আমি এমন একজন মানুষ যাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় যে একটা ভাইভা দিবা নাকি ৫টা লিখিত পরীক্ষা দিবা, আমি চোখ বুঝে বলবো যে আমি আমি লিখিত পরীক্ষা দিব । ভাইভাতে আমার সারা জীবন ভয় । ছাত্র জীবনে থাকা কালীন সময়ে বছরের শেষ সেমিস্টারে আমাদের একটা ভাইভা পরীক্ষা থাকতো । একজন এক্সাটার্নাল আসতেন । আর আমার রোল নম্বর ছিল একেবারে সবার প্রথমে । সবার আগে ভাইভার জন্য ডাকা হত আমাকে । বুঝতেই পারছেন আমার অবস্থা কি হত ! আমাকে স্যারেরা মনের সুখে প্রশ্ন করতেন, আমার অবস্থা কাহিল করে ছেড়ে দিতেন । আমার প্রতি সেমিস্টারে এই এই ভাইভাতে গ্রেড আসতো সব সময় কম । ভাইভা বোর্ডে ঢুকলেই আমি জানা প্রশ্নের উত্তর ভুলে যেতাম ।
সেই হিসাবে আমার প্রথম চাকরির পরীক্ষা খুবই বাজে হওয়ার কথা ছিল । কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে সেটা মোটেও হয় নি । ভাইভার আগে আমাদের লিখিত পরীক্ষা হয়েছিলো । তখন সবে মাত্র পড়াশুনা শেষ করেছি । টুকটাক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি । সাউথইস্ট ব্যাংকের পরীক্ষা ছিল । লিখিত পরীক্ষা দিয়ে এসে মনে হল ভাইভাতে ডাক দিবেই । কারণ পরীক্ষা ভাল হয়েছিলো বেশ । হলও তাই । ভাইভা কার্ড চলে আসলো । ভাইভা পরীক্ষার আগের দিন, এইচআর থেকে আলাদা ভাবে ফোন করে জানিয়ে দেওয়া হল যেন অবশ্যই টাই পরে আসা হয় । এখানে সবাইকে টাই পরতে হয় !
আমার জীবনে সেটাই ছিল প্রথম টাই পরা । এর আগে ফরমাল ড্রেস পরে একাডেমিক ভাইভা দিয়েছি অবশ্য তবে সেখানে টাই কোন দিন পরা হয় নি । এমন কি আমার টাই ছিলও না । বন্ধুর বড় ভাইয়ের কাছ থেকে একটা টাই ধার নিয়ে এলাম । তারপর ইউটিউব থেকে টাই বাঁধা শিখতে শুরু করলাম । কত ভাবে যে টাই বাঁধার চেষ্টা করতে লাগলাম । বার বারই ঝামেলা হয়ে যাচ্ছিলো ।
নির্ধারিত দিন এসে হাজির হল । সময় ছিল সকাল দশটা থেকে । কিন্তু আমি সময়ে বেশ আগেই গিয়ে হাজির হলাম । ফরমাল ড্রেস টাই সু । এখানে বলে রাখি সু টাও পরীক্ষা উপলক্ষ্যে কেনা হয়েছিলো । ছুটির দিন বলে বিধায় মতিঝিলের এই এলাকাটা ফাঁকাই ছিল । একে একে দেখলাম আরও অনেকে এসে হাজির হতে লাগলো । সেদিন সব মিলিয়ে আমরা ১০০ জনের মত ভাইভা দিয়েছিলাম । আগে আমাদের সার্টিফিকেট গুলো চেক করা হল । তারপর আমাদের চেয়ার পেতে বসতে দেওয়া হল । চুপ চাপ বসে রয়েছি চেয়ারে । একে দেখছি মানুষ ঢুকছে আর বের হচ্ছে । সবার ক্ষেত্রে মিনিট ৫ থেকে ১০ । এর বেশি কাউকে রাখা হচ্ছে না । এক সময়ে আমারও ডাক এল । আমি তখন অনুভব করছিলো যে আমার বুকের ভেতরে কেমন ধুকধুক করছিলো । চেয়ার রেখে দরজার দিকে যাওয়ার সময় খেয়াল করছিলাম যে আমার পা একটু একটু কাঁপছে । এমন ভাবে কেন কাঁপছে সেটা আমি নিজেও জানি না । চাকরি হলে হবে নয়তো হবে না, ব্যাস ঝামেলা শেষ । এটা নিয়ে এতো চিন্তার কী আছে ! কিন্তু কিছুতেই নিজের নার্ভাসনেসটা কাটাতে পারছিলাম না । দরজা ঠেকে ঢুকলাম ভেতরে । সালাম দিলাম । মোট দুইজন ছিল । দুইজনই মাঝ বয়সী । আমার আব্বার মত বয়স হবে ।
আমাকে বসতে বলা হল । আমি দেখলাম তাদের হাতে লিখিত পরীক্ষার খাতা । এবং বুঝতে কষ্ট হল না যে এখন যে খাতাটা রয়েছে সেটা আমার । কেন জানি একটু টেনশন কমলো । কারণ আমার লিখিত পরীক্ষা ভাল হয়েছিলো । একজন আমার নাম জিজ্ঞেস করলেন । কোথায় থাকি কি করছি এই সব জানতে চাইলেন প্রথমে । তার কন্ঠ ছিল আন্তরিক । আন্তরিকতার কারণে নার্ভাসনেস কেটে গেল আরও । হোম টাউনের কথা জানতে চাইলেন । তারপর জানতে চাইলেন আমার হোম টাউপের বিখ্যাত কি আছে । দেশের সর্ব বৃহৎ চিনির কল সেখানে । সেটা বললাম । আমি সেখানে গিয়েছি কিনা জানতে চাইলেন । তারপর জানতে চাইলেন আমার নামে একজন বিখ্যাত চলচিত্র পরিচালক আছে তার নাম কি ! সেটা আমার জানা ছিল । বলে দিলাম ।
তার চেহারা দেখে মনে হল সে সন্তুষ্ট হয়েছে । পাশের দিকে তাকিয়ে বললেন আপনি কিছু ধরবেন? সে এবার আমার দিকে ফিরলো । আমার খাতা এখন তার কাছে । আমার দিকে তাকিয়ে প্রথমে জানতে চাইলেন যে অর্থনীতি কাকে বলে । একজন অর্থনীতিবিদের কাজ কী? আর প্রায় চার পাঁচটা প্রশ্ন করলেন আমার পড়াশুনা থেকে । তার মুখ ছিল গম্ভীর । আমি হয়ে পড়েছিলাম নার্ভাস । একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে আমার কথা একটু একটু আটকে গিয়েছিলো । সেটা সে লক্ষ্য করলো বেশ ভাল করেই । তারপর আর কোন প্রশ্ন করলেন না । দুজনেই কি যেন কথা বললেন ।
শেষ পর্যায়ে আমাকে যখন চলে যেতে বলা হবে তার আগে দ্বিতীয়জন বললেন, আপনার যে কথা আটকে গেল এটা কি কোন প্রায়ই হয় । আমি সত্য কথা বললাম। বললাম যে আমি যখন নার্ভাস হই তখন আসলে এমন হয় । তাছাড়া আর কোন সময়ে হয় না । আর এটা আমার প্রথম ভাইভা ! এবার প্রথমজন বললেন, চাকরি যদি হয় জয়েন করবেন তো?
আমি বললাম, অবশ্যই স্যার । জয়েন অবশ্যই করবো !
-আচ্ছা আপনি আসুন !
আমি সালাম দিয়ে বের হয়ে এলাম । দরজা দিয়ে যখন বের হয়ে এলাম মনে হল উপরওয়ালা রক্ষা করেছে । আর এই রকম কক্ষে ঢুকবো না । তবে আমার ঘর ছেড়ে বের হওয়ার সময়ই মনে হল আমি চাকরি পেয়ে যাচ্ছি ।
এইচআর থেকে আমাকে আবার ফোন দেওয়া হল প্রায় ১০ দিন পরে । সকাল ১০টার দিকে ফোন দিয়ে বলা হল যেন দুপুর একটার দিকে হেড অফিসে এসে এপোয়েন্টমেন্ট লেটারটা নিয়ে যাই । সত্যি বলতে কি সবার জীবনে বিশেষ বিশেষ কিছু মুহর্ত আসে । যেমন প্রথম প্রেমে পড়া, এসএসসির রেজাল্ট, ভাল ভার্সিটিতে চান্স পাওয়া আর চাকরি পাওয়া …. এই রকম অনেক গুলো মুহুর্ত জীবনে অন্য রকম একটা অনুভূতি এসে জমা হয় । এই অনুভূতিটা ভাষায় ব্যাখ্যা করা সম্ভব না । কেবল মাত্র উপভোগ করা যায় ।
আমি চাকরির খবর পেয়ে কাউকেই বললাম না । হেড অফিসে গিয়ে হাজির হলাম । লেটার নিয়ে বাইরে বের হয়ে এলাম । রাস্তার ফুটপাথ দিয়ে হাটছি । পকেটে খামটার অস্তিত্ব অনুভব করছি । সবার প্রথমে ফোন দিলাম আমার বাবাকে । সেদিন আমি চাকরি পেয়েছি এই সমান্য একটা লাইন বলতে গিয়ে আমার গলা ধরে এসেছিলো । কেন এসেছিলো আমার জানা নেই ।
ফোন রেখে কিছু সময় এদিক ওদিক হাটলাম । তারপর আরও ইন্টারভিউ দিয়েছি । লেটারও এসেছে হাতে কিন্তু এই অনুভূতি আর কোন বারে হয় নি ।
Discover more from অপু তানভীর
Subscribe to get the latest posts sent to your email.