মিতুর সংসার

oputanvir
4.8
(79)

একটু বিরক্ত হয়েই বললাম, তুমি কেন ওকে বলতে গেছো যে আমার জ্বর এসেছে !
ওপাশ থেকে মা কিছু বলল না । আমি আবার বললাম, ও যে একা একা ঢাকার গাড়িতে উঠে পড়েছে, পথে যদি কিছু হয় ! আমি বারবার করে বললাম যে কিছু না বলতে তারপরেও কেন বলেছো !
মা বলল, আমি বলতে চাই নি । আমার মুখ দিয়ে বের হয়ে গেছে ।

আমার সত্যিই খুব বিরক্ত লাগছে । সবার উপরেই বিরক্ত লাগছে । এমনিতেই আমার জ্বর খুব একটা আসে না । বছরে একবার কী দুইবার আসে তবে এই বছর এটা নিয়ে তিনবার জ্বর এল । জ্বর এলে খেতে ভাল লাগে না, শরীর ব্যাথা করে আর সব থেকে বড় কথা ঢাকায় একা থাকার কারণে দেখা শোনার কেউ নেই । আমি অবশ্য সারা জীবনই একা একা থেকেছি । সব কাজ নিজেই করেছি । যে কোন কাজের জন্য অন্যের উপর নির্ভর করাটা আমার কাছে বিরক্তির একটা ব্যাপার । এমন কি সেটা নিজের বউয়ের উপরেও । এই কারণে আমি একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত বিয়ে করি নি । যদিও বিয়ে না করার পেছনে আরো কারণ ছিল । তবে মিতুকে আমার বিয়ে করতে হয়েছে । আমার নিজের কারণে না । আমার পরিবারের কারণে ।

আমার বাবা যখন বলল যে তার ৪৭ লাখ টাকার ঋণ হয়েছে তখন আমি কেবল বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে । আমার দিকে তাকিয়ে এমন স্বাভাবিক ভাবে কথাটা বলল যেন এটা খুবই স্বাভাবিক । কিন্তু তারপরে সে যা বলল তা শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে বলল । সে জানালো যে আমাকে এই ঋণ শোধের জন্য আমাকে বিয়ে করতে হবে । এক লোক তার মেয়েকে আমার সাথে বিয়ে দিতে রাজি হয়েছে বিনিমনে সে বাবাকে ৪০ লাখ টাকা দিবে।

কপালে থাকলে বিয়ে করবো এমন একটা ভাবনা আমার মনে ছিল । কিন্তু কোন দিন আমি ভাবতেও পারি নি যে এই ভাবে টাকা নিয়ে বিয়ে করবো । তাও আবার চল্লিশ লাখ টাকা নিয়ে। তবে বাবার ছেলে হিসাবে এটাই নাকি আমার দায়িত্ব । আমাকে বিয়ে করতেই হবে।

আমার মাথায় এটা এলো না যে এতো টাকা দিয়ে কোন মেয়ের বাবা আমার সাথে নিজের মেয়েকে আমার সাথে কেন বিয়ে দিতে রাজি হবে ! আমি তো মোটেই প্রিন্স চার্মিং না । কোন মেয়ের মনের রাজাও না । চাকরি একটা করি তবে সেটা খুব আহামরিও না । খেয়ে পরে কোন মতে টিকে আছি । এমন একজন ছেলের পেছনে এতো টাকা কেন খরচ করবে কেউ !

অবশ্য পরদিনই সব খবরাখবর আমার কাছে এল । মা এই বিয়েতে রাজি ছিল না মোটেও । তবে এতো টাকার ঋণটা কাটানোর এর থেকে সহজ পথ আর নেই বলে মাও কিছু বলছে না । মেয়ের আগে এক স্থানে বিয়ে হয়েছিলো । এবং বিয়ের পরে সেখান থেকে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে কোন কারণে । কী সে কারণ সেটা অবশ্য মা এখনও জানতে পারে নি । প্রাথমিক ভাবে জানা গেছে যে স্বামী নাকি তাকে অনেকটা মারই ধোর করতো । ওর বাবার কাছ থেকে বার বার টাকা নিয়ে আসতে বলতো । একবার নাকি মেরে মেয়েটার হাত ভেঙ্গে দিয়েছিল ।

আমার অবশ্য এসব ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ ছিল না । আগে বিয়ে হলেই বা কি আর না হলেই বা কি ! আমার আসলে তাতে কোন কিছুই যায় আসে না । আমি নিরস মুছে মিতুকে বিয়ে করে ফেললাম । অফিসের ছুটি ছিল না । শুক্রবার শনিবার মিলে বিয়ে হল । ঘরোয়া ভাবেই । ঠিক হল যে পরবর্তিতে সময় ছুটি পেলে আমি এসে অনুষ্ঠান করা যাবে । বিয়ের আগে আমার মিতুর সাথে দেখা হল না একবারও । বিয়ের সময় একবার তাকে দেখলাম । একটা নীল রংয়ের জামদানি পরে আছে । মাথা নিচু করে বসে রয়েছে । ঠিক আমার মতই । বিয়েতে আমার কেবল মনে হচ্ছে আমি টাকা নিয়ে বিয়ে করেছি । নিজেকে এতো ছোট লাগছে । অথচ এদিকে আমার পরিবারের এমন ভাবে চলছে যেন এটা খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার ।

পরের দিন আমি ঢাকা চলে আসি । তবে কেন জানি আমার মিতুর সেদিনের চেহারাটা ঠিকই চোখে লেগে থাকে । এই মেয়েটা আমার বিয়ে করা বউ হয়ে গেছে ব্যাপারটা ভাবতেই কেমন যেন ভাল লাগার একটা অনুভূতি কাজ করতে শুরু করে । তবে যতবারই আমি মিতুর কথা ভাবি তত বারই আমার মনে হয় যে ওর কাছ থেকে টানা নিয়ে আমি বিয়ে করেছি ।

তবে মিতুর সাথে তারপর থেকে প্রতিদিনই কথা হত । অফিস ছুটির পরে বাসা ফেরার পরে ও ফোন করতো আমাকে । টুকটা কথা আমাদের মাঝে হত । এভাবে মাস ছয় কেটে গেল । আমি অফিসের কয়েকটা প্রেজক্ট নিয়ে খুব বেশি ব্যস্ত থাকার কারণে বাসায় যাওয়ার সুযোগ হল না । সেই প্রজেক্টের একটা কাজে বৃষ্টির ভেতরে ছাতা মাথায় নিয়ে দেখাশোনা করতে গিয়ে জ্বর বাঁধালাম । এর আগেও আমি অনেকবারই বৃষ্টিতে ভিজেছি । জ্বর তো আসে নি । তাহলে এবার কেন আসলো কে জানে ।
আর সব থেকে বড় কথা মিতু প্রায় চলে এসেছে ঢাকায় । মেয়েটা এভাবে একা একা চলে আসবে আমি ভাবতেও পারি নি । অবশ্য এখন পদ্মা সেতুর কারণে ঢাকা আসাটা সহজ আর কম সময় লাগে । দিনে এসে আবার দিনে ফেরৎ চলে যাওয়া যায় !

মিতু আমার এলাকাতে এসে ফোন দিল । বলল সে ও কলেজটার সামনে চলে এসেছে । ওখানেই দাড়িয়ে আছে । আমাকে বাসার ঠিকানা বলতে বলল । আর বলল যে আমাকে নামতে হবে না । তবে আমি নেমে এলাম । বাসার গেট দিয়ে বের হতেই দেখতে পেলাম মিতুকে ।

মিতুকে দেখে একটু চমকেই গেলাম । মিতু একটা কালো রংয়ের জিন্স পরেছে । তার উপরে একটা সাদা কুর্তা । পায়ে একটা কালো স্নিকার্স । ওকে প্রথম যেদিন দেখেছিলাম সেদিন গ্রামের শান্ত স্নিগ্ধ মেয়ে মনে হয়েছিলো অথচ এখন ওকে শহরের মর্ডান মেয়েদের মত মনে হচ্ছে । ওর কাধে একটা কালো রংয়ের স্কুল ব্যাগ । আর হাতে একটা টিফিন ক্যারিয়ার । আমার সামনে এসে বলল, আপনাকে না বললাম যে নিচে না নামতে !
আমি হাসলাম । তারপর বলল, আরে আমি সব সময়ই নামি ! আর তুমি এমন করে কেন চলে এলে !
মিতু সে প্রশ্নের জবাব দিলো না । আমি আবার বললাম, এভাবে কেউ চলে আসে একা একা ? যদি রাস্তায় কিছু হয়ে যেত !
-আপনি এর আগেও একা একা অনেকবারই ঢাকা এসেছি ।
-তাই নাকি?
-হ্যা । এখন চলুন । আপনার দাড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে ।

সত্যিই আমার দাড়িয়ে থাকতে একটু কষ্টই হচ্ছে । মিতুর সাথেই উঠে এলাম উপরে । আমি বর্তমানে একটা ফ্যামিলির সাথে আলাদা একটা রুম নিয়ে থাকি । মিতুকে ঢুকতে দেখে ওরা একটু অবাক হল । বিশেষ করে আমি কখনই আমার ঘরে কোন গেস্ট নিয়ে আসি নি । মেয়ে তো আনা অনেক পরের ব্যাপার । যখন বললাম যে মিতু আমার বউ তখন ওরা যেন আকাশ থেকে পড়লো ।

আমার ঘরে ঢুকে মিতু চারিদিকে তাকিয়ে বলল, বাহ আপনি তো দেখি বেশ গোছালো ! এতো পরিস্কার হবে ভাবি নি ।
আমি হাসলাম । মিতু তখনই কাজে লেগে গেল । যতই গোছালো হোক মিতু চট করে আরেকবার ঘরটা পরিস্কার নিয়ে নিল । আমি খাটে শুয়ে পড়লাম । আমার দাড়িয়ে তঃাকতে ভাল লাগছিলো না !

এরপরের কয়েকটা দিন আমি সত্যি অনুভব করলাম যে মানুষের আদর আর যত্ন পাওয়াটা কতটা মধুর হতে পারে । এই অল্প সময়েই মিতুর প্রতি টানটা যেন বেড়ে গেল অনেক বেশি । তবে সেই অস্বস্তিটা আমার ঠিকই মনের ভেতরে রয়ে গেল । বারবারই কেবল মনে হতে লাগল যে মিতু ঠিকই জানে যে ওর বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে আমি বিয়ে করেছি ওকে ।

আমার কেন জানি মনে হচ্ছিলো যে আমার শরীর যাতে দ্রুত ভাল না হয় । ভাল হলেই তো মিতুর আদর যত্ন পাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে । তবে শরীর ভাল হয়ে গেল । আমি অফিস যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলাম । যদিও মিতু বলছিলো যে আরো কয়েকটা দিন বিশ্রাম নিয়ে আমি যেন অফিস যাই । তবে এর থেকে বেশি ছুটি কাটানোর উপায় ছিল না । অফিস যাওয়ার সময় বারবার করে বলে গেলাম যে কোন দরকারেই যেন আমাকে ফোন দেয় । এছাড়া ওর ফোনে নতুন করে ফুড পান্ডার এপ ডাউনলোড করে দিলাম । এমন দারোয়ানকেও বলে দিলাম যে যেকোন দরকারে যেন মিতুকে সাহায্য করে । মিতুর প্রতি এতো কেয়ার দেখে আমার নিজেরই অবাক লাগছিলো ।

অফিস থেকে ফিরে মিতুকে বললাম, সামনের শুক্রবার তোমাকে বাসায় দিয়ে আসি । এখন তো আমি সুস্থ হয়ে গেছি ।
দেখলাম মিতুর মুখটা কেমন যেন কালো হয়ে গেল । সে মাথা নিচু করে বলল, আমি থাকলে কি আপনার খুব সমস্যা হচ্ছে ? মা বলছিলেন যে আপনি একা থাকতে পছন্দ করেন ।
-আরে সেটার জন্য না । আমি সারা দিন অফিসে থাকি । আমি এই একটা ঘরের ভেতরে আটকা থাকো ।
-আমার সমস্যা হচ্ছে না ।

আমি মিতুর দিকে তাকিয়ে বললাম, তুমি থাকতে চাও?
মিতু মাথা নিচু করেই মাথা ঝাকালো । ঠিক তখনই আমার মনের ভেতরে একটা তীব্র অনুভূতি এসে ধাক্কা দিল । একজন আমার সাথে থাকার জন্য কী আকুল হয়েই না আমাকে অনুরোধ করছে । এই অনুভূতিটা আমার কাছে নতুন ছিল খুব ।

রাতের বেলা খাওয়া শেষ করে যখন শুলাম মিতু আমার পাশেই গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়লো । খাটটা খুব বেশি বড় না । তবে দুজনের শোয়ায় সমস্যা হয় না খুব একটা । মিতু আমার কাছে একটু এগিয়ে এসে বলল, আপনি সব সময় আমার কাছ থেকে এমন দুরে দুরে কেন থাকেন? আমি কি এতো খারাপ?
আমি কী বলবো প্রথমে ঠিক বুঝতে পারলাম না । কিছু সময় চুপ থেকে বললাম, তুমি খারাপ না । আমি আসলে তোমার অযোগ্য !
-কেন এই কথা কেন বলছেন?
-তুমি জানো না আমি কী করেছি?
-কী করেছেন?
-তোমার বাবার কাছ থেকে কত টাকা নেওয়া হয়েছে জানো না । জীবনে আমি এই কাজটা কোন দিন করবো ভাবতেই পারি নি । নিজেকে এতো ছোট লাগে তোমার কাছে !

কিছু সময় কেউ কোন কথা বললাম না আমরা । তারপরেই আমি অনুভব করলাম মিতু একেবারে আমার শরীরের উপরে উঠে এসেছে । আমার ওর নিঃশ্বাসের গরম বাতাস আমি অনুভব করতে পারছিলাম । মিতু বলল, আপনি আর কখনো এই কথাটা বলবেন না । কখনো না । যদি বলেন তাহলে আমি মরে যাবো !

কী তীব্র অভিমান আর ভালোবাসা মিতুর কন্ঠস্বর । এই ভালোবাসা উপেক্ষা করা পৃৃথিবীর কোন পুরুষের পক্ষে সম্ভব না । এতো তীব্র ভাবে একে অন্যকে ভালোবাসতে শুরু করলাম যে আমাদের কাছে অন্য সব কিছু তুচ্ছ হয়ে গেল ।

পরদিন অফিসে গিয়ে একটা সুসংবাদ পেলাম । স্বয়ং এমডি আমাকে তার রুমে ডেকে নিয়ে আমার প্রমোশন লেটার দিল । বলল, আপনি যে কষ্ট করেছেন গত কয়েক বছর আমার মনে হয় এটা কম করা হচ্ছে । শেষে জ্বর পর্যন্ত বাঁধয়ে ফেললেন এই কাজের জন্য ।
প্রমোশনের চিঠি নিয়ে নিজের ডেস্কে আসতেই কেন জানি মনে হল যে মিতু এসেছে বলেই যেন এটা হয়েছে । সত্যি মিতুর সাথে বিয়ের পরপরই আমার কাজের চাপ বেড়েছে অনেক গুণে । যে প্রোজেক্টে কাজের কারণে আমার প্রোমশন হল সেগুলো সব আমার হওয়ার কথা ছিল না । মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম।

অফিস থেকে একটু আগে আগে বের হলাম । কাজটা শেষ করে যখন বাসায় ফিরলাম তখন একটু রাত হয়ে গেছে । রুমে ঢুকে দেখি মিতু বই পড়ছে । আমার বেশ কিছু গল্পের বই আছে । আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এতো দেরি হল ?
-একটু কাজ ছিল ।
-ও । কিছু খাবেন ।
-নাহ । আগে গোসল করে নিই ।

আমি গোসল করে ফিরে দেখলাম খাবার রেডি একদম । খেতে খেতেই বললাম, তোমাকে আর এখানে থাকতে হবে না ।
তাকিয়ে দেখি মিতুর মুখটা আবার কালো হয়ে গেছে । আমি বললাম, মন কেন করছো? এখানে থাকতে হবে না। তার মানে ঢাকা ছাড়তে বলছি না ।
-মানে?
-মানে হচ্ছে আজকে একটা বাসা দেখে এলাম । এই জন্যই আজকে একটু দেরি হল ! দুটো রুম । ড্রয়িং ডাইনিং । একটা বারান্দা । আমার অফিসের একদম কাছেই । দুপুরে প্রতি এসে লাঞ্চ করে যেতে পারবো !

আমি একমনে কথা বলে যাচ্ছিলাম । তাকিয়ে দেখি মিতু আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে একভাবে । ওর চোখে পানি টলমল করছে । এটা আনন্দের পানি । আমারও কেন জানি চোখ সিক্ত হয়ে এল । আমাদের দুজনের চোখেই সামনের জীবনের আনন্দময় স্বপ্ন !

এই গল্পের কাছাকাছি থিমের আরেকটা গল্প লেখা হচ্ছে । খুব জলদিই প্রকাশ হবে। গল্প সরাসরি পেতে হোয়াটসএপগ্রুপ কিংবা টেলিগ্রাম চেনেলে জয়েন করুন।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.8 / 5. Vote count: 79

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →