অনুরূপা

oputanvir
4.6
(67)

ফেন্সী আর পস রেস্টুরেন্টে খুব একটা যাওয়া হয় না অনুরূপার । অনুরূপার কেন জানি এখন এই আভিজাত্য চাকচিক্য গুলো সব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে । নিজের কাজের ভেতরে থাকা, ছুটির দিন গুলোতে বাসায় শুয়ে বসে বই পড়ে সময় কাটাতেই এখন অনুরূপার বেশি ভাল লাগে । এই শুক্রবারেও ঠিক সেই রকমই পরিকল্পনা ছিল কিন্তু আজকে ওকে গুলশানের এই রেস্টুরেন্টে আসতেই হল । কিছুতেই জয়নুল আবেদিন নামের মানুষটাকে এড়ানো সম্ভব হয় নি ।
জয়নুল আবেদিনকে সে চেনে প্রায় মাস দুয়েক ধরে । অনুরূপা যে অফিসে চাকরি করে সেই অফিসের একজন স্বনামধন্য ক্লাইন্ট সে । প্রথম যে দিন সে তাদের অফিসে আসে অনুরূপাই তাকে এটেন্ড করেছিল । যখন যার ডেস্ক ফাঁকা থাকে ক্লাইন্টদেরকে সে সার্ভিস দেয়ে । এই হচ্ছে নিয়ম । তবে পরের সপ্তাহে জয়নুল আবেদিন আবার যখন এল বিশেষ ভাবে তার চাহিদা ছিল যাতে অনুরূপাই তার কাজটা করুক । বড় মাপের ক্লাইন্ট সে । তার নিজেস্ব অফিস রয়েছে গুলশানেই । এই এক ক্লাইন্টকে হাতে রাখা মানেই হচ্ছে অনেক কিছু হাতে রাখা । অনুরূপার বস তাই তার দাবী মেনে নিয়ে নিয়েছেন । এরপর প্রায় প্রতি সপ্তাহেই জয়নুল আবেদিন এসেছে । এমন সব ছোট কাজ নিয়ে এসেছে, এমন কাজের জন্য কেউ অফিস পর্যন্ত আসে না । ফোনে কিংবা ইমেলে জানান দেয় । অনুরূপারা সেই মোতাবেগ কাজ করে দেয় ।
অনুরূপা একটু বিরক্ত হলেও কিছু বলতে পারে নি । বিশেষ করে তার বসস তাকে স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছে যে এই ক্লাইন্ট হাত ছাড়া করা যাবে না । এমনিতেও অফিসের অবস্থা ভালো না । তারা কোভিট পরবর্তি ক্ষতি এখনও কাটিয়ে উঠতে পারে নি । তাই সহ্য করে নেওয়া ছাড়া আর কিছু করার ছিল না । সেই কারণেই আজকে এই রেস্টুরেন্টে আসা ।

অনুরূপা কালো রংয়ের একটা সেলোয়ার কামিজ পরে এসেছে । গেট দিয়ে ঢুকতেই একজন ওয়েটার ওকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল ভেতরের দিকে । বড় ঘরটার পরেই এই ছোট ঘরটা । একটু অন্ধকার মত চারিদিকে । তবে চারিদিকে চমৎকার পরিবেশ । অনুরূপার মন ভাল হয়ে গেল । দেখতে পেল একেবারে কোণার দিকে একটা টেবিলে জয়নুল আবেদিন বসে আছে । সেদিকেই হেটে গেল সে ।

জয়নুল আবেদিন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আপনাকে চমৎকার লাগছে আজকে ।
অনুরূপা হাসলো । সে জানে তাকে দেখতে সুন্দর লাগছে । ভদ্রতা করে বলল, আপনাকেও ইয়াং লাগছে খুব ।
শব্দ করে হেসে উঠলো জয়নুল । তবে এটা কোন ভাবেই মিথ্যে না যে জয়নুল আবেদিন দেখতে সুপুরুষ । বয়স এখনও চল্লিশ পার হয় নি । অনুরূপা শুনেছে যে একবার বিয়ে হয়েছিল তবে বিয়েটা ঠিক টিকে নি । দুই বছরের মাথায় ডিভোর্স হয়ে যায় । তারপর থেকে সে সিঙ্গেলই আছে । এবং সে অনুরূপার ব্যাপারে তীব্র ভাবে যে আগ্রহী এটা অনুরূপা খুব ভাল করেই বুঝতে পারছে । তবে এখনও অনুরূপা ঠিক সিদ্ধান্ত নেয় নি । এটা নিয়ে এখনও নিজের কাছেই সে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে।

জয়নুল আবেদিন বসতে বসতে বলল, আচ্ছা বলুন তো আমার বয়স কত?
-কত হবে ! এই ধরেন ৩৫/৩৬ ।
জয়নুল আবেদিনের মুখ থেকে হাসি মিলিয়ে গেল । সেখানে একটা রহস্যময় আভা দেখা গেল । তারপর বলল, আমি যদি বলি আমি প্রায় ৬০০ বছরের বেশি সময় ধরে বেঁচে আছি , বিশ্বাস করবেন?
কথাটা জয়নুল আবেদিন এমন ভাবে বলল যে অনুরূপা একটু যেন চমকে উঠলো । তবে সামলে নিলো আথে সাথেই । তারপর বলল, এটা কি বিশ্বাস করার মত কোন কথা?
জয়নুল আবেদিন কিন্তু হাসলো না । সে বলল, না তবে এটা কিন্তু মিথ্যা না । আমি আসলেই অনেক গুলো বছর ধরে বেঁচে আছি । আমি একজন ভ্যাম্পায়ার !
এবার অনুরূপা শব্দ করে হেসে ফেলল । তারপর বলল, হ্যা আর আমি হচ্ছি রানী ভিক্টোরিয়া ।
জয়নুল আবেদিন একটু আহত কন্ঠে বলল, আপনি বিশ্বাস করলেন না? আমি কিন্তু মিথ্যা বলছি না । আমি আসলেই একজন ভ্যাম্পায়ার কাউন্ট। ৬০০ বছরের বেশি সময় ধরে আমি বেঁচে আছি। যখন বখতিয়ার খলজি এই দেশ আক্রমন করে, সেই সময়ে আমি সেই সতের জন সৈন্যের একজন ছিলাম ।
অনুরুপা এবার একটু বিরক্ত হল । সে বলল, দেখুন আপনি আমাকে এখানে ডিনারের জন্য ডেকেছেন সেটাই বরং শুরু করি আমরা ।
-আপনি আসলেই আমার কথা বিশ্বাস করছেন না ?
-করার কি কোন কারণ আছে?
-ওকে কী করলে আপনি বিশ্বাস করবেন শুনি?
অনুরূপা একটু দ্বিধায় পড়ে গেল । বিশেষ করে জয়নুল আবেদিনের কন্ঠে দৃঢ়তা দেখে সে আসলেই একটু অবাক হয়ে গেল । অনুরূপা বলল, আপনি যে ভ্যাম্পায়ার তা ওরা দিনের আলোতে বের হতে পারে না, শরীর পুড়ে যায় আপনি কিভাবে বের হন !
হাত দিয়ে আকাশে একটা তুড়ি মারার মত করে জয়নুল আবেদিন বলল, আরে ওসব গল্পের বেশির ভাগই বানানো । তবে সত্যিকারের ভ্যম্পায়ারদের সূর্যের আলোতে কিছুই হয় না । তবে হ্যা রক্ত কিন্তু আমর ঠিকই খাই । এটাই মূলত আমাদের অনেক বছর বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করে । আমরা আমাদের চোখ দিয়ে মানুষকে নিয়ন্ত্রনও করতে পারি । যে কাউকে দিয়ে যে কোন কিছু করাতেও পারি ।
অনুরূপা বলল, আচ্ছা আমাকে বলুন এমন কিছু করতে । দেখি যদি পারেন তাহলে বিশ্বাস করবো ।
জয়নুল আবেদিন বলল, আমি চেষ্টা করেছি আপনাকে নিয়ন্ত্রন করতে ! কিন্তু পারি নি । কী এক অদ্ভুত কারণে আপনাকে কিছুতেই নিয়ন্ত্রন করতে পারছি না আমি । এর একটা কারণ সম্ভবত আমি আপনার প্রেমে পড়েছি । এই কারণে কিছুতেই কিছু হচ্ছে না ।
অনুরূপা বলল, তাহলে আমি বাদ দিয়ে অন্য যে কাউকে নিয়ন্ত্রন করতে পারবেন?
-অবশ্যই । দেখতে চান ?
তারপর অনুরূপার উত্তরের অপেক্ষাতে না থেকেই সে হাতের ইশারাতে ওয়েটারকে ডাক দিল । ওয়েটার কাছে আসতেই সে ক্লাসের পানিটা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, এই গ্লাসের পানিটা তুমি ঐ সাদা শার্ট পরা ভদ্রলোকের গায়ে ঢেলে দিয়ে আসো !
ওয়েটার কিছু সময় তাকিয়ে রইলো জয়নুল আবেদিনের দিকে । তারপর গ্লাস টা হাতে নিয়ে এগিয়ে গেল সেই টেবিলের দিকে যেখানে সাদা সার্ট পরা লোকটা বসে আছে । অনরূপাকে চোখ বড় বড় করে কিছু সময় তাকিয়ে রইলো সেই দিকে । এবং সত্যি সত্যিই ওয়েটার পানি ঢেলে দিলো লোকটার শরীরে । পানি পড়তেই লোকটা চিৎকার করে উঠলো । তারপর ওয়েটারের গালে একটা চড় বসিয়ে দিল । ওয়েটার চড় খেয়েই যেন বাস্তবে ফিরে এল । তারপর অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো লোকটার দিকে । একটু আগে যে সে পানি ঢেলে দিয়েছে সেটা যেন তার মনেই নেই ।

অনুরূপার চোখের বিস্ময়টা উপভোগ করলো জয়নুল আবেদিন । তারপর ওর দিকে তাকিয়ে বলল, এই রুমের যে কাউকে দিয়ে আমি যা ইচ্ছে করাতে পারি । কেবল আপনি ছাড়া !
অনুরূপা ওয়েটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে তখনও । লোকটা তখনও সরি বলেই চলেছে । আর অন্য লোকটা চিৎকার করে চলেছে । অনুরূপা বলল, ঐ লোকটাকে থামতে বলুন । আমার মনে হয় যথেষ্ঠ অভিনয় করেছে সে !

জয়নুল আবেদিন এবার একটু চমকালো । তারপর হেসে ফেলল । ওয়েটার আর সাদা শার্ট পরা লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল, জামান এবার থামো ।
সাথে সাথে থেমে গেল কথা বার্তা । ওদের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লো ।

অনুরূপা কেন জানি বিরক্ত হল না । জয়নুল আবেদিনের দিকে তাকিয়ে বলল, এই কাজটা কেন করলেন শুনি?
খানিকটা লজ্জা মিশ্রিত হাসি দিয়ে জয়নুল আবেদিন বলল, আসলে আমি আপনাকে ইম্প্রেস করতে চেয়েছিলাম ।
-কেন?
-আপনি জানেন আমি কেন ইম্প্রেস করতে চেয়েছি, চাচ্ছি ! আমি আপনার ব্যাপারে খোজ খবর নিয়েছি । আপনাকে যখন প্রথম দেখি তখনই আমার কেবল মনে হয়েছে বাকি জীবনটা আপনার সাথে কাটানো যায় !
-সত্যি কথা বলার জন্য ধন্যবাদ । তবে আমি আপনার মনভাব বুঝতে পেরেছি অনেক আগেই । তবে বিরক্ত হই নি । আজকের আপনার ছেলে মানুষী দেখে হাসলাম কেবল ।

একটু পরেই খাবার চলে এল । খাবার খেতে খেতে গল্প হল অনেক । খাওয়া দাওয়া শেষ যখন হল তখন প্রায় বারোটা বেজে গেছে । জয়নুল আবেদিন নিজে গাড়ি চালিয়ে অনুরূপাকে বাসায় পৌছে দিল । অনুরূপার বাসাটা শহর থেকে বেশ দুরে । বসিলা ব্রিজ পার করে আরও কিছুটা দুরে । একেবারে নদীর ধারে । একটা ছোট দুই তলা বাড়ি । বাড়িটা প্রায় অন্ধকার হয়ে আছে । কেবল সামনে একটা আলো জ্বলছে । জয়নুল আবেদিন একটু অবাক হল বাড়ি দেখে । গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল, আপনি এখানে থাকেন ?
অনুরূপা বলল, হ্যা । আসলে আমি একটু নিরিবিলি থাকতে পছন্দ করি সব সময় । এই নদীর ধারে বসে থাকতে আমার ভাল লাগে । আসবেন ভেতরে?
জয়নুল আবেদিন বলল, চলুন । আপনার বাসাটা দেখা যাক ।

গেটের সামনেই গাড়িটা পার্ক করে রাখলো জয়নুল আবেদিন । তারপর ভেতরে ঢুকলো । দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই জয়নুল আবেদিনের মনে হল যেন একটা অন্য জগতে জগতে চলে এসেছে । আলো জ্বলে উঠলো ঘরের । তাকে বসিয়ে রেখে অনুরূপা রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ালো । জয়নুল ঘরের দিকে দেখতে শুরু করলো । পুরো ঘর জুড়ে অনেক চমৎকার আসবারে সাজানো । সব কিছু বেশ পুরানো আর দামি মনে হল জয়নুল আবেদিনের কাছে । মেয়েটা কেবল দেখতেই সুন্দর নয়, মেয়েটার রূচিরও প্রশংসা করতে লাগলো জয়নুল আবেদিন । মনে মনে আবারও ঠিক করে নিল যে যে কোন ভাবেই মেয়েটাকে রাজি করাতেই হবে ।

একটু পরেই অনুরূপা দুই কাপ কফি নিয়ে ঢুকলো ঘরে । একটা জয়নুল আবেদিনের দিকে । কফিতে চুমুক দিতেই জয়নুল আবেদিনের মনে হল এমন চমৎকার স্বাদের কফি সে খায় নি অনেক দিন । অনুরূপার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি আমাকে সত্যি ইম্প্রেস করেই চলেছেন ।
অনুরূপা হেসে বলল, আপনিও কম চেষ্টা করেন নি ।
-আচ্ছা আপনার মনে কি একবারের জন্যও মনে হয় নি এটা সত্য হতে পারে । মানে যে সত্যিই রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ার হতে পারি !
-নাহ ! একটা বারের জন্যও না !
-কেন না? আমার সেটআপে কি কোন সমস্যা ছিল ?
-না ছিল না । অন্য কেউ হলে বিশেষ করে ওয়েটার যখন জামান সাহেবের শরীরে পানি ঢেলে দিলো তখন মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল । কিন্তু আমার মনে হয় নি ।
-কেন?
-কারণ …..
একটু থামলো অনুরূপা । তারপর ঠান্ডা গলাতে বলল, একটা ভ্যাম্পায়ার অন্য ভ্যাম্পায়ারকে খুব ভাল করেই অনুভব করতে পারে ।
জয়নুল আবেদিন চমকালো একটু । বলল, মানে?
অনুরূপা এবার একটু হেসে বলল, মানে হচ্ছে আমি আপনাকে অনুভব করতে পারি নি । মানুষ আর ভ্যাম্পায়ারের রক্তের প্রভাহে একটা পার্থক্য আছে । মানুষেরটা বড় লাউড । এই যে আপনার গলার কাছ থেকে একটা রক্তের প্রবাহ বয়ে যাচ্ছে আমি এটা এখান থেকে টের পাচ্ছি ।

জয়নুল আবেদিন কেন জানি এই কথাটা মোটেই হেসে উড়িয়ে দিতে পারলো না । সেই সাথে একটা ভয় এসে জড় হল তার মনের ভেতরে । এবং অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো যে সে মোটেই নড়তে পারছে না । এমন কি অনুরূপার চোখ থেকে নিজের চোখ পর্যন্ত সরাতে পারছে না । অনুরূপা হাসলো আবারও । তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে এল জয়নুল আবেদিনের দিকে ! তারপর বলল, বোকা আবেদিন, একবারও মনে হল যে শহর থেকে দুরে একা একটা বাসায় একটা মেয়ে একা একা কিভাবে থাকে ! মেয়েটার মাঝে নিশ্চয়ই কোন অস্বাভাবিকত্ব আছে । তাই না ? এটা ভাবা দরকার ছিল । যাক অনেক দিন আমি ফ্রেশ রক্ত খায় নি । আজকে খাবো !

জয়নুল আবেদীন চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো কেবল । সামান্য নড়তে পর্যন্ত পালরো না । যদিও তার হাত বাঁধা নয় তারপরেও মনে হল যেন তার শরীরের প্রতিটা পেশি শক্ত হয়ে আটকে আছে । অন্য কারো নিয়ন্ত্রনে রয়েছে । সে অনুভব করলো একজোড়া দাঁত এগিয়ে আসছে তার গলার দিকে । তারপর সুই ফোঁটার মত করে সেখানে কিছু একটা বিঁধলো । তারপর সব শান্ত !

oputanvir.com

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.6 / 5. Vote count: 67

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →