চিতংবুড়া

oputanvir
4.5
(21)

সকালবেলা ঘুম ভেঙ্গেই নীতুর মনটা ভাল হয়ে গেল। বিছানার পাশের জানালার দিয়ে অর্ধেকটা আকাশ আর পাহাড় দেখা যাচ্ছে । একটু পরেই পাহাড়ের উপর দিয়ে সূর্য উঠবে । ঋদ্ধ রায়হান বলেছিল এই জানালা দিয়েই সে সূর্যোদয় দেখা যাবে। নীতুর আরও একটু সময় শুয়েই থাকতে ইচ্ছে হল । ভোরের দিক থেকে একটু শীত পড়েছে । অবশ্য পাহাড়ে সব সময়ই এমন আবহাওয়া থাকে। দিনের বেলা যত গরমই থাকুক না কেন রাতে ঠান্ডা পড়বেই। তাই গতকাল সারাদিন পরিশ্রমের পরে এই ঠান্ডা আবহাওয়াতে ঘুমটা আরামের হয়েছে।
নীতুর সত্যিই ধারণা ছিল না যে শহরে বেড়ে ওঠা কেউ শহরের সব যান্ত্রিকতা আর আধুনিক সুযোগ সুবিধা ছেড়ে একেবারে এই পাহাড়ে এসে স্থায়ী ভাবে বসবাস করতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা সময়ে নীতু নিজে বেশ কয়েকবার পাহাড়ে এসেছে । সেই সময়ে পাহাডের মানুষদের কঠিন জীবন নিজের চোখে দেখেছে। ঘুরেফিরে বেড়ানোর কয়েকটা দিন হয়তো ভালই যায় তবে দিনের পর দিন পাহাড়ে থাকার কথা নীতু তখন চিন্তাই করতে পারে নি । আর এখানে কিনা ঋদ্ধ রায়হান বছরের পর বছর ধরে থাকছে। ব্যাপারটা নীতুর কাছে বেশ অদ্ভুত মনে হয়েছে। একটা মানুষ কী কারণে এই পাহাড়ের নির্জন পরিবেশে বছরের পর বছরে পড়ে থাকবে?
হ্যা, নীতু জানে যে যারা লেখক হয়, তাদের মাথায় সব সময় অদ্ভুত সব খেয়াল এসে বাসায় বাঁধে। লেখার জন্য তারা কত কী করে তার কোন ঠিক নেই। কিন্তু তাই বলে সব কিছু ছেড়ে এখানে থাকবে কেউ? কী কারণ থাকতে পারে?
নীতু সেটাই জানতে এসেছে। ঋদ্ধ রায়হানের উপরে পুরো একটা রিপোর্ট তৈরি করতে হবে ওকে । ওর সম্পাদক এই দায়িত্ব দিয়েই ওকে পাঠিয়েছে। আসছে ঈদ সংখ্যায় এই রিপোর্টটা বের হবে । এই রিপোর্টটা যদি ঠিকমত তৈরি না হয় তাহলে সম্ভবত ওর চাকরিটা আর স্থায়ী হবে না। সেই সাথে নতুন করে চুক্তিও আর নবায়ন হবে না। ওকে নতুন কোন চাকরি খুজে নিতে হবে নয়তো বড় মামার খুজে আনা পাত্রের সাথে বিয়েতে রাজী হতে হবে। নীতু আর যাই হোক সেই ছেলেকে মোটেই বিয়ে করতে চায় না। নয়টা-পাঁচটা ধরে অফিস করা মোঁচওয়ালা সেই ছেলেকে নীতুর মোতেই পছন্দ নয়। তাই যে কোন ভাবে তার এই সাক্ষাৎকারটা ভাল ভাবে নিতে হবে।

সূর্য উঠে গেছে। রোদটা একেবারে মুখের উপরে এসে পড়ছে। সত্যিই বলেছিল ঋদ্ধ রায়হান । গতকাল রাতের খাবারের সময় সে জানিয়েছিল এখানকার সকালটা অন্য রকম ভাবে শুরু হয় । শহরের কোন পরিবেশের সাথে এর কোন মিল নেই । নীতুর এমনিতেই প্রতিদিন সকালে ওঠার অভ্যাস । রাত জেগে যত কাজই করুক না কেন ঠিক ঠিক সকালে সূর্যের আগেই তার ঘুম ভাঙ্গে । প্রতিদিন বাসার পাশের পার্কে হাটতে বের হয় সে । সেখানেই সে প্রতিদিন সূর্যকে স্বাগত জানায় । তবে আজকের সূর্যটা নীতুর কাছে যেন একেবারেই অন্য রকম মনে হচ্ছে। অনেক দিন আগের সেই পাহাড়ের সকালের কথা মনে পড়ছে। এতো চমৎকার সকাল যেন অনেক দিন নীতুর জীবনে আসে নি।
ঋদ্ধ রায়হানকে চেনে না এমন মানুষ এই দেশে একটাও নেই। অবশ্য এখানে একটু ভুল বলা হল । বলা উচিৎ ছিল যে ঋদ্ধ রায়হানের লেখার ব্যাপারে জানে না এমন একটা শিক্ষিত মানুষ খুজে পাওয়া যাবে না। তবে মানুষটা যে আসলে দেখতে কেমন সে ব্যাপারে অনেকেরই কোন ধারণা নেই। একদম যেন উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। তার লেখক হয়ে ওঠার গল্পটা অনেকেই জানে। দৈনিক তোলপাড় পত্রিকাতে একদিন একটা হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি এসে হাজির হল ঈদ সংখ্যার জন্য । এই সময়ে আর কেউ আর হাতে লেখা কাগজে পাণ্ডুলিপি দেয় না। সবাইকেই ডক ফাইলে পাঠাতে হয়। সহকারি সেটা ফেলেই দিচ্ছিল তবে কী মনে করে সাথে করে নিয়ে গেল বাসায় । রাতের খাওয়ার পরে সেটা পড়তে বসল । সে পাণ্ডুলিপির ভেতরে এতোটাই ডুবে গেল যে সেখান থেকে আর উঠতেই পারল না। গল্পের ভেতরেই ডুবে গেল একেবারে । একটানা ছয় ঘন্টা পড়ে সেটা শেষ করল । তার মনে হল যে এটার মত একটা রহস্য উপন্যাস সে এর আগে কোন দিন পড়ে নি। ঐদিন সকাল বেলা সোজা সম্পাদকের কাছে নিয়ে গিয়ে হাজির হল সেটা । কোন কিছু না বলে কেবল তাকে পাণ্ডুলিপিটা পড়তে বলল ।
সম্পাদকের সাথেও ঠিক একই রকম ঘটনা ঘটল । তিনি সেদিনের সব মিটিং ক্যান্সেল করে দিলেন। কারো সাথে দেখা করলেন করলেন না, কথা বললেন না। এক ভাবে কেবল পাণ্ডুলিপিটাই পড়তে থাকলেন।
পড়া শেষ করেই তার মনে হল যে এবারের ঈদ সংখ্যাটা কেবল এই একটা লেখার জন্যই হিট হবে। এবং সত্যিই হল তাই। ঈদসংখ্যা তিনি প্রতিবারের চেয়েও তিন গুণ সংখ্যক ছাপালেন। কিন্তু তাতেও কুলালো না। আরও ছাপাতে হল । পুরো দেশের পড়ুয়া মানুষরা যেন পাগল হয়ে গেল তার লেখা পড়ে । কিন্তু কেউ তাকে চিনে না। কেবল নামটা জানে ।
অবশ্য পত্রিকার অফিসও যে খুব ভাল করে লেখককে চিনত সেটাও না। প্রকাশের আগেই সম্পাদক তার সাথে যোগাযোগ করতে চেয়েছিল সম্মানির ব্যাপারে। লেখকের নাম আর মোবাইল নম্বর ছিল বটে তবে যখন মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করা হল জানা গেল যে সেটা বান্দরবানের একটা স্টেশনারী দোকানের নম্বর। অবশ্য দোকানী লেখক ঋদ্ধ রায়হানকে চিনতে পারল। সেখান থেকেই জানা গেল যে ঋদ্ধ রায়হান বলেই গিয়েছে তার খোজে ফোন আসলে যেন একটা প্যাকেট পাঠাই । ঠিকানা ফোনে পাওয়া যাবে। সম্পাদক মশাই মোটেই দেরি করলেন না। ঠিক তিন দিন পরে আরেকটা পাণ্ডুলিপির প্যাকেট এসে হাজির হল। এবং এই উপন্যারও আগের মতই দুর্দান্ত ।
পত্রিকার নিজেস্ব একটা আলাদা প্রকাশনি ছিল একই নামে। সারা বছরই তারা বই ছাপায় । এবার ঋদ্ধ রায়হানের বই বের হল । এক বারে এক লক্ষ কপি ছাপিয়ে ফেলল । এবং পুরোটা শেষ হয়ে গেল এক মাসের ভেতরেই ।

পরের মাসে সম্পাদক সাহেব নিজে এসে হাজির হলেন বান্দরবানে । সেই স্টেশনারী দোকানে গিয়ে হাজির হলেন। অনেক অনুরোধের পরে ঋদ্ধ রায়হানের সন্ধান পাওয়া গেল । থানচি তারপর রেমাক্রি এবং তারও অনেকটা ভেতরে হাটলে পাওয়া যাবে তার বাসা । বাহাদুর নামে এক বম ছেলে আছে । সে লেখকের বাসায় যায় মাসে দুই একবার । রায়হানের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে নিয়ে যায়। মাঝে মাঝে ঋদ্ধ নিজেও আসে শহরে কোন দরকারে ।
বাহাদুরকে ফোনে পাওয়া গেল । সম্পাদক সাহেব প্রয়োজনীয় কথা বার্তা সেরে বাহাদুরের হাতে একটা চিঠি দিলেন ঋদ্ধ রায়হানকে দেওয়ার জন্য । কয়েকদিন পরে যোগাযোগ হল, সম্পাদক সাহেব আবার এলেন বান্দরবান । ঋদ্ধের সাথে মিটিং হল কথা বার্তা হল । চুক্তি হল । একের পর এক বই বের হতে থাকল । ঋদ্ধ রায়হানের এই রহস্যময়তা তাকে পাঠকের কাছে আরও বেশি আকর্ষনীয় করে তুলল।
প্রথম প্রথম কেবল তোলপাড় থেকেই বই বের হত তবে ধীরে ধীরে অন্য প্রকাশনিরাও তার সাথে যোগাযোগ করা শুরু করল। বই প্রকাশ ছাড়াই তার ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য অনেকেই ঘুরতে লাগল । কিন্তু দূর্গম এলাকা হওয়ার কারণে কেউই বলতে গেলে যেতে পারত না। আর বেশির ভাগ মানুষের সাথে ঋদ্ধ রায়হান দেখা করতেন না। বাড়িটা একটু দুর্গম হওয়ার কারণে অনেকেই এ পথটা ঠিক মত খুজে পেত না । আর স্থানীয় পাহাড়ি গাইডরা ঐদিকে যেতে চাইতো না । কেন যেতে চাইতো সেটাও বলত না। তবে কালে ভাদ্রে অনেক টাকার বিনিময়ে কেউ কেউ যেত।
নীতু যখন ঋদ্ধ রায়হানের বাসায় এসে হাজির হল তখন রাত নেমেছে পাহাড়ে। গাইড বাড়ির ভেতরে ঢুকল না। যখন পাড়া থেকে রওয়ানা দিয়েছিল সেই সময়েই গাইড জানিয়েছিল যে এই বাড়িতে সে ঢুকবে না। তাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে চলে যাবে । বৃষ্টির ভেতরেই গাইড ফেরত গেল । এই আচরণটা নীতুর কাছে অদ্ভুত লেগেছিল। তবে এটা মেনে নিয়েই সে এসেছে। অন্য কিছু চিন্তা করার কোন উপায় ছিল না।
ভেতরে প্রবেশের সময় ঋদ্ধ রায়হানের মুখ গম্ভীর থাকলেও রাতের খাবারের সময় পরিস্থিতি একেবারেই বদলে গেল । অনেকটাই হাসিহাসি মুখে ঋদ্ধ রায়হান নীতুর সাথে কথা বলছিল। নীতুর খোজ খবর নিচ্ছিল। নীতু তখনই তার আসার উদ্দেশ্য ঋদ্ধ রায়হানকে জানাল । এমন একটা সম্ভবনা ছিল যে সে নীতুকে সকালেই চলে যেতে বলবে। তেমনটা বললেই সম্ভবত নীতু অবাক হত না। কিন্তু সেটা না করে নীতুর প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল । তবে শর্ত দিল যে কালকে তার ইন্টারভিউ নেওয়া হবে না। সে একটু পাহাড়ের ভেতরে যাবে দরকারি কাজে। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। পরের দিন থেকে ইন্টারভিউ নেওয়া যাবে। কালকে চাইলে সে চলে গিয়ে পরশুদিন আবার আসতে পারে অথবা কালকে এখানেই থাকতে পারে। তবে সারাদিন তাকে একাই থাকতে হবে।
নীতু একেবারে এক বাক্যেই রাজি হয়ে গেল। এমন একটা প্রস্তাব যে ঋদ্ধ রায়হান করবে সেটা সে ভাবতেই পারে নি। সে তো মানসিক ভাবে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল । এমন রাতের বেলা কারো বাসায় আসলে যে কেউ বিরক্ত হবে সেটাই স্বাভাবিক । সেটা না হয়ে ঋদ্ধ রায়হান ওকে বড় একটা সুযোগ দিয়েছে । এই সুযোগ সে কোন ভাবেই হাত ছাড়া করবে না। এক বাক্যের নীতু রাজী হয়ে গেল।

শোবার ঘর থেকে মাঝে ঘরে আসতেই দেখতে পেল ঋদ্ধ রায়হান একেবারে পোশাক পরে তৈরি হয়ে আছে। মেঝেতে বসে খিচুড়ি খাচ্ছে। পাশের একটা হাড়ি রয়েছে। হাড়ির ঢাকনাটা খোলা । সেখানে বেশ কিছুটা খিচুড়ি এখনও দেখা যাচ্ছে ।
ঋদ্ধ রায়হান ওর দিকে হাসল একটু। তারপর বলল, আমি বের হচ্ছি। তোমার জন্য সকালের রান্না করে রেখেছি। সরি, এর থেকে ভাল কিছু পাওয়া মুস্কিল এখানে। বাহাদুর কাল আসবে । তখন মুরগি খাওয়া যাবে।
তারপর রান্না ঘরের দিকে হাতের ইশারা করে বলল, ওখানে সরঞ্জাম পাবে সব। চা কিংবা কফি বানিয়ে খেতে পার । এছাড়া দুপুরের রান্না করে নিতে হবে তোমার নিজের। আমার আসতে আসতে সন্ধ্যা, এমন কি রাত হয়ে যেতে পারে। তাই আমার জন্য অপেক্ষা করার দরকার নেই । খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। কাল সকালে আমাদের কথা হবে আশা করি।
ঋদ্ধ রায়হান এতো সহজ ভাবে নীতুর সাথে কথা বলছিল যেন সে তার কত দিনেরই না চেনা । আর এভাবে একজন পুরোপুরি অপরিচিত মানুষের কাছে পুরো বাড়িঘর রেখে কেউ চলে যেতে পারে?
নীতু বলল, আমার মত অচেনা অজানা একজনের কাছে এভাবে পুরো বাড়ি রেখে চলে যাচ্ছেন?
নীতুর কথা শুনে ঋদ্ধ রায়হান হাসল । তারপর বলল, আমার এই বাড়িতে এমন কিছু নেই! পাহাড়ে থাকতে থাকতে আমার স্বভাবও এই পাহাড়বাসীদের মতই হয়ে গেছে। ওরা জাগতিক জিনিস পত্রের প্রতি মোহগ্রস্থ নয় । জীবনে বেঁচে থাকতে যে আসলে খুব বেশি জিনিসপত্রের দরকার নেই সেটা এখানে না আসলে বোঝা যাবে না। আমিও এখন সেই রকম হয়ে গেছি।
একটু চুপ করে থেকে ঋদ্ধ রায়হান আবার বলল, এই বাসাটার পেছনের দিকে হাটলেই ছোট একটা ঝরণা পাবে। গোসল ওখান থেকেই করতে পারি যদি চাও।
-আচ্ছা ।
ঋদ্ধ রায়হান দ্রুত খাওয়া শেষ করে প্লেটটা রান্না ঘরের ভেতরে নিয়ে গেল । বের হয়ে এল একটু পরেই। তারপর ওকে বিদায় জানিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এল। নীতুও এল পেছন পেছন । দেখতে পেল গতকাল ওরা যে রাস্তা দিয়ে এসেছিল সেই রাস্তার দিয়ে হাটা দিল । নীতু জানে এই রাস্তাটা একটু সামনে গিয়েই দুই দিকে চলে গেছে। একদিন দিয়ে ওরা এসেছে গতকাল । আর অন্য দিকে যাবে পাহাড়ের আরো গভীরে। ঐদিকে দেখার কিছু নেই । তাই ট্রেকাররা সেদিকে খুব একটা যায় না। নীতু দেখতে পেল ঋদ্ধ রায়হান সেদিকেই গেল।

ঋদ্ধ রায়হান চলে যাওয়ার পরেই নীতু অনুভব করল যে চারদিকটা অনেকটাই শান্ত এবং নির্জন। একটু যেন বেশিই নির্জন। এভাবে এতো নির্জনতার ভেতরে নীতু এর আগে কোন দিন থাকে নি । পাহাড়ে এসেছে বটে তবে সব সময়ই ওর সাথে লোকজন থাকত । এভাবে একেবারে একা সে কখনই হয় নি । নীতু জানে যে কাছের যে পাড়াটা আছে সেখান থেকেও এই বাসায় আসতে প্রায় ঘন্টা দুয়েক লাগবে । এই অনুভূতিটা যেমন ওকে একটু অস্বস্তিতে ফেলল, ঠিক একই সাথে মনের ভেতরে একটা আলাদা আনন্দবোধও জাগিয়ে তুলল। পুরোটা দিন একেবারে নিজের মত করে থাকার অনুভূতিটা সম্ভবত ব্যাখ্যা করতে পারছে না ও ।
নীতুর প্রথমে ওয়াশরুমে গেল। গতকালের পর থেকে একবারও ওয়াশরুমে যাওয়া হয় নি। গতকাল পোশাক বদলেদিল বাড়িটার ঠিক পেছনের ছোট গোসলখানাতে। তারপর তো রাতের খাবার খেয়েই ঘুম । এর মাঝে আর ওয়াশরুমে যাওয়ার কথা মনে আসে নি। বাড়ির পেছনের গোসল খানার পাশ দিয়ে একটা সরু রাস্তা চলে গেছে। এই রাস্তা দিয়ে গেলেই সম্ভবত ঝরণাটা পাওয়া যাবে সম্ভবত। ওয়াশরুমটা গোসলখানার কাছেই। কাঠ দিয়ে তৈরি । দরজাটা খুলতেই নীতু বেশ অবাক হয়ে গেল। যদিও প্যান বসানো তবে সেটা পাঁকা করা । খুবই পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। পাশে বালতি ভর্তি পানি । নীতু এতো চমৎকার ওয়াশরুম আশা করে নি ।
সকালের নাস্তা শেষ করে নীতু এবার পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখল । অবাক করার মত ব্যাপার হচ্ছে বাড়িটার দেয়াল কাঠের তৈরি উপরে ছন দিয়ে ছাওয়া । তবে মেঝেটা পাকা । বেশ শক্ত মজবুত গাথুনী। এই পাহাড়ে এভাবে ঢালাই করা মেঝে সে কোন দিন দেখে নি । এমন যে আর্মি বিজিবির ক্যাম্পগুলো আছে সেগুলো এমন নয়। এটা নীতুকে বেশ অবাক করল । মোট তিনটা রুম । মাঝের একটা বড় ডাইনিং কাম বসার ঘর। এটার সাথে রান্নাঘর । আর দুই পাশে দুইটা শোবার ঘর ছোট ছোট । নীতু ঋদ্ধ রায়হানের শোবার ঘরে গিয়ে ঢুকল । একটা ছোট আলনাতে কয়েকটা কাপড় ঝুলছে। একেবারে শেষ মাথায় একটা ছোট টেবিল । এই টেবিলে বসেই সে লেখে । টেবিলের উপরে বেশ কিছু কাগজের স্তুপ দেখতে পেয়ে এগিয়ে গেল সে। একটা তুলে নিয়ে বুঝল সেটা ঋদ্ধ রায়হানের নতুন লেখা । সেখানে দাঁড়িয়েই কয়েকটা পেইজ পড়ে ফেলল । বুঝতে কষ্ট হল না যে আরেকটা হিট উপন্যাস হতে চলেছে এটা ।

আরও কিছুটা পড়তে চাইছিল কিন্তু তার আগেই কারো গলার আওয়াজ পেল । কেউ যেন এসেছে বাড়ির সামনে।
কে এল?
কারো কি আসার কথা ছিল?
নীতু বের হয়ে এল । দরজার কাছ থেকেই দেখতে পেল বেড়ার গেটের কাছে নীতুর গাইড সাং দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওকে দেখেই হাত নাড়ল । নীতু একটু অবাক হল । তারপরেই মনে পড়ল যে সাংয়ের তো আশার কথা ছিল । নীতু এগিয়ে গেল গেটের কাছে। কাছে আসতেই সাং বলল, চলেন আফা, যাইবেন না?
নীতু বলল, নাহ আজকে যাবো না। এমন কি কালকেও না । তুমি আমাকে পরশু দিন নিতে এসো কেমন !
সাংয়ের মুখের ভাব দেখেই মনে হচ্ছিল যেন সাং এই ভয়টাই পাচ্ছিল । নীতুর দিকে তাকিয়ে বলল, আফা, এই জায়গাটা ভাল না । আমরা এখানে আসি না। আপনি জোর করছেন বলেই নিয়া আসছি। এখানে থাইকেন না।
-কেন ভাল না কেন?
সাং যেন কিছু বলতে ভয় পাচ্ছে । কয়েকবার তাকাল ভেতরের দিকে । নীতু পেছনের দিকে তাকিয়ে বলল, ভয় নেই। কেউ নেই বাসায়। তুমি আমাকে বল কী সমস্যা?
এটা শুনেও যেন সাংয়ের ভয় কাটলো না। এই ভয়টা সে গতকাল রাতেও দেখেছিল। শুরু থেকেই কেউ এখানে ঠিক আসতে চাইছিল না । রেমাক্রি থেকে তো কেউ আসবে না । শেষে একজন রাজি হল যে মাঝের একটা পাহাড়ি পাড়া পর্যন্ত । জানালো যে ওখান থেকে অনেকেই নাকি এ বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে আসে। পাড়াতে গিয়েও মানুষ পাওয়া যাচ্ছিল না । শেষে একটু বেশি টাকার লোভ দেখাতে সাং রাজি হল । তবে আগেই জানিয়েছিল যে সে কোন ভাবে বাড়ির ভেতরে ঢুকবে না । তাকে গেট পর্যন্ত পৌছে দিয়ে আসবে। নীতু প্রথমে ভেবেছিল যে ঋদ্ধ রায়হান ব্যাপারটা পছন্দ করে না বলেই হয়তো এখানে কেউ নিয়ে আসতে চায় না । তবে এখন কেন জানি নীতুর মনে হচ্ছে এখানে অন্য কোন একটা ব্যাপার রয়েছে।
সাং বলল, আফা, এখানে নানান সময়ে অদ্ভুত সব আওয়াজ শোনা যায় । আমরা এই এলাকাতে আসি না । এইখানে একবার দুইজন ট্রেকার হারায়ে গেছিল । হারায়ে মানে একেবারে গায়েব । তাদের লাশ পর্যন্ত খুইজ্জা পাওয়া যায় নাই। দেখবেন এই এলাকাতে কোন পাখি ডাকে না। রাতের বেলা কোন পোকাও ডাকে না।
নীতু একটু অবাক হল । কাল রাতে অবশ্য ক্লান্ত ছিল । তাই সে ব্যাপারটা খেয়াল করে দেখে নি । তবে এটা সত্যি যে সকাল থেকে কোন পাখির ডাক সে শোনে নি। সকালটা অনেক বেশি নির্জন মনে হয়েছে ওর কাছে।
-আফা এখানে থাইকেন না । চলেন যাই গা !
নীতু বলল, চলে যেতে পারলে তো ভালই হতো । আমাকে থাকতে হবে। আমরা চাকরি চলে যাবে নয়তো । বুঝতে পেরেছো ! তুমি চিন্তা করো না। তুমি পরশুদিন এসো সকালের দিকে ।

সাং আরও কয়েকবার নীতুকে বোঝানোর চেষ্টা করল । তারপর যখন বুঝল যে নীতু যাবে না তখন পেছনে দাঁড়ানো সেই লোকটার কাছে গিয়ে কী যেন বলল। লোকটা নিজের কাধের ব্যাগ থেকে একটা ছোট গলার পরা লকেট বের করে দিল । লকেটটা কালো কারসুতো দিয়ে বাধা । অনেকটা তাবিজের মত । সাং সেটা নীতুর হাতে দিল । তারপর বলল, এটা সাথে রাইখেন । রাতের বেলা বালিশের নিচে রেখে ঘুমাইবেন । ভুলে যাইয়েন না ! কেমন !
নীতু সেটা হাত বাড়িয়ে নিল । বিশেষ করে সাংয়ের উদ্দিগ্ন মুখের দিকে তাকিয়েই লকেটটা নিল সে । একটু বিস্মিতও হল। হয়তো সাংয়ের চিন্তাটা অমূলক তবে সে যে নীতুকে নিয়ে চিন্তা করছে সেটার ব্যাপারে কোণ সন্দেহ নেই। মাত্র একদিনের পরিচয়ে নীতুর জন্য তার এতো চিন্তা দেখে নীতুর মন ভাল হয়ে গেল। শহরের মানুষ গুলো তো এমন না । এমন কি কাছের আত্মীয় স্বজনেরাও তো এতো ভাবে না।
নীতু হাসি মুখে বলল, তুমি চিন্তা করো না । কেমন ?
নীতু সাংয়ের চলে যাওয়া পথের দিকে দীর্ঘ সময় তাকিয়ে রইলো। ওর কেন জানি মনে হচ্ছে সাংয়ের ভয়ের কারণ মোটেই অমূলক নয় ! কেন এমনটা মনে হচ্ছে সেটা সে নিজেও জানে না তবে ওর এমনটাই মনে হচ্ছে।

পরের পর্ব

ফেসবুকের অর্গানিক রিচ কমে যাওয়ার কারনে অনেক পোস্ট সবার হোম পেইজে যাচ্ছে না। সরাসরি গল্পের লিংক পেতে আমার হোয়াটসএপ বা টেলিগ্রামে যুক্ত হতে পারেন। এছাড়া যাদের এসব নেই তারা ফেসবুক ব্রডকাস্ট চ্যানেলেও জয়েন হতে পারেন।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.5 / 5. Vote count: 21

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

One Comment on “চিতংবুড়া”

Comments are closed.