নিশিতা নিজের শরীরের উপরে থাকা ওড়না এক টানে মেঝেতে ফেলে দিল । ওর পরিস্ফুটিতো দেখটা ফারিজের কাছে আরও একটু বেশি ফুটে উঠলো । কিছুটা সময় ফারিজ কেবল সেদিকে তাকিয়ে রইলো । এমন আকর্ষনীয় শরীরের দিকে তাকিয়ে না থেকে উপায় নেই । তবে ফারিজের চোখ আসলে সেদিকে নেই । সে তাকিয়ে আছে নিশিতার চোখের দিকে । সেখানে বিন্দুর মত করে অশ্রু জমতে শুরু করেছে । ভাগ্যের ফেরে আজকে নিশিতাকে এখানে ফারিজের সামনে এভাবে নিয়ে এসে ফেলেছে । নয়তো কোন দিন নিশিতা ওর সামনে এভাবে আসতো ।
নিশিতা বলল, ইউ ক্যান হ্যাভ মি । আমার সাথে যা ইচ্ছে তুমি করতে পারো । কেবল রেহানকে বাঁচাও প্লিজ । আমি সারা জীবন তোমার দাসী হয়ে থাকবো ।
ফারিজের বুকের ভেতরে আবারও একটা কষ্ট মোচড় দিয়ে উঠলো । মস্তিস্কের একপাশটা খানিকটা বিদ্রোহই করেই একদম নিজের মত করে নিশিতাকে অধিকার করে নিতে চাইলো পরক্ষণেই অন্য পাশটা ওকে মনে করিয়ে দিল যে তাতে তো ফারিজের পরাজয় হবে । হয়েছে অনেক দিন আগেই । ভালোবাসার যুদ্ধে সে পরাজিত হয়ে গেছে । নিশিতা ওর সামনে দাড়িয়ে নিজেকে বিলিয়ে দিতে রাজি হয়েছে, নিজের সব কিছু ফারিজের হাতে দিতে রাজি হয়েছে । কিন্তু সেটা হয়েছে নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে রক্ষা করতে । ফারিজকে চিৎকার করে বুঝিয়ে দিচ্ছে যে দেখো রেহানকে সে ভালোবাসে । এর জন্য ও সব কিছু করতে পারে ।
ফারিজ নিশিতার একদম কাছে চলে গেল । এতো কাছে যে নিশিতার নিঃশ্বাসের শব্দও যে শুনতে পাচ্ছে । একভাবে কিছু সময় নিশিতার দিকে তাকিয়ে রইলও । এতো কাঙ্খিত একটা মুখ । এখন চাইলেই এই মুখ স্পর্শ করা যায় । চাইলেই এই ঠোঁটে চুমু খাওয়া যায় । তবুও ফারিজ নিজেকে খানিকটা নিয়ন্ত্রন করে নিল । তারপর নিজেকে একটু দুরে সরিয়ে নিল । নিশিতা তখনও একভাবে তাকিয়ে আছে ওর দিকে । সেই একই অশ্রুশিক্ত চোখে । ফারিজ বলল, আই ডোন্ট ওয়ান্ট ইয়োর বডি নিশি । আই ….
একটু থামলো । তারপর আবার বলল, আই ওয়ান্ট ইউ টু লাভ মি । কিন্তু আই গেস সেটা সম্ভব না । তাই না?
ফারিজ একবার নিশিতার দাড়িয়ে থাকা পুরো স্থানটা ঘুরে এসে আবারও নিশিতার মুখোমুখি হল । তারপর বলল, একবার ভেবে দেখো তোমার স্বামীকে বাঁচানোর জন্য নিজেকে আমার হাতে তুলে দিতে চাচ্ছো !! হাউ লাকি হি ইজ । আই উইস আমার জন্য তুমি এভাবে কিছু করতে !
আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো তখনই দরজায় কড়া নড়লো । নিশিতার দিকে তাকিয়ে ফারিজ বলল, কাপড় ঠিক করে নাও ।
নিশিতা ঝুকে গিয়ে ওড়নাটা তুলে নিল। তারপর নিজের শরীরে জড়িয়ে নিল সেটা । ফারিজ অনুমুতি দিতেই একজন ভেতরে ঢুকলো । তার হাতে একটা কাগজের ফাইল । সেটা নিশিতার হাতে তুলে নিল সে । তারপর আবার চলে গেল ।
ফারিজ আবারও নিশিতার সামনে এসে দাড়ালো । তারপর বলল, তোমার দেহ আমি চাই না । এমন কি আমাকে ভালোবাসার জন্য আমি তোমাকে জোরও করবো না । এই এতো গুলো বছর আমি অন্তত একটা ব্যাপার বুঝতে পেরেছি যে জোর করে ভালোবাসা হয় না । আজকে রাতেই তুমি রেহানকে নিয়ে সিঙ্গাপুর যাবে আমার প্রাইভেট জেটে করে । ইমার্জেন্সী মেডিক্যাল ভিসার জন্য এপ্লাই করা হয়েছে । খুব জলদি হাতে চলে আসবে আশা করি । যতদিন তোমার হাসব্যান্ড ঠিক না হয় সেখানে থাকবে তুমি । তার জন্য আলাদা একটা মেডিক্যাল টিম গঠন করা হচ্ছে । ঠিক দুইদিন পরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরো দুজন বিশেষজ্ঞ আসবে রেহানকে দেখতে । শুধু একটা শর্তে ।
নিশিতা এতো সময় খানিকটা নির্বাক হয়েই কথা গুলো শুনছিলো । ওর যে ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিলো না কথা গুলো । শর্তের কথা শুনে চোখ দুটো একটু চঞ্চল হয়ে উঠলো । ফারিজ বলল, তোমার হাজব্যান্ডের ট্রিটমেন্টের পেছে যত টাকা খরচ হবে তত টাকা তুমি আমাকে ফেরৎ দিবে । তবে সেই ফেরৎ দেওয়ার কোন সময় সীমা থাকবে না । যতদিনে পারো । তবে শর্ত হচ্ছে যতদিন তুমি আমার টাকা আমাকে ফেরৎ না দিতে পারো ততদিন আমার অফিসে তোমাকে চাকরি করতে হবে । কোন ভাবেই চাকরি ছাড়া চলবে না । তবে ভেবো না যে আমি তোমাকে বিনা বেতনে চাকরি করতে বলছি । চাকরি করবে বেতন নিয়েই । শর্তে কি রাজি?
নিশিতার এখন এমন একটা অবস্থা যে যদি ফারিজ শর্ত দিতো যে ওর সাথে নিয়মিত রাত কাটাতে হবে নিশিতা তাতেই রাজি হয়ে যেত । এই জন্যই তো এসেছিলো সে । যে কোন ভাবেই টাকা জোগার করতে হবে । নয়তো রেহানকে কোন ভাবেই রক্ষা করতে পারবে না । কিন্তু ফারিজ যে এই কথা বলবে সেটা ও ভাবতেই পারে নি ।
-এতো বড় উপকার এমনি এমনি কেন করছো?
ফারিজ হাসলো । তারপর বলল, তুমি জানো কেন করছি ! নিশিতা মাঝে মাঝে রেহান সাহেবকে আমার বড় ঈর্ষা হয় জানো ! তার কাছে নিজেকে আমার বড় পরাজিত মনে হয় । সে এমন কিছু পেয়েছে যা আমি পাই নি । এই যে দেখো এতো টাকা পয়সা এতো ক্ষমতা তবুও পাই নি । অন্য দিকে দেখো তার কিছুই নেই তবুও সে জয়ী ! তোমাকে পেয়ে জয়ী !
কয়েক মুহুর্ত কেটে গেল নিরবে। তারপর ফারিজ বলল, যদি শর্তে রাজি থাকো তবে সাইণ করে দাও । আর বাসায় গিয়ে গোসগাস করে ফেলো। রাত এগারোটায় তোমার ফ্লাইট ।
দুই
পরের দুইটা মাস নিশিতার কেটে গেল সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালেই । পানির মত টাকা খরচ হতে লাগলো । প্রায় দিনই নানান ডাক্তার আসছে রেহানকে দেখছে । সিঙ্গাপুরে পৌছানোর সপ্তাহ খানেক পরে আমেরিকা থেকে ডা. পাউল ক্যারোলিন এসে হাজির হলেন । পরে নিশিতা গুগল করে দেখেছিলো যে বর্তমান পৃথিবীর সেরা তিনজন ক্যা্ন্সার স্পেশালিস্টদের একজন তিনি । যত রকম ভাবে চেষ্টা করা সম্ভব ছিল সব রকম করা হল । কিন্তু শেষ রক্ষা হল না । ঠিক ৭৩ তম দিনের মাথায় রেহান মারা গেল । ততদিনে নিশিতা নিজের মনকে বুঝ দিয়ে ফেলেছিলো যে একজন মানুষকে রক্ষা করার যত রকম চেষ্টা করা সম্ভব রেহানের ব্যাপারে সব করা হয়েছে কিন্তু তবুও তাকে বাঁচানো সম্ভব হল না । রেহান ওকে ছেড়ে চলে গেলই । তারপর দেশে এসে একটু স্বাভাবিক হতে কেটে গেল আরও মাস দুয়েক । এই পুরো সময়ে নিশিতার সাথে ফারিজের একদিনও দেখা হয় নি । ফারিজ একদিনও নিশিতার সামনে আসে নি । তবে সব কিছু ঠিকই যোগার হয়ে গেছে । সিঙ্গাপুরে থাকতে নিশিতার কখন কী লাগবে সেটার জন্য একটা ফোন দেওয়া হয়েছিলো । তাকে বলা হয়েছে যে ফোন করারও দরকার নেই । কেবল নির্দিষ্ট একটা নম্বরে মেসেজ পাঠিয়ে দিলেই হবে। আর হাসপাতালে খরচের ব্যাপারে কোন চিন্তাই নিশিতাকে করতে হয় নি । তবে একটা ধারনা সে পেয়েছিলো যে ৭৩ দিনে রেহানের পেছনে প্রায় দেড় কোটি টাকা খরচ হয়েছে । এছাড়া ওর থাকা খাওয়ার পেছনেও বেশ কিছু টাকা তো গেছে ।
নিশিতা যখন ফারিজের অফিসে পা দিল তখন সকাল এগারটা । আজকে ওর অফিসের প্রথম দিন । গতকাল সে ফারিজকে একটা কেবল মেসেজ দিয়ে জানিয়েছিলো যে আজকে সে অফিসে আসতে চায় । আজ থেকেই কাজ কর্ম শুরু করতে চায় । ফারিজ কেবল ওকে লিখে জানিয়েছে ওকে । অফিসে ঢুকে প্রথমে কি করবে কিছু সময় সে বুঝতে পারলো না । তখনই দেখতে পেল যে অফিসের রিসিপশনে মেয়েটা ওর দিকে তাকিয়ে আছে । তার দিকে এগিয়ে যেতেই মেয়েটি বলল, আপনি কি নিশিতা রহমা ?
-জ্বী ।
-ওয়েলকাম ম্যাম । আপনার কথা স্যার বলে দিয়েছেন । একটু অপেক্ষা করুন প্লিজ ।
মেয়েটা তারপর কাকে যেন ফোন করলো । কিছু সময়ের ভেতরে একজন স্যুট পরা ছেলে এসে হাজির হল । নিশিতাকে নিয়ে গিয়ে একেবারে ওর ডেস্কে বসিয়ে দিল । একটু পরে ওর সামে ওর এপোয়েন্টমেন্ট লেটার এসে হাজির হল । খাম খুলে দেখলো ওকে অফিসের একজন এক্সিকউটিভ হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে । বেতন শুরুতে ৩৫ হাজার টাকা ধরা হয়েছে তিন মাস পরে সেটা ৪০ হাজার হবে । এছাড়া আরও নানান সুযোগ সুবিধার কথা উল্লেখ রয়েছে ।
কাজ কর্ম শুরু হল নিশিতার । ফারিজের সাথে ওর দেখা হল না সেদিন । নিশিতা ভেবেছিলো ফারিজ হয়তো ওর সাথে দেখা করতে আসবে নয়তো ওর ডাক পড়বে । তবে এমন কিছুই হল না । এমন কি এক সপ্তাহ কাজ করার পরেও ফারিজের সাথে ওর দেখা হল না । একদিন নিশিতা নিজ থেকেই ফারিজের সাথে দেখা করতে ওর কেবিনে গিয়ে হাজির হল । নিশিতা কোন রকম অনুমুতি কিংবা টোকা না দিয়েই কেবিনের ভেতরে ঢুকে গেল । ফারিজ তখন নিজের ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে কি যেন করছিলো । ওকে ঘরে ঢুকতে দেখে একবার চোখ তুলে তাকালো । তারপর আবারও স্ক্রিনের দিকে চোখ ফিরে তাকালো ।
নিশিতা চেয়ারের সামনে গিয়ে বসলো কিছু সময় । কেউ কোন কথা বলল না কিছু সময় । তারপর নিশিতাই মুখ খুলল, আমি তোমাকে ধন্যবাদ জানাতে এসেছি ।
-এক সপ্তাহ পরে !
-আমি ভেবেছিলাম তুমি আসবে!
ফারিজ একটু হাসলো । তারপর বলল, এই অফিসের বস আমি । আমার আসলে এভাবে তোমার কাছে যাওয়া মানায় না ।
-আচ্ছা তুমি এসবের তোায়ক্কা কর !
ফারিহ আবারও হেসে ফেলল । তারপর বলল, আসলে তোমার কাছে যত যাবো আমার মনে তত তোমাকে পাওয়ার আকাঙ্খা জন্মাবে । এই যে এই এগারো বছর আমি তোমার কাছ থেকে দুরে ছিলাম । মনের ভেতরে সেই আকাঙ্খাটা একটু ঘুমিয়ে ছিল । যেদিন তোমাকে আবার দেখলাম সব কিছু আবার ভেঙ্গে চুরে গেল গেল । আবারও সেই অদমিত মন উত্তল হল !
-তাহলে আমাকে এখানে আবার চাকরি করতে শর্ত দিলে কেন ? এখনও তো আমার তোমার চোখের সামনেই থাকবো সম সময় !
ফারিজ চট করে কোন জবাব দিল না । কিছু সময় অন্য দিকে তাকিয়ে রইলো কেবল । তারপর বলল, জানি না আসলে । সত্যিই আমি এইপ্রশ্নের উত্তর জানি না ।
তারপর দুজনেই চুপ করে রইলো কিছু সময় । নিশিতা বলল, আমি সম্ভবত তোমার সাথে অন্যায় করেছি । ঐ সময়ে তোমার সাথে যদি ওমন আচরণ আমি না করতাম তাহলে হয়তো আজকে তোমার জীবনটা অন্য রকম হত !
-তোমার জীবনও হয়তো হত !
-হয়তো !
কিছু সময় চুপ করে থেকে নিশিতা বলল, আমি জানি যে আমি যদি চাকরি ছেড়ে আজই চলে যেতে চাই তুমি আমাকে বাঁধা দিবে না । কিন্তু আমি যাবো না চাকরি ছেড়ে । এই টুকু কৃতজ্ঞতাবোধ আমার ভেতরে আছে ।
তিন
সব কিছু এমন ভাবেই চলল বেশ কিছু দিন । নিশিতা প্রতিদিন অফিসে আসে । মাঝে মাঝে ফারিজের সাথে কথা বলে । কাজের কথা ছাড়াও জীবনের কথা । নিশিতাও নিজের শোক কাটিয়ে স্বাভাবিক হয়ে উঠলো । অন্য দিকে ফারিজের মা নতুন করে আবারও ছেলের বিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন । এইবার তিনি একটু আশার আলো দেখতে পেয়েছেন । ফারিজ হয়তো বিয়েতে রাজি হবে ।
তিনি নিশিতার বাবা মায়ের কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গেলেন । তারাও মেয়ের বিয়ের জন্য চেষ্টা চালাচ্ছিলেন । নিশিতা তখন বাসাতেই ছিল । নিশিতার কেবল চুপচাপ শুনে গেল । নিশিতাকে ফারিজের মা একলা ঘরে ডেকে নিয়ে গেল কয়েকটা কথা বলার জন্য । কথা শেষ করে তিনি নিজেই নিশিতাকে সিদ্ধান্ত নিতে বললেন ।
ঐদিন বিকেল বেলা ফারিজ বাড়িতে এসে জানতে পারলো যে তার মা গিয়েছিলো নিশিতাদের বাসায় । এটা শুনে সে খুব রাগারাগি করলো । মা ছেলের ভেতরে বেশ কিছু সময় কথা কাটাকাটি চলল । ঠিক এমন সময় বাড়ির কাজের লোক এসে জানালো যে একজন মেয়ে দেখা করতে এসেছে । তাকে নিয়ে যখন ঘরের ভেতরে ঢুকলো ফারিজ আর ফারিজের মা দুজনেই অবাক হল এক ।
নিশিতা এসেছে ফারিজদের বাসায় !
ঘরে এসে সে ফারিজের মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, আন্টি আমি কি ফারিজের সাথে আলাদা করে কয়েকটা কথা বলতে পারি ?
ফারিজের মা বললেন, তোমরা বরং ফারিজের ঘরে গিয়েই কথা বল । সেটাই সব থেকে ভাল হবে ।
কেউ কোন কথা না বললেো মুখ দেখেই মনে হল ফারিজ এবং নিশিতা দুজনেরই এতে সম্মত আছে । ফারিজ দোতালায় নিজের ঘরের দিকে হাটা দিল । নিশিতা তার পিছু নিলো ধীরে পায়ে ।
ঘরে পৌছে নিশিতা একটা ছোট খাটো ধাক্কার মত খেল । ফারিজের দেওয়ালের ডান দিকে বড় একটা ওয়েল পেইন্টিং । এবং ওয়েল পেইন্টিং ওর নিজের । ওর কলেজ জীবনের ছবি । শিল্পী নিজের কল্পনা মিশিয়ে আরো একটু বয়স বাড়িয়েছে ।
ফারিজ নিজের খাটের উপর বসলো । নিশিতা তখনও পেইনটিংটার দিকে তাকিয়ে ।
একটা সময়ে ফারিজের দিকে তাকিয়ে বলল, হোয়াই ডু ইউ লাভ মি লাইক দিস?
-আই ডোন্ট নো । আই ডোন্ট নো ।
ফারিজের মা যখন কলেজে জীবনের কথা নিশিতাকে বলল আজকে নিশিতার মনে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হল । কলেজের শুরু থেকেই ফারিজকে সবাই চিনতো । বিশেষ করে বড়লোক বাপের ছেলে । মার্সিটিজে করে কলেজে আসে । দুই হাতে টাকা ওড়ায় । বন্ধু বান্ধব কম নেই । নিশিতার পেছনে যখন ফারিজ লেগেছিলো সত্যি বলতে নিশিতা একটু বিরক্তই হয়েছিলো । নিশিতা ভেবেছিলো যে হয়তো কদিন পরেই আগ্রহ চলে যাবে । অন্য মেয়ের পেছনে লাগবে । কিন্তু সেটা যখন হল না তখন একদিন সরাসরি ফারিজকে অপমানই করে ছিল সবার সামনে। সবার সামনেই বলেছিলো যে ওর মত ছেলের সাথে সে কোন দিন প্রেম তো দুরে থাক সামান্য কথা পর্যন্ত বলবে না ।
ফারিজের মা ওকে জানিয়েছিলো যে এরপর থেকেই ফারিজ একেবারে বদলে গেল । শেষে এমন অবস্থা হল যে ফারিজে বাবা পর্যন্ত ফারিজ কি চায় ও যা চায় তাই করবেন তিনি । সেদিন ফারিজ জানালো যে আর দেশে থাকতে চায় না । তখনই তাকে আমেরিকাতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ।
তারপর এতো গুলো বছর কেটে গেছে । আর কপালের ফের যাকে বলে । নিশিতা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যাকে ভালোবাসলো পরে বিয়ে করলো সেই ছেলে কিা ফারিজের অফিসেই চাকরি পেল । তারপর আবারও নিশিতার সাথে ফারিজের দেখা হল । ফারিজের বাবা তখন মারা গিয়েছেন । ফারিজ ব্যবসার হাল ধরেছে আমেরিকা থেকে এসে । যেদিন জানতে পেরেছে যে রেহান নিশিতার হাজব্যান্ড ঠিক তার মাস খানেক পরেই রেহানকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয় । নিশিতা বুঝতে পেরেছিলো ফারিজ সেটা ইচ্ছে করেি করেছে । ওর উপর প্রতিশোধ নিতে । ফারিজের প্রতি ঘৃণাটা তখন আরও বৃদ্ধি পেয়েছিলো কেবল ।
ভেবেছিলো যে কদিন পরেই রেহান অন্য কোথাও চাকরি ঠিকই জোগার করে ফেলবে । কিন্তু সেটা আর হল না । একদিন নিজের বাসাতেই মাথা ঘুরে পড়ে গেল । নিশিতা প্রথমে ভেবেছিলো হয়তো চাকরির টেনশনে এমন হচ্ছে । কিন্তু পরে যখন সব রিপোর্ট এল তখন যেন আকাশ ভেঙ্গে পরলো ওর মাথায় । রেহানের ফোর্থ স্টেজ ক্যান্সার ।
তখন আবারও ফারিজ এসে হাজির হল । নিশিতাকে অফার দিল যে যদি সে রেহানকে ছেড়ে দিয়ে ওর কাছে চলে আসে তাহলে রেহানের চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে । প্রথমে তীব্র ঘৃণা জন্মালেও একটা সময়ে নিশিতা আসলে বুঝতে পারে যে এটা ছাড়া আর কোনন উপায় নেই ওর কাছে ।
নিশিতা বলল, একটা কথা জিজ্ঞেস করবো ?
-বল ।
-রেহান কি সত্যি টাকা পয়সার গড়মিল করেছিলো ? এই জন্য তাকে চাকরি থেকে বরখাস্থ করেছিলে?
রেহান হাসলো । তারপর বলল, তোমার কি মনে হয় যে কেবল তোমার হাসব্যান্ড বলে আমি ওকে চাকরি থেকে বের করেছি ? সে যদি তোমার হাসব্যান্ড না হত তাহলে আজকে সে জেলের ভেতরে থাকতো ।
নিশিতা চুপ করে রইলো কিছু সময় । ফারিজ বলল, দেখো এতো কিছুর পরেও আমি তোমার ভালোবাসা পাই নি । সে পেয়েছে । দিন শেষে এটাই বড় কথা । আমার মা তোমাদের বাসায় গিয়ে কি বলেছি দয়া করে সেসব মনে রেখো না । কেমন ! তিনি মা হিসাবে কাজটা করেছেন ।
নিশিতা এবার ফারিজের পাশে বসলো । তারপর বলল, আমি যদি বিয়েতে রাজি হই?
নিশিতা দেখতে পেল ফারিজের চোখ দুটো কেমন যেন চঞ্চল হয়ে উঠলো । তবে সেটা নিভে গেল সাথে সাথেই । বলল, আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই না নিশিতা । আমি কেবল তোমার ভালোবাসা চেয়েছিলাম । চেয়েছিলাম তুমি মন থেকে আমাকে ভালোবাসো । রেহানকে ভালোবেসে যেমন ওকে রক্ষা করতে নিজেকে অন্যের কাছে বিলিয়ে দিতেও যেমন প্রস্তুত ছিল তেমন ভাবে ভালোবাসো । তোমাকে জোর করে আমি সেই ১১ বছর আগেই পেতে পারতাম । আমার বাবা আমাকে কী বলেছিলো জানো, বলেছিলো যে কোন মেয়ে তোর লাগবে বল, বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবো আজই, রাজি না হলে তুলে নিয়ে আসা হবে । কেবল হ্যা বলতাম তুমি আমার কাছে থাকতে কিন্তু আমাকে ভালোবাসতে না ।
-আর কিভাবে বুঝবে আমি তোমাকে ভালোবাসি না ?
-তোমার চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে । আমি বুঝতে পারবো ।
-আচ্ছা !
এই বলে নিশিতা রেহানের একদম কাছে চলে এল । তারপর ওর ঠোঁটে গাঢ় করে চুমু খেল । ঠোঁট সরিয়ে নেওয়ার পরে বলল, এবার তাকিয়ে দেখো তো বুঝতে পারো কি না !
-এখনও ভালোবাসো না !
আবারও একই ভাবে চুমু খেল নিশিতা । তারপর বলল, এবার ….
-এখনও না ।
নিশিতা চুমু খেল আবার । বলল, এবার ?
ফারিজ থামলো । তারপর বলল, এখনও তুমি রেহানকেই বেশি ভাল বাসো !
নিশিতা হেসে ফেলল এবার । তারপর বলল, যাক ভালোবাসা দেখতে পেয়েছো তাহলে । শুনো বাসা থেকে আমার বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে । আজ হোক কাল হোক আমাকে বিয়ে করতেই হবে । তুমি জানো আমাদের সমাজে একটা মেয়ে একটা চলতে পারে না । তাকে ঠিক ঠিক বিয়ে করতেই হয় । তুমি যদি বিয়ে করতে রাজি না হও তাহলে অন্য কাউকে বিয়ে করতে হবে । তারপর সেই হাজব্যান্ডকেও ভালো বাসা শুরু করবো হয়তো ..রেহান আমার হাজব্যান্ড ছিল । তার প্রতি আমার টান থাকবেই । সেই ভালোবাসা সেই টান নিশ্চয়ই একদিনে তৈরি হয় নি । আস্তে আস্তে হয়েছে । তুমি নিশ্চয়ই আশা কর না যে যে কারো প্রতি একদিনেই ভালোবাসা পাহাড় সমান হয়ে যায় !
ফারিজ কেমন বোকার মত তাকিয়ে রইলো নিশিতার দিকে। নিশিতা বলল, তোমার এসিস্ট্যান্ড ম্যানেজার আছে না আকিব সাহেব । কদিন আগে ডিভোর্স হয়েছে। উনি আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে ইন্ডাইরেক্ট ভাবে। তুমি রাজি না হলে ভাবছি ওকেই হ্যা বলে দিবো । কি বল !
ফারিজ চিৎকারে বলল, কী ঐ আকিব বেটার এতো বড় সাহস ! দাড়াও আজই বেটা …..।
নিশিতা হেসে ফেলল বেশ শব্দ করেই । তারপর আবারও ঠিক একই ভাবেই ফারিজের ঠোঁটে একটা চুমু খেল সে ।আর কোন কথা বলার দরকারই হল না ।
ভালোবাসা বড় অদ্ভুত একটা অনুভূতি । বেশির ভাগ মানুষ কখন কিভাবে কার প্রেমে পড়বে আর কিভাবে তার পুরো জীবন বদলে যাবে সেটা কোন দিন বুঝে উঠতে পারে না । কারো কারো জীবন এই ভালোবাসার কারণে বড় মধুর হয়ে যায় আবার কারো কারো জীবন হয়ে ওঠে বড় দুর্বিষহ !
Discover more from অপু তানভীর
Subscribe to get the latest posts sent to your email.