তেল পাম্পটার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে রইলাম। নামটা পড়লাম আরেকবার। ‘এনায়েত ফিলিংস্টেশন’। নিজের দেশে এমন কোন নাম দেখলে আমি হয়তো অবাক হতাম না তবে এই ইংল্যান্ডের মত স্থানে এসে এই নামের তেলপাম্প দেখতে পাব সেটা অবশ্য আমি ভাবি নি । নামটা যদিও ইংরেজিতেই লেখা তারপরেও আমার কাছে এই নামটা একটু বেমামানই মনে হল ! অন্য কোন নাম দিলেই হয়তো ভাল হত।
অবশ্য আমার এতো কিছু চিন্তা করার সময় নেই । তেলপাম্পের দিকে এগিয়ে গেলাম । উইনচেস্টার শহরের সেন্ট ক্যাথেরিন হিলের পাশ দিয়ে যে হাইওয়েটা চলে গেছে সেটার পাশে এই পাম্পটা অবস্থিত । এটা মূল শহর থেকে অনেকটাই দুরে। গাড়িতে করে যেতেই কম করে হলে মিনিট বিশেক সময় লাগবে। এটা মূলত শহর থেকে বের হয়ে পরে শহরের দিকে যাওয়ার জন্য যে হাইওয়ে রয়েছে সেটার পাশে অবস্থিত। এটার আশে পাশে অন্য কোন দোকান পাট নেই । এছাড়া এটা শুরু যে তেলের পাম্প সেটাই না, এটা একই সাথে খানিকটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরও । এখানে খাবারের সব কিছু পাওয়া যায় । হাইওয়ে দিয়ে যাওয়া গাড়ি গুলো এখানে থেমে তেল নেয়, সেই একই সাথে খাবারের জিনিসপত্র সহ আরও নানান জিনিসপত্র কেনে। একপাশে একটা ওয়াশরুমও রয়েছে।
আমি কাঁচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম । দেখলাম পুরো দোকানটা একেবারে ফাঁকা । আসার সময়ে কোন গাড়ি আমি সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি নি । তাই স্বাভাবিক ভাবেই বলা যায় এখন কোন কাস্টমার থাকবে না ।
আমি ঢুকতেই দরজার আপনা-আপনি একটা আওয়াজ শুনতে পেল । টুংটাং টাইপের একটা শব্দ। কেউ যে এসেছে সেটার ইঙ্গিত । দেখলাম দোকানের ভেতরে কাউন্টারের পাশে ডান দিকে একটা দরজা খুলে গেল । দরজা দিয়ে একজন মাঝবয়সী লোক বের হয়ে এল । আমার দিকে তাকিয়ে একটু যেন হাসল । তারপর বলল, আরে তুমি চলে এসেছো?
আমি হাসার চেষ্টা করলাম । সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এসো !
আমি আসলে এই তেলপাম্পে কাজের জন্য এসেছি । যদিও আজকেই আমার প্রথম আসা এখানে, মালিকের সাথে কথা বলার জন্য তবে আমি নিশ্চিত জানি যে আমার এখানে চাকরিটা হয়ে যাবে। জামাল ভাই আমাকে অনেকটাই নিশ্চিত করেই জানিয়েছেন যে এখানে চাকরিটা আমার হবে । এই ভদ্রলোক এই পাম্পের জন্য কোন লোক খুজে পাচ্ছেন না। রাতের ডিউটি দেওয়ার জন্য নাকি একজনকে দরকার । কেউ নাকি থাকতে চায় না বেশি দিন। কেন থাকতে চায় না সেটা অবশ্য আমাকে বলেন নি।
আমার ব্যাপারটা জামাল ভাই জানেন ভাল ভাবেই। আমি চোখ তুলে তাকাতেই জামাল ভাই বললেন, চিন্তা কর না । তোমার পার্মিট কোন ইস্যু হবে না । সেই সাথে ওখানে যদি থাকতে পারো তাহলে এনায়েত ভাই ব্যাপারটা সামাল দিবেন !
আমি ইংল্যান্ডে মোটামুটি বছর তিনেক ধরে আছি । প্রথম দুই বছর আমার ভিসা ছিল । এখানে এসেছিলাম পড়াশোনা করতে তবে সেটা আর চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হয় নি । এমবিএটা আমি শেষ করতে পারি নি । ভেবেছিলাম যে পার্টটাইম চাকরি করেই পড়াশোনার খরচটা উঠিয়ে ফেলব তবে সেটা আর সম্ভব হয় নি । এখানে আমি প্রায় এক বছর ধরে অবৈধ ভাবে রয়েছে । যদি পুলিশ আমাকে ধরে তাহলে সোজা দেশে পাঠিয়ে দেবে। আগে কয়েকদিন জেলের ভাত খাওয়াতেও পারে। আর পার্মিট নেই বলে কোথাও ঠিক মত চাকরিও পাচ্ছি না । চোখে মুখে যখন দিশেহারা ভাব দেখতে পাচ্ছি তখন এই চাকরির খোজ দিয়েল জামাল ভাই । তিনি জানালেন যে এখানে যদি চাকরি করতে রাজি থাকি তাহলে চাকরিটা আমার হবে !
আমি দেখলাম দোকানের একদম কোনার দিকে দুটো ছোট চেয়ার টেবিল রাখা । এখানে বসে খাওয়া দাওয়া করার জন্য ! এনায়েত সাহেব আমাকে নিয়ে সেদিকেই গেলেন । ফ্রিজ থেকে দুটো জুসের প্যাকেট বের করে এনে রাখলেন টেবিলের উপরে । আমরা সেখানে বসলাম । আমাকে নানান প্রশ্ন করতে লাগলেন । বিশেষ করে দেশের কোথায় থাকতাম, কে কে আছে, বাবা মা কী করে এই টাইপের । তারপরই আসল প্রশ্ন করলেন যে আমি এই চাকরিটা করতে চাই কিনা ! আমি বললাম যে যে কোন কিছুর বিনিয়ে আমি এই চাকরিটা করতে চাই। আমি যদি চাকরি না জোগার করতে পারি তাহলে আসলে আমাকে হয় না খেয়ে মরতে হবে নয়তো দেশে ফিরে যেতে হবে ! দেশে গিয়েও যে কিছু হবে সেটাও নিশ্চিত না।
এনায়েত সাহেবকে মনে যেন আমার কথা শুনে খানিকটা সন্তুষ্ট হলেন । কিছু সময় ভাবলেন কী যেন । তারপর বললেন, দেখ আমার আরও কয়েকটা ফুয়েল স্টেশন আছে। তবে এটা অন্যগুলোর থেকে আলাদা ! এখানে দিনের বেলা লোকজন ঠিক আসেও না । এখানে মূলত রাতে মানুষজন আছে । রাতের বেলা মালবাহী অনেক গাড়ি যায় এই রাস্তা দিয়ে । এছাড়া আরও অনেকেই আসে । তারা তেল যেমন নেয় একই সাথে এখান থেকে খাবার দাবারসহ নানা নানান রকম জিনিস নেয় । আমার এই রাতের শিফটের জন্য লোক দরকার । সন্ধ্যা সাতটা থেকে ভোর ছয়টা পর্যন্ত !
আমি সাথে সাথে বললাম, আমি পারব । কোন সমস্যা নেই।
-গুড ! তাহলে কবে থেকে কাজে যোগ দিতে পারবে?
-আপনি বললে আজ থেকেই ।
-বেশ তাহলে । আজ থেকেই কাজে গেলে যাও । তুমি যদি চাও পাশের এই ঘরে থাকতেও পার। আমার আগের এমপ্লোয়ী এখানেই থাকত ।
এটা যেন আমার কাছে মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মত হয়ে গেল।
এরপর তিনি আমার বেতনের ব্যাপারে কথা বললেন । ঘন্টা প্রতি কত টাকা দিবেন এই ব্যাপারে আমাদের মাঝে একটা আলোচনা হল । এও জানালেন যে ঘরে থাকার জন্য কোন টাকা দিতে হবে না । তবে সবার শেষে একটা কথা বললেন যা শুনে আমার একটু অদ্ভুত মনে হল । তিনি আমার থেকে দোকানের ডান দিকে থাকা কালো রংয়ের একটা ফ্রিজের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন এই ফ্রিজের ব্যাপারে একটা বিশেষ ব্যাপার লক্ষ্য রাখতে হবে তোমাকে ।
-কী বিশেষ ব্যাপার?
-এর ভেতরে ছাইয়ের একটা জাতীয় প্যাকেট থাকে । ওটার ভেতরে কী আছে সেটা তোমার জানার দরকার নেই । রাতের বেলা এমন কিছু মানুষ আসবে যারা সরাসরি এই ফ্রিজে এসে এই প্যাকেট গুলো নিবে। কেউ হয়তো এই প্যাকেট নিয়ে তোমার সামনে দিয়ে চলে যাবে কোন টাকা পয়সা না দিয়েই। তুমি তাদের থামাবে না।
-থামাবো না?
আমি একটু অবাক না হয়ে পারলাম না । দোকান থেকে যে কেউ আসবে জিনিস নিয়ে চলে যাবে আআর আমি কোন টাকা নেব না?
আমার চোখে অবাক ভাবটা দেখেই সম্ভবত এনায়েত সাহেব বললেন, অন্য যে কোন জিনিসের বেলাতে অবশ্যই দাম নেবে । কিন্তু যখন কেউ এই কালো ফ্রিজের সামনে আসবে এবং এর ভেতর থেকে ছাই রঙয়ের জুসপ্যাক বের করবে তখন তুমি সেটা দেখেও না দেখার ভান করবে। তবে কেউ যদি এই প্যাকেট ছাড়াও আরও কিছু নেয় এক সাথে সেই ক্ষেত্রেই অন্য সেই জিনিসের দাম রাখবে। ঠিক আছে? তোমার আর কোন চিন্তা করতে হবে না । আর কিছু ভাবতেও হবে না তোমাকে ! ঠিক আছে?
আমি মাথা নাড়ালাম । দোকানের মালিক যা বলবে আমার সেই মোতাবেক চললেই হবে। আমার কাজ শুধু আম খাওয়া । গাছের সংখ্যা দিয়ে আমি কী করব !
ওইদিন বিকেলেই আমি চলে এলাম । আমার সাথে অবশ্য খুব বেশি জিনিসপত্র নেই । আমি দুইটা ব্যাগ আর দরকারি কিছু জিনিস নিয়ে আমি হাজির হয়ে গেলাম। বিকেলের ভেতরে নিজের ঘর গুছিয়ে নিলাম। বিকেলের ভেতরে এনায়েত সাহেব আমাকে আরও কিছু জিনিসপত্রের ব্যাপারে জ্ঞান দিয়ে চলে গেলেন।
সন্ধ্যার ঠিক পরপরই আমি অনুভব করলাম যে এলাকাটা একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। কেবল কিছু সময় পরপর হাইওয়ে দিয়ে গাড়ি চলে যাওয়ার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া আর কোন আওয়াজ নেই। আমি যদিও সারা জীবনই একা একা থাকতে পছন্দ করি কিন্তু এই নিঃসঙ্গতা আমার কেন জানি ভাল লাগল না । বিশেষ করে একটা ভয়ের অনুভূতি। এই অনুভূতি আমি লিখে ব্যাখ্যা করতে পারব না । একটা অচেনা অনুভূতি এসে আমাকে ঘিরে ধরল । এই অনুভূতির ব্যাখ্যা আমার কাছে জানা নেই।
কয়েকজন এলো ফুয়েল নিতে । তবে তারা দোকানের ভেতরে প্রবেশ করল না। বাইরের ফুয়েল মেশিনটা একেবারেই কার্ড সিস্টেম । যারা তেল নিতে আসে তারা নিজেদের ক্রেডিট কিংবা ডেভিট কার্ড মেশিনের ভেতরে প্রবেশ করায় এবং টাকার পরিমান প্রবেশ করায় । সেই পরিমান তেল গাড়িতে ঢোকে । মূলত রাতের এই ধরনে ফুয়েল স্টেশনে ডাকাতি হতে পারে। সেই জন্য পুরো ব্যাপারটাই কার্ডে হয়ে থাকে । এছাড়া যাদের কাছে কার্ড নেই তারা আমার কাছ থেকে ফুয়েল কার্ড কিনে নেতে পারে । এই টাইপের ফুয়েল কার্ড অনেক জায়গায় পাওয়া যায় ।
কিন্তু বারোটার পরে পরিস্থিতি কেমন যেন বদলে গেল ! আমি ডেস্কের ওপাশে বসে ছিলাম । নিজের মোবাইল টিপতেই ব্যস্ত ছিলাম । আসলে আর কোন কাজও ছিল না। ঠিক এই সময়ে দেখতে পেলাম একজন মানুষ দোকানের ভেতরে প্রবেশ করলো। অবশ্য না তাকালেও আমি এমনিতেই বুঝতে পারতাম । কারণ দরজা খুললেই সেই বেলটা বেজে উঠে ।
লোকটা আমার দিকে একবারের জন্যও ফিরে তাকাল না । আমি মানুষটাকে দেখার চেষ্টা করলাম। মানুষটার বয়স আমার থেকে কয়েক বছর বড় হবে । তবে তার চেহারা খুবই গম্ভীর । পরণে কালো রংয়ের ওভারকোট । হাতে কালো গ্লোভস । ভেতরে জিন্সে আর শার্ট। দোকানের ভেতরে তার চলাচল দেখেই আমার বুঝতে কষ্ট হল না যে এই দোকানে সে নিয়মিত আসে। নিজের মত হেটে সে কালো রঙয়ের ফ্রিজটার দিকে এগিয়ে গেল । তারপর সেখান থেকে একটা প্যাকেট বের করল । সেটা নিয়ে আবার আগের মত আমাকে পরিপুর্ণ ভাবে উপেক্ষা করে দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল।
আমি কিছু সময় বিমূঢ় হয়ে বসেই রইলাম । এনায়েত সাহেবের কথাগুলো আমি আরেকবার মনে করার চেষ্টা করলাম । তিনি আমাকে বলেছিলেন যে ওদের নিয়ে আমাদের চিন্তা করার কোন দরকার নেই । ওরা আসবে চলে যাবে । এটা নিয়ে আমার চিন্তার কোন কারণ নেই ।
ঘন্টা খানেকের মধ্যে কম করে হলেও আরো দশ এগার জন মানুষ এলো দোকানে এবং আগের মত করেই আমাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে প্যাকেন নিয়ে চলে গেল। সবার মাঝেই এমন একটা ভাব যেন আমি এখানে নেই। তবে রাত দুইটার দিকে একটা মেয়েকে দেখলাম । মেয়েটাকে দেখলাম পুরোপুরি কালো পোশাক পরা। অনেকটা লেটাক্সের টাইট ফিটিং ড্রেস । দেহের সাথে পুরোপুরি আটাসাট করে জড়িয়ে আছে দেহের সাথে । হাতে লেটাক্সের গ্লোভস! সত্যিই বলতে আমার পক্ষে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে না থাকা সম্ভব হল না।
তবে এই মেয়েটা অন্য মানুষ গুলোর মত আমাকে একেবারে উপেক্ষা করে চলে গেল না । আমি দেখলাম মেয়েটি সেই প্যাকেট বাদ দিয়ে আরও কিছু জিনিসপত্র নিল। তারপর আমার দিকে এগিয়ে এল । আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি নতুন এখানে?
-হ্যা ।
-গুড । কদিন টেকো সেটাই দেখার ব্যাপার ।
এই বলে মেয়েটা হাসল। আমার দিকে নিজের জিনিসপত্র গুলো এগিয়ে দিল। আমি হিসাব করে জিনিসগুলো ব্যাগে ভরে দিলাম। দেখলাম সে ক্যাশ পাউন্ডে পরিশোধ করল । তারপর চলে গেল । আমি তার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম কেবল ! মেয়েটাকে আমার কেন জানি স্বাভাবিক কেউ মনে হল না । বিশেষ করে কেউ কি এতো সুন্দর হতে পারে?
সপ্তাহ দুয়েকের ভেতরে আমি নতুন এই জীবনে পুরোপুরি অভ্যস্ত হয়ে উঠলাম । প্রতিদিনের একই রকম রুটিন। সন্ধ্যা সাতটার দিকে আমি দোকানের কাউন্টারে এসে বসি। এই সময়ে এনায়েত সাহেবই এখানে থাকেন । আমাকে কাউন্টার ছেড়ে দিয়ে চলে যান । এই ফাঁকে টুকটাক কথা হয়। এরপর আমি বসি কাউন্টারে । রাত দশটা এগারোটার আগে দোকানে তেমন কোন কাস্টমার আসে না। আসলেও বেশির ভাগই বাইরে থেকে তেল নিয়ে চলে যায়। এরপর রাত যখন বাড়ে তখন আস্তে আস্তে আমাদের কাস্টমার আসতে শুরু করে যাদের বেশির ভাগই আমার দিকে ফিরেও তাকায় না । তারা দোকানের দরজা খুজে ভেতরে ঢোকে । কালো ফ্রিজের কাছে যায়। প্যাকেট নিয়ে আবার চলে যায় । তবে কয়েকজন প্যাকেট ছাড়াও আরও নানান জিনিসপত্র কেনে । কাউন্টারে এসে বিল পরিশোধ করে । সেই মেয়েটাও আসে প্রতিদিন । বেশ রাত করেই সে আসে । আমি খেয়াল করেছি যে মেয়েটা বাইক চালিয়ে আসে। বাইক চালায় বলেই এমন টাইট ফিটিং পোশাক করে। অন্যেরা যারা আসে সবাই নিজেস্ব গাড়ি নিয়ে আসে । কেউ কেউ আবার হেটেই আসে ।
মোটামুটি রাত তিনটা পর্যন্ত চলে এদের আনাগোনা। তারপর আর কেউ আসে না। এনায়েত সাহেব আমাকে বলেছিলেন যে ভোর ৫টার পরে চাইলে আমি দোকানের মেইন দরজার বন্ধ করে দিয়ে ঘুমাতে চলে যেতে পারি। কোন সমস্যা নেই। বাইরের ফুয়েল মেশিন সব সময়ই চালু থাকে তাই চাইলেই কেউ তেল নিতে পারবে । কোন সমস্যা হবে না। সকালের দিনে দোকান বন্ধই থাকে । আমার ঘুম ভাঙ্গে দশটার দিকে । প্রায় দিনই আমিই দোকানের ঝাঁপ খুলি। বিকেল তিনটার দিকে এনায়েত সাহেব আসেন । দোকানের খোজ খবর নেন । ক্যাশের হিসাবটা একটু দেখেন তবে আমার কাছে মনে হয়েছে যে এসব তার কাছে জরুরী কিছু না । তেমন মনযোগ দিয়ে তিনি তা দেখছেন না । দুইদিন পরপরই তিনি একটা সাপ্লাই ট্রাকের সাথে আসেন । সেখানে কালো ফ্রিজে সেই প্যাকেট ভরা হয় ।
আমি একবার যখন জানতেই চাইলাম ফ্রিজে রাখা ঐ প্যাকেটে আসলে কী আছে তখন এনায়েত সাহেব একটু বিরক্ত হলেন । জানালেন যে সেটা আমার না জানলেও চলবে । আমি যেন সেদিকে বেশি মনযোগ না দিই। রাতের বেলা আমি নিজে একবার কৌতুহল নিয়ে ফ্রিজ খুলতে গিয়েছিলাম । তখনই তীব্র বিস্ময় নিয়েই খেয়াল করে দেখলাম যে ফ্রিজটা আমি খুলতে পারলাম না । কোন ভাবেই সেটা আমি খুলতে পারলাম না। কোন ভাবে সেটা লক করা । কিন্তু যখন একজন কাস্টমার এসে সেটাতে হাত দিল তখন সেটা খুলে গেল আমি সত্যিই ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম না !
আগে আমি পুরোটা সময় দোকানের ভেতরেই থাকতাম । রাতে এবং দিনে । আমার ঘরের একপাশে একটা ছোট চুলা রয়েছে । সেখানেই আমি নিজের রান্না করে নিতাম । এই স্টোরে শুকনো খাবার পাওয়া গেলেও কোন কাঁচা মাংস পাওয়া যেত না । আমি প্রথম সপ্তাহের বেতন পেয়ে শহরে গিয়ে হাজির হলাম । এনায়েত সাহেব আমার যাতায়াতের জন্য একটা সাইকেলের ব্যবস্থা করে দিলেন । মূলত এর পরেই আমার বাইরে যাতায়াত শুরু হল । এদিক ওদিক ঘুরতে লাগলাম মাস খানেক শান্তিতেই কেটে গেল এভাবে । তারপর প্রথম ঝামেলাটা শুরু হল।
সেদিনও সব কিছু স্বাভাবিক ভাবেই আমার কাজ শুরু হল। রাত এগারটার কিছু পরে একজন সাধারণ কাস্টমার এসে ঢুকল । আমি জানালা থেকেই দেখতে পেলাম লোকটা লরি ড্রাইভার। তেল নিয়ে সে দোকানের ভেতরে ঢুকল। তারপর টুকটাক জিনিস পত্র নিতে শুরু করল । ঠিক সেই সময়ে এনায়েত ফিলিংস্টেশনের সেই বিশেষ কাস্টমারদের একজন এসে দোকানে ঢুকল । যথারীতি আমার এবং সেই লরি ড্রাইভারের দিকে না তাকিয়ে কালো ফ্রিজের দিকে চলে গেল। প্যাকেট বের করে নিয়ে আবার দরজার দিকে হাটা দিল ।
লরি ড্রাইভার সভব সেই কাস্টমারের দেখাদেখি কালো ফ্রিজের কাছে গিয়ে হাজির হল। তারপর সেটা খোলার চেষ্টা করল । কিন্তু সেটা খুলল না।
আমি সেটা দেখেই এগিয়ে গিয়ে বললাম, আপনার কী দরকার?
লরি ড্রাইভার বলল, এটার ভেতরে কী আছে?
-আপনার দরজার এমন কিছু নেই। আপনার কী লাগবে বলুন ।
-ঐ যে ঐ মেয়েটা নিল । ঐ প্যাকেটটা । আর ঐ মেয়েটা খুলতে পারল আমি কেন পারছি না?
-কারণ এটা ওদের জন্য । আমাদের জন্য না । আমিও এই ফ্রিজ খুলতে পারি না।
লোকটা আমার দিকে অদ্ভুত চোখে কিছু সময় তাকিয়ে রইল । তারপর বলল, তাহলে আমাকে ঐ মেয়ের কাছ থেকেই নিতে হয় জিনিসটা । দেখতে হবে কী আসে ওটার ভেতরে !
আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই লরি ড্রাইভার দৌড়ে বের হয়ে গেল দরজা দিয়ে। আমি তার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তখনই আমার মনে হল যে কিছু একটা সমস্যা হবে । কেন এমন কথা মনে হল সেটা আমি নিজেই জানি না । কেবল মনে হল আর কী !
কিন্তু একেবারে সকাল বেলা পর্যন্ত যখন লরি ড্রাইভার ফিরে এল না এবং তার লরি ট্রাকটা আমাদের ফিলিং স্টেশনের সামনেই দাঁড়িয়ে রইল তখন মনে হল যে কিছু না কিছু সমস্যা হয়েছেই। আমার এখন কী করা উচিৎ আমি বুঝতে পারলাম না । প্রথমেই মনে হল পুলিশকে ফোন দিই কিন্তু সেটা দিতে পারলাম না । কারণ পুলিশ আসলে তারা আমার ব্যাপারে জেনে যেতে পারে। এ ঝুকি আমি নিতে পারি না।
আমি এনায়েত সাহেবকে ফোন দিয়ে সব কিছু জানালাম। দেখলাম তিনি ঘন্টা খানেকের ভেতরেই চলে এল । তার মুখের ভাব দেখেই আমার মনে হল যে তিনি বেশ চিন্তিতবোধ করছেন ।
চলবে…
ফেসবুকের অর্গানিক রিচ কমে যাওয়ার কারনে অনেক পোস্ট সবার হোম পেইজে যাচ্ছে না। সরাসরি গল্পের লিংক পেতে আমার হোয়াটসএপ বা টেলিগ্রামে যুক্ত হতে পারেন। এছাড়া যাদের এসব নেই তারা ফেসবুক ব্রডকাস্ট চ্যানেলেও জয়েন হতে পারেন।
সরাসরি মেসেজ পাঠাতে চিঠি.মি এপ ব্যবহার করুন।
গত দুই সপ্তাহ ধরে যে কী পরিমান মানসিক অশান্তির ভেতরে আছি সেটা আমি নিজে বোঝাতে পারব না । দিনে কিংবা রাতে কোন কিছুতেই যেন মন বসছে না। এতোগুলো বাচ্চাকে মেরে ফেলল !
Discover more from অপু তানভীর
Subscribe to get the latest posts sent to your email.