অজ্ঞাত চুমু

oputanvir
4.7
(117)

অফিসে পা দিয়েই মনে হল আজকে অফিসে আসা মোটেই ঠিক হয় নি । রিসিপশনের মেয়েটা আমাকে দেখে কেমন যেন মুখ টিপে হাসলো। একটা তীব্র অস্বঃস্তি আমাকে পেয়ে বসলো । আবার মনে হল যে আসলেই আজকে অফিসে আসা মোটেই উচিৎ হয় নি । কিন্তু না এসে উপায়ও ছিল না । আজকে প্রজেক্টের প্রেজেন্টেশন আছে । ছুটি যে নিবো সেটারও উপায় ছিল না । এখন এই জিনিস আমাকে সহ্য করতে হবে ।

লিফটের উঠেও ঠিক একই পরিস্থিতির শিকার হলাম । একবার মনে হল লিফটে না গিয়ে সিড়ি দিয়ে উঠি কিন্তু আমার ডেস্কটা ঠিক ৯ তলাতে । এই সকাল বেলাতে এতো উপড়ে উঠতে ইচ্ছা করলো না । লিফটে দেখা হল রফিক ভাইয়ের সাথে । আমার দিকে এমন ভাবে তাকাতে লাগলো যেন আমার গালে এখনও সেই লিপস্টিকের দাগ লেগে আছে । আমার গালের কাছে এসে বলল

-কই অপু লিপস্টিকের দাগ তো এখনো উঠে নাই ?

লিফটে আরও দুইটা মেয়ে ছিল । রিয়া আর অনু । দুইটাই আমার ডিপার্টমেন্টে কাজ করে । অনু মেয়েটা আবার সব সময় গম্ভীর থাকে । কারো সাথে ঠিক মেশে না । চুপ চাপ থাকে । রফিক ভাইয়ের কথা শুনে দুজনেই হিহি করে হেসে দিল । আমি লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম । আমাকে এরকম বিপদে ফেলতে পেরে রভিক ভাই যেন খুব বেশি মজা পেল । রাগে দুঃখে তখনই ইচ্ছে হল চাকরি ছেড়ে চলে যাই । কিন্তু এই লিফটের ভেতর থেকে যাবো কোথায় আর আজকে যেন লিফট টা খুব বেশি আস্তে চলছে ।

লিফট থেকে বেরিয়ে কোন মতে দৌড়ে নিজের ডেস্কে চলে এলাম । আসার সময় কানে আরও নানা রকম হাসি ঠাট্টার আওয়াজ ভেসে এল । এই অফিসে আর কতদিন টিকতে পারবো আমি ঠিক জানি না । যদি এমন করেই চলতে থাকে তাহলে খুব বেশি দিন যে টিকতে পারবো না সেটা একেবারেই নিশ্চিত ।

আমি নিজে কোন দিন ভাবি নি যে এরকম একটা পরিস্থিতিতে পড়বো । গত পরশু দিন আমার সাথে এমন ঘটনা ঘটে গেছে যার ব্যাপারে আমার নিজের কোন হাত নেই । গত পরশু দিন আমাদের অফিসে পার্টি ছিল । সবাই সেখানে হাজির । তবে পার্টির কেন্দ্র ছিল আমাদের চেয়ারম্যান স্যারের বড় ছেলে মাহমুদ আহমেদ । বয়সে আমার মতই । তবে দেখতে খুবই সুদর্শন । দেশের বাইরে ছিল এতো দিন । মাত্রই পিএইচডি শেষ করে দেশে ফিরেছে । এখন বাবার অফিসের দায়িত্ব বুঝে নিচ্ছে । আর তার জন্য মেয়ে খোজা হচ্ছে । এই পার্টিটা ছিল মোটামুটি তাকে সবার সাথে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার জন্য ।

মাহমুদ আহমেদ অফিস জয়েন করেছে মাস খানেক হল । এরই মধ্যে পুরা অফিসের সব অবিবাহিত মেয়ে তার জন্য পাগল হয়ে গেছে । আর হবেই বা না কেন ? মাহমুদ আহমেদ কোন দিক দিয়ে কম না । একটা মেয়ের স্বপ্নের পুরুষ যেমন হওয়া উচিৎ মাহমুদ আহমেদ ঠিক তেমনই একজন ছেলে ।

সবাই মাহমুদকে ঘিরেই কথা বার্তা বলছিলো । আমিও তার পাশেই ছিল । পার্টি চলা কালীন সময়ে হঠাৎ ই হল রুম অন্ধকার হয়ে গেল । পুরা ব্লাক আউট । বুঝতে পারলাম ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেছে । সাথে সাথেই জেনারেটর চালু হয়ে যাওয়ার কথা কিন্তু হল না । হয়তো কোন একটা সমস্যা হয়েছে ।

আমাদের অফিস পার্টি রুমটা বানানো হয়েছে বেজমেন্টের নিচে । এই জন্য ইলেক্ট্রিসিটি চলে যাওয়ার সাথে সাথে পুরো ঘরটা একেবারে অন্ধকার হয়ে গেছে । আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম ।

ঠিক সেই সময়ে অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটলো । আমি অনুভব করলাম যে কেউ আমাকে জড়িয়ে ধরলো তারপর আমার গালে চট করে একটা চুমু খেল । এবং সাথে সাথেই আমাকে ছেড়ে দিল । আমি এতোই অবাক হয়ে গেল গেলাম কিছুটা সময় কোন কথা বলতে পারলাম না ।

আমার বিমুর্ত ভাবটা কাটলো যখন আবার আলো ফিরে এল । তাও আবার চেয়ারম্যান স্যারের কথায় । তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বলল

-কি ব্যাপার অপু ? গালে লিপস্টিক কেন ?

আমি মুছতে যাবো কি আশে পাশের সবাই আমাকে ঘিরে ধরলো । কেউ কেউ আবার ছবিও তুলে নিল । সবাই বিশেষ করে মেয়েরা আমার দিকে তাকিয়ে হাসাহাসি করতে লাগলো । ঠাট্টা টিপ্পনি তো চলতেই লাগলো । আমি লজ্জায় মাটির সাথে মিশে গেলাম ।

কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম আমার সাথে আসলে কি হল একটু আগে ? আর আমাকে এভাবে চেপে ধরে চুমু খাওয়ার কি হল !

তখনই আমার মাথায় কথাটা এল । আমাকে আসলে কেউ চুমু খেতে চায় নি । চুমু টা দিতে চেয়েছে মাহমুদকে । আমি যেহেতু ওর পাশেই দাড়িয়ে ছিলাম ভুল করে কেউ আমাকে চুমুটা খেয়েছে । কিন্তু তবুও সবাই তো আমার ব্যাপারেই কথা বলছে । যেখানে আমার কোন দোষ নেই ।

প্রেজেন্টেশন ভাল হল । কিন্তু সেটা শেষ হতেই আবার সেই সেই লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পড়তে হল । এবার স্বয়ং মাহমুদই আমাকে টিজ করলো । আমি কাজ শেষ করে ফাইল পত্র গুাচ্ছি তখনই মাহমুদ বলল

-অপু সাহেব ?

-জি স্যার !

-আপনি কাজ ভাল করেন কিন্তু আপনাকে ভাবছি এখানে আর রাখবো না ।

-মানে ? আমি ঠিক বুঝলাম না ।

-আপনাকে রাখার উপায় আছে বলেন ? আপনি আমার ভাগের জিনিস পত্র নিজে নিয়ে নিচ্ছেন । আজ কাল মেয়েদের চুমু কি আর সহজে পাওয়া যায় ?

পুরো মিটিং রুমে হাসির রোল পড়ে গেল । আমি কি বলব কিছুই বুঝতে পারলাম না । অন্যদের রসিকতায় না হয় মুখ কালো করে ফেলা যায় কিন্তু বস যেখানে আপনাকে নিয়ে রসিকতা করছে সেখানে সেটা হাসি মুখেই সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই । মনে মনে সেই মেয়ের উপর এমন রাগ হল যে বলে বোঝাতে পারবো না । এখন যদি তাকে কাছে পেতাম তাহলে খবরই ছিল । বেটা ফাজিল মাইয়া কোথাকার ! চুম্মাচাটি করবি ঘরের ভেতরে গিয়া কর । তার উপর আবার আসল মানুষকে কর আমাকে নিয়া টানাটানি ক্যান !

নিজের ডেস্কে এসেও অনেকটা সময় হপ করে বসে রইলাম । কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না । এমন কি লাঞ্চ আওয়ারে খেতেও গেলাম না । নিজের ডেস্কেই বসে রইলাম মাথা নিচু করে । এমন করেই কখন যে ঘুম চলে এসেছে টেরই পাই নি । যখন ঘুম ভাঙ্গলো তখন তখন দেখি পুরো অফিসে কেবল আমি একাই রয়েছি ।

আশে পাশেই সব ডেস্কেরই আলো নিভে গেছে । আমি এতো টা সময় ঘুমিয়েই ছিলাম । একটু অবাক হলাম, সেই সাথে একটু বিরক্তও । সবাই আমাকে রেখেই চলে গেছে। টের পেলাম বেশ ক্ষুধাও লেগেছে আমার । এতো সময়ে ক্যান্টিনও বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা, তাই সেদিকে আর পা বাড়ালাম না । সব জিনিস পত্র গুছিয়ে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম । বাইরে এসে আবারও বিরক্ত লাগলো । বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে । এখন এই বৃষ্টির ভেতরে বাসায় যেতে আমার খবর হয়ে যাবে । ধুর ! আজকের দিনটাই ছিল বাজে !

আমি পার্কিংয়ের সামনে দাড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন বৃষ্টি থামবে তখনই একটা লাল রংয়ের গাড়ি এসে আমার সামনে থামলো । আমি চিনি এই গাড়িটা কার ! আমি খানিকটা অবাকই হলাম । আমার ধারনা ছিল যে পুরো অফিসে কেবল মাত্র আমিই ছিলাম । অনুও যে অফিসে থাকতে পারে সেটা আমার ধরনা ছিল না । অবশ্য এই মেয়েটা সব সময় নিজের চারিপাশে কঠিন এক দেওয়াল তৈরি করে রাখে । তার সম্পর্কে কাউকে জানতে দেয় না । আমি কেবল অনুর নাম জানি । জানি যে ওর বাবা একজন সরকারি কর্মকর্তা । আর এই লাল গাড়িতে করে প্রতিদিন অফিস আছে । নিজেই গাড়ি চালিয়ে আসে !

কাঁচ নেমে নেমে গেল । আমার মনে হল এই মেয়েও এখন আমাকে নিয়ে ইয়ার্কি ঠোঁট্টা করবে । এই জন্যই হয়তো গাড়িটা থামিয়েছে । কিন্তু সেটা করলো না । গাড়ির জানালা থেকে মুখ বের করে বলল

-বাইরে তো বৃষ্টি হচ্ছে ! উঠে এসো …।

আমি মনে করার চেষ্টা করলাম অনুর সাথে এর আমার কথা হয়েছে কি না । হ্যা কয়েকবার যে হয় নি সেটা না কিন্তু সেটা কেবলই কাজ সম্পর্কৃত । তাও সম্ভব্যত আপনিতেই আমাদের কথা হয়েছিলো । আজকে দেখি মেয়ে আমাকে সরাসরি তুমি করে কথা বলছে । একটু অবাক না হয়ে পারলাম না । ঘটনা কি ?

আমি বললাম

-না ঠিক আছে !

-উঠে এসো । এই বৃষ্টি থামবে না ।

সত্যিই তাই । এই বৃষ্টি সহজে থামবে না । আমার কাছে মনে হল যেন কিছু একটা ঠিক নেই । অনুর তো আমাকে এভাবে লিফট দেওয়ার কথা না । তাহলে কেন দিচ্ছে ? আমি আর কোন কারণ জানতে চাইলাম না । গাড়িতে উঠে এলাম ।

গাড়ি চলতে শুরু করলো । আমি জড়সড় হয়ে বসেই রইলাম । কোন কথা বলছি না । কি বলব বুঝতেও পারছি না । হঠাৎ অনু বলল

-তো, টক অব টাউন হতে কেমন লাগছে ?

আমি ওর দিকে ফিরে তাকালাম । অনুর চেহারাতে আজকে আশ্চর্য্য এক উজ্জলতা দেখতে পাচ্ছি । মুখটাও কেমন যেন একটু হাসিহাসি । অনু সাধারনত এমন হাসিখুশি থাকে না । আজকে মেয়েটার কি হল ?

আমি কি বলব খুজে পেলাম না । কেবল হাসলাম । অনু বলল

-তুমি এমন লজ্জা পাচ্ছো কেন বলতো কিংবা বিব্রত হচ্ছো কেন এতে ?

-মানে ?

-মানে একটা মেয়ে তোমাকে চুমু খেয়েছে এতে তো তোমার খুশি হওয়ার কথা । তাই না ? সবার ভাগ্য কিন্তু এমনটা জোটে না ?

আমি অনুর কথাটা ভাবতে শুরু করলাম । আসলেই তো ! এটা তো খারাপ কিছু না । কিন্তু তারপরেই মনে হল এসব গল্প উপন্যাসে ভাল লাগে বাস্তব জীবনে এসব ঘটলে খানিকটা অস্বস্তিতে পড়তে হয় । অনু বলল

-বুঝতে পারছি । তোমার অস্বস্তি যাচ্ছে না । তাই না ?

আমি কেবল মাথা নাড়ালাম । অনু আবার বলল

-তবে তোমার কিন্তু জানায় একটা ভুল আছে !

-কি ভুল ?

অনু হাসলো একটু । তারপর বলল

-তুমি কিংবা তোমরা ভাবছো যে চুমুটা আসলে মাহমুদ স্যারের জন্য ছিল । ওটা ভুল করে তোমার গালে এসে হাজির হয়েছে ! তাই না ?

আমি কেবল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম অনুর দিকে । হঠাৎ লক্ষ্য করলাম গাড়ি থেমে গেছে । গাড়ি থামিয়ে অনু আমার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময় । আমি কেবল দেখতে পেলাম ওর ঠোঁট দুটো মৃদু ভাবে কাঁপছে । আমার বুকের ভেতরে আলাদা একটা অনুভূতি হল । আমার মনে পড়লো পার্টির ঐদিন অনু ঠোঁটে লাল লিপস্টিক ছিল । আর আমার গালে যে লিপস্টিকের দাগ ছিল সেটাও ছিল লাল ! আমি কেবল অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইলাম অনুর দিকে ।

অনু আমার কাছে এসে আমার ঠোঁটে আলতো একটা চুমু খেল । তারপর বলল

-চুমুটা তোমার জন্যই ছিল ।

আর কোন কথা বলল না । গাড়ির দরজা খুলে বাইরের বৃষ্টির ভেতরে বের হয়ে গেল । আমার বিস্ময়টা কাটতে আরও কিছুটা সময় লাগলো । আমি কখনও ভাবতেও পারি নি যে অনু কোন দিন আমাকে পছন্দ করতে পারে !

আমি যখন বাস্তবে ফিরে এলাম তখন তাকিয়ে দেখি গাড়িটা থেমে আছে মিন্টু রোডের রাস্তায় । চারিদিকে তীব্র বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে সব । গাড়ির হেড লাইটের আলোতে আমি অনুকে দেখতে পাচ্ছি আপন মনে বৃষ্টিতে ভিজছে । আমার কেবল কয়েক মুহুর্ত লাগলো বুঝতে যে আমার এখন কি করা উচিৎ !

আর অন সব কিছু ভুলে গেলাম মুহুর্তেই । তারপর গাড়ির দরজা খুলে বের হয়ে এলাম বৃষ্টির ভেতরে । আমার চোখ তখন কেবলই অনুর দিকে ! আমার কেবল মনে এই পৃথিবীতে আমি আর অনু ছাড়া আর কেউ নেই ! এই পৃথিবীটা কেবল আমাদের দুই জনের !

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.7 / 5. Vote count: 117

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →