চল পালাই

4.7
(98)

দরজাটা খুলতেই নিম্মি একটু অবাক হল । এই মানুষটাকে সে এখন আশা করে নি মোটেও । দরজার ওপাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে সোহেল । সম্পর্কে সোহেল নিম্মির দুলাভাই । অবশ্য কালকের পরে আর সেই সম্পর্ক থাকবে না । নিম্মির বড় বোন নীলার সাথে সোহেলের ডিভোর্সের সব কাজ কর্ম শেষ । কাল কেবল দুইজন এক সাথে সই করলে সেটা কার্যকর হয়ে যাবে । আর আজকে এই সময়ে সোহেল নিম্মিদের বাসায় এসে হাজির ।

-ভাইয়া আপনি?

সোহেল একটু যেন হাসার চেষ্ট করলো । তারপর বলল, তোমার আপু আছে?

-হ্যা আপু একটু আগে অফিস থেকে ফিরেছে । শুয়ে আছে ঘরে ।

-একটু বলবে যে আমি এসেছি ?

-হ্যা হ্যা ভেতরে আসুন ।

-না ঠিক আছে । আমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছি । ওকে একটু বল প্লিজ ।

নিম্মি কিছু বলতে যাচ্ছিলো এমন সময় নিম্মি ওর বাবার কন্ঠ শুনতে পেল । খানিকটা আদেশের কন্ঠেই বলল, তুমি এখনও এই বাড়ির আত্মীয় । ভেতরে এসো । যা বলার ভেতরে এসে বল।

সোহেল আর কোন কথা না বলে ভেতরে প্রবেশ করলো । খানিকটা সংকোচ নিয়েই সোফার উপর বসল । অনেক দিন সে এই বাড়িতে আসে নি । এমনিতেও শশুর বাড়িতে সে খুব একটা আসতো না । নীলার সাথে ঝগড়া শুরুর একটা কারণ এই শশুর বাড়িতে না আসা । কেবল শশুর বাড়িতেই না, সোহেল আসলে ঠিক কারো বাড়িতেই যেত না । এমন কি নিজের বাবার বাড়িতে যাওয়া নিয়েও তার ছিল প্রবল অনীহা । নীলাকে সব অনুষ্ঠানে যেতে হত একা একা । এটা নিয়ে প্রথম অসন্তুষ্টির সুত্রপাত । তারপর আস্তে আস্তে নানান বিষয়ে একটু একটু করে সেটা বৃদ্ধিই পেয়েছে কেবল ।

নিজের শশুরের সামনে বসে রইলো মাথা নীচু করে । কী বলবে সেটা খুজে পেল না । শশুর মশাইয়ের বেলাতেও তাই । তার জামাই এমনিতে কম কথা বলে, এটা সে জানে । নিজেও কী যেন বলতে চায় সেট খুজে পেল না । আর এখন সম্পর্কটা এমন হয়ে গেছে যে স্বাভাবিক কথা বার্তা যেন বের হবার নয় মুখ দিয়ে । তবুও কেমন আছি ভাল আছি টাইপের কথা বার্তা হল দুজনের ভেতরে । এর ভেতরে নিম্মি এসে বলল, ভাইয়া আপু আপনাকে ঘরে যেতে বলেছে ।

সোহেল একটু অবাক হল । দেখা করতে রাজি হবে এটা সোহেল জানতো তবে একেবারে ঘরের ভেতরে ডাকবে সেটা ভাবে নি । যদিও এখনও তারা স্বামী স্ত্রীই আছে । সোহেল নিজের শশুরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঘরের দিকে রওয়ানা দিল । হাটার সময় অনুভব করলো যে একটু একটু যেন সে কাঁপছে উত্তেজনাতে । দরজার কাছে এসে দেখলো সেটা খোলা । বিছানাতে নীলা শুয়ে আছে  চাঁদর গায়ে দিয়ে। ওর ফর্সা পা বের হয়ে আছে । এটা নীলার একটা অভ্যেস । গরম কালেও সে চাঁদর গায়ে দিয়েই শুয়ে থাকে সব সময় এবং সব সময় দুইটা পা বের করে রাখে ।

দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো সে । তারপর দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে রইলো কিছু সময় । কোথায় বসবে সেটা ভাবছে । নীলা অন্য দিকে ফিরে ছিল । তাই তার মুখ এখনও দেখতে পাচ্ছে না । নীলা মুখ না ফিরিয়েই বলল, দাঁড়িয়ে আছো কেন?

সোহেল ভেতরে ঢুকলো । নীলা দরজাটা বন্ধ করে দাও। দরজা খোলা থাকলে মশা আসে ।

সোহেল দরজাটা বন্ধ করল । তারপর ধীর পায়ে খাটের দিকে এগিয়ে গেল । বিয়ের পরে এই ঘরে খুব কমই থেকেছে সে । তবে ঘরটা তার পরিচিত । ড্রেসিং টেবিল আছে একটা । তার সামনে একটা টুল । এছাড়া ঘরে বসার জন্য আর কিছু নেই । সোহেল ঐ টুলটা টেনে বসতে পারে । তবে সেটা করলো না । বিছানার উপর বসলো । বসে রইলো কিছু সময় । কিছু সময় কেউ কোন কথা বলল না ।

নীলা বলল, কেন এসেছো? আরও কিছু টার্ম কি বদলাতে চাও?

সোহেল নীলার কন্ঠে একটা উত্তাপ ঠিকই বুঝতে পারল। সোহেল মৃদ্যু কন্ঠে বলল, তুমি জনো ঐ টার্ম গুলো আমার কথা না । আমার ছোট ফুফার কথা ।

-তোমার ঐ ফুফাকে আমার কোন দিন পছন্দ হয় নি ।

-আমারও তাকে পছন্দ না ।

এই কথা শুনে নীলা পাশ ফিরে তাকালো সোহেলের দিকে । সোহেলের দিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু তার উপর সব দায়িত্ব দিয়ে দিয়েছে । কী ভয়ংকর সে এনে ভয় দেখিয়েছে । আমার পুরো শরীর ঘৃণায় রিরি করে উঠেছিল ।

সোহেল বলল, আসলে বাবা এসবের দিকে যেতে চান না । তাই এই রকম সব কিছু ফুফাকে দিয়ে করান । উকিল মানুষ । তাই এইভাবে চিন্তা করেন তিনি । আমি এসবের কিছুই জানতাম না । সত্যিই জানতাম না । আজকে জানার পরে মনে হল যে কাজটা মোটেও ঠিক হয়নি । আমি তোমার কাছে সরি বলতে এসেছি ।

নীলা এবার উঠে বসল । নীলার পরনে কেবল একটা টিশার্ট আর একটা লেগিংস । বাসায় সে একদম হালকা পোশাকই পড়তে পছন্দ করে সব সময় । সোহেল ওর দিকে তাকাল । কতদিন নীলাকে এমন এলোমেলো মেকাপ সাজগোজ ছাড়া দেখে নি !

নীলা বলল, এখন আর এসব বলে লাভ কী?

-তুমি চাইলে টার্ম আবার লেখা হবে । দরকার হলে ……।

-কিছু যায় আসে না । মুক্তি চেয়েছিলে মুক্তি পাচ্ছো ।

-শুধু আমিই চেয়েছিলাম? তুমি চাও নি?

-আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি থাকতে । যখন পারি নি তখন……

সোহেল কিছু যেন বলতে গিয়েও বলল না । চুপ করে বসে রইলো । ওর চোখ তখন নীলার হাতের দিকে। হঠাৎ সোহেল বলল, তোমার হাতটা একটু ধরবো?

-কেন ?

-না মানে অনেক দিন ধরি না । কালকের পরে তো আর ধরতেও পারবো না ।

এই বলে সোহেল নীলার দিকে তাকালো । নীলা খানিকটা অবাক হয়েই তাকিয়ে আছে সোহেলের দিকে । সম্ভবত এমন কোন কথা সে আশা করে নি সোহেলের কাছ থেকে । তবে নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিল সোহেলের দিকে ।

সোহেল সব সময়ই নীলার হাত ধরতে পছন্দ করতো । এক সাথে বাইরে বের হলে সব সময় নীলার একটা হাত সোহেলের হাতে থাকতো । এমন কি আত্মীয় স্বজনের সামনেও । নীলা কয়েকবার লজ্জায় হাত সরিয়ে নিতে চাইলেও সেটা করতে দিত না । বাসায় যখন একা থাকতো টিভি দেখতে তখনও সোহেল নীলার একটা হাত ধরে থাকতো ।

হাত ধরে বেশ কিছু সময় সোহেল চুপ করে বসে রইলো । নীলার মনে হল সোহেল নিজেকে সামলানোর জন্য চেষ্টা করছে যেন । হাত ধরা ছাড়াও আরেকটা কাজ সোহেলের খুব পছন্দ ছিল । সেটা হচ্ছে নীলার কপালে চুমু খাওয়া । এই কাজটা সে প্রতিদিন করতো । বিশেষ করে অফিস যাওয়ার আগে । কতদিন এই কাজটা করা হয় না । নীলার মনে হল আজকে শেষ বারের মত সোহেল কি এই কাজ দুটো করতে এসেছে?

কী মনে হওয়াতে নীলা একটু এগিয়েই গেল সোহেলের দিকে । এমন একটা কাজ যে সে কেন করছে সে নিজেও জানে না । এমন ভাবেই সে এগিয়ে যেত প্রতিদিন । কপালটা সামনে নিয়ে আসতেই সোহেল সেখানে মৃদ্যু ভাবে চুমু খেল । নীলা অনুভব করলো ওর হঠাৎ করেই কান্না আসছে খুব । সব কিছু ছাপিয়ে সব ঝগড়া বিবাদ এক পাশে রেখে ওদের দুজনের ভেতরে থাকা ভালোবাসা টুকুই কেবল মনে হতে লাগল ।

নীলার মনে হল, আচ্ছা আরেকটা চেষ্টা করলে কি এক সাথে থাকা যেত না? এভাবে একটা সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে!

সোহেল অবশ্য কপালে চুমু খেয়েই থামলো না । নীলার নাকে এবং পরে ওর ঠোঁটে চুমু খেল আরও কয়েকবার । মাস ছয়েকের ভেতরে এই প্রথম সোহেল আর নীলা এতো কাছাকাছি এল। মুখটা নীলার কাছে রেখেই সোহেল বলল, ডিভোর্সটা কি হতেই হবে? আরেকটা চান্স কি দেওয়া যায় আমাকে?

-দিয়ে কী লাভ ? বদলাবে তুমি?

-হয়তো না । কিন্তু হুয়তো তুমি বদলে যেতে পারো !

-তবুও বলবে না যে হ্যা তোমার জন্য বদলে যাবো !

সোহেল হেসে ফেলল । তারপর নীলাকে আরেকবার চুমু খেল । নীলা বাঁধা তো দিলই না তাতে নিজেকে যুক্ত করলো আরও ভাল ভাবে । একটা সময় নিজেকে সরিয়ে বলল, এখন আমি বাসায় কী বলব শুনি? এতো ঝামেলা এতো প্যারা নিয়ে এখন বলব যে ডিভোর্স চাই না।

সোহেল বলল, কাউকে কিছু বলতে হবে না । চল আজকে কক্সবাজার ঘুরে আসি ।

-মানে?

-মানে এখন চল বের হই । বলবে যে একটা কাজে বের হচ্ছি । শেষবার আমার ঘরে কিছু রয়ে গেছে । নিচে চল । ট্যাক্সি দাড় করিয়েই রেখেছি ।

নীলাকে অবাক করে দিয়ে সোহেল নিজের পকেট থেকে একটা টিকিট বের করলো । নীলা সত্যি অবাক হল একটু । এখানে আসার আগে সোহেল টিকিট কেটেই নিয়ে এসেছে ।

টিকিটের দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে নীলা বলল, আমি রাজি না হই তবে?

-সত্যিই রাজি হবে না?

নীলা কথাটার জবাব দিতে পারলো না ।

সোহেল বলল, আমি জানি ডিভোর্সের জন্য তুমি কোন দিন একা সিদ্ধান্ত নাও নি । তোমার আত্মীয় স্বজনেরা তোমাকে ফোর্স করেছে, ইন্ধন জুগিয়েছে । আমার বেলাতেও তাই । একটা বার কেবল আমরা নিজেদের মনের কথা শুনি । শুনবে?

নীলা সোহেলের চোখের দিকে তাকালো । সেখানে নীলার জন্য কী এক আকুলতা দেখা যাচ্ছে ।

সোহেল আবার বলল, কাউকে কিছু বলার দরকার নেই । কিছু নেওয়ার দরকার নেই । এমন কি ফোনটাও না । আমিও আমার ফোন বন্ধ করে এখানে রেখে যাই ।

-আরে এভাবে বললেই যাওয়া যায় নাকি । অফিস আছে বাবা মা কত চিন্তা করবে আমি…।।

নীলা কিছু বলতে যাচ্ছিল সোহেল আবারও ওকে থামিয়ে দিল নিজের ঠোঁট দিয়ে । নীলা আর কিছু বলতে পারলো না । কোন প্রতিবাদও করতে পারলো না ।

সোহেলের সাথেই নীলা বের হল এক কাপড়ে । সাথে কেবল কিছু টাকা নিল । আর কিছু না । সোহেল নিজের ফোনটা বন্ধ করে নীলার ঘরে রেখে দিল ।

যখন বাইরে বের হল দেখতে পেল নীলার আব্বা ড্রয়িং রুমে বসে টিভি দেখছে । ওদের দুজনকে এক সাথে বের হতে দেখে চোখে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো । নীলা বলল, বাবা ওর বাসায় আমার কিছু জিনিস পত্র রয়েছে। সেগুলো নিয়ে আসি।

নীলার বাবা কিছু বললেন না । তবে বাবার চোখ দেখেই নীলার মনে হল যেন ওর বাবা কিছুটা আঁচ করতে পেরেছেন । তবে তিনি নীলাদের থামালেন না । এদেশের কোন মেয়ের বাবাই আসলে চান না তার মেয়ের ডিভোর্স হোক ।

ঘন্টা খানেক পরে গ্রিন লাইন বাসটা ছুটে চলেছে কক্সবাজারের দিকে । নীলা সোহেলের কাধে হেলান দিয়ে বসে আছে বাসের সিটে । ওর এখনও ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না যে ও সোহেলের সাথে কক্সবাজার যাচ্ছে। আগামীকাল ওদের আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা ছিল অথচ ওরা এক সাথে আগামীকাল সমুদ্র দেখবে ।  

আমি আসলে সব সময় বিশ্বাস করতে পছন্দ করি যে মানুষ অন্য সব কিছু বাদ দিয়ে কেবল ভালোবাসার কারণে একে অন্যের কাছে ফিরে আসবে বারবার । বাস্তবে এমন না হলেও গল্পে এই ভালবাসাকে জিতিয়ে দিতে আমার বড় ভাল লাগে ।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.7 / 5. Vote count: 98

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

One Comment on “চল পালাই”

Comments are closed.