জমিদার বউ

oputanvir
4.8
(93)

মিশু সাইকেলটা তিন রাস্তার মোড়ে এনে থামালো । যদিও এটা ঠিক তিন রাস্তার মোড় না । ও সাইকেল চালাচ্ছে ক্ষেতের রাস্তা দিয়ে । এই রাস্তা গুলো চলে গেছে ক্ষেতের মাঝ দিয়ে । স্পষ্টই এগুলো কেবল ফসল আনা নেওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছে । আশে পাশে কোন বাড়িঘর ও দেখতে পাচ্ছে না । এই সকাল বেলা যতদুর চোখ যায় কেবল ফসলের ক্ষেত আর ক্ষেত । দেখতে এতো চমৎকার লাগছে । এই জন্য সকাল বেলা যখন সাইকেল টা নিয়ে বের হয়েছিলো তখন অন্য কোন দিকে খেয়াল দেয় নি । এমন কী পথ টা মনে রাখার চেষ্টাও করে নি । কেবল সামনের পথ দিয়ে সাইকেল চালিয়ে গেছে । এতো ভাল লাগছিলো যে কেবল সাইকেল চালিয়েই গেছে । বেশ কিছু সময় সাইকেল চালানোর পরে ও যখন ক্লান্ত হয়ে গেল তখন মনে হল যে এখন ফেরা দরকার । বাসায় একদম কাউকে বলে আসে নি । সাথে করে মোবাইলটা পর্যন্ত আনে নি । ঘুম থেকে উঠে কেবল চারিদিকে চোখ বুলানোর জন্য ঘরের বাইরে বের হয়েছিলো । তখনই চোখ পড়ে সাইকেলটার উপর । গ্যারেজে গাড়ি বাইকের সাথে এই সাইকেলটাও দাড় করানো দেখে আর লোভ সামলাতে পারে নি । মিশুর বাবা ঢাকায় কোন ভাবেই ওকে সাইকেল চালাতে দেয় না দুর্ঘটনার পরে । এখন গ্রামে সাইকেলটা চালানো যায় । অন্তত কেউ মানা করার আগে তো যায় ই।

শীতের সকালে তখনও বাড়ির মানুষজন জেগে উঠে নি । সাইকেল নিয়ে যখন বের হতে যাবে তখন কাজের মহিলার মত একজন ওকে দেখছিলো । তবে মুখ দিয়ে কিছু বলে নি । সম্ভবত কিছু বলার সাহস করে নি । মিশু মহিলার দিকে একটু তাকিয়ে তারপর গেট দিয়ে বের হয়ে গেল । গায়ে একটা শোয়েটার পরেই বের হয়েছিলো । গতরাতে জিন্স পরেই ঘুমিয়েছিল । বেশ রাত করেই এই বাড়িতে এসে হাজির হয়েছিলো। এটা মিশুর শশুর বাড়ি । এভাবে সে শশুর বাড়ি আসবে সে কোন দিন ভাবেও নি । যদিও তার এখানে সম্ভবত এটাই শেষ আসা । এখানে সে এসেছে সাদিক অর্থাৎ তার স্বামীর সাথে সব সম্পর্ক শেষ করতে । যদিও কোন সম্পর্ক যদি আদৌও ওদের ভেতরে তৈরি হয়ে থাকে তবে।

মিশু তিনটা রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছু সময় । কোন দিকে যাবে ঠিক বুঝতে পারছে না । এখনও বেশ সকাল । আর শীতের সকাল বলেই হয়তো এখনও মানুষজন নেই আসে পাশে । গ্রামের লোকজন সম্ভবত আরও একটু বেলা করে মাঠে আসবে । মাঠে আসলে তখন কারো কাছে পথ জিজ্ঞেস করে নেওয়া যাবে ।
তত সময়ে মিশু কী করবে?
এখানে এভাবে দাড়িয়ে থাকবে সাইকেল নিয়ে ? নাকি আরও একটু সাইকেলটা চালিয়ে আসবে?

দেখা গেল এরপর আর সাইকেল চালানোর সুযোগই পেল না । তার স্বামী হয়তো বলবে এটা শহর নয়, গ্রাম । এখানে বাড়ির বউদের এভাবে সাইকেল চালানোটা শোভা পায় না ।
কথাটা মনে হতেই মিশু আপন মনে হাসলো । এমন কিছু যে বলবে না সেটার নিশ্চয়তা নেই । বরং না বললেই মিশু অবাক হবে ।

মিশু সাইকেলটা আবার ঘুরাতে যাবে তখনই লোকটার দিকে চোখ গেল । এই শীতের ভেতরেও লোকটার শরীর খালি । কেবল লুঙ্গি পরা । খেজুর গাছে উঠে গাছ সম্ভবত রস নামাতে উঠেছে । রসের কথা মনে হতেই মিশুর লোভ লাগলো একটু । গত শীতে ওরা ক্যাম্পাস থেকে ট্যুরে গিয়েছিলো যশোরের একটা গ্রামে । সেখানই সকালে খজুরের রস খেয়েছিলো সে । এমন চমৎকার স্বাদ ছিল সেই রসটার । এখনও যেন মুখে লেগে আছে । আজীবন ঢাকাতে বড় হওয়া মিশুর সেইবারই প্রথম রস খাওয়া ।
আচ্ছা, একটু কি রস চাইবে লোকটার কাছে ?
ব্যাপারটা কেমন দেখাবে?
না থাকুক ! পরে কাউকে বললে হয়তো কেউ যোগার করে দিবে !

তবে এই লোকটার কাছে বাসায় যাওয়ার পথটা খোজ নেওয়াই যায় । সে নিশ্চয়ই বলতে পারবে।

-এই যে শুনছেন?

মিশু একটু চিৎকার করে ডাক দিলো লোকটাকে । লোকটা ফিরে তাকালো ।
-জে !
-একটু নেমে আসবেন?
লোকটা রসের ভাড়টা কাধে নিয়ে আস্তে আস্তে গাছ থেকে নেমে । তারপর লুঙ্গির কাঁছাটা খুলতে খুলতে বলল, জ্বে আফা !
-এই রস কি খাওয়া যাবে?
একটু লজ্জিত কন্ঠেই বলল মিশু । যদিও সে পথ জানতে চাইবে ভেবেছিলো । লোকটা একটু হাসলো । তারপর বলল, রস খাইবেন? হ যাইবো । কিন্তু কিসে কইরা খাইবেন? গেলাস নাই তো ! ভাড়ে মুখ দিয়া তো খাইতে পারতেন না ।

তাও ঠিক । মিশু তো ভাড়ে মুখ দিয়ে খেতে পারবে না । লোকটা এবার জানতে চাইলেন, আফনে কুন বাড়ি আইছেন? মাস্টর বাড়ি?
-জ্বী না ।

একটু থামলো মিশু । তারপর বলল, জমিদার বাড়ি !

মিশু তখনই খেয়াল করলো লোকটার চোখে বিস্ময় ভাবটা কিভাবে ফুটে উঠছে । লোকটা যেন চিৎকার করে বলে উঠলো, আফনে ছোট জমিদারের বউ !

জমিদারের বউ !
হাসি চলে এল মিশুর মুখে । লোকটা এমন আনন্দ নিয়ে কথা বলল যে লোকটাকে নিরাশ করটে মন চাইলো না । আর এক হিসাবে সত্যিই সে জমিদারেব বউই । মিশু তার বাবার কাছে শুনেছে যে সাদিকরা প্রকৃতই এই গ্রামের জমিদারই । গ্রামের প্রায় সব জমিই ওদের । জমিদারি প্রথা চলে গেলেও এখনও গ্রামের মানুষেরা তাদের জমিদারের মতই সম্মান আর মান্য করে ।

মিশু একটু হেসে বলল, জ্বী !
-মাশাল্লাহ ! আপনে খুউব সুন্দর । ঠিক ছোট জমিদার যেমন আপনেও তেমন । আপনাদের খুউব মানাইছে । আপনে রস খাইবেন । আমি এখনই গেলাসই নিয়া আইতাছি !
-না না শুনুন । এখন রস খাবো না । পরে খাবো । আপনি আমাকে পথটা দেখিয়ে দিবেন ? আমি ঠিক চিনতে পারছি না ।
-দিবো ! একশবার দিবো !

এই বলেই লোকটা চিৎকার করে ডাক দিলো , এই পিটু এই পিটু !

মিশু দেখলো একটা গাছের আড়াল থেকে ছয় সাত বছরের একটা ছেলে বের হয়ে এল । পরনে হাফপ্যান্ট আর একটা লাল সোয়েটার পরা । লোকটা বলল, এই যা ইনারে জমিদার বাড়িতে নিয়ে যা । জমিদার বউ ইনি । ভাল ভাবে নিয়ে যা ।
তারপর মিশুর দিকে তাকিয়ে বলল, আফা, আপনে যান পিটুর সাথে । আর কাইল আমি আপনারে রস খাওয়ামু । এই গেরামের সব থেকে ভাল রস খাওয়ামু কাইল !
-আচ্ছা ! আপনাকে ধন্যবাদ ।

মিশু ভেবেছিলো যে পিটুকে সে নিজের সাইকেলে তুলে নিবে । তবে সেই সুযোগ তাকে পিটু দিলো না । সে সাইকেলের সামনেই দৌড় দিলো । মিশুকে বাধ্য হয়ে তার পেছন পেছনে যেতে হবে ।

যাওয়ার পথে একটা মজার কান্ড হতে থাকলো । মিশু যখন ক্ষেতের পথ ছেড়ে গ্রামের পথ ধরলো তখন দেখতে পেল যে গ্রামের বাড়ি থেকে অনেকেই বের হয়ে এসেছে । ওকে দেখছে । অবশ্য এটার পেছনে দায়ী হচ্ছে পিটু । সে সাইকেলের সামনে সামনে দৌড়াচ্ছে আর চিৎকার করে বলছে যে জমিদারের বউ আইছে গো জমিদার বউ আইছে ।
মিশুর এমন হাসি আসছে । তবে কেন জানি ছেলেটার উৎসাহ দেখে মোটেই তাকে চুপ করাতে ইচ্ছে করলো না । আর গ্রামের মানুষজন এমন ভাবে ওর দিকে তাকাচ্ছে যেন মিশু খুব চমৎকার কিছু ।

দুই
সাইকেল নিয়ে যখন মিশু আবার জমিদার বাড়ির সামনে এসে দাড়ালো তখন একটু অবাকই হল । গতকাল রাতে যখন এই বাড়িতে এসেছিলো তখন বাড়িটা যে এতো বড় সেটা খেয়াল করে দেখে নি । এমন কি সকালে বের হওয়ার সময়েও পেছনে ঘুরে দেখে নি সে । কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছে । সত্যিই যে এটা একটা জমিদার বাড়ি সেটা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই । বাড়ির সামনে বিশাল ফটক । সেখান দিয়েই বড় বাড়িটা দেখা যাচ্ছে । মুল দরজা দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢোকা যায় । ডান দিকেই গ্যারেজ। সেখানেই সাইকেলটা রাখলো মিশু । তখনই দেখতে পেল বাড়ীর দরজা খুলে মিশুর স্বামী সাদিক বের হয়ে এল । গায়ে একটা চাদর জড়ানো। আর ট্রাউজার। ওর দিকে তাকিয়ে বলল, গ্রাম ভ্রমনে বের হয়েছিলে?
মিশু কোন কথা না বলে কেবল মাথা ঝাকালো।
-একটা কান টুপি পরে যেতে! বাইরে ঠান্ডা না?
-সাইকেল চালাচ্ছিলাম। খুব বেশি ঠান্ডা লাগে নি ।
-এসো । ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে নাও !

মিশু একটু আড়ষ্টবোধ করলো। সামনের মানুষটা ওর প্রতি এমন যত্ন কেন দেখাচ্ছে কেন? কোন ভাবে মিশুর সিদ্ধান্ত বদলাতে চাইছে? কিন্তু মিশু তো পরিস্কার ভাবে জানিয়ে দিয়েছে সেটা । সে তো এখানে থাকতে আসে নি । কেবল তার বাবার অনুরোধ রক্ষা করতে এসেছে । এর বাইরে আর কিছু নয় । সে কোন ভাবেই এই গ্রামে থাকবে না । এই গ্রাম ছুটি কাটানোর জন্য হয়তো চমৎকার একটা স্থান । কিন্তু তার পক্ষে কোন ভাবেই এখানে স্থায়ী হয়ে থাকা সম্ভব না । যদি সে বিয়ের আগে জানতো যে সাদিক গ্রামেই থাকে তাহলে কোন ভাবেই রাজি হত না বিয়েতে ।

মিশু যখন দরজার কাছে উঠে এল তখন সাদিক জানতে চাইলো, সকালে কী খাবে?
-কী হয় এখানে? আই মিন সকালে আপনারা কী খান?
-এই বাড়িতে অনেক কিছুই হয় । ক্ষেত আর খামারের লোকেদের জন্য খিচুড়ি রান্না হয় প্রতিদিন সকালে । বাড়ির ভেতরের কাজের লোকেরা ভাত খায় । আমি মাঝে মাঝে ভাত খাই কখনও রুটি অথবা পরোটা খাই । ঢাকা থেকে ভাইয়ারা এলে তাদের জন্য ব্রেড ডিম এই সবের ব্যবস্থা হয় । তুমি কী খাবে ?
-তেল ছাড়া পরোটা আর সাথে কিছু একটা হলেই হল !
-আচ্ছা আমি খালা কে বলে দিচ্ছি।

ওয়াশ রুমের দিকে পা বাড়ানোর আগে হঠাৎ মিশু ফিরলো আবার সাদিকের দিকে । বলল, শুনুন,
-বল ।
-আমি যে এই সকাল বেলা সাইকেল চালিয়েছে এতে এই বাড়ির সম্মানের কোন ক্ষতি হয় নি তো !

সাদিক কিছু সময় মিশুর দিকে তাকিয়ে রইলো । তারপর হো হো করে হেসে ফেলল । হাসতে হাসতেই বলল, বাড়ির বউদের এমন কাজ করতে নেই টাইপের সম্মানের কথা বলছো ! না কোন সমস্যা নেই । সাইকেলটা তোমার জন্যই নিয়ে আসা হয়েছে ।

এটা মিশুকে একটু অবাক করলো । বলল, আমার জন্য?
-হ্যা । তোমার বাবার কাছে শুনেছিলাম যে তুমি সাইকেল চালাতে কি পরিমান পছন্দ করছে । এক্সিডেন্টের পরে তোমার বাবা আর তোমাকে সাইকেল চালাতে দেন নি । তবে এখানে চালাতে পারো যত ইচ্ছে ।

মিশুর আবার মনে হল যে সাদিক চাইছে মিশুকে আটকাটে । সম্ভবত মিশুর বাবাও তাই চাইছে । কোন মেয়ের বাবাই চায় না তার মেয়ের ডিভোর্স হোক । মেয়ের সংসার টিকে থাকুক এটাই সব বাবা মায়ের ইচ্ছে । মিশুর মা তো মিশুর সিদ্ধান্তে খুবই না খুশি । সে কোন ভাবেই চায় না যে সাদিকের সাথে তার ডিভোর্স হয়ে যাক । কিন্তু মিশুর এক কথা, সে কোন ভাবেই গ্রামে থাকবে না । এই তথ্য তার কাছ লুকিয়ে তারপর বিয়ে দেওয়া হয়েছে । এটা জানা থাকলে মিশু কোন দিন বিয়ে করতো না ।

মিশুর এখন বিয়ে করার কোন ইচ্ছে ছিল না । মিশুর পড়াশুনা শেষ হতে এখনও বছর খানেক বাকি । পড়াশুনা শেষ করে বাইরে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল । তারপর নিজের একটা বুটিক শপ দেওয়ার ইচ্ছে ছিল মিশুর । নিজের ডিজাইন করা পোশাক থাকবে সেখানে । কিন্তু মাঝ পথেই মিশুর বিয়ের সম্মন্ধ এসে হাজির । প্রস্তাবটা এমন ছিল যে ওদের পরিবারের কেউ মানা করে নি ।

মিশুর বাবার কলিগ ছেলে । ছেলের দাদী খুব বেশি অসুস্থ । মারা যাওয়ার আগে ছোট নাতীর বউ দেখে মরতে চান । মৃত্যু পথযাত্রী মায়ের শেষ ইচ্ছে পূরণ করার জন্যই বিয়ে । মিশু রাজি ছিল না । তবে আস্তে আস্তে যখন ছেলে এবং ছেলের পরিবার সম্পর্কে জানলো তখন নিম রাজি হল । ওর বাবার কলিগ মানে সাদিক বাবা জয়েন্ট সেক্রেটারি । তার বড় দুই ছেলে একজন ডাক্তার অন্যজন ইঞ্জিনিয়ার । সবারই ভাল চাকরি করে । ছোট ছেলে অর্থ্যাৎ সাদিক বাংলাদেশ কৃষিবিশ্ববিদ্যাল থেকে পড়াশুনা করেছে । ঢাকাতে নিজেদের বিশাল বাড়ি আছে । গ্রামেও বিশাল সম্পত্ত আছে তাদের । বাড়ির সবাই রাজি । তবে মিশু রাজি হল যখন সাদিক তাকে নিজে বলল যে আপাতত বিয়েটা হয়ে যাক । দাদীর শেষ ইচ্ছেটা পুরণ হোক । তারপর মিশুর পড়াশুনা শেষ করে যা যা করতে চায় তারপর বিয়ের অনুষ্ঠান করে তুলে আনা হবে । এই প্রস্তাবটা মিশুর সব থেকে বেশি ভাল লেগেছিল । বিয়েতে রাজিও হয়ে গিয়েছিলো । দুইদিন পরেই ওদের বিয়ে হয়ে যায় । হাসপাতালে ভর্তি দাদীর কাছে মিশুকে নিয়ে যাওয়া হয় । সেখানে মিশুকে বৃদ্ধা একটা বড় গহনা ভর্তি বাক্স উপহার দিলেন । এটা নাকি তিনি মিশুর জন্যই যত্ন করে রেখেছিলেন । পরে মিশু জানতে পারে না দাদীর সব থেকে পছন্দের নাতিচচ্ছে সাদিক । দাদীর সাদিকের সম্পর্ক সব থেকে কাছের । দাদির সাথেই থাকে সে । প্রথমে ব্যাপার মিশু ঠিক ধরতে পারে নি ।

বিয়ের পর সপ্তাহখানেক বেঁচে ছিলেন সাদিকের দাদী । তারপর মারা যান । এরও মাস দুয়েক পরে মিশু আসল ব্যাপারটা ধরতে পারে। সাদিক তার অন্য ভাইদের মত ঢাকাতে থাকে না । সে গ্রামে থাকে । পড়াশুনা শেষ করেই সে গ্রামে ফিরে গেছে । সেখানেই চাষ করে, পুকুরে মাছ চাষ করে গরু আর ছাগলের খামার আছে তার । তার বড় দুই ভাইয়ের থেকে তার টাকা পয়সা আয় অনেক বেশি কিন্তু মূলকথা হচ্ছে সে গ্রামে থাকে

। এবং মিশুকেও গ্রামে থাকতে হবে !

এই কথা জানার পরে মিশু একেবারে বেঁকে বসেছে । সে কোন ভাবেই গ্রামে থাকবে না । মিশুর বাবাও সম্ভবত ব্যাপারটা জানতো না । সে নিজেও মিশুকে ঠিক জোর করতে পারছে না । শেষে ঠিক হল যে ওরা আলাদা হয়ে যাবে । তবে আলাদা হয়ে যাওয়ার আগে সাদিক ওকে অনুরোধ করেছে যে কিছু দিন যেন গ্রামে এসে থাকে । গতকালক রাতে সে এখানে এসেছে কয়েকটা দিন থাকার জন্য।

সকালের নাস্তার পরে মিশু আবারও সাইকেল নিয়ে বের হল । আজকে আবাহওয়া বেশ ঠান্ডা । তবে এই যেন পথ না হারিয়ে ফেলে এর জন্য সাথে আরও একজন ছেলেকে দেওয়া হল । সে দুর থেকে মিশুর উপর নজর রাখবে যাতে সে পথ না হারিয়ে ফেলে ।

তবে সকালের মত এবার হল না । দেখলো গ্রামের মেয়ে বউরা কেমন রাস্তায় দাড়িয়ে রয়েছে । ওকে দাড় করিয়ে ওর সাথে কথা বলছে । একটু কথা বলতে বলতে তাদের কী যে আনন্দ । অনেকে বারবার ওকে নিজেদের ঘরে নিয়ে যেতে চাইলো । কিছু খেতে অনুরোধ করতে শুরু করলো। মিশু হঠাৎ অনুভব করলো এই মানুষ গুলো খুব আন্তরিকতার সাথেই এই কাজ গুলো করছে । এবং এটা তারা করছে কারণ তারা সবাই সাদিককে পছন্দ করে ।

পুরোটা দিনটা মিশুর চমৎকার কাটলো । দুপুরে খাওয়ার পরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে বই পড়তে শুরু করলো । বড় জানালা দিয়ে বিস্তৃর্ণ ফসলের মাঠটা চোখে পড়ছে । এতো চমৎকার লাগলো মিশুর সেটা বলে বোঝাতে পারলো না ।
পরদিন সকালে ঘটলো আরেক মজার ঘটনা । মিশু সেই লোকটার কাছে খেজুরের রস খেতে চেয়েছিলো । পরদিন সকালে মিশু অবাক হয়ে আবিস্কার করলো যে অন্তত বিশ মানুষ বিশটা রসের ভাড় নিয়ে হাজির হয়েছে জমিদার বাড়িতে । সবাই মিশুকে রস খাওয়াতে চায় ।

মিশু চোখ কপালে তুলে বলল, আরে আমি এতো রস কিভাবে খাবো?
পেছন থেকে সাদিক বলল আরে তুমি রস খেতে চেয়েছো তাই তো নিয়ে এসেছে ?
-তাই বলে ২০টা ভাড় । আপনার কি মাথা খারাপ হয়েছে ! এখন কী করবো বলেন ? একজনের না অন্যেরা মন খারাপ করবে?

মিশু সত্যিই অসহায় বোধ করলো। সবারটা সে খেতে পারবে না । একজনের টা খেলে অন্যেরা মন খারাপ করবে । সেটা সে কিছুতেই চায় না । শেষে সাদিক তাকে রক্ষা করলো । বলল যে ভাড় সব গুলো রেখে দেওয়া হোক। কিছু খাবে আর বাকি গুলো থেকে গুড় বানানো হবে । সেটা সে মিশু ঢাকাতে নিয়ে যাবে ।

সাদিক যখন তাদের ভাড়ের বদলে টাকা দিতে গেল কেউ নিলো না । তারা বলল যে এই রস দিতে পেরে তারা আনন্দিত । মিশু কেবল লোক গুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল । সত্যিই যে তারা আনন্দিত সেটা তাদের মুখের ভাব দেখেই বুঝতে পারছে ।

তারপরের দিন গুলোতে মিশুর নানান অভিজ্ঞতা হতে লাগলো । নানান মানুষের সাথে পরিচয় হতে লাগলো । কেবল এই গ্রাম থেকেই নয় পাশের গ্রাম থেকেই মানুষজন জমিদার বাড়িতে আসতে লাগলো কেবল মিশুকে দেখার জন্য । ছোট জমিদারের বউ এসেছে বাসায় । তাকে সবাই এক নজর দেখতে চায় । কেবলই দেখতে চায় তার সাথে কথা বলতে চায় একটা ছবি তুলতে চায় । সবাই কিছু না কিছু উপহার নিয়ে এসেছে সাথে করে । মিশুকে দিবে । ঘরের চালে কুমড়া থেকে শুরু করে তাতের শাড়ি । মিশুর জন্য এটা নতুন ছিল । এমন ভাবে কেউ যে ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারে সেটা মিশুর ধারণার বাইরে ছিল । বারবার কেবল মনে হচ্ছিলো যে এই মানুষ গুলো যখন জানতে পারবে যে মিশু কদিন পরেই এখান থেকে চলে যাবে, আর কোন দিন আসবে না তখন এদের মনের ভাব কেমন হবে !

একদিন শখ করে মিশু একটা শাড়ি পরে ফেলল । শাড়ি পরে যখন দুপুরে খেতে এল সাদিক ওর দিকে তাকিয়ে কেমন থমকে গিয়েছিলো । এই ব্যাপারটা মিশুর চোখ এড়ালো না কিছুতেই । সাদিকের চোখে মুগ্ধতা দেখে মিশুর নিজেরও ভাল লাগলো । সেদিনই সাদিকদের ফ্যামিলি সম্পর্কে আরও অনেক কিছু জানতে পারলো ।

এই বাড়ির ভেতরের দিকটা সবটাই সামলায় সাদিকের দুঃসম্পর্কের এক খালা । বাড়ির রান্নাবান্না, কখন কি হবে কে খাবে এইসবটা সেই মরিয়ম খালাই দেখে। শাড়ি পরে বড়রান্না ঘরের দিকে গেলে খালাও তাকে দেখে বেশ অবাক হলেন । এবং সাথে সাথে খুশিও হলেন। সেই চুলার পাড়ে বসিয়ে গল্প করতে লাগলেন । দুপুরের খাবার শেষ করে আবার রাতের খাবারের আয়োজন শুরু হয়ে গেছে ।

-তোমার দাদী শাশুড়ি ছিল তোমার মত।
মিশু একটু অবাক হল । বলল, আমার মত?
-হ্যা তোমার মত ! এই যে দেখতেছো না গ্রামের সবাই তোমারে খুব পছন্দ করতেছে, তোমার দাদী শাশুড়িতেও সবাই খুব মান্য করতো ।এই যে কদিন আগে সে মারা গেল, তুমি তো আসো নি, গ্রামের মানুষজন কিভাবে তাকে হারিয়ে কান্নাকাটি করছে সেটা যদি তুমি দেখতে ! তোমার দাদা শশুরের বাবা এই গ্রামকে খুব ভালবাসতেন । গ্রামের জন্য তিনি ছিলেন অন্তপ্রাণ । কিন্তু তোমার তার ছেলে মানে তোমার দাদা শশুড় অতোখানি গ্রামের প্রতি টান ছিল না । তবে তার বউ হয়ে এসে তোমার দাদী শাশুড়ির টান ছিল খুব । সে একা হাতে সব কিছু সামলাতেন । তার ছেলে মানে তোমার শ্বশুর মশাই তো গ্রামেই থাকলেন না । কিন্তু সাদিকের আবার কেমন করে যেন এসবের প্রতি টান তৈরি হল খুব বেশি । এটা কি গ্রামের প্রতি নাকি দাদীর প্রতি ভালবাসা থেকে হয়েছে আমি জানি না । হয়েছে এটাই সব থেকে বড় কথা । এতো গুলো মানুষ একটা মানুষের ভরশায় জীবিকা নিয়ে বসে আছে । বয়সে সে অনেক ছোট কিন্তু গ্রামের সবাই তাকে দেখলে ভরশা পায় । তারা জানে যে যে তাদের যে কোন বিপদে এই মানুষটা সবার আগে দৌড়ে আসবে !

মিশু চুপচাপ শুনে যাচ্ছিলো সব কথা । মরিয়ম খালা আবার বলা শুরু করলো, সাদিক চেষ্টা করে গ্রামে হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছে । হয়তো কয়েক বছর পরে কলেজও তৈরি করে ফেলবে । এই দেখছো না এতো তৈরি করেছে, এতো খামার সব সে একা করেছে । নিজের বাবার কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে নয় !

গল্প করতে করতে কখন যে সন্ধ্যা হয়ে গেছে মিশু খেয়ালই করে নি । খালাই তাকে বলল ঘরে যেতে । সন্ধ্যার নাস্তা সে পাঠিয়ে দিচ্ছে । ঘরে ঢুকে দেখতে পেল সাদিক একজন বয়স্ক লোকের সাথে বসে কথা বলছে । মিশু ঘরে ঢুকতেই মিশুর দিকে ফিরে তাকালো ওরা । মিশু শাড়ির আচল দিয়ে মাথায় কাপড় দিল । এটা হল আপনা আপনিই ।
-মিশু এদিকে এসো ।
মিশু তাদের দিকে এগিয়ে গেল ।
সাদিক বলল, ইনি হচ্ছেন আরমান স্যার । আমাদের হাই স্কুলের হেড স্যার । বাবার বন্ধু । এক সময়ে বাবার সাথে চাকরি করতেন ।
মিশু সালাম দিল । মিশু নিজের বাবার নাম বলতেই তাকে চিনতে পারলো আরমান মিয়া । সে খুব খুশি হলেন মিশু এখানে এসেছে শুনে ।

তিন

রাতের খাওয়া শেষ করে গ্রামে খুব বেশি কাজ থাকে না । এই জমিদার বাড়ির নিজেস্ব বিদ্যুৎ ব্যবস্থা আছে । তাই কখনই অন্ধকার হয় না এখানে। মিশুর রাতে বই পড়ে কাটায় । সাদিকের ঘুমানোর ঘরেই মিশু রয়েছে । সাদিক এখনও ওর সাথে ঘুমাতে আসে নি । যদি আসতো তাহলে কি মিশু বাঁধা দিতো? আইনত সে মিশুর স্বামী ! কাছে সে আসতেই পারে !

আজকে একটু ব্যতীক্রম ঘটলো । দরজার কড়ার শব্দ শুনে দেখলো সাদিক সেখানে দাড়িয়ে । ওর দিকে তাকিয়ে বলল, আসবো ?
-হ্যা আসুন ।
বিছানায় উঠে বসতে বসতে মিশু বলল।
-শুয়ে পড়বে কি?
-নাহ । ঘুম আসবে না এতো জলদি । বই পড়ছিলাম । নেটওয়ার্ক এখানে খুব একটা শক্ত নয় ।
সাদিক একটু হাসলো । বলল, হ্যা । টু জি নেট পাওয়া যায় । কিন্তু ইন্টারনেট চালানোর মত নেট পাওয়া যায় না । তবে কথা চলছে । এখানে একটা আলাদা টাওয়ার বসানো হতে পারে । খুব জলদি সমাধান হবে নেটের । তখন নেট পাওয়া যাবে ।

মিশু কী বলবে খুজে পেল না । সাদিকও কিছু সময় চুপ থেকে বলল, আজকে শাড়িতে তোমাকে সুন্দর লাগছে । আমি আগে তোমাকে কল্পনাকে দেখার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু বাস্তবে সেটা আরও অনেক বেশি সুন্দর !
মিশুর গালটা আপনা আপনি একটু লাল হয়ে এল । সাদিক বলল, হাটবে একটু আমার সাথে । রাতে এখানে হাটতে বেশ চমৎকার লাগে !
-চলুন !

জমিদার বাড়ির ডান দিকে একটা বড় আমের বাগান আছে । বাগানের পাশ দিয়ে রাস্তা চলে গেছে । তার পাশেই ক্ষেত । সেই রাস্তা দিয়ে দুজন হাটতে লাগলো । মিশুর শাড়ির উপরে একটা চাদর জড়িয়ে নিয়েছে । সাদিক পাঞ্জাবীর উপরে শাল জড়িয়েছে । দুজন হাটছে চুপচাপ । মিশুর মনটা অন্যরকম হয়ে গেল । মনে হল কী চমৎকার একটা জীবন ওর এখানে শুরু হতে পারে !
এই প্রিয় মানুষটার কাছে থাকা ! এতো গুলো মানুষের ভালোবাসা । এটা কী কম কিছু?
কেন সবাইকেই শহরে থাকতে হবে?
আরমান স্যারের কথাই মিশু ভাবছিল । কেমন করে শহুরে জীবন ছেলে এই গ্রামে চলে এসেছেন ! বৃদ্ধ লোকটা যে সুখী একজন মানুষ সেই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই । জীবনে সফল হওয়া বেশি জরুরী নাকি সুখী ! সাদিকও একজন সুখী মানুষ । কোন সন্দেহ নেই !
তখনই মিশু অনুভাব করলো সাদিক মিশুর হাত ধরেছে । চুপচাপ হাতটা ধরে আরও কিছুটা সময় সে আরও কিছু সময় হাটলো !

তারপর হঠাৎ সাদিক বলল, আমি সব সময় গ্রাম ভালোবেসেছি । এই যে সবুজ প্রকৃতি এসবের প্রতি আমার টান ছিল সব সময় । যখন ঢাকায় ছিলাম গ্রামের জন্য মন কেমন করতো । স্কুল কলেজ ছুটি হলেই আমি দৌড় দিতে চলে আসতাম এখানে । আমি আমার সব ছুটিগুলো এখানে দাদীর সাথে কাটিয়েছি । বিশ্ববিদ্যালয়টা আমি ইচ্ছে করে কৃষি চুজ করেছি । ঢাবি ছেড়ে আমি কেন কৃষিতে পড়লাম এটা নিয়ে বাবার একটু অসন্তুষ্টি ছিল তবুও আমি চেয়েছি প্রকৃতির কাছে থাকতে । বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে একটা মেয়ের সাথে একটু ভাব হয়েছিলো আমার । আমার রেজাল্ট খুব ভাল ছিল । স্যার হয়ে যেতাম হয়তো যদি এপ্লাই করতাম । মেয়েটাকে যখন বললাম যে আমি গ্রামে স্থায়ী হব তখন সে আমার দিকে এমন বিস্ময় মাখা চোখে তাকিয়েছিল যে আমি সেই সময়ই বুঝতে পেরেছিলাম যে কোন মেয়ে আমার এই ইচ্ছেকে সাথী করে আমাকে ভালোবাসবে না ।

মিশু চুপচাপ শুনে যাচ্ছে । হাতটা তখনও ধরা রয়েছে সাদিকের হাত । হাত ধরার কারণে ওরা বেশ কাছাকাছিই হাটছে । সাদিক আবারও বলল, এই জন্য আমার বিয়ে করার কোন ইচ্ছে ছিল না । কিন্তু দাদীর শেষ ইচ্ছেটা রাখতে চেয়েছিলাম । তার জন্য এইটা হয়েছে । দাদী তার শেষ সময়ে বড় আনন্দ নিয়ে মারা গেছে । এটার জন্য আমি আজীবন তোমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো । এখান থেকে যাওয়ার পরে জীবনে যে কোন সময়ে তুমি যদি কোন বিপদে কোন বিপদে পড় তাহলে মনে রেখো যে আমি সব সময় তোমাকে সাহায্য করার জন্য আছি ।

সাদিক একটু দম নিল । আবারও বলা শুরু করলো একটু পরে।
-আমি জানি তোমার কাছ থেকে অনেক কিছু লুকিয়ে তারপর বিয়ে দেওয়া হয়েছে । সত্যটা জানলে হয়তো তুমি বিয়ে করতে না । তুমি কেন কেউ ই করতো না । এই জন্য আমি দুঃখ প্রকাশ করছি । আমি জানতাম এমন দিন আসবেই । তাই আমি মানসিক ভাবে প্রস্তুত হয়েই ছিলাম । কিন্তু আজকে তোমাকে শাড়িতে দেখে হঠাৎ করেই মনে হল ইস ! যদি তুমি থাকতে এখানে !

মিশুর বুকের ভেতরটা কেমন ধক করে উঠলো । সাদিকের কন্ঠে কী তীব্র এক আকুতি সে শুনতে পাচ্ছে ! এমন ভাবে কেউ কি কোন তাকে থাকতে বলেছে? নাকি কোন দিন বলবে?
মিশুর হঠাৎ কেন জানি কান্না আসতে লাগলো !
এই কান্নার উৎস মিশুর অজানা !

আরও কিছু সময় ওরা নিরবে হাটলো । কেউ কোন কথা বলছে না । কেবল হেটে যাচ্ছে গ্রামের রাস্তা দিয়ে । মিশুর যেন একটু ঠান্ডা লাগা শুরু করেছে । হঠাৎই একটু বেশি ঠান্ডা বাতাস বহা শুরু হয়েছে । মিশু আরও একটু কাছে সরে গেল সাদিকে । সময় যেন থামকে গেছে দুজনের জন্যই

চার
মিশুর যাওয়ার সময় হয়ে গেল । মিশুর মন তখন কেমন দোটানাতে ভুগছে । একটা দিক ওকে বলছে এখানেই থেকে যেতে । সেদিন রাতের পর মিশুর মনটা আরও যেন উতলা হয়েছে । সাদিকের চিন্তা বারবার ঘুরে বেড়াচ্ছে মনে । অন্য দিকে তার এতো দিনের লালায়িত স্বপ্ন ! কোন কে বিষর্জন দিবে সেটা সে বুঝতে পারছে না ।
যাওয়ার জন্য মিশু যখন ব্যাগ নিয়ে বের হল তখন অবাক হয়ে দেখলো পুরো গ্রামের মানুষজন জমিদার বাড়িতে এসে হাজির হয়েছে । কেউ তাকে যেতে দিবে না । সাদিক শেষ পর্যন্ত তাদের বোঝালো যে মিশু এখনও পড়াশুনা করছে । আগে পড়াশুনা শেষ হবে । তারপর সে এখানে থাকতে আসবে । এখন তো তাকে যেতেই হবে ।

যখন গাড়ি ছাড়লো মিশু দেখলো কতগুলো মানুষ তার গাড়ির পেছন পেছন আসছে । কী অদ্ভুত সেই মায়া ! মিশুর চোখ দিয়ে আনপা আপনি পানি বের হয়ে এল ! কী করতে যাচ্ছে সে ! কী করবে ?
ঢাকাতে গিয়ে সে কি শান্তি পাবে !
সাদিকের চোখের দিকে তাকাতেই পারে নি !

গ্রাম থেকে বের হয়ে যখন প্রধান সড়কে বের হয়ে এল তখনই মিশুর মনে হল যে ও যে কাজ করছে সেটা ঠিক হয় নি । তখনই সে ড্রাইভারকে বলল, ড্রাইভার সাহেব গাড়ি ঘোরান !
-জে আফা !
মিশুর মনে হল যেন ড্রাইভার একেবারে প্রস্তুতই ছিল সাথে সাথে গাড়ি ঘুরিয়ে গ্রামের দিকে দ্রুত বেগে ছুটে গেল । যখন গাড়িটা আবারও জমিদার বাড়ির সামনে এসে থামলো তখন সন্ধ্যা নেমে গেছে । কিন্তু মিশু দেখলো অনেক তখনই বসে রয়েছে সেখানে । যেন তারা জানতো যে মিশু আসবেই । ওকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে সবাই যেন আনন্দ চিৎকার করে উঠলো । গাড়িতে গাড়ির দরজা খুলে নামতে নামতে দেখলে সাদিক দরজার কাছে এসে দাড়িয়েছে । ওর চোখে একটা বিস্ময় কাজ করছে । মিশুর সাদিকের দিকে কিছু সময়ে তাকিয়ে রইলো স্থির ভাবে । তারপর খানিকটা সিনেমা কায়দায় দৌড়ে গেল সাদিকের দিকে । এতো গুলো মানুষের সামনেই ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো । বিয়ের পর এই প্রথম সাদিকের এতো কাছে এল সে ।
জড়িয়ে ধরেই মিশু বুঝতে পারলো সাদিকের বুকের স্পন্দনটা কত দ্রুত হয়েছে । সাদিকে জড়িয়ে ধরেই মিশু বলল, আই এম গোনা কাম ব্যাক ! আই প্রমিজ ইউ আমি তোমাকে, এই গ্রামকে ছেড়ে যাবো না ! আর মাত্র কয়েকটা দিন । অপেক্ষা করতে পারবে না?
সাদিক বলল, তোমার জন্য আজীবন অপেক্ষা করবো !

ঐদিন অবশ্য আর যাওয়া হল না মিশুর । ঢাকায় ফিরলো আরও সপ্তাহ খানেক পরে । তবে ফিরে আসা মিশু আর আগের মিশুর ভেতরে আকাশ পাতাল পার্থক্য !

পরিশিষ্ট

মিশু পড়াশুনা শেষ করে আর বাইরে পড়তে যায় নি । সরাসরি গ্রামে ফিরে গেলে সাদিকের কাছেই । ততদিনে মিশুর জন্য সে গ্রামেই একটা বুটিক ফ্যাক্টরি বসিয়ে দিয়েছে । গ্রামের বেশ মহিলাকে ট্রেনিং দিয়ে কাজ শেখানো হয়েছে । এখন তারা সেখানে কাজ করে । ঢাকায় বুটিকের একটা শোরুম নেওয়া হয়েছে । গ্রামে থেকেই মিশু নিজের ডিজাইণ করা পোশাক তৈরি করে শোরুমে পাঠানো হয় । মিশুর কোন ইচ্ছেকে গলা টিপে মারতে হয় নি ।

মিশু এখন সত্যি সত্যিই জমিদার বউ হয়ে উঠেছে । সাদিকের সাথে সাথে সব কিছু সে নিজেই দেখা শুনা করে । মরিয়ম খালার বয়স হয়েছে । সে এখন চাইলেও সব কিছু দেখা শুনা করতে পারেন না । মিশুর কাছে সব দায়িত্ব দিতে পেরে সে নিজেও শান্তিতে আছে ।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.8 / 5. Vote count: 93

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

One Comment on “জমিদার বউ”

  1. ভাল ছিল 😍
    কিন্তু প্রথমে ভাবছিলাম রাফায়েলের গার্লফ্রেন্ড মিশুর কাহিনি
    পরে দেখি 🤑

Comments are closed.