দরজায় আওয়াজ হতেই মুমু জড়োসরো হয়ে বসল। বুকের ভেতরের ভয়টা আরেকবার নাড়া দিয়ে উঠল। ওর কপালে কী লেখা আছে সেটা মুমু জানে না। বাবার মতো সেও যদি মারা যেত, তাহলে হয়তো ভালো হতো!
বাবার কথা মনে হতেই চোখ দিয়ে আরেক ফোঁটা পানি বেরিয়ে এলো। এই ক’দিনে ওর জীবনটা এমনভাবে বদলে যাবে, সেটা মুমু কোনোদিন ভাবতেও পারেনি। প্রতিপক্ষের প্রতিহিংসা যে এত ভয়ংকর হবে, সেটা মুমু নিজের চোখে দেখেছে। হয়তো ওর জন্য আরও ভয়ংকর কিছু অপেক্ষা করছে। এই বাড়িতে সে গত দুই দিন ধরে আটকা রয়েছে। মুমু জানে, বাইরে থেকে দরজাটা আটকানো। গত দুই দিনে এক ফোঁটাও ঘুমায়নি সে। এই দুই দিনে প্রতিবার দুই বেলা দরজা খুলেছে। খাবারের একটা প্লেট ভেতরে ঢুকেছে, আবার দরজাটা বন্ধ হয়ে গেছে। প্রথমে মুমু ভেবেছিল খাবে না সে, কিন্তু ক্ষুধার কাছে সব শোক পরাজিত হয়েছে। আজকেও যখন দরজা খুলল, মুমু ভয়ে জড়োসরো হয়ে গেল!
তবে আজ শুধু ভাতের প্লেটটা একপাশে রেখে দরজা বন্ধ হলো না। একজন মানুষ প্লেটটা নিয়েই ভেতরে ঢুকল। মুমু মানুষটাকে খুব ভালো করেই চেনে। এই মানুষটাই ওকে এখানে ধরে এনেছে।
প্লেটটা মুমুর সামনে নামিয়ে রেখে রায়হান ওর পাশে দাঁড়াল। ওর দিকে কিছুক্ষণ একভাবে তাকিয়ে থেকে বলল, “তোমার বাবার কবর হয়েছে স্কুলের পাশের গোরস্থানে।”
মুমু কোনো কথা বলল না। হঠাৎ বিষাদের একটা অনুভূতি ছেয়ে গেল ওর মনে। সত্যিই কি এমনটা হয়েছে? মুমুর এখনও ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। মুমুর গত দুই দিন ধরে কেবল মনে হচ্ছে সে কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছে। হয়তো এখনই ঘুম ভাঙবে। দেখবে সবকিছু আগের মতোই রয়েছে।
মুমু বলল, “আমাকে যেতে দেন!”
রায়হান যেন হাসল। তারপর বলল, “তোমাকে এখন বাইরে যেতে দেওয়া যাবে না।”
“আপনি আমাকে এভাবে আটকে রাখতে পারেন না।”
“আমি চাইলেই পারি।”
“আপনি খুনি! আপনি আমার বাবাকে খুন করেছেন!”
রায়হান একটু এগিয়ে এসে মুমুর দিকে তাকিয়ে, মুখের ভাবটা কঠিন করে বলল, “আমি চাইলে তোমার সঙ্গে কী করতে পারি জানো?”
মুমু এবার তীব্র গলায় বলল, “এটাই তো চান! আমার বাবাকে খুন করে আমাকে এখানে ধরে এনেছেন। আমাকে রেপ করার জন্যই তো! সেটাই করেন আগে। আমার বাবাকে কেন মারলেন?”
“তোমার বাবা মারা গেছেন তার কর্মফলের জন্য। গত ১৫ বছর ধরে এলাকার মানুষের ওপর কী পরিমাণ অন্যায় সে করেছে, সেটা তুমি দেখোনি? নাকি বাবা বলে তার কোনো অন্যায় তোমার চোখে পড়েনি?”
“সে অন্যায় করলে তাকে শাস্তি দেওয়ার আপনি কে?”
“আমি কেউ না। তাকে কারা খুন করেছে, সেটা তুমি ভালো করেই জানো। এখন চুপচাপ খাবার খেয়ে নাও।”
“আমাকে যেতে দেন!”
রায়হান আর কোনো কথা না বলে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল। তারপর সেটা বাইরে থেকে আটকে দিয়ে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। ক’দিন ধরে দেশের অবস্থা একদম বদলে গেছে। ক্ষমতাসীন সরকার গত ১০ বছর ধরে দেশের ক্ষমতা দখল করেছিল অন্যায়ভাবে। ভোটাহীনভাবে দমন-নিপীড়ন করে চলেছিল। তবে তীব্র ছাত্র-জনতা আন্দোলনের মুখে সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ক্ষমতা ছাড়ার পরপরই তাদের ওপর আক্রমণ শুরু হয়। বিশেষ করে এতদিন ধরে যারা জুলুম করে এসেছে তাদের ওপর আক্রমণ শুরু হয়। এই গ্রামের মতিন চেয়ারম্যান ছিলেন ক্ষমতাসীন দলের একজন। তিনি এবং তার দল এতদিন এতো দমন-নিপীড়ন চালিয়েছেন যে লোকজন, বিশেষ করে যারা এই দমন-নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, তারা এখন পাল্টা হামলা শুরু করেছেন। এরই মধ্যে কয়েকজন মারা গেছেন। তাদের মধ্যে মতিন চেয়ারম্যানও আছেন।
কবে যে অবস্থা শান্ত হবে, রায়হান বলতে পারছে না। এখনও লোকজন সারা গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মতিন চেয়ারম্যানের লোকজনকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। যতদিন না নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে দেশে আইন-শৃঙ্খলা ঠিক করে না, ততদিন এসব চলবে। রায়হানের মনে অবশ্য অন্য চিন্তা রয়েছে। ফোনটার দিকে আরেকবার তাকাল। একটা মানুষের কাছ থেকে মেসেজ আসার কথা। সেটা নিয়ে সে বেশ চিন্তিত। ঠিক এমন সময় ওদের বাসার উঠোনে কিছু মানুষের শোরগোল শোনা গেল।
রায়হান সেদিকেই এগিয়ে গেল। উঠোনে গিয়েই দেখতে পেল তার বাবার সঙ্গে এলাকার কিছু মানুষ কথা বলছে। এদেরকে রায়হান খুব ভালো করেই চেনে। মতিন চেয়ারম্যানের মেয়েকে খুঁজে বের করতে সিরাজের পরিবারের সদস্যদের সবচেয়ে বেশি চাপ আসছে। চেয়ারম্যানের বাড়িতে হামলায় সিরাজের হাত ছিল সবচেয়ে বেশি।
সিরাজ গলা উঁচু করে রায়হানের বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, “চাচা, মতিন চেয়ারম্যানের মাইয়া আপনার বাসায় আছে, আমরা জানি! ওরে আমাদের হাতে তুলে দেন!”
রায়হানের বাবা কিছু বলতে যাবেন, তার আগেই রায়হান এগিয়ে এল। তারপর বলল, “এখানে কেউ নেই।”
“তুমি বললেই হবে? আমরা দেখব।”
রায়হান এবার কঠিন গলায় বলল, “আমি বলছি, এখানে কেউ নেই। কথা কানে যায় না?”
রায়হানের এই কঠিন কণ্ঠ শুনেই বুঝি সিরাজ একটু পিছিয়ে গেল। রায়হান আবারও তীব্র কণ্ঠে বলল, “এখানে কেউ নেই। কথা বোঝা গেছে? কার এত সাহস দেখি আমাদের ঘরে ঢোকে!”
রায়হান খুব ভালো করেই জানে যে সিরাজ যত বড় বড় কথাই বলুক না কেন, রায়হানদের বাড়ির ভেতরে ঢোকার সাহস তার নেই। যখন মতিন চেয়ারম্যান ক্ষমতায় ছিলেন, তখন রায়হানদের সঙ্গে তাদের ঝামেলা লেগেই থাকত। গ্রামে দুই গ্রুপের মধ্যে ঝগড়া চলতই। সেই হিসাবে গ্রামে রায়হানদের ওপর আর কেউ নেই।
সিরাজরা চলে গেল। সিরাজ চলে যাওয়ার পরপরই রায়হানের বাবা রায়হানের দিকে তাকিয়ে বললেন, “মেয়েটাকে কতদিন লুকিয়ে রাখবে? দেশের অবস্থা এখন ভালো না, বুঝতেই পারছো?”
রায়হান বলল, “দেখছি আব্বু। খোঁজ লাগিয়েছি। আজ-কালকের ভেতরেই কিছু একটা হবে।”
“জলদি দেখো। সিরাজের মতো অনেকের মাথাই এখন গরম। ওরা যদি নিশ্চিত হয় যে মেয়েটা এখানে আছে, পরেরবার কিন্তু আটকানো মুশকিল হয়ে যাবে।”
রায়হান মাথা নাড়ল। সে খুব ভালো করেই জানে যে এখন অবস্থা আসলেই বেশ খারাপ। যে কোনো সময় যে কোনো কিছু হয়ে যেতে পারে। মুমুকে এই বাসাতে রাখা খুব বেশি নিরাপদ হবে না। এখন সবারই মাথা একটু গরম। তাই যত দ্রুত সম্ভব মুমুকে এই এলাকা থেকে দূরে নিয়ে যেতে হবে।
দুই
সিরাজের মাথা গরম হয়ে আছে। সে নিজের মোবাইলে তাকিয়ে অপেক্ষা করছে একটা ফোন আসার। আজকে সারাদিন সে গ্রামের সব জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছে। সব জায়গায় খুঁজে দেখেছে, কিন্তু মতিন চেয়ারম্যানের মেয়েকে এখনও খুঁজে পায়নি। মেয়েটা কোথায় গেল, সেটা সে বুঝতে পারছে না। যেদিন ওরা মিলে চেয়ারম্যানের বাড়িতে হামলা করেছিল, সেদিন তার কাছে পরিষ্কার খবর ছিল যে বাসায় মতিন চেয়ারম্যানের সাথে তার মেয়েও আছে। তার বড় ছেলে ঢাকায় ছিল, এই খবর সে জানে। হামলার সময় লোকজনের সাথে মতিন চেয়ারম্যান মারা যায়, কিন্তু মুমুকে কোথাও পায়নি। পুরো বাড়ির কোথাও মুমু ছিল না। এই অল্প সময়ের মধ্যে মুমুর পক্ষে গ্রাম ছেড়ে বাইরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। গ্রামের কারো না কারো বাসায় সে থাকবে। তারপরই সিরাজের কানে আসে যে মুমু আছে তালুকদারদের বাসায়। তালুকদারের বড় ছেলে রায়হানের চোখও যে মুমুর ওপর আছে, সেটা সিরাজ অনেক দিন থেকেই জানে। তবে এবার সে ছেড়ে দেবে না। এই মেয়েকে সে নিজের কাছে আনবেই, কোনো ছাড় সে দেবে না।
এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল। ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কাঙ্ক্ষিত কণ্ঠস্বরটা শোনা গেল। তারপর শোনা গেল তার কাঙ্ক্ষিত খবরটাও। ফোনটা কেটে দিয়ে নিজের ডান হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করল শক্তভাবে। মনে মনে বলল, “রায়হান, আজকে তোমাকে হাতের মুঠোয় পাব!”
রাত এগারোটা। সিরাজ রহিম ব্যাপারীর ঘাট থেকে কিছুটা দূরে অপেক্ষা করছে। খবর অনুযায়ী এই ঘাট দিয়েই নৌকায় উঠবে রায়হান আর মুমু। নৌকা করেই গ্রাম থেকে বাইরে যাবে। পালানোর এই পথেই সিরাজ ওদের ধরবে।
“বস!”
সিরাজ পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পিছলুর দিকে তাকাল।
“কী হলো?”
“এইখান থেকেই কি ধরবেন?”
“না। গ্রামের ভেতরে রায়হানকে কিছু করতে পারব না। তবে মাঝনদীর ব্যাপার আলাদা। ধর মাঝনদীতে ডাকাত যদি পড়ে, ডাকাতের গুলিতে সে তো মরতেও পারে! তাই না?”
পিছলু খানিকটা অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, “একেবারে ফাইনাল করে দিবেন! চান্স যখন আছে! দিতে সমস্যা কি? জানেনই তো দেশের অবস্থা এখন অস্থির। এই সুযোগ তো বারবার আসবে না।”
সিরাজ প্রথমে ভেবেছিল যে নৌকায় ওঠার সময়েই সে মুমুকে ধরবে। কিন্তু তারপরই তার মাথায় এই বুদ্ধিটা আসে। রায়হানকে যদি খতম করা যায় এই সুযোগে, তাহলে তালুকদার দুর্বল হয়ে যাবে। তালুকদারের পরে গ্রামের নিয়ন্ত্রণ তার নিজের হাতে আসবে। এই সুযোগ কোনোভাবেই হাতছাড়া করা যাবে না।
পিছলুর কণ্ঠ তখনই শোনা গেল।
“বস ঐ যে!”
সিরাজের মুখে একটা হাসি ফুটল। সিরাজ নিজেও দেখতে পেয়েছে। অন্ধকারের মধ্যেই দেখতে পাচ্ছে সে। বোরকা পরা মেয়েটাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে।
নৌকা সম্ভবত আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। দুইজন সোজা উঠে গেল নৌকায়। তারপর মাঝি সেটা নদীতে ভাসিয়ে দিল।
সিরাজ একটু সময় অপেক্ষা করল। একটু দূরে যাক সে। তারপর পিছু নেবে সে। সে ইঞ্জিন নৌকা নিয়ে পিছু নেবে। তাই ধরতে খুব বেশি সময় লাগবে না।
আধা ঘণ্টা পরে সিরাজের নৌকাটা ধরে ফেলল ওদের। তবে একটা ব্যাপার সিরাজের কাছে কেমন যেন খটকা লাগল। নৌকাটা মোটেই পালানোর চেষ্টা করেনি। ইঞ্জিনের আওয়াজ শুনেও একই গতিতে চালিয়ে গেছে। নৌকাটা পাশাপাশি আসতেই সিরাজ লাফিয়ে সেই নৌকায় চলে এল। মাঝি সিরাজের আগে থেকেই পরিচিত। সিরাজের দিকে তাকিয়ে বলল, “কী ব্যাপার ভাই? আপনি হঠাৎ?”
“কই যাও?”
“যাই একটু পাশের গ্রামে। আপনি এখানে কেন?”
“সইয়ের ভেতরে কে?”
এই প্রশ্নের উত্তর মাঝি দিল না। তার আগেই সইয়ের ভেতর থেকে একজন বের হয়ে এল। সিরাজ অবাক হয়ে তাকাল। এটা রায়হান না। ওদের গ্রামের শফিম মিয়া। রায়হানের বয়সীই। সিরাজের মনে তখন একটা প্রশ্ন জাগল। রায়হান তাহলে নিজে আসেনি? অন্য কাউকে দিয়ে পাঠিয়েছে। একটা সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেল। যাক, আপাতত মুমুকে নিয়েই সে যাবে!
সিরাজ বলল, “তোমার সাথে কে?”
শফিম মিয়া বলল, “সাথে আবার কে? আমার দোকানের পোলা। ওর সাথে পাশের গ্রামে যাই মাল নিয়ে!”
সিরাজের কথাটা মোটেই বিশ্বাস হলো না। সে স্পষ্ট দেখেছে যে বোরকা পরে একজন নৌকায় উঠেছে। সিরাজ নিজে সইয়ের ভেতরে ঢুকল এবং সত্যিই অবাক হয়ে দেখতে পেল যে একটা কম বয়সী ছেলে সইয়ের ভেতরে বসে আছে। আর কেউ নেই!
সিরাজের মাথায় কিছুতেই ব্যাপারটা ঢুকল না। তাহলে?
ঠিক একই সময়ে রহিম ব্যাপারী ঘাটের উল্টো দিকের গ্রামের প্রধান সড়ক দিয়ে একটা বাইক দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। বাইকে দুইজন আরোহী। পেছনে বসা মেয়ে যাত্রীর ভয়ে কাঠ হয়ে আছে।
তিন
বাইকটা এসে থামল একেবারে সীমান্তের কাছে। এখানে কাঁটাতারের একটা বেড়া দেওয়া রয়েছে। বেড়ার ঠিক নিচেই রয়েছে একটা গর্ত। এই গর্ত দিয়েই দীর্ঘদিন চোরাচালানির কাজকর্ম চলে এই রাস্তায়।
মুমু যখন অন্ধকার বনের ভেতরে এসে থামল তখন ওর মনে ভয়টা আবার বেড়ে উঠল। গ্রামের ভেতর দিয়ে যখন বাইকে করে আসছিল তখন বারবার মনে হচ্ছিল যে এই বুঝি ওদের পিছু কেউ নেবে। তবে অদ্ভুতভাবে কেউ ওদের পেছনে আসেনি। হতে পারে কেউ ভাবতেই পারেনি যে রায়হান ওকে সোজা রাস্তা দিয়েই নিয়ে যাবে। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক বাইক চালানোর পর ওরা এই সীমান্তে এসে হাজির হয়েছে।
বাইকটা থামতেই মুমু নেমে এল। বাইকের আলোতেই মুমু মানুষটাকে দেখতে পেল। নিজের চোখকে যেন সে বিশ্বাস করতে পারল না। এই কয়েকদিনে সে নিজের জীবনের আশা ছেড়েই দিয়েছিল। নিজের আপন কাউকে সে দেখবে, সেটা কল্পনাতেও আনতে পারেনি।
“ভাইয়া!”
মুমু দৌড়ে গিয়ে তার ভাই মারুফকে জড়িয়ে ধরল। হামলার সময়ে তার ভাই মারুফ ছিল ঢাকায়। তাই গ্রামের হামলা থেকে সে রক্ষা পেয়েছে।
মুমুর এখনও ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না যে রায়হান ওকে তার ভাইয়ের কাছে নিয়ে এসেছে। সত্যিই বিশ্বাস হচ্ছে না। এই মানুষটা গ্রামে তাদের প্রধান শত্রু ছিল। এমনকি ওর ভাইয়ের সাথে রায়হানের কয়েকবার হাতাহাতি পর্যন্ত হয়েছে। আর এই রায়হান কিনা ওকে নিরাপদে মারুফের কাছে নিয়ে এসেছে!
“বেশি সময় নেই আমাদের হাতে!”
রায়হানের কণ্ঠে একটা উৎকণ্ঠা। মারুফ বলল, “হ্যাঁ, আমাদের যেতে হবে!”
আজ মারুফ ইন্ডিয়াতেই পালাবে ওর বোনকে নিয়ে। মারুফ তার বাবার মৃত্যুর খবর ঠিকই পেয়েছিল। গ্রামে আসতে চেয়েছিল বটে, তবে সে খুব ভালো করেই জানত যে গ্রামে আসা মানেই মৃত্যু বরণ করা। ভারতে পালিয়ে যাওয়ার একটা ব্যবস্থা সে করেছিল, কিন্তু নিজের বোনের কোনো খোঁজই বের করতে পারেনি। গ্রামের পরিচিত অনেকের কাছেই খোঁজ নিয়েছে। কেউ বলতে পারেনি। তখনই এমন একজনের কাছ থেকে ফোনটা এল, যেটা সে মোটেই বিশ্বাস করতে পারেনি। প্রথমে মনে হয়েছিল যে ওকে ধরার জন্যই রায়হান ফাঁদ পাতছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও মারুফ রাজি হয়েছে এখানে আসতে। রায়হান জানিয়েছিল যেন সব ব্যবস্থা করে সে ওকে ফোন দেয়। মুমুকে সঠিক জায়গা পর্যন্ত নিয়ে আসার দায়িত্ব ওর নিজের! আজ সত্যিই মুমুকে নিয়ে সে হাজির হয়েছে।
মারুফ মুমুকে একপাশে সরিয়ে রেখে রায়হানকে জড়িয়ে ধরল। তারপর ধরা গলায় বলল, “তোমার এই ঋণ আমি কোনোদিন শোধ করতে পারব না।”
“শোধ করতে হবে না। মনে রেখো। আর একটা কথা। আমি কিংবা আমার বাবা তোমাদের বাসায় হামলা করিনি। তুমি আমার বাবাকে চেনো! চেনো না?। তুমি ভালো করেই জানো কারা হামলা করেছিল।”
“আমি জানি। তবুও তোমার এই সাহায্যটা কখনো ভুলব না। তবে তোমরা সাবধানে থেকো।”
“তোমার দুশ্চিন্তা করতে হবে না।”
মারুফ আর কিছু না বলে গর্তের দিকে পা বাড়াল।
যাওয়ার ঠিক আগে মুমু এগিয়ে এল রায়হানের দিকে । আবছা অন্ধকারের রায়হানের চেহারা দেখা যাচ্ছে। চোখ দুটো কেমন আকুল চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মুমু কোন দিন রায়হানকে পছন্দ করে নি । বিশেষ করে বাবার প্রতিপক্ষের ছেলে হওয়ার কারণে কোনদিন রায়হানকে সে পছন্দ করে নি । আজকে প্রথমবারের মত সে রায়হানকে অন্য চোখে দেখল । মৃদু স্বরে বলল, থ্যাঙ্কিউ !
-ইউ আর ওয়েলকাল !
-যদি আবার কোন দিন আমাদের দেখা হয়, তাহলে আপনাকে……
মুমু কথাটা শেষ করল না । তবে রায়হান সেই না বলে কথাটাও যেন বুঝতে পারল । মৃদু স্বরে হাসল সেও ।
ওদের চলে যাওয়া পথে দিকে একভাবে তাকিয়েই রইল । অন্ধকারে যখন একেবারে চোখের আড়াল হয়ে গেল তখন মনের ভেতরে একটা অদ্ভুত বিষন্নতা চেয়ে ধরল রায়হানকে । চাইলেই রায়হান মুমুকে নিজের কাছে রেখে দিতে পারত । কিন্তু যাকে ভালবাসা যায় তার উপরে জোর খাটানো যায় না । আমরা পৃথিবীর সব মানুষের উপরে জোর খাটাতে পারলেও ভালবাসার মানুষের উপরে কখনই জোর খাটাতে পারি না।
পরিশিষ্ট
কেটে গেছে অনেক কয়টা বছর । সব কিছু আবার আগের মত হয়ে গেছে ।
রায়হান এখন ঢাকাতে থাকে স্থায়ী ভাবে। গ্রামের রাজনীতি থেকে নিজেকে একেবারে সরিয়ে নিয়ে এসেছে । ওর ছোট ভাই অবশ্য বাবার সাথে রাজনীতিতে আছে । যদিও আবারও ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে তবে এবার আর রক্তপাতের মাধ্যমে নয় । সুষ্ঠ নির্বাচনের মাধ্যমে । তবে তার বাবা এখন গ্রামের চেয়ারম্যান হয়েছে। এদিকে ঐ ঘটনার মাস ছয়েকের ভেতরেই মুমু আর মারুফ দেশে ফিরে এসেছিল । মারুফ এখন তাপর দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা । ত্যাগ স্বীকারের জন্য তার দল তাকে বেশ ভাল ভাবেই স্বীকৃতি দিয়েছে।
-আসব?
রায়হান নিজের অফিসের কেবিনে একটা পরিচিত চেহারাকে দেখতে পেল । হাসি মুখে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
রায়হান হাসল । তারপর বলল, এসো।
মুমু মৃদু পায়ে কেবিনের ভেতরে ঢুকল । এখন মুমু ঢাকাতে ভাইয়ের থাকে । বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষে পড়ছে। দেশে ফিরে প্রথমেই সে রায়হানের সাথে দেখা করেছে। তারপর রায়হান যখন ঢাকাতে থিতু হল তখন থেকে মুমু প্রায়ই রায়হানের সাথে দেখা সাক্ষাত শুরু করে । যদিও দুইজের কেউই নিজেদের মনের কথা বলে নি । তবে নিজেদের আচরণে তারা একে অন্যকে এটা ঠিকই বোঝাতে পেরেছে তারা একে অপরকে পছন্দ করে। আজকেও মুমু এসেছে রায়হানের কাছে । একটু পরেই অফিস শেষ হবে । ওকে নিয়ে বাইরে যাবে।
আজকে সে মনে মনে ঠিক করেই এসেছে যে রায়হানকে সে মনের কথা বলবেই। এই কারণে সব নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে এসেছে। আজকে তাকে মনের কথা গুলো বলতেই হবে।