নীতু আর শাহেদ ভাইয়ের প্রেমের মিডল ম্যান ছিলাম আমি । কেবল এই একটা ব্যাপারে না । নীতু আমাকে প্রায় সব কাজেই এভাবে মাঝে নিয়ে যেত । পাড়ায় ভাল ছাত্র হিসাবে আমার বেশ নাম ডাক ছিল। সেই কারণে পাড়ার বাবা মায়েরা যখন শুনতে পেত যে তাদের ছেলে মেয়েরা আমার কাছে এসেছে কিংবা আমার সাথে মিশছে তাদের ধারণা জন্মাতো যে আমি হয়তো তাদের পড়াশোনার কথাই বলছি । কিংবা কিভাবে ভালো করে পড়াশোনা করে ভাল রেজাল্ট করা যায় সেই নিয়েই তাদের সাথে আলোচনা করছি ।
আর নীতু তো আমাদের বিল্ডিংয়েই থাকতো । আমার বাসায় এসে হাজির হত প্রায়ই । আমাকে জ্বালিয়ে মারতো পড়াশোনা নিয়ে । তবে নীতু মা আমাকে খুব আদর করতেন । ওদের বাসায় ভাল কোন কিছু রান্না হলেই আমার জন্য সেটা এসে হাজির হত । আমার উপর নীতুর মায়ের একটা অঘাত বিশ্বাস ছিল যে আমি কখনই কোন খারাপ কাজ করতে পারি না । তাই নীতু আমার সাথে যে মিশতো এটা নিয়ে তার কোন আপত্তি ছিল না । এই সুযোগটাই নীতু নিল ।
একদিন বিকেল বেলা নীতু আমার কাছে এসে বলল, শোন কালকে কলেজ থেকে ফেরার সময় আমি একটা জায়গায় যাবো । তুই আমার সাথে যাবি ।
-কোথায়?
-কোথায় যেটা সেটা গেলেই দেখতে পাবি । তবে আমার মা যদি কিছু জানতে চায় বলবি যে তুই আমার সাথে ছিলি । ওকে !
আমি তখনও ঠিক বুঝতে পারি নি যে নীতু ঠিক কী কারণে আমাকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে । পরের দিন ক্লাস শেষ হওয়ার আগেই আমরা কলেজ থেকে বের হয়ে এলাম । নীতু আমাকে নিয়ে হাজির হল শহরের একটা রেস্টুরেন্টে। সেখানেই আমি প্রথম টের পেলাম যে নীতুর আসলে শাহেদ ভাইয়ের সাথে প্রেম চলছে । এবং এটা বেশ কয়েকদিন ধরে চালু হয়েছে । অথচ আমি টের পাই নি । নীতু আমাকে বলল যে ওর বাসা থেকে বেশ চাপে রেখেছে । ব্যাপারটা ওর মায়ের কানে কোন ভাবে হয়তো চলে গিয়েছে । তাই এখন থেকে শাহেদ ভাইয়ের সাথে দেখা করতে আমাকে নিয়ে আসবে ।
শাহেদ ভাইকে নীতু কিভাবে পছন্দ করলো আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না । শাহেদ ভাই পড়ালেখায় মোটেই ভাল নন । কোন মতে পড়াশোনা শেষ করেছে । চাকরি পায় নি এখনও । তবে আমার ধারণা সে কোন দিন চাকরি পাবেও না । এই ছেলের ভেতরে নীতু কী দেখলো কে জানে । আমি জানি যে শাহেদ ভাই পাড়ার আরো কয়েকজনের পেছনে ঘুরেছে । কারো কাছে পাত্তা পায় নি । তাহলে নীতুকে কিভাবে পটিয়ে ফেলল !
তারপর থেকেই আমি ওদের মিডল ম্যান হয়েই কাজ শুরু করে গেলাম । যখনকার কথা বলছি তখন ইন্টারনেটের এতো সহজ লভ্যতা শুরু হয় নি । মানুষের হাতে হাতে ফোন ছিল না । শাহেদ ভাই আর নীতু তখন চিঠি লিখতো একে অন্যকে । এবং বলাই বাহুল্য মিডল ম্যান হিসাবে আমার দায়িত্ব পড়তো পড়তো সেগুলো একে অন্যের কাছে পৌছে দেওয়ার জন্য ।
মাস খানেকের ভেতরেই পুরো এলাকাতে নীতু শাহেদের প্রেমের কাহিনী ছড়িয়ে পড়লো । নীতু মা কঠিন ভাবে নীতুর প্রতি নজর দেওয়া শুরু করলো । সাথে করে কলেজ কোচিংয়ে নিয়ে যেত । তাই আপাতত ওদের বাইরে দেখা করা বন্ধ হয়ে গেল । তবে চিঠি লেখা বন্ধ হল না । আমার হাত দিয়েই চিঠি আদান প্রদান হতে থাকলো । চিঠি গুলো প্রথম প্রথম খামে বদ্ধ থাকলেও, ওর মায়ের সন্দেহের হাত থেকে রক্ষার জন্য কেবল সাদা একটা পেপারে চিঠি আসতে শুরু করলো । তাই আমি চাইলেই চিঠি গুলো পড়তে পারতাম । প্রথম প্রথম না পড়লেও পড়ে আমি চিঠি গুলো পড়তে শুরু করলাম । এবং তখনই ওদের ভয়ংকর পরিকল্পনার কথা জানতে পারলাম । ওরা বাড়ি থেকে পালানোর কথা ভাবছে । আমাদের এইচএসসি পরীক্ষার পরেই ওরা পালাবে ঠিক করেছে ।
নির্ধারিত দিন চলে এল । আমাদের পরীক্ষা শেষ । আমরা সবাই কোচিংয়ের জন্য ঢাকা যাওয়ার পরিকল্পনা করছি । এমন সময় শাহেদ ভাইয়ের কাছ থেকে নির্দেশনা মূলক চিঠি এল । সেখানে বলা হল ঠিক কোন দিন আর কোথায় নীতুকে থাকতে হবে । আমি সেটা পড়লাম । এবং চিঠিটা নীতুর কাছে পৌছে দিলাম । তবে চিঠি পৌছে দেওয়ার আগে ভয়ংকর একটা কাজ করে ফেললাম ।
নির্ধারিত চলে এল । নীতু নির্ধাতি স্থানে গিয়ে হাজির হল ব্যাগ নিয়ে । তবে সেদিন শাহেদ ভাই এল না । রাত দশটা পর্যন্ত নীতু সেখানেই দাড়িয়ে রইলো । তারপর ওকে বাসার লোকজন খুজে নিয়ে এল । পুরোপুরি ঘর বন্দী করে ফেলল ওকে । অবশ্য তারপর খুব বেশি দিন ওরা ওখানে ছিল না । মাস খানেক পরেই নীতুকে নিয়ে ওর মা চলে গেল ওর মামার বাড়ি রাজশাহীতে । নীতু ওখানেই কোচিং করেছে এবং ঐ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলো । আমি ঢাকাতে ভর্তি হয়েছিলাম । তারপর নীতুর সাথে আমার আর কখনই দেখা হয় নি । তবে শাহেদ ভাইয়ের সাথে আমার দেখা হয়েছে নিয়মিতই । নীতুরা চলে যাওয়ার বছর দুয়েক সে বিয়ে করে সংসারি হয়েছে ।
নীতুর কী হয়েছিলো আমি আর কোন খোজ পাই নি । তবে নীতু কোন দিন আমার মন থেকে মুছে যায় নি । নীতুকে আমি ঠিক ভালোবাসতাম না এটা সত্য । তবে কেন জানি নীতুর পাশে শাহেদ নামের ভ্যাগাবন্ড টাইপের কাউকে সহ্য হত না । তাই আমি চাই নি শাহেদের সাথে নীতুর বিয়ে হোক কিংবা ওরা একসাথে থাকুক । তাই সেদিন যখন শাহেদ ভাই নীতুকে বাসা থেকে পালিয়ে আসতে বলল আমি কেবল চিঠিতে একটা জায়গার যে জায়গার নামটা ছিল সেটা বদলে দিলাম । নীতু দাড়িয়ে দিল বাসস্টান্ডে আর শাহেদ ভাই অপেক্ষা করছিলো রেল স্টেশনে ।
Discover more from অপু তানভীর
Subscribe to get the latest posts sent to your email.