মিতুর অপেক্ষা

oputanvir
4.9
(81)

তামীম সকালের নাস্তা শেষ করে একটু সময় সময় নিয়ে কফি খায় । এক হাতে মোবাইল আর অন্য হাতে কফির কাপ হাতে নিয়ে একটু আয়েশ করেই কফি শেষ করে তারপর অফিসের দিকে পা বাড়ায় । আজও তার কফি খাওয়া চলছিলো । মিতু কিছু সময় ইতস্তত করে তামীর সামনে বসে রইলো তারপর বলল, আজকে বাসায় আসার সময় এক পাতা নাপা নিয়ে আসবেন !

মিতুর কথা শুনে তামীম মোবাইল থেকে চোখ তুলে তাকালো । তারপর বলল, নাপা কেন?
-আমার শরীরটা ভাল যাচ্ছে না । মাঝে মাঝে জ্বর আসছে !

তামীম মোবাইলটা টেবিলের উপরে রেখে এবার তাকালো মিতুর দিকে । তামীমের মনে হল মিতু যেন খানিকটা লজ্জিত এই জ্বর হওয়ার কারণে । তামীমের কী মনে হওয়াতে বলল, এদিকে এসো দেখি । এখন জ্বর আছে?
মিতু এক পা এগিয়ে গেল গেল। যখন তামীম ওর কপালে হাত দিল মিতুর পুরো শরীর কেঁপে উঠলো । আপনা আপনি চোখ বন্ধ হয়ে এল । বিয়ের এই চার মাসে তামীম একটা বারেও মিতুর কাছে আসে নি । আজকে এই প্রথম মিতুর শরীরে একটু স্পর্শ করলো সে । মিতুর মনে হল যে তামীম আরও কিছু সময় ওর কপালে হাত দিয়ে রাখে । তবে তামীম নিজের হাত সরিয়ে নিল । তারপর বলল, তোমার শরীর দেখি জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে ।
মিতু কোন কথা না বলে চুপ করে দাড়িয়ে রইলো । তখনই অনুভব করলো যে ওর মাথাটা একটু যেন চক্কর দিয়ে উঠলো । তামীম বলল, এই জ্বর নিয়ে তোমাকে নাস্তা বানাতে কে বলেছে !
মিতু আবারও কোন কথা বলল না । মাথা নিচু করে দাড়িয়ে রইলো । তামীম একটু রাগ গলাতেই বলল, আমাক জানাবে না যে জ্বর এসেছে । আশ্চর্য ! এর আগে কয়বার জ্বর এসেছে ?
মিতু কেন জানি তামীমের এই রাগ দেখানোটা ভাল লাগলো খুব । কেন লাগলো সেটা মিতুর জানা নেই । মিতু বলল গত এক সপ্তাহ ধরে আসছে প্রায় প্রতিদিনই ।

তামীম বলল, আর এই কথা একবারও বললে না ।
-আমি ভেবেছিলাম যে সেরে যাবে !

তামীম কিছু বলতে গিয়েও বলল না । কিছু সময় চুপ করে থেকে বলল, এই জ্বর নাপাতে যাবে না মনে হচ্ছে । চল ডাক্তারের কাছে ।
-না মানে আপনার অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে !
-সেটা নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না । এখনই চল । এই পোশাকেই চল ।

মিতু নিজের পোশাকের দিকে তাকালো । একটা সুতির শাড়ি পরে আছে সে । বাসায় থাকলেও শাড়ি সে সব সময় পরিপাটি করেই পরে । দেখতে খারাপ লাগে না । মিতু বুকের ভেতরে কেমন একটা অনুভূতি হতে থাকলো । এই অনুভূতির কোন ব্যাখ্যা নেই ।

তামীমের একটা বাইক রয়েছে । সেই বাইকে করেই সে অফিস যায় । তবে আজকে বাইক নিলো না তামীম । উবার ডাক দিল । তামীমের পাশে কেবল একটা আড়ষ্ঠ ভাবে বসে রইলো মিতু । কিছুতেই যেন সহজ হতে পারছে না । এভাবে বাইরে ওরা কোন দিন বের হয় নি । গাড়িতে থাকা অবস্থায় মিতু দেখলো তামীম ওর অফিসে ফোন দিয়ে জানালো যে আজকে তার অফিস যেতে একটু দেরী হবে । বউকে বউকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাচ্ছে সে । তামীমের মুখে স্ত্রী অসুস্থ এই কথাটাও মিতুর কেন জানি ভাল লাগলো খুব ।

তামীম মিতুকে ঠিক নিজের ইচ্ছেতে বিয়ে করে নি । বিয়েটা হয়েছে একান্তই তামীমের বাবার ইচ্ছাতে । মিতুর বাবার সাথে তামীমের বাবার একটা ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল । একদিন দুপুরে মিতুদের বাসায় আসে তামীমের বাবা । দুপুরে খাওয়ার জন্য । সেখানেই মিতুকে প্রথম দেখে তামীমের বাবা । তার সম্পর্কে জানতে পারে । কয়েকমাস পরে মিতু শোনে যে তামীমের সাথে তার বিয়ে ঠিক হয়েছে । মিতু অমত করে নি। মিতু কোন দিন ওর বাবার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করেই নি । তবে বিয়ের আগে একটু কথা কানে এসেছিলো যে ছেলে নাকি বিয়েতে রাজি না । মিতুর বাবা ওকে বলেছিলো এখনকার ছেলেরা নাকি বিয়ে করতে ভয় পায় । সেই কারণে ছেলে একটু গাইগুই করছে । তবে বিয়ের পরে মিতু টের পায় যে তামীম আসলেই বিয়ে করতে রাজি ছিল না । ওর বাবা এক প্রকার জোর করেই মিতুর সাথে বিয়ে দিয়েছে ।

বিয়ের পর মিতু অনেক ভাবেই তামীমের মন পেতে চেষ্টা করেছে তবে তামীম সব সময় ওদের সম্পর্কে একটা ঠান্ডা লাইন টেনে রেখেছিলো । রাগটা ওর বাবার উপরে ছিল, কিন্তু ফল ভোগ করছিলো মিতু । তামীম কিছুতেই তার কাছে যেতে দিচ্ছিলো না মিতুকে । একটা দুরুত্ব সব সময় বজায় রেখেই চলেছে । আজকে এই প্রথম তামীম স্বামী সুলভ আচরণ করছে ।

হাসপাতাল থেকে বের হতে হতে প্রায় দুপুর হয়ে গেল । ডাক্তার বেশ কিছু টেস্ট করালেন তখনই । সব কিছু দেখে ঔষদ দিলেন । তারপর বললেন যেন আগামী দুইদিন সম্পূর্ন বিশ্রাম নেওয়া হয় । ফেরার সময় উবারে করে আসার সময় মিতুর বসে থাকতে একটু কষ্ট হচ্ছিলো । সেটা বুঝতে পেরেই তামীম বলল, বসে থাকতে কষ্ট হচ্ছে?
মিতু কেবল মাথা ঝাকিয়ে সম্মতি জানালো । তামীম বলল, আমার কোলে মাথা রেখে রেখে শুয়ে থাকো ।
মিতু বিনা বাক্য ব্যয়ে তাই করলো । এই প্রথম বারের মত সে শুয়ে পড়লো তামীমের কোলে । এতো কাছে আর আসে নি তামীমের । ওর কাছে সব কিছু কেমন যেন স্বপ্ন মনে হচ্ছে ।

তামীম ওর মাথায় হাত রেখেছে । একটু একটু চুলে বিলি কাটছে । মিতু কেবল অনুভব করলো যে ওর চোখ দিয়ে আপনা আপনি পানি বের হয়ে এসেছে । তবে এটা আনন্দের অশ্রু । তামীম সেই অশ্রু দেখতে পেয়ে বলল, বেশি খারাপ লাগছে ?
-উহু !
তামীম সেই চোখের পানি মুছিয়ে দিল । মিতু বলল, আপনি কোন দিন আমাকে এভাবে আদর করেন নি তো তাই আনন্দ লাগছে । আগে জানলে আমি আরও আগে অসুস্থ হয়ে যেতাম !

তামীম হেসে ফেলল । কোলের উপরে নিজের স্ত্রীর এই শিশু সুলভ বাক্য শুনে তামীমেও কেন জানি ভালো লাগলো । চোখ বন্ধ করে মিতু শুয়ে আছে তামীমের কোলে । সেদিকে তামীম কিছু সময় তাকিয়ে রইলো । তখনই সে আবিস্কার করলো যে মিতুর চেহারাটা সে আগে এতো ভাল করে কখনও খেয়াল করে নি । বাবার প্রতি একটা রাগ থেকেই সে মিতু কাচ থেকে দুরে ছিল । গোলগাল চেহারার এই মেয়েটাকে ভাল করে দেখেই নি কোন দিন !

মিতুর চেহারার দিকে একভাবে সে তাকিয়ে রইলো বেশ কিছু সময় । কোন কথা না বলে কেবল এক ভাবে তাকিয়ে রইলো । কখন যে গাড়ি ওদের বাসার সামনে চলে এসেছে সেটা তামীমের খেয়ালই রইলো না ।

দুই

মিতুর ঘুম ভাঙ্গলো বিকেল বেলা । চোখ মেলে সে কিছু সময় শুয়েই রইলো । নিজের ঘরে নিজের বিছানাতে শুয়ে রয়েছে । বিয়ের পরে এই ঘরেই সে থাকে । তামীম ঘুমায় পাশের রুমে । সেখানে তার কাজ কর্ম সেখানেই তার ঘুম । তবে এটা ফ্ল্যাটের মাস্টার বেড রুম । বিশাল বড় কিং সাইজের বেড । পুরোটাই মিতুর জন্য । পাশের রুমে তামীম যেখানে ঘুমায় সেখানে একটা সিঙ্গলে খাট আছে । একটা কম্পিউটার টেবিল আছে । একটা বড় বুকসেলফ । তামীম তখন বাসায় থাকে না মিতু তখন প্রায়ই সেই রুমে যায় । ঐ বিছানায় শুয়ে থাকে । এমন অনেক দিন গেছে দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পরে সেখানেই শুয়ে থেকেছে । তামীমের শরীরের গন্ধ লেগে থাকতো সেই খাটে ।

ঘুম ভেঙ্গে বুঝলো শরীরের জ্বর তখনও আছে । আশে পাশে তাকিয়ে দেখলো তামীম কোথাও নেই । তখনই মনের ভেতরে ভয়টা এসে জড় হল । এতো সময় ওর সাথে যা ঘটেছে তা কি বাস্তব ছিল নাকি জ্বরের ঘোরে সে স্বপ্ন দেখেছে ? বিছানায় উঠে বসলো সে । তারপর ভয়ে ভয়ে তামীমের নাম ধরে ডাক দিল । স্বপ্ন হলে তামীম এই সময়ে অফিসেই থাকবে । কিন্তু ওর ভয়কে অমূলক প্রমাণ করে দিয়ে দরজায় তামীম এসে হাজির হল ।
তামীমের পরনে একটা থ্রি কোয়াটার প্যান্ট আর উপরে সাদা শার্ট । মিতুর বুঝতে অসুবিধা হল না যে তামীম নিজের রুমে বসে কাজ করছিলো । হোম অফিস ।
তামীম ওর দিকে তাকিয়ে বলল, কিছু লাগবে ?
মিতু মাথা ঝাকালো । তামীম বলল, কী ?
-আপনাকে !

শব্দটা বলার পরেই ওর মুখ লাল হয়ে গেল । এতো সাহস ওর কিভাবে হল কে জানে ! তামীম হেসে ফেলল । ধীর পায়ে এগিয়ে এল ওর দিকে খাটের এক পাশে এসে দাড়িয়ে ওর কপালে হাত দিয়ে দেখলো জ্বর আছে কিনা ! তারপর বলল, অফিসের কাজ টা শেষ করি তরপর কেমন !
তামীম ঘুরে যেতে চাইলে মিতু বলল, তামীম !
-হুম । কী হল !
-আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবেন প্লিজ !

তামীম একভাবে মিতুর দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময় । মেয়েটা আজকে একটু অস্বাভাবিক আরচণ করছে । সম্ভবত জ্বরের কারণেই সব বাঁধা, সংকোচ ভেঙ্গে মেয়েটার । তামীম খাটের কাছে এসেই বসলো । তারপর প্রথমবারের মত মিতুকে জড়িয়ে ধরলো । প্রথমে আলতো করে ধরলেও একসময়ে অনুভব করলো মিতু ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে । এবং কিছু সময় পরেই অনুভব করতে পারলো মেয়েটা ফুপিয়ে উঠেছে ।
তামীম নিজের মনের কাছেই দ্বিধা গ্রস্থ হয়ে উঠলো । এতোটা সময়ে সে মিতুকে নিজের কাছ থেকে দুরে সরিয়ে রেখেছে । নিজেদের ভেতরে একটা বিশাল দেওয়াল তুলে রেখেছিলো । মিতু সব সময় ওর কাছে আসতে চেয়েছে কিন্তু তামীম তা দেয় নি । তাই বলে মিতু কখনই ওকে অবহেলা করে নি । ওর কখন কি লাগবে সব কিছু খেয়াল রেখেছে । ওর প্রতিটা জিনিস চলে এসেছে একেবারে না চাইতেই । বিনিময়ে কেবল চেয়ে তামীমের একটু ভালোবাসা । আজকেও যখন নাপা আনতে বলল তখন কেবল বলেছিলো যাতে ফেরার পথে নাপা নিয়ে আসে ।

তামীম বলল, হয়েছে ? এবার কাজটা শেষ করে আসি । তারপর যত সময় ধরে ইচ্ছে জড়িয়ে ধরে থেকো ।
মিতু তামীমকে ছেড়ে দিল । তবে তামীম তখনও ওকে ছাড়ে নি । আরও কিছু সময় জড়িয়ে ধরে রাখলো । তারপর মিতুর কপালে একটা ছোট চুমু খেল । তারপর বলল, এখন শুয়ে থাকো । ক্ষুধা লাগলে আমাকে ডাক দিও । ঠিক আছে । জ্বর ছেড়ে যাবে কিছু সময় পরেই ।
-জ্বর না ছাড়ুক !
-সেকি কথা ! জ্বর কেন ছাড়বে না ?
-জ্বর ঠিক হলে আপনি তো আর আমাকে এভাবে আদর করবেন না !
-বোকা মেয়ে বলে কি ! কে বলেছে করবো না?
-আমি জানি !
-তুমি ভুল জানো ! এখন চুপচাপ শুয়ে থাকো তো । কোন কথা বলবে না !

মিতু দেখলো তামীম দরজার কাছে গিয়ে আরেকবার ফিরে তাকালো । মিতুর তখনও ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না যে আজকে এতোদিন পরে সে তামীমকে পেয়েছে । নিজের মত করে করে পেয়েছে । তার এতো দিনের অপেক্ষার শেষ হয়েছে । যে হৃদয়টা তামীমের জন্য তৃষ্ণিত ছিল সেটা আজকে যেন পরিপূর্ণতা পেয়েছে ।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.9 / 5. Vote count: 81

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →