চিত্রা

oputanvir
4.7
(51)

আমার প্রতি চিত্রার মনভাব সব সময় আন্তরিক ছিল । শুরুটা হয়েছিলো খুব সাধারণ ভাবে । বসুন্ধারা সিটিতে একদিন আমি মুভি দেখতে গিয়েছিলাম । মুভি সাধারণত আমি একাই দেখি । মুভি থিয়েটারে ঢুকতে যাবো তখনই চিত্রাকে আমি দেখি । কেমন যেন বিষণ্ণ ভাবে দাড়িয়ে রয়েছে । কারো জন্য অপেক্ষা করছে না । মেয়েটার চোখে যে বিষণ্ণতা ছিল সেটা আমাকে সহজেই আকর্ষিত করলো । তবে মেয়েটা যখকন আমার পাশের সিটে এসে বসলো তখন খানিকটা অবাক না হয়ে পারলাম না । পুরো মুভি চলাকালীন সময়ে আমি মুভির থেকে চিত্রার দিকেই বেশি তাকিয়ে ছিলাম । সম্ভবত চিত্রা নিজেও ব্যাপারটা খেয়াল করেছিলো । তবে সে বিরক্ত হল না ।

ইন্টারভ্যালের সময় আমি যখন পপকর্ণ কিনতে গেলাম তখন চিত্রা আমার পেছনেই দাড়িয়ে ছিল । আমাকে খানিকটা অবাক করে দিয়ে চিত্রা পেছন থেকে আমাকে বলল, একটা লার্জ সাইজ পরকর্ন কিনুন তো !
আমি সত্যিই এই ব্যাপারটা জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না । তবে সামলে নিলাম সাথে সাথেই । পরকর্ন কেনা হল । হলে ঢুকে ওর সাথে কথাও হল ।
মুভি শেষে বের হওয়ার সময় আমি যখন চিত্রার কাছে ওর ফোন নম্বর চাইলাম ও বলল যে এই দেখা এখানেই শেষ হোক । তবে ভাগ্যে থাকলে আবারও দেখা হবে । আমি যদিও নিশ্চিত ছিলাম না যে আমাদের আবার দেখা হবে কিনা তবে মনের ভেতরে একটা চাওয়া ছিল যে চিত্রার সাথে আরেকবার দেখা হোক। ও যখন চলে যাচ্ছিলো মুভির মত মনে মনে বলছিলাম যে আমার দিকে পেছন ফিরে তাকাবে ও । তবে তেমনটা হল না । চিত্রা পেছন ফিরে তাকালো না ।

তবে আমাদের আবারও দেখা হল । রাস্তার মাঝেই । মাঝে মাঝেই আমি বাইক নিয়ে এদিক ওদিক কোন কারণ ছাড়াই ঘুরে বেড়াই । সেদিনও ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম । তখন চোখ গেল রাস্তার এক কোনে । একটা মেয়ে রাস্তায় পড়ে থাকা একটা কুকুরের বাচ্চার পাশে বসে রয়েছে । তাকে পানি খাওয়ানোর চেষ্টা করছে । আমি বাইকটা থামিয়ে সেখানে গেলাম । কুকুরের বাচ্চার দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে । আমি দাড়াতেই মেয়েটা আমার দিকে ফিরে তাকালো । চিত্রাকে যেমন করে আমি চিনতে পারলাম । চিত্রাও আমাকে চিনতে পারলো ।

কুকুরের বাচ্চাকে আমি পশু হাসপালে নিয়ে গেলাম । সেখানেই ওর চিকিৎসা হল । ডাক্তার জানালো যে ওটাকে আরও কয়েকদিন রাখতে হবে । তাই করা হল । সব কাজ কর্ম শেষ করে যখন বাইরে বের হয়ে এলাম তখন বেশ রাত হয়ে গেছে । আমি চিত্রাকে বাসায় পৌছে দিতে চাইলাম । প্রথমে মনে হয়েছিলো যে ও হয়তো মানা করবে । তবে করলো না ।
ওদের বাসার গেটের সামনে নামিয়ে দেওয়ার পর চিত্রা নিজ থেকেই আমার নম্বর নিল । জানালো যে আমাকে সে ফোন করবে । এরপর থেকেই আমাদের দেখা সাক্ষাত হতে লাগলো । প্রথমে অল্প অল্প পরে ঘনঘন । একটা সময়ে আমি বুঝতে পারলাম যে চিত্রার প্রতি আমি দুর্বল হয়ে পড়েছি । বিশেষ ওর ভেতরে যে বিষণ্ণতা ছিল সেটা কেন জানি আমাকে খুব বেশি টানতো । কেবলই মনে হত কোন ভাবেই মেয়েটার এই বিষণ্ণতাকে আমি যদি দুর করতে পারতাম । কিন্তু চিত্রা সব সময় এটা এড়িয়ে যেত । ওর অতীতে কোন গল্প আছে সেটা এড়িয়ে যেত সব সময় । আমাকে বলতো না ।

আমি ওকে নিজের মনের কথা বলতে খানিকটা দ্বিধান্বিত ছিলাম কারণ চিত্রা আমার ধর্মের ছিল না । তারপরেও এক সময়ে কেবল খেয়াল করলাম যে চিত্রার কথা আমি কোন ভাবেই নিজের মন থেকে ভুলতে পারছি না । ওকে মন থেকে বের করতে পারছি না । সম্ভবত চিত্রাও আমার মনের কথা বুঝতে পেরেছিলো । একদিন সে নিজেই আমাকে বলল, তুমি যা চাচ্ছো তা আসলে আমার পক্ষে সম্ভব না ,
আমি অন্য দিকে তাকিয়ে বললাম, আমি বুঝতে পারছি ।
-তবে তুমি আমার সাথে অন্য কিছু করতে চাও সেটাতে আমার আপত্তি নেই ।
আমি ওর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বললাম, অন্য কিছু মানে?
চিত্রা বিন্দু মাত্র অস্বস্তিতে না পড়ে বলল, অন্য কিছু মানে যদি সেক্স করতে চাও তবে আমি মানা করবো না ।

আমি একটু থমকে গেলাম প্রথমে । চিত্রার কাছ থেকে এমন একটা কথা আমি শুনবো আশা করি নি । তবে সামলে নিলাম । তারপর বললাম, অবশ্য আমি তোমার সাথে সব কিছু করতে চাই । তবে সেটা কেবল শারীরিক নয় যখন তুমি আমাকে ভালোবেসে আমার কাছে আসবে তখন এর আগে না !

আমার কথা শুনে চিত্রা কিছুটা সময় আমার দিকে তাকিয়ে রইলো একভাবে । যেন বোঝার চেষ্টা করছে যে আমি মিথ্যা বলছি নাকি সত্য । এর কিছু সময় পরে আমার পাশে এসে বসলো সে । আমার ডান হাতটা নিজের হাতের ভেতরে নিলো । তারপর বলল, আমি যে অন্য ধর্মের সেটা তোমাকে সংকটে ফেলবে না ? তোমার ফ্যামিলি?
-হয়তো করবে ? কিন্তু সামলে নেওয়া যাবে !
-তাই ? প্রেমে পড়লে মানুষের যে চিন্তা ভাবনা সঠিক ভাবে করতে পারে না সেটা তোমাকে দেখে আবার প্রমাণিত হল!

চিত্রা এই কথাটা আমার কেন জানি মনে হল যে চিত্রার সাথে আমার প্রেম শুরু হয়ে গেছে । এবং সেটা সত্যিই হয়ে গেল । ও আমাকে যদিও তখনও মুখ ফুটে বলে নি যে ও আমাকে ভালোবাসে কিন্তু ওর আচরণে সেটা পরিস্কার ভাবে বলে দিতো যে সে আমারই প্রেমিকা । চিত্রাকে প্রথম চুমু খেলাম রিক্সার ভেতরে । সময় তখন সন্ধ্যা । আজিমপুরে ওর বাসার হাউজিংয়ের দিকে যাচ্ছি । রাস্তা বলতে গেলে একেবারে ফাঁকা । তখন চট করে ওর গালে তারপর ঠোঁটে চুমু খেলাম যদিও সেগুলোর স্থায়িত্ব খুব বেশি সময় ছিল না । মনের ভেতরে একটা ভয় ছিল যে ও হয়তো রাগ করবে তবে করলো না । আমার দিকে একবার দৃষ্টি দিল কপট রাখের একটা ভাব করে । তবে আমার মনে হল যে সেই চোখে প্রশ্রয়ের দৃষ্টি ছিল বেশি । এরপর থেকে আমি যেন আরও মাথায় উঠে বসলাম । প্রথমে কেবল চুমুতে আমি সন্তুষ্ট থাকলেও দিন দিন আমার চাহিদা বাড়ছিলোই । এক সময়ে সেটা এতো তীব্র হয়ে উঠলো যে মনে হল যে ওকে ছাড়া একটা দিনও থাকা যাবে না । আমি ওকে যখন বিয়ের কথা বললাম প্রথমে ও একটু চুপ করে ছিল । আমার মনে একটু ভয় উঠলো যে ও হয়তো মানা করে দিবে । তবে মানা করলো না । ও বলল যে বিয়ে করতে হবে আমাদের একা একাই । কারণ বাসার লোকজন মানবে না খুব স্বাভাবিক ভাবেই । আমার অবশ্য তাতেও কোন সমস্যা নেই । কোর্ট ম্যারেজ করে ফেললাম । বাসায় জানানোর পরে তারা যেন একেবারে ফেটে পড়লো । বলল যে আমি যেন তাদের মুখ আর না দেখি । আমি জানতাম যে এমন কথা তারা বলবে । তবে কদিনের ভেতরে তারা সব মেনে নিবে । সেটা নিয়ে আমার চিন্তার কোন কারণ ছিল না । আমার ভয় ছিল যে চিত্রার পরিবার হয়তো কোন ঝামেলা করতে পারে । তবে চিত্রার দিক থেকে কোন উচ্চ বাচ্চ দেখলাম না । আমি কয়েকবার জিজ্ঞেস করলাম ওর বাবা মায়ের কথা তবে খুব বেশি কথা বলল না। কেবল জানালো যে ওর বাবা মা কেউ বেঁচে নেই । বড় ভাই আছে । তারা ঢাকাতে থাকে । এরবেশি কিছুই আমাকে বলল না । বড় ভাইয়েরা ঝামেলা করবে কিনা এমন প্রশ্ন করলে বলল যে সেটা নিয়ে মোটেই আমাকে চিন্তা করতে হবে না ।
বিয়ের পর আমরা এক সাথেই থাকতে শুরু করলাম । মাস খানেক পরে চিত্রা নিজ থেকেই বলল যে ওর সাথে আমি কোথাও বেড়াতে যেতে চাই কিনা !
আমরা যদিও হানিমুন করে এসেছি । তারপরেও চিত্রা যখন মুখ ফুটে বলল আমি বললাম, হ্যা চল । এবার কোথায় যেতে চাও বল?
-আমাদের গ্রামের বাড়ি যাবে?
-তোমাদের গ্রামের বাড়ি? কোথায়?
-খুলনাতে ? অনেক দিন যাই না । যাবে?
-হ্যা । চল ।
-আচ্ছা ।

আমার তখন কিছু মনে হয় নি। অফিস থেকে দুদিন ছুটি নিয়ে রওয়ানা দিয়ে দিলাম । যতখানি সহজ মনে হয়েছিলো তার থেকে কঠিন হল ওদের গ্রামের বাসায় যাওয়াটা । যখন পৌছালাম তখন প্রায় বিকেল হয়ে গেছে । আমাদের রিক্সাটা যে বাড়িটার সামনে থামলো সেটা দেখে আমার চোখ চোয়াল ঝুলে গেল ।
আমি চিত্রার দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও আমার অবাক হওয়াটা খানিকটা উপভোগ করলো । আমি বলল, এতো বড় বাড়ি তোমাদের ? তোমরা দেখি জমিদার !
-জমিদার না ছাই । চল ভেতরে । দেখছো কেমন সব ভেঙ্গে চুরে গেছে ।

হ্যা এটা সত্য যে বাড়ির বড় করুণ দশা । তবে এক সময়ে যে এটা বিশাল বড় একটা বাড়ি ছিল সেটাতে কোন সন্দেহ নেই । আমরা গেটের কাছে আসতেই দেখলাম একজন বুড়ো মত লোক এসে হাজির হলেন । চিত্রার দিকে তাকিয়ে বললেন, এসেছো মা ?
-হ্যা কাকা । কেমন আছেন?
-এই আছি এক রকম । আসো আসো ভেতরে আসো ! তোমাদের জন্য বাড়িতে ঘর ঠিক করে রেখেছি । এটা কে তোমার সাথে?
-কাকা এটা আমার স্বামী ।

বৃদ্ধ লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছু সময় । আমি সালাম দিতে গিয়েও আটকে গেলাম । সালাম দেওয়া ঠিক হবে না । বললাম আদাব ! আপনিই বুঝি নরেন কাকা । আপনার কথা শুনেছি অনেক ।
নরেন কাকা হাসলো । দেখলো আরও দুজন লোক এসে হাজির হল । এরা বাড়ি দেখা শোনা করে । আমাদের ব্যাগ নিয়ে হাজির তারা দুই তলার দিকে চলে গেল ।

দুই
রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমি আর চিত্রা বের হলাম গ্রামের দেখতে । কিন্তু বের হতে যাওয়ার পথে নরেন কাকা আমাদের পথ আটকে দাড়ালেন । তারপর বললেন, এই সময় কোথায় যাচ্ছো তোমরা?
-কাকা একটু হাটতে যাচ্ছি ।
হাটতে যাচ্ছি বাক্যটা শুনেই নরেক কাকা কেমন যেন ভয় পেয়ে গেলেন । আমাদের দিকে তাকিয়ে সাবধানে বললেন, না মা, এখন বের হয়েও না । কাল সকালে যত পারো ঘুরে বের হয়েও । কিন্তু এখন না।
চিত্রা বলল, এখন বের হলে কী সমস্যা?
-তোমাদের ঢাকার মত এটা না । এটা গ্রাম। এখানে রাতে বের না হওয়াই ভাল । কাল সকালে বের হয়েও । সারা দিন পরে আছে ! আর এই ….

নরেক কাকা যেন কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না । থেমে গেল । কিছু সময় আমাদের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আচ্ছা এই পুকুরের পাড়ের বাইরে যেও না কেমন ! রাতের বেলা সাপখোপ থাকবে ।
-আচ্ছা কাকা !

আমি চিত্রাকে নিয়ে হাটতে বের হলাম । আমি যদিও গ্রামেই জন্মেছি তবে অনেক দিন ধরেই আমি ঢাকাতে থাকি । গ্রামে আমার যাওয়া হয় না খুব একটা । আর চিত্রাকে বিয়ে করার পরে আমার বাসার সাথে সম্পর্ক আরও খানিকটা খারাপ হয়েছে । আর এছাড়া আমাদের গ্রামকে ঠিক গ্রাম বলা যায় না যায় না এখন । তবে চিত্রাদের এই গ্রামটা একেবারেই গ্রাম । এখানে মানুষের বাসায় ঠিক মত বিদ্যুৎ পর্যন্ত পৌছায় নি । আমার বেশ চমৎকার লাগছিলো ওর সাথে হাটতে । বাইরে বেশ চমৎকার বাতাস দিচ্ছিলো । আমি চিত্রার হাত ধরে হাটছিলাম । আমার কাছে এখনও সব কিছু কেমন যেন স্বপ্নের মত মনে হয় । আমি আসলে কোন দিন ভাবিও নি যে চিত্রাকে আমি আপন করে পেয়ে যাবো ।

পুকুর পাড়ে দাড়িয়ে রইলাম বেশ কিছুটা সময় । পুকুরের পানিটা ঠিক পরিস্কার না। এই সন্ধ্যা বেলায় চারিদিক অনেক অন্ধকার হয়ে গেছে । তবে তারপরেও আমি পানিটাকে দেখছি পাচ্ছি বেশ ভালই । আমার মনের কথাই যেন চিত্রা বুঝতে পারলো । পানির দিকে তাকিয়ে থেকেই বলল, আগে আমাদের এই পুকুরটা অনেক পরিস্কার ছিল । রীতিমত মানুষ রেখে সেটা দেখা শোনা করা হত । এখান থেকে চলে যাওয়ার পরে আর এসব দেখা শোনার লোক নেই ।

আমরা আরও কিছু সময় পুকুর পাড়ে দাড়িয়ে রইলাম । পুকুরটা পাড় হয়েই বেশ কিছু ঝোপঝাড় । তারপরেই আমরা একটা ভাঙ্গা বাড়ি দেখতে পেলাম । বাড়ির পরেই ফসলের মাঠ । আমরা দুজন পুকুরের কাছে দাড়িয়ে রয়েছে । চারিদিকে সব নিশ্চুপ । ঠিক এমন সময়ই আমি দেখতে পেলাম যে পুকুরের ওপাশে, ভাঙ্গা বাড়িটার কাছে একজন মানুষ দাড়িয়ে রয়েছে । দুর থেকে অবশ্য তার চেহারা দেখা যাচ্ছে না তবে একটা অয়োবয় বোঝা যা্ছে একেবারে পরিস্কার । এই রাতের বেলা ওখানে লোকটা দাড়িয়ে থাকতে দেখে আমার একটু অবাক লাগলো । তখনই অনুভব করলাম যে চিত্রা আমার হাত খুব শক্ত করে চেপে ধরেছে । আমি ওর দিকে তাকিয়ে বুঝলাম যে ও নিজেও সেই অয়বয়টার দিকে তাকিয়ে রয়েছে । আমি বললাম, কী হল !
-চল এখান থেকে !
আমি কিছু বলতে গিয়েও বললাম না । চিত্রাকে নিয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলাম ।

রাতে খাওয়া শেষ করে শুয়ে পড়লাম একটু তাড়াতাড়িই । অনুভব করলাম যে চিত্রা আমার খুব কাছে এসে শুয়েছে । এমনিতে চিত্রা সব সময়ই শীতল আচরণ করে আমার সাথে। আমি এগিয়ে গেলেই কেবল এগিয়ে আসে । আজকে নিজ থেকে এগিয়ে আসায় আমি খানিকটা অবাক হলাম ।

সকালে ঘুম ভাঙ্গলো বেশ বেলা করেই । তাকিয়ে দেখি চিত্রা ততক্ষনে উঠে পড়েছে । সকালের নাস্তা শেষ করে আমরা গ্রাম দেখতে বের হলাম । চিত্রাদের গ্রামটা বেশ বড়ই বলা চলে । এক সময়ে গ্রামের প্রায় অর্ধেকটাই চিত্রাদের ছিল । তবে এখন নিজেদের বাড়ি আর পুকুর পাড় ছাড়া বলতে গেলে আর কিছুই নেই । সব কিছু ওরা বিক্রি করে দিয়ে শহরে চলে গেছে । নিজের ভিটা বলেই হয়তো বিক্রি করতে পারে নি ।

তবে দেখলাম যে গ্রামের মানুষজন এখনও চিত্রাকে মনে রেখেছে । চিত্রা যখন গ্রাম ছেড়ে চলে যায় তখন চিত্রা মাত্র এসএসসি পাশ করেছে । এতো দিন পরে ওকে দেখতে পেয়ে অনেকেই কাছে এসে কথা বলল । এখন কী করে না করে সব জানতে চাইলো । আমি যে ওর স্বামী এটা জেনে অনেকে অবাক হল খানিকটা তবে সেই সাথে খুশিও হল ।

রফিক মুন্সি নামের একজন লোকের সাথে দেখা হল আমাদের । চিত্রাদের প্রায় সকল জমিজমা এই লোকই কিনে নিয়েছেন । এক সময়ে বিদেশে ছিলেন । ফিরে এসেছেন অনেক টাকা নিয়ে । আর সেই সময়ই চিত্রারা সকল জমি জমা বিক্রি কে দিয়েছিল । অবশ্য সেই সময়ে কেন হঠাৎ করে সব বিক্রি করে দিয়েছিলো সেটা আমি জানি না । কোন কারণ ছিল কি?
রফিক মুন্সিও চিত্রার সাথে অনেক ভাল ব্যবহার করলেন । সাথে এও জানালেন যে ওদের বাড়িটা সে এখনও কিনতে আগ্রহী । চিত্রা কিছু বলল না অবশ্য ।

ঘুরতে ঘুরতে আমরা এবার পুকুর পাড়ের সেই ভাঙ্গা বাড়িটার সানমে এসে হাজির হলাম । চিত্রা সেই বাড়ির দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময় । তারপর বলল, চল ফিরে যাই । আমার মনে কিছু জানার ছিল অবশ্য । তবে কোন কথা বললাম না । সময় হলে হয়তো চিত্রা নিজেই বলবে ।

কয়েকটা দিন কেটে এভাবেই । এবং তারপরেই ঝামেলা শুরু হল । চিত্রা ছোট ভাই এসে হাজির হল । এবং এসেই আমাদের উপর চিৎকার চেঁচামিচি শুরু করলো । আমাকে চিত্রা বিয়ে করেছে এটা সে কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছে না । চিত্রা অবশ্য সেসবে কান দিলো না । ওর ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি কী করবো সেটা তোমাকে জিজ্ঞেস করার কোন কারণ নেই । ভেবো না যে আমি সেই ছোট রয়েছে যে তুমি যা বলবে যেভাবে বলবে তাই করবো !
তখনই আমার মনে হল চিত্রার ভাই চিত্রাকে চড় মাড়বে । আমি একেবারে সঠিক সময়ে গিয়ে সেটা ধরে ফেললাম । চিত্রার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, ভাইয়া চিত্রার গায়ে হাত দিবেন না দয়া করে ।

আমার এভাবে ঠেকানোটা চিত্রার ভাইকে আরও রাগিয়ে দিল । আমার দিকে তাকিয়ে হুমকি ধামকি দিতে লাগলো । তবে আমার কেন জানি মনে হল এই হুমকি ধামকির কোন দাম নেই । চিত্রার ভাই সাইজে একটু ছোট । আমার শহরের ধারে কাছেও নেই । আমি যদি ঠিক মত ধরি তাহলে সে পেরে উঠবে না কোন ভাবেই । তবে হিসাবে সে বড় চিত্রার থেকে । আমার গুরুজন ।
চিত্রা আমার পাশেই ছিল । সে তার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে তীব্র চোখে বলল, সেইবার তো নিজের সাঙ্গা পাঙ্গ দিয়ে একজনের সাথে খুব পেরেছিলো । এবার কোথার তোমার সেই সাঙ্গপাঙ্গ? তোমাকে কেবল আড়াচ মারবে এবার যদি আমার গায়ে হাত দিতে যাও । তোমার বাড়ি যেমন এইটা আমার বাড়িও ।

রাতে আমরা একই টেবিলে খাওয়া দাওয়া করলাম । নরেক কাকা চিত্রার ভাইকে কী বলে সামলিয়েছে সেটা আমার জানা নেই । তবে সে মুখ গম্ভীর করে খাবার টেবিলে বসে ছিলেন । আমরা চুপচাপ খাওয়া দাওয়া করলাম । রাতের বেলা চিত্রাকে নিয়ে বারান্দায় বসেছিলাম । চিত্রার কাছে কিছু জানার ছিল তবে নিজ থেকে সেটা বলতে খানিকটা দ্বিধাবোধ করছিলাম । চিত্রা এক সময়ে নিজ থেকেই বলল কথাটা ।

আমি যখন এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছি সেই সময়ে গ্রামের একটা ছেলের সাথে আমার ভাব হয় । ঐ যে পুকুর পাড়ের ঐ ভাঙ্গা বাড়িটা দেখছো না, ওটা ওদের বাসা ছিল । ওর বাবা ছিল আমার গৃহশিক্ষক । তাই প্রায়ই ওদের বাসায় যাওয়া হত । এই ভাবেই ওর সাথে প্রেম হয় । এক সময় ওর সেটা আমার ভাইদের কাছে প্রকাশ পেয়ে যায় ।
-তারপর?
-তারপর আর কী? আমি জমিদারের মেয়ে । ও ছিল সামান্য শিক্ষকের ছেলে । যা হবার তাই হল । ওর বাবাকে ছাড়িয়ে দেওয়া হল। এবং সেই সাথে গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার হুমকি দেওয়া হল । তবে মৃনাল ভয় পাওয়ার ছেলে ছিল না । এতেই আসলে কাল হল । আমার ছোট ভাই তার কয়েকজন গুন্ডা পান্ডা মিলে ওকে রাতের বেলা ধরে নিয়ে বেদম পেটালো । তারপর ওকে ওভাবেই জঙ্গলের ভেতরে ফেলে দিয়ে চলে এল । তখনও যদি ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হত হয়তো সে বেঁচে যেত । সারা রাত ওভাবে ঠান্ডার ভেতরে পড়ে ছিল সে । সেখানেই মারা যায় ।
-এরপর ?
-এরপর আর কী থানা পুলিশ হল । টাকা আর ক্ষমতা থাকলে সব অন্যায় থেকে পার পাওয়া যায় । আমার ভাইদেরকোন অন্যায় রইলো না । তবে তাদের করা এই অন্যায়টা ঠিক পারও হয়ে যায় নি ।
-কী রকম?
-মৃনালের মৃত্যুর কয়েক দিন পর পর্যন্ত ওর বাবা অনেক বার থানা পুলিশ করেছিলো । কিন্তু কোন লাভ হয় নি । শেষে একদিন তিনি হাল ছেড়ে দিলেন । তার কয়েকদিন পরেই মৃনালের বাবাকে নিজের ঘরে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় । এরপর থেকেই আসল সমস্যা শুরু হয় । স্যারের মৃত্যুর পরে আমাদের গ্রামে কিছু অদ্ভত ঘটনা ঘটতে শুরু হল । আমাদের গ্রামের অনেকেই মৃণালকে দেখতে শুরু করলো । বিশেষ করে যেখানে মৃনাল পড়ে রাতের বেলা সেই খানে । প্রথম প্রথম মানুষ দেখতো তবে এটা নিয়ে খুব একটা কিছু আমলে নিতো না । কিন্তু যখন প্রথম খুনটা হল গ্রামে তখন যেন মানুষ একটু নড়েচড়ে বসলো । প্রথম যে অপঘাতে মারা গেল সে হচ্ছে ঐ সাঙ্গপাঙ্গদের একজন ছিল যারা আমার ভাইয়ের সাথে মিলে মৃনালকে মেরেছিলো । এভাবে একে একে চারজন মারা গেল । রাতের বেলা ।

আমি চুপ করে রইলাম । ব্যাপারটা হজম করার চেষ্টা করছি আমি । কারণ চিত্রা যা বলছে তা সহজে বিশ্বাস করা সহজ ব্যাপার না । চিত্রা আবার বলে চলল, এবং একদিন সেই মৃনাল আমার ছোট ভাইকেও দেখা দিল । তবে ভাগ্য ভাল সে কোন ভাবে রক্ষা পেয়ে গিয়েছিলো । এরপর আমাদের পুরো পরিবারের লোকজন প্রায়ই তাকে দেখতে শুরু করলো । ভয় পাওয়া শুরু করলো । এমন কী আমিও একদিন দেখেছিলাম । এই ভয় থেকেই আমরা গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম ।

আমি বললাম, ঐদিন পুকুর পাড়ে কি তুমি তাকে দেখেছিলে?
-হ্যা ।
আমার পুরো শরীর জুড়ে কেমন জানি একটা কাটা দিয়ে উঠলো । কারণ সেই কালো অয়োবয় টা আমি নিজেো দেখেছিলাম । সেটা যদি মৃত আত্মার হয়ে থাকে, তাহলে …?

আমি আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলাম তখনই একটা ভয়ার্থ আওয়াজ শুনলাম । গলার আওয়াজটা চিনতে আমাদের কারোরই খুব একটা কষ্ট হল না । চিত্রার ভাইয়ের কন্ঠ ! আওয়াজটা আসছে পুকুর পাড় থেকে । আমি ঐদিকে যাওয়ার জন্য হাটতে যাবো তার আগেই চিত্রা আমার হাত চেপে ধরলো । চোখের ইশারাতে বলল যে যাওয়া লাগবে না ।
আমি খানিকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে । ততক্ষণে চিৎকার আসতে আরও জোড়ে । যেন কেউ চিত্রার ভাইকে তীব্র ভাবে মারধোর করছে । সেই আওয়াজটাই ভেসে আসছে । তবে এক সময় সেই চিৎকার বন্ধ হয়ে গেল । আমি এই পুরো সময় কাঠ হয়ে দাড়িয়ে ছিলাম । চিত্রা শান্ত ভাবে তাকিয়ে রইলো অন্ধকারের দিকে । এমন একটা মনভাব যে কোন কিছুই হয় নি ।

তিন

চিত্রার ভাইকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন নরেক কাকা । সে পুকুর পাড়ে পড়ে ছিল । তার চিৎকার আমার মত সবাই শুনতে পেয়েছে ঠিকই তবে কেউই সাহস করে এগিয়ে যেতে পারে নি । যখন চিৎকার বন্ধ হয়েছে তখন নরেন কাকা এগিয়ে গেছে । সেখান থেকে তাকে হাসপাতালের দিকে নিয়ে যাওয়া হল । আমি ভ্যানের উপরে তার চেহারা একটু দেখেছিলাম । এমন ভয়ংকর ভাবে তাকে পেটানো হয়েছে যে মুখের আর আস্ত নেই কিছুই। এমন ভাবে কোন মানুষর পক্ষে অন্য মানুষকে পেটানো সম্ভব না । সত্যিই সম্ভব না ।

চিত্রা সেদিকে কিছু তাকিয়ে থেকে দোতলা থেকে আস্তে আস্তে নিচের দিকে হাটা শুরু করলো । আমিও ওর পিছু নিলাম । দেখলাম আস্তে আস্তে সে পুকুর পাড়ের দিকেই এগিয়ে গেল । আমি ভয়ে ভয়ে চিত্রাকে কয়েকবার ডাক দিলাম । বললাম যে ওদিকে যাওয়ার দরকার নেই । তবে চিত্রা আমার কথায় কোন কান দিল না । সে এগিয়ে গেল সেদিকে । আমি ওকে রেখে কোন ভাবেই চলে আসতে পারি না । ওর সাথেই গেলাম সেখানে ।

কত সময় সেখানে দাড়িয়ে ছিলাম জানি না তবে একটা সময়ে ঠিকই সেই অয়োবয়টাকে দেখতে পেলাম । প্রথমে সেই ভাঙ্গা বাড়ির কাছে তারপর আস্তে আস্তে সেটা এগিয়ে এল পুকুর পাড়ে । যদিও আমরা তার চোখ দেখতে পাচ্ছি না অন্ধকারের কারণে তবে আমার বুঝতে মোটেও কষ্ট হল না যে সেটা আমাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে । আমার শরীরের ভেতরে সেই কাটা দিয়ে উঠলো । এভাবেই এক ভাবে তাকিয়ে রইলো সে । চিত্রাও একভাবে তাকিয়ে রইলো সেদিকে । তবে এক সময়ে সেই অয়োবয়টা পেছনে চলে গেল সেই ভাঙ্গা বাড়ির দিকে ।

সকালেই নরেক কাকা খবর দিলেন যে চিত্রার ভাইকে ঢাকাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে । অবস্থা নাকি খুবই খারাপ । ডাক্তাররা বলেছেন তার বাঁচার সম্ভবনা খুবই কম । আমরাও পরদিন সকালেই ঢাকার উদ্দেশ্য রওয়ানা দিলাম । পরের দিনই আমি জানতে পারলাম যে চিত্রার ভাই মারা গেছে ।

পরিশিষ্টঃ

আমার বাসা থেকে চিত্রাকে মেনে নিয়েছে । আমরা চিত্রার দিককার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করি নি । চিত্রাই করতে চায় নি । সে সব কিছু ছেড়েই আমার কাছে চলে এসেছে । আর চিত্রাদের গ্রামে আমরা গিয়েছিলাম আরও বছর দুয়েক পরে । সেখানে গিয়ে অবশ্য আর সেই আত্মায় দেখা পাই নি । লোকজনের কাছ থেকে শুনি যে সেই অশরীরিকে মানুষ অনেক দিন দেখে নি ।

আমার মনে একটা সন্দেহ অনেক দিন থেকেই জমা হয়ে রয়েছে । আমার কেন জানি মনে হয় যে চিত্রা ইচ্ছে আমাকে নিয়ে ওদের গ্রামে গিয়েছিলো । ওর মনের ধারণা ছিল যে চিত্রার ভাই আমাদের গ্রামে যাওয়ার কথা শুনে ঠিকই গিয়ে হাজির হবে । আর যে কোন ভাবে চিত্রা চাইছিলো যাতে সে গ্রামে যায় । এবং শেষ পর্যন্ত সেটাই হয়েছে ।
অবশ্য এসবই আমার অনুমান । আমি এই কথা চিত্রাকে জিজ্ঞেস করি নি কোন দিন । আমার এতো কথা জিজ্ঞেস করার কোন দরকার নেই ।

গল্পটার নিজের লেখা হলেও এই গল্পের উৎস একটি রেডিও প্রোগ্রামে শোনা গল্প । এই গল্পটা সেই গল্প থেকেই এডোপ্ট করা।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.7 / 5. Vote count: 51

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

One Comment on “চিত্রা”

Comments are closed.