চলতে ফিরতে আমাদের মানুষের সাথে প্রায়ই দেখা হয়ে যায়। একজনের সাথে প্রায়ই দেখা হওয়াটা স্বাভাবিক ব্যাপার। বিশেষ করে দুইজন যদি একই এলাকায় থাকে তাহলে দেখা হওয়াটা কোনো আশ্চর্যের ব্যাপার না। তবে আমার কাছে অবাকের ব্যাপার হয় যখন একজনের সাথে আমার প্রতিদিন দেখা হয়ে যায় এবং মানুষটিকে আমি চিনি না, তখন!
ছেলেদের ব্যাপারে একটা সাধারণ ব্যাপার হচ্ছে তারা চলতে ফিরতে মেয়েদের খেয়াল করবেই। আমি যদিও নিজেকে ঐ সব পুরুষের দলে ফেলতে চাই না যারা সারাক্ষণ মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকে, তবে আমি যে একেবারেই তাকাই না, সেটা বললে মিথ্যা বলা হবে। আমিও সুন্দরীদের দিকে তাকাই। এইভাবেই মেয়েটির সাথে আমার প্রথম দেখা!
আরও ভালো করে বললে, সেদিনই আমি মেয়েটিকে প্রথম দেখতে পেলাম। কেবল মেয়ে বলেই নয়, তাকে খেয়াল করার আরেকটি কারণ অবশ্য ছিল। সেটি হল তার পরণের পোশাক। প্রথম মেয়েটিকে আমি দেখলাম সাদা কামিজ আর সাদা লেগিংসে। সত্যি বলতে, সেদিনই আমি মেয়েটিকে ভালো করে খেয়াল করলাম। এর আগে সে আমার সামনে দিয়ে কখনও গেছে কিনা আমি জানি না। সেদিকে আমি খেয়াল করিনি। সেদিনই প্রথম আমি মেয়েটিকে খেয়াল করেছিলাম। এবং তারপর থেকে প্রতিদিন ঠিক একই সময়ে মেয়েটির সাথে আমার দেখা হতে লাগল।
দেখা হতে লাগল বলতে আমি যখন দুপুর বেলা ভাত খাওয়ার জন্য বের হতাম, মেয়েটিও ঠিক উল্টো দিক থেকে আসত। আমাদের দেখা হত মাঝ বরাবর। এই ঘটনা পরপর সাত দিন ঘটল। আমি যে সময় বের হতাম, মেয়েটিও সেই সময় বের হত। সম্ভবত আমার সামনের কোনো গলিতে থাকে মেয়েটি। এই সময়ে সম্ভবত মেয়েটির অফিস কিংবা ক্লাস থাকে। এই কারণে দেখা হয়।
আটদিনের দিন মেয়েটির সাথে আমার কথা হল। একটু অদ্ভুত ভাবেই। সেদিন দুপুরে একবার আমাদের দেখা হয়েছে। রাতের বেলা আমি খেয়ে বাসায় ফেরার সময় রাস্তার এক বাদাম কিনি। সেদিনও কিনতে গেলাম। কিন্তু কিনতে গিয়েই দেখি সেখানে সেই মেয়েটি দাঁড়িয়ে বাদাম কিনছে। তবে আরও কাছে গিয়ে বুঝলাম যে মেয়েটির কাছে বড় একটা নোট। ২০ টাকার বাদামের জন্য বাদামওয়ালা সেই নোট ভাঙিয়ে দিতে নারাজ। আমার একজায়গায় মনে হল যে এসব ঝামেলার দরকার নেই। আমি আমার বাদাম কিনে নিয়ে চলে যাই, কিন্তু কেন জানি মনে হল মেয়েটিকে সাহায্য করি। আমি বললাম, আমার কাছে খুচরা আছে!
মেয়েটি আমার দিকে ফিরে তাকাল। মুখে একটা হাসি দেখতে পেলাম সাথে সাথেই। তবে তারপর বললাম, আচ্ছা আমি বরং আপনাকে বাদাম কিনে দিই, আপনি আমাকে পরে টাকা দিয়ে দেবেন যদি সমস্যা না থাকে। আপনি সম্ভবত আশেপাশেই থাকেন। অন্তত আপনাকে দেখি তো প্রতিদিনই দুপুরে বের হন।
মেয়েটি বলল, আমিও খেয়াল করেছি?
-হ্যাঁ। প্রায়ই আমাদের দেখা হয়!
-প্রায়ই না, প্রতিদিন। দুপুরে আমার একটা ক্লাস থাকে ২৭ নম্বরে। সেখানে যাওয়ার জন্য বের হই। আর আপনিও এই সময়ে বের হন!
আমি হেসে ফেললাম। বাদামওয়ালার কাছ থেকে দুই প্যাকেট বাদাম নিয়ে আমরা হাঁটতে লাগলাম। আমি বললাম, হ্যাঁ ঐ সময়ে আমি দুপুরের খাবার খেতে বের হই!
মেয়েটি খানিকটা কৌতূহল নিয়ে বলল, খেতে যান বলতে?
-হোটেলে?
-নিয়মিত হোটেলে খান?
-হ্যাঁ।
-কেন? স্ত্রী সাথে থাকে না? সরি ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে ফেললাম।
আমি হেসে ফেললাম। এই প্রশ্নটা আমাকে প্রায়ই শুনতে হয়। বিশেষ করে যারা শোনে যে আমি নিয়মিত বাইরে খাওয়া দাওয়া করি, তারা সবাই প্রথমে আমাকে এই কথাটা বলে। আমি বললাম, না ঠিক আছে সমস্যা নেই। আমি আসলে এই প্রশ্নটা আগে অনেকবারই শুনেছি। আমি নিয়মিত বাইরে খাওয়া দাওয়া করি। কারণ হচ্ছে আমি এখনও বিয়ে করিনি।
-করেননি?
-নাহ!
মেয়েটি চার নম্বর গলির কাছে এসে থামল। তারপর বলল, আমার বাসা এই গলিতে, ১৩ নম্বর বাসা। আপনার?
-আমার টা এর দুই গলি পরে।
আমি হাসিমুখে বিদায় নিয়ে চলে এলাম। পরের দিন দুপুরে আবারও যথারীতি আমাদের দেখা হল। আজকে আমরা রাস্তার সামনেই কথা বললাম।
মেয়েটি ব্যাগ থেকে ২০ টাকা বের করে দিয়ে বলল, এই নিন আপনার টাকা।
আমি হাসলাম। টাকা নিতে নিতেই মেয়েটি আবার বলল, গতদিন আপনার নাম জানা হয়নি। আমি জেনি। আপনি?
আমি আমার নাম বললাম। আরও টুকটাক কথা বলেই জেনি নিজের ক্লাসের দিকে হাঁটা দিল। বলল যে পরে কথা হবে। তিন দিনের মাথায় আমরা একে অন্যের ফোন নম্বর নিয়ে নিলাম। দুপুরে দেখা হওয়া ছাড়াও রাতে আমাদের নিয়মিতই দেখা হতে লাগল। বিশেষ করে খাওয়া শেষ করে আমি বাসায় যাওয়ার পথে জেনি বের হয়ে আসত। আমরা হাউজিং-এর গলি ও গলিতে হাঁটাহাটি করতাম। একদিন জেনি বলল, আপনি বিয়ে করেননি কেন শুনি?
-আসলে বিয়ে যে কেন করিনি আমি নিজেই জানি না। তবে একটা বড় কারণ হচ্ছে আর্থিক সংকট। যে টাকা পয়সা আয় করি তা দিয়ে সংসার করার উপায় নেই। কোনোমতে আমি নিজে টিকে আছি।
জেনি বলল, আপনি যে কারণ দেখালেন, তেমন হলে তো এই দেশের অর্ধেক পুরুষ মানুষই বিয়ে করতে পারবে না।
-তা সত্য বলেছেন। তবে তাদের দিকে তাকিয়ে দেখেন কী অবস্থা তাদের। মানুষ বলে বিয়ে করলেই নাকি অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু সেই সাথে অনেক সমস্যা এসে হাজির হয়। আমি জীবনে নতুন কোনো সমস্যা চাই না আর! এই কারণে ঐদিকে আর যাইনি। এক সময়ে যে বিয়ে করার ইচ্ছে ছিল না সেটা বলব না। তবে এখন শান্তি চাই বেশি!
-যদি এমন কাউকে পান যে কিনা স্বাবলম্বী চাকরি করে? তখন কি বিয়ের চিন্তা করবেন?
-সেটা দেখা যাবে! আগে এমন কেউ থাকুক!
সেদিন আমরা নিজেদের বাসায় চলে গেলাম। এরপর প্রায়ই আমাদের দেখা হতে লাগল। শুক্রবারে আমরা এদিক-ওদিক যেতে লাগলাম। আমার সত্যিই এটা বুঝতে কষ্ট হল না যে জেনি আমাকে পছন্দ করতে শুরু করেছে। কারণটা আমি যদিও তখনও বুঝে উঠতে পারিনি। আমার অবশ্য জেনির সাথে কথা বলতে খুব একটা খারাপ লাগত না। প্রায় মাস দুয়েক পরে জেনি একদিন দুপুরে আমাকে ওর বাসায় দাওয়াত দিল। আমিও রাজি হয়ে গেলাম।
ওর বাসায় যাওয়ার কিছু সময় পরেই আমি বুঝতে পারলাম যে ওর বাসায় অন্য আর কেউ নেই। আমি প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করতেই জেনি বলল, এই বাসায় একাই থাকে ও। ওর বাবার বাসা রয়েছে ধানমণ্ডিতে।
-একা এখানে কেন থাকেন তাহলে?
-আপনার জন্য!
আমি একটু চমকে উঠলাম। একভাবে তাকিয়ে রইলাম জেনির দিকে। আমার কাছে জেনিকে কেন জানি অচেনা মনে হল। মাস দুয়েক ধরে আমি জেনিকে চিনি। তবে আজকে ওর চোখের দৃষ্টি আমার কাছে অচেনা মনে হচ্ছে! আমার কেন জানি মনে হল এভাবে একা জেনির সাথে ওর ফ্ল্যাটে আসা মোটেই ঠিক হয়নি।
জেনি বলল, আমি জানি তুমি অন্য কিছু ভাবছ। আমার কথাটা কি একটু শুনবে? তারপর যদি চলে যেতে চাও চলে যেও। আমি বাধা দেব না।
এই বলে জেনি ঘরের ভেতরে চলে গেল। ফিরে এল একটু পরে। ওর হাতে একটা ফটোফ্রেম দেখতে পেলাম আমি। ফ্রেমটা সে আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। আমি ফ্রেমটা হাতে নিয়ে একটু চমকালাম। ফ্রেমে দেখতে পেলাম জেনি একটা ছেলের সাথে বেশ ঘনিষ্ঠ ভাবে ছবি তুলেছে। দুজনের মুখই হাস্যোজ্জ্বল।
আমার বুঝতে কষ্ট হল না যে এই ছেলেটা জেনির প্রেমিক অথবা স্বামী। অবাক হওয়ার ব্যাপার হচ্ছে ছেলেটার চেহারা অনেকটাই আমার মত। চুল, চোখ, নাক, মুখ সব আমার মত। তবে আমার থেকে গায়ের রঙ একটু চাপা!
আমি তাকালাম জেনির দিকে। জেনি বলল, ওর নাম ফয়সাল। আমার হাসব্যান্ড। আমি যখন কলেজে পড়তাম তখনই আমাদের বিয়ে হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষে ওর কার এক্সিডেন্টে মৃত্যু হয়। আজ প্রায় ৫ বছর হতে চলল। জানো অপু, আমি এরপর কখনও অন্য কোনো পুরুষকে ভালোবাসতে পারিনি। কোনো দিন না। কিন্তু মাস চারেক আগে তোমাকে আমি দেখলাম বাতিঘরে। তোমাকে দেখে আমার বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। আমার কেবল মনে হল যে ফয়সাল আমার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তারপর তোমার খোঁজ বের করেছি। তোমার পাশে থাকার জন্য এখানে বাসা ভাড়া নিয়েছি। কেবল তোমাকে এক নজর দেখার জন্য।
আমি জেনির চোখের আকুতি দেখে সত্যিই অবাক হয়ে গেলাম। ফয়সাল সাহেব তাহলে সত্যিই একজন ভাগ্যবান মানুষ।
দুপুরে খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমি জেনিকে বললাম, আমার প্রতি তোমার এই টান কিন্তু আমার কারণে না। ফয়সাল সাহেবের জন্য। এটা তো জানো?
-হ্যাঁ।
-তার মানে হচ্ছে তুমি সবসময় আমার ভেতরে তোমার স্বামীকে খুঁজবে! আমি কোনো দিন তোমার স্বামী হতে পারব না।
-তুমি কি ভাবছ আমি সেটা ভাবিনি?
-তাহলে?
-তারপরেও আমি নিজের মনকে কিছুতেই দূরে রাখতে পারছি না। বিশ্বাস কর আমি কিছুতেই নিজেকে বোঝাতে পারছি না। আমার কেবল তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করে, তোমার আশেপাশে থাকতে ইচ্ছে করে! তোমাকে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। আমি কী করব বল? আমি নিজেকে সামলাতে পারি না। আমি যে কতটা অসহায় হয়ে আছি তোমাকে আমি বলে বোঝাতে পারব না!
আমি আসলেও জানি না এই রকম পরিস্থিতিতে আসলে আমার কী বলা উচিত। জেনি মেয়ে হিসেবে ভালো। অন্তত এই কদিন ওর সাথে মিশে আমার বেশ ভালোই মনে হয়েছে। তবে ওকে আমি ভালোবাসা টাইপ চোখে কখনই দেখিনি। কিন্তু জেনির ব্যাপার জানার পরে আমার কেন জানি জেনিকে খানিকটা অন্যরকম মনে হচ্ছে। তবে মেয়েটাকে ছেড়ে যেতেও ইচ্ছে করছে না। আমরা সবাই আসলে নিজের মনের কাছে বড় অসহায়।
আমি যখন বাসায় যাওয়ার জন্য বের হতে যাব তখনই জেনি আমাকে পেছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। একেবারে হঠাৎ করেই। আমি এটার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। আমার শরীরের কাছে নিজেকে জড়িয়ে রেখেই জেনি বলল, প্লিজ অপু, আমাকে ছেড়ে যেও না প্লিজ! আমাকে ভালো না বাসো, কেবল একটু পাশে থাকো। প্লিজ!
কোনো মেয়ের কাছ থেকে এই আবেদন উপেক্ষা করে চলে যাওয়ার ক্ষমতা এই জগতের কোনো পুরুষের আছে কিনা আমার জানা নেই। আমার হল না।
আমি যদিও জানি জেনির সাথে আমার এই সম্পর্ক কোন সুখের দিকে যাবে না । জেনি আমাকে কখনই ভালবাসবে না । সে আমার ভেতরে তার স্বামীকে খুজবে । আমরা যদি সামনে কখনও আমরা এক সাথে হইয়ো তবুও এই জিনিসটা কখনই পরিবর্তন হবে না । আমার সারা জীবন এটাই মনে হবে যে জেনি আমাকে ভালবাসে না । সে আমার ভেতরে তার স্বামীকে ভালবাসে । আমার প্রতি তার ভালবাসার জন্মই কেবল আমার চেহারা খানিকটা তার স্বামীর মত দেখতে বলে!
এই অনুভূতি নিয়ে কি আমার জীবনে সুখে থাকা সম্ভব? আমি জানি না । তবে এখন এই সময়ে জেনিকে রেখে চলে যাওয়া আমার কাছে সমীচীন মনে হল না । আমার মনে হল এখন জেনির পাশে থাকা উচিৎ আমার । হতে পারে সত্যিই কোন দিন জেনি আমাকে ভালবাসতে পারবে।