পিএস মাহমুদ খানিকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো প্রেসিডেন্ট আমান ফারিজের দিকে। সে যা বলছে সেটা শুনে মাহমুদের দুই কান গরম হয়ে গেছে । এখন তার নিজের চুপ ছিড়তে ইচ্ছে করছে । নিজের গালে একটা কষে চড়ও দিতে ইচ্ছে করছে। কোন দুঃখে সে ফেসবুক স্টাটাসটা প্রেসিডেন্টকে দেখাতে গিয়েছিলো! যদি সেটা না দেখাতো তাহলে নিশ্চিত এখন প্রেসিডেন্ট আমান ফারিজ নিজের স্টাডি রুমে বসে বই পড়তো। দিনের সকল কাজ শেষ করে এই সময়টা সাধারনত সে নিজের স্টাডি রুমে কাটায়।
-স্যার আরেকবার একটু ভাববেন, প্লিজ !
-কোন ভাবাভাবি নেই। শোন কোন প্রোটোকলের দরকার নেই। শাফিক আর নাইমকে ডাক দাও। সাথে নিমিলাকে নাও । ব্যাস, এই তিনজন পেছনের গাড়িতে থাকবে। আমার সাথে কেবল তুমি থাকবে। কোন প্রেসিডেন্সিয়াল ফ্ল্যাগ থাকবে না। কেউ জানবেই না যে আমি বের হচ্ছি !
মাহমুদ বলল, যদি চেয়ারম্যান স্যার জানতে পারেন !
-মাহমুদ ! সে পার্টি চেয়ারম্যান হতে পারে কিন্তু দেশ চালাই আমি আর তুমি আমার চাকরি কর। আমার কথা শোনা তোমার কাজ , তার কথা চিন্তা করা না !
যদিও আমান ফারিজ নিজেও জানে পার্টি চেয়ারম্যান মানে তার বাবা যদি এই ঘটনা জানতে পারে তাহলে তার খবর আছে। মাহমুদকে সেই বকা দিবে। একটু না হয় দিক ! কী যায় আসে ! মেয়েটার মুখে হাসি ফোটানো যাবে এটা সব থেকে জরুরী !
ডাক্তার নাদিয়া সারমিন নিজের কেবিনে বসে ছিলো । আজকে তার নাইট ডিউটি । সন্ধ্যা ছয়টা থেকে শুরু হয়েছে । চলবে সকাল ছয়টা পর্যন্ত । ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সবে মাত্র রাত দশ । একটু আগে একবার রাউন্ড দিয়ে এসেছেন । আবার একঘন্টা পরে আরেকবার রাউন্ডে যাবেন । এর মাঝে ইমারেজন্সী না হলে আর যাওয়ার দরকার নেই । এই সময়টা নাদিয়া সাধারনত বই পড়ে কিংবা মোবাইলে ফেসবুক ব্রাউজ করে । বইটা সে রাত বারোটার পরে পড়া শুরু করে ।
মোবাইল বের করে ফেসবুকে লগিন করলো সে । কালকের দেওয়া স্টাটাসটার দিকে তাকালো । বেশ কিছু লাইক আর কমেন্ট এসেছে সেখানে। নাদিয়া খুব একটা পোস্ট দেয় না । কিন্তু কালকে এমন মন খারাপ ছিল টুকুন মেয়েটার জন্য । মেয়েটার হাতে সত্যিই আর সময় খুব বেশি নেই।
২০৫০ সালে এসে চিকিৎসা বিজ্ঞাস কত আধুনিক হয়েছে । এখন দেশেই খুব ভাল ক্যান্সার চিকিৎসা হয় । ৫০০ সজ্য বিশিষ্ট একটা বিশাল আর অত্যাধুনিক ক্যান্সার হাসপাতালে নাদিয়া কাজ করে । এখানে সব ধরনের ক্যান্সার চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে । দেশী বিদেশী অনেক ডাক্তার রয়েছে কিন্তু তারপরেও তাদের কিছু করার নেই । আসলে কিছু কিছু ব্যাপার কেবল মাত্র উপরওয়ালার হাতেই থাকে । মানুষ কেবল চেষ্টা করছে পারে । অন্য কিছু করতে পারে না ।
টুকুন মেয়েটার অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে । আর মেয়েটা নিজেও সেটা বুঝতে পারছে । কিন্তু তারপরেও সব সময় কী না হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করছে সে । ইস, মেয়েটার জন্য যদি সে কিছু করতে পারতো! এটা নিয়েই সে লিখেছিলো গতদিন। মেয়েটার শেষ ইচ্ছে পূরণের ব্যাপারে । মেয়েটা তার পছন্দের মানুষের সাথে দেখা করতে চায় । কিন্তু সেই মানুষটা বলতে গেলে একেবারে ধরা ছোঁয়ার বাইরে । এই এগারো বছরের মেয়েদের সাধারণত কোন কার্টুন চরিত্র কিংবা নায়ক গায়কদের পছন্দ থাকে কিন্তু এই মেয়েটার পছন্দ দেশের প্রেসিডেন্টকে ! কী আজিব একটা ব্যাপার !
অবশ্য দেশের বর্তমান প্রেসিডেন্ট আমান ফারিজ আসলেই পছন্দ করার মতই একজন মানুষ । পুরো দেশের মানুষ তাকে পছন্দ করে । কিন্তু তাই বলে তাকে তো আর বলা যায় না আপনি আসুন তো, এই মেয়েটার সাথে একটু দেখা করে যান ।
নাদিয়ার মনটা আবারও খারাপ হল একটু । তখনই দরজার দিয়ে একজন অপরিচিত মানুষ ঢুকলো । পুরো ঘরটা দেখলো একবার । নাদিয়ার মনে হল লোকটা সব কিছু পরীক্ষা করে দেখছে । এই লোকটা কে ?
নাদিয়া বলল, কী ব্যাপার আপনি ?
লোকটা সেই কথার জবাব দিলো না । কানের কাছে এক হাত নিয়ে বলল, অল ক্লিয়ার ।
নাদিয়া আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো তখনই তার জীবনের সব থেকে আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটলো । আরও একজন মানুষকে সে কেবিনে ঢুকতে দেখলো । সেই মানুষটাকে চিনতে মাত্র তিন সেকেন্ড লাগলো । আমান ফারিজ হাসি মুখে তার সামনে এসে দাড়িয়ে বলল, মিস নাদিয়া। আপনার সাথে এভাবে দেখা করতে আসার কারণে আমি খানিকটা লজ্জিত । আসলে আপনার পেসেন্টের সাথে আমি দেখা করতে এসেছি । আই হোপ আপনার কোন আপত্তি নেই!
নাদিয়ার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হল না । সে কেবল একবার মাথাটা দুই দিকে নাড়ালো ।
-গুড । চলুন । যাওয়া যাক । আমার হাতে একদম সময় নেই । কেউ কিছু বোঝার আগেই আমার আমাকে রেসিডেন্সে ফিরে যেতে হবে !
নাদিয়া যখন করিডোর দিয়ে হাত তে শুরু করলো তখনও ওর ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না যে সে আমান ফারিজের পাশে হাটছে । এই মানুষটা টুকুনের সাথে দেখা করতে এসেছে । তার মানে কোন ভাবে তার স্টাটাসটা প্রেসিডেন্টের নজরে এসেছে । আর তিনি কোন প্রকার প্রটোকল না নিয়েই চলে এসেছেন ।
নাদিয়া যখন মেডিকেলে পড়তো তখন একবার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট তাদের কলেজ পরিদর্শনে এসেছিলো । কত যর প্রটোকল আর নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল সেখানে তার কোন ইয়ত্তা নেই । এমন কি তাদের মোবাইল ফোন পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার অনুমুতি ছিল না । অথচ এই মানুষটা তার পাশ দিয়ে হাটছে । সামনে দুজন গার্ডকে দেখা যাচ্ছে । আর পেছনে দুইজন । তাদের একজন আবার গার্ড না, সম্ভবত পিএ হবে । সে চিন্তিত মুখে সব কিছু দেখছে । নিশ্চিত ভাবেই সেএসব পছন্দ করছে না ।
হাটতে হাটতে টুকুনের কেবিনের সামনে চলে এল ওরা । ভেতরে টুকুন আর ওর মা রয়েছে । এখনও ঘুমানোর সময় হয় নি । সারা দিন শুয়ে বসে কাটানোর কারণে রাতে ঘুম আসতে দেরি হয় ।
নাদিয়া ভেতরে ঢুকলো । টিভি চলছিলো । টুকুনের মা একটা চেয়ারে বসে কমলা লেবুর খোঁসা ছাড়াচ্ছিলো আর টুকুন টিভির দিকে তাকিয়ে ছিল।
নাদিয়াকে ঢুকতে দেখে টুকুন হাসলো । তারপর বলল, আসুন আন্টি । দেখুন একটু পরেই প্রেসিডেন্ট স্যারকে দেখাবে । আজকে সে চীন মৈত্রীতে গিয়েছিলো।
নাদিয়া হাসলো । বলল, তোমার জন্য আরও বড় কিছু অপেক্ষা করছে ।
-তাই? কী?
-দেখতে চাও ?
-হুম !
ঠিক তখনই দরজা খুলে আমান ফারিজ ঢুকলো । প্রথম কয়েক মুহুর্ত কেউ কোন কথা বলল না । নাদিয়া কেবল দেখলো টুকুনের মায়ের হাত থেকে কমলালেবুটা পড়ে গেল । টুকুনের কয়েক মুহুর্ত লাগলো বুঝতে । তারপরই সে চিৎকার দিয়ে উঠলো আনন্দে !
টুকুন নিজের বিছানা ছেড়ে উঠে আসতে গেল কিন্তু আমান ফারিজ সেটা হতে দিল না । সে নিজেই দৌড়ে এগিয়ে এল তার বেডের কাছে । তারপর বলল, আরে তুমি কেন উঠছো শুনি ? উঠো না !
নাদিয়া কেবল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো টুকুনের চেহারার দিকে । মেয়েটার চোখ দিয়ে পানি পড়া শুরু করেছে তবে সেই পানি আনন্দের ! নাদিয়ার কাছে এখনও সব কিছু কেমন অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে ! আচ্ছা এমন কি সম্ভবনা রয়েছে যে সে স্বপ্ন দেখছে ? এমন তো হতে পারে ! পারে না?
আমান ফারিজ থাকলো আরও আধা ঘন্টা । টুকুনের সাথে সেলফি তুলল । নাদিয়াও তুলল সেলফি । এমন সুযোগ তো আর বারবার আসে না ।
একসময় মাহমুদ এসে বলল, আমাদের এখন যাওয়া দরকার । খবর এসেছে চেয়ারম্যান স্যার বাসায় দিকে রওয়ানা দিয়েছেন !
আমান ফারিজ এবার টুকুনের দিকে তাকিয়ে বলল, দেখেছো তো কী অবস্থা ! আমি দেশের প্রেসিডেন্ট তবুও এখনও বাবার কথা মত চলতে হয় ! তবে আমাদের আবার দেখা হবে । তুমি সুস্থ হয়ে এবার প্রেসিডেন্স রেসিডেন্সে আসবে । ঠিক তো !
টুকুন হাসলো । তারপর বলল, অবশ্যই !
-আমি তাহলে যাই ?
-আচ্ছা ।
আমান ফারিজ উঠে দাড়ালো । নাদিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, ডাক্তার ম্যাম, থাকুন তাহলে । আমি আসি !
নাদিয়ার হঠাৎ কী যে হল সে নিজেও বলতে পারবে না । সে আমান ফারিজকে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে । ধরেই থাকলো । তারপর আবার ছেড়ে দিলো হঠাৎ করেই । লজ্জিত চোখ তাকালো তারপর । বলল, সরি মিস্টার প্রেসিডেন্ট স্যার। আসলে আমি এখনও ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না ।
ফারিজ কেবল হাসলো । বলল, সরি বলতে হবে না । আসি আমি ।
নাদিয়াও তাদের সাথে সাথেই গেট পর্যন্ত এল । মুখে মাস্ক থাকার কারণে প্রেসিডেন্টকে কেউ চিনতে পারে নি । গাড়িতে ওঠার আগে নাদিয়া বলল, স্যার একটা অনুমুতি চাই ।
-বলুন ।
-আপনার সাথে তোলা এই ছবি কি আমি শেয়ার করতে পারি !
মাহমুদ জলদি বলে উঠলো, খবরদার না । আমরা যে এখানে এসেছি সেটা কেউ জানে না !
আমান ফারিজ বলল, ওহ মাহমুদ । চুপ করো না ।
তারপর নাদিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, ওকে আপনি শেয়ার করতে পারেন তবে আগে বাসায় পৌছে নিই । এই ধরুন ঘন্টা খানেক পরে । কেমন ?
-জ্বি আচ্ছা !
-স্যার !
মাহমুদ আবার বলল।
-যদি চেয়ারম্যান স্যার….
-মাহমুদ …. তোমাকে আমি আগেই বলেছি তুমি আমার চাকরি কর, চেয়ারম্যান স্যারের না ।
-জ্বি স্যার !
-চল এবার যাওয়া যাক ! মিস নাদিয়া ভাল থাকুন । হয়তো আবার কখনও দেখা হবে !
নাদিয়া কেবল অবাক হয়ে তাদের চলে যেতে দেখলো । তার শরীর এখনও খানিকটা কাঁপছে । এখনও সে বিশ্বাস করতে পারছে না সত্যিই সে এসেছিলো !
Discover more from অপু তানভীর
Subscribe to get the latest posts sent to your email.