ফেন্সী আর পস রেস্টুরেন্টে খুব একটা যাওয়া হয় না অনুরূপার । অনুরূপার কেন জানি এখন এই আভিজাত্য চাকচিক্য গুলো সব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে । নিজের কাজের ভেতরে থাকা, ছুটির দিন গুলোতে বাসায় শুয়ে বসে বই পড়ে সময় কাটাতেই এখন অনুরূপার বেশি ভাল লাগে । এই শুক্রবারেও ঠিক সেই রকমই পরিকল্পনা ছিল কিন্তু আজকে ওকে গুলশানের এই রেস্টুরেন্টে আসতেই হল । কিছুতেই জয়নুল আবেদিন নামের মানুষটাকে এড়ানো সম্ভব হয় নি ।
জয়নুল আবেদিনকে সে চেনে প্রায় মাস দুয়েক ধরে । অনুরূপা যে অফিসে চাকরি করে সেই অফিসের একজন স্বনামধন্য ক্লাইন্ট সে । প্রথম যে দিন সে তাদের অফিসে আসে অনুরূপাই তাকে এটেন্ড করেছিল । যখন যার ডেস্ক ফাঁকা থাকে ক্লাইন্টদেরকে সে সার্ভিস দেয়ে । এই হচ্ছে নিয়ম । তবে পরের সপ্তাহে জয়নুল আবেদিন আবার যখন এল বিশেষ ভাবে তার চাহিদা ছিল যাতে অনুরূপাই তার কাজটা করুক । বড় মাপের ক্লাইন্ট সে । তার নিজেস্ব অফিস রয়েছে গুলশানেই । এই এক ক্লাইন্টকে হাতে রাখা মানেই হচ্ছে অনেক কিছু হাতে রাখা । অনুরূপার বস তাই তার দাবী মেনে নিয়ে নিয়েছেন । এরপর প্রায় প্রতি সপ্তাহেই জয়নুল আবেদিন এসেছে । এমন সব ছোট কাজ নিয়ে এসেছে, এমন কাজের জন্য কেউ অফিস পর্যন্ত আসে না । ফোনে কিংবা ইমেলে জানান দেয় । অনুরূপারা সেই মোতাবেগ কাজ করে দেয় ।
অনুরূপা একটু বিরক্ত হলেও কিছু বলতে পারে নি । বিশেষ করে তার বসস তাকে স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছে যে এই ক্লাইন্ট হাত ছাড়া করা যাবে না । এমনিতেও অফিসের অবস্থা ভালো না । তারা কোভিট পরবর্তি ক্ষতি এখনও কাটিয়ে উঠতে পারে নি । তাই সহ্য করে নেওয়া ছাড়া আর কিছু করার ছিল না । সেই কারণেই আজকে এই রেস্টুরেন্টে আসা ।
অনুরূপা কালো রংয়ের একটা সেলোয়ার কামিজ পরে এসেছে । গেট দিয়ে ঢুকতেই একজন ওয়েটার ওকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল ভেতরের দিকে । বড় ঘরটার পরেই এই ছোট ঘরটা । একটু অন্ধকার মত চারিদিকে । তবে চারিদিকে চমৎকার পরিবেশ । অনুরূপার মন ভাল হয়ে গেল । দেখতে পেল একেবারে কোণার দিকে একটা টেবিলে জয়নুল আবেদিন বসে আছে । সেদিকেই হেটে গেল সে ।
জয়নুল আবেদিন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আপনাকে চমৎকার লাগছে আজকে ।
অনুরূপা হাসলো । সে জানে তাকে দেখতে সুন্দর লাগছে । ভদ্রতা করে বলল, আপনাকেও ইয়াং লাগছে খুব ।
শব্দ করে হেসে উঠলো জয়নুল । তবে এটা কোন ভাবেই মিথ্যে না যে জয়নুল আবেদিন দেখতে সুপুরুষ । বয়স এখনও চল্লিশ পার হয় নি । অনুরূপা শুনেছে যে একবার বিয়ে হয়েছিল তবে বিয়েটা ঠিক টিকে নি । দুই বছরের মাথায় ডিভোর্স হয়ে যায় । তারপর থেকে সে সিঙ্গেলই আছে । এবং সে অনুরূপার ব্যাপারে তীব্র ভাবে যে আগ্রহী এটা অনুরূপা খুব ভাল করেই বুঝতে পারছে । তবে এখনও অনুরূপা ঠিক সিদ্ধান্ত নেয় নি । এটা নিয়ে এখনও নিজের কাছেই সে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে।
জয়নুল আবেদিন বসতে বসতে বলল, আচ্ছা বলুন তো আমার বয়স কত?
-কত হবে ! এই ধরেন ৩৫/৩৬ ।
জয়নুল আবেদিনের মুখ থেকে হাসি মিলিয়ে গেল । সেখানে একটা রহস্যময় আভা দেখা গেল । তারপর বলল, আমি যদি বলি আমি প্রায় ৬০০ বছরের বেশি সময় ধরে বেঁচে আছি , বিশ্বাস করবেন?
কথাটা জয়নুল আবেদিন এমন ভাবে বলল যে অনুরূপা একটু যেন চমকে উঠলো । তবে সামলে নিলো আথে সাথেই । তারপর বলল, এটা কি বিশ্বাস করার মত কোন কথা?
জয়নুল আবেদিন কিন্তু হাসলো না । সে বলল, না তবে এটা কিন্তু মিথ্যা না । আমি আসলেই অনেক গুলো বছর ধরে বেঁচে আছি । আমি একজন ভ্যাম্পায়ার !
এবার অনুরূপা শব্দ করে হেসে ফেলল । তারপর বলল, হ্যা আর আমি হচ্ছি রানী ভিক্টোরিয়া ।
জয়নুল আবেদিন একটু আহত কন্ঠে বলল, আপনি বিশ্বাস করলেন না? আমি কিন্তু মিথ্যা বলছি না । আমি আসলেই একজন ভ্যাম্পায়ার কাউন্ট। ৬০০ বছরের বেশি সময় ধরে আমি বেঁচে আছি। যখন বখতিয়ার খলজি এই দেশ আক্রমন করে, সেই সময়ে আমি সেই সতের জন সৈন্যের একজন ছিলাম ।
অনুরুপা এবার একটু বিরক্ত হল । সে বলল, দেখুন আপনি আমাকে এখানে ডিনারের জন্য ডেকেছেন সেটাই বরং শুরু করি আমরা ।
-আপনি আসলেই আমার কথা বিশ্বাস করছেন না ?
-করার কি কোন কারণ আছে?
-ওকে কী করলে আপনি বিশ্বাস করবেন শুনি?
অনুরূপা একটু দ্বিধায় পড়ে গেল । বিশেষ করে জয়নুল আবেদিনের কন্ঠে দৃঢ়তা দেখে সে আসলেই একটু অবাক হয়ে গেল । অনুরূপা বলল, আপনি যে ভ্যাম্পায়ার তা ওরা দিনের আলোতে বের হতে পারে না, শরীর পুড়ে যায় আপনি কিভাবে বের হন !
হাত দিয়ে আকাশে একটা তুড়ি মারার মত করে জয়নুল আবেদিন বলল, আরে ওসব গল্পের বেশির ভাগই বানানো । তবে সত্যিকারের ভ্যম্পায়ারদের সূর্যের আলোতে কিছুই হয় না । তবে হ্যা রক্ত কিন্তু আমর ঠিকই খাই । এটাই মূলত আমাদের অনেক বছর বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করে । আমরা আমাদের চোখ দিয়ে মানুষকে নিয়ন্ত্রনও করতে পারি । যে কাউকে দিয়ে যে কোন কিছু করাতেও পারি ।
অনুরূপা বলল, আচ্ছা আমাকে বলুন এমন কিছু করতে । দেখি যদি পারেন তাহলে বিশ্বাস করবো ।
জয়নুল আবেদিন বলল, আমি চেষ্টা করেছি আপনাকে নিয়ন্ত্রন করতে ! কিন্তু পারি নি । কী এক অদ্ভুত কারণে আপনাকে কিছুতেই নিয়ন্ত্রন করতে পারছি না আমি । এর একটা কারণ সম্ভবত আমি আপনার প্রেমে পড়েছি । এই কারণে কিছুতেই কিছু হচ্ছে না ।
অনুরূপা বলল, তাহলে আমি বাদ দিয়ে অন্য যে কাউকে নিয়ন্ত্রন করতে পারবেন?
-অবশ্যই । দেখতে চান ?
তারপর অনুরূপার উত্তরের অপেক্ষাতে না থেকেই সে হাতের ইশারাতে ওয়েটারকে ডাক দিল । ওয়েটার কাছে আসতেই সে ক্লাসের পানিটা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, এই গ্লাসের পানিটা তুমি ঐ সাদা শার্ট পরা ভদ্রলোকের গায়ে ঢেলে দিয়ে আসো !
ওয়েটার কিছু সময় তাকিয়ে রইলো জয়নুল আবেদিনের দিকে । তারপর গ্লাস টা হাতে নিয়ে এগিয়ে গেল সেই টেবিলের দিকে যেখানে সাদা সার্ট পরা লোকটা বসে আছে । অনরূপাকে চোখ বড় বড় করে কিছু সময় তাকিয়ে রইলো সেই দিকে । এবং সত্যি সত্যিই ওয়েটার পানি ঢেলে দিলো লোকটার শরীরে । পানি পড়তেই লোকটা চিৎকার করে উঠলো । তারপর ওয়েটারের গালে একটা চড় বসিয়ে দিল । ওয়েটার চড় খেয়েই যেন বাস্তবে ফিরে এল । তারপর অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো লোকটার দিকে । একটু আগে যে সে পানি ঢেলে দিয়েছে সেটা যেন তার মনেই নেই ।
অনুরূপার চোখের বিস্ময়টা উপভোগ করলো জয়নুল আবেদিন । তারপর ওর দিকে তাকিয়ে বলল, এই রুমের যে কাউকে দিয়ে আমি যা ইচ্ছে করাতে পারি । কেবল আপনি ছাড়া !
অনুরূপা ওয়েটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে তখনও । লোকটা তখনও সরি বলেই চলেছে । আর অন্য লোকটা চিৎকার করে চলেছে । অনুরূপা বলল, ঐ লোকটাকে থামতে বলুন । আমার মনে হয় যথেষ্ঠ অভিনয় করেছে সে !
জয়নুল আবেদিন এবার একটু চমকালো । তারপর হেসে ফেলল । ওয়েটার আর সাদা শার্ট পরা লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল, জামান এবার থামো ।
সাথে সাথে থেমে গেল কথা বার্তা । ওদের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লো ।
অনুরূপা কেন জানি বিরক্ত হল না । জয়নুল আবেদিনের দিকে তাকিয়ে বলল, এই কাজটা কেন করলেন শুনি?
খানিকটা লজ্জা মিশ্রিত হাসি দিয়ে জয়নুল আবেদিন বলল, আসলে আমি আপনাকে ইম্প্রেস করতে চেয়েছিলাম ।
-কেন?
-আপনি জানেন আমি কেন ইম্প্রেস করতে চেয়েছি, চাচ্ছি ! আমি আপনার ব্যাপারে খোজ খবর নিয়েছি । আপনাকে যখন প্রথম দেখি তখনই আমার কেবল মনে হয়েছে বাকি জীবনটা আপনার সাথে কাটানো যায় !
-সত্যি কথা বলার জন্য ধন্যবাদ । তবে আমি আপনার মনভাব বুঝতে পেরেছি অনেক আগেই । তবে বিরক্ত হই নি । আজকের আপনার ছেলে মানুষী দেখে হাসলাম কেবল ।
একটু পরেই খাবার চলে এল । খাবার খেতে খেতে গল্প হল অনেক । খাওয়া দাওয়া শেষ যখন হল তখন প্রায় বারোটা বেজে গেছে । জয়নুল আবেদিন নিজে গাড়ি চালিয়ে অনুরূপাকে বাসায় পৌছে দিল । অনুরূপার বাসাটা শহর থেকে বেশ দুরে । বসিলা ব্রিজ পার করে আরও কিছুটা দুরে । একেবারে নদীর ধারে । একটা ছোট দুই তলা বাড়ি । বাড়িটা প্রায় অন্ধকার হয়ে আছে । কেবল সামনে একটা আলো জ্বলছে । জয়নুল আবেদিন একটু অবাক হল বাড়ি দেখে । গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল, আপনি এখানে থাকেন ?
অনুরূপা বলল, হ্যা । আসলে আমি একটু নিরিবিলি থাকতে পছন্দ করি সব সময় । এই নদীর ধারে বসে থাকতে আমার ভাল লাগে । আসবেন ভেতরে?
জয়নুল আবেদিন বলল, চলুন । আপনার বাসাটা দেখা যাক ।
গেটের সামনেই গাড়িটা পার্ক করে রাখলো জয়নুল আবেদিন । তারপর ভেতরে ঢুকলো । দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই জয়নুল আবেদিনের মনে হল যেন একটা অন্য জগতে জগতে চলে এসেছে । আলো জ্বলে উঠলো ঘরের । তাকে বসিয়ে রেখে অনুরূপা রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ালো । জয়নুল ঘরের দিকে দেখতে শুরু করলো । পুরো ঘর জুড়ে অনেক চমৎকার আসবারে সাজানো । সব কিছু বেশ পুরানো আর দামি মনে হল জয়নুল আবেদিনের কাছে । মেয়েটা কেবল দেখতেই সুন্দর নয়, মেয়েটার রূচিরও প্রশংসা করতে লাগলো জয়নুল আবেদিন । মনে মনে আবারও ঠিক করে নিল যে যে কোন ভাবেই মেয়েটাকে রাজি করাতেই হবে ।
একটু পরেই অনুরূপা দুই কাপ কফি নিয়ে ঢুকলো ঘরে । একটা জয়নুল আবেদিনের দিকে । কফিতে চুমুক দিতেই জয়নুল আবেদিনের মনে হল এমন চমৎকার স্বাদের কফি সে খায় নি অনেক দিন । অনুরূপার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি আমাকে সত্যি ইম্প্রেস করেই চলেছেন ।
অনুরূপা হেসে বলল, আপনিও কম চেষ্টা করেন নি ।
-আচ্ছা আপনার মনে কি একবারের জন্যও মনে হয় নি এটা সত্য হতে পারে । মানে যে সত্যিই রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ার হতে পারি !
-নাহ ! একটা বারের জন্যও না !
-কেন না? আমার সেটআপে কি কোন সমস্যা ছিল ?
-না ছিল না । অন্য কেউ হলে বিশেষ করে ওয়েটার যখন জামান সাহেবের শরীরে পানি ঢেলে দিলো তখন মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল । কিন্তু আমার মনে হয় নি ।
-কেন?
-কারণ …..
একটু থামলো অনুরূপা । তারপর ঠান্ডা গলাতে বলল, একটা ভ্যাম্পায়ার অন্য ভ্যাম্পায়ারকে খুব ভাল করেই অনুভব করতে পারে ।
জয়নুল আবেদিন চমকালো একটু । বলল, মানে?
অনুরূপা এবার একটু হেসে বলল, মানে হচ্ছে আমি আপনাকে অনুভব করতে পারি নি । মানুষ আর ভ্যাম্পায়ারের রক্তের প্রভাহে একটা পার্থক্য আছে । মানুষেরটা বড় লাউড । এই যে আপনার গলার কাছ থেকে একটা রক্তের প্রবাহ বয়ে যাচ্ছে আমি এটা এখান থেকে টের পাচ্ছি ।
জয়নুল আবেদিন কেন জানি এই কথাটা মোটেই হেসে উড়িয়ে দিতে পারলো না । সেই সাথে একটা ভয় এসে জড় হল তার মনের ভেতরে । এবং অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো যে সে মোটেই নড়তে পারছে না । এমন কি অনুরূপার চোখ থেকে নিজের চোখ পর্যন্ত সরাতে পারছে না । অনুরূপা হাসলো আবারও । তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে এল জয়নুল আবেদিনের দিকে ! তারপর বলল, বোকা আবেদিন, একবারও মনে হল যে শহর থেকে দুরে একা একটা বাসায় একটা মেয়ে একা একা কিভাবে থাকে ! মেয়েটার মাঝে নিশ্চয়ই কোন অস্বাভাবিকত্ব আছে । তাই না ? এটা ভাবা দরকার ছিল । যাক অনেক দিন আমি ফ্রেশ রক্ত খায় নি । আজকে খাবো !
জয়নুল আবেদীন চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো কেবল । সামান্য নড়তে পর্যন্ত পালরো না । যদিও তার হাত বাঁধা নয় তারপরেও মনে হল যেন তার শরীরের প্রতিটা পেশি শক্ত হয়ে আটকে আছে । অন্য কারো নিয়ন্ত্রনে রয়েছে । সে অনুভব করলো একজোড়া দাঁত এগিয়ে আসছে তার গলার দিকে । তারপর সুই ফোঁটার মত করে সেখানে কিছু একটা বিঁধলো । তারপর সব শান্ত !
oputanvir.com
Discover more from অপু তানভীর
Subscribe to get the latest posts sent to your email.