সম্মিলিত গল্পঃ রক্তযজ্ঞ

oputanvir
4.3
(48)

ঠিক যখন মনে হয়েছিলো যে আমার দ্বারা আর কোন চাকরি বাকরি পাওয়া হবে না ঠিক সেই সময়েই চাকরিটা এসে হাজির হল আমার কাছে । অনেকটা অপ্রত্যাশিত ভাবে । আমি অনেক আগেই চাকরির আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম । চাকরির পড়াশুনা করতে যে পরিমান ধৈর্য্য লাগে সেটা আমার ছিল না । আমি ব্যবসার কথা ভাবছিলাম । তবে মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেদের ব্যবসার জন্য সব থেকে দরকারী জিনিসটাই থাকে না । আমারও ছিল না । টাকার অভাবে কোন ভাল ব্যবসা যে করবো সেটাও সম্ভব হচ্ছিলো না । শেষে এমন একটা পরিস্থিতি হল  আমি ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম । ঢাকায় থাকলে সামনের কয়েক দিন পরে হয়তো আমাকে না খেয়ে থাকতে হবে ।

ঢাকার প্রতি আমার কোন কালেই কোন মায়া ছিল না । এখানে আমি এসেছিলাম কেবল পড়াশুনা করতে এবং পড়াশুনা শেষ করে একটা জীবিকার নির্বাহ করতে । এতোদিন এখানে থাকার পরেও সেই কাজের কিছুই হল না । এতোদিন টিউশনী আর কোচিংয়ে ক্লাস নিয়ে পার করেছি । করোনা শুরুর পর থেকে সেগুলো কমতে কমতে একেবারে কমে গেল । এমন একটা অবস্থা যে ঠিক ঠাক মত খেয়ে পড়ে থাকাই মুস্কিল হয়ে উঠলো । বাসা থেকে জানালো যে আমি যেন বাসায় চলে যাই । সেখানে গিয়েই কিছু করার চেষ্টা করি । আমি জানি সেখানে গেলে আমার পক্ষে কিছুই করা সম্ভব হবে না । আমার বাবা স্থানীয় একটা পোয়েল্ট্রি ফিডের ফ্যাক্টরীতে চাকরি করেন । সেটার মালিককে বলে হয়তো আমাকে সেখানে ঢুকিয়ে দিতে পারেন তিনি । আপাতত এই সম্ভবনা ছাড়া আর কিছু নেই ।

আমার যদিও এতে কোন সম্মতি ছিল না কিন্তু এছাড়া আপাতত আর কোন উপায়ও আমি দেখছিলাম না । তাই ঠিক করলাম যে গ্রামেই ফিরে যাবো । যখন মোটামুটি সিদ্ধান্ত ফাইনাল করে ফেলেছি তখনই চাকরির নিয়োগ পত্রটা এসে হাজির হল আমার কাছে । আমার প্রথমে মনেই পড়লো না যে আমি কবে এই অফিসে ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম । অবশ্য আমি অনেক কয়টা অফিসে ইন্টারভিউ দিয়েছি । কর্মক্ষেত্রের নামটা দেখার পরে আমার মনে পড়লো । প্রায় বছর খানেক আগে আমি এই অফিসে ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম । একটা এনজিও ধরনের অফিস। তারা বলেছিলো যে যদি আমার চাকরি হয় তাহলে আমার বাংলাদেশের একেবারে শেষ প্রান্তে গিয়ে কাজ করতে হবে । এনজিওটা গ্রামের মানুষদের নানান ভাবে সাহায্য সহযোগিতা করে, তাদের এবং তাদের বাচ্চাদের পড়ালেখা করায় । আমার কাজ হচ্ছে এই রকম একটা শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা । 

সত্যিই বলতে কী আমার মনে আর অন্য কোন চিন্তা এল না । আর আমি যেহেতু ঢাকা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছি তাই ঢাকার বাইরে যে কোন স্থানেই আমি গিয়ে চাকরি করতে পারি । বেতনের পরিমানটাও খারাপ না । এছাড়া যদি সব কিছু দিয়ে আমি সেখানে টিকতে না পারি তাহলে আমি তো ফিরে যেতে পারি পরিবারের কাছে । সেই পথটা তো খোলাই আছে । আর কোন চিন্তা ভাবনা না করেই পরদিনই হাজির হলাম এনজিওর অফিসে । ওরা আমাকে সব কিছু বুঝিয়ে দিল । এছাড়া এও জানালো যে এনজিওটার সে অফিসটা আছে তার সাথেই একটা ঘর আমার জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে । রান্নার জন্যও লোক আছে । সুতরাং থাকা এবং খাওয়ার জন্য আমাকে চিন্তা করতে হবে না ।

দুই

পরের কয়েকটা দিন কেটে গেলো খুব ব্যস্ততায়। অফিস থেকে যে ঠিকানা দিয়েছে সেটা অনুযায়ী আমার যেতে হবে খুলনা। মুল শহর থেকে আরও ভেতরে ঠিক সুন্দরবনের কোল ঘেষে গ্রামটা। ঢাকা থেকে ট্রেনে খুলনা পৌছুতে দুপুর  হয়ে গেলো। মুল শহর থেকে গাবুরা অব্দি যেতে প্রায় সন্ধ্যা নেমে গেলো। আজাদ নামের একজনের নম্বর দিয়েছিলো অফিস থেকে। ওকে ফোন দিয়ে আমার লোকেশন বললাম। নেটওয়ার্ক এর অবস্থা যাচ্ছে তাই রকমের খারাপ।

আজাদের সাথে হেটে যাচ্ছি। আজাদকে ভ্যান বা রিক্সা আছে নাকি জিজ্ঞাসা করতেই বলে উঠলো, রেজওয়ান ভাই, সন্ধ্যার পরে গ্রামের দিকে কোনো ভ্যান রিক্সা ঢোকে না।

গ্রামটা অনেকটা জঙ্গলের চাদরে ঘেরা। সন্ধ্যা নেমে এসেছে। গায়ের মাঝে কেমন জানি শিউরে উঠছে। কেমন জানি একটা ছমছমে পরিবেশ এদিকে। আজাদ কথা বেশ কম বলে। চোয়াল শক্ত করে শুধু হেটে যাচ্ছে। কেমন একটা ভীতিকর ভাব ওর মুখে যেনো ঘরে পৌছুতে পারলে বাঁচে।

হাটতে হাটতে গ্রামের মাঝে ঢুকে পড়েছি। এদিকে গ্রামে বাড়িঘর তুলনামূলক কম এবং বেশ ফাঁকা ফাঁকা। রাত মাত্র আটটা অথচ মানুষের কোনো সাড়াশব্দ নেই। একেবারে পিনপতন নিরবতা।

আজাদকে জিজ্ঞাসা করতেই বলল, মাস দেড়েক পরপর গ্রামে একটা করে  লাশ পাওয়া যায়। বিভৎস লাশের মাথা আর হৃদপিণ্ড থাকে না। গত ছয়মাস ধরে পুলিশ খুনি খুজে বের করতে পারে নাই। তাই চেয়ারম্যান সাহেব বলে দিছে মাগরিবের পর কারো আর বাইরে থাকা যাবে না।

কথাগুলো শুনে শরীরটা কেমন ভার হয়ে গেলো। কেমন একটা গা ঝমঝম ভাব করতে লাগলো । আমি চারিদিকে হাটতে হাটতে দেখতে থাকি চারিদিকটা । বারবার মনে হতে থাকে যে এখানে এসে আমি কী ভুল করলাম ! পরক্ষণেই মনে হল এখানে না এলে আমার গ্রামে ফিরে যেতে হবে । সেখানে আমার জন্য কী অপেক্ষা করছে সেটা আমার খুব ভাল করেই জানা আছে !

টানা দেড়ঘন্টার মত হেটে রুমে ফেরার পরে সারাদিনের ক্লান্তি যেন চোখের পাতায় ভর করলো। মনে হলো এখনই ঘুমাতে হবে না হলে আমি মারা যাবো।

ঘুম ভাঙ্গলো বেশ ভোরে। সবে ভোরের আলো ফুটছে। রাতে খেয়াল করা হয়নি রুমের বাইরেটা। অফিসের পেছনে লাগোয়া একটা রুম। বেশ বড় একটা রুম বলা চলে । আজাদ অফিস দেখাশোনা করে । ও অফিসের এক কোনায় রাতে থাকে। গ্রামে কোনো স্কুল নেই।চেয়ারম্যান সাহেবের উদ্যোগে এই এনজিওটা কয়েক বছর ধরে বাচ্চাদের শিক্ষা কার্যক্রম চালায়। আমার কাজ বাচ্চা ও বড়দের পড়ানো। সকালে বাচ্চাদের এবং বিকেলে বয়স্কদের । এছাড়া আমার আরও একটা কাজ হচ্ছে প্রতি মাসে এখানে এনজিও থেকে একটা মেডিক্যাল  কার্জক্রম চালানো হবে । সেটার সার্বিক দায়িত্ব আমাকে নিতে হবে । সব রিপোর্ট তৈরি করে ঢাকাতে পাঠাতে হবে । এছাড়া আমার আর কোন কাজ নেই । বেশ আরামের চাকরী বলা চলে । সমস্যা একটাই বিদ্যুতের লাইন থাকলেও পাঁচ ছয় ঘন্টার বেশী বিদ্যুৎ থাকে না।

আমার রুমের পেছন থেকেই জঙ্গলের পরিমানটা বেশী। কেমন যেন একটা থমথমে আবহাওয়া এই গ্রামে। নয়টা নাগাদ অফিসে গিয়ে একটু আমি থমকে গেলাম। সাদা সালোয়ার সাথে সাদা লেগিংস পরনে এত সুন্দর একটা মেয়ে এখানে কি করে! তার পাশে মুরব্বি মত একজন বসা টকটকে লাল দাড়ি একটা ছাই রঙ্গের পাঞ্জাবি পরনে। আমি দরজা দিয়ে ঢুকে সালাম দিয়ে দাড়ালাম। মুরুব্বি আমার দিকে হাত বাড়িয়ে একগাল হেসে বলল, বাবা আমি আজিজ খন্দকার, এখানকার চেয়ারম্যান। এইটা আমার মেয়ে অর্পা। ও ঢাকায় পড়ে । ছুটিতে আইসা ঘরে বসে থাকার চেয়ে তোমার সাথে একটু পড়ালে সময় চলে যাবে তাই নিয়ে আসলাম। সমস্যা নাই তো তোমার?

আমি  মুচকি হেসে বললাম, না না চাচা সমস্যা নাই, আমারও চাপ কমবে যদি একজন থাকে।

আরও কিছুক্ষন গল্প করে অর্পা আর চেয়ারম্যান সাহেব চলে গেলো। ভাবলাম সময়টা এখানে খুব একটা খারাপ যাবে না। পরদিন থেকে কাজ কর্ম শুরু হয়ে গেল।

দিনগুলো বেশ ভালই যাচ্ছিলো সকাল থেকে পড়ানো, মাঝে মাঝে বিকেলে অর্পার সাথে ঘুড়ে বেড়ানো গ্রামের এদিক সেদিক। কিন্তু সন্ধ্যার পরে পুরো গ্রামটা হয়ে যেত শ্মশান। আজাদের মুখে শোনা লাশের কথা মনে হতেই গায়ের লোম গুলো দাড়িয়ে যেত। আগের খুন গুলোর সময়ের হিসাব করলে আর হয়তো কিছুদিনের মাঝেই হয়তো আরেকটা খুন হবে।

সমস্যা শুরু হলো আরও কদিন পরে। জানালা খুলে শুয়ে আছি বেশ সুন্দর চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় জানালা দিয়ে জঙ্গলটা বেশ সুন্দর লাগছে। মাঝরাতের দিকে অদ্ভুত এক গোঙ্গানির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। জঙ্গল থেকে কেউ খুব ব্যাথায় গোঙ্গাচ্ছে সাথে খশখশ একটা শব্দ। জানালা দিয়ে কিছু দেখা যাচ্ছে না। পুরো গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে। সাহস করে উঠে যাবো ভাবছি এমন সময় আমার জানালার পাশ দিয়ে একটা ছায়া হুট করে জঙ্গলের ভেতরে চলে গেলো। কাঠ হয়ে জানালা দিয়ে তাকিয়ে বসে থাকলাম আমি।

তিন

আমার একবার মনে হল যেন আমি ভুল দেখলাম । তবে আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকানোর সাথে সাথে সেই গোঙ্গানীর মত আওয়াজটা বন্ধ হয়ে গেল । আমি কিছু সময় সেই দিকে তাকিয়ে রইলাম !

ঢাকাতে আমার রাত জেগে থাকার অভ্যাস ছিল । এখানে এসে সেই অভ্যাসটা তখনও যায় নি । তাই রাতে ঘুম আসতে আমার একটু দেরি হয় । একটু আগেই আমি ঘুমিয়েছিলাম আর এখন ঘুম ভেঙ্গে গেল আওয়াজ শুনে । আমি কান পেতে রইলাম আওয়াজটা শোনার জন্য ! এছাড়া মনের ভেতরে কেমন একটা ভয়ও করতে লাগলো । জানালাটা আমি বন্ধ করে দিলাম ! আবারও বিছানাতে শুয়ে পড়লাম । যদিও জানি যে কাঁচা ঘুম ভেঙ্গেছে । সহজে এখন আর ঘুম আসবে না !

রাত জেগে আমি বেশির সময়ে বই পড়ি । বই কিংবা মোবাইলে গান শুনি । এখানে বিদ্যুতের একটু সমস্যা রয়েছে । তবে অফিসে আমার জন্য আলাদা ভাবে একটা সোলার এনার্জি বসানো হয়েছে । এর আগের অফিসারের বেশিভাগই নাকি চলে গেছে এই বিদ্যুৎ সমস্যার কারণে । হেড অফিসের অবস্থা দেখে বুঝলাম যে তারা আমাকে এখানে রাখতে আগ্রহী । তাই যথা সম্ভব আমাকে সুযোগ সুবিধা দিতে চাচ্ছে । এখানে আসার পরদিনই হেড অফিস থেকে ফোন করে আমার খোজ খবর নিয়েছে তারা । বিদ্যুতের সমস্যাটার কথা বলতেই তিন দিনের মাথায় সোলারপ্যানেল বসে গেছে । সেই সাথে আমাকে জানানো হয়েছে যে মাস খানেকের ভেতরে আমার জন্য আলাদা একটা জেনারেটরের ব্যবস্থা করা হবে । এছাড়া সময় কাটানোর জন্য অফিস থেকে বেশ বই পাঠানো হয়েছে । আরও বলা হয়েছে যে পছন্দের বইয়ের নাম যেন তাদের জানানো হয় তাহলে সেই বই গুলো এখানে পাঠানো হবে ।

আমি জানালোর পাশ দিয়ে চলে যাওয়া অন্ধকার ছায়ার কথা মনে করতে লাগলাম ! আমার কেবল ষ্পষ্ট মনে হল যে একটা ছায়াকে আমি জঙ্গলের দিকে যেতে দেখেছি । এই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই । ঘুম ঘুম চোখ ছিল বটে তবে আমি কোন ভুল দেখি নি !

কোন বানর কিংবা হুনুমান কি চলে গেল ?

কিংবা কোন বন্য প্রাণী ?

দিনের বেলাতে আমি কোন প্রাণীকে আমার বাসার আশে পাশে আসতে দেখি নি । তবে পাখি আছে প্রচুর । এছাড়া রাতের বেলা আমি ডাক শুনি অনেক কিছুর । একদিন সম্ভবত বাঘের ডাক শুনেছিলাম ! আরও নানান আওয়াজ শুনতে পাই রাতের বেলা । সত্যি বলতে কি এই সময়ে আমি যেন ঘোরের ভেতরে চলে যাই । বারবার মনে হয় যে আমি গল্পের চরিত্রের ভেতরে ঢুকে পড়েছি । বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরণ্যক বইটার কথা ইদানীং খুব বেশি মনে পড়ে । আমার নিজেকে সেই বইয়ের চরিত্র মনে হয় !

যখন আমি শুয়ে শুয়ে এমন সুখের কল্পনা করছি তখনই আবারও সেই গোঙ্গানীর মত আওয়াজটা শুরু হল । আমার মনে হল যে আওয়াজটা আমার ঘরের খুব কাজ থেকে আসছে । মানুষের মত আওয়াজ আবার মানুষের মতও নয় । আমি মনের ভেতরে কু ডেকে উঠলো । কয়েকবার মনে হল যে টর্চটা নিয়ে আমি বাইরে বের হয়ে দেখি কোথা হতে আসছে আওয়াজটা কিন্তু আজাদের সাবধানী বানী মনে পড়লো। সামনের সপ্তাহটা যেন আমি কোন ভাবেই রাতের বেলা ঘর থেকে বের না হই । খুব জলদিই আরেকটা খুন হতে যাচ্ছে । আমি কোন ভাবেই সেই তালিকাতে পড়তে চাই না । তাই কোন ভাবেই বাইরে বের হওয়া যাবে না ।

আমি মোবাইলে হেড ফোন লাগিয়ে গান শুনতে শুরু করলাম । অন্য কোন আওয়াজ আমি এখন শুনতে চাই না । কখন যে আমার ঘুম চলে এল আমি নিজেও বলতে পারবো না ! 

চার

পরদিন সকালে আবার সব কিছু স্বাভাবিক । রাতে যে আমি কিছু একটা দেখে ভয় পেয়েছিলাম সেটা যেন আমার মনেই রইলো না । সকালের নাস্তা শেষ করতে না করতেই দেখলাম যে অফিসের সামনে একটা গাড়ি এসে থামলো । আজাদকে দেখলাম গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে । গাড়ি থেকে সাদা এপ্রোন পরা একটা মেয়েকে নামতে দেখলাম । মেয়েটার পরনে নীল রংয়ের সেলোয়ার কামিজ । তার উপরে ডাক্তারী এপ্রোন ।

প্রতিমাস একবার এখানে একটা মেডিক্যাল ক্যাম্প বসে । খুলনা শহর থেকে একজন ডাক্তার আছেন । এই গ্রাম এবং এই গ্রামের আশে পাশের মানুষজন সেদিন এই এনজিওতে আসে চিকিৎসা নিতে । আমি অফিসের একটা আলমারিতে বেশ ভাল পরিমানের ঔষধ পত্র দেখেছি । সেখান থেকেই জানি ।

আমাকে দেখে ডাক্তার মেয়েটি এগিয়ে এল । তারপর বলল, আপনি নতুন অফিসার ?

আমি একটু হাসলাম ।

মেয়েটি বলল, আপনাকে নিয়ে মোট ৮ জন অফিসরের সাথে পরিচয় হল আমার । আপনি কতদিন টিকবেন কে জানে?

আমি একটু হেসে বললাম, নাহ ! আমি এতো সহজে যাচ্ছি না ।

-সবাই এমনটাই বলে । কিন্তু টিকে না বেশি দিন ।

-আমার যদি খানা পিনা আর গল্পের বই থাকে তাহলে আমি হিমালয়েও গিয়ে থাকতে রাজি আছি ।

-তাই বুঝি !

আর কথা বার্তা হল না । দেখতে পেলাম আজাদ ইতিমধ্যে ব্যানার টাঙ্গিয়ে ফেলেছে । ডাক্তার মেয়েটি সেদিকে যাচ্ছিলো আমি তখন বললাম, আপনার নাম জানা হল না ?

-আমার নাম রিনি আহমেদ ।

-আপনার সাথে পরিচয় হয়ে ভাল লাগলো মিস রিনি ।

তারপর আমি নিজের নাম বললাম । রিনিও হেসে প্রতি উত্তর করলো । তারপর সে নিজের কাজে চলে গেল । আমিও আমার ক্লাস রুমের দিকে চললাম । ইতিমধ্যে ছেলে মেয়েরা আসতে শুরু করেছে । কিছু সময় পরেই দেখলাম অর্পা এসে হাজির হল ।

আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো । কিন্তু অর্পার হাসি মিলিয়ে গেল যখন ওর চোখ পড়লো মেডিক্যাল ক্যাম্পের দিকে । অর্পার চেহারার এই পরিবর্তন আমার মোটেই চোখ এড়ালো না । একটু অবাক না হয়ে পারলাম না ।

রিনি নামের মেয়েটার কথা বার্তা শুনে মনে হল যে গ্রামে সে বেশ কিছু সময় ধরে আসছে । তার নামে অর্পা তাকে চেনে । এদের ভেতরে কি কোন ঝামেলা আছে ?

থাকতে পারে !

আমি চিন্তাটা মাথা থেকে দুর করে দিলাম । তারপর পড়ানোর দায়িত্ব অর্পার হাতে দিয়ে আমি ক্যাম্পের দিকে গেলাম সেখানে কি হচ্ছে দেখার জন্য ।

ইতিমধ্যে বেশ কিছু লোক চলে এসেছে । রিনি তাদেরকে দেখছে । আজাদ সাহায্য করছে তাকে । অফিস থেকে ঔষধের সেই আলমারিটা সে বাইরে নিয়ে সেট করেছে । রিনির পরামর্শ মোটাবেগ ঔষধ দিচ্ছে ! 

ডাক্তার রিনি দুপুরের কিছু পরেই চলে গেল । দিন টা বেশ ভালই গেল বলতে গেলে । তবে আমার চোখের সামনে সেই সকালের দৃশ্যটা ভাসতে লাগলো । রিনিকে দেখে অর্পার চোখে ওমন জ্বলে উঠেছিল কেন হঠাৎ করে !

বিশেষ কোন কারণ আছে কী !   

পাঁচ

মাগরিবের নামাজ শেষ করে একটা গল্পের বই পড়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু পড়াতেও মনযোগ দিতে পারছি না। জীবনে যত বই পড়েছি তার বেশির ভাগ ই ছিলো রহস্য বই। এজন্য মনের মাঝে বিভিন্ন ধরনের চিন্তা ভাবনা আসছে। কালকে রাতের বিষয়টাও মাথায় আসছে। কোন ভাবেই মনকে শান্ত করতে পারছি না। মনের মাঝে যে প্রশ্নগুলো আছে যার কোন উত্তর তো আমার কাছে নেই। আজাদের থেকে বেশ কিছু জিনিস জেনে নিতে হবে। তাই আজাদকে একটা ফোন দিয়ে আসতে বললাম।

একটু পর আজাদ চলে আসলো । আজাদ এসেই জিজ্ঞাসা করলো, স্যার কিছু হয়েছে নাকি? ভয় পাইছেন আপনি?

রাতের বেলা আজাদকে ফোন করে আসতে বলায় সে মনে হয়ে হয় ভাবছে আমি ভয়ে পেয়ে আসতে বলছি। আজাদকে শান্ত হতে বললাম। তারপর তাকে কালকে রাতের ঘটনা পুরোটা বললাম। সব কিছু শোনার পর আজাদ কিছুটা বিচলিত হয়ে বলে উঠলো। বলল, ওর আসার সময় হয়ে গেছে স্যার। ও এবারো আরেকজনকে হত্যা করবে।

তারপর আজাদের কাছ থেকে মারা যাওয়া মানুষগুলো সম্পর্কে জেনে নিলাম কিছুটা৷ আগে যারা মারা গেছে তারা সবাই যে এই গ্রামের তা নয়। এর মাঝে একজন এনজিও কর্মী, একজন ডাক্তার আর বাকিরা এই গ্রামের লোক। তাছাড়া সবাই যে ছেলে তাও নয়। এর মাঝে মেয়েও আছে। কিছুতেই আমি হিসাব মিলাতে পারছি না। সিলিয়াল কিলিং হলে তাতে কোন না কোন সম্পর্ক থাকবে সবার মাঝে। আবার অতিপ্রাকৃত কোন ঘটনাকে আমি বিশ্বাস করি না। বই এর পাতায় অতিপ্রাকৃত ঘটনা পড়তে ভালো লাগলেও সেটার সাথে যে বাস্তবের কোন মিল যে নেই সেটা আমি ভালো ভাবেই বিশ্বাস করি।

আজাদ চলে গেলে খাবার খেয়ে আমি বিছানায় শুয়ে পড়ি। আজকে রাতে কালকের মত কোন শব্দ শুনতে পেলাম না। আবার কোন ছায়াও দেখলাম না। তাই স্বাভাবিক ভাবেই ঘুমিয়ে পড়লাম।

পর দিন ভোরে আজাদের ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙলো। দরজা খুলতেই বলে উঠলো,স্যার বলছিলাম না ও আরেকজনকে হত্যা করবে, ডাক্তার আপার লাশ পাওয়া গেছে জংগলের ভিতরে।

আজাদের কথা শুনে আমি নির্বাক হয়ে গেলাম। কালকেই তো আমি রিনির সাথে কথা বললাম। কি সুন্দর হেসে হেসে আমার সাথে কথা বললো মেয়েটা। আর আজকেই সে মেয়েটা দুনিয়াতে নেই। আজাদকে সাথে নিয়ে আমি রিনির মৃত দেহের পাশের আসলাম। পুলিশ এখনো এসে পৌছায় নি। গ্রামের কিছু লোকজন চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে। আগের লাশ গুলোর মতন এটারও মাথা আর হৃদপিণ্ড ছিলো না। আমি একপলকের বেশি তাকিয়ে দেখার সাহস পেলাম না। চলে আসলাম নিজের রুমে।

আজকে আর পড়াতে পারবো না। আজাদকে বলে রাখলাম সবাইকে যেন বলে দেয় আমি অসুস্থ। তাই আজকের মত স্কুল বন্ধ।

রুমে আসার পর বার বার রিনির কথা মনে পড়ছে। রিনিকে কেউ কেন খুন করবে? সে তো গ্রামের স্বাস্থ্যসেবা দেয় বিনামুল্যে। সবার উপকারই করে। আমি যে কালকে রাতে ভাবলাম কোন সিরিয়াল কিলারের কাজ এটা, কিন্তু কোন সিরিয়াল কিলার রিনিকে কেন মারবে? কোন ভাবেই কোন হিসাব মিলাতে পারছি না। অসুস্থতার কথা শুনে বিকেলের দিকে অর্পা আসলো আমাকে দেখতে। আমার কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করায় আমি তেমন কিছু না বলে এড়িয়ে গেলাম। তারপর অর্পার বললো, বাইরে একটু হেটে আসলে ভালো লাগবে। আমিও আর না করলাম না। এমনেও অর্পার সাথে আমার হাটতে ভালো লাগে।

অর্পার সাথে হাটছি। অর্পা কিছু দিন পর চলে যাবে ঢাকায়। ঢাকায় গিয়ে কি কি করবে সেগুলো আমাকে বলছে এক এক করে। আমিও সব শুনে যাচ্ছি। সত্যি বলতে অর্পার কথা শুনতে, ওর সাথে হাটতে এককথায় অর্পার সব কিছুই আমার ভালো লাগে। কেমন কেন একটা অদৃশ্য মাথায় আটকে যাই অর্পা সাথে থাকলে । হঠাৎ একটা জিনিস খেয়লা করলাম অর্পাদের গ্রামে আজকেও একটা লাশ পাওয়া গেছে কিন্তু সেটা নিয়ে কোন কথাই সে বললো না। তাছাড়া কালকে কথা বার্তায় মনে হয়েছিল অর্পা এবং রিনি একে অপরকে ভালো ভাবেই চিনতো। তারপরেও অর্পা কেন রিনিকে নিয়ে কোন কথা বললো না সেটা বুঝতে পারলাম না। অবশ্য আমি অসুস্থ বলে আমার সাথে ঐ বিষয়ে কথা বললো না নাকি অন্য কিছু!  

রিনির মৃত্যু আসলে আমাকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছে। তাই মনে মনে ভেবে নিলাম এ রহস্যের একটা কিনারা করবার চেষ্টা সন্তর্পণে করে যাবো আমি। আমি মৃত মানুষগুলো সম্পর্কে খোঁজ খবর শুরু করলাম, তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক, চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে তাদের কারোর ব্যক্তিগত লেনদেন বা অন্য কোন কারণে বিশেষ যোগাযোগ ছিলো কিনা তাও জানতে চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু  রিনির দিকে অর্পার ওই ভাবে তাকানোর দৃশ্য কোন ভাবেই আমার পিছু ছাড়ছিলো….বার বার ভাবছিলাম কিন্তু  কোন ভাবেই কুল কিনারা পাচ্ছিলাম না। আমার লজিক্যাল মাইন্ড কোন ভাবেই আধিভৌতিক ব্যাপার বলে বিষয় টাকে মেনে নিতে পারবে না, তা আমি যতই এই  নির্জন.. নিঃসংগ..  গ্রামীণ অন্ধকার পরিবেশে ভয় পাই না কেন!!!

ব্যাপারটাকে রাজনৈতিক কোন্দলের মধ্যে ও ফেলা যাচ্ছে না, কারন মৃত ব্যক্তিরা কেঊই একি ক্যাটাগরির নয়। নাকি এটা কোন  চোরাকারবারিদের চালাকি… নিরীহ লোকজন কে নৃশংসভাবে হত্যা করে এলাকায়  একটা ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করে, নিজেদের চলাফেরা কে নির্বিঘ্ন করার একটা অপকৌশল মাত্র।

নিজেকে বুঝালাম ধুর… আমার অত ভাবার দরকার  কি। এই পড়ো জায়গায় এসেছি একটা নিরুপদ্রব, নির্ভেজাল স্বাধীন জীবন যাপন  করবো বলেই, তাহলে কেন এই সব ঝামেলায় নিজেকে আগ বাড়িয়ে জড়াচ্ছি। আমার একমাত্র ভাবনা হতে পারে নিজেকে নিরাপদ রাখার সব রকম ব্যাবস্থা করা।

বরং আমি অর্পাকে নিয়ে ভাবতে পারি। ওর অমায়িক ব্যাবহার, মিষ্টি হাসি কিংবা আমাদের গল্প চালিয়ে যাবার যে প্রবনতা তা আমাকে অনেক সুন্দর অনুভব দেয়…. স্বপ্ন দেখার প্রেরণা যোগায়!!!

একদিন কাজের ফাঁকে গল্পচ্ছলেই এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে আলাপ তুলতে চাইলাম অর্পার সাথে। কিন্তু এই প্রসঙ্গে অর্পার শীতলতা খুব চোখে লাগে আমার। কথা বেশী দূর এগোয় না…. ভাবছি একদিন সুযোগ করে চেয়ারম্যান সাহেবের এই হত্যাকাণ্ডের সুরাহা করার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা কি তা জানার চেষ্টা করবো। পরের মাসে কোন ডাক্তার আসছেন আজাদের কাছে কোন সদুত্তর  পেলাম না…. 

ইতিমধ্যে ডাক্তার রিনি হত্যার তিন দিন পাড় হয়ে গেছে কিন্তু প্রশাসনিক কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি।

এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রশাসন, অর্পা ও গ্রামের মানুষের এরকম শীতল অবস্থান দেখে মনে মনে হতাশ ও অবাক হলাম।

পরেরদিন চেয়ারম্যানের সাথে এই ব্যাপারে কথা বলার স্বীদ্ধান্ত নিয়ে ঘুমিয়ে গেলো।

সকালে ঘুম থেকে উঠে বাইরে এসে দেখলাম অর্পা এসেছে, অর্পার সাথে কুশলাদি বিনিময় করে রেডি হয়ে বের হলাম পড়ানোর উদ্দেশ্যে। দুপুর ১২ টা নাগাদ স্কুল ছুটি দিয়ে অর্পাকে সাথে নিয়ে তাদের বাড়ির দিকে রওনা দিলাম।

বাড়িতে গিয়ে শুনলাম চেয়ারম্যান চাচা বিচারে গেছেন, ফিরতে ঘন্টাখানেক লাগতে পারে। অতঃপর অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই, কারণ আমি চাচ্ছিলাম এই ব্যাপার টা যত দ্রুত সম্ভব একটা সুরাহা করতে।

প্রায় আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করিয়ে চেয়ারম্যান চাচা আসলেন, আমাকে দেখে দুপুরে খেয়ে যাওয়ার জন্য বলে উনি ভিতরে গেলেন।  দুপুরে খাওয়ার পর গত কয়েকমাসে ঘটে যাওয়া হত্যার ব্যাপার টা নিয়ে তার কাছে জানতে চাইলে উনি এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন, যা অন্তত বিব্রতকর। এবং এসব ব্যাপারে আমাকে বেশী ভাবতে নিষেধ করে দিলেন।

উনি আমাকে আরো কিছু বলতে চাইছিলেন কিন্তু আমি কিছু না শুনেই রুমে কাজ আছে এই অজুহাতে বের হয়ে গেলাম। এবং একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে গ্রামের মানুষ ও এখানকার প্রশাসন থেকে আমি এই ব্যাপারে নির্দিষ্ট কিছু জানতে পারবো না। তাই স্বীদ্ধান্ত নিলাম এর পিছনের রহস্য আমি উদঘাটন করবো, আর আজকে রাতে যদি সেই রাতের মতো কোনো অবস্থা বা অন্যরকম কোনো কিছু ঘটে তাহলে আমিও বের হয়ে দেখবো। এগুলো ভাবতে ভাবতে নিজেকে রুমের সামনে আবিষ্কার করলাম, চিন্তায় এতটা মশগুল ছিলাম যে কখন রাস্তা শেষ হয়ে গেছে তা টেরই পাইনি।

রুমে ঢুকে বিশ্রাম নিয়ে পড়ানোর উদ্দেশ্যে বের হলাম, যথারীতি বিকেলেও অর্পার সাথে দেখা হয়ে গেলো। তবে এখন অর্পার চাহনি কেমন যেনো পরিবর্তন হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পরপরই আমার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে দেখতছে, নিছক মনের ভুল ভেবে এইসব চিন্তা মাথা থেকে নামিয়ে পড়ানোয় মনোযোগ দিলাম। মাথার ভিতর অর্পার চাহনির ব্যাপার টা বারবার চলে আসতেছিলো তাই পড়া বাদ দিয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলাম।

রাত আনুমানিক ২ টার দিকে কোনো কারণ ছাড়াই ঘুম ভেঙে গেলো। ঘুম ভাঙার কারণ খুঁজে না পেয়ে বিরক্ত হয়ে উঠতে যাবো হটাৎ করে বড় কিছু একটা অনেক উপর থেকে নিচে পড়ার শব্দ পেলাম। শব্দ টা বেশ কাছ থেকেই এসেছে, আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম কেউ জঙ্গলের ভিতর ছুটাছুটি করতেছে। এক অজানা আতংকে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো।  

ছয়

ভয় পেলেও কৌতূহল আর দমিয়ে রাখতে পারলাম না। শোয়া থেকে উঠে বসলাম। যেভাবে হোক এর শেষ দেখে ছাড়বো। ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম । কিছু দুর যাওয়ার পরেই মনে পড়লো যে টর্চ-লাইট নিয়ে আসিনি। তাই শেষ ভরসা হিসেবে মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে বের হলাম।

শব্দের উৎস বরাবর পা চালাতে লাগলাম। হাঁটতে হাঁটতে জঙ্গলের অনেকটা ভিতরে ঢুকে গেলাম কিন্তু  তেমন কিছুই চোখে পড়লো না। কোনোকিছু না দেখে হতাশ হয়ে যখনই ফিরে যাব মনস্থির করলাম তখনই মনে হলো পিছন দিকে কে যেন দৌড়ে গেল। কে? কে? বলে ডাক দিলাম কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ নাই। হঠাৎ আশেপাশে কোথাও থেকে গোঙানির আওয়াজ শুনতে পেলাম।

আওয়াজটা কোনদিক থেকে আসাতেছে বুঝার চেষ্টা করলাম। হ্যাঁ, দক্ষিণ দিক থেকে আসতেছে। আওয়াজ অনুসরণ করে পা বাড়ালাম, কয়েক কদম পা চালানোর পর ফ্লাশের অল্প আলোয় কীসের একটা অবয়ব পড়ে থাকতে দেখলাম। এবং স্পষ্ট বুঝতে পারলাম গোঙানির আওয়াজটা ওইখান থেকেই আসতেছে। সাহস করে পা চালিয়ে অবয়বটার কাছে গিয়ে ফ্লাশের আলো ফেলতেই দেখলাম একটা নারী দেহ!! অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে আর গোঙাচ্ছে।

বয়স আনুমানিক ১৬ বা ১৮ বছর হবেই।

শরীরের কয়েক জায়গায় ক্ষতচিহ্ন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

আর কোনকিছু না ভেবে কোলে তুলে নিয়ে বাসায় নিয়ে আসলাম। হাতের কাছে যা ছিল তা দিয়ে কোনোরকমে প্রাথমিক চিকিৎসা করে ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিলাম। মেয়েটা তখনো অচেতন অবস্থায় রয়েছে।

রাত তখন তিনটা বেজে ত্রিশ মিনিট।

একা কী করবো বুঝতে পারতেছিলাম না। তাই আজাদের রুমের সামনে গিয়ে তাকে ডাকতে লাগলাম।

-কে? এত রাতে কে ডাকেন?

-আমি তোমার স্যার, একটু তাড়াতাড়ি উঠো।

ঘুমঘুম চোখে আজাদ দরজা খুললো। চোখ কচলাতে কচলাতে বললো, কী হয়েছে স্যার? এত রাতে ডাকেন ক্যান?

-এত কিছু বলার সময় নেই, একটু তাড়াতাড়ি আসো আমার সাথে।

তাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সাথে করে নিয়ে আসলাম।

আমার রুমে এসে আজাদ মেয়েটাকে দেখে একটা চিৎকার দিয়ে উঠলো

-আজাদ চুপ করো, এইভাবে চিৎকার দিচ্ছো কেন?

-স্যার, মেয়েটা….কেঁপে কেঁপে আবার বললো মেয়েটা..

-কী মেয়েটা কী?

-না স্যার এই হতে পারে না।

-কী হতে পারে না আজাদ? সব ক্লিয়ার করে বলো।

না, না বলে হঠাৎ আজাদ অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলো।

এই যেন এক বিপদের উপর আরেক বিপদ। অগত্যা আজাদকে একপাশে শুয়ে দিয়ে চেয়ারে এসে বসলাম।

মাথার ভিতর নানান প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।

সবচেয়ে বেশি ভাবাচ্ছে আজাদ মেয়েটাকে দেখে এইভাবে ভয় পেলো কেন?

মেয়েটাকে কি আজাদ চিনে?

না, আর কিছু ভাবতে পারতেছি না।

আপাতত তাদের দুইজনের জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত কোনোকিছু বুঝতে পারবো না।

তাদের জ্ঞান ফিরলে সব উত্তর পাওয়া যাবে।  

পর দিন সকাল। আমরা সবাই বসে আছি চেয়ারম্যান চাচার ঘরের সামনে। অসংখ্য উৎসুক মানুষের ভীড়।

গতকাল রাতে খুঁজে পাওয়া মেয়েটা এই সিরিয়াল কিলিং এর প্রথম আসামি। না, সে খুন হয়নি। সে নিখোঁজ হয়েছিলো। তাকে গত ৬ মাসের ও বেশি সময় যাবত পুলিশ খুঁজছিল কিন্তু পাচ্ছিলেন না। তারই নিখোঁজের প্রথম দেড় মাস পর সর্বপ্রথম খুন টি হয়। এই মেয়ের নিখোঁজের পর পুরো গ্রামবাসী এবং পুলিশ মিলে অনেক খোজাখুজি করেও কোন সন্ধান বের করতে পারেনি। তার নিখোঁজের পর আরো অনেকগুলো অস্বাভাবিক মৃত্যু এবং তাদের লাশের মাথা এবং হৃৎপিণ্ড না পাওয়ায় সকলে ধরে নিয়েছিল যে এই মেয়েও ঐ একই দূর্ঘটনার স্বীকার। হঠাৎ এতদিন পর তার ফিরে আসায় পুরো গ্রামে সাড়া পড়ে গেলো। জন্মনিলো অসংখ্য প্রশ্নের। এবং এই আশাও জন্মালো যে এবার কি তাহলে শেষ হতে চলেছে এই সিরিয়াল কিলিং এর।

মেয়েটার নাম শারমিন। রাতে আজাদের কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরলে খুলনা মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে শারমিনের জ্ঞান ফিরে আসে। শারমিন খুবই ভয় পেয়ে আছে। কিছুই বলছে না। আপাতত তাকে কোন কিছু বলার জন্যে জোরাজোরি করতে নিষেধ করা হয়েছে। মেয়েটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরত এলে সব কিছুই জানা যাবে।

এই ঘটনায় আমিও এই কেসের সাথে জড়িয়ে গেলাম। সকলের নজর আমার দিকে পড়লো। পুলিশ ইতিমধ্যেই আমাকে গতকাল রাতের পুরো ঘটনা নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে গেছে।

শারমিন সুস্থ হওয়ার পর তার কাছ থেকে যা জানা গেল তা একেবারে অপ্রত্যাশিত এবং অসম্ভব। শারমিনের বয়স ১৬। সে দশম শ্রেণীর ছাত্রী। যেদিন নিখোঁজ হয় সেদিন সন্ধায় সে টিউশনি পড়ে বাড়ি ফিরছিলো। ঠিক তখনই সে খেয়াল করলো তার মাথা কেমন ঘুরাচ্ছে এবং সে তার নিজেকে একটা ঘোরের ভিতরে আছে এমন মনে করতে শুরু করলো। সেই ঘোরে থাকা অবস্থাতেই তার মনে হলো একটা উষ্ণ বাতাস তার শরীর একটু স্পর্শ করে কান ঘেঁষে চলে গেলো। সে কখন যে রাস্তা ছেড়ে রাস্তার পাশের জঙ্গলের ভিতর ঢুকে পড়েছে সে বলতে পারবে না। কিছুক্ষণ পরে সে আবিষ্কার করে সে ঘন জঙ্গলের ভিতর এসে পড়েছে। এবং এখন আর খারাপ লাগছে না। মাথা ঘুরানো নেই, ঘোরের মধ্যে থাকার ব্যাপারটাও কেটে গেছে। স্পষ্টই সবকিছু দেখতে পাচ্ছে। রাতটা ছিল পূর্ণিমা রাত। চাঁদের আলোয় অনেক ভালো ভাবেই দেখা যাচ্ছিলো চারপাশ টা। সে ভাবতে শুরু করলো কোথায় এসেছে সে। কিভাবেই বা আসলো এখানে। এখান থেকে যাবেই বা কিভাবে। এসব ভাবতেই ভাবতেই হঠাৎ সে দেখতে পেলো খট করে একটা গাছের ঢাল ভেঙে পড়লো। শব্দটা শুনেই সে ভয় পেয়ে গেলো। এবং তৎক্ষনাৎ ই সব কিছু অন্ধকার হয়ে গেলো। চাঁদের আলো চলে গেলো ঘুটঘুটে অন্ধকার। এই অন্ধকারের মাঝেই চারপাশে এসে দাড়িয়েছে কিছু অবয়ব। পুরো শরীর ছায়ার মত। এই দৃশ্য দেখে শারমিন প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলো। ভয়ে তার হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে আসবে এমন অবস্থা। তখনই সে জ্ঞান হারালো। তার যখন জ্ঞান ফিরে তখন সে খুলনা মেডিকেল হাস্পাতালে।

এই শেষের কথাটা শোনার জন্যে কেউই প্রস্তুত ছিল না। এ কি করে সম্ভব। শারমিন ৬ মাসেরও বেশি সময় নিখোঁজ। এই ৬ মাস কি সে তাহলে অজ্ঞান অবস্থায় ছিল। ৬ মাস কিভাবে তার কাছে এক রাতের মত মনে হলো। নাকি এর মধ্যখানের ঘটনা সে ভুলে গেছে। কোনভাবেই কিছু মিলাতে পারছিলাম না। সবকিছু কেমন অবাস্তব ঠেকতে শুরু করলো।

এই ঘটনা ছড়িয়ে যাওয়ার পরে এক প্রকার থমথমে পরিবেশ সৃষ্টি হয় গ্রামে। লোকমুখে ঘটনা ছড়িয়ে যাচ্ছে আর আসল ঘটনার আদলে লোকমুখে তৈরি হচ্ছে নানা রকম কাহিনী। আর এই ঘটনায় আমার এমন সম্পৃক্ততা আমার প্রতি মানুষকে কৌতূহলী করে তোলে। এই থমথমে পরিবেশের কারণে স্কুল কিছুদিনের জন্য বন্ধ দেওয়া হয়েছে। আপাতত সেজন্যে আমার কোন কাজ নেই। তাই সারাদিন একপ্রকার শুয়ে বসে কাটিয়ে দিচ্ছি। আর বিকেলে বাইরে থেকে একটু এদিক সেদিক ঘুরে আসা হচ্ছে। এরই মধ্যে একদিন রাতে শুয়ে বই পড়ছি। সারাদিন বেশিরভাগ সময় শুয়ে থাকার কারণে ঘুমও আসছিল না। এমন সময় ঠিক সেই আগের মতই জানালার সেই শব্দ। খচ খচ একটা শব্দ আসছে পাশের সেই জংগল থেকে। মনে হচ্ছে কেউ খুব সন্তর্পণে হাটছে। আমি জানালা দিয়ে চাইলাম কিন্তু কিছু দেখা যাচ্ছে। শব্দটা থেমে গেল। আমি ভাবছি টর্চ নিয়ে কি আবারো যাবো। গিয়ে কি আবারো কাউকে পাবো নাকি এবার নিজেই ভিক্টিম হয়ে যাবো। এইসব যখন চিন্তা করছি। ঠিক তখনই দরজায় কেউ কড়া নাড়লো। ভাবলাম আজাদ সম্ভবত। সেই সম্ভবত শব্দ শুনতে পেয়েছে। কিন্তু না। দরজা খুলে আমি কিছুটা বিস্মিত হলাম। দরজায় দাঁড়িয়ে শারমিন। সে একাই এসেছে। তার সাথে কেউ নেই। আমি অবাক জিজ্ঞেস করলাম,

-শারমিন এত রাতে তুমি একা এখানে কি করছো?

-আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই।

-হ্যাঁ অবশ্যই বলবে। কি ব্যাপারে?

-আমার নিখোঁজ হওয়া নিয়ে। আমি আসলে সেদিন সব কিছু সত্যি বলি নি !

আমার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো। আমি ওকে ভিতরে এসে বসতে বললাম এবং তারপর সে আমাকে যা বললো তা আমার এই ছোট্ট জীবনের শুনা সবচে অদ্ভুত কান্ড।……….   

শারমিনের সাথে আমার কথপোকথন গুলো আমি হুবহু বলার চেষ্টা করছি “সেদিন সন্ধ্যার পরে আমি প্রাইভেট পড়ে বাসায় ফিরছিলাম।হঠাৎ করেই এনজিও-র অফিস টা পার হবার সময় আমি জঙ্গলের ভেতরে কেমন অদ্ভুত কিছু শব্দ শুনতে পাই। আমার মনে কৌতুহল জন্মে। সন্ধ্যা হয়ে গেছিলো বলে মনে হালকা ভয়ও কাজ করছিল। তাই আমি না থেমে সামনের দিকে হাটতে শুরু করি। একটু পরে আবার কেমন যেন অদ্ভুত একটা গোঙ্গানি মতো শব্দ শুনতে পায়। কিন্তু গোঙ্গানির শব্দটা কেন যেন আমার কাছে অদ্ভুত বলে মনে হচ্ছিলো। “

-কেন?

-সত্যি বলতে গোঙ্গানি টা ঠিক মানুষের মত মনে হচ্ছিল না।

-এরপর?

-আমার প্রাইভেট থেকে বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হতো বলে আমি সবসময় নিজের কাছে একটা টর্চ লাইট রাখতাম।

আমি নিজের কৌতুহল দমন করতে না পেরে লাইট টা নিয়ে আমি জঙ্গলের দিকে যেতে থাকি। কিছুদূর যাওয়ার পরেই  হঠাৎ করেই কোথা থেকে যেন প্রচন্ড ধোঁয়া আসতে শুরু করে। ধোঁয়ার ভেতরে যাওয়ার পর থেকেই আমার কেমন যেন মাথা ঘুরাতে শুরু করে। চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করি। তবুও আমি টর্চ হাতে সামনে এগুতে থাকি। কিছুদূর যাওয়ার পরে আমি হঠাৎ করেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।”

শারমিন ভয়ে কেমন যেন কুড়কে যাচ্ছিল কথা গুলো বলার সময়। ভয়ে বেচারির চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে। সত্যি বলতে আমি কৌতূহলী হয়ে আছি। কিন্তু মনে মনে আমিও একটু একটু ভয় পাচ্ছি। শারমিনকে এবার আমি এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলাম। শারমিন এক ঢোকে পানিটা শেষ করলো।

-এখন বলো এরপর কি হলো।

-এর কতক্ষণ পরে আমার জ্ঞান ফিরেছে আমি ঠিক বলতে পারব না। জ্ঞান ফিরতেই দেখি আমার হাত পা বাঁধা। আমার আশেপাশে কিছু কালো পোষাক পরা মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে। যাদের পোশাক ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছিল আমার সামনে কোনো আত্মা উড়ে বেড়াচ্ছিলো। চারিদিকে কেমন যেন শব্দ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল হাজার হাজার মানুষ যেন একসাথে কোনো মন্ত্র পড়ছিলো। মনে হচ্ছিলো তারা যেন একসাথে কোনো প্রভুকে স্মরণ করছে। আর মন্ত্র পড়া শুরু হতেই এই কালো পোশাকে থাকা জীব গুলো কেমন যেন ঢুলতে শুরু করে। শুধু তাদের মাঝে একজন ছিল যে একটা বড় রাজার আসনের মতো দেখতে সিংহাসনের সামনে হাটু গেড়ে বসে ছিল।”

ঠিক সেই মুহুর্তে আমার ঘরের পাশ দিয়ে কোনো একটা ছায়ামূর্তি যেন দৌড়ে এনজিও অফিসের দিকে চলে গেলো। শারমিন যে শব্দটা শুনে অনেক ভয় পেয়েছে ব্যাপার টা ওর চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আমি শারমিনকে বললাম, তুমি বসো আমি আজাদকে ডেকে নিয়ে আসি। আজাদের কথা শুনে শারমিনের মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

শারমিন উঠে চলে যেতে চাইলো। বললো, এত রাতে আসাটা আমার বোধহয় ঠিক হয়নি। আমি কাল সকালে আসব। আমি শারমিনকে কিছু বললাম না, সত্যি বলতে বলতে পারলাম না। আমি শুধু শারমিনের মুখের পরিবর্তন টা দেখছি। শারমিন নিজেই দরজা খুলে এই গভীর রাতে একাই তার বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেল। আমার চোখে শুধু আজাদের কথা শুনে শারমিনের মুখের পরিবর্তন টা ভাসছে। হঠাৎ করেই মনে পড়লো  সেদিন রিনিকে দেখেও অর্পার চেহারা কেমন যেন বদলে গেছিলো। আচ্ছা রিনি বা আজাদ এদের কারও কি এই খুন গুলোর সাথে কোনো সম্পর্ক আছে? যেভাবেই হোক কাল শারমিনের কাছ থেকে পুরো ঘটনা টা জানতে হবে। আমি জানি এখন আর আমার ঘুম আসবে না। তবুও গা টা এলিয়ে দিলাম বিছানায়।   

সাত

আজকে রাতে বোধহয় আমার ঘুমানো হবে না। যে করেই হোক এই রহস্যের সমাধান করতেই হবে। কিন্তু তার জন্য আমাকে কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। শারমিনকে সবাই সন্দেহ করছে, শারমিন কেন খুন করতে যাবে? যদি খুন করেই থাকে তাহলে ওকে এমনভাবে ক্ষতবিক্ষত করেছে কে? তাহলে খুন করছে কে? আজাদ? যদি আজাদ খুন করে থাকে তাহলে সে শারমিনকে দেখে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো কেন? তার তো শারমিনকে দেখে ভয় পাওয়ার কথা না। আর তাছাড়া আজাদের কথা বলতেই শারমিনের চেহারা অমন ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিলো কেন? কোনো কিছুতেই যেন কিছু মিলছে না। আচ্ছা শারমিন যদি ভিক্টিম হয় তাহলে ওকে ৬মাস ধরে কেন জীবিত রাখা হলো? কেন ওকে মেরে ফেলা হয়নি?

এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছিলাম টেরই পাইনি। সকালে আজাদের ডাকে ঘুম ভাঙ্গে। আজাদ নাস্তা নিয়ে এসেছে।

-স্যার নাস্তা করে নেন।

-চা, এনেছেন? চা খেতে হবে। মাথাটা খুব ধরেছে।

-আপনি নাস্তা করে নিন, আমি চা নিয়ে আসছি।

নাস্তা শেষ করে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আজাদকে বললাম আপনার সাথে আমার কথা আছে।

-কি ব্যাপার স্যার?

-শারমিনের বিষয়ে, ওর পরিচয় কি, বাবা-মা কি করে এসব জানতে চাচ্ছি।

-স্যার ওর বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই। সড়ক দুর্ঘটনায় দু’জনেই মারা গেছে। ও এখন ওর দাদা-দাদির কাছে আছে।

-এত ছোট একটা মেয়েকে খুনের আসামী করা হয়েছে কেন? কেউ তো ওকে খুন করতে দেখেনি, তাছাড়া ও নিখোজ হওয়ার ৬ মাস পর প্রথম খুন হয়েছিলো।

-স্যার ওর বাবা মা মারা যাওয়ার পর সে সবসময় তাদের কবরের কাছে বসে থাকতো। অস্বাভাবিক আচরণ করতো। কেউ তার বাবা-মায়ের কবরের কাছে যেতে চাইলে ও দা নিয়ে তাড়া করতো আর বলতো আমি তোদের হৃদপিণ্ড ছিড়ে খাবো, মাথা শকুনকে খাওয়াবো। আমাকেও একবার তাড়া করেছিলো। স্যার আপনি বিশ্বাস করবেন না, ওর সাথে অশরীরি আত্মা আছে। নিখোজ হওয়ার আগে মাঝে মধ্যে সে কবরস্থানের পাশে ওই পোড়াবাড়িতে গিয়ে থাকতো।

আজাদের কাছে এসব শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম। আমি তাকে গতকাল রাতের ঘটনা বললাম, যে শারমিন এসেছিলো আমার কাছে।

আজাদ খানিকটা আতংকিত হয়ে বললো, স্যার বলেছিলাম না ওর সাথে অশরীরি আত্মা থাকে? নাহলে সে দুইবার হাসপাতাল থেকে পালিয়ে আসে কিভাবে? একবার পালাতে চেয়েছিলো, আমি ধরিয়ে দিয়েছে, পরেরবার পুলিশ তাকে ধরেছে। পালিয়ে সে তাহলে আপনার কাছে এসেছে?

আমি ভাবলাম আরেহ ওর যে পুলিশ কাস্টাডিতে থাকার কথা সেটা তো আমি একেবারেই ভুলে গেছি। এখন বুঝতে পারছি কাল রাতে আজাদের কথা শুনে ওর চেহারা কেন ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিলো। তাছাড়া পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালাতে অশরীরি আত্মার সাহায্যর প্রয়োজন নেই। শারমিনকে নিশ্চয়ই কেউ ব্যবহার করছে, ওকে আপাতত আমার সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দিতে হচ্ছে।

যে করেই হোক আমাকে এই রহস্য ভেদ করতে হবে। আমি অফিসের ভেতর ঢুকলাম। উদ্দেশ্য পুরনো ফাইল ঘেটে যারা এনজিওর চাকুরী ছেড়ে দিয়েছিলো তাদের সাথে কথা বলা। কেন তারা চাকুরী ছেড়ে দিয়েছিলো সেটা জানতে হবে।

দুজনকে পাইনি, তাদের ফোন বন্ধ ছিলো বাকি সবার কাছ থেকে একই উত্তর পেলাম। সকলেই প্রতি রাতে গোঙানির শব্দ পেত, রাতে বের হলে একটা ছায়া তাদের ফলো করতো। বেশিরভাগ  সময় তারা সকলেই অসুস্থ ছিল। কিছু একটা হচ্ছে, আমি সেটা আন্দাজ করতে পারছিলাম। যে এনজিও কর্মী খুন হয়েছে তার পরিবারের সাথে কথা বলতে হবে, হয়তো কিছু না কিছু পেয়ে যাবো।

ফোনে ওনার স্ত্রীর সাথে কথা বলে আমার সন্দেহ আরো পাকাপোক্ত হয়ে গিয়েছে। ওনার স্ত্রীর ভাষ্য মতে উনিও প্রতি  রাতে গোঙানির শব্দ শুনতেন। রাতে মনে হতো একটা ছায়া চারপাশে ঘুরছে। যে রাতে তিনি খুন হন তার আগের রাতে তার স্ত্রীকে সেই পোড়া বাড়ির কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন এখানে কিছু একটা হচ্ছে, আমি আজকে ভেতরে ঢুকতে পারিনি, ভেতরে প্রবেশ করতে পারলে বুঝতাম কি হচ্ছে।

ওনার স্ত্রী ওনাকে নিষেধ করেছিলেন ভেতরে ঢুকতে, বলেছিলেন যেন চাকুরী ছেড়ে এখুনি বাড়ি চলে আসতে।স্ত্রীকে তিনি কথা দিয়েছিলেন তিনি সেখানে যাবেন না। কে জানে,হয়তো কৌতুহলী মনকে পরাজিত করতে সেই পোড়াবাড়িতে গিয়ে মৃত্যুর কাছে পরাজিত হয়েছেন।।আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না যে কোনো একটা চক্র চাচ্ছে না এই গ্রামে এনজিও থাকুক। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না এখানে এনজিও থাকলে কার অসুবিধা হচ্ছে! কারো সাথে কথা বলতে হবে। কার সাথে কথা বলবো? চেয়ারম্যান? কিন্তু ওনার সাথে এটা নিয়ে কথা বলে লাভ হবে না। আচ্ছা এটা নিয়ে পরে ভাবতে পারবো। আপাতত একটু হাসপাতালে যেতে হবে, শারমিনের সাথে কথা বলতে হবে।

আট

নাহ, কাজ হলো না। পুলিশ শারমিনের সাথে দেখ করতে দিচ্ছে না। আমি আবার অফিসে ফিরে আসলাম। এনজিওর কাজ করতে এসে যে দুজন ডাক্তার মারা গিয়েছেন তাদের পরিবারের সাথে কথা বলতে হবে। দেখি কোন ক্লু পাওয়া যায় কিনা। তাছাড়া গ্রামের যে মানুষগুলো মারা গিয়েছে তাদের পরিবারের সাথেও কথা বলতে হবে। যে বা যারা খুন করেছে, এনজিও সরানোই যদি তাদের উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তাহলে গ্রামের নিরীহ মানুষদের খুন করছে কেন? শুধুই কি খুনের উদ্দেশ্যকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য?

বিকেলে আজাদ এসে হাজির। বললাম চলেন একটা জায়গায় যাবো। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কোথায়?

বললাম পোড়া বাড়ির দিকে।

আজাদ বললো, না স্যার ওখানে যাবেন না, আপনার ক্ষতি হয়ে যাবে।

আমি বিড়বিড় করে বললাম, এখন এলাকায় পুলিশ আছে, তোমার পোড়া বাড়িতে কেউ থাকবে না।

সে বলল, কিছু বলছেন?

আমি বললাম, তুমি যাবে আমার সাথে? গেলে চল, নাহয় আমি একাই চললাম।

বাড়িটা অনেক পুরোনো। ইটগুলো খসে পড়ছে। দেয়ালে পরগাছার রাজত্ব।

আজাদ আমাকে বললো, স্যার চলেন এবার।

আমি বললাম, এতদূর চলে এসেছি আর ভিতরে ঢুকবো না তা কি করে হয়!

তুমি চাইলে এখানেই অপেক্ষা কর,আমি আসছি।

ভেতরে প্রবেশ করেই বুঝতে পারলাম এখানে অনেকের যাতায়াত আছে, সিগারেটের প্যাকেট পড়ে আছে একপাশে। পোড়া ফয়েল পেপারও দেখতে পেলাম একপাশে। আমি সিড়ি ভেঙে দোতলার রুমে গেলাম, রুমের ঠিক মাঝে কিছু পোড়া কাঠ আর ছাই পড়েছিল তারপাশে মানুষের কিছু হাড়। রুমের একপাশে পুরোনো-ময়লা একটা বড় সোফা। দেয়ালের একপাশে একটা পুতুলকে পেরেক মেরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। ফ্লোরে বিচ্ছিন্ন একটা ইট দেখতে পেলাম। সেটা উঠাতেই তার নিচে ভাজ করা কাগজ দেখতে পেলাম। কাগজে কিছু সংকেত লিখা ছিল এবং যারা এনজিওতে কাজ করে গিয়েছে তাদের নাম লিখা ছিল।বুঝতে পারলাম ব্ল্যাক ম্যাজিকের জন্য সমস্ত এনজিওকর্মী অসুস্থ থাকতো। দড়ি থেকে পুতুলটা হাতে নিয়ে সোফায় বসে পড়লাম। পকেট থেকে ম্যাচ বের করে পুতুলটায় আগুন ধরিয়ে দিলাম। ভাজ করা কাগজগুলি আগুনের মধ্যে ফেলে দিয়ে একটা সিগারেট ধরালাম।

নিচে এসে আজাদকে বললাম, চল, এবার যাওয়া যাক।

আজাদ জিজ্ঞেস করলো, কিছু পেলেন স্যার?

-না, তেমন কিছু না। আচ্ছা তুমি একটা কাজ কর, গ্রামের মানুষ যারা খুন হয়েছে আমাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে চল, তাদের পরিবারের সাথে কথা বলতে হবে।

আজাদ জিজ্ঞেস করলো, এখন যাবেন স্যার?

-না,আজকে যাবো না। আমার অর্পার সাথে একটু কথা আছে। চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ি যেতে হবে।

অফিসের কাছে আসতেই দেখলাম অর্পা আমার জন্য অপেক্ষা করছে। ভাবলাম, থাক বাঁচা গেলো এখন আর চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়িতে যাওয়ার হ্যাপা পোহাতে হবে না।

অর্পার কাছে আসতেই দেখলাম ওর চুলগুলো খোলা। বিকেলের হেলে পরা লাল টুকটুক সূর্যের আলোর ছোয়ায় ওকে মনে হচ্ছিল যেন আকাশ থেকে নেমে আসা লাল টুকটুকে একটা অপ্সরী।

আমাকে দেখেই অর্পা বললো, কোথায় ছিলেন?

-আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমার জন্য অপেক্ষা করছো কেন?

ও বললো, আমার মনটা ভালো নেই, চলেন আপনার সাথে একটু নদীর পাড়ে হাটবো।

কখন যে সময় চলে গেল বুঝতেই পারিনি, অর্পার সাথে থাকলে মনে হয় সময় যেন রকেটের গতিতে ছুটছে। এই এনজিওর কারণে যে কাদের ক্ষতি হচ্ছে সেটা নিয়ে কথা বলতেই ভুলে গেছি। ওর বাবার কোন শত্রু আছে কিনা সেটাও দেখতে হবে। যাইহোক আজকে অনেক ধকল গেল এখন আর এসব ভাবতে ইচ্ছে করছে না। আপাতত ঘুমাতে হবে,সকালে উঠে ঠিক করবো কি করবো। 

নয়

হাহহহহহহহ। বুকটা হাপড়ের মত ওঠানামা করছে। গায়ে থাকা গেঞ্জিটা ভিজে চুপচুপে। ভয়ানক একটা দুঃস্বপ্ন। আমি দৌড়াচ্ছি। আমার আশেপাশে কেউ নেই। শূন্য প্রান্তর। দূরে একটা ন্যাড়া গাছ। আমি পাগলের মত দৌড়াচ্ছি। কেন দৌড়াচ্ছি আমি ঠিক জানিনা। আমার ভেতর একটা ভয়ানক ভয় আলোড়ন তুলছে। একটা শূন্য অবয়ব আমার পেছন তাড়া করছে। আমার পেছন কেউ নেই। তাও কিসের ভীতি আমাকে ঠেলে দিচ্ছে। বারংবার মনে হচ্ছে আমাকে কেউ ধরে ফেলছে। এই ধরে ফেললো।

ফোনটা হাতড়ে খুঁজছি। কখন যে গান বাজতে বাজতে বন্ধ হয়ে গেছে। উফ। ইলেকট্রিসিটি টাও নেই। বেডসাইডের জানলা টা খুলে দিলাম। একটা উদ্ভট গন্ধ দমকা বেগে আমার নাকে এসে লাগল।

কই! কিছু নেইতো! সব তো আগের মতোই। রেইন ট্রি গাছটা দাড়িয়ে আছে। দিনটা কেমন মরা মরা। মনে হয় বৃষ্টি হবে। থমকে আছে সব। আমার মাথা কাজ করছে না। বেডসাইডে থাকা বেল টা টিপে দিলাম।

ধ্যাত! মনেই নেই ইলেকট্রিসিটি নেই। অভ্যাস!

মাত্র এই কয়দিনেই অভ্যাস হয়ে গেলো! বিছানা ছেড়ে দাড়ালাম। আহঃ! পায়ে এত ব্যথা করছে কেন! পায়ের নিচে জ্বলে যাচ্ছে। পা উঁচু করে দেখলাম। কেটে গেছে! এমনভাবে কেটেছে। মনে হচ্ছে প্রচন্ড পরিশ্রম করেছি খালি পায়ে। কিন্তু আমি তো জুতো ছাড়া বেরোই না। মাথায় চিন্তার ঝড় খেলে যাচ্ছে। মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। বোকামি করলে চলবে না।

আপাদত কাউকে কিছু জানানো যাবে না। বেলা বেশ হলো।

আজাদ! মাত্র এক ডাকেই আজাদ ঘরে উপস্থিত হলো।

-স্যার আসবো?

ও কিভাবে জানলো আমি ওকে ডাকবো? নাকি আগে থেকেই দাড়িয়ে ছিল? আজাদ কি আমাকে ফলো করছে? কেন করছে? ও কি আসলেই কোনো মোটিভ থাকতে পারে? এমন কেন হচ্ছে তবে?

ভাবনা গুলো মাথার একপাশে সরিয়ে রাখতে হলো।

আজাদ আবার অনুমতি চাইছে।

-হ্যা এসো।

আজাদ এর শরীরে একটা চাদর চাপানো। দুটো হাত ই চাদরের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছে। ওর চালচলন খুব অদ্ভুত লাগছে।

-অনেক বেলা হলো নাস্তার ব্যবস্থা কি?

-হাত মুখ ধুয়ে নেন স্যার। কি খাইবেন কন?

কথায় কেমন যেন জোর করে শান্ত থাকার একটা প্রবণতা।

আজ মনে হয় বৃষ্টি হবে। খিচুড়ি আর বেগুন ভাজা করতে বলো।

-যে আচ্ছা স্যার।

আমি বিছানায় পা উঠিয়ে বসলাম। জানলার দিকে বাইরে চোখ মেলে দিলাম। অর্পার সঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে হচ্ছে।

কেন হচ্ছে? আমি কি ওকে ভালোবাসতে শুরু করেছি? জানি না। আজকে হাতে বেশ কাজ আছে। খেয়েই বেরোব।

“ওগো বৃষ্টি আমার চোখের পাতা ছুঁয়ো না”

ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। আকাশ ডাকছে। খেয়ে একটা নাপা খেয়ে নিতে হবে। নাহলে এই ব্যথায় হাঁটতে পারবো বলে মনে হয় না।

-স্যার, খাবার তৈয়ার আছে ।

চটকা ভাঙলো আজাদের কথায়। উম হ্যা! আজকে রুমেই খাবার দাও। ডাইনিং এ যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না।

-আচ্ছা স্যার।

বেশ ঝামেলা কোরে রিডিং টেবিলটায় বসলাম। এখান থেকে জানালা টা আড়াআড়ি নজরে আসে। আমি বৃষ্টি দেখছি। মাঝে মাঝে দমকা হাওয়ার ঝাপটা গায়ে এসে লাগছে। কেমন শীত শীত করছে।

-স্যার। আপনার নাস্তা।

বাহ! চমৎকার ব্যবস্থা। মুগ ডালের দারুন একটা গন্ধ ভেসে আসছে। বেগুন এর সঙ্গে ইলিশ মাছ ভাজা ও দেওয়া হয়েছে।

আজাদ এর উপর থেকে সন্দেহ টা মুহূর্তের জন্য উড়িয়ে দেওয়াই যায়।

আমি ওর দিকে ভালো করে তাকালাম। কেমন একটা গোবেচারা ভাব। আমার সামনে পানির জগ নিয়ে দাড়িয়ে আছে। আমার হটাৎ। বেশ মায়া হতে লাগলো দেখে।

-স্যার এই যে পানি । কিছু লাগলে ডাক দিয়েন।

আজাদ ঘুরে চলে যাচ্ছে। আমি হটাৎ লক্ষ্য করলাম ওর চাদরে মাটি লেগে আছে। মুখটাও কালো দেখাচ্ছিল। হয়তো লোডশেডিং এর জন্য!! কি জানি! তাও!!

-আজাদ!

আজাদ কেমন যেন থমকে দাড়ায়।

-জ্বি!

-তোমার চাদরে মাটি কিভাবে লাগলো?

কেমন একটা তড়িঘড়ি করে চাদর টা খুলে খুঁজতে লাগলো

-কই স্যার কই!

হটাৎ একটা বাজ পড়লো।

দমকা আলোয় আমি স্পষ্ট দেখলাম আজাদের কপালে কালো টিকা।

এমন তো হবার কথা নয়! আজাদ আসলে কে? আসলেই কি ও একটা কেয়ার টেকার? নাকি ওর অন্য পরিচয় আছে?

আমাকে জানতে হবে।  আজাদের চেহারা টা দেখার সাথে সাথে আমি চমকে গেলাম, আজাদও হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

…….আমি শুয়ে আছি, মাত্রই ঘুম ভাঙ্গলো। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কোথায় আছি। ঘোর কাটার পর বুঝলাম আমি আমার বিছানায়, বালিশের নিচ থেকে মোবাইল বের করে সময় দেখলাম, রাত ২ টা ৩৯ বাজে। আমি কিছুক্ষণ আগের ব্যাপার গুলি মনে করতে চেষ্টা করলাম। কি হয়েছিল আমার সাথে?

আসলে আমি রাতে ফেরার পর না খেয়েই ঘুমিয়ে যাই, এরপর মাত্রই আমার ঘুম ভাঙল। তার মানে আমি পরপর দুটি স্বপ্ন দেখেছি, ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের পর মোবাইল খোজা, আজাদের আমার রুমে আসা, চারদের ব্যাপার, আর আজাদের ঐ রূপ সবই স্বপ্ন। স্বপ্ন আর বাস্তবকে আলাদা করতে কঠিন হচ্ছে। কিছু প্রশ্ন মাথায় আসলো, সকালের নাস্তার সময় ইলেক্ট্রিসিটি না থাকলেও এতটা অন্ধকার হবার কথা না যে আজাদের চেহারা আমি বিদ্যুৎ চমকানো ছাড়া দেখতে পারবো না, আমার রুমে বাইরের আলো বাতাস ভালভাবেই আসে। আসলে স্বপ্নের যুক্তি খুজে লাভ নাই। এসব ভাবতে ভাবতেই আমি ঘুমিয়ে গেলাম, ঘুম ভাংলো পরের দিন বিকালে।

শরীরটা এতই ক্লান্ত মনে হচ্ছে যে উঠে দাড়াতেও কষ্ট হচ্ছে। আজাদকে ডাকলাম, কিছুক্ষণ পর আজাদ আসলো, ও সম্পূর্ন স্বাভাবিক হলেও আমার অস্বস্তি লাগছে, বুঝলাম গতকালকের স্বপ্নের কারনে এমনটা হচ্ছে। ও বললো সকাল থেকে ৩ বার আমার দরজায় নক করেছে আমি ঘুমিয়েই ছিলাম কোন সাড়া দেইনি। ভয় পেয়ে হেড অফিসে জানানোর কথাও ভেবেছিল, সন্ধ্যার মধ্যে না উঠলে নাকি হেড অফিসে জানাবে ভেবেছিল।

এরপর আজাদ আমার খাবার আনলো, পেট ভরে খেলাম, মনে হচ্ছে দীর্ঘদিন পর খাবার খাচ্ছি, অবশ্য গতকাল দুপুরের পর আজকে বিকালে খাচ্ছি। খাওয়া শেষ করে বেশ কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবার পর শরীরে কিছুটা শক্তি সঞ্চারিত হলো৷ আজ আর কোথাও যাব না ভেবেছিলাম তবুও বের হলাম।

দশ

গন্তব্য অর্পাদের বাড়ি, তার সাথে কথা বলে আমাকে কিছু বিষয়ে পরিষ্কার ধারনা নিতে হবে, আর চেয়ারম্যান সাহেবের সাথেও কিছু বিষয়ে কথা বলা জরুরী। তবে আমার এলোমেলো স্বপ্নের ব্যাপারে কিছু বলাযাবে না, কারন  এসব স্বপ্নের পেছনে আছে আমার অবচেতন মনে জমে থাকা ভয়, ভয়প্রকাশ করা সমীচীন নয়। অর্পাদের বাসাটা দূরে নয় অল্পসময় হেটেই চলে আসলাম। আসতে আসতে ভাবলাম হেড অফিস থেকে অগ্রিম কিছু টাকা নিয়ে একটা বাই সাইকেল কিনলে মন্দ হয় না।

অর্পাদের বাসা এরকম গভীর গ্রামে হলেও ওদের বাসায় একজন সুঠাম দেহের দাড়ওয়ান আছে, নাম আজগর আলী। হাসিখুশি চেহারা কথায় আঞ্চলিক টান স্পষ্ট হলেও কথার মধ্যে জোর আছে, লোকটিকে আমার খুবই ভাল লাগে। আগেও এ বাড়িতে কয়েকবার এসেছি তাই গেট দিয়ে ঢোকার সময় না আটকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো

-কেমন আছেন স্যার?

-ভাল, আপনি কেমন আছেন?

-ভাল।

-চেহারম্যান সাহেব বাড়িতে আছেন?

-জ্বী।

-আর অর্পা?

-জ্বী, ম্যাডামও আছে।

কথপোকথন শেষ করে বাড়ির ভিতরে চলে আসলাম, চেয়ারম্যান সাহেবের রুমটি বাড়িতে প্রবেশের পর প্রথমেই পরে। চেয়ারম্যান সাহেবের রুমের সামনে আসার পর মনে হলো ভিতরে চেয়ারম্যান সাহেব ফোনে কথা বলছে,

-জ্বী না, অফিসার ততটা বাড়াবাড়ি না করলেও এই ব্যাপারে সে খুব আগ্রহী।

(নিরবতা)

-আমাদের বিষয় বুঝতে পেরেছে বলে মনে হয়না, আর আজাদ সর্বক্ষনই তার উপর নজর রাখছে।

(নিরবতা)

-জ্বী, অর্পাও সব তার কাজ ঠিকঠাক করছে।

(নিরবতা)

-না, না। স্থানীও প্রসাশন আমার কথার বাইরে কিছুই করবে না।

আরো অনেক্ষণ কথা চালিয়ে গেলো চেয়ারম্যান সাহেব, কথাগুলি শুনে মনে হচ্ছে সে আমাদের এনজিওর হেড অফিসের উচ্চপদস্থ কারো সাথে কথা বলছে। যদিও এটা আমার শুধুমাত্র একটা ধারনা কারন আমি অন্যপাশের কথা শুনতে পারতেছিলাম না। চেয়ারম্যান সাহেবের কথা শেষ হবার পর অর্পার কাছে ফোনটি দিলেন তিনি।

অর্পার কথা গুলি শুনে আমি চমকে গেলাম, সে এসব কি বিষয়ে কথা বলছে? ব্যাফোমেট! চার্চ অব স্যাটান! আমি এসব শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। অনেক বিষয়েই ধারণা করেছিলাম কিন্তু এটা ভাবিনি, ব্যাফোমেট সম্পর্কে আমার ধারনা খুবই ক্ষীন তাই বুঝলাম এসব নিয়ে আরেকটু পড়াশোনা করতে হবে।

আমি সব শুনে কলিং বেল চাপলাম, চেয়ারম্যান সাহেব দরজা খুলে দিলেন, অর্পা ফোন কেটে দিল, তাদের সাথে কুশল বিনিময় করে আমি দ্রুত আমার বাসস্থলে ফেরার জন্য বেরিয়ে পরলাম। কারণ এসব শুনে মস্তিষ্ক এলোমেলো হয়ে গেছে, যে বিষয়ে আলাপ করতে এসেছিলাম তা এখন তা বলাই ভাল।

ফিরে এসে ব্যাফোমেট নিয়ে পড়াশোনার আগে কিছু প্রশ্ন নোট করে নিলাম।

১. ব্যাফোমেট চর্চা কি আমাদের দেশে ছড়িয়ে দিতে আমাদের এনজিও কাজ করছে? অর্থাৎ এই এনজিনিও কি শয়তান পুজারীদের মাধ্যমেই পরিচালিত?

২. চেয়ারম্যান সাহেব, তার মেয়ে এবং আজাদ কি এই সংস্থার হয়ে টাকার বিনিময়ে কাজ করে নাকি এরাও শয়তান পুজারী?

৩. এই এলাকার আর কারা কারা এদের সাথে আছে?

ইন্টারনেট স্পিড খুব কম হলেও গুগল সার্চ করা সম্ভব হচ্ছে তাই প্রথমেই গুগলে “ব্যাফোমেট” লিখে সার্চ করলাম। 

‘ব্যাফোমেট’ যে শয়তানের উপাসনা এ আগেই জানতাম। নতুন জানার মধ্যে ‘চার্চ অব স্যাটান’ নিয়ে পড়লাম কিছুটা। প্রচন্ড অবাক হয়েছি এর উৎপত্তিকাল দেখে‌। মাত্র অর্ধশতাব্দী আগে এই আধুনিক যুগে এসে চার্চ অব স্যাটান বা শয়তানের উপাসনালয় নামক সংগঠনের যাত্রা শুরু হয়। তারপর বিভিন্ন দেশে প্রায় আড়াই দশক ধরে দাপিয়ে রাজত্ব করে বেড়িয়েছে এই সংস্থা। আমেরিকায় প্রতিষ্ঠিত হলেও আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ইয়োরোপেও সংগঠন ছড়িয়ে দিতে সময় নেয়নি মোটেও। তবে উল্লেখযোগ্য ধ্বস নামে ১৯৯৭ সালে, প্রতিষ্ঠাতা মহাযাজক এন্টন সানন্দর লভির মৃত্যুর পর। কোন্দল আর অন্তর্দ্বন্দ্বে এরপর প্রায় হারিয়ে যেতে বসে চার্চ অব স্যাটান। যদিওবা মাঝে মাঝে বিচ্ছিন্নভাবে এর উপস্থিতির কথা শোনা যেতো। এর বাইরে দৃষ্টি আকর্ষণের মতো তথ্য পেলাম যুগান্তরের একটি আর্টিকেল দেখে। শিরোনাম – ‘দেশেও ডানা মেলছে শয়তানের চার্চ।’ তবে লিংকে ক্লিক করে দেখি অন্তঃসারশূন্য, অনলাইন পত্রিকার আর্টিকেলগুলো যেমন হয় আর কি!

যাইহোক, এর বেশি তেমন কিছু জানতে পারলাম না। একে তো ইন্টারনেট স্পিড প্রচন্ড স্লো। তার উপর উইকিপিডিয়ায় তেমন তথ্য নেই। এ ব্যাপারে ভালো কোন বই পেলে দারুন হতো।

অবশ্য ইন্টারনেট ঘেঁটে ইন্টারেস্টিং একটা সিম্বল পেয়েছি। পেন্টাকলের ভিতরে এক বিরাট শিংওয়ালা ছাগলের মাথা। উপরে স্যামুয়েল আর নিচে লিলিথ লেখা। চিহ্নটা দেখার পর থেকেই কি যেন মনে আসি আসি করছে অথচ মনে পড়ছে না। অথচ সিক্সথ সেন্স বলছে এই মুহূর্তে মনে পড়াটা জরুরী। ওফ!

‘স্যার, অর্পা ম্যাডাম আইছে’ – আজাদের ভীত সন্ত্রস্ত কন্ঠ।

‘ওকে, বসতে বলো আসছি।’

অন্যসময় হলে এই সংবাদে মন নেচে উঠতো। তবে এই মুহূর্তে খুশির চেয়ে অস্বস্তি কাজ করছে বেশি। বিশেষত ঐ ফোনকল শোনার পর থেকেই মাথা ঝিম মেরে আছে। অর্পা কেন বলছিল এসব! অর্পার মতো মিষ্টি মেয়েও কি করে জড়িত থাকতে পারে শয়তানের উপাসনায়! এমন অসময়ে ও কেন? তবে কি বাজিয়ে দেখতে এলো তখন কিছু শুনেছি কিনা? যাইহোক, কয়েকবার ধীরে শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ে নিজের মনকে শান্ত করলাম। এখন এসব ভাবার সময় নয়। মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। এই বিদেশ-বিভূঁইয়ে এই কেজি দেড়েকের মস্তিষ্কটাকেই এখন আপন মনে হচ্ছে। দ্রুত পা চালালাম বাইরের ঘরের দিকে।

‘কেমন আছো অর্পা?’

‘মন ভালো নেই। চলুন না একটু হেঁটে আসি’ – অর্পার অপূর্ব কন্ঠ রিনিঝিনি করছে তবে চোখ নিশ্চুপ আজ। নজর এড়ালো না আমার। নিজেকে সাবধান করলাম। আর মুখে মিষ্টি একটা হাসি ঝুলিয়ে ছোট্ট করে বললাম, ‘চলো’।

নদীর ধার ঘেঁষে নিশ্চুপ হেঁটে চলেছি দুজনে। অন্যদিন কথার ফুলঝুরি ছোটানো অর্পাও নিশ্চুপ।

‘আমাকে আপনার কেমন মেয়ে মনে হয়?’

হঠাৎ প্রশ্নে থমকে গেলেও দ্রুত সামলে নিলাম। বললাম, ‘বেশ মেয়ে তুমি। তোমার কম্প্যানিওন আমি উপভোগ করি।’

‘যা দেখা যায় তা সবসময়ই সত্যি হয়না। আর সব সত্যিকে বিশ্বাস করাও যায় না। তাই না?’

ওকে কেমন যেন মনে হচ্ছে। এরকম খাপছাড়া কথার মানে কি? তবে এই মুহূর্তে ওর চোখে চোখ মিলাতে ভয় করছে। কি নিঃসীম মায়া! একটু আগে ফোনকলে ব্যাফোমেট, চার্চ অব স্যাটান এর মুখ থেকেই শুনেছি বিশ্বাস হচ্ছে না।

‘চলো ফেরত যাই। আকাশ আবার অন্ধকার হয়ে আসছে’ – ওকে এলোমেলো লাগছে তা আর বললাম না।

‘আঁধারেই যার বাস, এসবে তার কিসের ত্রাস!’

‘কিছু বললে?’

‘না, চলুন।’

এগারো

আকাশ চমকাচ্ছে মুহুর্মুহু। বোধহয় বাড়িতে পৌঁছাতে পারবো না। পথেই পোড়োবাড়িটা পড়বে জানতাম। তবে অর্পা ওখানেই যেতে বলবে তা জানতাম না। ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো বলে! উপায় না পেয়ে অর্পার প্রস্তাবে রাজি হতে হলো। আধো আঁধারে পোড়োবাড়ি অদ্ভুতুড়ে দেখাচ্ছে। ঢুকতে বেশ অস্বস্তি কাজ করছে তাই। গেটে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। ততক্ষণে ও পৌঁছে গেছে বাড়ির ভিতরে, হাত নেড়ে ডাকছে। কি মনে করে তাকালাম উপরের দিকে আর সেই মুহূর্তে বিদ্যুচ্চমক। হাড় হিম হয়ে এলো ভয়ে।

পোড়োবাড়ির ক্ষয়িষ্ণু নামফলকে এই আঁধারেও লেখাটা যেন জ্বলজ্বল করছে!

লিলিথবাড়ি” 

মাথার ভিতরে অনেক প্রশ্ন ভিড় করছে। তবে এতটুকু বুঝতে পারছি যে, এই খুনের রহস্যের সাথে নাম ফলকের যোগসূত্র আছে। কিছুটা ভয়, কিছুটা কৌতূহল নিয়ে আমি এগোতে থাকলাম। একবার মনে হলো ফিরে যাই। কিন্তু পরক্ষণেই সেই চিন্তা বাদ দিয়ে ভিতরের দিকে আগালাম। যদিও আমি আগেও এখানে এসেছি, তবু আজ পরিবেশটা কেমন যেনো থমথমে লাগছে। আবছা আলোতেও যেতে খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না।

নিচে কোথাও অর্পাকে দেখতে পেলাম না। সিড়ি দিয়ে উপরে গেলাম। অর্পা একটা জানালার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি অর্পাকে ডাক দিলাম। কিন্তু ও যেনো কিছুই শুনছেনা। একটু কাছে গিয়ে ডাক দিতেই ও আমার দিকে ঘুরে দাড়ালো। আবছা আলোতেও ওর চেহারায় দুশ্চিন্তা ছাপ স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। বাহিরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ঘরের অন্য পাশের জানালা দিয়ে সেই আলো রুমের পরিবেশকে অদ্ভুতুড়ে বানিয়ে দিচ্ছে। দুজনেই চুপচাপ।

অর্পাই নিরবতা ভেঙে প্রথম কথা বললো। সে বললো, আপনি এই এলাকা ছেড়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে যান।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেনো?

-আপনি কোনো কিছু জানতে চাইবেন না, সকালেই চলে যাবেন এই এলাকা ছেড়ে।

ওর কন্ঠের ব্যকুলতা আমার বুঝতে কষ্ট হলোনা। আমার জন্য ওর চোখে কি এক অদ্ভুত মায়া দেখতে পাচ্ছি। ওর চেহারা থেকে চোখ সরাতে পারছিনা। আমি যেনো নড়তেও ভুলে গিয়েছি। ও আবারও বললো,  আপনি কাল সকালেই চলে যাবেন।

আমি মনে মনে ভাবলাম, এমন কারো জন্য মৃত্যুকেও হাসিমুখে মেনে নেয়া যায়। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, কেনো যেতে বলছো আমায়? কি সম্পর্ক তোমার এসব খুনের ঘটনার সাথে? কি কি জানো তুমি?

ও শুধু বললো, এখানে আপনার ক্ষতি হতে পারে।

আমি বললাম যে, তুমি থাকতে যে আমার কোনো ক্ষতি হবে না তা খুব ভলোই বুঝতে পারছি। কিন্তু আমি জানতে চাই কেনো বা কিসের জন্য এখানে এসব হচ্ছে?

-আপনি এসব ঝামেলায় নিজেকে জড়াবেন না, এই ঝামেলা আমার জন্য শুরু হয়েছে, আমিই এর শেষ করবো।

আমি এবার ওর চোখের দিকে তাকিয়ে দৃঢ়ভাবে বললাম যে, আমি কোথাও যাচ্ছি না তোমাকে ছেড়ে। যা হবার হবে।

আমার দৃঢ়তা দেখে ও বলতে শুরু করলো, অনেক যুগ ধরেই কিছু মানুষ শয়তানের পূজা করে আসছে। পুরো পৃথিবীতেই শয়তানের পূজারীরা ছড়ায় আছে। আমাদের দেশেও কিছু মানুষ লুকিয়ে শয়তানের পূজা করে, কালো জাদু করে। তেমনি একজনের সাথে ঘটনাক্রমে আমার বাবার পরিচয় হয়। আমাদের এদিকটা জঙ্গল এলাকা হওয়ায় সেই লোক এদিকে তার উপাসনার জায়গা খুজছিলো। যার জন্য তার লোকাল সাপোর্টের প্রয়োজন ছিলো। বাবার গ্রাম্য রাজনীতির দিকে খুব ঝোক ছিলো। বাবা দুবার চেয়ারম্যান নির্বাচন করে জিততে পারেনি। দুবার নির্বাচনে বাবা মোটামুটি নিজের বেশির ভাগ সম্পদ খোয়ায় ফেলে। নির্বাচনে হারার ক্ষোভ, ক্ষমতা লোভ, হারানো সম্পদের জন্য বাবা রীতিমতো পাগল হয়ে আছে। সেই সময়ে শয়তানের পূজারী সেই লোক বাবাকে বলেন যে, আমি আপনার হারানো সব কিছু ফিরিয়ে দিতে পারি, সেই সাথে পাবেন আপনার কাঙ্খিত ক্ষমতা অল্প কিছু শর্তের বিনিময়ে। বাবা এতটাই পাগল হয়ে গিয়েছিল সব শর্তে রাজি হয়ে গেলো। অল্প কয়েক দিন পরেই তখনার চেয়ারম্যান অসুস্থ হয়ে মারা গেলো। হয়তো তাকে কালো জাদু করা হয়েছিল। বাবা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলো। শয়তানের অনুসারীরা এ গ্রামে আসা শুরু করলো। তারা প্রতি দেড়মাস পর এখানে আসে তাদের উপাসনা করে চলে যায়। শর্ত অনুযায়ী বাবা তাদেরকে সাহায্য করে। সাধারণ মানুষের চোখ এড়িয়ে উপাসনার ব্যবস্থা করে দিতে থাকে। এই পুরাতন বাড়িটাকে তারা আস্তানা বানায়। তাদের রীতি অনুযায়ী বাড়ির নাম দেয়। এদিকটায় লোকজন আসে না। তাই তারা নির্বিঘ্নে তাদের কাজ চালিয়ে যেতে থাকে । তাদের কাজ আরো সহজ করতে এই এলাকায় এনজিও করে, যেটাতে আপনি চকরি করেন। বিভিন্ন সময়ে এই এনজিও এর কাজের আড়ালে তারা এসে তাদের উপাসনা করতে থাকে। গ্রামের কয়েকজনও  তাদের দলে ভিরে যায়। সব কিছু এভাবেই চলছিল কোনো ঝামেলা ছাড়াই।

কিন্তু ছমাস আগে এসব বদলে যায়। আমি খুব ছোটো থেকেই শহরে থাকে পড়াশোনা করি। ওই সময় আমি ছুটিতে বাড়ি আসি। একদিন বিকালে হাটতে বের হয়ে এদিকটায় চলে আসি। এই বাড়িটা দেখে কেনো যেনো মনে হলো ভিতরে মানুষ আসা যাওয়া করে। কৌতূহল মেটাতে না পারে ভিতরে যাই। ভেতরে কোনো মানুষ না থাকালেও মানুষ থাকার চিহ্ন স্পষ্ট। আমি উপর তালয় গেলাম। সেখানে এই সোফাটা সরানো ছিলো। ওখান দিয়ে ছোট্ট একটা সিড়ি নিচে নেমে গিয়েছে। আমি নীচে গেলাম। মোমবাতি জ্বলছে রুমটায়। সেই রাতেই তাদের উপাসনা ছিলো। উপাসনার সব আয়োজন করা আছে। মেঝেতে জানা অজানা অনেক কিছু ছরিয়ে আছে। মেঝেতে একটা নকশা আকা। তার সামনে কিছু একটা কাপর দিয়ে ঢাকা। আমি গিয়ে কাপরটা সরাতেই ভয়ে লাফ দিয়ে পিছায় আসলাম। তাল সামলাতে না পারে পরে গেলাম। হাতে একটু কাটে গিয়ে একফোটা রক্ত পরে ওদের উপাসনার জন্য আকা নকশায়। একটা ভয়ংকর মুর্তি ছিলো ওখানে।  মুর্তিটা যেন আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি ওখান থেকে বাড়ি চলে যাই। বাড়িতেও কাউকে কিছু বলিনি। কিন্তু সেই রাতেই ওদের উপাসনা সফল হয়। ওদের সেই  অপদেবতা জাগ্রত হয়। আর ওদেরই একজনকে সেই রাতে মেরে ফেলে। পরের দিন আমি বাবাকে ফোনে কারো সাথে এসব নিয়ে কথা বলতে শুনি। বাবা খুব চিন্তিত ছিলো। আমি বাবার কাছে  সব কিছু জানতে চাই। প্রথমে বাবা অস্বীকার করলেও এক পর্যায়ে সব বলে।

ওরা বাবাকে বেলছে যে, সব কিছু আগের মতোই সামলাতে।  নতুবা আমাকে মারে ফেলবে। ওদের অপদেবতা জাগ্রত হয়ছে কিন্তু সেটা পরিপূর্ণ হয়নি। শারমিন কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন। মাঝে মধ্যেই এই পোড়া বাড়িতে চলে আসে। ওদের ধারনা শারমিনের রক্তেই ওদের দেবতা জাগ্রত হেয়ছে। কিন্তু কোনো কারণে দেবতা অসন্তুষ্ট হয়েছে, তাই শারমিনকে আটকে রেখে তারা তাদের দেবতাকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করতেছে। বাবা আমাকে বলে যে এসবে যেনো আমি মাথা না ঘামাই। আমি প্রচন্ড ভয় পাওয়ায় বাবার কথা মেনে নেই। কিন্তু তার পর থেকেই প্রতি দেড়মাসে একজন করে মারা যেতে থাকে। আমি এসবের শেষ করার জন্য বিভিন্ন তথ্য যোগার শুরু করি। তাদের আরো কাছে আসার জন্য এই এনজিও তে কাজ শুধু করি। ভেবেছিলাম আপনিও ওদের দলে। কিন্তু আপনি আসার পর বুঝলাম যে আপনি এসবের সাথে নেই। আপনি অনেক ভালো মনের একটা মানুষ। তাই আমি চাই না আপনার কোনো ক্ষতি হোক। যেই কজন মারা গেছে তারা আসলে কেনো মারা গেছে আমি এখোনো জানতে পারি নি। তবে মনে হয় তারা সকলেই শয়তানের অনুসারী। এখনো অনেক প্রশ্নের উত্তর জানা বাকি এই অপশক্তিকে থামাতে। তবে এতটুকু বুঝতে পারছি আমিই পারবো এসব থামাতে। এসব এক নিঃশ্বাসে বলে ও থামলো।  

অর্পার কথাগুলো শুনে কিছুক্ষণ আমি চুপ। মাথায় অনেক প্রশ্ন একসাথে ঘুরছে। বোঝার চেষ্টা করছি আমার আসলে কি করা উচিত। আমি ব্ল্যাক ম্যাজিক, কালোজাদু এগুলোতে কখনো বিশ্বাসই করতাম না কিন্তু এই গ্রামে এসে একের পর এক যে অভিজ্ঞতাগুলো হচ্ছে,  কি বিশ্বাস করবো, কাকে বিশ্বাস করবো কিছুই বুঝতে পারছি না।

আমার নিরবতা দেখে অর্পা জিজ্ঞেস করলো, কি চিন্তা করছো? এত চিন্তা করার কিছু নেই। তুমি কাল সকালেই চলে যাচ্ছো।

-উহু, আমি যাচ্ছি না। এর শেষটা আমিও দেখতে চাই।

-দেখো, ব্ল্যাকম্যাজিক কোন ছেলেখেলা না৷ আর এটা কোন সিনেমা না যে তুমি শেষ দেখার জন্য এখানে থাকবে। তোমার লাইফ রিস্কে…..

অর্পার কথাগুলো কানে যাচ্ছে না। মাথায় অনেক প্রশ্ন ঘুরছে। অর্পাকে জিজ্ঞেস করলাম, 

আচ্ছা শারমিনকে ওরা ছেড়ে দিয়েছে কেন? মেরে ফেলেনি কেনো?

-আমি সেটা জানিনা। হয়তো ভেবে নিয়েছে এই মানসিক ভারসাম্যহীন মেয়েকে বাঁচিয়ে রাখলে তো কোন ক্ষতি নেই।  ওরা ব্ল্যাকম্যাজিক করে, সেটার জন্য প্রয়োজন বোধ করলে খুন করে,  অযথা খুন করা নিশ্চয়ই তাদের শখ না!

-হুম, হতে পারে…

কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার প্রশ্ন করলাম, অর্পা কিছু মনে করোনা,  ডাক্তার রিনি মারা যাওয়ার আগের দিন তোমাকে দেখেছিলাম ওনার দিকে একটু অদ্ভুদভাবে তাকাতে। সেটা কি শুধুই আমার মনের ভুল ছিল? নাকি তুমি কিছু জানতে?

-উহু তোমার মনের ভুল ছিল না। উনিও বুঝতে পেরেছিলেন এই গ্রামে কিছু একটা হচ্ছে।  ওনার অতি আগ্রহের কারণেই অনেক কিছুই জেনে ফেলেছিলেন তিনি। আমি তাকে সতর্ক করেছিলাম এই গ্রামে আর না আসতে, আসলে বিপদ হবে। বুঝতে পারিনি তিনি আমার কথা না শুনে আবার আসবেন। তাই ওনাকে সেদিন দেখে ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু দেখো, যা ভয় পেয়েছিলাম সেটাই হলো।

-কিন্তু বাকি লোকদের খুন করা হলো কেন?

-জানি না, হয়তো তাদের উপাসনার জন্য বলি দেওয়া হয়েছে বা তারাও হয়তো আগ্রহী ছিল লিলিথবাড়ির রহস্য নিয়ে।

কথা বলতে বলতে আমরা বাড়িটার ভেতরের দিকে হাটছিলাম। ফ্লোরে অনেক ধরণের সংকেত আঁকা।  বোঝাই যাচ্ছে ব্ল্যাক ম্যাজিকের জন্য আঁকা এগুলো।

অর্পা কথা বলতে বলতে তার পায়ের গোড়ালির দিকে চুলকাতে গিয়ে হঠাৎ করে খুব আশ্চর্য হলো মনে হলো। তারপর তার পায়ের দিকে তাকিয়ে গলা ছেড়ে এক চিৎকার দিলো। আমি অর্পার পায়ের দিয়ে তাকিয়ে দেখি,  গোড়ালিতে একটা জোঁক।  বৃষ্টির সময় গ্রামে জোঁক থাকবে এটাই স্বাভাবিক।  অর্পা একটা গ্রামের মেয়ে হয়ে জোক এতটা ভয় পাবে বুঝতে পারিনি।

মেয়েটা মনে হচ্ছে চিৎকার করতে করতে অজ্ঞান হয়ে যাবে।

আমি তাড়াতাড়ি টেনে পা থেকে জোকটা ছাড়িয়ে দিলাম।

অর্পার চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে আমি যেন তার জীবন বাঁচিয়েছি।

-থ্যাঙ্কিউ,  থ্যাঙ্কিউ সো মাচ। তুমি না থাকলে….

-হা হা তোমাকে তো অনেক সাহসী ভেবেছিলাম। এদিকে ব্ল্যাক ম্যাজিশিয়ানদের তাড়ানোর চেষ্টা করছো আর সামান্য একটা জোঁককে এত ভয়!

-দেখো!  আমি অনেক সাহসী!  আমার সামনে বাঘ ভাল্লুক আসলেও আমি ভয় পাবোনা,  কিন্তু জোক!! মাগো!!!

-হা হা বুঝলাম। আচ্ছা বৃষ্টি তো অনেকটা কমে গেছে। আমরা বেরোই?

-হ্যা চলো

গল্প করতে করতে অর্পাকে ওর বাড়ির দিকে এগিয়ে দিয়ে আমি আমার ঘরে আসলাম।

শেষ পর্ব

ঘরে আসার একটু পরে বাড়ি থেকে ফোন এলো, মা অনেক অসুস্থ।  হেড অফিসে ফোন দিয়ে ছুটি নিয়ে আমি তখনই বেড়িয়ে পরলাম। কাউকে জানানোর সুযোগ পাইনি। শুধু আজাদকে বলে গেলাম বাড়ি যাচ্ছি, মা অসুস্থ।

প্রায় এক সপ্তাহ পরে গ্রামে ফিরে আসলাম।

আজাদের কাছ থেকে জানতে এই কয়দিনে নাকি গ্রামে  অনেক কিছু ঘটে গেছে এবং অর্পা অসুস্থ। কি কি ঘটেছে সেটা পড়ে জানা যাবে। আমি আগে চলে গেলাম অর্পাকে দেখতে।

অর্পাকে দেখে মনে হচ্ছে ওর ওজন কয়েক কেজি কমে গিয়েছে। চোখের নিচে কালি, ঠোঁট ফ্যাকাসে।

কেমন আছো অর্পা?

-এখন বেটার। তোমার মা কেমন আছে?

-সুস্থ এখন। তুমি কিভাবে অসুস্থ হলে?

-তুমি চলে যাওয়ার পর অনেক কিছু ঘটেছে।

অর্পার কাছ থেকে জানতে পারলাম আমি চলে যাওয়ার দুইদিন পর হঠাৎ অর্পা অসুস্থ হয়ে যায়।

অর্পার কিছু মনে নেই। সে শুনেছে সে নাকি অপ্রকৃতস্থের মত আচরণ করছিল। অনেকটা হরর মুভিতে আমরা দেখি পোজেস্ট হলে যেমনটা করে। অর্পার বাবা বুঝতে পারে অর্পার উপর হয়তো অপদেবতা ভর করেছে। তিনি তাই সেই ব্ল্যাক ম্যাজিশিয়ানকে ডেকে আনেন।

জানা যায়,  ওইদিন তারা আবার অপদেবতাকে ডাকতে বসেছিল। যখন তারা ধ্যানে ছিল ঠিক সেই সময়ই নিজের বাড়িতে অর্পা অসুস্থ হতে শুরু করে।

ওই ব্ল্যাক ম্যাজিশিয়ানের মতে এক দুইদিনের মধ্যে অর্পা নিশ্চয়ই পোড়াবাড়িতে গিয়েছিল এবং কোনভাবে সেখানে অর্পার শরীরের কয়েক ফোঁটা রক্ত পড়েছিল আর তাতেই আবারো অপদেবতা আসে।

তখনই আমার মনে পড়লো, অর্পা আর আমি সেদিন লিলিথবাড়ি গিয়েছিলাম।  অর্পার পায়ে জোঁক ধরেছিল।

আরে তাইতো! জোক ছাড়ানোর পর সাধারণত কিছুক্ষণ ব্লিডিং হতে থাকে। আমরা হয়তো সেদিন খেয়াল করিনি।

যাইহোক, অর্পা সুস্থ হতে শুরু করার পর সেই ব্ল্যাক ম্যাজিশিয়ান অর্পার বাবাকে বলে, অর্পাকে তাদের উপাসনার জন্য লাগবে। সেই প্রস্তাবে অর্পার বাবা রাজি হয়নি।

অর্পা বুঝতে পারে যেহেতু পর পর দুবার অপদেবতা তার রক্তেই এসেছে, ওরা অর্পাকে যেকোনভাবে উপাসনার সাথে যুক্ত করতে চাইবে।

অর্পার বাবা মেয়ের জীবনের ঝুঁকি নিতে চাননি তাই তিনি দুদিন পরেই সেই ব্ল্যাক ম্যাজিশিয়ান চক্রকে পুলিশে ধরিয়ে দেন।

অর্পা এক সপ্তাহের মধ্যেই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যায়। তারপর প্রায় পাঁচ মাস কেটে গেছে,  গ্রামে কোন খুন হয়নি। পোড়াবাড়িটাও পরিষ্কার করা হয়েছে। এরমাঝে ভালো খবর হচ্ছে আমার প্রমোশন হয়েছে। পরবর্তি মাস থেকে ঢাকায় হেড অফিসে কাজ করতে হবে।

অর্পার ক্লাস শুরু হয়েছে দেখে ও ঢাকাতেই এখন।  মাঝে মাঝে ফোনে কথা হয়।

অনেকদিন হয়ে গেছে দেখা হয়নি ওর সাথে। ঢাকায় গিয়েই একবার দেখা করতে হবে।

এই গল্পের লেখকগন হচ্ছেনঃ মুক্তাদিরুল ইসলাম চমক, মোস্তাক শিপন, সাগর, সাদিয়া লতিফ, রেজোয়ান রাহাত, সাগর বড়ুয়া, মোস্তফা আল জুবায়ের, ইমরান আহমেদ, আব্দুল কাইয়ুম, তৌহিদ আহমেদ, সজীব হোসেন, ইসতিয়াক সাইফুল্লাহ, সাব্বির আহমেদ, কণিকা

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.3 / 5. Vote count: 48

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

One Comment on “সম্মিলিত গল্পঃ রক্তযজ্ঞ”

Comments are closed.