তামীম সকালের নাস্তা শেষ করে একটু সময় সময় নিয়ে কফি খায় । এক হাতে মোবাইল আর অন্য হাতে কফির কাপ হাতে নিয়ে একটু আয়েশ করেই কফি শেষ করে তারপর অফিসের দিকে পা বাড়ায় । আজও তার কফি খাওয়া চলছিলো । মিতু কিছু সময় ইতস্তত করে তামীর সামনে বসে রইলো তারপর বলল, আজকে বাসায় আসার সময় এক পাতা নাপা নিয়ে আসবেন !
মিতুর কথা শুনে তামীম মোবাইল থেকে চোখ তুলে তাকালো । তারপর বলল, নাপা কেন?
-আমার শরীরটা ভাল যাচ্ছে না । মাঝে মাঝে জ্বর আসছে !
তামীম মোবাইলটা টেবিলের উপরে রেখে এবার তাকালো মিতুর দিকে । তামীমের মনে হল মিতু যেন খানিকটা লজ্জিত এই জ্বর হওয়ার কারণে । তামীমের কী মনে হওয়াতে বলল, এদিকে এসো দেখি । এখন জ্বর আছে?
মিতু এক পা এগিয়ে গেল গেল। যখন তামীম ওর কপালে হাত দিল মিতুর পুরো শরীর কেঁপে উঠলো । আপনা আপনি চোখ বন্ধ হয়ে এল । বিয়ের এই চার মাসে তামীম একটা বারেও মিতুর কাছে আসে নি । আজকে এই প্রথম মিতুর শরীরে একটু স্পর্শ করলো সে । মিতুর মনে হল যে তামীম আরও কিছু সময় ওর কপালে হাত দিয়ে রাখে । তবে তামীম নিজের হাত সরিয়ে নিল । তারপর বলল, তোমার শরীর দেখি জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে ।
মিতু কোন কথা না বলে চুপ করে দাড়িয়ে রইলো । তখনই অনুভব করলো যে ওর মাথাটা একটু যেন চক্কর দিয়ে উঠলো । তামীম বলল, এই জ্বর নিয়ে তোমাকে নাস্তা বানাতে কে বলেছে !
মিতু আবারও কোন কথা বলল না । মাথা নিচু করে দাড়িয়ে রইলো । তামীম একটু রাগ গলাতেই বলল, আমাক জানাবে না যে জ্বর এসেছে । আশ্চর্য ! এর আগে কয়বার জ্বর এসেছে ?
মিতু কেন জানি তামীমের এই রাগ দেখানোটা ভাল লাগলো খুব । কেন লাগলো সেটা মিতুর জানা নেই । মিতু বলল গত এক সপ্তাহ ধরে আসছে প্রায় প্রতিদিনই ।
তামীম বলল, আর এই কথা একবারও বললে না ।
-আমি ভেবেছিলাম যে সেরে যাবে !
তামীম কিছু বলতে গিয়েও বলল না । কিছু সময় চুপ করে থেকে বলল, এই জ্বর নাপাতে যাবে না মনে হচ্ছে । চল ডাক্তারের কাছে ।
-না মানে আপনার অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে !
-সেটা নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না । এখনই চল । এই পোশাকেই চল ।
মিতু নিজের পোশাকের দিকে তাকালো । একটা সুতির শাড়ি পরে আছে সে । বাসায় থাকলেও শাড়ি সে সব সময় পরিপাটি করেই পরে । দেখতে খারাপ লাগে না । মিতু বুকের ভেতরে কেমন একটা অনুভূতি হতে থাকলো । এই অনুভূতির কোন ব্যাখ্যা নেই ।
তামীমের একটা বাইক রয়েছে । সেই বাইকে করেই সে অফিস যায় । তবে আজকে বাইক নিলো না তামীম । উবার ডাক দিল । তামীমের পাশে কেবল একটা আড়ষ্ঠ ভাবে বসে রইলো মিতু । কিছুতেই যেন সহজ হতে পারছে না । এভাবে বাইরে ওরা কোন দিন বের হয় নি । গাড়িতে থাকা অবস্থায় মিতু দেখলো তামীম ওর অফিসে ফোন দিয়ে জানালো যে আজকে তার অফিস যেতে একটু দেরী হবে । বউকে বউকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাচ্ছে সে । তামীমের মুখে স্ত্রী অসুস্থ এই কথাটাও মিতুর কেন জানি ভাল লাগলো খুব ।
তামীম মিতুকে ঠিক নিজের ইচ্ছেতে বিয়ে করে নি । বিয়েটা হয়েছে একান্তই তামীমের বাবার ইচ্ছাতে । মিতুর বাবার সাথে তামীমের বাবার একটা ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল । একদিন দুপুরে মিতুদের বাসায় আসে তামীমের বাবা । দুপুরে খাওয়ার জন্য । সেখানেই মিতুকে প্রথম দেখে তামীমের বাবা । তার সম্পর্কে জানতে পারে । কয়েকমাস পরে মিতু শোনে যে তামীমের সাথে তার বিয়ে ঠিক হয়েছে । মিতু অমত করে নি। মিতু কোন দিন ওর বাবার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করেই নি । তবে বিয়ের আগে একটু কথা কানে এসেছিলো যে ছেলে নাকি বিয়েতে রাজি না । মিতুর বাবা ওকে বলেছিলো এখনকার ছেলেরা নাকি বিয়ে করতে ভয় পায় । সেই কারণে ছেলে একটু গাইগুই করছে । তবে বিয়ের পরে মিতু টের পায় যে তামীম আসলেই বিয়ে করতে রাজি ছিল না । ওর বাবা এক প্রকার জোর করেই মিতুর সাথে বিয়ে দিয়েছে ।
বিয়ের পর মিতু অনেক ভাবেই তামীমের মন পেতে চেষ্টা করেছে তবে তামীম সব সময় ওদের সম্পর্কে একটা ঠান্ডা লাইন টেনে রেখেছিলো । রাগটা ওর বাবার উপরে ছিল, কিন্তু ফল ভোগ করছিলো মিতু । তামীম কিছুতেই তার কাছে যেতে দিচ্ছিলো না মিতুকে । একটা দুরুত্ব সব সময় বজায় রেখেই চলেছে । আজকে এই প্রথম তামীম স্বামী সুলভ আচরণ করছে ।
হাসপাতাল থেকে বের হতে হতে প্রায় দুপুর হয়ে গেল । ডাক্তার বেশ কিছু টেস্ট করালেন তখনই । সব কিছু দেখে ঔষদ দিলেন । তারপর বললেন যেন আগামী দুইদিন সম্পূর্ন বিশ্রাম নেওয়া হয় । ফেরার সময় উবারে করে আসার সময় মিতুর বসে থাকতে একটু কষ্ট হচ্ছিলো । সেটা বুঝতে পেরেই তামীম বলল, বসে থাকতে কষ্ট হচ্ছে?
মিতু কেবল মাথা ঝাকিয়ে সম্মতি জানালো । তামীম বলল, আমার কোলে মাথা রেখে রেখে শুয়ে থাকো ।
মিতু বিনা বাক্য ব্যয়ে তাই করলো । এই প্রথম বারের মত সে শুয়ে পড়লো তামীমের কোলে । এতো কাছে আর আসে নি তামীমের । ওর কাছে সব কিছু কেমন যেন স্বপ্ন মনে হচ্ছে ।
তামীম ওর মাথায় হাত রেখেছে । একটু একটু চুলে বিলি কাটছে । মিতু কেবল অনুভব করলো যে ওর চোখ দিয়ে আপনা আপনি পানি বের হয়ে এসেছে । তবে এটা আনন্দের অশ্রু । তামীম সেই অশ্রু দেখতে পেয়ে বলল, বেশি খারাপ লাগছে ?
-উহু !
তামীম সেই চোখের পানি মুছিয়ে দিল । মিতু বলল, আপনি কোন দিন আমাকে এভাবে আদর করেন নি তো তাই আনন্দ লাগছে । আগে জানলে আমি আরও আগে অসুস্থ হয়ে যেতাম !
তামীম হেসে ফেলল । কোলের উপরে নিজের স্ত্রীর এই শিশু সুলভ বাক্য শুনে তামীমেও কেন জানি ভালো লাগলো । চোখ বন্ধ করে মিতু শুয়ে আছে তামীমের কোলে । সেদিকে তামীম কিছু সময় তাকিয়ে রইলো । তখনই সে আবিস্কার করলো যে মিতুর চেহারাটা সে আগে এতো ভাল করে কখনও খেয়াল করে নি । বাবার প্রতি একটা রাগ থেকেই সে মিতু কাচ থেকে দুরে ছিল । গোলগাল চেহারার এই মেয়েটাকে ভাল করে দেখেই নি কোন দিন !
মিতুর চেহারার দিকে একভাবে সে তাকিয়ে রইলো বেশ কিছু সময় । কোন কথা না বলে কেবল এক ভাবে তাকিয়ে রইলো । কখন যে গাড়ি ওদের বাসার সামনে চলে এসেছে সেটা তামীমের খেয়ালই রইলো না ।
দুই
মিতুর ঘুম ভাঙ্গলো বিকেল বেলা । চোখ মেলে সে কিছু সময় শুয়েই রইলো । নিজের ঘরে নিজের বিছানাতে শুয়ে রয়েছে । বিয়ের পরে এই ঘরেই সে থাকে । তামীম ঘুমায় পাশের রুমে । সেখানে তার কাজ কর্ম সেখানেই তার ঘুম । তবে এটা ফ্ল্যাটের মাস্টার বেড রুম । বিশাল বড় কিং সাইজের বেড । পুরোটাই মিতুর জন্য । পাশের রুমে তামীম যেখানে ঘুমায় সেখানে একটা সিঙ্গলে খাট আছে । একটা কম্পিউটার টেবিল আছে । একটা বড় বুকসেলফ । তামীম তখন বাসায় থাকে না মিতু তখন প্রায়ই সেই রুমে যায় । ঐ বিছানায় শুয়ে থাকে । এমন অনেক দিন গেছে দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পরে সেখানেই শুয়ে থেকেছে । তামীমের শরীরের গন্ধ লেগে থাকতো সেই খাটে ।
ঘুম ভেঙ্গে বুঝলো শরীরের জ্বর তখনও আছে । আশে পাশে তাকিয়ে দেখলো তামীম কোথাও নেই । তখনই মনের ভেতরে ভয়টা এসে জড় হল । এতো সময় ওর সাথে যা ঘটেছে তা কি বাস্তব ছিল নাকি জ্বরের ঘোরে সে স্বপ্ন দেখেছে ? বিছানায় উঠে বসলো সে । তারপর ভয়ে ভয়ে তামীমের নাম ধরে ডাক দিল । স্বপ্ন হলে তামীম এই সময়ে অফিসেই থাকবে । কিন্তু ওর ভয়কে অমূলক প্রমাণ করে দিয়ে দরজায় তামীম এসে হাজির হল ।
তামীমের পরনে একটা থ্রি কোয়াটার প্যান্ট আর উপরে সাদা শার্ট । মিতুর বুঝতে অসুবিধা হল না যে তামীম নিজের রুমে বসে কাজ করছিলো । হোম অফিস ।
তামীম ওর দিকে তাকিয়ে বলল, কিছু লাগবে ?
মিতু মাথা ঝাকালো । তামীম বলল, কী ?
-আপনাকে !
শব্দটা বলার পরেই ওর মুখ লাল হয়ে গেল । এতো সাহস ওর কিভাবে হল কে জানে ! তামীম হেসে ফেলল । ধীর পায়ে এগিয়ে এল ওর দিকে খাটের এক পাশে এসে দাড়িয়ে ওর কপালে হাত দিয়ে দেখলো জ্বর আছে কিনা ! তারপর বলল, অফিসের কাজ টা শেষ করি তরপর কেমন !
তামীম ঘুরে যেতে চাইলে মিতু বলল, তামীম !
-হুম । কী হল !
-আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবেন প্লিজ !
তামীম একভাবে মিতুর দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময় । মেয়েটা আজকে একটু অস্বাভাবিক আরচণ করছে । সম্ভবত জ্বরের কারণেই সব বাঁধা, সংকোচ ভেঙ্গে মেয়েটার । তামীম খাটের কাছে এসেই বসলো । তারপর প্রথমবারের মত মিতুকে জড়িয়ে ধরলো । প্রথমে আলতো করে ধরলেও একসময়ে অনুভব করলো মিতু ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে । এবং কিছু সময় পরেই অনুভব করতে পারলো মেয়েটা ফুপিয়ে উঠেছে ।
তামীম নিজের মনের কাছেই দ্বিধা গ্রস্থ হয়ে উঠলো । এতোটা সময়ে সে মিতুকে নিজের কাছ থেকে দুরে সরিয়ে রেখেছে । নিজেদের ভেতরে একটা বিশাল দেওয়াল তুলে রেখেছিলো । মিতু সব সময় ওর কাছে আসতে চেয়েছে কিন্তু তামীম তা দেয় নি । তাই বলে মিতু কখনই ওকে অবহেলা করে নি । ওর কখন কি লাগবে সব কিছু খেয়াল রেখেছে । ওর প্রতিটা জিনিস চলে এসেছে একেবারে না চাইতেই । বিনিময়ে কেবল চেয়ে তামীমের একটু ভালোবাসা । আজকেও যখন নাপা আনতে বলল তখন কেবল বলেছিলো যাতে ফেরার পথে নাপা নিয়ে আসে ।
তামীম বলল, হয়েছে ? এবার কাজটা শেষ করে আসি । তারপর যত সময় ধরে ইচ্ছে জড়িয়ে ধরে থেকো ।
মিতু তামীমকে ছেড়ে দিল । তবে তামীম তখনও ওকে ছাড়ে নি । আরও কিছু সময় জড়িয়ে ধরে রাখলো । তারপর মিতুর কপালে একটা ছোট চুমু খেল । তারপর বলল, এখন শুয়ে থাকো । ক্ষুধা লাগলে আমাকে ডাক দিও । ঠিক আছে । জ্বর ছেড়ে যাবে কিছু সময় পরেই ।
-জ্বর না ছাড়ুক !
-সেকি কথা ! জ্বর কেন ছাড়বে না ?
-জ্বর ঠিক হলে আপনি তো আর আমাকে এভাবে আদর করবেন না !
-বোকা মেয়ে বলে কি ! কে বলেছে করবো না?
-আমি জানি !
-তুমি ভুল জানো ! এখন চুপচাপ শুয়ে থাকো তো । কোন কথা বলবে না !
মিতু দেখলো তামীম দরজার কাছে গিয়ে আরেকবার ফিরে তাকালো । মিতুর তখনও ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না যে আজকে এতোদিন পরে সে তামীমকে পেয়েছে । নিজের মত করে করে পেয়েছে । তার এতো দিনের অপেক্ষার শেষ হয়েছে । যে হৃদয়টা তামীমের জন্য তৃষ্ণিত ছিল সেটা আজকে যেন পরিপূর্ণতা পেয়েছে ।
Discover more from অপু তানভীর
Subscribe to get the latest posts sent to your email.