আমার প্রথম কর্পোরেট চাকরির ইন্টারভিউয়ের অভিজ্ঞতা

অপু তানভীর
4.8
(29)

আমি এমন একজন মানুষ যাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় যে একটা ভাইভা দিবা নাকি ৫টা লিখিত পরীক্ষা দিবা, আমি চোখ বুঝে বলবো যে আমি আমি লিখিত পরীক্ষা দিব । ভাইভাতে আমার সারা জীবন ভয় । ছাত্র জীবনে থাকা কালীন সময়ে বছরের শেষ সেমিস্টারে আমাদের একটা ভাইভা পরীক্ষা থাকতো । একজন এক্সাটার্নাল আসতেন । আর আমার রোল নম্বর ছিল একেবারে সবার প্রথমে । সবার আগে ভাইভার জন্য ডাকা হত আমাকে । বুঝতেই পারছেন আমার অবস্থা কি হত ! আমাকে স্যারেরা মনের সুখে প্রশ্ন করতেন, আমার অবস্থা কাহিল করে ছেড়ে দিতেন । আমার প্রতি সেমিস্টারে এই এই ভাইভাতে গ্রেড আসতো সব সময় কম । ভাইভা বোর্ডে ঢুকলেই আমি জানা প্রশ্নের উত্তর ভুলে যেতাম ।

সেই হিসাবে আমার প্রথম চাকরির পরীক্ষা খুবই বাজে হওয়ার কথা ছিল । কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে সেটা মোটেও হয় নি । ভাইভার আগে আমাদের লিখিত পরীক্ষা হয়েছিলো । তখন সবে মাত্র পড়াশুনা শেষ করেছি । টুকটাক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি । সাউথইস্ট ব্যাংকের পরীক্ষা ছিল । লিখিত পরীক্ষা দিয়ে এসে মনে হল ভাইভাতে ডাক দিবেই । কারণ পরীক্ষা ভাল হয়েছিলো বেশ । হলও তাই । ভাইভা কার্ড চলে আসলো । ভাইভা পরীক্ষার আগের দিন, এইচআর থেকে আলাদা ভাবে ফোন করে জানিয়ে দেওয়া হল যেন অবশ্যই টাই পরে আসা হয় । এখানে সবাইকে টাই পরতে হয় !

আমার জীবনে সেটাই ছিল প্রথম টাই পরা । এর আগে ফরমাল ড্রেস পরে একাডেমিক ভাইভা দিয়েছি অবশ্য তবে সেখানে টাই কোন দিন পরা হয় নি । এমন কি আমার টাই ছিলও না । বন্ধুর বড় ভাইয়ের কাছ থেকে একটা টাই ধার নিয়ে এলাম । তারপর ইউটিউব থেকে টাই বাঁধা শিখতে শুরু করলাম । কত ভাবে যে টাই বাঁধার চেষ্টা করতে লাগলাম । বার বারই ঝামেলা হয়ে যাচ্ছিলো ।

নির্ধারিত দিন এসে হাজির হল । সময় ছিল সকাল দশটা থেকে । কিন্তু আমি সময়ে বেশ আগেই গিয়ে হাজির হলাম । ফরমাল ড্রেস টাই সু । এখানে বলে রাখি সু টাও পরীক্ষা উপলক্ষ্যে কেনা হয়েছিলো । ছুটির দিন বলে বিধায় মতিঝিলের এই এলাকাটা ফাঁকাই ছিল । একে একে দেখলাম আরও অনেকে এসে হাজির হতে লাগলো । সেদিন সব মিলিয়ে আমরা ১০০ জনের মত ভাইভা দিয়েছিলাম । আগে আমাদের সার্টিফিকেট গুলো চেক করা হল । তারপর আমাদের চেয়ার পেতে বসতে দেওয়া হল । চুপ চাপ বসে রয়েছি চেয়ারে । একে দেখছি মানুষ ঢুকছে আর বের হচ্ছে । সবার ক্ষেত্রে মিনিট ৫ থেকে ১০ । এর বেশি কাউকে রাখা হচ্ছে না । এক সময়ে আমারও ডাক এল । আমি তখন অনুভব করছিলো যে আমার বুকের ভেতরে কেমন ধুকধুক করছিলো । চেয়ার রেখে দরজার দিকে যাওয়ার সময় খেয়াল করছিলাম যে আমার পা একটু একটু কাঁপছে । এমন ভাবে কেন কাঁপছে সেটা আমি নিজেও জানি না । চাকরি হলে হবে নয়তো হবে না, ব্যাস ঝামেলা শেষ । এটা নিয়ে এতো চিন্তার কী আছে ! কিন্তু কিছুতেই নিজের নার্ভাসনেসটা কাটাতে পারছিলাম না । দরজা ঠেকে ঢুকলাম ভেতরে । সালাম দিলাম । মোট দুইজন ছিল । দুইজনই মাঝ বয়সী । আমার আব্বার মত বয়স হবে ।

আমাকে বসতে বলা হল । আমি দেখলাম তাদের হাতে লিখিত পরীক্ষার খাতা । এবং বুঝতে কষ্ট হল না যে এখন যে খাতাটা রয়েছে সেটা আমার । কেন জানি একটু টেনশন কমলো । কারণ আমার লিখিত পরীক্ষা ভাল হয়েছিলো । একজন আমার নাম জিজ্ঞেস করলেন । কোথায় থাকি কি করছি এই সব জানতে চাইলেন প্রথমে । তার কন্ঠ ছিল আন্তরিক । আন্তরিকতার কারণে নার্ভাসনেস কেটে গেল আরও । হোম টাউনের কথা জানতে চাইলেন । তারপর জানতে চাইলেন আমার হোম টাউপের বিখ্যাত কি আছে । দেশের সর্ব বৃহৎ চিনির কল সেখানে । সেটা বললাম । আমি সেখানে গিয়েছি কিনা জানতে চাইলেন । তারপর জানতে চাইলেন আমার নামে একজন বিখ্যাত চলচিত্র পরিচালক আছে তার নাম কি ! সেটা আমার জানা ছিল । বলে দিলাম ।

তার চেহারা দেখে মনে হল সে সন্তুষ্ট হয়েছে । পাশের দিকে তাকিয়ে বললেন আপনি কিছু ধরবেন? সে এবার আমার দিকে ফিরলো । আমার খাতা এখন তার কাছে । আমার দিকে তাকিয়ে প্রথমে জানতে চাইলেন যে অর্থনীতি কাকে বলে । একজন অর্থনীতিবিদের কাজ কী? আর প্রায় চার পাঁচটা প্রশ্ন করলেন আমার পড়াশুনা থেকে । তার মুখ ছিল গম্ভীর । আমি হয়ে পড়েছিলাম নার্ভাস । একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে আমার কথা একটু একটু আটকে গিয়েছিলো । সেটা সে লক্ষ্য করলো বেশ ভাল করেই । তারপর আর কোন প্রশ্ন করলেন না । দুজনেই কি যেন কথা বললেন ।

শেষ পর্যায়ে আমাকে যখন চলে যেতে বলা হবে তার আগে দ্বিতীয়জন বললেন, আপনার যে কথা আটকে গেল এটা কি কোন প্রায়ই হয় । আমি সত্য কথা বললাম। বললাম যে আমি যখন নার্ভাস হই তখন আসলে এমন হয় । তাছাড়া আর কোন সময়ে হয় না । আর এটা আমার প্রথম ভাইভা ! এবার প্রথমজন বললেন, চাকরি যদি হয় জয়েন করবেন তো?
আমি বললাম, অবশ্যই স্যার । জয়েন অবশ্যই করবো !
-আচ্ছা আপনি আসুন !

আমি সালাম দিয়ে বের হয়ে এলাম । দরজা দিয়ে যখন বের হয়ে এলাম মনে হল উপরওয়ালা রক্ষা করেছে । আর এই রকম কক্ষে ঢুকবো না । তবে আমার ঘর ছেড়ে বের হওয়ার সময়ই মনে হল আমি চাকরি পেয়ে যাচ্ছি ।

এইচআর থেকে আমাকে আবার ফোন দেওয়া হল প্রায় ১০ দিন পরে । সকাল ১০টার দিকে ফোন দিয়ে বলা হল যেন দুপুর একটার দিকে হেড অফিসে এসে এপোয়েন্টমেন্ট লেটারটা নিয়ে যাই । সত্যি বলতে কি সবার জীবনে বিশেষ বিশেষ কিছু মুহর্ত আসে । যেমন প্রথম প্রেমে পড়া, এসএসসির রেজাল্ট, ভাল ভার্সিটিতে চান্স পাওয়া আর চাকরি পাওয়া …. এই রকম অনেক গুলো মুহুর্ত জীবনে অন্য রকম একটা অনুভূতি এসে জমা হয় । এই অনুভূতিটা ভাষায় ব্যাখ্যা করা সম্ভব না । কেবল মাত্র উপভোগ করা যায় ।

আমি চাকরির খবর পেয়ে কাউকেই বললাম না । হেড অফিসে গিয়ে হাজির হলাম । লেটার নিয়ে বাইরে বের হয়ে এলাম । রাস্তার ফুটপাথ দিয়ে হাটছি । পকেটে খামটার অস্তিত্ব অনুভব করছি । সবার প্রথমে ফোন দিলাম আমার বাবাকে । সেদিন আমি চাকরি পেয়েছি এই সমান্য একটা লাইন বলতে গিয়ে আমার গলা ধরে এসেছিলো । কেন এসেছিলো আমার জানা নেই ।

ফোন রেখে কিছু সময় এদিক ওদিক হাটলাম । তারপর আরও ইন্টারভিউ দিয়েছি । লেটারও এসেছে হাতে কিন্তু এই অনুভূতি আর কোন বারে হয় নি ।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.8 / 5. Vote count: 29

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →