আমার খুব ইচ্ছে অবনীকে একটু জড়িয়ে ধরি । মেয়েটার চোখে দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে । আমার জন্য মেয়েটা কাঁদছে । কেঁদেই চলেছে । ক্যাম্পাসের এই পুকুর পাড়টা একটু নির্জন । মানুষ জন খুব একটা আসে না । অবশ্য আসলেও খুব একটা সমস্যা ছিল না । আমরা এমন কোন কাজ করছি না যে কেউ দেখে ফেললে সেটা আমাদের জন্য খারাপ কিছু হবে । তবে কেউ দেখলে তাদের মনে ঠিকই এই প্রশ্ন জাগবে যে মেয়েটা কেন এভাবে কাঁদছে !
আমি কোন মতে বললাম, অবনী, তুমি কেঁদো না প্লিজ । এভাবে কেঁদো না ।
অবনীর কান্না তো কমলোই না বরং বাড়ল আরো । কোন মতে সে বলল, আমি বাবাকে অনেক বার বোঝানোর চেষ্টা করেছি । বিশ্বাস করুন ।
-আমি জানি তুমি চেষ্টা করেছ । তুমি কেন কাঁদছো?
অবনী কেমন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো । আমার বুকের ভেতরে কেমন যেন করে উঠলো । মনে হল, ইস ! এই মেয়েটাকে আমার আর বিয়ে করা হল না । এই চমৎকার মেয়েটা কে আর পাওয়া হল না ।
আমি নিজের হাত দিয়ে অবনীর মাথায় হাত রাখলাম । তারপর বলল, কেঁদো না । এই জীবনে বাবা মায়ের ইচ্ছেটা অনেক বড় । তারা তোমার সব থেকে আপনজন । তারা তোমার ভালই চাইবে ।
অবনী কোন কথা বলল না । আমার দিকে তাকিয়ে রইলো আর নিরবে কাঁদতে লাগলো ।
ওর কান্না থামতে আরও কিছু সময় লাগলো । আমি তাকিয়ে দেখলাম চারিপাশটা অন্ধকার হয়ে আসছে । অবনীকে বললাম, বৃষ্টি নামবে মনে হয় । চল যাওয়া যাক ।
অবনীর নিজেকে সামলে নিতে আরও কিছু সময় লাগলো । টিস্যু নিয়ে নিজেকে চেহারা মুছে নিল । তারপর আমরা সামনের দিকে এগোতে লাগলাম । ক্যাম্পাসের সামনের দিকে এসেছি এমন সময় বৃষ্টি নামলো । আমি একটু তাড়াহুড়া করে হাটতে শুরু করতে যাবো, তখন দেখি অবনী হাটছে আস্তে আস্তে । ওর যেন দ্রুত হেটে বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার কোন ইচ্ছেই নেই । ওর ইচ্ছেই বৃষ্টিতে ভেজার । আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমার সাথে বৃষ্টিতে ভিজবেন ?
-চল ভিজি।
বলতে না বলতেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল । আমার কাছে মোবাইল ছাড়া আর কিছু নেই যা ভিজলে সমস্যা হবে অবনী সেটা নিয়ে নিজের ব্যাগের ভেতরে ঢুকিয়ে রাখলো । তারপর আমার সাথে ভিজতে লাগলো ।
সত্যি বলতে কী, এমন একটা দিন যে আসবে সেটা আমি ভাবতে পারি নি ।
অবনী ঠিক আমার প্রেমিকা নয় । এমন কী সে আমার বন্ধুও নয় । ওর সাথে আমার পরিচয় আমাদের একটা কমন বন্ধুর মাধ্যমে । পড়ালেখা শেষ করে চাকরি পাওয়ার পরপরই আমার বাসা থেকে বিয়ের জন্য মেয়ে দেখা শুরু করে । এটাই স্বাভাবিক ছিল । আমারও খুব একটা আপত্তি ছিল না । এমনই এক সময়ে অবনীকে দেখতে পেলাম । বাবার দিককার এক আত্মীয় বাড়িতে । বিয়ের দাওয়াতে । সেখানেই ওকে আমার মা অবনীকে দেখলো । আমাকে দেখালো । তারপর মাস খানেকের মধ্যে মা কিভাবে যেন সব খোজ খবর নিয়ে ফেলল ।
চাকরি শুরু করলেও ক্যাম্পাসে আমি আসতাম নিয়মিত । আমার কয়েকজন বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতাম নিয়মিত । এই ক্যাম্পাসেই আবার অবনীর সাথে দেখা হল । আড্ডাই দিচ্ছিলাম তখন দেখলাম অবনী তার কয়েকজন বন্ধুর সাথেই আড্ডা দিচ্ছিলো । আমার মত সেও আমার দিকে তাকাচ্ছিল বারবার । এবং অবাক করার ব্যাপার হচ্ছে আমি যখন বন্ধুদের সাথে কথা বলছি তখনই আমার ফোনে একট ফোন এসে হাজির হল । অপরিচিত নম্বর । ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে একজন বলে উঠলো, কত সময় থাকবেন ?
আমি বলতে গেলাম কে বলছেন কিন্তু থেমে গেলাম অবনীর দিকে তাকাতেই । অবনীর কানে ফোন এবং আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে । আমার বুঝতে মোটেই কষ্ট হল না যে যে ফোনটা অবনীই করেছে । সম্ভবত সে আমার নম্বর যোগার করেছে ।
আমি বললাম, এই আধা ঘন্টা ।
অবনী ওপাশ থেকে বলল, আচ্ছা যাওয়ার আগে একটু রোকেয়া হলের সামনে দাড়াবেন প্লিজ ।
আমি দেখলাম যে একটু পরে অবনী উঠে গেল । আমিও উঠে দাড়ালাম । বন্ধুদের সাথে বিদায় নিয়ে বের হয়ে এলাম । গিয়ে হাজির হলাম হলের সামনে । আমার দাড়াতেই দেখলাম অবনী সামনে এল । আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কেমন আছেন?
-ভাল। তুমি ?
প্রথমেই তুমি বলতে একটু অস্বস্থি যে লাগছি না সেটা বলব না । তবে মেয়েটা আমার ছোটই হবে । এখনও পড়ালেখা শেষ হয় নি । ক্যাম্পাসের সিনিয়ার হিসাবেও তো তাকে তুমি বলা যায় ।
-আমি আছি ভালই । তা আপনি কি নিয়মিতই এখানে আসেন?
-হ্যা । অনেক দিনের অভ্যাস !
এইভাবে আমাদের কথা শুরু হল । প্রতিদিন আমাদের দেখা হল ক্যাম্পাসে । টুকটাক কথা হত । চা খাওয়া হত । ফোনে মেসেঞ্জারে প্রথমে চ্যাট তারপর ভয়েজ ভিডিও কল । এভাবে কেটে গেল মাস দুয়েক । বিয়ের কথা টুকটাক এগিয়ে চলছে । এমন সময় সব বন্ধ হয়ে গেল । অবনীর বাসা থেকে আমাদের জানানো হল যে এখন তারা মেয়েকে বিয়ে দিবে না ।
প্রথম কদিন দেখলাম অবনীও আমাকে এড়িয়ে চলল। তারপর একদিন নিজ থেকেই দেখা করলো । দেখা করে জানালো যে তার বাবা এক বিসিএস কাস্টম অফিসারকে পছন্দ করে তার জন্য । তার সাথেই বিয়ে দিবে ।
আমার মন একটু খারাপ হল । পাত্র হিসাবে আমি মোটামুটি । একটা বেসরকারী ব্যাংকে আমি চাকরি করি । বেতন বলা যায় বেশ তবে । তবে সেটা বিসিএস কাস্টমস অফিসারের কাছে কিছু না । যে কোন মেয়ের বাবাই আমাকে রেখে ঐটাই ভাল অপশনকেই মেনে নিবে । আমার বড় বোনের ক্ষেত্রেও আমার বাবা একই পন্থা বেঁছে নিয়ে।
আমি একটু হাসলাম । তারপর ওকে ভাল থেকো বলে চলে এলাম ।
তবে অবনী তারপরেও আমার সাথে দেখা করতে থাকলো । ও মুখ ফুটে কিছু না বললেও আমার বুঝতে কষ্ট হল না যে মেয়েটা আমাকে পছন্দ করেছে এবং আমাকে বিয়ে করতে চায় কিন্তু বাবার কারণে কিছু বলতে পাচ্ছে না । আমিও কিছু বলতে পারছি না ।
কালকে অবনীর গায়ে হলুদ । আজকেও সে আমার সাথে সাথে দেখা করতে এসেছিল । এবং এ সময়ে এমন ভাবে বৃষ্টি নামলো । আমরা একসাথে আরও কিছু সময় বৃষ্টিতে ভিজলাম । তারপর এক সাথে রিক্সাতে করে আরও কিছু সময় ঘুরলাম আমরা । আমার মনে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছিলো । কেমন যেন ভাবছিলাম । বারবার কেবল মনে হচ্ছে এই মেয়েটার সাথে আমার বিয়ে হচ্ছে না । কালকেই মেয়েটা অন্য কারো হয়ে যাবে । ভাবতে কষ্ট লাগল।
ওকে ওর বাসায় নামিয়ে দিলাম । তারপর আমি আরও কিছু সময় একা একাই ঘুরে বেড়ালাম একা একা । মনটা বড় বেশি উদাস হয়ে গেল ।
আমি ভেবেছিলাম হয়তো অবনীর সাথে আর কোন দিন দেখা হবে না । কিন্তু পরের দিনই যে আবার দেখা হবে সেটা আমার ধারণার বাইরে ছিল । সকালে অফিসে যাওয়ার জন্য বের হয়েছি এমন সময় অবনীর ফোন এসে হাজির । আমি ফোনটা পেয়ে একটু অবাক হলাম । ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে বলল, আমি যাচ্ছি পার্লারে । আপনি আসবেন?
-আমি?
-হ্যা । আসবেন প্লিজ ?
-আচ্ছা । কোন পার্লারে?
-আপনার অফিসের কাছেই । ঐ রেনোভাটা আসে না, ওখানে…
-আচ্ছা আমি আসছি ।
অফিসের কাছে যেহেতু তাই খুব একটা সমস্যা হওয়ার কথা না । কিছু কাটিয়ে আবার অফিসে ফিরে যাবো । আমি পার্লারের সামনে যেতেই দেখতে পেলাম ওকে । ওর পরনে একটা সাদা টিশার্ট আর কাল জিন্স । হাতে একটা ব্যাগ । আমি কাছে যেতেই বললাম, আর কেউ আসে নি তোমার সাথে?
-না ।
-ও । চল ভেতরে ।
-আমি ভেতরে যাওয়ার জন্য আসি নি আজ।
আমি যেন ছোট খাটো একটা ধাক্কা খেলাম । কোন মতে বললাম, মানে?
-মানে ?
-কালকের পরে কোন ভাবেই আমার কাউকে বিয়ে করা সম্ভব না । আমি সারা রাত ভেবেছি ।
-কিন্তু তোমার বাবা মা !
-আমি অনেক রিকোয়েস্ট করেছি তাদের । অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেছি । তারা শুনে নি । কেবল নিজের সিদ্ধান্ত আমার উপরে চাপিয়ে দিয়েছে । এই ব্যাপারটা কাল আরও ভাল করে বুঝেছি আমি ।
-এখন?
-এখন আমি চাই আপনাকে বিয়ে করতে । যদি আপনি চান।
-আমি তো অবশ্যই চাই ।
-তাহলে চলুন । আর দেরি করে লাভ নেই । একবার বিয়ে হয়ে গেলে আর কিছু করার থাকবে না ।
তাই তো । একবার বিয়ে হয়ে গেলে আর কিছু করার থাকবে না ।
আমাদের অফিসের পাশেই একটা কাজী অফিস রয়েছে । ওকে নিয়ে সেই দিকে পা বাড়াতে যাবো ঠিক সেই সময়েই আমার কিছু একটার সাথে বেঁধে আমি পড়ে গেলাম । এবং সাথে সাথেই আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল । তাকিয়ে দেখি দুপুর হয়ে গেছে । আমি এতো সময় তাহলে স্বপ্ন দেখছিলাম । অবনী আসে নি । আসার কোন কারণ নেই । আজকে তার গায়ে হলুদ । কাল বিয়ে ।
বৃষ্টি তে ভেজাও হয় নি,,জড়িয়ে ধরাও হয় নি,,একরাশ অপুর্নতা রেখেই তাকে যেতে দিতে হয়েছিলো।। 😊
আপনার তো বাস্তব সপ্ন সবই আসে, আমার কো কিছুই আসে না