দরজাটা খুলতেই নিম্মি একটু অবাক হল । এই মানুষটাকে সে এখন আশা করে নি মোটেও । দরজার ওপাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে সোহেল । সম্পর্কে সোহেল নিম্মির দুলাভাই । অবশ্য কালকের পরে আর সেই সম্পর্ক থাকবে না । নিম্মির বড় বোন নীলার সাথে সোহেলের ডিভোর্সের সব কাজ কর্ম শেষ । কাল কেবল দুইজন এক সাথে সই করলে সেটা কার্যকর হয়ে যাবে । আর আজকে এই সময়ে সোহেল নিম্মিদের বাসায় এসে হাজির ।
-ভাইয়া আপনি?
সোহেল একটু যেন হাসার চেষ্ট করলো । তারপর বলল, তোমার আপু আছে?
-হ্যা আপু একটু আগে অফিস থেকে ফিরেছে । শুয়ে আছে ঘরে ।
-একটু বলবে যে আমি এসেছি ?
-হ্যা হ্যা ভেতরে আসুন ।
-না ঠিক আছে । আমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছি । ওকে একটু বল প্লিজ ।
নিম্মি কিছু বলতে যাচ্ছিলো এমন সময় নিম্মি ওর বাবার কন্ঠ শুনতে পেল । খানিকটা আদেশের কন্ঠেই বলল, তুমি এখনও এই বাড়ির আত্মীয় । ভেতরে এসো । যা বলার ভেতরে এসে বল।
সোহেল আর কোন কথা না বলে ভেতরে প্রবেশ করলো । খানিকটা সংকোচ নিয়েই সোফার উপর বসল । অনেক দিন সে এই বাড়িতে আসে নি । এমনিতেও শশুর বাড়িতে সে খুব একটা আসতো না । নীলার সাথে ঝগড়া শুরুর একটা কারণ এই শশুর বাড়িতে না আসা । কেবল শশুর বাড়িতেই না, সোহেল আসলে ঠিক কারো বাড়িতেই যেত না । এমন কি নিজের বাবার বাড়িতে যাওয়া নিয়েও তার ছিল প্রবল অনীহা । নীলাকে সব অনুষ্ঠানে যেতে হত একা একা । এটা নিয়ে প্রথম অসন্তুষ্টির সুত্রপাত । তারপর আস্তে আস্তে নানান বিষয়ে একটু একটু করে সেটা বৃদ্ধিই পেয়েছে কেবল ।
নিজের শশুরের সামনে বসে রইলো মাথা নীচু করে । কী বলবে সেটা খুজে পেল না । শশুর মশাইয়ের বেলাতেও তাই । তার জামাই এমনিতে কম কথা বলে, এটা সে জানে । নিজেও কী যেন বলতে চায় সেট খুজে পেল না । আর এখন সম্পর্কটা এমন হয়ে গেছে যে স্বাভাবিক কথা বার্তা যেন বের হবার নয় মুখ দিয়ে । তবুও কেমন আছি ভাল আছি টাইপের কথা বার্তা হল দুজনের ভেতরে । এর ভেতরে নিম্মি এসে বলল, ভাইয়া আপু আপনাকে ঘরে যেতে বলেছে ।
সোহেল একটু অবাক হল । দেখা করতে রাজি হবে এটা সোহেল জানতো তবে একেবারে ঘরের ভেতরে ডাকবে সেটা ভাবে নি । যদিও এখনও তারা স্বামী স্ত্রীই আছে । সোহেল নিজের শশুরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঘরের দিকে রওয়ানা দিল । হাটার সময় অনুভব করলো যে একটু একটু যেন সে কাঁপছে উত্তেজনাতে । দরজার কাছে এসে দেখলো সেটা খোলা । বিছানাতে নীলা শুয়ে আছে চাঁদর গায়ে দিয়ে। ওর ফর্সা পা বের হয়ে আছে । এটা নীলার একটা অভ্যেস । গরম কালেও সে চাঁদর গায়ে দিয়েই শুয়ে থাকে সব সময় এবং সব সময় দুইটা পা বের করে রাখে ।
দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো সে । তারপর দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে রইলো কিছু সময় । কোথায় বসবে সেটা ভাবছে । নীলা অন্য দিকে ফিরে ছিল । তাই তার মুখ এখনও দেখতে পাচ্ছে না । নীলা মুখ না ফিরিয়েই বলল, দাঁড়িয়ে আছো কেন?
সোহেল ভেতরে ঢুকলো । নীলা দরজাটা বন্ধ করে দাও। দরজা খোলা থাকলে মশা আসে ।
সোহেল দরজাটা বন্ধ করল । তারপর ধীর পায়ে খাটের দিকে এগিয়ে গেল । বিয়ের পরে এই ঘরে খুব কমই থেকেছে সে । তবে ঘরটা তার পরিচিত । ড্রেসিং টেবিল আছে একটা । তার সামনে একটা টুল । এছাড়া ঘরে বসার জন্য আর কিছু নেই । সোহেল ঐ টুলটা টেনে বসতে পারে । তবে সেটা করলো না । বিছানার উপর বসলো । বসে রইলো কিছু সময় । কিছু সময় কেউ কোন কথা বলল না ।
নীলা বলল, কেন এসেছো? আরও কিছু টার্ম কি বদলাতে চাও?
সোহেল নীলার কন্ঠে একটা উত্তাপ ঠিকই বুঝতে পারল। সোহেল মৃদ্যু কন্ঠে বলল, তুমি জনো ঐ টার্ম গুলো আমার কথা না । আমার ছোট ফুফার কথা ।
-তোমার ঐ ফুফাকে আমার কোন দিন পছন্দ হয় নি ।
-আমারও তাকে পছন্দ না ।
এই কথা শুনে নীলা পাশ ফিরে তাকালো সোহেলের দিকে । সোহেলের দিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু তার উপর সব দায়িত্ব দিয়ে দিয়েছে । কী ভয়ংকর সে এনে ভয় দেখিয়েছে । আমার পুরো শরীর ঘৃণায় রিরি করে উঠেছিল ।
সোহেল বলল, আসলে বাবা এসবের দিকে যেতে চান না । তাই এই রকম সব কিছু ফুফাকে দিয়ে করান । উকিল মানুষ । তাই এইভাবে চিন্তা করেন তিনি । আমি এসবের কিছুই জানতাম না । সত্যিই জানতাম না । আজকে জানার পরে মনে হল যে কাজটা মোটেও ঠিক হয়নি । আমি তোমার কাছে সরি বলতে এসেছি ।
নীলা এবার উঠে বসল । নীলার পরনে কেবল একটা টিশার্ট আর একটা লেগিংস । বাসায় সে একদম হালকা পোশাকই পড়তে পছন্দ করে সব সময় । সোহেল ওর দিকে তাকাল । কতদিন নীলাকে এমন এলোমেলো মেকাপ সাজগোজ ছাড়া দেখে নি !
নীলা বলল, এখন আর এসব বলে লাভ কী?
-তুমি চাইলে টার্ম আবার লেখা হবে । দরকার হলে ……।
-কিছু যায় আসে না । মুক্তি চেয়েছিলে মুক্তি পাচ্ছো ।
-শুধু আমিই চেয়েছিলাম? তুমি চাও নি?
-আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি থাকতে । যখন পারি নি তখন……
সোহেল কিছু যেন বলতে গিয়েও বলল না । চুপ করে বসে রইলো । ওর চোখ তখন নীলার হাতের দিকে। হঠাৎ সোহেল বলল, তোমার হাতটা একটু ধরবো?
-কেন ?
-না মানে অনেক দিন ধরি না । কালকের পরে তো আর ধরতেও পারবো না ।
এই বলে সোহেল নীলার দিকে তাকালো । নীলা খানিকটা অবাক হয়েই তাকিয়ে আছে সোহেলের দিকে । সম্ভবত এমন কোন কথা সে আশা করে নি সোহেলের কাছ থেকে । তবে নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিল সোহেলের দিকে ।
সোহেল সব সময়ই নীলার হাত ধরতে পছন্দ করতো । এক সাথে বাইরে বের হলে সব সময় নীলার একটা হাত সোহেলের হাতে থাকতো । এমন কি আত্মীয় স্বজনের সামনেও । নীলা কয়েকবার লজ্জায় হাত সরিয়ে নিতে চাইলেও সেটা করতে দিত না । বাসায় যখন একা থাকতো টিভি দেখতে তখনও সোহেল নীলার একটা হাত ধরে থাকতো ।
হাত ধরে বেশ কিছু সময় সোহেল চুপ করে বসে রইলো । নীলার মনে হল সোহেল নিজেকে সামলানোর জন্য চেষ্টা করছে যেন । হাত ধরা ছাড়াও আরেকটা কাজ সোহেলের খুব পছন্দ ছিল । সেটা হচ্ছে নীলার কপালে চুমু খাওয়া । এই কাজটা সে প্রতিদিন করতো । বিশেষ করে অফিস যাওয়ার আগে । কতদিন এই কাজটা করা হয় না । নীলার মনে হল আজকে শেষ বারের মত সোহেল কি এই কাজ দুটো করতে এসেছে?
কী মনে হওয়াতে নীলা একটু এগিয়েই গেল সোহেলের দিকে । এমন একটা কাজ যে সে কেন করছে সে নিজেও জানে না । এমন ভাবেই সে এগিয়ে যেত প্রতিদিন । কপালটা সামনে নিয়ে আসতেই সোহেল সেখানে মৃদ্যু ভাবে চুমু খেল । নীলা অনুভব করলো ওর হঠাৎ করেই কান্না আসছে খুব । সব কিছু ছাপিয়ে সব ঝগড়া বিবাদ এক পাশে রেখে ওদের দুজনের ভেতরে থাকা ভালোবাসা টুকুই কেবল মনে হতে লাগল ।
নীলার মনে হল, আচ্ছা আরেকটা চেষ্টা করলে কি এক সাথে থাকা যেত না? এভাবে একটা সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে!
সোহেল অবশ্য কপালে চুমু খেয়েই থামলো না । নীলার নাকে এবং পরে ওর ঠোঁটে চুমু খেল আরও কয়েকবার । মাস ছয়েকের ভেতরে এই প্রথম সোহেল আর নীলা এতো কাছাকাছি এল। মুখটা নীলার কাছে রেখেই সোহেল বলল, ডিভোর্সটা কি হতেই হবে? আরেকটা চান্স কি দেওয়া যায় আমাকে?
-দিয়ে কী লাভ ? বদলাবে তুমি?
-হয়তো না । কিন্তু হুয়তো তুমি বদলে যেতে পারো !
-তবুও বলবে না যে হ্যা তোমার জন্য বদলে যাবো !
সোহেল হেসে ফেলল । তারপর নীলাকে আরেকবার চুমু খেল । নীলা বাঁধা তো দিলই না তাতে নিজেকে যুক্ত করলো আরও ভাল ভাবে । একটা সময় নিজেকে সরিয়ে বলল, এখন আমি বাসায় কী বলব শুনি? এতো ঝামেলা এতো প্যারা নিয়ে এখন বলব যে ডিভোর্স চাই না।
সোহেল বলল, কাউকে কিছু বলতে হবে না । চল আজকে কক্সবাজার ঘুরে আসি ।
-মানে?
-মানে এখন চল বের হই । বলবে যে একটা কাজে বের হচ্ছি । শেষবার আমার ঘরে কিছু রয়ে গেছে । নিচে চল । ট্যাক্সি দাড় করিয়েই রেখেছি ।
নীলাকে অবাক করে দিয়ে সোহেল নিজের পকেট থেকে একটা টিকিট বের করলো । নীলা সত্যি অবাক হল একটু । এখানে আসার আগে সোহেল টিকিট কেটেই নিয়ে এসেছে ।
টিকিটের দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে নীলা বলল, আমি রাজি না হই তবে?
-সত্যিই রাজি হবে না?
নীলা কথাটার জবাব দিতে পারলো না ।
সোহেল বলল, আমি জানি ডিভোর্সের জন্য তুমি কোন দিন একা সিদ্ধান্ত নাও নি । তোমার আত্মীয় স্বজনেরা তোমাকে ফোর্স করেছে, ইন্ধন জুগিয়েছে । আমার বেলাতেও তাই । একটা বার কেবল আমরা নিজেদের মনের কথা শুনি । শুনবে?
নীলা সোহেলের চোখের দিকে তাকালো । সেখানে নীলার জন্য কী এক আকুলতা দেখা যাচ্ছে ।
সোহেল আবার বলল, কাউকে কিছু বলার দরকার নেই । কিছু নেওয়ার দরকার নেই । এমন কি ফোনটাও না । আমিও আমার ফোন বন্ধ করে এখানে রেখে যাই ।
-আরে এভাবে বললেই যাওয়া যায় নাকি । অফিস আছে বাবা মা কত চিন্তা করবে আমি…।।
নীলা কিছু বলতে যাচ্ছিল সোহেল আবারও ওকে থামিয়ে দিল নিজের ঠোঁট দিয়ে । নীলা আর কিছু বলতে পারলো না । কোন প্রতিবাদও করতে পারলো না ।
সোহেলের সাথেই নীলা বের হল এক কাপড়ে । সাথে কেবল কিছু টাকা নিল । আর কিছু না । সোহেল নিজের ফোনটা বন্ধ করে নীলার ঘরে রেখে দিল ।
যখন বাইরে বের হল দেখতে পেল নীলার আব্বা ড্রয়িং রুমে বসে টিভি দেখছে । ওদের দুজনকে এক সাথে বের হতে দেখে চোখে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো । নীলা বলল, বাবা ওর বাসায় আমার কিছু জিনিস পত্র রয়েছে। সেগুলো নিয়ে আসি।
নীলার বাবা কিছু বললেন না । তবে বাবার চোখ দেখেই নীলার মনে হল যেন ওর বাবা কিছুটা আঁচ করতে পেরেছেন । তবে তিনি নীলাদের থামালেন না । এদেশের কোন মেয়ের বাবাই আসলে চান না তার মেয়ের ডিভোর্স হোক ।
ঘন্টা খানেক পরে গ্রিন লাইন বাসটা ছুটে চলেছে কক্সবাজারের দিকে । নীলা সোহেলের কাধে হেলান দিয়ে বসে আছে বাসের সিটে । ওর এখনও ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না যে ও সোহেলের সাথে কক্সবাজার যাচ্ছে। আগামীকাল ওদের আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা ছিল অথচ ওরা এক সাথে আগামীকাল সমুদ্র দেখবে ।
আমি আসলে সব সময় বিশ্বাস করতে পছন্দ করি যে মানুষ অন্য সব কিছু বাদ দিয়ে কেবল ভালোবাসার কারণে একে অন্যের কাছে ফিরে আসবে বারবার । বাস্তবে এমন না হলেও গল্পে এই ভালবাসাকে জিতিয়ে দিতে আমার বড় ভাল লাগে ।
Valobashar joy hok❤️