লাইফ ইজ নট ফেয়ার

oputanvir
4.5
(33)

সকালবেলা যখন নীরুর চোখ খুলল তখন সে কিছু সময় ঠিক বুঝতে পারল না যে কোথায় রয়েছে। কয়েক সেকেন্ড লেগে গেল নিজের বর্তমান অবস্থান মনে করতে । এবং মনে পড়ার সাথে সাথেই নিজের মনের ভেতরে একটা অদ্ভুত বিষন্নতা এসে ভর করল। উপরওয়ালার প্রতি এক অদ্ভুত অভিমান এসে জড় হল মনে। শেষ পর্যন্ত তাহলে তিনি তার কপালে এটাই লিখে রেখেছিলেন ! এমন ভাবে নিজের জীবনটা শেষ পর্যায়ে এসে পৌছাবে সেটা নীরু ভাবে নি। কান্না আসতে গিয়েও কেন জানি এল না । তবে কাঁদল না সে । ছোট বেলা থেকেই তো এমন হয়েছে। জীবন ওকে যতভাবে পেরেছে ততভাবে কেবল কষ্ট দিয়েই গেছে। শেষ যে স্বপ্নটা ছিল ওর সেটা গতকাল রাতে শেষ হয়ে গেছে ।
ওকে আর কেউ বাঁচাতে আসবে না । জীবনে এমন অনেকেই থাকে যাদের কেউ বাঁচাতে আসে না । কেউ তাদের রক্ষা করতে আসে না । তাদের জন্য কেউ থাকে না । তাদের কেউ থাকে না।
নীরু বিছানা থেকে উঠে বসল । চারিদিকে তাকাল। কাল রাতে এখানে যখন ওকে ওর অফিসের সেলসের হেড তার বাসায় অর্থ্যাৎ এখানে নিয়ে এল তখন ও নিরুপায় হয়ে না এসে পারে নি । সে নিজে ইচ্ছে করে সম্মতি দিয়েছে। কদিন থেকেই অফিসে কানা ঘুসা শোনা যাচ্ছিল যে অনেক গুলো কর্মী ছাটাই করা হবে। আগের দিন সেলস হেড আমির আহমেদ ওকে নিজের কেবিনে ডেকে জানাল যে ছাটাইয়ে তার নাম আসবে । কথা শোনার পর থেকেই নীরু যেন একেবারে ভাবে দিশেহারা হয়ে পড়ল । সবার জীবনেই কিছু না কিছু ব্যাকআপ থাকে । কোন বিপদে পড়লে মানুষ তাদের কাছে গিয়ে হাজির হয় । বিশেষ করে ফ্যামিলি এমন থাকে। নীরু বাবা থেকেও যেন নেই। নীরু কোন ভাবেই এখন নিজের পরিবারের কাছে গিয়ে থাকতে পারবে না। সে আমির আহমেদের কাছে খানিকটা নিরুপায় হয়েই বলেছিল যে সে যে কোন কিছু করতে প্রস্তুত । আমির সুযোগটা হাতছাড়া করে নি। প্রথম সুযোগেই তাকে নিজের বাসায় নিয়ে হাজির করেছে।
নীরু ঠিক ঠিক জানত যে ওর সাথে তার বস আমির আহমেদ কী করবে! তারপরেও নিজের চাকরি বাঁচাতে নীরু নিজ ইচ্ছের বিরুদ্ধে এসেছে সে। তার বস আমির আহমেদ যা যা করতে চেয়েছে সব করতে দিয়েছে সে । কোন প্রতিবাদ করে নি । করতে পারে নি। এই চাকরিটা যে কোন ভাবেই হারাতে চায় না । পড়াশোনা শেষ করে কত কষ্ট করে সে এই চাকরিটা পেয়েছে। এই চাকরি হারালে তার আরেকটা চাকরি খুজে পেতে কত সময় লাগবে নীরু জানে না। পড়াশোনাতে সে কোন কালেই আহামরি কোন ভাল ছাত্রী ছিল না । কাল চালানোর মত এই চাকরিটা সে যোগার করেছে। বলা যায় অনেকটা ভাগ্যগুণেই পেয়েছে। এটা যদি চলে যায় আদৌও সে আরেকটা চাকরি পাবে কিনা সেটা সে জানে না ।
বিছানার পাশেই একটা বড় টিশার্টটা পরে নিল । কারণ আশে পাশে ওর পোশাক কোথাও সে দেখতে পেল না। ওর পরনের সেলোয়ার কামিজটা সে কোথায় দেখতে পেল না। বাধ্য হয়েই সে বড় টিশার্টটা পরল । ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে এল। তারপর ভয়ে ভয়ে বসার রুমে যেতেই অবাক করা একটা দৃশ্য দেখতে পেল । তার বস আমির খাবার টেবিলে নাস্তার প্লেট সাজাচ্ছে । পরনে তার কেবল একটা ট্রাউজার । উপরের অংশ একেবারে খালি । পেশি বহুল দেহের দিকে একবার তাকিয়েই চোখ সরিয়ে অন্য দিকে নিল ।

আমির আহমেদের বয়স খুব বেশি না । ওর থেকে কয়েক বছরের বড় হবে। হয়তো ত্রিশ পার হয়েছে । এর বেশি না কোন মতেই । এই ছোট বয়সেই সে কোম্পানীর সেলসের হেড হয়ে বসে আছে। ব্যাপারটা অফিসে যে সবার ঈর্ষার কারণ সেটা নীরু খুব ভাল করেই জানে । তবে এই কথা নীরুকেও স্বীকার করে নিতে হবে যে আমির কাজ কর্মে খুবই দক্ষ। তবে মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করার বদনাম তার আছে ।
আমিরের গা খালি থাকার কারণটা নীরু বেশ ভাল ভাবেই বুঝতে পারল । কারণ তার টিশার্টটা নীরুর শরীরে । নীরুর দিকে তাকিয়ে আমির একটু হেসে বলল, বাহ আমার টিশার্ট দেখি তোমার শরীরে বেশ ভালই মানিয়েছে! আসো নাস্তা করা যাক !
তখনই নীরুর ব্যাপারটা খেয়াল হল। আমির তার জন্য সকালের নাস্তা বানিয়েছে। দুইটা নাস্তার প্লেট একেবারে পরিস্কার দেখা যাচ্ছে।
-আসো নাস্তা করা যাক !
আমি কথাটা আবার বলল। নীরুর একবার নাস্তার প্লেট আর একবার আমিরের চেহারার দিকে তাকাল। এখনও নীরুর যেন ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। ওর জন্য কেউ সকালের নাস্তা বানিয়েছে । মা মারা যাওয়ার পরে নীরুর জন্য কেউ নিজ থেকে সকালের নাস্তা বানিয়ে দিয়েছে কিনা নীরু মনে করার চেষ্টা করল ।

নীরুর মা যখন মারা যায় তখন ক্লাস এইটে পড়ে । ওর বাবা ঠিক দুই মাসের মাথায় নতুন বিয়ে করে । নীরু তখন থেকেই জানে না যে জীবন কতটা কঠিন হতে পারে । ওর নতুন মায়ের জন্যই সকাল বেলা ওর নাস্তা বানাতে হত । নাস্তা বানিয়ে তারপর স্কুলে যেত সে । ও সব সময় চাইতো যেন ওর সৎমায়ের ওর জন্য কিছু না করতে হয় । আগে আগে সেই সব কাজ করে দেয় যাতে ওকে বাসায় থাকতে দেওয়া হয় ! এসএসসির পরেই নীরু হোস্টেলে উঠে যায় । সেখানে সকালের নাস্তা বলতে মূলত ছিল সাদা ভাত আর এক ধরনের তরকারি । হাড়িতে রাখা থাকত । যে যার মত খেয়ে নিত । কোন কোন দিন দেরি হলে খাবার শেষ হয়ে যেত । সেদিন সকালের নাস্তা না খেয়েই কলেজে যেতে হত নীরুর । বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঠার পরেই নতুন ভাবে জীবন শুরু হয়েছিল ।
নিজে প্রথমে টিউশনি এবং পরে বিভিন্ন কল সেন্টারে চাকরি নিয়েছিল । নিজের খরচ নিজেই চালিয়ে নিত কোন মতে । টাকা দিতে হত না বলে নীরুর সৎমা খুব বেশি উচ্চবাচ্চ করে নি । নীরুর বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে নি । বিয়ে দিতে গেলে আবার কত গুলো টাকা খরচ হবে । তাই সেদিকে কেউ যায় না । সারা বছর নীরু হোস্টেল আর হলেই থাকত। ঈদের সময়ে একেবারে আগের দিন যেত আর ঈদের পরপরই চলে আসত । সেই সময়েও নীরু নিজেই সব কাজ কর্ম গুলো করতো । ওর মনে হত যে যদি ওর জন্য পরিবারের অন্য কাউকে কাজ করতে হয় তাহলে হয়তো ওকে আবার কথা শুনতে হবে । সেই সুযোগ সে তার মাকে দেয় নি।
আজকে এতোও গুলো দিন পরে কেউ ওর জন্য নিজ থেকে সকালের নাস্তা বানিয়ে টেবিলে সাজিয়েছে এটা দেখার পরে নীরুর মনে অদ্ভুত এক অনুভূতি এসে জড় হল । যখন ঘি দিয়ে ভাজা পাউরুটিটা মুখে দিল তখন মনে হল যেন জীবনে এর থেকে মজাদার নাস্তা সে আর খায় নি ।
-কী হল?
নীরুর মুখের অবস্থা দেখে আমির নিজ থেকেই প্রশ্নটা করল ।
-নাস্তা ভাল হয় নি ? সকালে তুমি কী খাও ? আমি অবশ্য সকালে যা খাই তাই বানিয়েছি তবে তুমি চাইলে অন্য কিছু তৈরি করা যায় ! স্যান্ডউইচ খাবে !
-না না । নাস্তা ঠিক আছে । এখন আর কিছু দরকার নেই । অফিস যেতে হবে !
-তোমার কামিজটা আমি ওয়াশিংমেশিনে দিয়েছি ।
-ও !
নীরু এখন তাহলে অফিস যাবে কিভাবে? সাথে করে তো কোন কাপড়ও আনে নি সে । নীরুর মনের কথা যেন আবারও আমির বুঝতে পারল । সে বলল, শোবার ঘরের ওয়ালডেস্কে তোমার জন্য কয়েক সেট ড্রেস রাখা আছে । হাতের মাপে কেনা । দেখ শরীরে ফিট হয় কিনা !
এই তথ্য নীরুর কাছে অন্য রকম লাগল । আমির তার জন্য পোশাক কিনেছে । এমনই কি হয়ে থাকে? এভাবেই মেয়ে গুলো দামী পোশাক আর জিনিস পত্র ব্যবহার করতে পারে ? এতো দিন নীরু এসবের গল্পই কেবল শুনে এসেছে । এখন সেই একই ব্যাপারটা তার নিজের সাথে ঘটছে। নীরুর মনটা আরেকবার বিষন্ন হয়ে উঠল ।

নাস্তা শেষে নীরু আগে রেডি হল অফিসের জন্য । আমিরের দেওয়া পোশাকটা ওর শরীরে বেশ চমৎকার ভাবেই ফিট হল ।
-আমার সাথে যাবে অফিসে ?
-একই গাড়িতে?
-হ্যা।
-না, ব্যাপারটা ভাল দেখাবে না । আপনাকে আমাকে এক সাথে অফিসে দেখলে মানুষজন নানান কথা বলবে । আমাদের দুজনের বাসা দুইদিকে!
-তা ঠিক । আচ্ছা আমি উবার ডাকছি । তুমি আগে যাও আমি আসছি !
নীরু প্রতিবাদ করতে গিয়েও করল না । উবারে যাওয়ার ব্যাপারটা নীরুর জন্য বিলাসিতাই বলা চলে । কালে ভাদ্রে সে উবারে ওঠে । তবে মেট্রো আসার পরে নীরুর চলাচলে বেশ সুবিধা হয়েছে । অফিসটা মেট্রো স্টেশনের কাছে হওয়ার কারণে যাতায়াত বেশ সহজ হয়ে গিয়েছে ।
বের হওয়ার ঠিক আগের মুহুর্তে আমির ওর দিকে একটা ক্রেডিট কার্ড এগিয়ে দিল । নীরু বলল, এটা?
-এটা রাখো তোমার কাছে !
-না না ঠিক আছে । এটা লাগবে না ।
-রাখতে বলছি রাখ।
আমির একটু ধমকের সুরে বলল কথাটা । নীরু কার্ডটা হাতে নিল। এতোদিন যা যা শুনে এসেছে সব তাহলে সত্যি।

মন খারাপ নিয়েই সে বের হয়ে এল বাইরে । উবারকারটা বাসার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল । সেখাটে উঠে বসল । গাড়িটা অফিসের দিকে চলতে শুরু করলেই নীরুর মনে একটা ভয় এসে জড় হল । নীরুর মনে হল যে যখন সে অফিসে গিয়ে হাজির হবে অফিসে সবাই ওর ব্যাপারটা জেনে যাবে । অফিসের বীথি নামের একটা মেয়েকে নিয়েও এই গল্প প্রচলিত আছে । ম্যানেজারের সাহেবের সাথে নামি মেয়েটাকে প্রায়ই দেখা যায় ! এই কত রকম মুখোরোচক গল্পই প্রচলিত আছে অফিসে । বীথির কানেও সেই গল্পের অংশ আসে। বীথি কখনও ওদের সাথে লাঞ্চ আওয়ারে বসে না । মেয়েটা একা একাই থাকে এখন ।
কদিন পরে হয়তো নীরুকে নিয়েও এমন গল্প প্রচলিত হবে!
হঠাৎ নীরুর কান্না এল খুব । গাড়ির ভেতরে কান্না আটকানোর চেষ্টা নীরু করল না । শূন্য দৃষ্টিতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকানোর সময় চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকল ওর !
-আপনি ঠিক আছেন ম্যাম ?
ড্রাইভারের কথা শুনে বাস্তবে ফিরে এল । ব্যাগ থেকে টিস্যুর বের করে চোখ মুছে বলল, হ্যা হ্যা ঠিক আছে ।

ড্রাইভার আর কিছু জানতে চাইল না । নীরু চোখ মুছে নিজেকে শান্ত করে নিল যা হবার আসলে হবে । এতো কিছু ভেবে আর লাভ নেই । ওদের মত মেয়েগুলো এমন ভাগ্য নিয়েই পৃথিবীতে আসে । ওদের জন্য কোন রাজকুমার ঘোড়ায় চড়ে আসে না । কেউ ওদের জন্য অপেক্ষা করে না । কেউ ওদের স্পেশার দিন গুলোর কথা মনে রাখে না । ওদেরকে কেবল ব্যবহার করা যায় । ভালবাসা যায় না ।
এই পৃথিবীতে জীবন কখনই সবার সাথে ফেয়ার আচরণ করে না । কখনই না।

ফেসবুকের অর্গানিক রিচ কমে যাওয়ার কারনে অনেক পোস্ট সবার হোম পেইজে যাচ্ছে না। সরাসরি গল্পের লিংক পেতে আমার হোয়াটসএপ বা টেলিগ্রামে যুক্ত হতে পারেন। এছাড়া যাদের এসব নেই তারা ফেসবুক ব্রডকাস্ট চ্যানেলেও জয়েন হতে পারেন।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.5 / 5. Vote count: 33

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →