আমিনুল ইসলাম নিজেকে কোন ভাবেই শান্ত রাখতে পারছেন না । হাসপাতালের কেবিনের ভেতরে বারবার পায়চারি করছেন । কীভাবে নিজেকে শান্ত করবেন বুঝতে পারছেন না । একটু আগে থানাতে গিয়েছিলেন । অফিসার বলেছে যে কোন চিন্তা না করতে । যারা তার ছেলের এই অবস্থা করেছে তাদেরকে ছাড়া হবে না । যে কোন ভাবেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে ।
আমিনুল ইসলাম নিজের ছেলের দিকে তাকালেন । নাফির একটা হাত ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে । ডান পা টি ভাঙ্গা না হলেও ভয়ানক ভাবে মুচড়ে দেওয়া হয়েছে । মাথা ফেঁটেছে কয়েক জায়গায় । শরীরে অগনিত আঘাতের চিহ্ন । নাফির মা অনবরত কেঁদে চলেছেন । তাকে দোষ দেওয়া চলে না । নিজের আদরের ছেলের এই অবস্থা দেখলে যে কারো অবস্থায় এমন হবে । আমিনুল ইসলাম নিজেকে শান্ত রাখতে পারছেন না । একবার কেবল ওদের হাতের কাছে পেয়ে নেন, তারপর মজা বুঝাবে সে ।
সব চেয়ে খারাপ লাগছে আনিকার জন্য । বেঁচারির সাথে আর কদিন পরেই নাফির বিয়ে হবে । সব ঠিক হয়ে আছে । মেয়েটিও কেবিনের ভেতরে বসে রয়েছে । আমিনুল ইসলাম আনিকার মাথায় হাত রাখলেন । তারপর বললেন, চিন্তা কর না মা, নাফি অবস্থা যে করেছে তাকে আমি ছাড়বো না !
এমন সময় একজন ডাক্তার ঢুকলো কেবিনে । আমিনুল ইসলাম তাকে দেখে বললেন, ডাক্তার রিপোর্টে কি বলছেন? ওর সুস্থ হতে কতদিন লাগবে ?
ডাক্তারের চেহারা মাস্ক পরা । কেবল চোখ দুটো দেখা যায় । তখনই আমিনুল ইসলাম ব্যাপারটা খেয়াল করলেন । এই ডাক্তার অন্য জন । একটু আগে যে রিপোর্ট নিয়ে গিয়েছিলো, ইনি সে নন । ডাক্তার এগিয়ে গেল নাফির দিকে । ভাঙ্গা প্লাস্টার করা হাতের দিকে তাকিয়ে রইলো । তারপর পা টা পরীক্ষা করলো হাত দিয়ে । মোচড়ানো স্থানে কেবল কালসিটে পড়ে আছে । হঠাৎ একটা ভয়ংকর কাজ করলো ডাক্তার । কালসিটে পরা স্থানে জোরে চাপ দিল । সাথে সাথে নাফির ঘুম ভেঙ্গে গেল । চিৎকার করে উঠলো সে । সোজা তাকালো ডাক্তারের দিকে । চোখে একটা হতভম্ব ভাব । সেই বিস্ময় ভাবটা মুহুর্তেই আতংকে রূপ নিল । একভাবে তাকিয়ে রইলো ডাক্তারের দিকে ।
আমিনুল ইসলাম চিৎকার করে বললেন, হোয়াট দ্য ফাক ডাক্তার !
সাথে সাথে নাফি চিৎকার করে বলল, ড্যাড, এই লোকই আমাকে মেরেছে !
-কী !
আমিনুল ইসলাম যেন রাগে লাল হয়ে গেল । এতো বড় সাহস । তিনি দ্রুত এগিয়ে গেলেন ডাক্তার রূপী মানুষটার দিকে । এখনই যেন মেরে ফেলবে তাকে । কিন্তু সে আশা তার পূরন হল না । মাঝ পথেই তাকে আটকে যেতে হল । কারণ আগন্তক নিজেই এগিয়ে এসেছে তার দিকে । সোজা গলা চেয়ে ধরেছে তার । এক প্রকার ধাক্কা মেরে দেওয়ার কাছে নিয়ে গেল তাকে । আমিনুল ইসলাম কয়েক মুহুর্ত নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলেন বটে । কিন্তু বুঝতে পারলেন যে সামনের মানুষটার শরীর ভয়ানক শক্ত । তিনি কোন ভাবেই শাক্তিতে কুলিয়ে উঠতে পারবেন না ।
সারা জীবন মানুষ জন তাকে সমীহ করে চলেছে। তার টাকার জোরের কারণে । কিন্তু এখন সেই টাকার জোর কোন কাজে লাগছে না । হঠাৎ আগন্তক বলল, আপনার ছেলেকে কেন মেরেছি জানেন? জানেন কি? কারণ আপনার ছেলে এবং আরও দুইজন মিলে আপনারই অফিসের ইন্টার্ন সোফিয়াকে রেপ করেছে ।
আমিনুল ইসলাম অবাক হয়ে তাকালেন আগন্তককের চোখের দিকে । তারপর বিছানার দিকে চোখ চলে গেল তার । তার ছেলে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে । ছেলের চোখ দেখেই তিনি বূঝতে পারলেন যে আগন্তক ঠিক কথা বলছে । তিনি ছেলের এমন স্বভাবের কথা জানে বেশ ভাল করেই, এগেও এমন ঘটনা ঘটেছে । তবে সেগুলো সামনে আসার আগেই সব সামাল দেওয়া হয়েছে ।
এবার আগন্তক তাকালো নাফির দিকে । নাফি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে তার বাবার দিকে । তার বা ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করছে কিন্তু আগন্তকের শক্তির কাছে অসহায় বোধ করছে। তখনই আগন্তক আস্তে আস্তে আমিনুল ইসলামকে দেওয়ালের সাথে চেপে ধরে একটু উপরে তুলে ধরলো । আমিনুল ইসলামের পা মাটি থেকে উপরে উঠে গেল । সে আরও বেশি ছটফট করতে লাগলো । নাফি মা এতোটাই অবাক হয়ে গেছে যে মুখ দিয়ে একটা কথা তো দুরে থাকুক সামান্যতম চিৎকার করতে ভুলে গেছে, একটুও নড়তে পারছেন না তিনি ।
নাফি এবার চিৎকার করে বলল, প্লিজ বাবাকে ছেড়ে দিন । প্লিজ বাবাকে ছেড়ে দিন । আমি সব স্বীকার করে নিচ্ছি । আমি অপরাধ করেছি ।
আগন্তক এবার এক ঝকতাকে আমিনুল ইসলামকে ঘরের এক পাশে ছুড়ে মারলেন । ওখানে কিছু জিনিস পত্র ছিল । সেগুলোর উপরে গিয়ে পড়লেন তিনি । আগন্তক এবার নাফির বেডের দিকে এগিয়ে গেল । তারপর বলল, তোমার পা আমি কেন ভাঙ্গি নি জানো? কারন তুমি যেন হেটে পুলিশ স্টেশনে যেতে পারো । তোমাকে সাত দিন সময় দেওয়া হল । এই সাত দিনের ভেতরে তুমি নিজে পুলিশের কাছে যাবে এবং নিজের দোষ স্বীকার করবে । সোফিয়াকে নিয়ে যাবে পুলিশের কাছে । সে ভয় পেয়েছে । তাকে দিয়ে মামলা করাবে এবং নিশ্চিত করব যেন পুলিশ মামলা নেয় । নিজে স্বীকারোক্তি দিবে । ক্লিয়ার ?
নাফি মাথা নাড়ালো !
আগন্তক আবার বলল, তোমার দুই বন্ধুকে বলবে তোমার সাথে যেন ধরা দেয় এবং তুনি নিজে তোমার সহ তাদের কুকীর্তির কথা পুলিশের কাছে বলবে । আরেকটা কথা যদি তোমাদের বাবাদের কেউ সোফিয়াকে বাধ্য করে কেস তুলে নিতে কিংবা যে কোন ভাবে তোমরা ছাড়া পেয়ে যাও আমি তোমাকে সহ তোমার ঐ দুই বন্ধুকে মেরে ফেলবো । এবং আমি যে মিথ্যা কথা বলছি না সেটা তুমি খুব ভাল করেই বুঝতে পারছো! তোমরা একটা অপরাধ করেছো এবং এই অপরাধের শাস্তি তোমাদের পেতে হবে ! পরিস্কার হয়েছে আমার কথা?
নাফি কেবল মাথা নাড়ালো?
-গুড ! আমি চাই না তোমার সাথে আমার আবার দেখা হোক । কারণ যদি দেখা হয় তাহলে সেটা তোমার জন্য মোটেও ভাল কিছু হবে না ।
আগন্তক আর কিছু না বলে চলে গেল দরজা দিয়ে । আনিকা এতো সময়ে ভয়ে ভয়ে ঘরের এক পাশে দাড়িয়ে ছিল । আগন্তক বেড়িয়ে যেতেই সে নাফির সামনে এসে দাড়ালো । তারপর বলল, লোকটা যা বলল সে সব সত্যি?
নাফি মাথা নিচু করে রইলো কেবল । আনিকা বলল, সেইম অন ইউ নাফি ! সেইম অন ইউ !
তারপর সেও দরজা খুলে বের হয়ে গেল ।
দুই
-হেই রাহাত কি খবর ?
ভিডিও কলে আরাজকে দেখতে পেল । আরাজের পেছন দিকটা দেখা যাচ্ছে । রাহাত বুঝতে পারলো আরাজ ওর ফার্ম হাউজে রয়েছে । রাহাত শুকনো কন্ঠে বলল, ওদিকে কী খবর?
-তুমি মিয়া একটা বোকা ! এমন ভীতুর ডিম হলে চলে ? কিভাবে লেজ গুটিয়ে পালালে ?
-বলা যায়! তুমি না হয় জোর খাটিয়ে কেস থেকে নিজের নাম সরিয়েছো আমি তো আর পারি নি । আমার নাম কেসে আছে । আর নাফি নিজে স্টেসমেন্ট দিয়েছে পুলিশের সামনে !
-আরে রাখো সব সামলানো যেত । কিসের না কিসের ভয়ে তুমি পালালে ওর নাফি ধরা দিল । দরকার ঐ মেয়েটাে গায়েব করে দেওয়া যেত ! বাবা দেখতো ব্যাপারটা !
রাহাত জানে আরাজের বাবা একজন উপমন্ত্রী । অনেক ক্ষমতা তার বাবার । রাহাতের বাবাও যদি বেশ ক্ষমতাবান । সরকারী আমলাদের একজন তবুও রাহাতের কেন জানি শান্তি লাগছিলো না । বিশেষ করে নাফির ঐ ভয়ার্থ কন্ঠস্বর শোনার পর থেকে একটা ভয় ঝেকে বসেছে ওর নিজের মাঝে । নাফি যে কী পরিমান ভয় পেয়েছে সেটা ওকে না দেখলে নিজে বিশ্বাস করতো না । নিজের দোষ সে স্বীকার করে নিয়েছে ।
রাহাত হঠাৎ চমকে উঠলো । আরাজের পেছনে একটা কালো আয়োবয় দেখতে পেল । রাহাত কিছু বলতে যাবে তার আগেই আরাজের কন্ঠস্বর শুনতে পেল ।
-কে তুমি ? এখানে কীভাবে ঢুকলে ।
রাহাত দেখতে পেল ফোনটা পরে গেল । সোজা ছাদটা দেখা যাচ্ছে এখন । কিন্তু চিৎকার শোনা যাচ্ছে ঠিকই । আরাজের চিৎকার । চিৎকার এবার আর্তনাদে পরিনত হল । রাহাতের বুকটা ভয়ে কেঁপে উঠলো । কিন্তু কিছুতেই সে ফোন কাটতে পারলো না । আর্তনাদের মাত্রা এক সময়ে তীব্র হল এবং আস্তে আস্তে মিইয়ে গেল । তারপর সব চুপচাপ । কোন আওয়াজ নেই ।
রাহাত কেবল অনুভব করলো যে ওর বুকের ভেতরটা হাতুড়ি পেটা খাচ্ছে । তখনই ছায়াটাকে দেখতে পেল । ফোনটা কেউ হাতে নিয়েছে । নড়ে উঠলো স্ক্রিন । তারপরই চেহারা টা দেখতে পেল সে । মুখে একটা সার্জিক্যাল মাস্ক পরা । চোখ দেখতে পেল কেবল !
-হেই রাহাত কেমন আছো ?
রাহাতের মুখ দিয়ে একটা কথাও বের হল না । কেবল চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো সামনের মানুষটার দিকে । তোমার বন্ধুকে দেখবে না কী অবস্থা !
এই বলে ফোনের স্ক্রিনটা সরালো সে । সাথে সাথেই রাহাতের হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেল । কিন্তু ফোন পড়ার আগে সে ঠিকই দেখতে পেয়েছে সিলিং থেকে আরাজের ঝুলে থাকা দেহটা দেহে যে প্রাণ নেই সেটা বুঝতে কষ্ট হল না মোটেও ।
রাহাত এখন কী করবে ! কি করা উচিৎ ? ঐ লোকটা আরাজকে মেরে ফেলেছে । একেবারে খুন করে ফেলেছে । যেমনটা নাফি বলেছি । মেরে ফেলবে ! মেরে ফেলেছে !
রাহাত !
রাহাত !
ফোন থেকে আওয়াজটা ভেসে এল । রাহাত কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা তুলে নিল । লোকটার চোখ দেখতে পেল আবার ! লোকটা গাঢ় কন্ঠে বলল, বুঝতে পারছো তো কী হয়েছে তোমার বন্ধুর সাথে । আরাজ মরেছে কারণ সে নিজের অপরাধ স্বীকার করে নি । বরং প্রভাব খাটিয়ে কেস থেকে নিজের নাম মুছে দিয়েছে । তবে তোমার জন্য সুসংবাদ ! কেসে তোমার নাম আছে । তোমাকে সাত দিন সময় দিলাম আবারও । দেশে ফিরে আসো, পুলিশের কাছে ধরা দাও । জেল খাটো । নিজের অপরাধের শাস্তি পাও । কিন্তু যদি আমি শাস্তি দেই তাহলে অবস্থা ঠিক এই আরাজের মত হবে ! তোমার বাসার পেছনে একটা বড় অক গাছ রয়েছে । ওটা দুইনম্বট ডালটাতে লাল রং করা আছে । ঠিক ঐ ডালে তোমাকে ঝুলিয়ে দেওয়া হবে ঠিক আট নম্বর দিনে ।
রাহাত তীব্র চোখে কেবল তাকিয়ে রইলও । নড়তে ভুলে গেছে । ওর বর্তমান বাড়িটার পেছনে আসলেই একটা বড় অক গাছ রয়েছে । নিচ থেকে দ্বিতীয় ডালটা গতদিন কে জানি লাল রং করে গেছে । এই লোকটা জানলো কিভাবে?
ও মাই গড ! তার মানে রাহাত যে এই বিদেশের এই খানে আছে সেটাও সে জানে !
আবার শোনা গেল আগন্তকের কন্ঠে । ভেবো না দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছো বলে তোমার কাছে পৌছাতে পারবো না । সাত দিন সময় দিলাম !
লাইন কেটে গেল !
ফোন হাতে নিয়ে রাহাত কেবল কিছু সময় চুপ করে বসেই রইলো । সে কোন ভাবেই আরাজের মত মরতে চায় না । যে লোকটা আরাজের নিজের বাসার ভেতরে শুকে আরাজকে খুন করতে পারে, যে লোকটা ওর বাড়ির পেছনের গাছের কথা জানতে পারে সে এখানে ওর কাছেও আসতে পারবে । ও বাঁচতে চায় । মরতে চায় না । দরজার হলে সব স্বীকার করে নিয়ে জেলে যাবে নাফির মত । তবুও বাঁচতে চায় ! তখনই ফোন দিল সে টিকিট বুকিং দিতে । ওকে যেতে হবে !
গল্পের নাম টি মার্ভেল কমিক্স দ্য পানিশার থেকে নেওয়া হয়েছে । এই সিরিজের এইটা দ্বিতীয় গল্প । আগুন্তক নামে এই সিরিজের প্রথম গল্পটা আপনারা পড়েছেন আশা করি !