এই সব মিথ্যা গল্প ৫

oputanvir
4.7
(76)

লাঞ্চ আওয়ার শেষ করে আবার যখন ডেস্ক ফিরে এলাম, দেখি নীরা আমার ডেস্কের সামনে দাড়িয়ে আছে । ওর চেহারায় এখনও রোদে পোড়া ভাবটা রয়ে গেছে । এটা যেতে আরও কয়েকটা দিন লাগবে । যেভাভে কয়েক দিন আমরা রোদের ভেতরে হেটেছি ওর চামড়া বেশ ভাল ভাবেই পুড়েছে । আমি এখনো বেশ অবাক হয়েছি যে নীরার মত একজন কির্সতং সামিট করতে পারবে । যদিও বেশ প্যারা সে আমাকে দিয়েছে । তারপরেও যে উঠতে পেরেছে সেটা বেশ বড় একটা ব্যাপার

আমাকে দেখে হাসলো নীরা । তারপর বলল, আজকে অফিসের পড়ে চলে যাবেন না যেন ! ওকে?
-কেন ? কোন কাজ আছে?
-হ্যা । আজকে আপনাকে ডিনার করাবো !
-হঠাৎ ?
-আপনার এটা পাও্না । আপনি না থাকলে ট্যুরে যে আমার কপালে কী হত কে জানে !

আমি হাসলাম । তারপর বললাম, এরকম প্রায়ই হয় । সো মেনশন নট !
-না না । না করবেন না প্লিজ । আজকে অফিসের পরে ডিনার আমার সাথে । ওকে?

আমার আর মানা করলাম না । নীরা হাসি মুখে চলে গেল । আমি নিজের ডেস্কে বসে কাজ করা শুরু করলাম ।

ভার্সিটি জীবন থেকেই আমার এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ানোর অভ্যাস । কর্ম ক্ষেত্রে যোগ দেওয়ার পরেও ছুটি কিংবা শুক্রশনি মিলিয়ে প্রায়ই আমি এদিক সেদিক বেরিয়ে পড়ি । নিজের ফেসবুকে সেই ছবি দেওয়ার পরে যখন পরদিন অফিসে আসি তখন কলিগরা অভিযোগের সুরে বলে যে আমি কেন তাদের কে আগে বলি নি । বললে তারাও আমার সাথে যেত । তাই এইবার যখন কির্সতং যাওয়ার সব কিছু ঠিক হল সবাইকে আগে থেকেই আমি বললাম যে সেখানে যাচ্ছি । সেই সাথে এও জানালাম যে ওখানে কী কী হবে কেমন কষ্ট হবে । প্রথমে সবাই খুব আগ্রহ দেখালো বটে কিন্তু নিজেরা যখন একটু রিসার্চ করলো তখন আর কেউ আগ্রহ দেখালো না । কিন্তু একজন রাজি হল যেতে । আমি সত্যিই খানিকটা অবাকই হলাম । তবে বুঝলাম যে নীরা যখন যাচ্ছে আমার জীবনটা প্যারাময় করে তুলবে ।

শেষ সময় পর্যন্ত আমার একটা ধারণা ছিল যে হয়তো নীরা যাবে না । তবে আমাকে অবাক করে দিয়ে সে ঠিক ঠিক ট্যুরে হাজির হয়ে গেল । এবং সত্যিই বলতে কী পুরো ট্যুরে আমার জীবনটা প্যারাময় করে তুলল । পুরো ট্যুর গ্রুপে আমাকেই সে চিনে এবং আমার সাথেই সে কাজ করে । সুতরাং আমার উপর তার অধিকার সব থেকে বেশি। পুরো ট্যুরে আমি এই জিনিসটা বুঝলাম যে নীরা খুব বেশি ডিমান্ডিং । ইফতি ভাই এটা করেন দেন ওটা এনে দেন, ভাইয়া ছবি তুলে দেন এভাবে তুলেন ওভাবে তুলেন, ভাইয়া প্লিজ একটু হেল্প করুন আরও কত কি যে !

তবে শেষ পর্যন্ত যে মেয়েটা উঠতে পারছে এটাই সব থেকে বড় কথা । পাহাড়ের চুড়ায় উঠে নীরা কেমন মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিল সামনের দিকে । প্রতিবার পাহাড়ে উঠে আমিও এমন চোখে তাকিয়ে থাকি ।
তবে একটা ব্যাপার ঘটলো যে পুরো ট্রিপে নীরার সাথে আমার সম্পর্ক আরও ভাল হয়ে গেল । এতোদিন আমরা কেবল কলিগ ছিলাম এখন সম্ভবত কলিগের থেকে বেশি কিছু হয়ে গেলাম । বিশেষ করে রাতে অনেক রাত পর্যন্ত নীরা টুকটুক করে আমার গল্প বলছিলো । ওর পরিবারের কথা বন্ধু বান্ধবের কথা জীবনে কী করেছে কী করেনি । পাহাড়ে যারা যায় ঘুমানোর জন্য আলাদা কোন ঘর দেওয়া হয় না । পুরো গ্রুপটা একটা রুমের ভেতরেই থাকে । নীরা আমার পাশেই শুয়ে ছিল । প্রথমে ওর একটু অস্বস্থি লাগছিলো বুঝতে পারছিলাম । তবে সেটা কেটেও গিয়েছিলো ।

দুই
ডিনার টেবিলে খাবারের অর্ডার দিয়ে আমরা গল্প করতে লাগলাম । তখনই খেয়াল করলাম যে নীরাকে আজকে যেন একটু বেশি সুন্দর লাগছে । অফিসে কাজ করার সময়ও তো এতো সুন্দর লাগে নি ! সম্ভবত মেকাপ করে আলাদা ভাবে ।
এখানে ডিনার করার জন্য?
নাকি আমার জন্য?
চিন্তাটা আমি মাথা থেকে বের করে দিলাম । আমার জন্য মেকাপ করার কোন মানে নেই । মেয়েরা নিজেদের জন্য মেকাপ করে । নিজেদেরকে সুন্দর দেখানোর জন্য । এটাই স্বাভাবিক .। টুকটাক গল্প করতে করতে হঠাৎ নীরা বলল, ইফতি আপনাকে কয়েকটা কথা বলার জন্য আজকে এখানে নিয়ে এসেছি ।
-জ্বী বলুন ।
-আসলে ……।

নীরা কিছু সময় থামলো । কিছু যেন ভাবছে । তারপর নীরা বলল, আসলে কিভাবে যে বলি বুঝতে পারছি না ।
-এতো ভেবে লাভ নেই । মনে যা আছে বলে ফেলুন !
নীরা একটা লম্বা দম নিল । তারপর বলল, পুরো ট্যুরে আমাকে আপনার কেমন মনে হয়েছে ?
আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না নীরার কথাটা । খানিকটা কৌতুলের চোখে তাকিয়ে রইলাম । নীরাও বুঝতে পারলো যে আমি ওর কথা ঠিক ধরতে পারি নি । নীরা বলল, মানে বলতে চাইছি যে আপনার মনে হয় নি যে আমি ডিমান্ডিং ! তাই না? অন্তত অফিসে আমি তো এমন না।

আমি একটু ভেবে বললাম, এটা সত্যিই । আপনি অফিসে এমন নন । তবে ওখানে একটু ডিমান্ডিং ছিলে।

নীরা হাসলো আবারও । তারপর বলল, সত্যিই বলতে কি আমি এমনটা ইচ্ছে করেই করেছি । মানে ইচ্ছে করে আপনাকে জ্বালিয়েছি ।
আমি সত্যিই অবাক হলাম । বিশেষ করে নীরা যখন ব্যাপারটা স্বীকার করে নিলো দেখে । বললাম, কেন জানতে পারি কি?
নীরা বলল, হ্যা এটার জন্যই আপনার সাথে আজকে কথা বলতে এসেছি ।

নীরা একটু দম নিল । তারপর বলল, আপনি তো জানেনই যে আমার বাবা নেই । আমি যখন কলেজে পড়ি তখন মারা গেছেন ।
-হ্যা আমি জানি ।
নীরার মুখটা একটু মলিন দেখলাম । তবে সেটা সে সামলে নিল । তাররপ আবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি আমার বাবার কাছে প্রিন্সেস ছিলাম । আমার যত চাহিদা সব কিছু সব সময় সে সবার আগে পূরণ করতো । একবার কী হয়েছিলো রাত তখন একটা । আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি । আমি বায়না ধরলাম যে আইসক্রিম খাবো । আম্মু তো এক ধমকে আমাকে চুপ করিয়ে দিল। তবে বাবা ঠিক সেই রাত একটা সময়েই বাইরে বের হল । আইসক্রিম নিয়ে এল । এমন করে আমার সব চাহিদা সব সময় সে পূরণ করেছে ,

এই বলে নীরা একটু থামলো । তারপর আবার বলল, বাবা মারা যাওয়ার পরে হঠাৎ আবিস্কার করলাম যে আমার জেদ রাগ চাহিদার দাম আর কারো কাছে নেই । এমন কি আমার মায়ের কাছেও না । আমি বলছি না যে আমার মা আমাকে ভালোবাসে না । কিন্তু আমার বাবার মত করে না । আস্তে আস্তে তাই নিজেকে একদম গুটিয়ে নিলাম । বুঝে গেলাম যে আমাকে আমার বাবার মত করে কেউ কেয়ার করবে না । জানেনই তো মেয়েদের জীবনের প্রথম প্রেম হয় তার বাবা । সব মেয়ের তার প্রেমিকের ভেতরে তার বাবার ছায়া দেখতে পছন্দ করবে যে তাকে প্রটেক্ট করবে, দেখে শুনে রাখবে । পরে আমি আরও একটা ছেলের সাথে সম্পর্ক করার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু তার কাছেও আসলে আমার চাহিদার খুব বেশি মূল্য ছিল না । এরপর আর সেদিকে যাই নি কোন দিন । নিজেকে লুকিয়ে রেখেছি ।

আমার আসলে কী যে বলা উচিৎ আমি নিজেই জানি না । আমি চুপ করে তাকিয়ে রইলাম নীরার দিকে । ওর চোখ দুটো কেমন যেন টলটল করে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে । এই চাহনী অবশ্যই যে কোন ছেলের ঘুম হারাম করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ঠ ।

নীরা আবার বলতে শুরু করলো, অফিসে আপনি আসার পর থেকে আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে ।
এই বলে নীরা হাসলো । লজ্জা মিশ্রিত হাসি । তারপর আবার বলল, লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে বলেই ফেললাম কথাটা । তবে পছন্দ হলেও মনের ভেতরে লুকিয়ে রেখেছিলাম । কারণটা আপনি নিশ্চিত ভাবেই বুঝতে পারছেন । কিন্তু দিন যতই যেতে লাগলো ততই মনে হল একটা কিছু না করে এভাবেই যদি বসে থাকি আমরা তাহলে তো কোন দিন আমি কাউকে কাছে পাবো না । একাই থাকতে হবে । তাই এই ব্যাপারটা দেখার জন্যই আপনার সাথে আমি ট্যুরে গিয়েছিলাম । এবং আবিস্কার করলাম যে আপনি ঠিক ঠিক আমার জন্য কেয়ার করছেন । এই যে সব কিছু সহ্য করছেন ।

আমি জানতাম এমন কিছু হতে চলেছে । নীরা বলল, সো, এখন থেকে তোমাকে ঠিক ঠিক প্যারা দিবো আমি । বারবার দিবো । তুমি যতই দুরে যেতে চাও পালিয়ে যেতে চাও আমি তোমার পিছু ছাড়ছি না ! বুঝেছো !

আমার চেহারার অবস্থা দেখেই নীরা শব্দ করে হেসে ফেলল । তারপর বলল, ভয় পেও না তো ! আমি ভাল মেয়ে ! মাঝে মধ্যে কেবল একটু আধটু ডিমান্ডিং ! আর কিছু না !

তারপর?
তারপর আর কি ! বাংলার প্রেমিকদের কপালে যা হয়ে থাকে আমার কপালেও তাই শুরু হল । সে গল্প অন্য কোন দিন !

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.7 / 5. Vote count: 76

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →