আমি যে হোটেলে নিয়মিত খাওয়া দাওয়া করি সেই হোটেলে একটা বেড়াল ছিল । হোটেলের বয় রাকিবেশর পোষা বেড়াল । নাদুস নুদুস দেখতে । গায়ের রং অনেকটা বাঘের মত । খুবই চমৎকার । সারাদিন হোটেলের আশে পাশে ঘুরে বেড়াতো কিংবা হোটেলের এক কোনে বসে থাকতো চুপচাপ । পাশেই খাবার সাজানো কিন্তু কোন দিন সেখানে মুখ দিতো না । সময় মত ক্ষুধা লাগলে সে রাকিবের পায়ের গিয়ে শরীর ঘষতো । আর মিয়াও মিয়াও করতো ।
আমি প্রতিদিন রাতে যখন খেতে যেতাম প্রতিদিন খাওয়া শেষ করে মাছ কিংবা মাংসের কিছু অংশ বেড়ালটাকে খেতে দিতাম ! প্রথম দু একদিন খাবার দেওয়ার পরপরই খেয়াল করে দেখতাম যে রাতে যখনই খেতে যেতাম তখনই সে হাজির হয়ে যেত আমার সামনে । আমি কিছু খেতাম আর খাওয়া থেকে বেড়ালটাকে খেতে দিতাম । আমার পায়ের কাছে এসে বসতো চুপচাপ ! কয়েকদিন আগে থেকে খেয়াল করলাম যে বেড়ালটা আর নেই । যখন পরপর কয়েকদিন দেখলাম না খাওয়ার সময় তখন রাকিবকে জিজ্ঞেস করলাম যে তার বেড়ালটা কোথায় । রাকিব জানালো যে ওপাড়ার কয়েকটা ছেলে বেড়ালটাকে মেরে ফেলেছে ।
বুকের ভেতরে ছ্যাৎ করে উঠলো ! কেমন যে মনে হল ঠিক বোঝাতে পারবো না । রাতে ঠিক মত খাওয়াই হল না আর । বারবার কেবল চোখের সামনে বেড়ালটার ছবি ভেসে উঠলো । পায়ের এসে মিউ মিউ করছে । আমার দিকে তাকিয়ে আছে ! আমার পায়ের কাছে এসে বসেছে !
মানুষ কিভাবে একটা জলজন্ত একটা প্রাণীকে মেরে ফেলতে পারে ! তিন দিন আগে ফেসবুকে একটা ছবি দেখতে পেলাম ! বাংলাদেশেরই একটা গ্রামের গ্রামবাসীরা মিলে একটা চিতা বাঘকে মেরে ঝুলিয়ে রেখেছে এবং উল্লাস করছে !
কি ভয়ংকর একটা দৃশ্য !
পুরো গ্রামের মানুষ একটা প্রাণীকে মেরে ফেলেছে এবং সেটা নিয়ে উল্লাস করছে !
কেবল যে নৃসংশ এই দৃশ্য সেটাই না, এর থেকে কাপুরুষতার ব্যাপার আর কিছু ঘটতেই পারে না !
এদের ছেলেরা যখন এই নৃসংশ দৃশ্য দেখে বড় হবে তাদের কাছ থেকে আপনি কিভাবে স্বাভাবিক আচরণ আশা করতে পারেন?
এই রকমই আমাদের দেশে খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার ! এর আগেও অনেকের চোখে পড়ার কথা । বনবেড়াল, মেছোবাঘ চিতাবাঘ আরও কত প্রাণী মানুষ মেরে ফেলেছে !
ছোট বেলাতে দেখতাম নিজ গ্রামেই এই রকম দৃশ্য !
তখন আশে পাশে বনজঙ্গল ছিল ! বাঁশের ঝাড় ছিল ! তারই ভেতরে বাস করতো শেয়ালের দল । বর্ষা কালে মাঝে মাঝে তারা বের হত । এলাকার কারো বাড়ি হতে মুরগি ধরে নিয়ে যেত । প্রতি রাতে তাদের ডাক শোনা যেত । এখন আর এসব শোনা যায় না । প্রায়ই তখন দেখা যেত এলাকার ছোট বড়রা মিলে এই রকম শেয়ালের পেছনে লেগেছে । তাদের বাসায় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারছে নয়তো বের হতে বাধ্য করছে পরে সেগুলোকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে । আমার চোখের সমানে একদিন দুইটা ছোট ছোট বাচ্চাকে কী ভয়ংকর ভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলা হল !
বছর দুয়েক আগের একটা ঘটনা সম্ভবত । ঢাকার একটা এলাকার একজন কুকুরের সাত ছোট ছোট বাচ্চাকে মাটি চাপা দিয়ে মেরে ফেলেছে । কারণ হিসাবে বলেছে কুকুরের ডাক তার সমস্যা হয় !
কদিন আগেও আমাদের ঢাকা শহরে কুকুর গুলোর প্রতি কর্তৃপক্ষ কী নিষ্ঠুর একটা পদক্ষেপ গ্রহন করলো । কতিপয় ব্লগারদের দেখলাম এই নিধনে তার সম্মতি রয়েছে । রাতে কুকুরের ডাকে তাদের ঘুম আসে না ! এই জন্য এই সব অবলা প্রাণী গুলোকে মেরে ফেলার পক্ষে তাদের সম্মতি রয়েছে !
রাস্তা ঘাটে যখন হাটা চলা করবেন তখন দেখবেন কিছু কিছু মানুষ আছে এমনিতেই কোন কারণ ছাড়াই পাশ দিয়ে হেটে যাওয়া কুকুর কিংবা বেড়ালের গায়ে ঢিল ছুড়ছে কিংবা তাদের আঘাত করছে ! কেন করছে ওরা?
এর উত্তর আমার জানা নেই ।
গ্রামে যখন ঈদের ছুটিতে বাসায় যাই তখন আমার সারাদিনই কাটে কেবল টিভি দেখে ! ডিসকভারি আর ন্যাশনাল জিওগ্রাফি । নাটজিওতে একটা প্রোগ্রাম হয় স্নেক ইন দ্য সিটি নামে ! এই প্রোগ্রামে দেখানো হয় যে এক দম্পতি সাপ ধারার কাজ করে । যদি কারো বাসা বাড়িতে কোন সাপ চলে আসে তাহলে তাদেরকে ফোন করা হয় তাহলে তারা সেখানে গিয়ে সাপটাকে ধরে বনে ছেড়ে দেয় ।
সাপকে মারে না কিন্তু । জীবন্ত ধরে এবং এমন ভাবে ধরার চেষ্টা করে যাতে সাপটার শরীরের আঘাত না লাগে ! সাপের মত একটা ভয়ংকর প্রাণীকেও ওরা মারতে নারাজ। একবার দেখেছিলাম একটা সামান্য বিড়াল ছানাকে রক্ষা করার জন্য রাস্তার পুরো পাইপলাইণ কেটে ফেলেছিল ফায়াব্রিগেড ! কেবল মাত্র সামান্য একটা বিড়াল ছানাকে বাঁচানোর জন্য ! আর আমাদের দেশে মানুষের বাচ্চা ড্রেনে পড়ে মরে থাকলেও কারো কিছু যায় আসে না !
খারাপ ভাল মিলিয়েই সব দেশের মানুষ । সব স্থানেই খারাপ মানুষ থাকবে এটা স্বাভাবিক । প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ অন্য দেশের মানুষও করে থাকে কিন্তু আমাদের দেশের মত এতো বিশাল পরিমানে সেটা নেই । সত্যিই নেই ।
মানুষের ভাল মন্দ বিচার করার আমার বেশ কিছু মান দণ্ড রয়েছে । এর ভেতরে একটা হচ্ছে এই প্রাণীর প্রতি আচরণ । আমার আসে পাশের মানুষজনের আচরণে যখন দেখি তার ভেতরে প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা প্রকাশ পেয়েছে কিংবা প্রাণীর প্রতি তাদের কোন সহানুভূতি প্রকাশ পায় না আমি নিজেকে তাদের কাছ থেকে সব সময় দুরে সরিয়ে নিই ধীরে ধীরে ! এরা বাইরের দিকে যত ভাল মানুষের মুখোশই পরে থাকুক না কেন এদের ভেতরে একটা ভয়ংকর চেহারা লুকিয়ে আছে । জীবনের যে কোন পরিস্থিতিতে সেটা বের হয়ে আসতে পারে ! এদের কাছ থেকে সব সময় দুরত্ব বজায় রেখে চলাই উত্তম !
Discover more from অপু তানভীর
Subscribe to get the latest posts sent to your email.