হবে না ।
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, শুনো আমাকে এখন যেতেই হবে । তবে আমার কারনে তোমাদের যাওয়া বন্ধ করতে হবে না ।
আমি চিৎকার করে বলে চেষ্টা করলাম যে আমি এই মেয়ের সাথে যাবো না কিন্তু তৃষার জন্য সে কথা বলা হল না । তৃষা বলল, তুমি জেরিনের সাথে যাও । আমার কাজটা শেষ করতে বিকেল হবে । তারপরই আমি তোমাদের সাথে জয়েন করবো । ঠিক আছে ?
আমি একবার বলতে চেষ্টা করলাম যে আমরা বরং তখনই যাই কিন্তু তৃষা সেটাও শুনলো না । ও অবশ্য শুনবেও না । ওর মনে একবার যা আসবে সেটাই করবে । কেউ ওকে বাঁধা দিতে পারবে না । আমি তো পারবোই না । তাই বাধ্য হয়ে বের হতেই হল । যাওয়ার আগে আমাকে তৃষা বারবার করে বলে দিল যে আমি যেন কোন ভাবেই যেন আমি জেরিনের সাথে অসামাজিক আচরন না করি । ওর সাথে ঠিকঠাক মত কথা বলি । কয়েক ঘন্টার ভেতরেই ও আমাদের সাথে জয়েন করবে ।
সত্যিই বলতে কি যখন আমি জেরিনের সাথে রওনা দিলাম তখনও আমার ভাল লাগছিলো না । বার বার মনে হচ্ছিলো জেরিনের সাথে এই মেয়ের সাথে যাওয়া মোটেই ঠিক হচ্ছে না । রাওয়ানা দেওয়ার সাথে সাথে আমার ধারনা আরও মজবুত হতে শুরু করলো যে এই মেয়ে আসলেই আমাকে ইম্প্রেস করার চেষ্টা করেই যাচ্ছে । আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, মেহেদীর ডিজাইন কেমন হয়েছে বল তো ?
আমি আগেই সেটা লক্ষ্য করেছি । বললাম, ভাল হয়েছে ।
-আর আমাকে কেন লাগছে ? সুন্দর না ?
-তুমি এমনিতেই সুন্দর ।
-অনেক সুন্দর ?
-হ্যা ।
-তৃষার থেকেও ?
এবার আমি ওর চোখের দিকে তাকালাম । তখনই অস্বাভাবিক ব্যাপারটা ধরতে পারলাম । জেরিনের চোখের মনির রং নীল । কিন্তু একটু আগেও সেটা কালো ছিল । আমাকে অবাক হতে দেখে জেরিন বলল
-কই বললে না ?
-তুমি তৃষার থেকে বেশি সুন্দর কি কম সুন্দর সেটা আমি জানি না তবে আমার কাছে তৃষার সুন্দরী আর কেউ নেই । কেউ না !
শেষের “কেউ না” শব্দ দুটো একটু জোর দিয়ে বললাম । জেরিনের চোখ দেখে আমি একটু বিদ্রুপের হাসি দেখতে পেলাম । মনে হল আমার এই কথাটাকে ও মোটেই পছন্দ করলো না । তবে মুখে কিছু বলল না । আমার গলার দিকে তাকাতেই বলল, গলায় চেইন পরেছো দেখছি । লকেট টা কিন্তু চমৎকার !
আমি বললাম, আমার চেইন পরতে ভাল লাগে না । এটা পরতে হয়েছে তৃষার জন্য । এটা আসলে ওরই চেইন । আমাকে বাধ্য করেছে গলায় পরতে ।
কথাটা সত্যি । তৃষা আমাকে নিয়ে এতো পরিমান চিন্তিত থাকে সব সময় আমি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই । আমার সকালের ঘুম থেকে রতের ঘুম পর্যন্ত সব কিছুর ব্যাপারে তার তীক্ষ নজর । একটু এদিক ওদিক হলে প্রথমে চলবে বকা ঝাকা তারপর বইবে কান্নার জোয়ার । এবং এই দুই ঝড়ই আমাকে সহ্য করতে হবে নিরবে । একটা কথা বলার কোন উপায় নেই । কথা বলা মানে হচ্ছে ঝড় দীর্ঘস্থায়ী করা ।
আমি তৃষাকে মিস করতেই থাকলাম । ও সাথে এলে সব থেকে ভাল হত । তবুও আমি জেরিনের সাথে একটু স্বাভাবিক ভাবে কথা বলার চেষ্টা করলাম । কিন্তু পুরো রাস্তা জুড়েই আমার মনে হল জেরিন মেয়েটার মাঝে কিছু একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার আছে । কিন্তু আমি সেটা ধরতে পারছি না ।
ফার্ম হাউজে গিয়েও ব্যাপারটা কমলো না বরং বাড়লো । বিকেল বেলার দিকে শুরু হল আরেক ঝামেলা । আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি এসে হাজির। বৃষ্টি হলেই তৃষা বৃষ্টিতে ভেজার জন্য জেদ ধরে । ঠিক একই কাজটা জেরিন করলো । আমাকে বারবার জোর করতে লাগলো বৃষ্টিতে ভেজার জন্য । আমার বৃষ্টিতে ভেজার কোন ইচ্ছেই নেই । একটা পর্যায়ে ও আমাকে এক প্রকার জোর করেই বৃষ্টির মধ্যে টেনে নিতে চাইলো । আমার মনে হল যে এবার একটু শক্ত আচরন করা দরকার । তৃষা আমাকে বলে দিয়েছিলো যে আমি যেন সামাজিক থাকি কিন্তু এবার আমার পক্ষে আর সহ্য করা সম্ভব হল। কঠিন গলাতে বললাম
-তুমি আমার সাথে এমন কে করছো আমি বুঝতে পারছি না । আসলেই পারছি না । তুমি যেখানে জানো তৃষার সাথে আমার বিয়ে হওয়ার কথা বার্তা একেবারে পাকা হয়ে আছে !
জেরিন আমার কন্ঠে শুনে বিন্দু মাত্র লজ্জিত না হয়ে বলল, তুমি বুঝতে পারছো না আমি কি চাই? দেখ তৃষা এখানে নেই আর এখানে তোমার সাথে আমার কি হবে সেটা সে কোন দিন জানবেও না ।
আমি কিছুটা সময় জেরিনের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম । সেই অবাক হওয়ার ভাবটা এবার বিরক্তিতে রূপান্তরিত হল । আমি বললাম
-আমি জানবো !
-ওয়েল, সেটা না হয় জানলে কিন্তু আমার দিকে তাকিয়ে দেখো একবার !
এই বলে নিজের দেহটার দিকে নির্দেশ করলো । তারপর বলল
-এই আমাকে কোন ছেলে আজ পর্যন্ত এড়িয়ে যেতে পারে নি । ভাল করে দেখ এদিকে । সত্যিই বলছি তৃষা কোন দিনও জানবেনা !
তারপর আমার দিকে আরেকটু এগিয়ে আসতেই আমার মেজাজটা আরেকটু খারাপ হল । জেরিন আমার হাত ধরে ফেলল । আমি আমার সব বাঁধ ভেঙ্গে ফেললাম । তারপরই যা করতে চাই নি তাই করলাম । কষে একটা চড় বসালাম ওর গালে । চড় খেয়ে ও যতটা না ব্যাথা পেল তার থেকে অবাক হয়ে তাকালো আমার দিকে । ও যেন এখনও ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না । আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম
-আমার আসলেই এখানে আসা ঠিক হয় নি । তোমার মত মেয়ের সাথে তো নয়ই ।
এবার জেরিনের কন্ঠে আমি হিংস্রতা দেখতে পেলাম । ও সাপের মত হিস হিস করে বলল
-অপু কাজ টা তুমি ভাল করলে না । এখনও সময় আছে । আমি নয়তো তৃষাকে বলবো তুমি আমার সাথ জোর জবরদস্তি করার চেষ্টা করেছো ?
-তাই ? এখনই বল ! প্লিজ বল । তৃষা তোমার মত মেয়ের কথা বিশ্বাস করবে না ।
-তুমি আমাকে অপমান করছো ?
-করা কি উচিৎ নয় ?
-তুমি …
এই বলে ও আরেকবার আমার দিকে এগিয়ে আসতে গেলেই আমি আবারও ওকে একটা ধাক্কা দিলাম । তারপর বলল, কাছে আসলে এবার ফল ভাল হবে না । সত্যিই বলছি ।
জেরিন চিৎকার করে বলল, অপু !
ঠিক সেই সময়ে আম তৃষার আওয়াজ শুনতে পেলাম । ওর চেহারা দেখেই আমি খানিকটা অবাক হলাম । তৃষা খানিকটা রেগে আছে । জেরিনের দিকে তাকিয়ে বলল
-আমি তোকে আমার বন্ধু ভাবতাম । অপুকেও তুই ছাড়লি না ?
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-আমি ড্যাডের অফিসে গিয়ে দেখি ড্যাড সেখানে নেই । তাকে ফোন করার পরে সে যেন আকাশ থেকে পড়লো । বলল যে সে খুব ভাল করেই জানে যে আমি তোমাদের সাথে বের হব । তাই আমাকে নাকি ডাকার প্রশ্নই আসে না ।
-কি ?
-হ্যা । তখনই আমার মনে হল এখানে কোন ঝামেলা আছে । গাড়ি করে তখনই রওনা দিলাম । আসার পথে আমার গাড়ি দুইবার নষ্ট হয়েছে । আমি এখানে কিভাবে এসেছি সেটা কেবল আমি জানি ! কতবার ফোন দেওয়ার চেষ্টা করেছি লাভ হয় নি !
তৃষা এবার জেরিনের দিকে ফিরলো । তারপর বলল
-লোকে যে তোকে ডাইনি বলে আজকে তুই তাই প্রমান করলি । আমি যে তোর বন্ধু এটা তোর একবারো মনে হল না ? তুই এখনই আমার চোখের সামনে থেকে চলে যাবি, এখনই ।
আমি তৃষাকে খুব একটা রাগতে দেখি নি । ওর সব রাগ আমার আর ওর বাবার উপর । আমাদের উপর কথায় কথায় রাগ করে বটে সেটা মুহুর্তে আবার শেষও হয়ে যায় । কিন্তু এখন তৃষার কন্ঠে যে স্বরটা শোনা যাচ্ছে এটা আমি এর আগে শুনেছি কি না মনে করতে পারছি না !
জেরিন উঠে দাড়ালো । ওর চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হল ও রেগে গেছে । বিশেষ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো অগ্নি চোখে । তবে কিছু বলল না ।
দুই
তারপর দুটো দিন শান্তিমত কেটে গেছে । কোন ঝামেলা হয় নি । ঝামেলা বাঁধলো তিন নাম্বার দিনে । আমি অফিস থেকে ফেরার পথে হঠাৎ জেরিনকে দেখতে পেলাম । ঠিক আমাদের অফিসের উল্টো দিকে দাড়িয়ে আছে । আমার বুঝতে মোটেই কষ্ট হল না যে ও আমার জন্য অপেক্ষা করছে । আমরা কয়েক মুহুর্ত একে অন্যের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মাঝখান দিয়ে গাড়ি চলাচল করছে । জেরিন এগিয়ে এল না আমার দিকে । আমার তো ওর দিকে যাওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না । আমি জেরিনের দিকে তাকিয়ে আছি এমন সময় একটা মশা আমার গলার কাছে কামড় দিলো । আমি চট করে সেটা মারার চেষ্টা করলাম । কিন্তু বেটা পালিয়ে গেল । খানিকটা বিরক্ত লাগলো । চোখ আবারও চলে গেল সামনে ।
জেরিন তখনও সেখানে দাড়িয়ে আছে । তবে একটু পরেই একটা বড় বিআরটিসি বাস এসে থামলো আমাদের মাঝে । কিছু সময় পরে যাত্রী নিয়ে বাসটা ছেড়ে দিল । বাস চলে যেতে আমি জেরিনকে আর কোথাও দেখতে পেলাম না । তবে আমার কেন জানি মনে হল কিছু একটা করে গেছে ও । এই অনুভুতি হওয়ার কোন ব্যাখ্যা নেই তবে আমার মনের ভেতরে একটা সুক্ষ অস্বস্থি বোধ হতে লাগলো । তবে সেটা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করলাম । তৃষাকেও কিছু বললাম না । ও যদি জানতে পারে যে জেরিন আমার সামনে এসেছিলো তাহলে হয়তো খারাপ কিছু করে বসতে পারে ।
রাতের বেলা আমি ঘুমিয়ে রয়েছি । এমন সময় কিসের যেন আওয়াজে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল । আমি সব সময় ঘর একেবারে অন্ধকার করে ঘুমাই । সামান্য তম আলো থাকলেও আমার ঠিক মত ঘুম আসতে চায় না । এমন কি ইন্ডিকেটরের আলোটাও আমি কালো টেপ দিয়ে বন্ধ করে রেখেছি ।
যখন ঘুম ভাঙ্গলো তীব্র একটা কটু গন্ধে পুরো ঘরটা ছেঁয়ে আছে । এই গন্ধেই আমার ঘুম ভেঙ্গে গেছে । আমি চোখ মেলে কিছুটা সময় তাকিয়ে রইলাম অন্ধকারের দিকে । আমার সাধারনত এক ঘুমে রাত পার হয়ে যায় । ঘর অন্ধকারখয়ে আছে, এর অর্থ হচ্ছে এখনও ভোর হয় নি । আমি বুঝার চেষ্টা করলাম ঠিক কি কারনে আমার ঘুম ভাঙ্গলো । তারপরই আমার নাকে সেই কটু গন্ধ টা আসলো । গন্ধটা এতোই তীব্র যে মুহুর্তের মধ্যেই মনে হল আমার নিঃশ্বাসটা বন্ধ হয়ে আসছে ।
এই গন্ধটা কোথা থেকে আসছে ? আমি বালিশের পাশে রাখা মোবাইলটা হাটতে খুজতে লাগলাম । কিন্তু সেটা কোথাও পেলাম না । মোবাইলটা হাতে পেলে আলো জ্বালানো যেতে । আমি বিছানা ছেড়ে উঠতে যাবো ঠিক সেই সময়ে আমি ভয়ে জমে গেলাম । আমার স্পষ্ট মনে হল আমার রুমে আমি একা নই । আমার সাথে আরও কেউ আছে । আমি আমার খাটের চারিপাশে পা চেনে চলার একটা আওয়াজ পেলাম । আমার বুকের ভেতরে কেমন ধকধক করতে লাগলো ।
পাশের রুমে নোমান ভাই ঘুমিয়ে আছে । তাকে ডাক দিলে হয়তো তিনি উঠে চলে আসবে কিন্তু আমি ডাক দিতে পারলা না । খাটের চারিপাশে সেই জিনিসটার উপস্থিতিটা স্পষ্ট টের পাচ্ছি । সেটা যে পা টেনে টেনে চলতেছে সেই সাথে সাথে সেই কটু গন্ধটাও এদিক ওদিক নড়তেছে ।
আমার হাত তখনও মোবাইলটা খুজেই বেড়াচ্ছে । কিন্তু সেটা কোথাও পেলাম না । আমার মনে হল যে আজকেই আমার জীবনের শেষ রাত । এখনই এই জিনিসটা খাটের আশে পাশে হাটাহাটি বন্ধ করে দিবে তার পর আমার উপর ঝাপিয়ে পড়বে । আমার তৃষার মুখটা হঠাৎ করে খুব মনে পড়লো । তৃষার ভয়টা তাহলে অমূলক ছিল না । জেরিনের নামের ঐ ডাইনির সত্যিই কিছু ছেড়ে গিয়েছে আমার পেছনে । আমি উপরওয়ালার নাম করতে লাগলাম বারবার । চোখ বন্ধ করে যে যে সুরা জানি সেটাই পড়তে শুরু করলাম ।
কতটা সময় এভাবে ছিলাম জানি না তবে একটা সময়ে আযানের ধ্বনি কানে এল । এবং আমি অনুভব করলাম যে আমার ঘরে সেই কটু গন্ধটা আর নেই । ঘরে সামান্য আলোও ফুটেছে । বিছানা থেকে মানতেই পায়ের কাছে আমার মোবাইলটা পড়ে থাকতে দেখলাম । এটা এখানে কিভাবে পড়লো কিভাবে কে জানে । দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে এলাম । বাইরে তখন অন্ধকার । দুরে চোখ যেতে আমি একটা মানুষকে দেখতে পেলাম । মানুষটা লম্বায় খুব বেশি বড় হবে না । একটা পা টেনে হাটতেছে । আমি অনুভব করলাম যে আমার বুকের ভেতরে কেমন যেন একটা ভয়ের অনুভুতি হচ্ছে ।
তখনই তৃষাকে ফোন করে সব কিছু জানালাম । কথাটা শুনার পরে তৃষা বেশ কিছুটা সময় চুপ করে রইলো । তারপর বলল, তুমি ওখানেই থাকো । আমি গাড়ি পাঠাচ্ছি ।
আরও ঘন্টা খানেক পরে আমি তৃষাদের বাসায় এসে হাজির হলাম । এর আগেও আমি তৃষাদের বাসায় এসেছি কিন্তু আজকের অবস্থা অন্য যে কোন দিনের থেকে আলাদা । তৃষা আমার আসার জন্যই অপেক্ষা করছিলো । আমি আসতেই কিছু সময় আমাকে জড়িয়ে ধরে থাকলো । তারপর বলল, চল এক জায়গাতে যেতে হবে ।
আমি কোন প্রশ্ন করলাম না । ঢাকা ছেড়ে ওদের ফ্যাক্টরির দিকে বেশ কিছুটা সময় আমাদের গাড়ি চলল । পুরোটা সময় ও আমার হাত ধরে রেখেছিলো । এমন একটা ভাব যেন আমার হাত ছেড়ে দিলে আমি কোথাও হারিয়ে যাবো ।
আমি এর আগেও বেশ কয়েকবার এখানে এসেছি । ঢাকার কোলাহল এখানে নেই । মাঝে মাঝেই আমি আর তৃষা এদিকটাতে ঘুরতে হাসি । বিশেষ কোন কাজ করি না । কেবল হাটাহাটি করি । এদিক ওদিক বসে বসে গল্প করি । এদিকে একটা ছোট্র নদীর মত আছে । বর্ষাকালে বেশ পানি হয় । সেখানে তখন নৌকা চলে । আমরা একটা নৌকা ভাড়া করে ঘুরে বেড়াই তখন ।
আজকে অবশ্য সেদিকে গেলাম না । গ্রামের একেবারে শেষ মাথার গিয়ে হাজির হলাম । গাড়ি থেকে নামতেই বাড়িটা দেখতে পেলাম । এখানে গ্রামের বেশির ভাগ বাড়িই মাটি নয়তো টিনের তৈরি কিন্তু এই বাড়িটা একটু অন্য আদলে তৈরি । ঠিক যেন এই এলাকার সাথে যাচ্ছে না । তৃষা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এটা আমার প্রথম ন্যানির বাসা !
আমি বললাম, ন্যানী !
-হ্যা । আমেরিকাতে যখন ছিলাম তখন আমাকে দেখাশুনা করতো । এখন এখানেই থাকে । উনি এই সব ব্যাপারে বেশ কিছু জানেন । এখন আমাকে যা যা বলেছো তাই তাই বলবে তাকে ।
তৃষার ন্যানীর বয়স বেশ ভালই । তবে এখনও তিনি বেশ শক্ত সামর্থ্য আছেন । তৃষাকে দেখেই হাসি মুখে এগিয়ে এলেন । বুঝতে পারলাম যে এখানে তৃষার মাঝে মাঝেই আসা হয় যদিও আমার সাথে এই প্রথম বার এল ।
আমি আমার পুরো ঘটনা তৃষার ন্যানীর সামনে আবারও বললাম । তিনি জেরিনকে খুব ভাল করে চেনেন । কেবল জেরিনকেই নয় জেরিনের পুরো পরিবারকেও সে চেনে ভাল ভাবে । আমি যখন গন্ধের কথাটা বললাম তিনি চমকে উঠলেন । তারপর যখন সেদিন অফিস থেকে বের হয়ে জেরিনকে দেখেছিলাম সেই কথাটা বলতেই বললেন
-সেই সময়ে এমন কিছু কি হয়েছিলো ?
-না । তেমন কিছুই হয় নি । কেবল সে রাস্তার অন্য পাশে দাড়িয়ে ছিল । আর কিছু না ।
-আর কিছু না ?
আমি মনে করার চেষ্টা করলাম আর কি হয়েছিলো তখন !
কেবল জেরিন আমার দিকে তাকিয়েছিল । ওর মুখ খানিকটা হাসিহাসি ছিল । আর তখনই …
আমার কিছু একটা মনে পরলো । হ্যা মনে পরেছে । আমি বললাম
-হ্যা তখন একটা মশা আমাকে কামড়েছিলো ।
এবার আমি সত্যি সত্যি ন্যানীকে চমকে যেতে দেখলাম । তিনি কিচুটা সময় ঝিম মেরে বসে রইলো । তারপর ঘরের ভেতরে চলে গেল । ফিরে এল কিছু সময় পরেই । হাতে একটা পুরোনো বই নিয়ে । কয়েক পাতা উল্টে আমাদের দিকে বাড়িয়ে দিলেন । তারপর বলল
-ওটার নাম “ডাব্রো”।
আমরা দুজনেই এক সাথে বলে উঠলাম “ডাব্রো”
-হ্যা ডাব্রো । আমেরিকান ডাইনি বিদ্যায় এই জিনিস আছে । শত্রুকে মেরে ফেলার জন্য ব্যবহার করা হয় তবে উইচরা এটাকে খুব একটা ব্যবহার করে না । কারন এটা খুবই ভয়ংকর একটা প্রাণী । আর এটাকে এই পৃথিবীতে নিয়ে আসাও বেশ ঝামেলার ।
-কি রকম ?
-একে তো যে নিয়ে আসবে তাকে খুব বড় ডাইনি হতে হবে । মানে হচ্ছে তার ডাইনি বিদ্যা বেশ শক্তিশালী হতে হবে । যে কেউ চাইলেই এটা নিয়ে আসতে পারবে না । আর এটার টার্গেট ঠিক করতে হলে টার্গেটের শরীর রক্ত দরকার হয় । যেটা ম্যানেজ করা একটু কষ্ট করই ।
আমি তখনই বুঝতে পারলাম যে ন্যানী আমার মশার কামড় খাওয়ার কথা শুনে কেন চমকে উঠেছিলো । মশাটা আসলে আমাকে কামড় দিয়েছে আমার রক্ত সংগ্রহ করার জন্য । ন্যানী আবার বলল
-ওটাকে আটকানো খুব কঠিন একটা ব্যাপার । বলা যায় একেবারে অসম্ভব । একবার নিয়ে আসা হলে ওটা প্রাণ না নিয়ে ফিরবে না । যাকে মারতে হয় তার রক্ত এবং যে নিয়ে আসে তার রক্ত এক সাথে বসিয়ে ডেকে আনতে হয় । যদি কোন ভাবে টার্গেটকে মিস করে তাহলে তাহলে যে ডেকে নিয়ে এসেছে তার কাছে ফেরৎ যায় । তার জীবন নিয়ে তারপরই নিজের জগতে ফিরবে ওটা !
তৃষার মুখ দেখলাম শুকিয়ে গিয়েছে । ন্যানীর দিকে তাকিয়ে বলল
-কিছুই কি করার নেই ?
ন্যানী কিছু সময় তৃষার দিকে তাকিয়ে বলল, আমার হাতে আসলে কিছু নেই । আমার এই সব ব্যাপার জ্ঞান এই বই পড়েই যা । এর বেশি কিছু না । ডাব্রো কে একবার ছাড়া হলে সেটা তার কাজ করবেই । মাঝে তার কাজে যারাই বাঁধা দিবে তারাই মারা পড়বে কেবল । ডাব্রো মোট তিন বারে আসে । প্রথমবার কেবল দুর থেকে দেখে যায় । দ্বিতীয়বারে একেবারে কাছে চলে আসে । তারপর তৃতীয়বারে হামলা করে । দুই বার চলে এসেছে সে । এইবার শেষ বার !
তৃষা বলল
-ওকে যদি দুরে কোথাও পাঠিয়ে দেই ? যদি ওকে খুজেই না পায় !
-এটা কাজ হতে পারে । আমি যতদুর জানি যে সাত দিন ডাব্রোর স্পেলটা কাজ করে । এর মাঝে কোন ভাবে যদি ওকে ডাব্রোর কাছ থেকে দুরে রাখা যায় তাহলে কাজ হতেও পারে ।
তৃষা আমাকে নিয়ে উঠে দাড়ালো । আমাকে নিয়ে বের হতে যাবে তখন ন্যানী আবার বলল, ডাব্রোর একটাই কেবল নাজুক দিক আছে । ও একট আপা খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাটে । ঐ পা টাই সব থেকে বড় দুর্বলতা ।
তৃষা আরেকবার ন্যানীকে জড়িয়ে ধরলো । তারপর বেরিয়ে এল বাড়ি থেকে ।
আমি যখন গাড়িতে উঠতে যাবো তখন ন্যানীর দিকে চোখে পড়লো আমার । তার চোখের দৃষ্টি দেখে আমার কেন জানি মনে হল তিনি আমার দিকে খুব বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন । যেন খুব খারাপ কিছু হতে চলেছে ।
তিন
বাসায় ফিরে ও আমাকে নিয়ে ওদের ফার্ম হাউজের দিকে রওনা দিল । সেখানে পৌছে কেয়ার টেকারকে বলে কিছু শক্ত সমর্থ মানুষ নিয়ে বাড়ি পাহারা দিতে । তার অনুমুতি ছাড়া আর কেউ যেন বাসার ভেতরে না ঢুকতে পারে । তারপর আমাকে নিয়ে একটা ঘরে বসে রইলো চুপ করে । আমার যে ভয় করছিলো না সেটা আমি বলব না তবে আমার বেশি চিন্তা লাগছিলো তৃষার জন্য । মেয়েটার মাথা ঠিক মত কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে । ও এখন নিজেই জানে না কি করবে!
আমি ওকে বুকের ভেতরে জড়িয়ে ধরে বসে রইলাম । যদি ন্যানির কথা সত্যিই ঠিক হয়ে থাকে তাহলে ডাব্রো কেবল আসবে আমাকে ধরার জন্য । আমাকেই ওর দরকার । যদি তৃষা আমার তার তার পথে আসে তাহলে তৃষার ক্ষতি হবে । সেটা আমি কোন ভাবেই হতে দিতে পারি না ।
তৃষার রাতে এমনিতে ঘুমের সমস্যা আছে বলে ওর ব্যাগের ভেতরে সব সময়ই ঘুমের ঔষধ থাকে । সেটা থেকে দুটো ঘুমের ঔষধ নিয়ে ওর পানিতে মিশিয়ে দিলাম । তারপর ওটা রাতে খাওয়ার সময় ওকে খাইয়ে দিলাম । ও একটু ঘুমাক । রাতে যদি সত্যিই যদি ডাব্রো চলে আসে তাহলে তার সাথে কেবল আমার মোবাবেলা হবে । আর কারো না ।
রাতের খাওয়ার পরে যখন তৃষার ঘুম ঘুম ভাব আস্তে লাগলো ওকে আমি শোবার ঘরে নিয়ে গেলাম । তারপর বিছানায় শুইয়ে দিলাম । ও শুয়ে শুয়ে আমাকে নানান কথা বলতে লাগলো । কিছু সময় পরেই ওর কন্ঠ ভারি হয়ে গেল । একটা সময়ে ঘুমিয়ে পড়লো । আমি তারপরও ওর পাশেই বসে রইলাম । মনে হল যেন ওকে আর হয়তো দেখা হবে না । একটু ভাল করে দেখে নেই ।
কত সময় ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম আমি বলতে পারবো না হঠাৎ বাইরে একটা চিৎকার শুনে আমি বাস্তবে ফিরে এলাম । তাহলে কি চলেই এল ডাব্রো ! আমি তৃষার কপালে একটু চুমু খেয়ে উঠে পড়লাম । তারপর দরজাটা বন্ধ করে বাইরে বের হয়ে এলাম । বাইরে ততক্ষণে চিৎকার চেঁচামিচি বেড়েই চলেছে । তারপর যেমন করে হঠাৎ করেই শুরু হয়েছিলো তেমন করেই শান্ত হয়ে গেল ।
আমি বুকে বড় একটা নিঃশ্বাস নিলাম । বুকের ভেতরে টিপটিপ করতে লাগলো । যতই নিজের মনকে বুঝাতে চেষ্টা করলাম কোন কাজ হল না । ভয় আমাকে পেয়ে বসলো । আমি কিছুতেই নিজেকে বোঝাতে পারলাম না । তীব্র একটা ইচ্ছে হল দৌড় দেই কিন্তু দৌড় দেব কোথায় । আমি যেখানেই যাই না কেন ওটা আমার কাছে চলে আসবেই ।
তারপরেই আমি সেই তীব্র কটু গন্ধটা পেলাম । মনে হল ঘরের ভেতরেই সে আছে । যে কোন স্থানে । কোথায় আছে ?
আমাকে খুজতে হল না । ডান দিকে তাকাতেই তাকে দেখতে পেলাম । গতদিন আমি দুর থেকে দেখেছিলাম । আজকে সেটাকে কাছ থেকে দেখতে পেলাম । লম্বায় খুব বেশি হলে তিন ফুট হবে । সার্কাসের ক্লাউনের মত খানিকটা তবে মুখটা খানিকটা বাদুরের মত । মাথার উপরে আবার একটা শিং আছে । ঠিক কপালের মাঝে । আমার দিকে তাকিয়ে আছে স্থির চোখে । আমার মনে হল ওটা একটু একটু হাসছে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে ।
আমার একটু আগে যতটা ভয় লাগছিলো এখন কেন ততখানি ভয় লাগছে না । চোখের সামনে এই শয়তানকে দেখে আমার ভয় অনেকটাই কমে গেছে । ডাব্রো আমার দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করলো । সেই বাঁ পা একটু টেনে । আমি পকেট থেকে রিভালবার বের করলাম । তাক করলাম ডাব্রোর দিকে । তারপর পরপর তিবার গুলি করলাম কিন্তু কোন কাজ হল না । মনে হল গুলি তিনটা কেবল একটা বস্তায় ভেতরে গিয়ে লাগলো । সেটা তখনও এগিয়েই আসছে আমার দিকে । আমি আস্তে আস্তে পেছাতে লাগলাম । তখনই আমার মনে হল ন্যানীর। ডাব্রোর নাজুক দিক হচ্ছে ওর বাঁ পা । আমি এবার গুলি করলাম ওর বাঁ পা লক্ষ্য করে । প্রথমটা মিস করলেও পরের দুটো গুলি ঠিকই সেখানে লাগলো ।
মনে হল কাজ হল । কারন তীব্র একটা হুংকার বের হয়ে এল ডাব্রোর গলা থেকে । ওর বাঁ পা থেকে এবার কালো তরল জাতীয় কিছু বের হতে লাগলো । পুরো ঘরে সেই কটু গন্ধটা যেন আরও একটু বেড়ে গেল । আমি আবারও আরেকটা গুলি করতে যাবো কিন্তু আর সুযোগ পেলাম না । ডাব্রো একটা লাফ দিয়ে একেবারে আমার কাছে চলে এল । তারপর একটা ধাক্কা দিল আমাকে । আমি যেন উড়ে গিয়ে পড়লাম । পেছনের দেওয়ালে গিয়ে ধাক্কা খেলাম একটা । আমার কেবল মনে হল আমার বুক আর পাজরের সব হাড় ভেঙ্গে গেছে । আমি আর উঠতে পারলাম না । মেঝেই পড়ে রইলাম কিছুটা সময় । চোখের সামনে দেখলাম সেটা ধীরে ধীরে আমার দিকে এগিয়ে এল । তারপর ওর ডান পা টা আমার বুকের উপর তুলে দিল ।
আমার মনে হল আমার বুকের উপর ১০০ মন ওজনের একটা পাথর চাপা দিয়েছে কেউ । আমার দম বন্ধ হয়ে এল । মনে হল আর আমি বাঁচবো না । এটাই আমার শেষ সময় । তৃষার মুখটা দেখতে ইচ্ছে হল কেন জানি খুব । কি আশ্চর্য লাগলো নিজের কাছে । এই মেয়েটার জীবনের সাথে এমন ভাবে জড়িয়ে গেছে যে এই শেষ মুহুর্তে এসেও আমার কেবল ওকেই দেখতে ইচ্ছে করছে । আমার দৃষ্টি ঝাপছা হয়ে এল ।
আমার প্রাণ বায়ুটা এখনই বের যাবে এমন একটা সময় আমার বুকের ওপর থেকে চাপ করে এল । আমি ঝাপচা চোখ নিয়ে তাকিয়ে দেখলাম দুইয়া অয়বয় । ছোট অয়বয়টা যে এই নরকের জীবটার বুঝতে কষ্ট হল না । কিন্তু লম্বা অয়বয়টা কার ?
তৃষা !
ও কিভাবে এল ?
ওকে না ঘুম বাড়িয়ে এসেছিলাম । আরও কয়েক মুহুর্ত পরে আমার চোখের ঝাপসা ভাবটা পুরো পুরি কেটে এল । আমি কেবল দেখলাম তৃষার হাতে তলোয়ার জাতীয় কিছু রয়েছে । সেটা দুই হাত ধরে সে ঐ ডাব্রোর বাঁ পা লক্ষ্য করে কোপ দিল । এবং পা টা আলাদা হয়ে গেল সাথে সাথেই । অমানসিক চিৎকার বের হয়ে এল প্রাণীটার মুখ দিয়ে । কিছুটা যেন পিছিয়ে গেল । তৃষা ততক্ষণে আমার কাছে চলে এসেছে । আমাকে আড়াল করে দাড়িয়েছে । ঐ প্রাণীটার উদ্দেশ্য করেই তীব্র কন্ঠে বলল
-আমার প্রাণ থাকতে তুই ওকে কিছু করতে পারবি না । কিচ্ছু না ! আর দেখি তোর কত বড় সাহস !
আমার চিন্তা ভাবনা তখন পুরোপুরি ফিরে এসেছে । আমি কেবল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম তৃষার দিকে । ওর এই অগ্ন মুর্তি আমি কোন দিন দেখিনি । ও একটা মশাকেও মারতে পারে না । ওর শরীরে মশা বসলে ও সেটা না মেরে তাড়িয়ে দেয় । এই মেয়ে কিনা এই তলোয়ার দিয়ে এই ডাব্রোটার পা আলাদা করে ফেলেছে ।
ঘরে নিরবতা নেমে এল । ডাব্রো তখনও মেঝেই পড়ে আছে । তারপর ওটা উঠে দাড়ালো । তৃষা আবারও ওটাকে কোপ মারতে প্রস্তুতি নিলো তবে আমি আর তৃষা দুজনেই অবাক হয়ে দেখলাম ওটা আর হামলা করলো না । আস্তে আস্তে পিছু হাটলো ।
যখন মনে হল ওটা চলে গেছে তখন তৃষা আমার দিকে তাকালো । তারপর হাতের তোলয়ার টা ফেলে দিল । ওটা ওর এই ফার্ম হাউজের দেওয়া ছিল । তৃষার বাবা সেট করেছিল । তৃষা আমার দিকে এগিয়ে এসে সোজা আমার গালে একটা চড় মারলো । তারপর বলল
-সব কিছু একা একা কেন করতে যাও ! যদি আজকে তোমার কিছু হয়ে যেট তাহলে তোমাকে আমি খুন করে ফেলতাম !
আমি মোটেই রাগ করলাম না । বরং হাসলাম । বলল
-তুমি থাকতে আমার কিছু হতে পারো বল ?
-চুপ । ঢং করবা না । একটা থাপ্পড় লাগাবো ।
-একটা তো দিয়েছোই ।
-আরেকটা দিব !
তৃষা আমাকে শক্ত করেই জড়িয়ে ধরলো ! যেন আমাকে কিছুতেই ছাড়বে না !
পরিশিষ্টঃ
দুইদিন পর তৃষার কাছে দুইজন পুলিশ অফিসার এসে হাজির । তার বক্তব্য হল তারা ঢাকার একটা ফ্ল্যাট থেকে একটা মেয়ের লাশ উদ্ধার করেছে । মেয়েটাকে শ্বাস রোধ করে মেরে ফেলা হয়েছে । মেয়েটার ফোন থেকে তৃষার নাম্বার পাওয়া গেছে । মেয়েটা আমেরিকান অধিবাসী !
পুলিশ আরও জানালো যে ঘর দরজা সব ভেতর থেকে বন্ধ ছিল । এপার্টমেন্টের সিসিটিভি ফুটেজেও কাউকে দেখা যায় নি । কিভাবে খুনটা হয়েছে তারা কিছুইতেই বুঝতে পারছে না ।
পুলিশ চলে যেতেই তৃষা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ভাগ্য ভাল ডাব্রো ওর কাজ করে দিয়েছে । নয়তো আমি ঐ ডাইনিকে মেরে ফেলতাম । সত্যিই মেরে ফেলতাম !
আমি তৃষার দিকে তাকিয়ে হাসলাম । ওর কথা সত্যিই বিশ্বাস হল । যদি জেরিনকে ঐ ডাব্রো না মেরে ফেলতো তৃষা নিশ্চিত কিছু করে ফেলতো । যাক আপাতত সে সব ঝামেলা যে হচ্ছে না এটাই বড় কথা !
(সমাপ্ত)
বেতাল অবলম্বনে
আহা! অসাধারণ লেখা।
ধন্যবাদ