ঠিক যখন মনে হয়েছিলো যে আমার দ্বারা আর কোন চাকরি বাকরি পাওয়া হবে না ঠিক সেই সময়েই চাকরিটা এসে হাজির হল আমার কাছে । অনেকটা অপ্রত্যাশিত ভাবে । আমি অনেক আগেই চাকরির আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম । চাকরির পড়াশুনা করতে যে পরিমান ধৈর্য্য লাগে সেটা আমার ছিল না । আমি ব্যবসার কথা ভাবছিলাম । তবে মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেদের ব্যবসার জন্য সব থেকে দরকারী জিনিসটাই থাকে না । আমারও ছিল না । টাকার অভাবে কোন ভাল ব্যবসা যে করবো সেটাও সম্ভব হচ্ছিলো না । শেষে এমন একটা পরিস্থিতি হল যে আমাকে আর ঢাকা ছেড়ে চলে যেতে হবে । ঢাকায় থাকলে সামনের কয়েক দিন পরে হয়তো আমাকে না খেয়ে থাকতে হবে।
ঢাকার প্রতি আমার কোন কালেই কোন মায়া ছিল না । এখানে আমি এসেছিলাম কেবল পড়াশুনা করতে এবং পড়াশুনা শেষ করে একটা জীবিকার নির্বাহ করতে । এতোদিন এখানে থাকার পরেও সেই কাজের কিছুই হল না । এতোদিন টিউশনী আর কোচিংয়ে ক্লাস নিয়ে পার করেছি । করোনা শুরুর পর থেকে সে গুলো কমতে কমতে একেবারে কমে গেল । এমন একটা অবস্থা যে ঠিক ঠাক মত খেয়ে পড়ে থাকাই মুস্কিল হয়ে উঠলো । বাসা থেকে জানালো যে আমি যেন বাসায় চলে যাই । সেখানে গিয়েই কিছু করার চেষ্টা করি । আমি জানি সেখানে গেলে আমার পক্ষে কিছুই করা সম্ভব হবে না । আমার বাবা স্থানীয় একটা ফলট্রি ফিডের ফ্যাক্টরীতে চাকরি করেন । সেটার মালিককে বলে হয়তো আমাকে সেখানে ঢুকিয়ে দিতে পারেন তিনি । আপাতত এই সম্ভবনা ছাড়া আর কিছু নেই ।
আমার যদিও এতে কোন সম্মতি ছিল না কিন্তু এছাড়া আপাতত আর কোন উপায়ও আমি দেখছিলাম না । তাই ঠিক করলাম যে গ্রামেই ফিরে যাবো । যখন মোটা মুটি সিদ্ধান্ত ফাইনাল করে ফেলেছি তখনই চাকরির নিয়োগ পত্রটা এসে হাজির হল আমার কাছে । আমার প্রথমে মনেই পড়লো না যে আমি কবে এই অফিসে ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম । অবশ্য আমি অনেক কয়টা অফিসে ইন্টারভিউ দিয়েছি । কর্মক্ষেত্রের নামটা দেখার পরে আমার মনে পড়লো । প্রায় বছর খানেক আগে আমি এই অফিসে ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম । একটা এনজিও ধরনের অফিস। তারা বলেছিলো যে যদি আমার চাকরি হয় তাহলে তাহলে আমার বাংলাদেশের একেবারে শেষ প্রান্তে গিয়ে কাজ করতে হবে । এনজিওটা গ্রামের মানুষদের নানান ভাবে সাহায্য সহযোগিতা করে, তাদের এবং তাদের বাচ্চাদের পড়ালেখা করায় । আমার কাজ হচ্ছে এই রকম একটা শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা ।
সত্যিই বলতে কী আমার মনে আর অন্য কোন চিন্তা এল না । আর আমি যেহেতু ঢাকা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছি তাই ঢাকার বাইরে যে কোন স্থানেই আমি গিয়ে চাকরি করতে পারি । বেতনের পরিমানটাও খারাপ না । এছাড়া যদি সব কিছু দিয়ে আমি সেখানে টিকতে না পরি তাহলে আমি তো ফিরে যেতে পারি পরিবারের কাছে । সেই পথটা তো খোলাই আছে । আর কোন চিন্তা ভাবনা না করেই পরদিনই হাজির হলাম এনজিওর অফিসে । ওরা আমাকে সব কিছু বুঝিয়ে দিল । এছাড়া এও জানালো যে এনজিওটার সে অফিসটা আছে তার সাথেই একটা ঘর আমার জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে । রান্নার জন্যও লোক আছে । সুতরাং থাকা এবং খাওয়ার জন্য আামকে চিন্তা করতে হবে না ।
দুই
ঘরটা বেশ গোছালো। পুরানো জমিদারদের কাঁচারি ঘর মনে হলো। আগেও এখানে মানুষজন ছিলো তার কিছু চিহ্ন পেলাম দেয়ালের আঁকিবুঁকি দেখে। সারাদিনের ক্লান্তির শেষে একটা জম্পেস ঘুমের প্রয়োজন মনে করলাম। ফ্রেশ হয়ে খাটে গা এলিয়ে দিতেই ঘুম এসে হাজির। পাখির কিচিরমিচির শব্দ শুনে ঘুম যখন ভাঙলো তখন ভোর সাড়ে ৫টা। সাধারণত এত তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস আমার নেই। ঢাকায় যখন ছিলাম তখন আটটা নাগাদ বা তারও পরে ঘুম থেকে উঠতাম। নতুন জায়গা, নতুন সবকিছু তাই ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় তেমন একটা গা করিনি।
ফ্রেশ হয়ে দেখলাম টেবিলে নাস্তা রেডি। এই বিষয়টা খুব পছন্দ হলো আমার। নাস্তা খেয়ে আশেপাশে ঘুরে দেখবো বলে ঠিক করলাম। বাইরে বের হয়ে কাঁচারি ঘরের চারপাশ দেখে অবাক হলাম। ঘরটা বেশ পুরানো। অথচ ভেতর থেকে দেখে বুঝার উপায় নেই। পেছনের দিকে বিশাল যায়গা জুড়ে পুরনো একটা বটগাছ দেখতে পেলাম। তার একটু পরেই ঘন জঙ্গল। আশেপাশে আর ঘরবাড়ি তেমন একটা নেই বললেই চলে। পাশ দিয়ে একটা ছোট রাস্তা। সেটা দিয়েই বড় রাস্তায় যাওয়া যায়। বাইরে বের হয়ে বড় রাস্তার দিকে যেতেই কেমন যেন মনে হলো আমার। মনে হলো কিছু একটা ঠিক নেই। আশেপাশের মানুষের চাহনি দেখে তাই মনে হলো। কেমন গভীর দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিলো আমার দিকে সবাই, যেন কতদিনের চেনা আমি। চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো তারা আমাকে কিছু একটা বলতে চায় অথচ বলার সাহস পাচ্ছে না। ব্যাপারগুলো তেমন একটা গা করবো না ভেবে সামনে এগুতে থাকলাম। চারপাশে দেখে নিচ্ছি। এনজিওর চাকরি বলে কথা, মানুষজনের সাথে আলাপ আলোচনা হওয়া জরুরী, পরিচয় থাকা জরুরী। এ ক্ষেত্রে কাজের সুবিধা অনেকটা বেড়ে যায়।
জয়েনিং হতে দুইদিন দেরি হবে এখনো। সকল ফরমালিটি শেষ হয়নি। তাই আপাতত আর কোনো কাজ নেই হাতে। রুমে ফিরে খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষ করে বিছানায় ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়লাম।
মাঝেমাঝে গল্প লেখার অভ্যাস আমার। আর এমন নীরব জায়গা গল্প লেখার জন্য উত্তম। কেয়ারটেকার রফিক মিয়া এখানকার স্থানীয় মানুষ, বহু বছর থেকেই এই এনজিওর সাথে আছেন তিনি। এখানে আসা সকল অফিসারদের দেখাশোনা উনিই করেন। রফিক মিয়ার থেকে আশেপাশের টুকটাক খোঁজ খবর নেওয়া শুরু করলাম। পেছনের জঙ্গলের কথা বলতে গিয়ে রফিক মিয়ার চোখে কেমন ভয় দেখা গেলো।
সকাল থেকেই সবকিছু কেমন অদ্ভুত মনে হলো। এখন অদ্ভুত বিষয়টা মনের মধ্যে আরও জেকে বসেছিলো। কি হয়েছে! কেন এমন চাহনি মানুষের, কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তবে একটা জিনিস ঠিকই বুঝলাম যে এখানে কিছু একটা ঠিক নেই। বেশ কয়েকজন অফিসারদের হঠাৎ চাকরি ছেড়ে চলে যাওয়ার বিষয়টা ভাবনায় আসলো আমার। বেতন অনেক বেশি না হলেও পরিমানটা খারাপ না। তবুও হঠাৎ এতগুলো মানুষ চাকরি ছেড়ে চলে গেছে । সে বিষয় নিয়ে রফিক মিয়ার সাথে কথা বলছিলাম বসে বসে।
তিন
রফিক মিয়ার সাথে টুকটাক কথার ফাঁকে যখন জানতে চাইলাম, এখানে কেউ থাকতে চায় না কেন তখন তার চোখে আতঙ্কের ছাপ দেখতে পেলাম । পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে এড়িয়ে যেতে চাইলো বিষয়টা । কিছুটা জোর করতেই তিনি বললেন পেছনের জঙ্গলে ভয়ঙ্কর কিছু একটা আছে । জঙ্গলের পেছনের থাকা পোড়াবাড়ি থেকে রাতে নানা ধরনের শব্দ ভেসে আসে। রাত হলেই ভয়ঙ্কর সব শব্দ শুনতে পাওয়া যায় । কেউ যেন কান্না করতে করতে সাহায্য চাইছে । প্রায়ই গ্রামের মানুষ নিখোঁজ হয়ে যায় । তাদের মৃত লাশ পাওয়া যায় জঙ্গলে। আবার অনেকের লাশ পাওয়া যায় না । যাদের লাশ আজ পর্যন্ত পাওয়া গেছে সবারই মৃত্যু হয়েছে ভয়ঙ্কর ভাবে । লাশ গুলাকে কখনো বড় কোন গাছের উপর, কখনো ঝুলন্ত অবস্থায়। এই কারণেই এখানে কোন স্যার বেশিদিন থাকেন না । হয়ত অন্য কোথাও পোষ্টিং নিয়ে চলে যায়, আবার অনেকে চাকরি ছেড়েও চলে যায় । কথা গুলো বলার সময় রফিক মিয়ার চেহারায় আতঙ্ক দেখতে পেলাম, যদিও রফিক মিয়ার কথাগুলা আমি সিরিয়াসলি নিলাম না কিন্তু তাকে কিছুই বুঝতে দিলাম না । রফিক মিয়ার সাথে কথা বলতে বলতে বেশ বেলা হয়ে গেলো । তার থেকে বিদায় নিয়ে আশে পাশে ঘুরে দেখার জন্য বেরিয়ে আসলাম । ছোট রাস্তা ধরে হাটতে হাটতে বড় রাস্তার কাছাকাছি চলে এসেছি, এই দিকটায় মানুষ জনের আনাগোনা রয়েছে । বেশ কিছু বাড়ি ঘর ও ছোট খাটো কিছু দোকানও রয়েছে । বেশি ভাগই কাঁচা বাড়ি তবে একটি বাড়ি দেখা গেলো মোটামুটি আধুনিক ডিজাইনে বানানো দৌতলা বিশিষ্ট পাকা বাড়ি । আজকেও আমার কেন জানি মনে হলো এই গ্রামে কিছু একটা ঠিক নেই, সবার চাহনি কিছু একটা বলতে চায় কিন্তু কেউ বলার সাহস পাচ্ছে বা বলতে চাচ্ছে না । হাটতে হাটতে অনেক দূর চলে এসেছি আমার মনে হলো এবার ফেরা দরকার প্রায় দুপুরও হয়ে এসেছে । ফিরে আসার সময় চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ির ছাদে একজনকে রাগি গলায় বেশ জোরে জোরে ফোনে কথা বলতে শুনলাম । মেয়েটি ঢাকায় গিয়ে কাউকে দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়ে যাচ্ছিল । হয়তো চেয়ারম্যান এর মেয়ে হবে । বাড়ি রাস্তার সাথেই হওয়াতে তার কথা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। রফিক মিয়া বলেছিল চেয়ারম্যান সাহেবের মেয়ে ঢাকার কোন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে । এখানে বেশ কিছুদিন ধরে এই গ্রামেই আছে ।
দুপুরে খাওয়াটা একটু বেশি হয়ে গিয়েছে । খাওয়ার পর বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম । শুয়ে শুয়ে রফিক মিয়ার কথা গুলা ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে গিয়েছি জানি না। ঘুম থেকে উঠতে উঠতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেলো । আমাকে উঠতে দেখে টেবিলে চা দেওয়া হলো । আজকে আর বাহিরে বের হওয়ার ইচ্ছে করলো না । গতকাল একটা গল্প লেখা শুরু করেছিলাম আজ শেষ করব ভেবে রুমে এসে ল্যাপটপ নিয়ে বসলাম। আমার থাকার যায়গা টা লোকালয়য়ের শেষ দিকে হওয়ায় এমনিতেই সব সময় সুনসান থাকে সন্ধ্যার পর মনে হলো নিরবতার পরিমাণ আরো কয়েক গুণ বেড়ে গেলো। হঠাৎ করেই আমার মনে হলো আশে পাশের পরিবেশ কেমন যেন ভূতুড়ে হয়ে উঠছে। নতুন এলাকা নতুন পরিবেশ তাই হয়ত এমন হচ্ছে ভেবে আমি আমার লেখায় মনযোগ দিলাম ।
হঠাৎ করে বাড়ির পেছন থেকে শুকনা পাতার উপর দিয়ে কারো হাটার শব্দ কানে আসল । ভাবলাম হয়ত রফিক মিয়া কিন্তু এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ । কে, জিজ্ঞেস করতেই রফিক মিয়া বলে উঠল, স্যার আমি । রাতের খাবার কখন খাবেন জিজ্ঞেস করতে এসেছিলাম ।
প্রত্যন্ত অঞ্চল সবাই তারা তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যায়, এইটাই স্বাভাবিক । আমার জন্য তাদের কষ্ট করে জেগে থাকতে হবে ভেবে রফিক মিয়াকে টেবিলে খাবার দিতে বললাম। বাড়িতে এই মুহুর্তে আমি আর রফিক মিয়াই আছি শুধু । এদিকটায় এই সময় কারো আসার কথা নয়। রান্নার লোক রান্নার কাজ শেষ করে সন্ধ্যার আগেই চলে গিয়েছে । ভাবতে ভাবতে রফিক মিয়া আবার কড়া নাড়লো । খাবার সময় দেখলাম রফিক মিয়া কেমন যেন চুপচাপ হয়ে আছে । আমিও চুপচাপ খাওয়া শেষ করে এসে লেখায় মন দিলাম । হটাৎ মনে হল পেছনের জঙ্গল দিয়ে কাউকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে । কিছুক্ষণ পরপর চাপা গোঙ্গানির শব্দও পাচ্ছি । একবার মনে হলো যাই জানালা খুলে দেখি পরক্ষণেই মনে হলো ভুল শুনেছি । আবার লেখায় মনযোগ দেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু মাথায় রফিক মিয়ার কথা এবং কিছুক্ষণ আগের ঘটনা ঘুরতে থাকে ।
চার
ভুত প্রেতে বিশ্বাস আমার ঠিক সেভাবে কখনো ছিলো না। ঢাকায় থাকাতে এসবের প্রতি বিশ্বাসের চিন্তা কখনো মাথায় আসেনি। কিন্তু তারপরও রফিক মিয়ার কথা গুলো বার বার মনে হচ্ছে। আমার রাত জাগার অভ্যাস আছে। খাবার শেষে রফিক মিয়াকে চা দিয়ে যেতে বলেছিলাম। গল্প লেখায় মনোযোগ দিলাম। ঠিক ঘন্টা দুই পর রফিক মিয়া চা দিয়ে গেলো । এবং এও বলে গেলো কোন শব্দ শুনে বাহিরে না যাই আর তাড়াতাড়ি যেন ঘুমিয়ে পড়ি। চায়ে চুমুক দিতে দিতে গল্পটার মোর ঘুরানোর চিন্তা করতেই আবার চাপা গোঙ্গানির শব্দ কানে এল।
সেই রাতে আর লেখা হলো না । ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন ঘুম ভাঙ্গল বেশ বেলা করে। ঘুম। থেকে উঠেই দেখলাম চারপাশে বেশ কিছু মানুষের শোরগোল। আমাকে বের হতে দেখেই রফিক মিয়া আমার দিকে আসলেন। কিছু বলার আগে উনি নিজে থেকেই বললো গত রাতে নাকি আরও এক জন মানুষকে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না । আমি ঠিক জানি না যে ওরা আমার কাছে কেন এসেছে ! আমি কোন সরকারি লোক নই কিংবা আমি পুলিশের লোকও নই । তবে এই গ্রামে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা কম । সেই হিসাবে আমার কাছে এরা আসতেই পারে ! আমি লোকগুলোর সাথে বের হলাম । আমার নিজেরও খানিকটা কৌতুহল হচ্ছে !
তারপর কয়েকদিন ভালো ভাবেই চলে গেলো। এর মধ্যে চেয়ারম্যানের মেয়ের সঙ্গে বেশ কয়েকবার দেখা হয়ে গেলো। বেশ চমৎকার মেয়ে । নাম অর্পা। বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞানে পড়ছে । এই মেয়ে অনেক দিন ধরেই নাকি এই গ্রামে রয়েছে । মেয়েটার পড়ালেখা এখনও শেষ হয় নি । এই সময়ে এখানে সে কেন বসে আছে সেই ব্যাপারটা আমার ঠিক মাথায় ঢুকছে না !
কদিন আগে চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে কিছু পুলিশ এসেছিল। প্রথমে ভেবেছিলাম যে গ্রামে যে খুন গুলো হচ্ছে সেই ব্যাপারে কথা বলতে কিন্তু পরে বুঝলাম এই পুলিশ সাধারণ পুলিশ না । ডিবির লোকজন ! অর্পার এক বন্ধুকে খুন হয়েছে ভয়ংকর ভাবে। শুধু তাই নয়, হত্যার পরে লাশ ক্যাম্পাসের ব্যাচেলর চত্তরের আম গাছে ঝুলিয়ে রেখেছে কেউ ।
অর্পার যেদিন হল থেকে গ্রামে আসে তার আগের দিন এই ছেলের সঙ্গে তুমুল ঝগড়া হয়েছিলো কিছু একটা নিয়ে ! তারপরই অর্পা গ্রামে চলে আসে ! এবং তারপর দিনই ছেলেটাকে কেউ খুন করে ওভাবে ঝুলিয়ে রেখে চলে যায় ! আমি সামনেই ছিলাম । আমার সামনেই সব কথা বার্তা হল । চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, আমার মেয়েটা একটু নরম মনের । বন্ধুর সাথে ঝগড়া হয়েছে এই কারণেই সে চলে এসেছে । এখন যদি শোনে সে মারা গেছে তাহলে খুব কষ্ট পাবে ।
একজন অফিসার বলল, তা বুঝতে পারছি ।
আমি খানিকটা অবাক হয়েই দেখলাম যে চেয়ারম্যান সাহেব লোক গুলোকে ফিরিয়ে দিল । ব্যাপারটা আমার মাথায় ঢুকলো না ।
রাতে খেয়ে আবারও সেদিনের শুরু করা গল্পটা শেষ করার জন্য ল্যাপটপটা নিয়ে বসলাম। তখনই চাপা গোঙ্গানির শব্দে চুপ হয়ে গেলাম। মনে সাহস নিয়ে জানালাটা আস্তে করে খুলতেই পঁচা গন্ধ এসে আমার নাকে লাগলো । আমি নাকে হাত দিয়ে সামনে তাকাতেই তীব্র আলোর ঝলকানিতে আমার চোখ অন্ধকার হয়ে এল । সেই সাথে মাথার ভেতরে একটা সুতীব্র ব্যাথা অনুভব করলাম । সাথে সাথেই মাটিয়ে লুটিয়ে পড়লাম আমি ।
পাঁচ
যখন জ্ঞান ফিরলো তখন বেশ অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে, বুঝতে পারলাম বাইরের তীব্র আলোর ঝলকানি দেখে। ধীরে ধীরে উঠে বসতে বসতে মনে করার চেষ্টা করলাম গত রাতে ঠিক কি হয়েছিলো। কিছুটা সময় লাগলেও ধীরে ধীরে সবটাই মনে পড়লো। আমি জ্ঞান হারিয়েছিলাম আমারই ঘরের জানালার সামনে। চমকে উঠে চারপাশে তাকালাম। মাথায় অসহ্য ব্যাথা, সাথে চোখেও কিছুটা ঝাপসা দেখছি।
কিছুটা সময় পর চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক হয়ে এলে বুঝতে পারলাম আমি অচেনা একটি ঘরের মেঝেতে পড়ে রয়েছি। আমার পাশের দেয়ালে লাগোয়া বিশাল জানালা দিয়ে সূর্যের আলো আসছে। জানালাটি আমার ঘরের জানালা থেকে কমপক্ষে দ্বিগুন বড় তো হবেই। যে ঘরে আছি সেটিও বেশ বড়। রুমের একপাশে পুরান আমলের বেশ বড় একটি পালংক আর তার পাশেই বেশ সুন্দর কারুকাজ করা আয়না। পুরো ঘরেই আভিজাত্যের ছাপ। আমি যখন সবকিছু অবাক হয়ে দেখছি তখনই হঠাৎ ঘরের দরজা খুলে গেল। কয়েকজন লোক হাত-পা বাঁধা একটি মেয়েকে পাঁজাকোলা করে ঘরের ভেতর নিয়ে এসে পালংকে ফেলে দরজা বন্ধ করে আবার চলে গেলো। মেয়েটি মুখ বাঁধা তাই চেহারা চিনতে পারলাম না। পরনে শাড়ি আর প্রচুর গয়নাগাটি। বেশভূষা বেশ আভিজাত্যপূর্ণ। আমি কিছুটা অবাক হলাম। লোকগুলো আমার দিকে ফিরেও তাকালো না। আমি উঠে ধীরে ধীরে মেয়েটির দিকে এগোলাম। মেয়েটিকে দেখেই মনে হচ্ছে ক্লান্ত, একদম নেতিয়ে আছে। খুব সম্ভবত এতোক্ষন চিৎকার-চেঁচামেচি, ধস্তাধস্তি করেছে। অনেক্ষণ ডাকার পরেও মেয়েটার কোন সাড়া পাওয়া গেলো না। আমি মেয়েটার মাথায় হাত ছোঁয়ানোর জন্য যেই হাত বাড়ালাম, বিস্ফোরিত চোখে দেখলাম আমার হাত মেয়েটির মাথা ভেদ করে চলে যাচ্ছে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো আমার। হঠাৎ করে আমার কি যেন হলো, একটা আতংক গ্রাস করে নিল যেন আমায়। দু হাতে মাথা চেপে ধরে কয়েক পা পিছনে চলে এলাম।
আমার পাশেই সেই কারুকাজ করা আয়নাটি। হাঁসফাঁস করতে করতে আয়নার দিকে তাকাতেই আরেক দফা চমকে উঠলাম। আয়নায় আমার কোন প্রতিচ্ছবি নেই। আমার সারা শরীর অসার হয়ে গেছে। হতবাক হয়ে আমি আয়নার দিকে তাকিয়ে আছি। এমন সময় ঘরের দরজা আবার খুলে গেলো। এবার কাঁচাপাকা চুলের সৌম্যদর্শন এক বৃদ্ধ ঘরে ঢুকলো। বৃদ্ধের গায়ে পুরোহিতদের মতো ধূতি ও জপের মালা। যা ভেবেছিলাম তাই হলো। লোকটিও আমাকে দেখতে পেলো না। আমাকে ভেদ করেই মেয়েটির দিকে এগিয়ে গেলো। মেয়েটি হঠাৎ বিদ্যুৎ বেগে উঠে বৃদ্ধের পা জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করলো। কিন্তু হাত বাঁধা থাকার কারণে সেটা পারলো না। কেবল পুরোহিত গোছের মানুষটার পায়ের কাছে গিয়ে জড় হল । মেয়েটির ফুঁপানি শুনে লোকটিকে বরং বেশ বিরক্ত হতে দেখলাম। সে মেয়েটির চুল ধরে নির্দয়ের মতো বিছানায় ফেললো। আমি আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে বুঝতে পারছি এখানে কি হতে যাচ্ছে। আমার ধারণাকে যেন সত্যি প্রমাণ করতেই লোকটি পশুর মতো মেয়েটির উপর ঝাপিয়ে পড়লো। লোকটির চোখে পাশবিক উল্লাস স্পষ্ট। আমি নিজের ভেতর মেয়েটিকে বাঁচানোর এক তাড়না অনুভব করলাম। কিন্তু কিভাবে?
আমি না পারছি কাউকে স্পর্শ করতে, না পারছি কারোর সাথে কথা বলতে। এমন মনে হচ্ছে যেন আমি কোন সুদূর অতীতের কোন ঘটনা দেখছি অথবা কারোর কোন অতীত স্মৃতি আমি ছবির মতো চোখের সামনে দেখতে পারছি। যেখানে আমার কোনই ভূমিকা নেই, শুধু দেখে যাওয়া ছাড়া।
তারপরও মেয়েটাকে বাঁচাতে হবে যে করেই হোক। তার গগণ বিদারী চিৎকারে যেকোন পাষন্ডের হৃদয়ও আদ্র হতে বাধ্য। আমি বুঝতে পারছি, হয়তো বা আমি কিছুই করতে পারবো না। উল্টো মেয়েটির উপর ঘটে যাওয়া নির্মম অত্যাচারের সাক্ষী হতে হবে আমাকে।
হঠাৎ এমন সময় আরেকটি কন্ঠের চিৎকার শুনতে পেলাম। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলাম বৃদ্ধের গলার কাছে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। হুট করেই বুঝতে পারলাম কি হয়েছে। মেয়েটি তার খোঁপার কাটা বৃদ্ধের গলায় ঢুকিয়ে দিয়েছে!
মেয়েটির হাত না বাঁধা ছিল !
সেটা খুললো কিভাবে?
বৃদ্ধের চিৎকার শুনেই দরজা খুলে অনেকগুলো লোক ভেতরে ঢুকলো। তাদের ভেতর প্রথমবার মেয়েটিকে এই ঘরে যারা নিয়ে এসেছিলো তারাও আছে। আমি আবার চোখে ঝাপসা দেখা শুরু করলাম। মনে হচ্ছে যেন আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলছি। ঠিক মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগ মুহূর্তে মেয়েটির দিকে তাকালাম। হ্যাঁ! ওকে তো আমি চিনি! ওতো অর্পা! অন্তত দেখতে তো তার মতোই।
আমি আর কিছু ভাবতে পারলাম না। হারিয়ে গেলাম অন্ধকারে।
দ্বিতীয়বার যখন জ্ঞান ফিরলো তখন আমি বিস্তীর্ণ প্রান্তরে। আশেপাশে প্রচুর মানুষ। বেশ সহজেই উঠে দাঁড়ালাম। চারপাশের মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখে বুঝলাম এবারো তারা আমায় দেখতে পারছে না। সামনে তাকিয়ে দেখলাম একটি চিতা যেখানে হাত পা বেঁধে অর্পা কে অথবা অর্পার মতো দেখতে মেয়েটিকে ফেলে রাখা হয়েছে। পাশেই দুইজন লোকের ফিসফিসানি শুনতে পেলাম।
একজন বেশ আফসোস করে বলছে, “জমিদার রামাকান্ত দেব শেষপর্যন্ত নিজের মেয়েটাকে জ্যান্ত চিতায় উঠালো!”
আহাহা করে আরেকজন ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করতে বললো তার সঙ্গীকে।
-চারপাশে জমিদারের লোকজন। তোর কথা কেউ শুনলে আর রক্ষে নেই। আর মেয়েটির দোষ নেই কি বলছিস! এতো দিনের যজ্ঞ ভেস্তে দিলো! শুধু কি তাই, রাজপুরোহিতকে নিজের হাতে হত্যা করেছে এই মেয়ে! এতো সাক্ষাৎ রাক্ষসী।
-তা ঠিক বলেছিস ভাই। আমাদের গ্রামের মঙ্গলের জন্যই না এতোদিন ধরে যজ্ঞ চালাচ্ছিলো জমিদারমশাই। একদম শেষে এসে সব ভন্ডুল হয়ে গেলো। এখন কি আপদ নেমে আসে আমাদের উপর কে জানে!
লোক দুটো আরো কিছু বলার চেষ্টা করছিলো কিন্তু হঠাৎ করেই এক চিৎকারে সবাই সামনে ঘুরে তাকালো। চিতায় আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। অর্পা বা অর্পারূপি মেয়েটার কলিজা ফাটানো চিৎকার আকাশ বাতাসে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। কিছু একটা বলছে মেয়েটি। কিন্তু অবর্ণনীয় যন্ত্রণায় তার কথা বিষবাস্প হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। সবাই কান খাড়া করে রয়েছে মেয়েটি কি বলছে তা বুঝার চেষ্টায়।
অকস্মাৎ আমি বুঝতে পারলাম মেয়েটির কথা,
“আমি, স্বর্ণলতা, আবার ফিরে আসবো। সবকিছু ধ্বংস করবো নিজ হাতে, সবকিছু!”
আবারও মাথার ভেতর তীব্র ব্যথা অনুভব করে জ্ঞান হারালাম।
ছয়
চোখ খুলে দেখি আমার বিছানায় শুয়ে আছি। রফিক পাশে।
-স্যার আমরা ভয় পেয়ে গেছিলাম। সকালে এসে দেখি আপনার দরজা বন্ধ। শেষে দরজা ভেঙ্গে ফেলেছি।
চিন্তিত মুখে রফিক মিয়া বললো কথা গুলো।
আধো আধো শুনলেও আমার মাথার মধ্যে স্বপ্নে দেখা বিষয়গুলো তালগোল পাকাচ্ছে। আচ্ছা সেই স্বর্ণলতা মেয়েটিই কি অর্পা?
আর রামাকান্ত দেব জমিদার কি এমন যজ্ঞ করেছেন এলাকায় মঙ্গলের জন্যে? এলাকার কি এমন মঙ্গল করতে হয় যার কারণে নিজের মেয়ের সম্মান বিলিয়ে দেবার মতো নিকৃষ্ট কাজ করতে হয়।
যদি সত্যিই হয় এসব তাহলে তো থামাতে হবে যুগ যুগ ধরে চলে আসা কিছু কুসংস্কারের সাথে অলৌকিক দৃশ্য!
আগে সব জানতে হবে। কিন্তু কে বলবে এসব?
রফিক কে চা আনতে পাঠিয়ে চিন্তা করছিলাম আমি একজন শিক্ষিত যুবক হয়ে কি না এসব বিশ্বাস করছি। অবশ্য স্বপ্নে যা দেখলাম অবিশ্বাস এর প্রশ্নই আসে না।
-স্যার গরম চায়ের সাথে তাজা ঘিয়ে ভাজা মুচমুচে লুচি খান। ভালো লাগবে।
-আচ্ছা রফিক মিয়া এই এলাকায় কি রামাকান্ত নামে কোন জমিদার ছিল নাকি?
আকস্মিক চমকে আমার দিকে তাকাল রফিক। আমি আবারও বললাম, আমি আসলে তোমাদের এই জমিদার সম্পর্কে জানতে চাই। সাথে জমিদারের মেয়ে স্বর্ণলতার কথা।
হুট করে রফিক যেন অন্য কঠিন মানুষ হয়ে উঠলো। গমগমে গলায় সারসংক্ষেপে একটি কথাই বললো, তাকে যা বলেছি তা যাতে আর কাউকে যাতে না বলি। চেয়ারম্যান সাহেব জমিদারের বংশধর। আর স্বর্ণলতার নাম নেওয়া এই গ্রামে নিষিদ্ধ। যদি চেয়ারম্যান জানতে পারে তাহলে প্রাণ নিয়ে গ্রাম থেকে বেরুনো মুশকিল হবে আমার। এবং এটাও জানতে চাইলো আমি কিভাবে জানলাম জমিদারের কথা।
আমি বললাম
-এমনি আগের নথিপত্রে জমিদার রামাকান্ত নাম ছিল। তাই এইসব জমিদারদের প্রতি আগ্রহ থেকেই জানতে চেয়েছি
রফিক চোখেমুখে অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে থাকলো।
স্যার, ৫ দিন পর পূর্ণিমা। আপাতত কয়দিন সাবধানে থাকবেন।
এই বলে সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল । আর আমি ততক্ষণে নিশ্চিত আসলেই রমাকান্ত জমিদার এবং স্বর্ণলতা সত্যি।
তাহলে কি অর্পা কোন পূর্ণজন্ম?
নাহ এসব মিথ! এলিক্সি অফ লাইফ পুরোটাই মিথ।
সেদিন রাতে চেয়ারম্যানের বাসায় ডালভাতের দাওয়াত পড়লো আমার। চেয়ারম্যানের ডানহাত হরিষচন্দ্র আমাকে নিমন্ত্রণ দিতে এসেছিল। তারে দেখে দিনেই পিলে চমকে যায় আর রাতে দেখলে মনে হয় সাক্ষাত যমদূত সামনে দাড়িয়ে। মুখের মাঝ বরাবর বড় একটা কাটা দাগ। কোনরকম সেলাই করা। এবং সেলাইগুলো দগদগে ঘায়ের মতো। বার বার মনে হচ্ছিল এই লোকটাকে আগেও দেখেছি। কিন্তু মনে পড়ছিল না। অকস্মাৎ মনে হলো সেই স্বপ্নের কথা।
রাজপুরোহিত!
তীব্র অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে থাকলাম প্রকৃতির দিকে। এগুলো সব প্রকৃতির নিয়ম। মানুষের জীবনে বৈচিত্র্য আনতে নানান রকম অলৌকিকতা প্রকৃতি সৃষ্টি করেছে। বৈচিত্র্যের সাথে সাথে হাজারও মানুষের বলিদান হয়।
সন্ধ্যার দিকে বের হলাম চেয়ারম্যানের বাড়ির দিকে। দিন কয়েক আগে এ গ্রামে আসলেও এখন পর্যন্ত চেয়ারম্যানের বাড়িতে যাওয়ার সৌভাগ্য কিংবা দূর্ভাগ্য একটাও হয়ে উঠে নি। দূর থেকেই ছাদে দাড়িয়ে থাকা অর্পাকে দেখেছি শুধু। তবে একটা বিষয় খচখচ করছিল মনের মাঝে তা হলো গ্রামে সাধারণত রাতের বেলা তেমন নিমন্ত্রণ করা হয় না মানুষদের।
চেয়ারম্যানের বিশাল বাড়ি। দেখেই মনে হচ্ছে এই অজঁপাড়া গায়ের বাড়িটায় আধুনিকতা এবং আভিজাত্যের কোন কমতি নেই।
বসার ঘরের মস্ত চেয়ারে জায়গা হলো। তবে বসতেই বিদ্যুৎ চলে গেল। একজন ভৃত্য কিছু মোমবাতি জ্বালিয়ে গেলেন।
বসে বসে চারদিকের আলো আধারির নৃত্য দেখতে দেখতে আসলেন চেয়ারম্যান সাহেব।
মোলাকাত শেষে বললেন, শুনলাম আপনার নাকি জমিদার রামাকান্ত দেব সম্পর্কে জানার অনেক ইচ্ছে। তাই ডাকলাম গল্প করতে। আমি মোহনকান্ত দেব। জমিদারের বংশধর আমি।
হালকা আলোতে উনার ছোট কুতকুতে চোখদুটো জ্বলে উঠলো যেন একবার। সাথে আমার বুকও ধ্বক করে উঠলো। জমিদারের কথা আমি রফিক মিয়াকে ছাড়া কাউকে বলি নি। তবে গ্রামবাসীরাই কি যুক্ত এর সাথে?
এখানে এসে কি ভুল করলাম !
সাত
আমি চেয়ারম্যান সাহেব মহনকান্ত দেবের সামনে নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করলাম। বললাম,কালকে নথিপত্র গুলো ঘাটছিলাম। তখনই জমিদার রামাকান্ত দেবের নামটা পাই। বেশ প্রতাপশালী জমিদার ছিলেন বটে। কিন্তু হটাৎ করে প্রতিপত্তি কমতে শুরু করলো। এটাই মনে খটকা লাগছে।
কথা শেষ হতে না হতেই চেয়ারম্যানের ডান হাত হরিশ চন্দ্রের ধুর্ত হাসি আমার কানে বাজলো। চেয়ারম্যান সাহেবও আমার দিকে তাকিয়ে একটা বিদ্রুপের হাসি দিলেন। যেন বুঝতে পেরে গেছেন আমি তাকে মিথ্যা কথা বললাম। চেয়ারম্যান মহনকান্ত দেব এরপর একটু মাথা নামিয়ে বললেন, রামাকান্ত দেব আমার দাদুর বাবা ছিলেন মানে পরদাদা আরকি । বংশানুক্রমে তিনিও জমিদারি পেয়েছিলেন।বেশ নামও নাকি হয়েছিল উনার। বাবার কাছে শুনেছিলাম। কিন্তু হটাৎ করে তার ছোটো মেয়েটা মরে গেল। স্বর্নলতা নাম ছিল মেয়েটার।এরপর থেকে তার জমিদারিত্বে লোকসান নামতে শুরু করে।পাল্লা দিয়ে প্রতিপত্তিও কমা শুরু হলো এরপর। তিনি আর লাভের মুখ দেখেননি। আচ্ছা শোনো বাবা, তোমাকে বাবাই বলছি। তুমি তো আমার ছেলের বয়সীই হবে।এই জমিদার তার মেয়ে এসব নিয়ে ঘাটাঘাটি করিও না। তোমার এনজিওর কাজ ঠিক মতো করো। আর এখন বিশ্রাম কর যাও।
আমি চুপ করে শুনে গেলাম শুধু। এরপর চেয়ারম্যান মহনকান্ত দেব হরিশ চন্দ্রকে কিছু একটা ইশারা করে রুমের ভেতরে ঢুকলেন। তারপর হরিশচন্দ্র আমার কাছে এসে আবার আগের মতো করে সেই ধুর্ত হাসিটা দিয়ে বলল, “এই ছোকড়া আগেও তোর মতো এনজিও কর্মীর জমিদার রামাকান্ত দেবের ব্যাপারে একটু বেশিই আগ্রহ ছিল। যার কারনে তাদের চাকরি ছেড়ে চেলে যেতে হইছে। তুই চাকরি বাঁচাতে চাইলে যা কিছু জেনেছিস সবকিছু ভুলে যাওয়াই তোর জন্য মঙ্গল। নাহলে আগের গুলোর মতো তোরও একই অবস্থা হবে। এই বলে শাসিয়ে চলে গেল চেয়ারম্যানের ডান হাত হরিশ চন্দ্র।
আমি কেবল মাথায় একরাশ কৌতুহুল আর বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলাম হরিশ চন্দ্রের চলে যাওয়ার দিকে। বার বার শুধু মনে হতে লাগলো আমার এই লোকটা ঠিক আগের মতোই আছে। এর স্বভাবের একটুও পরিবর্তন হয় নি। কিন্তু অন্যপাশে আর এক জায়গায় চোখ আটকে গেল আমার, একটু দুরে দরজার কাছে দাড়িয়ে থাকা চেয়ারম্যান মহনকান্ত দেবের মেয়ে অর্পার ভাবলেশহীন মুখটা আমার দিকে পলকহীন ভাবে তাকিয়ে আছে।
আট
আজকের স্বপ্নটা আসলেই কেমন যেন। কেন যে এমন স্বপ্ন দেখেছিলাম আজকে। মহনকান্ত দেবের আচরনও অন্যরকম ঠেকল আমার।অনেক কিছুই লুকিয়েছেন তিনি আমার কাছ থেকে। আর তার ডান হাত হরিশ চন্দ্র!! আমি নিশ্চিত আমার আজকের স্বপ্নটার সাথে ওদের দুজনের কানেকশন আছেই।
“বাবু, খেতে আসুন। খাবার দিচ্ছি।” রফিক মিয়ার ডাকে চিন্তার ছেদ ঘটলো আমার।
খেতে খেতে রফিক মিয়াকে জিগ্যেস করলাম, জমিদারের কথাটা আপনি চেয়ারম্যান সাহেবকে গিয়ে বলেছিলেন না?
রফিক মিয়া কিছুটা সংকোচ নিয়ে বলল, হ্যা বাবু। চেয়ারম্যান সাহেবই আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন। আসলে হয়েছে কি আপনার আগে যারা এখানে এসেছিলেন তারাও আসার কয়েকদিনের মধ্যে স্বপ্নের মাধ্যমে জানতে পারতো জমিদার রামাকান্ত দেব আর তার মেয়ে স্বর্ণলতার কথা। তারপর তাদের ব্যাপার এ জানতে চাইতো। সেজন্য চেয়ারম্যান আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন এরকম কিছু হলেই যেন তাকে জানিয়ে দেই। আর চেয়ারম্যান সাহেবও তার পুর্বপুরুষের গল্প তাদের শোনাতে পারবেন।
আমি কিছুক্ষন চুপ থেকে রফিক মিয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম, আপনি তো এ গ্রামেরই বাসিন্দা। আপনি কি আমাকে পুরো ঘটনা টা বলতে পারবেন? আসলে কেন স্বর্নলতাকে ওরকম পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছিল?
রফিক মিয়া আবারও তখনকার মতো নাহ নাহ বলে মাথা ঝাকাতে লাগলেন। বললেন,আমি সকালে যেটা বলেছিলাম ওটা ছাড়া কিছু জানিনা আর। পুরো ঘটনা চেয়ারম্যান এর বাড়ির লোকজন ছাড়া খুব কম লোকই জানে। ওই লোকগুলোও যেন আর কাউকে না বলে সে ব্যবস্থাও করে রেখেছেন চেয়ারম্যান সাহেব। এই স্বর্ণলতা নামটা মুছে ফেলার জন্য এমন কোনো কাজ নেই যেটা করেননি চেয়ারম্যান সাহেব।
-আচ্ছা তাহলে এটা বলুন, ওই যে ঘন জঙ্গলটার ভেতরে পোড়া বাড়িটার কথা একটু বলুন।
-কি বলবো বাবু, ওই পোড়া বাড়িতে আর কেউ যায় না ভয়ে। ওখানেও নাকি অনেক কিছু দেখা যায়।
আমি আর কিছু বললাম না রফিক মিয়াকে। ও জানলো যে জমিদার আর তার মেয়ের ব্যাপারে কিছু বলবে না। তাই রুমে এসে ল্যাপটপটা নিয়ে বসে পড়লাম। এরপর কিছুক্ষণ গুগলে ঘাটাঘাটি করলাম যদি কিছু লেখা থাকে জমিদার রামাকান্ত দেব আর স্বর্ণলতাকে নিয়ে। কিন্তু দু একটা আর্টিকেল ছাড়া কিছুই খুব একটা চোখে পড়ল নাহ। আর্টিকেল গুলোতেও বেসিক সব কথা লেখা। যত সময় যাচ্ছিল স্বর্ণলতার ব্যাপারে কৌতুহুলটা যেন আরও বাড়ছিল। শেষ পর্যন্ত একটা সিদ্ধান্ত নিয়েই নিলাম।
নয়
ছোট রাস্তাটা একদিকে বড় রাস্তার সাথে যুক্ত হয়েছে। আর অন্যদিকটা চলে গেছে ঘন জঙ্গলটার ভেতরে। এই রাস্তাটা দিয়ে গেলেই হয়তো পোড়া বাড়িটা পাওয়া যাবে। রফিক মিয়া সহ এই সকাল সকাল রওনা দিয়েছি পোড়া বাড়িটার উদ্দেশ্যে। রফিক মিয়ে প্রথমে রাজি হচ্ছিলেন না। বারবার শুধু বলছিলেন আর কয়েকদিন পর পুর্নিমা। এদিক সেদিক গেলে বিপদ হতে পারে। জঙ্গলে গেলে বিপদ হতে পারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাজি করিয়েছি তাকে। যেতে যেতে দেখা হলো হরিশ চন্দ্রের সাথে। আমাকে দেখে তার ধুর্ত হাসিটা দিয়ে বলল, এই ছোকড়া,ওদিকে জঙ্গলের দিকে কই যাস? তোকে বলেছি না জমিদারের ব্যাপারে নাক গলাবি নাহ? নিজেই নিজের বিপদ ডেকে আনতে চাচ্ছিস নাকি?
জবাবের অপেক্ষা না করে উলটো পথে বড় রাস্তাটার দিকে চলে গেল হরিশ চন্দ্র। আমরাও আমাদের পথ ধরলাম। যত এগোচ্ছি তত মনে হচ্ছে গাছগুলো ঘন হয়ে আসছে। আর আশ্চর্যজনক নিরব হয়ে আছে জঙ্গলটা। দিনের বেলা দুজন থাকার পরও কেমন অসস্তি লাগছে।পাশে রফিক মিয়াকে দেখলাম চুপচাপ হাটছে শুধু। বুঝলাম বেচারা ভয়ে আছে। জঙ্গলের আরও একটু ভেতরে আলোটাও একটু কমে এসেছে। আর একটু এগুতেই পোড়াবাড়ির চুড়া টা দেখতে পেলাম। এর আগে যে ইটের মতো লাল রঙের ছিল চুড়াটা এটা এখনও সুন্দর মতো বোঝা যাচ্ছে।
ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম পোড়া বাড়ির দিকে। নিস্তব্ধ জঙ্গল সাথে ভুতুড়ে পরিবেশ আপনা-আপনি গা ছমছমে অনুভূতি সৃষ্টি করে দেয়। চতুর্দিকে প্রাচীর ঘেরা পোড়া বাড়ির প্রাচীর প্রায় ধ্বসে গিয়েছে। জঙ্গলে বিলীনপ্রায় কাঁচা পথ সরাসরি বিশাল এক রাজকীয় ফটকে শেষ হয়। অদ্ভূত হলেও প্রধান ফটকের ছিটকিনি খুলে হালকা ধাক্কা দিতেই ফটকটা স্বাভাবিকভাবে খুলে যায়। অথচ পোড়া বাড়ির ভগ্নদশা দেখে আন্দাজ করা যায় এখানে মানুষের যাতায়াত নেই বহুদিন। বিষয়টা খানিকটা খটকা তৈরী করে।
এতক্ষণে রফিক মিয়ার দিকে আবার তাকাতেই দেখলাম রফিক মিয়ার মুখ শুকিয়ে গিয়েছে, খুব সম্ভবত ভয়ে। পরিবেশটা যেমন হয়ে আছে তাতে নিজেরও একটু ও ভয় লাগছে না এমনটা বলা অবশ্য মিথ্যা হয়ে যাবে। রফিক মিয়া বলেই বসলো, বাবু! ভিতরে আপনি যান, আমি যেতে পারবো না। অগত্যা টর্চ হাতে রফিক মিয়াকে অপেক্ষা করতে বলে একা পোড়া বাড়িতে প্রবেশ করলাম। বাড়ির প্রবেশদ্বারে হালকা ধাক্কা দিতেই প্রধান ফটকের মত এটিও খুলে গেলো। ধীর পায়ে ভবনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে চারপাশে গভীর দৃষ্টি বুলালাম।
আশ্চর্যজনক যা চোখে পড়লো তা হচ্ছে দেয়ালে একটি ছবি রাখা। সাইজ অন্তত ৭’ বাই ৫’। চতুর্দিকে ধুলোর আস্তরণ চোখে পড়লেও ছবিটা একদম পরিষ্কার হয়ে আছে। যেন একটু আগেই কেউ ছবিটা মুছে গিয়েছে। কাছে যেয়ে ছবিটা খানিকটা নাড়াচাড়া করতেই টের পেলাম পেছনে কিছু একটা আছে। কৌতুহল বসত ছবিটা ডানে হেলিয়ে দিতেই চোখে পড়লো সুন্দর কারুকাজ করা এক দরজা। ভেতরে ঢোকার চিন্তা হতেই ছবিটা দেয়াল থেকে খুলে পাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে রাখলাম। দরজার গোল হাতল ঘোরাতেই খুলে গেলো এক অন্ধকার কক্ষ। টর্চের আলো জ্বালিয়ে ভুল ভাঙলো। সামনে কোন কক্ষ নয় বরং নীচের দিকে রয়েছে এক পাতালকক্ষের সিড়ি। গভীরভাবে লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় নিয়মিত যাতায়াত হয় এই রাস্তা এক বা একাধিক ব্যক্তির।
সিড়ি বেয়ে একেবারে নীচে নামার পর আবিষ্কার করলাম এক বিশাল হলঘর। সে হলঘরে দেয়াল ভয়ংকর সব মূর্তিতে ভরা। ডানদিকের দেয়ালে একটা দরজা চোখ পড়তেই দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লাম ভিতরে। বিস্ময়ের শেষ সীমায় পৌছলাম কারণ ঘরটা অজ্ঞান থাকাকালীন সময়ে দেখা ঘরটির মত, হুবহু। আচমকা আবার সেই তীব্র আলোর সৃষ্টি হলো। সেদিনের মতই মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রণা অনুভব করে লুটিয়ে পড়লাম মাটিতে।
দশ
আমি আর স্বর্ণলতা বসে আছি জমিদারবাড়ির পুকুর ঘাটে। স্বর্ণলতা নিদারুণ সাজে উপস্থিত হয়েছে আর আমার পরণে ধুতি পাঞ্জাবি। আমার সামনে দৃশ্যগুলো এমনভাবে ঘটে চলতে শুরু করলো যেন আমি কোন মুভি দেখছি। দুজনে পুকুরের দিকে আনমনে তাকিয়ে থাকার সময়েই স্বর্ণলতা বলে উঠলো, দেখো অপু! আমার বাবা দিনদিন কেমন যেন নিষ্ঠুর আচরণ করছে আমার প্রতি। আমি জানি না এর কারণ কী! কিন্তু বাবা আর রাজপুরোহিতের মাঝে আমাকে নিয়ে কিছু আলোচনা হতে শুনেছি। সম্ভবত আমার সাথে খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে যা আমি নিজেও জানি না।
আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই স্বর্ণলতা উঠে দাঁড়ালো। ‘আসা অনেকক্ষণ হয়েছে, সন্ধ্যার আগে বাড়ি না ফিরলে আবার অত্যাচার করবে। চলো।’ এই বলে স্বর্ণলতা আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। অগত্যা উঠে হাঁটা শুরু করলাম। মনে মনে ভাবছি কি হতে চলেছে স্বর্ণলতার জীবনে।
হঠাৎ চিত্রপট পালটে গেলো। এবারের দৃশ্যে আমি নেই কিন্তু আমার সামনে স্বর্ণলতার বাবা রামাকান্ত দেব আর রাজপুরোহিত কথা বলছে।
-একটা বিষয় নিয়ে কিছুদিন যাবত চিন্তিত পুরোহিত মশাই। সম্পদের অপদেবতা গদ্রবঙ্গার সাধনা করি আপনি জানেন। বিভিন্ন সময়ে তার চাহিদা আমি পূরণ করতে পারলেও এবারে কিছুটা সমস্যায় পড়েছি। গদ্রবঙ্গার এবারের চাহিদা পূর্ণিমায় জন্ম নেয়া অষ্টাদশী কুমারী মেয়ের দেহ। পুরো গ্রামজুড়ে এমন কাউকে আমি পাচ্ছি না।
খানিকটা সময় নিরবতার পর রাজপুরোহিত বলে উঠলেন আপনার মেয়ে স্বর্ণলতা তো পূর্ণিমায় জন্মেছে না? ওর বয়স তো সম্ভবত এই পূর্ণিমায় আঠারো হতে যাচ্ছে।
এই ভয়টাই পাচ্ছিলো রামাকান্ত দেব। নিজের সন্তানকে এভাবে বিসর্জন দেয়াটা অত্যন্ত কঠিন। অপরদিকে যজ্ঞের এই শেষ মূহুর্তে হেরে যাওয়ার ইচ্ছাও তার নেই। গদ্রবঙ্গার কথা অনুযায়ী এতকাল অল্প অল্প দিয়ে এলেও এবারে তার চাহিদা পূরণ করলে সে এত বিপুল সম্পদ দেবে যা নাকি আমার চৌদ্দ পুরুষ ও দেখেনি।
শুধুমাত্র বললেন, হুম ঠাকুরমশাই, আচ্ছা চলুন উঠি। একটু কাজ আছে ।
এই বলে ঘর ছেড়ে হনহন করে বাইরে বেরিয়ে গেলেন জমিদারমশাই।
মূহুর্তেই দৃশ্যপটের পরিবর্তন। এবারে আমি আরেক অচেনা জায়গায়। পুরোহিত নিজের সাথে নিজেই কথা বলছে।
জমিদারের মেয়েটার এবার বিসর্জন পাকা। মেয়েটার এত সুন্দর রূপ, তার দেহের গড়নটাও চমৎকার। কাজের ফাকে আচলটা পড়ে গেলে যা দেখা যায় তা একবার ভোগ না করতে পারলে জীবনটা বৃথা। জমিদার যেহেতু মেয়েকে বিসর্জন দেবে তাই এই সুন্দর দেহটা ভক্ষণের কিছু চেষ্টা করা যেতে পারে।
এভাবে অবচেতন মনে কতক্ষণ ছিলাম বুঝতে পারিনি। চেতনা ফিরল রহিম মিয়ার ডাকে। সে আমার পাশে বসে ডাকছে, হাতে টর্চ লাইট। টর্চের আলো একবার আমার মুখের উপর ফেলছে আবার আশেপাশে দেয়ালের দিকে। তার চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে ভয়ে তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ আমার জন্য বাইরে অপেক্ষা করছিলেন, কিন্ত শেষে আমি বের না হওয়ায় সাহস করে ভিতরে ঢুকে পড়েছে আমাকে খুঁজতে। আমার চোখ মিটমিট করে তাকানো দেখেই হন্তদন্ত হয়ে রফিক মিয়া বলে উঠলেন,
-স্যার উঠেন! কি হইছে আপনার? সন্ধ্যা হইয়া আইলো। আপনে হেই যে ভিতরে আইলেন আর বাইর হন না। একা বাইরে ডর ডর লাগতেছিলো। বের হন না দেইখা একবার চইলা যাইতে নিছিলাম। আপনারে ভিতরে রাইখা চইলা যাই কেমনে, কন।
মাথা টা ঝিম ধরে আছে। রুমটার ভিতরে কতক্ষণ পড়ে ছিলাম মনে নেই। আস্তে ধীরে উঠে বসলাম। রফিক মিয়া বারবার বলছে,
-স্যার বাইরে আইন্ধার হইয়া যাইতাছে। চইলা যাওন লাগবো তো, উঠেন! রাইত হইলে জঙ্গল দিয়া যাওন মুশকিল।
আস্তে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে আমি চারপাশটা ভালভাবে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। আমার সেই প্রথম দিনের অবচেতন মনে দেখা বড় কক্ষ যেন আমার চোখের সামনে বাস্তবে দেখতে পাচ্ছি! সেই বড় পালঙ্ক, যেখানে সব লোক মিলে হুবহু অর্পার মতো দেখতে স্বর্ণলতাকে নিয়ে এসেছিল! চারপাশে বেশ সুন্দর কারু কাজ করা। অন্দরমহলের দরজা দিয়ে হালকা আলোর ঝলক এসে পড়ছে পাশে।
রহিম মিয়ার তাড়া হুড়ো করায় আস্তে ধিরে বের হয়ে আসলাম সেই কক্ষ থেকে। বাইরে সত্যি সত্যিই অন্ধকার নেমে এসেছে। টর্চের আলো জ্বালিয়ে এগোতে থাকলাম সামনের দিকে। বের হওয়ার পথে পেছনের দিকে টর্চের আলো ফেললাম একবার! এখন আর আগের মত ভয় লাগছে না, মনের মধ্যে কেমন যেন সাহস বোধ করলাম। পুর্বে ঘটা ঘটনা গুলো যেন চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। বুঝতে পারছি কি ঘটেছিল স্বর্নলতার সাথে। সেই স্বপ্নে শোনা চিৎকার যেন আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি নিজের ভিতর।
কেও যেন আমার কানের কাছে বলছে,
“আমি স্বর্ণলতা, আমি আবার ফিরে আসবো। সবকিছু ধ্বংস করবো নিজের হাতে, সবকিছু!”
আমি আর রহিম মিয়া টর্চের আলোর দ্রুত পা ফেলে এগোচ্ছি। ভয়ের পরিবর্তে আমি নিজের ভিতর এক ধরনের ক্ষোভ অনুভব করলাম। যেভাবেই হোক চেয়ারম্যানের সামনে হরিশ চন্দ্র নামক রাজ পুরোহিতের মুখোশ ফাঁস করতেই হবে। আর এসব কিছুতে মাত্র একজন ই আছে যে আমাকে সাহায্য করতে পাড়ে। হ্যাঁ অর্পা!
যেভাবেই হোক অর্পার সাথে যোগাযোগ করতে হবে। ওর থেকে জানতেই হবে, ওর নিজের ভেতর লুকিয়ে থাকা স্বর্নলতা সম্পর্কে ও কতটা জানে! সত্যিই কি জানে, নাকি সব-ই আমার নিছক কল্পনা?
এসব ভাবতে ভাবতে আমরা প্রায় বাসার কাছাকাছি এসে গেছি। পুরো রাস্তায় রহিম মিয়া আমার সাথে একটি কথাও বলেন নি। ঘরে ঢোকার আগে রহিম মিয়াকে বললাম, আমি গোসল করে ফ্রেশ হয়ে নিচ্ছি, তুমি দেখো কি রান্না হয়েছে। রান্না শেষ হলে খাবার টা রুমে দিয়ে যেও।
সে “আচ্ছা” বলে, গামছা কাঁধে নিয়ে চলে গেলো।
এগারো
আমি রুমে গিয়ে কল চেপে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করে নিলাম। গোসল শেষে রুমে এসে গামছা দিয়ে মাথা মুছচ্ছি, তখন রহিম মিয়া খাবার নিয়ে রুমে আসলো। তার চোখে মুখে এখনও ভয়ের ছাপ স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। টেবিলে খাবার দিয়ে চুপচাপ চলে যাচ্ছিলো। দরজার সামনে থেকে আবার ঘুরে এসে গামছা দিয়ে মুখ টা মুছে, কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। আমার দিকে তাকিয়ে। মুখ কাচুমাচু করে বললো, স্যার, আমি যে আপনার লগে পুড়া বাড়িডায় গেছিলাম। দয়া কইরা কাউরে কইয়েন না। চেয়ারম্যান সাব জানলে সমস্যা হইয়া যাইবো।
আমি তাকে অভয় দিলাম, নিশ্চিন্তে থাকো, কেও জানতে পারবে না। বাসায় গিয়ে খেয়ে ঘুমিয়ে যাও।
রহিম মিয়া যাওয়ার পর আমি খেয়ে নিলাম। বাবুর্চির রান্নার হাত বেশ ভালো। ঢাকায় মেসে খেতে খেতে যে এক ঘেয়েমি চলে এসছিলো এখানকার বাবুর্চি তা খুব সুনিপুন ভাবে ভুলিয়ে দিয়েছে।
অফিসের কিছু কাজ বাকি ছিলো, ল্যাপটপ টা নিয়ে বসলাম। পরশুদিন ঢাকায় যেতে হবে। প্রধান শাখা থেকে ফোন করেছিলো। একদিনের একটা কর্মশালা আছে ঢাকায়, সকল শাখার ম্যানেজারদের ডাকা হয়েছে। এর আগে যে করেই হোক সবগুলো কাজ শেষ করতে হবে। হিসাব বই দেখে ডাটাগুলো এক্সেলের শীটে এন্ট্রি করতে করতে সারাদিনের ক্লান্তি চোখে ভর করলো। ল্যাপটপটা স্লীপ মুডে দিয়ে ঘুমিয়ে গেলাম।
পরের দুই দিন অফিসের কাজের চাপে এসব সম্পর্কে আর ভাবার অবকাশ পেলাম না। সারাদিন অফিসের কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। কাজ শেষ করে বাসস্ট্যান্ড হয়ে বাসায় ফিরছি। রাত তখন পনে আটটার মতো বাজে। অফিসের কাজ শেষ করে, ঢাকা যাওয়ার জন্য হানিফ বাসের টিকিট কেটে জঙ্গলের পাশে রাস্তা দিয়ে বাসায় ফিরছিলাম। চারপাশে শুনশান নিরবতা।
বাসায় ফিরে হাতমুখ ধুয়ে, পরদিন সকালের জন্য ব্যাগ গুছিয়ে শুয়ে পড়লাম। সকাল সাড়ে সাতটায় বাস ছাড়বে ঢাকার উদ্দেশ্যে। এতো সকালে কিছু পাওয়া যাবেনা রাস্তায়৷ বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত হয়তো হেটেই যেতে হবে। রহিম মিয়াকে সকাল বেলায় নাস্তার কথা বলা ছিলো। সাড়ে পাঁচাটায় এলার্ম দিয়ে রাখলাম মোবাইলে।
সাড়ে পাঁচটায় মোবাইলে এলার্ম বেজেছে ঠিকই, কিন্ত ঘুম ভাঙলো পনে ছয়টার দিকে রহিম মিয়ার ডাকাডাকি তে। উঠে তাড়াহুড়ো করে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে বেরিয়ে পড়লাম। যা ভেবেছিলাম তাই। পুরো রাস্তায় কোনো রিকশা অটো কিছুই পেলাম না। হেঁটে আসতে হলো বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত।
বাসে উঠে আমার সিটে বসতে গিয়েই তো আমার চক্ষু চরকগাছ! আমার পাশের সিটে জানালার পাশে বসে আছে অর্পা। নিজের চোখ কে যেন বিশ্বাস করতে পারছো না। জিজ্ঞেস করলাম, আরে আপনি! অর্পা না? কোথায় যাচ্ছেন।
– হ্যাঁ অপু সাহেব, আমিই। ভার্সিটি তে ব্যক করছি। আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
মেয়েটি আমার নাম ধরে ডাকছে দেখে একটু অবাক হলাম।
-আমি ঢাকায় যাচ্ছি একটু কাজে। কিন্ত আপনি আমাকে চিনেন! আমার নাম ও জানেন?
-হ্যাঁ জানি।
-কিন্ত কিভাবে?
-আমার বাসায় দাওয়াত খেয়ে আসলেন অথচ আপনার নাম জানবো না? আপনাকে তো আমিই দাওয়াত করেছিলাম।
-কিন্ত আমাকে চিনলেন কিভাবে!?
-আচ্ছা বসুন তো আগে। সব কথা কি এখন ই শুনতে হবে নাকি? গাড়ি থেকে তো আর এখনি নেমে যাচ্ছি না। যেতে যেতে কথা হবে।
আমি চুপচাপ তার পাশের সীটে বসে পড়লাম। স্বর্ণলতা আর অর্পাকে নিয়ে হাজারো প্রশ্ন মাথায় এসে ভীর করলো। যে করেই হোক, প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁযে বের করতে হবে।
বারো
অর্পা কিছুটা গম্ভীর হয়ে প্রশ্ন করে উঠলো, “আপনি কেন এইসব ঝামেলায় পড়ছেন? কেন গেছিলেন পোড়া বাড়ি? “
আমি অবাক হলাম এই কথা অর্পা জানলো কী করে তবে কি হরিশ কিছু বলেছে? আমার মনের কথা অর্পা যেন শুনতে পেল।
এবারে একটু নরম হয়ে বলল, তোমার সাথে কথা বলার সুযোগ পাইনি আগে। আজকে রহিম মিয়া আমাকে বলল, তুমি নাকি ঢাকায় যাচ্ছো। তাই ভার্সিটি যাওয়ার কথা বলে আমিও এলাম। অবশ্য আর একটা কাজও আছে আমার।”
-কি বলবেন আমায়?
আমি কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে বললাম।
-ওরা খুব ভয়ংকর মানুষ অপু। এক বার তোমায় হারিয়েছি আর ওদের আমি তোমার কোনো ক্ষতি করতে দেবো না।
সবটা আমার মাথার ওপর দিয়ে গেল, আমি জিজ্ঞাসা করলাম প্লিজ আমায় খুলে বলুন সবটা l
ওই জঙ্গলের বাড়ির কী রহস্য ? কী কানেকশন আমাদের, কেনো আমি স্বপ্নে বারবার দেখি আপনায়, কেন ওই হরিশ আপনার সাথে……….
অর্পা কিছুক্ষন অসহায় ভাবে তাকিয়ে বলতে শুরু করল, ‘আমাদের এই গ্রামে বাস ছিলো সাঁওতাল উপজাতিদের। এরা সাধনা করত অপদেবতা গদ্রবঙ্গার। এই গদ্রবঙ্গা কোনো সাধারণ দেবতা নয়।
গদ্রবঙ্গার সাধনাও খুব কঠিন, প্রতি পূর্ণিমা তিথিতে একটি করে মানুষের বলি দিয়ে তাকে তুষ্ট করতে হয়। দেবতাকে তুষ্ট করতে পারলে যেমন অসীম বৈভবের সন্ধান কোনো কারণে সাধক যদি এই বলি দিতে অক্ষম হন তাহলে সাধকের ওপর ই নেমে আসবে চরম আঘাত।
গদ্রবঙ্গা নৃশংস হত্যালীলা চালায়।
আমাদের পূর্ব পুরুষেরাও এই অপদেবতার উপাসনা করত, স্বর্ণলতা কেও এই জন্যই মরতে হয়েছিল।”
আমি বিস্ময়ে তাকিয়ে আছি অর্পার দিকে কি বলছে এই মেয়ে। বললাম, তারমানে আপনি বলতে চাচ্ছেন জমিদার রামাকান্ত দেব নিজের সম্পদ আর প্রতিপত্তি বাড়ানোর লোভে নিজের মেয়েকেই অপদেবতা গদ্রবঙ্গাকে উৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন?”
“হ্যা, জমিদার রামাকান্তদেব সাঁওতালদের সর্দারের কাছে গদ্রবঙ্গার কথা জেনে নিয়েছিল। তারপর প্রাসাদের গুপ্ত কক্ষেই গদ্রবঙ্গাকে পৃথিবীতে নামিয়ে আনার আয়োজন করা হয়। অপদেবতা গদ্রবঙ্গাকে উৎসর্গ করার মতো উপযুক্ত মেয়ে পাওয়া যাচ্ছিলনা। তাই জমিদার রামাকান্ত দেব নিজের লোভকে সংবরণ করতে না পেরে নিজেরই অষ্টাদশী কন্যা স্বর্ণলতাকে উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নেন। আর তারপরের ঘটনা তো জানোই।
-হ্যা,তা আছে। কিন্তু আপনি এসব কিছু জানলেন কি করে? গুগলে ঘেটেছিলাম আমি। কিচ্ছু পাইনি।
অর্পা একটু হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার মতো আমিও এই স্বপ্ন গুলো দেখতে পাই। প্রথমে ঠিক করে বুঝতে না পারলেও ক্রমশ সবটা পরিষ্কার হয়েছে। পোড়াবাড়ির ভেতরেই একটা পুরাতন লাইব্রেরি আছে। ওখানেই পুরোনো একটা আধপোড়া নথিপত্রের মধ্যে পেয়েছিলাম এসব। সেটা থেকেই অনেকটা ধারনা হয়েছে আমার।
আমিই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম কেবল অর্পার দিকে। সে আবার শুরু করল, স্বর্ণলতা মৃত্যুর পর সাঁওতালদের বৃদ্ধ সর্দার এই অপদেবতা কে আটকায়। কিন্তু এখন হরিশ আর বাবা মিলে আবার এই গদ্রবঙ্গার পূজা শুরু করেছে। গ্রামের এই খুনগুলোও এই জন্যই।
-এখন তাহলে কি করতে চাচ্ছেন আপনি?
সে বলল, এখন যত দ্রুত সম্ভব ওদের আটকাতে হবে, গদ্রবঙ্গার অশুভ শক্তি ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে, নাহলে পুরো গ্রাম ধ্বংস হয়ে যাবে। যা করার আমিই করবো। তবে তোমায় আমি এসবের মধ্যে পড়তে দেব না ,তুমি আজই ঢাকায় ফিরে যাবে। আর ফিরে আসবে না !
-আমি সাথে সাথে বলে উঠলাম, কখনই না। আপনায় এই বিপদে ফেলে আমি কোথাও যাব না।
নিজের কন্ঠস্বর নিজের কাছেই অচেনা লাগছে। আমি তো অর্পাকে ভালো মতো চিনিও না। তাহলে ওট জন্য এত চিন্তা কিসের আমার?কিন্তু সেটা প্রকাশ না করে বললাম, যদি এর মোকাবেলা করতে হয় তবে এক সাথে করবো। এখন এটা বলুন এই গদ্রবঙ্গাকে শেষ করার উপায় কি?
অর্পা স্তিমিত কন্ঠে বলল,”গদ্রবঙ্গাকে শেষ করার মতো ক্ষমতা আমার নেই। যেই সর্দার জানতো সেও এখন বেঁচে নেই।
-তাহলে উপায়?
-এখন একমাত্র একজনই আছে যে আমাদেরকে সাহায্য করতে পারে। সেজন্যই আজকে ঢাকায় যাচ্ছি।
তের
এনজিও তে কাজ শেষ করে বের হতেই মনে হলো একটু চা খাওয়া দরকার করা করে। টং এর দোকানে বসে চা এর অর্ডার দিয়ে বসলাম। এই কয়দিন এ কি কি হলো ভাবতে লাগলাম। অর্পা কে হাজার জোর করবার পরেও একজনটা কে বলল না,শুধু এই টুকু বলল সময় হলে জানাবে। এই বলে আমার নম্বরটা রেখে দিল।
-আরে,অপু না?
পিছনে ফিরেই ভার্সিটির বন্ধু আসিফকে দেখতে পেলাম।
-আসিফ?
-তুই ত ব্যাটা একেবারে উধাও হয়ে গেলি হঠাৎ করে।
আসলে কোথাও চাকুরী হচ্ছে না বলে এড়িয়ে চলতাম সবাইকে। একসাথে বসে অনেক কথা বলা হলো। কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলাম, তুই ত ইতিহাস নিয়ে ভালোই পড়াশোনা করতি, জমিদার রামাকান্ত দেব এর সম্পর্কে জানিস কিছু?
তখন আসিফ বলল, আমি এ সম্পর্কে তেমন কিছু জানিনা কিন্তু আমারই ডিপার্টমেন্টে একজন স্যার ছিলেন, উনি হয়তো কিছু জানতে পারে, বেশিদিন হয়নি রিটায়ার্ড হলেন। উনার বাসায় গেলেই উনাকে পাওয়া যাবে।
বিশ্বনাথ দাসকে তার বাসায় গিয়েই তাকে পাওয়া গেল। আপাতদৃষ্টি তে গম্ভীর মনে হলেও আসলেই মিশুক, তবে কথার মাঝে হঠাৎ হঠাৎ কই যেন হারিয়ে যান।
আমি আর আসিফ একপাশের সোফায়, স্যার সামনাসামনি আরেক সোফায় বসা। কেমন গম্ভীরতা ছেয়ে আছে পুরো রুমে।রাজা রামাকান্ত দেব নামটা শুনতেই উনি এক ই রকম ভাবে চেয়ে আছেন, যেন খুব ভয়ংকর কিছু বলে ফেলেছি।
-নাম টা আবার বল !
অনেকক্ষণ পর বললেন উনি।
-জ্বি, রামাকান্ত দেব।
-আচ্ছা!
এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলা শুরু করলেন।
-আমার দাদার নাম ছিল করমচন্দ্র দাস। উনি ছিলেন রাজা রামাকান্ত দেবের খুবই বিশ্বস্ত কর্মচারী। রাজা জংগলে শিকার করতে গিয়ে, রাণী মারাতঙ এর দেখা পান, যিনি ছিলেন সাঁওতাল দের সর্দার এর কন্যা। এক নজর দেখেই তাকে পছন্দ করে ফেলেন এবং বিয়ে করেন। সাঁওতাল বংশধর হয়েও রাণী গদ্রবজার এর পূজা পছন্দ করতেন না। রাজপুরোহিত যতবার ই রাজাকে লোভ দেখান রাণীর জেদ এ রাজা ততবার ই পিছিয়ে যান। তাই পূর্ণিমা রাতে রাজপুরোহিত সন্তান প্রসব এর পর রাণী কে সুযোগ বুঝে অপহরণ করে গোপন কুঠরিতে নিয়ে আসেন এবং তাকে একটা কুকুর এ পরিণত করে দেন। আর রাজাকে বলেন যেহেতু বংশপরম্পরায় রাণী অপদেবতার পূজার ধারা বজায় রাখেনি তাই দেবতা ক্ষিপ্ত হয়ে রাণীকে বলি হিসেবে নিয়ে যান। যদি রাণী কে বলি হতে বাঁচাতে হয় তবে তাকে এই অপদেবতার পূজো শুরু করতে হবে। রাজা এই ভয়ে আর কিছু টা লোভে ও পূজা করতে রাজি হন এবং গোপনে অনেক মানুষের বলি দিতে শুরু করেন।
রাজপুরোহিত রাজাকে ভুলভাল বুঝিয়ে তার ছোট মেয়ে কে দাসী হিসেবে মন্দিরে রেখে দেন, কিন্তু সুযোগ এর অভাবে কখনো কিছু করতে পারতেন না।
ছোট রাজকন্যা যত বড় হয়, তার রূপ তত বাড়তে থাকে। একদিন গদ্রবজা পূর্ণিমাতিথি তে জন্ম নেয়া মেয়ের বলি চান। রাজপুরোহিত এইবার যেন সুযোগ পেয়ে যান। আমার দাদার উপর দায়িত্ব ছিল ছোট রাজকন্যা কে সবসময় দেখে রাখার আর তাই রাজপুরোহিত দাদা কে সম্পত্তির লোভ দেখিয়ে রাজার কানে রাজকন্যার নামে বিষ ঢুকাতে থাকেন। রাজা আস্তে আস্তে তার মেয়ের সাথে দূরত্ব বাড়িয়ে দেন, ঘৃণা করতে শুরু করে দেন। রাজপুরোহিত একদিন সাধারণ এক ছেলের সাথে রাজকন্যাকে দেখে ফেলেন। তাকে ছেড়ে দেবার জন্য রাজপুরোহিত এর কাছে হাতজোড় করেন, উনি তাকে আশ্বাস দেন কিছু করবেন না এবং রাজামশাই কেও জানাবেন না কিন্তু এক ভয়ংকর পরিকল্পনায় তার চেহারায় বিদ্রুপাত্নক হাসি ফুটে উঠে।
বলির আগের দিন তিনি রাজা কে দিয়ে রাজকন্যা কে এই বলান যে, উনি রাজপুরোহিত এর কথায় আশ্বস্ত হয়ে তার পছন্দের মানুষের সাথে তার বিবাহ ঠিক করেন। রাজকন্যা খুশি তে লজ্জারাঙা হাসি দিয়ে চলে যান সে ঘুণাক্ষরেও টের পায়না তার সাথে কি হতে চলেছে।
রাজপুরোহিত বলির পূর্বে মহাযজ্ঞের প্রারম্ভিক পূজার জন্য তার গোপন কুঠুরি তে রাজকন্যা কে নিয়ে আসার পরিকল্পনা জানান, রাজা সম্মতি দিয়ে দিলেও আমার দাদা তার বিশ্বত কর্মচারীকে তার সাথে পাঠান। কিন্তু আমার দাদা সেদিন রক্ষক হয়ে ভক্ষক এর সাথী হয়ে যান। রাজকন্যা যখন বিয়ের সাজে সব জানতে পারেন তিনি বারবার দাদার কাছে মিনতি করেন কিন্তু তারা তাকে রাজপুরোহিত এর কামরায় রেখে আসেন। ওইদিন ঘটনাক্রমে রাজপুরোহিত মারা গেলে আমার দাদা সব দোষ চাপিয়ে দেন রাজকন্যার ঘাড়ে, রাজাকে একটু ও জানতে দেন না প্রারম্ভিক পূজার নামে তারা কি করতে গিয়েছিল তার সাথে। রাজা ক্রোধে চিতায় জ্যান্ত পুড়িয়ে ফেলেন তাকে, পুড়বার সময় রাজকন্যার অভিশাপ আর আবার ফিরে আসার কথা দাদা ভুলতে পারতেন না। অপরাধবোধে তিনি ভেঙে পড়েন যখন এই ঘটনার দুই দিন পর তার নিজের মেয়ে পূর্ণিমাতিথি তে নিজেই নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্নহত্যা করেন তার সামনেই। তখন তার মেয়ে রূপি রাজকন্যা বলতে থাকেন সবাই কে সে শাস্তি পেতে হবে, কাউকে ক্ষমা করব না।
এই বলে বিশ্বনাথ দাস চোখ মুছে কিছুক্ষণ বাইরে ব্যস্ত রাস্তায় অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার বলতে শুরু করেন, এই ঘটনার পর থেকে তাদের বংশে জন্ম নেয়া প্রতিটা মেয়ে ১৮ বছর হবার পর ই পূর্ণিমাতিথিতে নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্নহত্যা করে নেন। কোনভাবে যদি তাকে দূরেও রাখা হোক না কেন ওই রাতেই একটা সময় নিজে থেকেই তার শরীরে আগুন জ্বলতে থাকে। এবং এটা ততদিন পর্যন্ত চলবে যতদিন না রাজকন্যা আবার জন্ম নিয়ে তার প্রতিশোধ পূর্ণ না করেন।
পুরো ঘটনা শুনে আমি কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করলাম যে স্বর্ণলতার পুনর্জন্মের কথাটা বিশ্ব বাবুকে বলা ঠিক হবে কি না। অন্তত এই অপশক্তি ঠেকাতে উনি সাহায্য করতে পিছপা হওয়ার কথা না। উনার পরিবারও পূর্বপুরুষের অপকর্মের জন্য কম ভোগান্তি সহ্য করছে না। আসিফ সাথে থাকায় আপাতত না জানানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। এই ঘটনা যত কম জানাজানি হবে ততই ভালো। আর একটা খটকা লাগল মনের ভেতর। উনি যদি সবই জানেন আর প্রায় তিনপুরুষ ধরে নিজ পরিবারের মেয়েদের এভাবে অসহায় মৃত্যু দেখে আসছেন, তাহলে কেন কিছু করলেন না এতদিন। পুরো ঘটনা অর্পাকে না জানিয়ে কারো সাথে আলাপ করা ঠিক হবে না ভেবে আসিফ সহ বেরিয়ে আসলাম। ফিরতে ফিরতে আসিফ বলল আমাকে কি সব আজব কথা স্যারের। হুট করে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, স্যারের ছেলেমেয়ে কয়জন। ভাবলেশহীন ভাবে বলল তিন মেয়ে।
সিগারেটের ধোঁয়াটা যেন মুখের ভেতরই বিষম খেল আমার। আসিফ কে দেখে নিশ্চিত হলাম ও এই খটাকাটা ধরতে পারে নাই। পুরোটা সময় ও অবশ্য মোবাইল গুতাচ্ছিল, ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছিল গার্লফ্রেন্ডের সাথে তুমুল ঝগড়া হচ্ছে। যাই হোক, নিজ থেকে কিছু না বলে কাজটা ভুল হয় নাই।
রাতটা আসিফদের বাসায় কাটিয়ে দেয়ার প্লান করলাম। ওকে খুব একটা উতফুল্ল মনে হল না। রাতে ওর গোপনীয়তা দরকার। কিন্তু আমার আসলে উপায় নাই। রাতটা পরিষ্কার মাথায় চিন্তা করা দরকার। অনেকগুলো প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। বিশ্ববাবুকে পেয়ে যাওয়া টা বেশ কাকতালীয় ব্যাপার। উনার পূর্বপুরুষের এমন লজ্জাজনক ইতিহাস আমার মত অপরিচিত একজনের সামনে বা আসিফের সামনে এভাবে অকপটে বলে ফেলার কথা না। তাহলে কি হরিশ্চন্দ্র আর এই বিশ্ববাবুর কোনো যোগাযোগ এখনো আছে? তাদের পূর্বপুরুষদের অসম্পূর্ন যজ্ঞ তারা একসাথে পরিপূর্ণ করতে চাচ্ছে? এভাবে একের পর এক মানুষ উধাও হয়ে যাওয়া বা একের পর এক মানুষের হুট করে ওই জায়গা ছেড়ে চলে আসার কারণ এবার মূল সহ উপড়ে ফেলতে হবে। এর শেষ দেখতেই হবে। স্বর্ণলতা যা পারে নি অর্পাকে সেটা করতেই হবে। অর্পার কথা মনে হতেই আমার মনটা হাহাকার করে উঠল। হুট করে মনে হল এত কারণের তো আমার দরকার নেই। এই মেয়েটাই তো আমার সবচাইতে বড় কারণ। যত বড় বিপদই আসুক বা যত প্রবল প্রতিপক্ষই হোক না কেন এই গদ্রবংগা আর তার চেলাদের এবার চিরতরে নির্মূল করবই করব।সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে চোখটা একটু লেগে এল।
ঘুম ভাংল অর্পার ফোনে।
চৌদ্দ
ফোনের শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো । ঘুম ভাঙতেই পাশে আসিফ কে ঘুমন্ত দেখতে পেলাম। ফোন কানে নিতেই ওপাশ থেকে অর্পা বলে উঠলো, অপু, তুমি এখনই ওই বাসা থেকে বের হও। ওরা তোমাকে মেরে ফেলবে !
খুব ই অবাক হলাম ওর কথায়। মাথায় কিছু ঢুকছে না। আমাকে কে এখানে মেরে ফেলবে? বললাম
-মানে? কি বলছো এসব?
আসিফ? এই ভাবতেই পাশে ঘুমন্ত আসিফ এর দিকে তাকালাম।
অর্পা বলল, আস্তে কথা বলো, আসিফ উঠে যাবে।
এবারে আরো অবাক হলাম। ও কিভাবে আসিফ কে চিনে? আর ও যে আমার সাথেই ঘুমাচ্ছে সেটা কিভাবে ও জানলো।
-অপু? অপু?
বারবার ডাকতে লাগলো অর্পা।
-হমম! হমম! তুমি কিভাবে..!!
-এখন কোন কথা না, চুপচাপ বের হয়ে যাবে। আমি যেভাবে বলবো সেভাবে সেভাবে করবে।
বলে থামলো অর্পা।
আমি বাধ্য ছেলের মতো চুপচাপ ওর কথা মতো খাট থেকে নেমে বাইরে যাবার দরজা খুলতে যাব, ঠিক তখনই অর্পা বলে উঠল, দরজা ছুবেনা !
-তুমি!!..
-সব পরে জানবে। তোমার পকেট এ হাত দেও একটি মুর্তি পাবে ছোট ওইটা হাতে ধরে দরজার বিপরীত পাশে দেয়ালের সামনে ধরে রাখো।
থামল অর্পা। অবাক হয়ে পকেট এ হাত দিতেই ছোট একটা মূর্তি বের হয়ে এলো, কোথায় যেন দেখেছি এটা! কিসের মূর্তি হতে পারে হাতে নিয়ে দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবতে ভাবতেই কিছুক্ষণ পর এই আধো অন্ধকারেও পরিষ্কার দেখতে একটা সরু রেখা দেখতে পেলাম যেটার উৎশ দেয়াল। ভালো ভাবে লক্ষ করতেই দেখতে পেলাম পুরো দেয়াল জুড়ে ঘুর্ণির মতো একটা সরু আলো কয়েকশ আলো তে বিভক্ত হয়ে ঘুরছে…আমার চোখ বিস্ময়ে আটকে যাচ্ছে।ফোনের ওপাশ থেকে এখন কেমন মন্ত্র উচ্চারণের শব্দ শুনা যাচ্ছে। হঠাৎ ই ওই আলো আমাকে অদ্ভুত ভাবে টানতে লাগলো যেন কোন অদৃশ্য চুম্বক আমাকে টেনে তার ভিতরে নিয়ে যাচ্ছে সাথে সাথে হাতে রাখা ফোন থেকেও খুব জোড়ে মন্ত্র উচ্চারিত হতে লাগলো।
একসময় হেচকা টানে এটি আমাকে টেনে নিল। কোথাও ছিটকে এসে পড়লাম।
অনেক আলো থেকে স্বল্প আলোতে এসে পড়লে চোখ যেমন সব অন্ধকার দেখে আমার ও তেমন লাগতে লাগল। আস্তে আস্তে কম আলোতেও চোখে দেখতে পেলাম যেই মাটিতে আছড়ে পড়েছি সেটা কেমন লালচে, যেন এই মাটি রক্ত খেকো। উপরে তাকাতেই দেখতে পেলাম, আকাশ গুমোট অন্ধকারে ছায়া।
পিছনে ফিরতেই আবছা দেখতে পেলাম একজন মেয়ে বেশে কেউ আমার দিকেই আসছে, গায়ে হয়ত অনেক গয়না জড়ানো আবার তাকাতেই দেখলাম সাধারণ সালোয়ার কামিজ পড়া কেউ আসছে আবার তাকাতেই পূর্বের রূপেই দেখলাম। কি হচ্ছে আমার সাথে?
বারংবার যেন রূপ পালটিয়ে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। কাছে আসতেই পরিষ্কার বুঝলাম মেয়েটি স্বর্ণলতা, আবার বেশ পালটে সে হয়ে গেল অর্পা।
চিনতে পারলেন কি এই জায়গাটিকে? বলে সামনে দাঁড়ালো অর্পারূপী স্বর্ণলতা ।
ফুসতে লাগল স্বর্ণলতা।
স্বর্ণলতা হাত দিয়ে ইশারা করতেই আমার চোখের সামনে কিছু একটা ভেসে উঠলো। আরে এটা তো এই জায়গাই। এই সেই গাছ কিন্তু ওখানে কি সুন্দর সবুজে ঘেরা পুরো জায়গা টা আর এখানে সব কিছু কেমন ভয়ংকর রাক্ষুসে হয়ে আছে যেন কত যুগ ধরে তার প্রতিশোধ এর আগুনে জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে গেছে।
হঠাৎ আমার সামনেই দেখতে পেলাম এই আমি কে, একটা ধুতি আর পাঞ্জাবি পড়া। অর্পার সাথে বসে হাত ধরে কথা বলছি আর হাসছি। আমার যেন আবছা কিছু মনে পড়তে লাগল সাথে প্রচণ্ড মাথায় যন্ত্রণা আর সামনে স্বর্ণলতার হাসিতে কান ফেটে যাচ্ছে, একসময় সহ্য করতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে গেলাম।
স্বর্ণলতা… বলে ডাক দিলাম আমি।
গায়ে অনেক গয়না জড়ানো রাণী বেশে স্বর্ণলতা আমার দিকে পিছন ফিরে তাকালো হাসি মুখে।
-অপু, তুমি এখানে? আর কিছুক্ষণ পরেই আমাদের বিয়ে হবে আমার সত্যি সব স্বপ্ন লাগতেছে। কিন্তু লগ্নের আগে তুমি কেন এলে? যাও নয়ত রাজপুরোহিত জানতে পারলে খুব রাগ করবে।
তখন ই পিছন থেকে বের হয়ে এলো রাজপুরোহিত।
এবার যেন স্বর্ণলতা ভয় পেল আমাকে আর পুরোহিত মশাইকে একসাথে দেখে।
রাজপুরোহিত বলে উঠলো, অপু ও আমার গোলাম। কোন ভালবাসাটাসা নেই। সব ই আমার চাল। আর আজ তোমাদের বিয়ে নয় বলি হবে তোমার আর সেজন্যই তোমার পিতার কাছে তোমাকে খারাপ বানাতে আমার এত আয়োজন আর তার আগে তুমি হবে আমার ভোগ !
বলে উল্লাসে হেসে উঠল রাজপুরোহিত।
স্বর্ণলতা অবিশ্বাসের দৃষ্টি তে তাকিয়ে রইল আমার দিকে,আমি আস্তে আস্তে বের হয়ে এলাম জানি এখন ই তাকে ভোগের জন্য নিয়ে যাওয়া হবে তার গোপন কুঠুরিতে।
বের হতেই সামনে এলো নায়ারা, রাজকুমারী স্বর্ণলতার সখী আর আমার ভালোবাসা ভাবতেই মুখে হাসি ফুটে উঠল তার।
পূর্ণিমাতিথিতে নায়ারার জন্ম, কিন্তু তাকে বাচানোর জন্যই রাজপুরোহিতকে গুটি হিসেবে ব্যবহার করে এত কিছু কিন্তু রাজপুরোহিত শুধু জানে ১০০ স্বর্ণমুদ্রার জন্য আমার এত কিছু করা। আর করমচন্দ্র দাস তার মেয়ে নায়ারাকে বাঁচাতে এতদিন আমাদের গোপনে দেখা থেকে শুরু করে সবকিছু তে সাহায্য করেছে, স্বর্ণলতা ভাবতো সে করমচন্দ্রকে ফাঁকি দিতো কিন্তু সে ছিল আমাদের সবারই নজরবন্দি পাখি!
আর ঠিক তখন ই আমার চোখ খুলে গেল। সামনে দাঁড়িয়ে স্বর্ণলতা আর তার পাশেই একটা আলো ছোট থেকে বড় হয়ে একজন মহিলার রূপ নিলো।
সেই মহিলাটি ক্রুদ্ধদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কি ভেবেছিলি এত সহজে পার পেয়ে যাবি? তোর করা পূর্বজন্মের পাপের জন্যই তোর ভালোবাসার মানুষ মারা পড়েছে, করমচন্দ্রের বংশের সব মেয়ে মারা পড়েছে।
এবার স্বর্ণলতা বলে উঠল, মহনকান্ত দেব আর হরিশচন্দ্রকে দিয়ে প্রতি পূর্ণিমা তিথিতে আমিই বলি দেওয়াই। এই জনমে তুমি যতজনকে ভালোবাসবে সবাই এই ভাবেই মারা পরবে । অর্পাকে তোমার পছন্দ হয়েছে না, সেও যাবে ঐ পথেই….
যেমন করে হঠাৎ করে এসেছিলো তেমনি করে সব মিলিয়ে গেল । আমি আবিস্কার করলাম সেই দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে।
এক হাতে ফোন, অন্য হাতে মূর্তি।
পিছনেই আসিফ ঘুমিয়ে আছে খাটে। কললিস্ট এ অর্পার কোন নাম নেই।
আমি কি এতো সময়ে স্বপ্ন দেখলাম ? আস্তে আস্তে আমার কাছে সব কিছু কেমন যেন পরিস্কার হয়ে গেল । কেমন করে আমি এই এনজিওর চাকরিটা পেয়ে গেলাম ! কেমন করে ঠিক এই ঐ স্থানে হাজির হলাম । আমার তো এখানে কোন ভাবেই যাওয়ার কথা ছিল না । তাহলে আগের জীবনে করা পাপ আমাকে পিছু ছাড়ছে ন।
ঠিক সেই সময়েই আমার ফোনটা বেজে উঠলো । আমি মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দেখি অর্পা ফোন দিয়েছে । ফোনটা রিসিভ করতেই অর্পার ভয়ার্ত কন্ঠ আমার কানে এলো । সে কোন মতে বলল, ওরা আমাকে ধরে নিতে আসছে !
আমি তীব্র কন্ঠে বললাম, কারা ? কারা আসছে?
কিন্তু অর্পার দিক থেকে কোন জবাব এল না । ওপাশ থেকে হুটোপটির আওয়াজ শুনতে পেলাম আমি । যেন কতগুলো লোক চিৎকার করে কিছু বলছে । আমি বুঝতে পারলাম না । আমি ডাক দিলাম অর্পার নাম ধরে । কিন্তু অর্পা কোন জবাব দিলো না । একটু পরে ঠাস করে ফোনটা পড়ার আওয়াজ এল । লাইন কেটে গেল !
পরিশিষ্ট
এই পর্যন্ত বলে অপু আহমেদ থামলেন । সাব্বির আর নীলা একভাবে শুনছিলো বৃদ্ধ ভদ্রলোকের গল্প । মাস খানেক আগে সে ওদের পাশের ফ্লাটে ভাড়া এসেছেন । একাই থাকেন । কয়েকদিন আগে সিড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে একটু মাথা ঘুরে উঠেছিল তার । তখন নীলাও সিড়ি দিয়ে উঠছিলো । সাথে সাথে তাকে ধরে ফেলেন । তারপর ফ্ল্যাটে পৌছে দেন । তারপর থেকেই ভদ্রলোকের সাথে ওদের একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে ওঠে । নিজের ফ্ল্যাটে দাওয়াত দিয়ে খাওয়ালেন । আজকেও সেরকম একটা ডাওয়াত ছিল । খাওয়া দাওয়া শেষে নীলা যখন বিয়ে কেন করেন জিজ্ঞেস করলো তখনই সে গল্প শুরু করলো । দুইজন এমন ভাবে তন্ময় হয়ে শুনছিলো যে ভদ্রলোক যে থেমে গেছে সেটার পরেও রেসটা দুইজনের ভেতরে রয়ে গেল কিছু সময় ।
নীলা বলল, তারপর ? তারপর কী হল?
অপু আহমেদ বললেন, তার আসলে আর কোন পর নেই । আমি আর অর্পার দেখা পাই নি । তাকে কে বা কারা কোথায় নিয়ে গেছে সেটাও জানি না । পুলিশও কিছু বের করতে পারে নি ।
সাব্বির বলল, ঐ গ্রামে গিয়েছিলেন কী?
-হ্যা । গিয়েছিলাম । অর্পার বাবাও কিছু বলতে পারে নি । সেও তার মেয়েকে খুজছে আমার মতই।
-ঐ খুন গুলো কি থেমেছিলো?
-জানি না ঠিক । তারপরই ওখান থেকে চলে আসি । আর কাউকে কোন দিন পছন্দ করতে সাহস হয় নি । সে আসবে ! আবারও পছন্দের মানুষটাকে নিয়ে যাবে । আমি ঐ জন্মে তার সাথে যেমন বিশ্বাসঘতকতা করেছিলাম সেই পাপ আমাকে বয়ে নিয়ে যেতে হবে সারা জীবন !
আবারও ভদ্রলোক চুপ করে গেলেন । রাত হয়েছিলো বেশ । নীলা আর সাব্বির নিজেদের ফ্ল্যাটে ফিরে এল । দুইজনের মন বেশ খারাপ ছিল । বৃদ্ধ ভদ্রলোকের জন্য তাদের খারাপ লাগছে । গল্প যেমনই হোক না কেন ভদ্রলোক সে তার কাছের মানুষকে হারিয়েছেন সেটা কোন ভাবেই মিথ্যা নয় ! রাতে নীলা সাব্বিরকে জড়িয়ে ধরে অনেকটা সময় শুয়ে থাকার পরে বলল, তোমার কি মনে হয় আগের জনমের পাপের ফল এই জনমে মানুষ পায়?
-কী জানি !
-তুমি আগের জীবনে কোন পাপ কর নি তো? কোন মেয়েকে ধোকা দাও নি তো !
-কী ! আমি কিভাবে জানবো !
-দিলে খবর আছে কিন্তু তোমার ! আর এই জীবনে যদি আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা মাথায়ও আনো তাহলে একেবারে কিন্তু খবর খারাপ করে দিবো ! ঐ স্বর্ণলতার মত কোন দিন তোমার পিছু ছাড়বো না বলে দিলাম !
সাব্বির কোন কথা না বলে নীলা আরও একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো । এমন কোন কিছু করার কোন ইচ্ছে তার নেই । নীলা ছেড়ে থাকার কথা সে ভাবতেও পারে না ! ধোকা দেওয়া তো অনেক পরের ব্যাপার !
এই গল্পের লেখকগন হচ্ছেনঃ মুসা, সিরাজুল কবির সাকিব, মোন্নাক হোসেন, আফরিন মোহনা, আসফিমা মিমু, শুভ্র দেব, সীফাত হাসান, আসাদুজ্জামান রাকিব, অয়ন্তিকা ঘোষ , সাদিয়া, মালয় কান্তি রায়
অনেক ভালো হয়েছে গল্পটা। মনেই হচ্ছে না গল্পটা অনেকজন মিলে লিখেছে।
12 te rafael er ashar signal dewa hoise..but tarpor ar ashlo nah….sobshesh ekta opurnota niye golpo ta shesh korte holo….