আমার শেষ কর্পোরেট চাকরির ইন্টারভিউয়ের অভিজ্ঞতা

অপু তানভীর
4.7
(11)

গতদিনের ভাইভা অভিজ্ঞতা লিখেছিলাম ফেসবুকের মেমরির কারণে । ফেসবুক আমাদের জানান দেয় একই দিন কয়েক বছর আগে আমরা কী কী লিখেছিলাম । অভিজ্ঞতা লেখার পর মনে হল প্রথমটা যখন লেখা হয়েছে শেষটাও লেখা হোক । সালটা ২০১৮ । আমি গিয়েছি কক্সবাজারে । একা । দুইদিন পরে আরও দুইজন আমার সাথে যোগ দিবে । তারপর সবার একসাথে ঢাকা ফিরবো। তাদের আসার আগেই আমার মোবাইলে মেসেজটা এসে হাজির হল । আমাকে ডাকা হয়েছে উত্তরা ব্যাংকে ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য । একটু অবাক না হয়ে পারলাম না । কারণ এইটাতে আমার ভাইভা কল আসার কথা না ।

শুনেছিলাম এমসিকিউতে যারা যারা অংশ নিয়েছিলো সবাইকেই রিটেন পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিলো । যারা ব্যাংক নিয়োগ পরীক্ষা সম্পর্কে জানেন না তাদেরকে বলি, সরকারী এবং বেসরকারী ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রথমে মোট তিনটা ধাপ অতিক্রান্ত করতে হয় । এমসিকিউ হয় প্রথমে । সেখান থেকে কাট মার্ক নিয়ে নির্দিষ্ট সংখ্যক পরীক্ষার্থীকে লিখিত পরীক্ষার জন্য ডাকা হয় । এবং লিখিত পরীক্ষাপাশ করলে তাদেরকে ডাকা হয় ভাইভাতে । যেহেতু যারা এমসিকিউতে অংশ করেছিলো সবাইকেই লিখিত পরীক্ষা দিতে দেওয়া হয়েছিলো সেহেতু অনেক পরীক্ষার্থী ছিল । তার টিকতে হল দরকার ছিল ভাল পরীক্ষা দেওয়া । কিন্তু আমার পরীক্ষা এতোটাও ভাল হয় নি । অন্তত ডাক পাওয়ার মত পরীক্ষা দেই নি । আমার এখনও মনে আছে যে মোট চারটা ম্যাথ এসেছিলো । যার ভেতরে দুইটা করেছিলাম ভালোভাবে । একটা করেছিলাম অর্ধেক আর একটাতে হাতই দিতে পারি নি । সেই হিসাবে ডাক পাওয়ার কথা না । তখন ব্যাপারটা এমন ছিল যে বেসরকারী ব্যাংকের লিখিত পরীক্ষা পার করতে ম্যাথের ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ন ছিল । ম্যাথ গুলো ভাল ভাবে করতে পারলে ডাক নিশ্চিত ছিল ।

যাই হোক, ডাক যখন পেয়েছি আরও একবার ঘুরে আসি । এইবার ভাইভা দিতে গিয়েছিলাম একেবারে স্যুট টাই পরে । বান্ধবীর বিয়ে উপলক্ষ্যে কিছুদিন আগে একটা স্যুট বানিয়েছিলাম । সেই স্যুট পরেই হাজির হলাম উত্তরা ব্যাংকের হেড অফিসে । এখানে বলে রাখা ভাল যে প্রথম ইন্টারভিউ দেওয়ার সময় যে টাইটা ধার করে এনেছিলাম এইবারও সেই টাইটা পরেই হাজির হলাম । নতুন করে আর কোন টাই কেনা হয় নি ।

নির্দিষ্ট সময়ে আমাদের বসানো হল । তারপর একে একে ডাকা হল । আমি একটু অবাক হলাম এই দেখে যে এতো জলদি ইন্টারভিউ শুরু হওয়া নিয়ে । পরে অবশ্য বুঝতে পারলাম যে এটা আসলে আসল ইন্টারভিউ না । আমাদের আগে অন্য একজনের সাথে কথা বলতে হচ্ছে । তাকে সব সার্টিফিকেট দেখাতে হচ্ছে । আমিও ভেতরে ঢুকলাম । সেই আমার নাম জিজ্ঞেস করলো । আমি নাম বলতে একটা কাগজ এগিয়ে দিল । নাম সই করতে হল । সে আমার সার্টিফিকেট সহ আরও কাগজপত্র চেক করতে শুরু করলো । তারপর আমার কাছে জানতে চাইলো যে আমার সার্টিফিকেটের ফটোকপি সত্যায়িত করা নেই কেন ! আমাদের মেইলে বলা হয়েছিলো যাতে আমরা এককপি করে ফটোকপি নিয়ে আসি এবং সেগুলো যাতে সত্যায়িত করা থাকে । আমি সেটা করি নি । ঢাকাতে আমার কোন পরিচিত মানুষ ছিল না যার কাছ থেকে সত্যায়িত করা যায় । অবশ্য চাইলে নীলক্ষেত থেকে করানো যেত কিন্তু এতো প্যারায় যায় নি । তিনি আর কিছু জানতে চাইলেন না । আমি আমার চেয়ারে গিয়ে বসলাম । কিন্তু কিছু সময়ে পরে আমার ডাক পড়লো আবার । যে সার্টিফিকেট চেক করেছিলো সে আমাকে ডেকে নিয়ে গেল অন্য একটা রুমে । সেখানে এক ভদ্রলোক বসে । কোর্ট টাই পরা । একটু বয়স্ক ।
ভদ্রলোক আমাকে বললেন যে আমি কেন সার্টিফিকেট সত্যায়িত করি নি । বললাম যে আমি আসলে কাউকে চিনি না যে সত্যায়িত করতে পারি । সে তারপর বলল যে আমার ভার্সিটির শিক্ষকরা কি ছিলেন না । তাকে জানালাম যে ভার্সিটির শিক্ষকরা সত্যায়িত করতে পারেন না । বিসিএস পাস ফার্স্টক্লাস অফিসাররা পারেন । দেখলাম আমার উপর অসন্তুষ্ট হলেন । তার চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছিলো । তারপর বললেন যে এই ব্যাপারটা ইন্টারভিউবোর্ডে তাকে জিজ্ঞেস করা হবে ।

আরও প্রায় এক ঘন্টা পরে আসল ইন্টারভিউ শুরু হল । আমরা বসে ছিলাম বড় একটা অফিস রুমের ভেতরে । কর্পোরেট অফিস রুম গুলো যেমন হয় । সাধারন এপ্লোয়ীদের ডেস্ক গুলো অল্প উচু কার্ডবোর্ড দিয়ে আলাদা করা থাকে সেই রকম একটা বড় রুমে । মাঝে আমরা বসে ছিলাম । সই করার সময় দেখেছিলাম মোট ৫০টা নাম । তবে সবাই আসে নি ভাইভা দিতে ।
কিছু সময় পরে দেখলাম আমাদের সবাইকে চা দেওয়া হচ্ছে । সাথে বিস্কিট । আমি চায়ের সাথে বিস্কিট নিলাম । আস্তে আস্তে আমার নার্ভাসনেস বাড়ছে । আমার এই রোগ এখনও আছে । ইন্টারভিউভীতি সম্ভবত আমার কোন দিন কাটবে না ।

আবারও সেই শরীরে খানিকটা কাঁপন নিয়েই আমি ভাইভা বোর্ডে ঢুকলাম । সালাম দিলাম । এবার ভাইভা বোর্ডে ছিল তিনজন । তবে একজন ছিল মুল টেবিল থেকে দুরে । আমাকে যে টেবিলের সামনে বসতে দেওয়া হল তার বিপরীতে দুইজন বসে । পাশের আরেকটা টেবিলের পেছনে একজন বসে রয়েছে । সে চুপচাপ বসে ছিল । সে কোন প্রশ্ন করে নি । যা প্রশ্ন করেছিলো এই দুইজনই । দুইজনের একজন স্বয়ং ব্যাংকের এমডি সাহেব ! আগের দিন আমি উত্তরা ব্যাংকের ওয়েব সাইট থেকে কিছু তথ্য ঘেটেছিলাম । সেখানেই এমডি সাহেব ছবি পরিচয় ছিল । এই জন্য চিনতে পারলাম । অন্যজন কে ছিল জানি না ।

এমডি সাহেবই প্রশ্ন শুরু করলেন । আমাদের কাছ থেকে আগেই আমাদের সার্টিফিকেটের ফটোকপি নিয়ে নেওয়া হয়েছিলো । সেইটাই সম্ভবত তার হাতে ছিল । সেটার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন পাশ তো অনেক আগে করেছি । এখনও কিছুতে ঢুকি নি কেন !
এই প্রশ্নের উত্তরে যে কিভাবে দেব আমি বুঝলাম না । একটু ক্যাবলা হাসি দিলাম । তারপর আরও কী কী যেন জানতে চাইলেন । সব প্রশ্ন মনে নেই । তবে সেগুলো একটাও পড়াশুনা রিলেটেড ছিল না । একটা সময় জানতে চাইলেন এটাই কি আমার প্রশ্ন ইন্টারভিউ কি না । আমি বললাম, না । আগে কোন কোন টা পরীক্ষা দিয়েছি । বললাম কোথায় কোথায় দিয়েছি । তখন সে বলল ওগুলো কেন চাকরি হয় নি বলে আমার মনে হয় । আমার কাছে জানতে চাইছেন যে আমার কী মনে হয় ! আমার কি ভুল ছিল ! আমি তখন আরও নার্ভাস অনুভব করলাম । মনে হল যে যদি বলি যে হয়েছিলো কিন্তু জয়েন করি নি তাহলে হয়তো এটা কিছুটা বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে । হয়তো এটা একটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল । বলা সত্য বলা উচিৎ ছিল । তবে আমি আংশিক মিথ্যা বললাম যে আসলে আমি ভাইভা দিতে গিয়ে একটু নার্ভাস ফিল করি । তাই হয়তো !
এমডি সাহেব হাসলেন । তারপর বললেন, কই আপনাকে তো বেশ কন্ফিডেন্ট মনে হচ্ছে । নার্ভাসতো মনে হচ্ছে না একদম । আমার ভেতরে তখন কী চলছে তখন কেবল আমি জানি । বুকের ভেতরে ধুকধুক করছে । এমডি সাহেব আর কিছু জানতে চাইলেন না । এবার পাশের লোকটা আমাকে একটা একাডেমিক প্রশ্ন করলেন । তবে সেটা যে কি সেটা এখন আর আমার মনে নেই । প্রশ্নটা আমাকে লিখতে বলা হয়েছিলো এবং ইংরেজিতে । আমার সামনেই একটা খাতা আর কলম রাখা ছিল । আমি সেটার উত্তর লিখে তার দিকে এগিয়ে দিলাম । এর ফাঁকে দেখলাম সেই বয়স্ক লোকটা ভেতরে ঢুকতে যে আমাকে সার্টিফিকেট সত্যায়িত করি নাই কেন জানতে চেয়েছিলো । সে কি যেন বলল এমডি সাহেবকে ।

আমাকে যে প্রশ্নটা লিখতে বলা হয়েছি সেটা লিখে আমি সামনে এগিয়ে দিলাম । সেটা দ্বিতীয়জন দেখলো । দ্বিতীয় লোকটা লেখা টা দেখলেন তারপর আর কিছু জানতে চাইলেন না । আমাকে এবার চলে যেতে বলা হল । যাওয়ার আগে সালাম দিয়ে বের হয়ে এলাম । সব মিলিয়ে মিনিট তিনের মত ছিলাম ভেতরে । কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছিলো যেন কত যুগযুগ ধরে আমি সেখানে ছিলাম । বের হয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম ।

মনের ভেতরে একটা আশা ছিল যে হয়তো ডাক আসবে । পরে খোজ পেয়েছিলাম যে মোট ৪০০ জনকে ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাকা হয়েছিলো । নেবে ১০০ জনকে । বেশ বড় নিয়োগ। পোস্টও ভাল । প্রোভেশনাল অফিসার। বেশ কয়েকদিন পরে রেজাল্ট দিল । তখন ঈদের সময় । আমি গিয়েছি বাড়িতে । ঈদের ঠিক আগের দিন আমার এক বন্ধু ফোন দিয়ে জানালো যে উত্তরা ব্যাংকের রেজাল্ট দিয়েছে । আমি রেজাল্ট দেখতে ওয়েব সাইটেে ঢুকলাম । মোট ৯৯ জনের নাম রয়েছে । তবে সেখানে আমার নাম নেই । চাকরি হয় নি ।

এটাই মূলত আমার দেওয়া শেষ কর্পোরেট ইন্টারভিউ ভাইভা । অবশ্য এর পরে আমি আর কোন ইন্টারভিউ দেই নি ।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.7 / 5. Vote count: 11

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →