আসল খুনী কে (শেষ পর্ব)

oputanvir
4.4
(15)

দুপুর থেকেই আজকে বৃষ্টি হচ্ছে। ঢাকা শহরের এমন অনেক এলাকাই রয়েছে সেখানে একটু বৃষ্টি হলেই পানিই জমে যায়। এএসপি জাহিদ অনিকের বাসাটা উচু স্থানে হলেও তার থানাটা পরেছে একেবারে এমন নিচু জায়গায় । একটু বৃষ্টি হলেই ওর থানার সামনে একেবারে পানি জমে একাকার হয়ে যায় । তখন থানা থেকে বের হতে সমস্যা হয় । আজকে যখন দুপুরে ঝুম বৃষ্টি নামল তখনই মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিল যে একটু পরেই থানা থেকে সে বের হয়ে যাবে। পেট্রোলিংয়ের নাম করে আর আজকে থানাতে আসবে না। কিন্তু সেই আশাতে গুড়েবালি দেখা দিল।
ওর থানার আন্ডারে বেশ কয়েকটা মধ্যম মানের আবাসিক হোটেল রয়েছে। সেই হোটেলগুলোর একটা থেকে ফোন এসে হাজির হল। একটা ঘরে লাস পাওয়া গেছে। বাধ্য হয়েই অনিক সেই হোটেলে গিয়ে হাজির হতে হল। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল তবে সেটা জটিল কিছু না। অটোমেটিক লক । দরজা বন্ধ হলে এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে ।
অনিক আসার আগেই এসআই এসে হাজির হয়েছিল। সে সব খোজ খবর এরই ভেতরে বের করে ফেলেছে। ফরেন্সিক টিমও এসে হাজির হয়েছে। প্রাথমিক ভাবে ধারণা করা হচ্ছে যে সিরিঞ্জ দিয়ে গলার কাছে কিছু ফোটানো হয়েছে । গলার কাছে সেই দাগ দেখা যাচ্ছে । অনিক খুব বেশি চিন্তা করল না । এস আই নিজেই সব সামলাতে পারবে। অনিকের এখন বের হতে মনে চাইছে এখান থেকে।
এসআইকে দায়িত্ব দিয়ে অনিক বের হয়ে এল হোটেল থেকে । বৃষ্টি থেমে গিয়েছে । তাই আর গাড়ি নিল না । ড্রাইভারকে বলল যে বাকিটা পথ সে নিজেই যাবে। আজকে সোনিয়ার সাথে দেখা করার কথা আছে। মেয়েটাকে এই হোটেলে ডাকলেই খুব সহজেই বের হয়ে যেত খুনি কে তবে যদি এতো সহজে সব কাজ হয়ে যায় তাহলে পুলিশের কাজ কী ! কিছু কিছু কাজ পুলিশের নিজের করা উচিৎ।
অনিক এখন নিজেও বিশ্বাস করে যে মেয়েটার ভেতরে আসলেই একটা অলৌকিক ব্যাপার আছে। সে যা বলে সেটা ঠিক হয়। ঐ বিখ্যাত নায়িকা নীরানা চৌধুরীর মৃত্যুর পরে অনিক ব্যাপারটা নিজে পরীক্ষা করে দেখেছে। আরও ডজন খানেক কেসে সোনিয়াকে সে সাথে করে নিয়ে গেছে খুনের স্থানে। প্রতিটা ক্ষেত্রে যা বলেছে সেটাই একেবারে ঠিক ঠিক মিলে গেছে। একটা কেসে লাশটা পড়েছিল ভাওয়াল গড়ের জঙ্গলের ভেতরে। লাশের অবস্থা এতো খারাপ ছিল যে সেটাকে ঠিকমত চেনাই যাচ্ছিল না । স্থানীয় পুলিশ লাশের নাম ঠিকানাই বের করতে পারছিল না, খুনী বের করার ব্যাপারটা তো অনেক পরের ব্যাপার । অনিকের এক বন্ধু সেই থানার ইনচার্জ ছিল । সাহায্য চাইল ওর কাছে। সোনিয়াকে নিয়ে হাজির হল সেখানে। কিছু সময় সোনিয়া লাশের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল খুনটা করেছে আজমির নামের একজন । আজমির কলাবাগানে থাকে । এই লোকটার ঠিক উপরের ফ্লাটে। এই লোকের বউয়ের সাথে তার পরকীয়া চলছে। খুনের সাথে তার বউও জড়িত ।
এই কেসটাতে খুনীরা প্রায় পার পেয়ে যেত। কারণ খুন হওয়া লোকটা দীর্ঘিদিন ধরেই প্রবাসে থাকে। বাসাতেই খুন করে তাকে এখানে ফেলা হয়েছে। এবং তার বউ সবাইকে বলেছে যে তার স্বামী আবারও বিদেশ চলে গেছে। কেউ কোন সন্দেহ করে নি।
সোনিয়ার কাছে এই ব্যাপারে অনিক অনেক কথা জানতে চেয়েছে। বিশেষ করে কবে থেকে এই ক্ষমতা সে জানে । সোনিয়া নিশ্চত করে কিছু বলতে পারে নি। ছোট থেকেই সে এই ব্যাপারটা ধরতে পারে। প্রথম প্রথম বুঝতে না পারলেও পরে এক সময় সে ধরতে পারে । প্রথমে খুব ভয় পেত সে । তবে এক সময়ে ব্যাপারটা সোনিয়ার কাছে পরিস্কার হয় । মৃত্যুর পরে মোটামুটি মৃতদেহ দাফন বা সৎকারের আগ পর্যন্ত মৃতের আত্মারা তার সাথে কথা বলতে পারে। কিন্তু একবার যদি লাশ দাফন হয়ে যায় তাহলে আর তাদের দেখা পাওয়া যায় না ।
রিক্সা নিয়েই নির্দিষ্ট ক্যাফের সামনে গিয়ে হাজির হল অনিক। দরজা ঠেলে প্রবেশ করতেই দেখতে পেল ক্যাফের ভেতরের সবগুলো চোখ ওর দিকে ঘুরে গেল। অবশ্য এটা হওয়াটাইই স্বাভাবিক। ওর পরণের পোশাকটার কারণেই এমনটা হয়েছে। একবার চোখ বুলালো চারিদিকে । সোনিয়াকে খুজছে। নেই। তার মানে এখনও আসে নি । অবশ্য এখনও আসার সময় হয় নি । একটু আগে আগেই চলে এসেছে সে।
কোণার দিককার একটা টেবিলে গিয়ে বসল সে । বুঝতে পারল যে ক্যাফের ভেতরে অনেকে ওকে দেখে খানিকটা অস্বস্তিতে পড়েছে। অবশ্য অনিক সেদিকে মনযোগ দিল না । নিজের ফোন বের করে সেদিকে মনযোগ দিল । সোনিয়াকে একবার ফোন দিবে কিনা ভাবছে। কিন্তু বেশি সময় অপেক্ষা করতে হল না। মিনিট পাঁচেক পরেই সোনিয়া ক্যাফে এসে হাজির হল । সোনিয়াকে দেখে একভাবে ওর দিকে তাকিয়ে রইল । সোনিয়া দেখতে বেশ সুন্দরই বলা যাবে । সব সময় স্বাভাবিক ভাবেই সে থাকে। খুব বেশি সাজগোজ করে না। তবে আজকে সে সাজগোজ করে এসেছে খানিকটা । গোলাপী রংয়ের একটা সেলোয়ারের সাথে সাদা লেগিংস। উপরে সারা ওড়ণা । ঠোঁটে হালকা লিপ্টিক দিয়েছে। কেবল অনিকই না, ক্যাফের অন্য সবাই সোনিয়ার দিকে খানিকটা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো কিছু সময়।
সোনিয়ার চঞ্চল চোখ প্রথমে ক্যাফের ভেতরে কিছু সময় ঘোরাফেরা করল । তারপর অনিককে দেখতে পেয়েইই হাসল । এগিয়ে এল ওর দিকে ।
-খুব বেশি দেরি করে ফেললাম ?
-আরে না । আমি মাত্রই এলাম । এখনও সময় হয় নি। আমিই একটু আগে চলে এসেছি। একটা কেসের কাজে এসেছিলাম। আর থানাতে যাই নি। ভাবলাম আপনার সাথে দেখা করেই যাই । আপনার কী না জরুরী কথা ছিল !
-আপনাকে যে কেসটার দিকে নজর দিতে বলেছিলাম, সেটা কি দেখেছেন?
অনিক একটু হতাশ হল । এই মেয়েটার সাথে এই কয়দিনে অনেকবার দেখা হয়েছে। একটা সময় অনিক মেয়েটার উপরে বিরক্ত থাকলেও এখন অনিকের মনভাব বদলেছে । সোনিয়া কি সেটা টের পায় নি? অবশ্য টের না পেলে আজকে এইভাবে সেজেগুজে আসার কোন মানে আছে? কেসের কথাই যদি এভাবে সেজে গুজে এসে বুকের হার্টবিট মিস করানোর কোন মানে নেই ।
অনিক বলল, হ্যা দেখেছি আমি। সাধারণ সুইসাইড কেস। কোন প্যাঁচ নেই। ডাক্তারের রিপোর্টে পরিস্কার ভাবে লেখা আছে যে ঘুমের ঔষধ খাওয়ার ফলেই মেয়েটার মৃত্যু হয়েছে ।
অনিক দেখল সোনিয়ার চোখে একটা হতাশা ফুটে উঠেছে। অনিক বলল, আপনি নিশ্চিত যে ওটা স্বাভাবিক না? মানে সুইসাইড না হয়ে খুন সন্দেহ করছেন কি?
আসলে আমাকে যে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল, আমরা ভেবেছিলাম যে নীরানা চৌধুরীর স্বামী হয়তো আমাকে হত্যার চেষ্টা করছে কিন্তু আপনি সেদিন তার মুখের ভাব দেখেন নি? সে আমাকে চেনেই না । আমার ব্যাপারেও তার জানার কথা না । আমাকে হত্যার কোন কারণই তার কাছে নেই। এমন কারো কাছে কারণ যে আমাকে চেনে যার জন্য আমি বিপদজনক ।
-আপনার মতে কে হতে পারে?
-রিমিকে যে মেরেছে, সে!
অনিক জানে যে মেয়েটার নাম রিমি। মেয়েটা একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে । খোজ খবর নিয়ে দেখেছে সে। হাসিখুশি মেয়ে ছিল । ক্লাসের সবাই রিমির আত্মহত্যা নিয়ে একটু অবাকই হয়েছে। কারণ রিমি এমন মেয়েই ছিল না যে কিনা আত্মহত্যা করবে। তাহলে মেয়েটা কেন এমন করল? এই প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে পারে নি। তবে অনিক নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই জানে যে মানুষের বাইরের দিক দিয়ে ভেতরটা কোন ভাবেই টের পাওয়া যায় না। বিশেষ করে মেয়েটা এই দিকটা বেশি লুকিয়ে রাখে। এমন অনেক কেস অনিকের হাতে এসেছে।
অনিক বলল, বুঝতে পারছি আপনি এখনও আপসেট ।
-আসলে আমার মনে শান্তি লাগছে না। বারবার মনে হচ্ছে খুনী ছাড়া পেয়ে গেছে।
-আপনার কাউকে কি সন্দেহ হয়? মানে এমন কাউকে যে মেয়েটাকে হত্যা করতে পারে। এখানে হত্যার সব থেকে বড় প্রশ্ন হচ্ছে সেটার পেছনে মোটিভ কী? এই মোটিভ না খুজে পাওয়া গেলে আসলে আমাদের পক্ষে আসল সত্যটা বের করা সম্ভব না।
সোনিয়া অবশ্য এই মোটিভ নিয়ে আগে কখনই চিন্তা করে নি। ওকে চিন্তা করতে হয় নি। ওর জন্য ব্যাপারটা সব সময়ই সহজ ছিল। ওকে কেবল মৃতদেহের সামনে গিয়ে হাজির হতে হত !
ব্যাপারটা কবে থেকে শুরু হয় সেটা সোনিয়া নিশ্চিত করে বলতে পারবে না। হয়তো বুঝতে শেখার আগে থেকেই ওর সাথে এই ব্যাপারটা ঘটে। ছোট সোনিয়া হয়তো বুঝতেও পারে নি । একবারের ঘটনা সোনিয়ার খুব ভাল করে মনে আছে। সেইবার বড় নানা মারা গেলেন। সোনিয়ার তখনও ব্যাপারটা ঠিক বোঝার মত হয় নি যে মানুষ মারা গেলে আর কথা বলতে পারে না । ওদের পরিবারের সবাই কান্নাকাটি করছে লাশের ঘরে। তখন সে দেখতে পেল তারা নানাকে । তার নানা এগিয়ে এলেন তার কাছে। তারপর অনেক কথা বললেন। সেই কথার কোন কিছুই এখন সোনিয়ার মনে নেই। তখনও সোনিয়া ঠিক জানতোই না যে তার নানা মারা গেছে।
এরপর ক্লাস সেভেনে থাকতে প্রথম ব্যাপারটা সোনিয়ার কাছে একেবারে স্পষ্ট হয়ে ওঠে । ওদের ক্লাসেরই এক মেয়ে আত্মহত্যা করল। সবাই একেবারে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল এই ঘটনাতে। এই বয়সে একটা মেয়ে কেন আত্মহত্যা করবে। ওদের ক্লাস থেকে সবাই যখন মেয়েটির বাড়িতে গিয়ে হাজির হল সেই সময়ে সোনিয়া মেয়েটিকে ঘরের ভেতরে দেখতে পেল। ওর দিকে এগিয়ে এসে মেয়েটি বলল যে তাদের বাসায় থাকা তার দূর সম্পর্কের ছোট মামা দীর্ঘদিন তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক তৈরি করেছে। এটা সে সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেঁছে নিয়েছে।
সোনিয়া সেদিন ভয় পেয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। পরে আরও কয়েকবার যখন ঘটনা ঘটল তখন ব্যাপারটা তার সাথে স্বাভাবিক হল। সব থেকে চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটল ওর এইচএসসি পরীক্ষার সময়ে। সোনিয়া এক বান্ধবীর বাবা ছিলেন পুলিশ অফিসার। সেদিন পরীক্ষা দিয়ে বের হওয়ার পরে দেখতে পেল কলেজের পাশের একটা বিল্ডিংয়ের সামনে অসংখ্য মানুষ আর পুলিশের গাড়ি। একটু দাড়াতে পুরো ব্যাপারটা পরিস্কার হল সোনিয়ার কাছে। একজন বিখ্যাত মডেলকে নিজের ঘরে কে বা কারা ছুড়ি মেরে মেরে রেখে গেছে।
সোনিয়া মাথা নিচু করে চলেই যাচ্ছিল তখনই বিল্ডিংয়ের একটা জানালায় চোখ গেল । এবং সেখানেই সেই মডেলকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল সে। সোনিয়া যে কেবল মৃতদের দেখতে পায়, সেটা নয়, মৃতরাও সোনিয়াকে দেখতে পায়, তারা বুঝতে পারে যে সোনিয়া তাদের দেখতে পাচ্ছে তাদের কথা শুনতে পাচ্ছে !
ঐদিন বিকেলে সোনিয়া তার সেই বান্ধবীর বাসায় গিয়ে হাজির হল। তার বাবার সাথে যখন পুরো ব্যাপারটা বলল, পুলিশ অফিসার অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে রইল । প্রথমে সে সোনিয়ার মাথা খারাপ বলে মনে করল । কিন্তু যখন সোনিয়া আরও বিস্তারিত বলল, কিভাবে মারা হয়েছে এবং কোথায় সেই মডেলকে হত্যা করা হয়েছে তখন পুলিশ অফিসার একটু নড়েচড়ে বসল। সোনিয়া তাকে কেবল বলল, আমার কথা আপনার বিশ্বাস করতে হবে না । আপনি কেবল সেই বাড়িটায় গিয়ে একবার দেখে আসুন।
হয়তো মেয়ের বান্ধবী বলেই সেদিন সোনিয়ার কথা তিনি রেখেছিলেন এবং ফলও পেয়েছিলেন হাতেনাতে ! তারপর থেকেই প্রায়ই তিনি সোনিয়ার সাহায্য নিতেন । এবং এই ব্যাপারটা আস্তে আস্তে লোকজনের কানেও চলে গেল । অনেকেই বিশ্বাস করত না, সোনিয়াকে ফ্রড বলার চেষ্টা করত কিন্তু সোনিয়ার বলা কথাগুলো প্রতিবার যখন সত্য হতে লাগল তখন তাদের মেনে না নেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকল না।
সোনিয়ার কিছু বলছে না দেখে অনিক বলল, আসুন আরেকবার আলোচনা করা যায়। মেয়েটার কোন বয়ফ্রেন্ড ছিল না।
-ছিল না?
-না । আমরা তো খোজ খবর নিয়ে পাই নি।
সোনিয়া যেন কিছু একটা মনে করার চেষ্টা করল । তারপর বলল, কিন্তু আমার কেন জানি মনে হচ্ছে ছিল । আমি রিমিকে বেশ কয়েকবার একটা ছেলের সাথে দেখেছি।
-ছেলেটা বন্ধু বা ক্লাস মেট হতে পারে।
-তা পারে কিন্তু ক্লাসমেট আর বন্ধু সাথে মেয়েরা যেভাবে চলে বয়ফ্রেন্ড বা প্রেমিকের সাথে ঐ রকম ভাবে চলে না। বাইরে থেকে দেখলেই বোঝা যায়।
-তারমানে বলতে চাইছেন যে রিমির প্রেমিক ছিল?
-হ্যা। আমার মনে হচ্ছে। আরেকটু খোজ খবর নেওয়া কি যায়?
-চেষ্টা করা যায় ।
আরও কিছু সময় তাদের ভেতরে গল্পগুজব চলল । তারপর অনিক সোনিয়াকে বাসায় পৌছে দিল । ঠিক দুইদিন পরে অনিক আবারও দেখা করল সোনিয়ার সাথে।
-একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে।
-কী ?
-আপনার ধারণা সম্ভবত সঠিক। রিমির একজন বয়ফ্রেন্ড থাকলেও থাকতে পাড়ে। সেদিন এখানে যখন এসেছিলাম তখন আপনাদের বাসা থেকে একটু দুরে যে এটিএমবুথ আছে ওটার সিসিটিভি ফুটেজ চেক করে দেখেছি গত তিনমাসের । সেখানে রিমিকে মোট ৫বার একটা ছেলের সাথে রিক্সায় করে আসতে দেখা গেছে। ছেলেটার খোজ করেছি আমি। নাম দ্বিপ্ত । রিমির এক ক্লাস নিচে পরে সে । জুনিয়র। দ্বিপ্তের একজন কাছের বন্ধুকে খুজে পাওয়া গেছে । ওর কাছ থেকে জানতে পেরেছি যে রিমির সাথে দ্বিপ্তের প্রেম চলছিল । একে তো জুনিয়র তার উপরে হিন্দু। এই দুই ব্যাপারে ওরা সম্পর্কটা গোপন রেখেছিল।
-অস্বাভাবিক ব্যাপার । মোটিভ হতে পারে?
-পারে।
-তাহলে দ্বিপ্তকে খুজে বের করতে হবে।
-এখানেই সমস্যা । রিমির মারা যাওয়ার দুইদিন পর থেকে দ্বিপ্তের কোন খোজ নেই। শেষবার ওকে রিমির কবরের কাছে দেখা গেছে। গোরস্থানের সিসিটিভিতে দেখেছি আমি। গেট দিয়ে ঢুকতে দেখেছি। তারপর থেকে তার আর কোন খোজ নেই।
-বের হতে দেখেন নি?
-না বের হতে দেখা যায় নি।
-কোন দিকে গেছে কেউ জানে না।
-হয়তো অন্য পথ দিয়ে বের হয়েছে। তবে আপনি চিন্তা করবেন না। আমি খোজ খবর নিচ্ছি। দেখা যাক সে কোথায় গেছে । তাকে পেয়ে গেলে হয়তো অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে।
ঐদিন বিকেল বেলা সোনিয়া কৌতুহলবসত কবরস্থানে গিয়ে হাজির হল। শহরের এই কবরস্থানটা বেশ নির্জন স্থানেই অবস্থিত। চারিদিকে দেয়াল দিয়ে ঘেরা। মুল দরজা দিয়ে ঢুকতে একটু বেগ পেতে হল বটে । তবে দারোয়ানকে ১০০টার একটা নোট দিতেই দরজা খুলে দিল।
সোনিয়ার কবরটা খুজে পেতে একটু সময় লাগল বটে তবে শেষ পর্যন্ত খুজে পাওয়া গেল। করবের সামনে দাঁড়িয়ে রইলো বেশ কিছুটা সময়। মাথাটা যেন হঠাৎ করেই ঘুরে উঠল ওর । ঝিমঝিম করে করে উঠল । মনে হল যেন মাথার ভেতরে এক সাথে হাজারও শব্দ ভেসে উঠল। অনেক গুলো কথা যেনে কেউ বলে উঠছে। কারো কথাই সে ঠিকমত শুনতে পাচ্ছে না।
এতোদিন সোনিয়ার ধারণা ছিল যে যে কোন মৃতদেহকে একবার করব দিয়ে দিলেই তাদের সাথে আর যোগাযোগ করতে পাড়ে না সে। কিন্তু এখন এই কবরস্থানে এসে সোনিয়ার মনে হচ্ছে সে হয়তো করব দেওয়ার পরেও তাদের সাথে যোগাযোগ সম্ভব । আসলেই কি সম্ভব?
সোনিয়া তখনই সেখানে বসে পড়ল । তারপর খুব মনযোগ দিয়ে কথা শোনার চেষ্টা করল । তবে সেই একই রকম ভাবে অনেক মানুষের আওয়াজ শোনা গেল কেবল। কোন নির্দিষ্ট কারো কথা শোনা গেল না ।
-এইভাবে হইবো না!
সোনিয়া চোখ খুলল । একটু চমকে উঠেছে। তবে ভয় পেল না। যে মানুষ মৃত মানুষের সাথে কথা বলতে পাড়ে সে এতো সহজে ভয় পায় না।
সোনিয়া শব্দের উৎসের দিকে তাকাল । এক ফকিরের মত বুড়ি লোক বসে রয়েছে ওর থেক একয়েক হাত দুরে। ওর দিকে একভাবে তাকিয়ে আছে। বুড়ির চোখের দিকে তাকিয়েই সোনিয়ার মনের ভেতরে একটা শীতল অনুভব হল । বুড়ির ভেতরে কিছু রয়েছে । কিছু যেন স্বাভাবিক না । তবে সোনিয়া ভয় পেল না। সাহস নিয়ে বলল, কী করলে কাজ হবে?
এই কথা শুনে বুড়ি যেন হাসল । তারপর বলল, পারবি করতে?
-চেষ্টা করতে পারি।
-আমাবস্যার দিন আসবি। সেইদিন পারবি। তয় গায়ে কিছু রাখবি না। অন্য জগতের সাথে যোগাযোগ করতে গেলে এই জগতের কোন কিছু রাখা যাইবো না শরীরে। তাইলেই পারবি।
সোনিয়া ঠিক কথাটার মানে বুঝল না। বলল, মানে?
বুড়ি অবশ্য সেই প্রশ্নের জবাব দিল না। ওর দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত চোখে হাসল । তারপর সোনিয়াকে এক প্রকার উপেক্ষা করে হাটা দিল ।
সোনিয়া আর সেখানে থাকল না। এখানে থেকে আর লাভ নেই। তবে সে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে সে চাইলি যোগাযোগ করতে পারবে রিমির সাথে। বুড়িকে সেটা সে জানে না তবে বুড়ির কথা কেন জানি সোনিয়ার সত্যি বলেই মনে হল
দুই
ঠিক এক সপ্তাহ পরে সোনিয়া আবারও সেখানে এসে হাজির হল । আজকে ওর সাথে অনিক রয়েছে। অনিকের সাথে সব পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে। প্রথমে অনিক তীব্র বিস্ময় নিয়ে কেবল সেই কথাগুলো শুনেছে, এই অধুনিক যুগে এসেও কেউ যে এমন কথা বলতে পাড়ে সেটা অনিকের ধারণার বাইরে ছিল। তবে সোনিয়াকে যতদিন ধরে চেনে তত দিন ধরেই জানে যে জগতে অস্বাভাবিক অনেক কিছুই ঘটে। আজকেও সেই রকম অস্বাভাবিক কিছু ঘটতে চলেছে !
আগে থেকেই সে দারোয়ানকে হাত করে রাখা হয়েছিল তাই ভেতরে ঢুকতে কোন অসুবিধা হল না। চারিদিকে একেবারে ঘুরঘুটে অন্ধকার হয়ে আছে। অনিক নিজের মোবাইলের টর্চ বের করে পথ দেখাচ্ছে। নির্দিষ্ট স্থানে এসে সোনিয়া দাঁড়িয়ে গেল । এরপর কী হবে সেটা অনিক জানে ।
অনিকের এখানে না আসলেও চলত । তবে এতো রাতের বেলা সোনিয়াকে একা ছেড়ে দিতে অনিকের ইচ্ছে করে নি। এখন সোনিয়া যা করবে সেটা ওর সামনে করতে সোনিয়া একটু অস্বস্তিতে পড়বে । তাই অনিক বলল, আপনি শুরু করুন । আমি ঐদিকে আছি।
এই বলে অনিক একটু দুরে সরে গেল । মোবাইলের আলো বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগল । কত সময় পার হয়েছে সেটা অনিক বলতে পারবে না তবে হঠাৎ অনুভব করল যে চারিদিকের পরিবেশ বদলে গেছে। হঠাৎ করেই যেন বাতাস বইতে শুরু করেছে খুব জোরে, যেন ঝড় শুরু হয়েছে। অথচ আজকে ঝড়ের কোন পূর্বাভাস ছিল না।
অনিকের মনে হল সোনিয়ার কোন বিপদ হয়েছে। অনিক আর কিছু চিন্তা করল না । মোবাইলের আলোটা জ্বেলে সে সে সোনিয়ার দিকে দৌড় দিল । যখন সোনিয়ার কাছাকাছি আসতেই ব্যাপারটা চোখে পড়ল ওর । মোবাইলের ফ্লাসের আলোতেই সে দেখতে পেল সোনিয়ার দেহের উপরে কালোমত কিছু একটা যেন বসে রয়েছে। আলো নিয়ে আসতেই সেটা দ্রুত দৌড়ে পালাল ।
অনিক সোনিয়ার কাছে গিয়ে আলো ফেলল মুখের উপরে। সোনিয়া চোখ বন্ধ করে আছে। পালস চেক করে বুঝল যে চেতনা হারিয়েছে সে। সোনিয়ার পোশাকটা পাশে খুলে রাখা । আলোতে সোনিয়ার সম্পূর্ণ শরীরের উপরে একবার নজর পড়ল ওর । না চাইতেও চোখ সরাতে পারল না । এতো আকর্ষনীয় শরীর সে কোন দিন দেখে নি।
তিন
সোনিয়ার জ্ঞান ফিরল সকালবেলা । চোখ মেলে কিছু সময় সে বোঝার চেষ্টা যে কোথায় আছে । ঘরটা ওর কাছে অপরিচিত মনে হল । তারপরেই গত রাতের সব কিছু মনে পড়ে গেল । শিরশিরে একটা অনুভূতি এসে জড় হল মনে । অপরিচিত এই বাসাটা অনিকের সেটা বুঝতে কষ্ট হল না । গত রাতে শেষের দিকে ঠিক কী হয়েছিল সেটা ওর মনে নেই। কিছু একটা যেন ওর উপরে ঝাপিয়ে পড়েছিল। রিমি এসেছিল ঠিকই । কিন্তু রিমির সাথে আরও কেউ এসেছিল । সোনিয়া মনে করার চেষ্টা করল । কিন্তু মনে করতে পারল না।
-ঘুম ভেঙ্গেছে ? আসবো?
দরজার টোকা পড়ল । সোনিয়া একটু আড়ষ্ট বোধ করল। ওর স্পষ্ট মনে আছে যে যখন সে জ্ঞান হারিয়েছিল তখন ওর পরণে কিছু ছিল না । তার মানে অনিক ওকে সেই অবস্থাতেই দেখেছে এবং নিয়ে এসেছে। এই ভাবনাটাই ওকে অস্বস্তিতে ফেলে দিল। এতো লজ্জা অনুভব হল যে বলতে পারবে না । ইচ্ছে হল অনিককে বলে যেন সে সামনে না আসে । তবে বলল না ।
-আসুন !
দরজা খুলে গেল। অনিক ভেতরে ঢুকল। হাতে একটা কাপ। চা নাকি কফি সোনিয়া বুঝতে পারল না। কাপটা বিছানার পাশের ছোট টেবিলে রাখল সে। কফি!
-ঘুম ভাল হয়েছে?
-জ্বী ! আপনাক কী বলে যে ধন্যবাদ দিব তা বুঝতে পারছি না। আপনি না থাকলে কি হত ! আমি এখনও জানি না আসলে কী হয়েছিল!
অনিক ওকে বলল কী হয়েছিল । যদিও সে নিজেও ঠিকমত জানে না যে কী হয়েছিল । যা দেখেছে তাই বলল। সোনিয়াকে চিন্তিত মনে হল কিছুটা । তবে চিন্তাটা দূর করে বলল, আমি কথা বলতে পেরেছি।
অনিকের চোখে মুখে বিস্ময়ের ভাব দেখা গেল।
-সত্যি?
-হ্যা । আমি জানি রিমিকে কে হত্যা করেছে।
পরিশিষ্টঃ
পরের দিন রিমির বাবাকে পুলিশ গ্রেফতার করল । খুনের ছয় সপ্তাহহ আগে থেকেই সে নানান ফার্মেসী থেকে ঘুমের অল্প অল্প ঘুমের ঔষদ কিনছিল। বেশ কয়েকটা দোকানের সিসিটিভিতে সেটা ধরা পরেছে। একটু চাপ দিতেই পুরো ব্যাপারটা স্বীকার করে নিল। রিমির বাবা খুবই রক্ষণশীল ঘরোয়ানার মানুষ । তার মেয়ে কোন বিধর্মীর সাথে সম্পর্ক গড়বে সেটা সে কোন ভাবেই মেনে নিতে পারে না । প্রথমে সে রিমিকে ফেরাতে চেষ্টা করেছিল বটে রিমি তার কথা শোনে নি।
অবশ্য সে স্বীকার না করলেও পুলিশের কাছে আরও তথ্য ছিল। রিমি নিজের ডায়েরীতে সব কথা লিখে গেছে। সেই ডায়রিটা লুকানো ছিল বিছানার নিচে। পুলিশ সেটাও খুজে পেয়েছে । অবশ্যই সোনিয়ার দেওয়ার তথ্য মতেই।
আসল খুনীকে ধরা পরেছে এতেই সোনিয়া খুশী । তবে সেই দিন থেকেই সোনিয়ার একটা অদ্ভুত ব্যাপার খেয়াল করছে। তার সব সময় মনে হচ্ছে কেউ যেন তার উপরে চোখ রাখছে। রাত হলেই এই অনুভূতিটা আরও তীব্র হয়ে ওঠে।

প্রথম পর্ব

ফেসবুকের অর্গানিক রিচ কমে যাওয়ার কারনে অনেক পোস্ট সবার হোম পেইজে যাচ্ছে না। সরাসরি গল্পের লিংক পেতে আমার হোয়াটসএপ বা টেলিগ্রামে যুক্ত হতে পারেন। এছাড়া যাদের এসব নেই তারা ফেসবুক ব্রডকাস্ট চ্যানেলেও জয়েন হতে পারেন।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.4 / 5. Vote count: 15

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →