গাড়িটা কখন যে রেস্টুরেন্টের গেটে এসে দাড়িয়েছে অবনী খেয়াল করে নি । ছোট চাচার ডাক শুনে ফিরে তাকালো । ছোট চাচা ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই নিশ্চিত আমি আসবো না?
অবনী হাসলো । তারপর বলল, কেন ভরশা হচ্ছে না ? ভয় পাচ্ছো সে নীল সাহেব কিছু করে বসবেন?
ছোট চাচা কিছু বললেন না । অবনী বলল, ছোটচা, তুমি যাও । তোমার এই পুলিশের পোশাক দেখলে বেচারা ভয় পাবে । আর আমি যা বলবো সেটা তোমার সামনে বলতে পারবো না । শুনতে তোমার ভালও লাগবে না ।
ছোট চাচা রাকিব উদ্দিন বললেন, এবারও বিয়েটা ভেঙ্গে দিবি ?
-উহু । বিয়ে ভাঙ্গতে যাবো কেন ? আমি কেবল সত্যটা বলবো ।
রাকিব উদ্দিন সামনের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছু সময় । তারপর হঠাৎ বললেন, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এই ছেলে বিয়ে ভেঙ্গে দিবে না ।
অবনী সাথে সাথে বলল, কেন এই কথা কেন বললে? তুমি তাকে ভয় দেখিয়েছো?
-পাগল নাকি? নীল কি ক্রিমিনাল নাকি সে ভয় দেখবো । ছেলে সম্পর্কে আমি খোজ খবর নিয়েছি । ভাল ছেলে ।
-হ্যা ভাল ছেলে আমিও জানি । নয়তো বাবা তুমি দুজনই একই সাথে কিভাবে রাজি হয়ে গেলে !
রাকিব উদ্দিন বললেন, সব কিছু বলার কি দরকার আছে? মানুষের জীবনে দুর্ঘটনা ঘটেই । ঘটে না?
-ছোটচা ওটা দুর্ঘটনা না । আমার ভুল অথবা অপরাধ ! এটা লুকিয়ে যদি বিয়ে করি তাহলে আমি জীবনে শান্তি পাবো না । বারবার মনে হবে যে আমি কোন অপরাধ করছি ।
-আচ্ছা যা । তোর যা ইচ্ছে ।
-বাবা যেন না জানে।
-জানবে না । তবে সন্দেহ তো করবেই ।
-করুক । তুমি কিছু বলবে না । মনে থাকবে তো ?
-মনে থাকবে ।
অবনী গাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে ছোটচাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো । তারপর আর একবার না তাকিয়ে বের হয়ে এল গাড়ি থেকে । আজকে খুব কঠিন কাজ করতে হবে । এর আগে কাজটা আরও দুইবার সে করেছে । প্রতিবারই ফল যেমন টি ভেবেছিলো তেমনটি হয়েছে । এইবারও তেমন হবে?
হবে হয়তো ! এটাই স্বাভাবিক আচরন । যে কোন ছেলেই এমন টা করবে ।
নীল মুগ্ধ হয়ে অবনীর দিকে তাকিয়ে রয়েছে । প্রতিবার চোখের পলক ফেলতে গিয়েও যেন আফসোস হচ্ছে । বারবার মনে হচ্ছে ঐ সময় টুকু মেয়েটাকে সে কেন দেখবে না ? কেন নিজের চোখকে সে বঞ্চিত করবে ? নীল নিজেকে কিছুটা সামলে নিল । গত রাতে অবনী যখন ওর সাথে দেখা করতে চাইলো তখন থেকেই সে উত্তেজনা ধরে রাখতে পারছিলো না । আজকে এই জন্য সে অফিসেও যায় নি । সারাটা সকাল আর দুপুর মিলে ভেবেছে অবনীকে কী বলবে কি করবে । কোন পোশাক পরে ওর সামনে যাবে ! নিজের আচরণে নিজেই খানিকটা অবাক হয়েছে । অবনীর প্রেমে সে পড়েছিলো জানে কিন্তু সেটা যে এতো তীব্র ভাবে সেটা বুঝতে পারে নি নিজেও ।
অবনীকে বলল, কিছু খাবে না ? অর্ডার দেই ?
-না থাকুক ।
-সেকি, কেন?
-কারণ আমি যা বলব তাতে আপনার খাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে । শুধু খাবার নষ্ট হবে ।
নীলের বুকের ভেতরে যেন একটু অস্বস্থি শুরু হল । মনের ভেতরে একটা সঙ্কা দেখা দিল । অবনীকে সে এখনও কাছে পায় নি । পাওয়ার একটা সম্ভবনা দেখা দিয়েছে কেবল । এখনই কী হারিয়ে যাবে সে । মনের কথা মনেই রইলো অবনী বলল, আপনাকে আমি বিয়ে করতে পারবো না ।
অবনী লাইণটা বলে সরাসরি তাকালো নীলের দিকে । এতো সময় নীলের চোখ দুটো কেমন উজ্জ্বল হয়ে ছিল আনন্দে । সেটা ধপ করে নিভে গেল । মুখে একটা অন্ধকার নেমে এল ।
অবনী বলল, আমাকে আপনি যেমন মেয়ে ভাবছেন তেমন কেউ না আমি ।
-মানে?
-মানে আমি আপনার যোগ্য না । আমি আসলে কারো যোগ্য না ।
-কি বলছো আমি বুঝতে পারছি না।
-আমাকে বিয়ে না করলেই আপনার জন্য ভাল হবে । এই কথা টাই কেবল বলতে এসেছি ।
নীল বলল, অন্য কাউকে ভালোবাসো কি? মানে আমাকে বিয়ে না করার কারণটা কি বলা যায় অন্তত?
-শুনতে ভাল লাগবে না আপনার।
-আমি তবুও শুনতে চাই । অন্তত এই টুকু আমাকে বল প্লিজ ।
একটা বড় করে নিঃশ্বাস নিল । আবারও সেই কথা গুলো বলতে হবে তাকে । আবারও সেই স্মৃতি গুলো মনে করতে হবে ।
আমাদের ছাদে একটা চিলেকোঠা আছে । সেখানে নাদিম নামে একটা ছেলে থাকতো । একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো । আমি যখন ছাদে যেতাম তখন প্রায়ই কথা হত আমাদের । সত্য কথা বলতে কি ছেলেটা কথা বার্তায় দারুন স্মার্ট ছিল । দেখতে শুনতেও ভাল । যে কোন মেয়েরই ভাল লাগবে তাকে । আমারও তাই ।একদিন দুপুরে বৃষ্টিতে ভিজছি আমি একা একা, কখন যে পেছন থেকে সে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো আমি টের পাই নি । প্রথমে ভয় লাগলেও আমি কেন জানি নিজেকে ছাড়িয়ে নেই নি ।
অবনী চুপ করলো কিছু সময় । নীলের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে ব্যথিত চোখে তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে । অবনী আবারও বলা শুরু করলো ।
তারপর থেকে আমাদের প্রেম শুরু হল । নিজেকে যেন উজার করে দিলাম তার কাছে । ফলে যা হওয়ার তাই হল । তখন সবে মাত্র বিশ্ব বিদ্যালয়ের ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি । যা দেখি সব রঙ্গিন লাগে । কত স্বপ্ন আমার তখন । কিন্তু সেই স্বপ্ন ভাঙ্গতে সময় লাগলো না । মাস ছয়েকের ভেতরে আমি হঠাৎ খেয়াল করলাম যে আমার মাসিক বন্ধ হয়ে গেছে। একটু ভয় পেলাম বটে তবে কাউকে কিছু বললাম না । এমন কি নাদিমকেও না । এটা সম্ভবত ভুল ছিল । যখন তাকে বললাম তখন দেরি হয়ে গেছে অনেক । সে পরিস্কার ভাবে বলে দিলো যে এখন বিয়ে শাদীর কথা সে ভাবছে না । বাচ্চা ফেলে দিতে হবে । সব ব্যবস্থা সে করবে । কিন্তু সে আর এল না । কোথায় যে গেল আমি আর তার কোন খোজ পায় নি । বাসায় জানা জানি হতে সময় লাগলো না । মা খুব মেরেছিলো সেদিন । জানেন নীল সাহেব একটুও ব্যাথা অনুভব হয় নি সেদিন । কেবল নিজের প্রতি ঘেন্না জন্মেছিল কেবল ।
ছোটচা সময় মত না আসলে সেদিন হয়তো মা আমাকে মেরেই ফেলতো । ছোটচাই সব ব্যবস্থা করলেন । আমাকে বাসা থেকে দুরে নিয়ে গেলেন । ছোটচা পুলিশ তো ! তার অনেক জানা শোনা । গাজীপুরে তার এক বন্ধুর বাংলোবাড়িতে গিয়ে উঠলাম । মানুষজন যেন না দেখে আমাকে । এর মাঝে কতবার নাদিমকে ফোন দেওয়ার চেষ্টা করেছি কিন্তু কাজ হয় নি । ওর ফোন বন্ধ ছিল । মা কিংবা বাবা একদিনও আমার সাথে দেখা করতে আসে নি । ওখানে মাস দুয়েক ছিলাম । তারপরই ঠিক করলাম যে আর এই জীবন রাখবো না । আমার দেখা শোনা করার জন্য একটা মেয়ে আর গেট পাহারা দেওয়ার জন্য একজন বয়স্ক চাচা ছিলো । তাকে কিছু টাকা দিয়ে ঘুমের ঔষধ কিনতে পাঠালাম । শিখিয়ে দিলাম তাকে অল্পঅল্প করে ঘুরে ঘুরে যেন কেনে । কাজ হল । গ্রামের দিকে তো এতো বেশি কড়াকড়ি নেই । প্রতিদিন তাকে দিয়ে অল্প অল্প কিনিয়ে আনতাম । এক সপ্তাহের ভেতরে অনেক জমে গেল ।
নীল দেখতে পেল অবনীর চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়া শুরু করেছে । নিজ হাত দিয়েই টিস্যু বের করলো সে । চোখ মুছে আবারও শুরু করলো ।
যখন ওষুধ গুলো খাচ্ছিলাম তখন কেন জানি মনে হল পেটের ভেতর থেকে কেউ যেন আমাকে মা মা বলে ডাকছে । বলছে তাকে মেরে না ফেলতে । খুব ইচ্ছে করছিলো বেঁচে থাকতে । বারবার কেবল ফোনের দিকে তাকাচ্ছিলাম । মনে হচ্ছিলো নাদিম বুঝি এই এখন ফোন করবে । সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে । কিন্তু হল না । মাঝ রাতের দিকে আমি সব গুলো ঔষধ খেয়ে নিলাম । তারপর শুয়ে পড়লাম বিছানাতে । দরজা বন্ধ করেছি আগেই । আর আমি খুব বেশি বেরও হতাম না রুম থেকে । তাই সকালে কেউ কিছু বোঝার আগেই আমি উপরে চলে যাবো ভেবেছিলাম ।
কিন্তু কপালে না থাকলে মানুষ মরতেও পারে না। আমিও পারলাম না । সাতদিন পরে আবার হুস ফিরলো । জ্ঞান ফিরে প্রথমে যা টের পেলাম সেটা হচ্ছে আমার ভেতরে কিছু যেন নেই । আমি বেঁচে গিয়েছি ঠিকই কিন্তু আমার বাবুটা বাঁচে নি । মিসক্যারেজ হয়েছে । তাকেও ওয়াশ করে ফেলে দেওয়া হয়েছে । জানেন আমি আজও জানি না যে সে ছেলে ছিল নাকি মেয়ে । ছোটচা আমাকে জানতে দেয় নি । আমি জানিও না ওকে কবর কোথায় দেওয়া হয়েছে । আদৌও দেওয়া হয়েছে কিনা ! আমি ….
অবনী আর কোন কথা বলতে পারলো না । চুপ করে রইলো । কয়েকটা মিনিট কেটে গেল । কেউ কো কথা বলল না । নীল হঠাৎ বলল, আমি তোমাকে কেন বিয়ে করতে চাই জানো ? শুনবে?
অবনী মুখ তুলে তাকালো নীলের দিকে । নীলের দিকে তাকিয়ে একটা বিস্ময় বোধ করলো । নীলে চোখে একটা অচেনা দৃষ্টি সে দেখতে পাচ্ছে । আগের দুইজনকে যখন সে এই কথা বলেছিলো তাদের চোখে অবনীর জন্য একটা ঘৃণা ছিল কিন্তু নীলের চোখে অন্য কিছু দেখতে পাচ্ছে সে । তখনই ছোট চাচার কথা মনে পড়লো ওর । চাচা কি তাহলে ঠিক কথা বলেছিলো!!
অবনী মুখ ফুটে কারণটা জানতে চাইলো না । তবে চোখে একটা কৌতুলের ভাব ফুটে উঠেছে ঠিকই ।
আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষের দিকের কথা । একটা মেয়ের সাথে আমার খুব কথা হত ফোনে । প্রেম হতে সময় লাগলো না । সারাদিন ফোনে তার পেছনে লেগে থাকতাম । যে সময়টা আমার ক্যারিয়ারের পেছনে দেওয়ার কথা ছিল সে সময় টা আমি সেই মেয়ের পেছনে দিয়েছিলাম। আমার বন্ধুরা সব একে একে চাকরি বাকরি শুরু করে বিয়ে শাদি করছে আমি সেই মেয়ের প্রেমে বিভোর হয়ে অন্য সব কিছু ভুলে আছি । মোট চার বছর টিকেছিলো আমাদের প্রেম । কিন্তু মজার ব্যাপার কী জানো? এই চার বছর কেবল আমি তার সাথে কথাই বলেছি । একবারও আমাদের দেখা হয় নি, এমন কি একবারও ভিডিও কলে কথা পর্যন্ত হয় নি । যদিও সে আমাকে ছবি দিয়েছিলো । তারপর একদিন সব কিছু বন্ধু । আমাকে ছেড়ে দিল সে । কোন কারণ বলল না, কোন ব্যাখ্যা না । পরে জানতে পারলাম যে আমাকে যে যা যা বলেছিলো সব কিছু মিথ্যা । কয়েকজন বান্ধবী মিলে আমার সাথে এই ট্রিক্সটা তারা খেলেছিলো । এমন কি যে মেয়ের ছবি দিয়েছিলো সেটা তার নিজের চেহারা ছিল না । আমার পুরো জগত টা একেবারে মিথ্যে হয়ে গেল ।
এতোদিন অন্য কোন দিকে খেয়াল দেই নি । আমার সব বন্ধুরা তখন সেটেল হয়ে গেছে । সবার চাকরি পেয়ে বিয়ে শাদী করে ফেলেছে । যা করে নি করবে করবে করছে । আমি একদম একটা হয়ে গেছি । বাসার মানুষজন আমার সাথে কেমন আচরন শুরু করেছে । আমাকে যেন তারা ঠিক চেনেই না এমন একটা অবস্থা । এভাবে আরও একটা বছর কেটে গেল । চাকরির বয়সের আর কয়েকটা দিন বাকি অথচ আমার পড়তে মন বসে না একদম । কিছুই করতে ভাল লাগে না । ঠিক করে নিলাম যে আর এজীবন রাখবো না । ঠিককরলাম সুইসাইড করবো ।
সেদিন মন খারাপ নিয়ে আমি পার্কে বসে ছিলাম । বারবার কেবল উপরওয়ালার কাছে চাচ্ছিলাম সে যেন আমাকে এমন একটা ইশারা যেন দেয় যাতে অন্তত আমি বাঁচার আশা টুকু পাই । সেই দিনই আমি প্রথম দেখি তোমাকে । পার্কের এক পাশে চুপ করে বসে আছো । কী যেন ভাবছো ! অন্য কোন দিকে তোমার খেয়াল নেই । আমি তোমার দিকে কী অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম কেবল ! সেদিনের সেই অনুভূতি আমি কোন দিন কাউকে বোঝাতে পারবো না ।
তোমার পিছু নিয়ে তোমার বাড়ি পর্যন্ত গেলাম । তারপর থেকে নিয়মিত তোমার পিছু নিতাম । তুমি অবশ্য কোন দিন খেয়াল কর নি । তবে একজন ঠিকই খেয়াল করলো ।
-কে?
-তোমার ছোট চাচা ।
অবনী অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো কিছু সময় । নীল বলল, আমাকে একদিন পাকড়াও করলেন তিনি । আমি ভেবেছিলাম খুব মারবেন তবে আমার কন্ঠে তিনি কিছু বুঝতে পেরেছিলেন হয়তো । আমাকে ছয় মাস সময় দিলেন । বললেন এর ভেতরে যদি আমি কিছু করতে পারি তাহলে তিনি ব্যাপারটা দেখবেন । অবনী সত্য করে বলছি জীবনে এতো চেষ্টা আর কোন কিছুর জন্য করে নি যতটা সেই ছয় মাসে করেছিলাম । আমার বাবা আমার পড়াশুনা দেখে একদিন কী বলেছিলাম জানো, বলেছিলো বাবারে এতো কষ্ট করতে হবে না । আমি আর তোকে কিছু বলবো না । একটু ঘুমা তুই । সপ্তাহে হয়তো সব মিলে ১০/১২ ঘুমাতাম আমি । চোখের নিচে কালি পরে কি অবস্থা হয়ে গিয়েছিলো । আমার তখন এসব খেয়াল ছিল না । বারবার মনে হচ্ছিলো যে একটা শেষ সুযোগ এসেছে । একটা সুযোগ ! এটা হাত ছাড়া করা যাবে না ।
ওম শান্তি ওম মুভির একটা ডায়ালগ আছে না- যদি কোন জিনিস সত্যি মন থেকে চাও তাহলে সেটা তোমার পাইয়ে দেওয়ার জন্য পুরো পৃথিবী কাজ করতে শুরু করে । এইবার সত্যিই হল তাই । যেদিন চাকরির মেসেজ এল । সবার আগে আমি তোমার ছোট চাচাকে ফোন দিয়েছিলাম ।
কিছুটা সময় থামলো নীল । তারপর অবনীর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার আজকের আমি কেবল তোমাকে পাওয়ার জন্য । আর অন্য কোন কারণে না । সেদিন পার্কে যদি তোমাকে বসে থাকতে না দেখতাম তাহলে পরদিনই হয়তো মরে যেতাম ।
অবনী কী বলবে কিছু খুজে পাচ্ছে না । এমন কিছু সে মোটেও আশা করে নি । নীল আবার বলল, অবনী আমি জানি না তোমার সাথে আমার বিয়ে হবে কিনা । যদি হয় তাহলে সামনে কি হবে সেটাও আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি না । হয়তো আমাদের বিবাহিত জীবন সুখের হবে হয়তো না । হয়তো খুব ঝগড়া হবে আমাদের । কোন কিছুই নিশ্চিত করে বলতে পারি না আমরা । তবে একটা ব্যাপার আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি । সেটা হচ্ছে আমাদের মাঝে ঝগড়া বিবাদ যাই হোক না কেন তোমার অতীতের কারণে সেটা কখনও হবে না ।আজকের পরে এই প্রসঙ্গ উঠবেও না কোন দিন আমাদের মাঝে
রাতে খাবারের পর রাকিব উদ্দিন ছাদে উঠে একটা সিগারেট খান । আজকেও সিগারেট ধরিয়েছিলেন এমন সময় অবনীকে ছাদে আসতে দেখলেন । সিগারেট টা ফেলে দিয়ে অবনীর দিকে তাকিয়ে বললেন, কি ব্যাপার এখন ছাদে ?
-জানি না ছোটচা । কেমন যেন অস্থির লাগছে ।
-কেন?
-জানি না ।
-নীল না করে দিয়েছিস?
-না ।
রকিব উদ্দিন হাসলেন । তারপর বললেন, ও তোকে ছাড়বে না । তোকে বিয়ে করেই ছাড়বে ।
-তুমি যে ওকে চিনতে আমাকে কেন বল নি?
-না বললেই বা কি !
-তুমি আমার পেছনে আসা সব ছেলেকে সেই মার দিতে । ঐ ঘটনার পর থেকে সেটা যেন আরও বেড়ে গিয়েছিল। তারপরেও নীলকে কিছু বললে না কেন?
প্রশ্নটার উত্তর রাকিব উদ্দিন চট করেই দিলেন না । কিছু সময় আকাশের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবলেন । তারপর বললেন, প্রথমে মাইর দেব ভেবেছিলাম । বেশ কয়েক দিন থেকেই খেয়াল করছিলাম যে ও তোর পিছু নিয়েছে । কিন্তু যখন ও বলল যে তোকে ও বিয়ে করতে চায় । ওর বেঁচে থাকার শেষ আশা টুকু হচ্ছিস তুই , জানি ওর কন্ঠে এমন কিছু ছিল যে আমি নিজে পর্যন্ত স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম । পরে খোজ খবর নিয়েছি। ভাল ছেলে । কেবল চাকরি পাচ্ছিলো না । বললাম চাকরি পেলে কিছু হবে ।
-আমার অতীতের কথা বলেছিলে ওকে?
-নাহ । কিছু বলি নি । কেবল বলেছিলাম যে তোর জীবনে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিল । কী দুর্ঘটনা সেটা ও জানতে চায় নি ।
রাকিব উদ্দিন আরও কিছু সময় চুপ করে থেকে বললেন, একবার ছেলেটাকে সুযোগ দিয়ে দেখবি মা । সবাই ঐ লম্পটের মত হয় না । ভালোবাসার মূল্য মানুষ বোঝে ।
ঠিক এক মাস পরে অবনীয়ে বিয়ে হয়ে গেল । নীলের সাথেই । বিয়ের সব ঝামেলা শেষ করে যখন অবনী গাড়িতে উঠলো তখন কেমন একটা ভালোলাগা ওর মন জুড়ে কাজ করছিলো । বারবার মনে হচ্ছিলো যে সামনে ওর জন্য খুব চমৎকার সময় অপেক্ষা করছে । সেটার প্রমান পেল ও ঠিক একদিন পরেই । বিয়ের পরদিন বিকেল বেলা অবনীকে নিয়ে নীল গাজীপুরে এল । গাড়িটা যতই এগিয়ে যেতে লাগলো অবনীর মনের ভেতরে কেমন যেন করতে লাগলো । এই এলাকাটা ওর চেনা । গাড়িটা থামলো একটা নির্জন করব স্থানের সামনে । নীল হাত ধরে ওকে করব স্থানের ভেতরে নিয়ে এল । তারপর নির্দিষ্ট একটা বাঁধানো করবের সামনে এসে থামলো । অবনী খেয়াল করলো করবটা সম্প্রতি বাঁধানো হয়েছে । নীল সেদিকে তাকিয়ে বলল, তোমার মেয়ের করব ।
অবনী একবার নীলের দিকে তাকালো আরেকবার করবটার দিকে । হু হু করে কেঁদে উঠলো ওটার সামনে দাড়িয়ে ।
নীল পাশেই দাড়িয়ে ছিল সব সময় । মন ভরে ওকে কাঁদতে দিল ওকে । অবনীকে খানিকটা জড়িয়ে ধরে ছিল ।
একটা সময় শান্ত হয়ে এল অবনী । মেয়ের কবরের সামনে দাড়িয়ে দোয়া করলো উপরওয়ালার কাছে।
করব স্থান থেকে ওরা দুজন বের হতে যাবে এমন সময় নীল থামলো । তারপর চোখের ইশারাতে কোণার দিকের একটা করব দেখালো । অবনী খানিকটা কৌতুহলী হয়ে বলল, কার করব?
-যার জন্য তোমাকে এতো কষ্ট পেতে হল?
অবনী তীব্র বিস্ময় নিয়ে তাকালো নীলের দিকে । কোন মতে বলল, মানে? সে না বাইরে চলে গিয়েছিলো!!
-গিয়েছিলো। ফিরে এসেছিলো দুই বছর পরে । সে ভেবছিলো তার কৃতকর্মের ফল সে পাবে না । সবাই সব কিছু ভুলে যাবে । কিন্তু তোমার ছোট চাচা তাকে মনে রেখেছে । সে যে কোথায় হারিয়ে গেছে কেউ জানেই না । ইস! তোমার ছোট চাচার মত একজন চাচা যদি আমার থাকতো !
অবনী খেয়াল করলো ঘটনাটা জানার পরে তার মোটেও খারাপ লাগছে না । অবনী বলল, কেন এখন তো পেয়েছো ! আমার চাচা মানেই তো তোমার চাচা । তাই না? তবে সাবধান কিন্তু কোন দিন যদি আমাকে কষ্ট দাও …..
-তোমাকে আর কষ্ট !! অবনী আমাদের কষ্ট পাওয়ার দিন শেষ । যে কষ্ট লেখা ছিল তা পেয়ে গেছি ।
গ্রামের রাস্তা ধরে হাটতে হাটতে অবনীর ঠিক একই কথা মনে হল । সত্যিই জীবনে যে কষ্ট টুকু পাওয়ার ছিল ওরা দুজনেই পেয়ে গেছে । সামনে আর পেতে হবে না ।