তিতিক্ষার বিয়ে টা ঠিক ওর ইচ্ছে মত হয় নি । বলা চলে খানিকটা জোর করেই ওর পরিবার তিতিক্ষাকে বিয়ে দিয়েছে সাদমানের সাথে । বিয়েটা অবশ্য হয়েছে ঘরোয়া ভাবেই । কথা হয়েছে তিতিক্ষার পড়াশুনা শেষ হলে তারপর ভালো করে অনুষ্ঠান করা হবে । বিয়ের পরপরই ওকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে । মূলত বিয়ের পরে তিতিক্ষা যাতে স্বামীর সাথে থাকতে পারে এই জন্য ওকে বিয়ে দেওয়া হয়েছে । সবে মাত্র অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে সে । তিতিক্ষার বাবা কোন ভাবেই মেয়েকে একা ঢাকা শহরে থাকতে দিবেন না । পড়াশুনার এই দুই বছর তিতিক্ষা ওর বড় মামার বাসায় ছিল । সেখান থেকেই উনিভার্সিটিতে যাওয়া আশা করেছে । কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বড় মামা পুরো পরিবার চলে যাচ্ছে আমেরিকাতে । এই অবস্থায় তিতিক্ষার বাবা মেয়েকে একা ঢাকা শহরে থাকতে দিবে না । তার সাফ কথা হয় বিয়ে কর নয়তো বাসায় চলে এসো । সিদ্ধান্ত তোমার ! তিতিক্ষা বাধ্য হয়ে বিয়েতে রাজি হয়েছে । কিন্তু মন থেকে কিছুতেই বিয়েটা মেনে নিতে পারছে না । বিশেষ করে গত কালকের ঘটনার পর থেকে সাদমানকে উপর তীব্র রাগ হচ্ছে ।
ওদের বিয়ে হয়েছে সপ্তাহ খানেক । এতো দিন সব অনুষ্ঠান পালন করে এসেছে । ঘরোয়া ভাবে বিয়েটা হলেও দুই পরিবারের ভেতরে আচার অনুষ্ঠান ঠিকই পালন হয়েছে । আজকে মোটমাুটি সব অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে । গতকাল রাতে হঠাৎ সাদমান ওর উপর জোর খাটায় । স্বামী হিসাবে ওর পাওয়া পেতে চায় । প্রথমে তিতিক্ষা মোটেও রাজি ছিল না । এক পর্যায়ে সাদমান ওর হাত দুটো পেছন দিকে বেশ জোরেই চেপে ধরে । নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেো ব্যর্থ হয় তিতিক্ষা । এই পর্যায়ে এসে সাদমান ওর গালে একটা চুমু খায় ।
তিতিক্ষা রাগ হয় কিন্তু সে একেবারে অসহায় । শক্তিতে সে কিছুতেই সাদমানের সাথে পেড়ে উঠছে না । শেষে ওর চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে আসে । তিতিক্ষা ভেবেছিলো এরপরেই হয়তো সাদমান ওর উপরে আসল শক্তি খাটাবে । তবে ওকে অবাক করে দিয়েই সাদমান ওকে ছেড়ে দেয় । তারপর ঘর ছেড়ে চলে যায় । এরপর আর ঘরে আসে নি । পরদিন সকালে উঠে যথারীতি সাদমান অফিসে চলে গেছে । দুপুরের দিকে তার শশুর শাশুড়িও চলে গেল।
তিতিক্ষা এবার একটু ভয় পেল । ভেবেছিলো এই ফ্লাটে বুঝি সাদমানের সাথে ওর বাবা মাও থাকে । কিন্তু জানতে পারলো যে ওরানা এখানে থাকে না । মীরপুরে তাদের ফ্ল্যার রয়েছে । সেখানে তারা থাকে । সাদমান এখানে একা থাকে । সে মানুষজন ঠিক পছন্দ করে না । তার জগত আলাদা । যাওয়ার আগে শাশুড়ি বলে গেলেন যে সাদমান শান্তিপ্রিয় মানুষ । ওর সাথে মানিয়ে নিতে তিতিক্ষার নাকি সমস্যা হবে না । তিতিক্ষা মনে মনে বলল আদৌও যদি মানিয়ে নেওয়া হয় । অন্তত গত রাতের ঘটনার পরে সাদমানের সাথে সামনে কি হবে সে জানে !
সন্ধ্যা সময়ই সাদমান ফিরে এল । তিতিক্ষা একা একাই ঘরে ছিল । নিজের চিন্তায় অস্থির । কাল ওকে ছেড়ে দিয়েছিলো আজকে কি ছাড়বে? আজকে যদি আবার জোর করে তাহলে? তিতিক্ষার কি কিছু করার থাকবে ? এমন একটা অবস্থা যে তিতিক্ষা কাউকে কিছু বলতেও পারবে না । বিয়ের পর স্বামী তো এসব করবেই । বরং তিতিক্ষাকেই সবাই দোষারোপ করবে ।
যাওয়ার আগে শাশুড়ি রান্না করেই গেছে তাই নতুন করে রান্না করতে হবে না । এছাড়া বাড়িতে কাজের লোক আছে রান্না করার জন্য । ওর কাজ এখানে বউ হিসাবে থাকা, পড়াশুনা করা ইউনিভার্সিটিতে যাওয়া । সন্ধ্যায় সাদমান আসাতে কেন জানি তিতিক্ষার একটু ভাল লাগলো । দুপুরের পর থেকে ওর একা একা মন খারাপই লাগছিলো । সাদমান ফ্রেশ হয়ে টিভির ঘরে আসতেই তিতিক্ষা বলল, চা দিবো?
সাদমান বলল, চা ঠিক পছন্দ না আমার । কফি খাই ।
-আচ্ছা বানিয়ে আনি?
-থাকুক । তুমি বস । আমিই বানিয়ে নিয়ে আসছি । সন্ধ্যার কফি আমি নিজেই বানাই ।
তিতিক্ষা কী বলবে খুজে পেল না । সাদমানের কথা মত বসে পড়লো সোফার উপরে । একটু পরেই সাদমান ট্রে হাতে ঢুকলো ঘরে । দুইকাপ কফি রাখলো তিতিক্ষার সামনে । তবে তখনই বসলো না । শোবার ঘরের দিকে চলে গেল । ফিরে এল একটু পরে । তিতিক্ষা দেখলো একটা প্যাকেট আর উপরে একটা গোপাল রাখা । সেটা ওর সামনে রাখলো । তারপর ওর থেকে একটু দুরে বসেল কফির কাপ নিয়ে ।
তিতিক্ষাও কফির কাপটা নিয়ে চুপচাপ চুমুক দিতে শুরু করলো । ওর চোখ প্যাকেট টার দিকে । ওটা যে ওর জন্য সেটা বলে দিতে হল না । তবে নিজ থেকে আগ বাড়িয়ে নিতেও চাইলো না । সাদমান বলল, ওটা তোমার জন্য ।
এবার তিতিক্ষা হাত বাড়িয়ে প্যাকেট টা নিলো । খুলে দেখলো দুইটা চকলেটের বক্স । উপরে লেখা সরি !
খানিকটা অবাক হয়েই সে সাদমানের দিকে তাকালো ।
সাদমান বলল, গত রাতের জন্য আমি সরি ! আসলে আমি বুঝতে পারি নি । এমনটা আর হবে না ।
টিভির মৃদু আওয়াজ ছাড়া কোন আওয়াজ নেই । তিতিক্ষা সত্যিই অবাক হয়ে গেছে । অন্তত এমনটা সে মোটেই আশা করে নি । সাদমান বলল, আমি জানি তুমি বিয়ের জন্য এখন মোটেই প্রস্তুত ছিলে না । তোমার বাবা এই ব্যাপারে আমার সাথে কথা বলেছে । তোমার অনার্স শেষ হওয়ার পরেই না হয় আমাদের পুরোপুরি সংসার আরাম্ভ হবে । এর মাঝে তোমাকে আমার বউয়ের দায়িত্ব পালন করতে হবে না । তোমার জীবন যেমন ছিল, মানে তোমার মামার বাসায় যেমন ছিলো তেমনই থাকবে । ধরে নিবে যে কেবল বাসা বদলিয়েছো । আর কিছু না । ঠিক আছে ? এমন কি চাইলে তুমি আলাদা ঘরেও ঘুমাতে পারো ! কোন সমস্যা নেই ।
তিতিক্ষা কেবল অপলক চোখে তাকিয়ে রইলো সাদমানের দিকে । সাদমান বলল, ধর এই সময়ে তুমি আমার গার্লফ্রেন্ড হলে । এই টুকু তো মনে করতেই পারো ! নাকি?
তিতিক্ষা কি বলবে আসলে বুঝতেই পারলো না । সাদমান যে এমন হবে সেটা সে একদমই ভাবতে পারে নি । ওর এখন কী করা উচিৎ ! সেটাও তিতিক্ষা বুঝতে পারলো না ।
পরদিন থেকে সত্যিই তিতিক্ষার জীবন একদম আগের ট্রাকে ফিরে এল । আগে সে মামার বাসা থেকে ক্যাম্পাসে যেত, এখন যায় সাদমানের বাসা থেকে । কেবল এই পরিবর্তন । বাকি সব আগের মত । আগের ফ্রেন্ড ক্লাস সব আগের মত চলতে লাগলো । ও আরও একটা পরিবর্তন এল ওর জীবনে । সাদমান । যতই সাদমান বলুক যে আগের মত জীবন হবে তবে বিয়ের পরে কারো জীবন কি আগের মত থাকে? থাকে না। বিশেষ করে তিতিক্ষার মনে সাদমানের জন্য বিশেষ স্থান তৈরি হতে থাকলো আস্তে আস্তে । তিতিক্ষা লক্ষ্য করতে শুরু করলো যে সাদমানের সাথে তার সময় কাটাতে ভালো লাগছে । তবে একদিন এমন একটা ঘটনা ঘটলো যে তিতিক্ষার মনে সাদমানের জন্য যে আরও একটু ভালোবাসা বৃদ্ধি পেল।
রাতে খাবার টেবিলে সাদমান কেমন যে চুপ করে বসে ছিল । এটা যে সাদমানের স্বাভাবিক এটা তিতিক্ষা এই কদিনে খুব ভাল ভাবেই বুঝতে পেরেছে । সে খাবার বাড়তে বাড়তে বলল, কী হয়েছে? মুখ এমন কেন লাগছে?
সাদমান ওর দিকে তাকিয়ে রইলো কিছু সময় । তারপর একটু ইতস্তর করে বলল, একটা কথা বলবো? মানে রিকোয়েস্ট করবো?
-কর?
-তুমি দয়া করে এমন পোশাক পরে আর ঘরে থেকো না । কেমন !
তিতিক্ষা নিজের ড্রেসের দিকে তাকালো । আজকে সে একটা টিশার্ট আর লেগিংস পরে রয়েছে । ঘরের ভেতরে সাদমানের সামনে এতোও স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে যে কোন পোশাক পরেই ওর সামনে এখন আসতে ওর কাছে অস্বাভাবিক কিংবা অস্বস্তি লাগে না ।
তিতিক্ষা কি বলবে ঠিক বুঝতে পারলো না । সাদমান তাড়াতাড়ি বলল, না না দয়া ভুল বুঝো না । আমি তোমার পোশাক নিয়ে কোন মন্তব্য করছি না । আসলে আসলে এই লেসিংস জিনিসটা আমার কাছে অন্য রকম লাগে । তুমি যখন পরে সামনে ঘোরাফেরা কর তখন আমার চোখ বারবার তোমার দিকে চলে যায় ! মাথার ভেতরে মানে …. কিভাবে বোঝাবো মাথার ভেতর কেমন তুমি তুমি আর তুমি ঘোরে বেড়াও ! মানে বারবার তোমার দিকে চোখ চলে যায় ! তুমি ব্যাপারটা দেখে ফেললে কি না কি ভাববে!
এই টুকু বলে সাদমান চুপ করলো । তিতিক্ষা হেসে ফেলল । বিশেষ করে সাদমানের চোখের অস্বস্তিটা কেন জানি ওর ভাল লাগছে । এই যুগে আসলেই এমন ছেলে আছে তাহলে ?
তিতিক্ষা বলল, তাহলে যে মেয়ে লেগিংস পরে তুমি তাদের দিকে এমন আড় চোখে তাকাও !
সাদমান তাড়াতাড়ি বলল, না না । এমন ভেবো না । আ-আমি এমন কিছু করি না !
-আরে রিলাক্স এমনি এমনি বললাম। আর তুমি চাইলে আমার দিকে তাকাতে পারো । এই স্বাধীনতা তোমার আছে ! আর আমি এতে কিছু মনে করবো না! বুঝতে পেরেছো কি?
সাদমান তিতিক্ষার দিকে তাকালো । ওর চোখে একটা আনন্দময় হাসি দেখতে পেল ।
এরপর থেকে তিতিক্ষা বাসয়া যত সময় থাকতো কেবল এই পোশাকই পরতে শুরু করলো । তিতিক্ষার মনে ততদিনে একটা তীব্র আকাঙ্কা জমা হয়েছে সাদমানকে কাছে পাওয়ার । একদিন যখন সাদমান ওর কাছ আসতে চেয়েছিলো তখন নিজেও ওকে দুরে সরিয়ে দিয়েছিলো কিন্তু যতই দিন যেতে শুরু করলো ততই সাদমানকে পছন্দ করতে শুরু করলো । এখন নিজেও ওকে কাছে পেতে চাচ্ছে কিন্তু বারবার ঐদিনের কথা ওর মনে পড়ছে । লজ্জার কারণে সে কিছু করতে পারছে না । ও যখন নিজ থেকে সাদমানকে দুরে সরিয়ে দিয়েছে তখন আবার কিভাবে নিজেই এগিয়ে যাবে । বারবার চাচ্ছে যেন সাদমান আগে এগিয়ে আসুক ! কিন্তু এই ছেলে এমনই ভদ্র যে কিছুতেই আসবে না । দুর থেকে ওর দিকে তাকাবে ঠিকই তবে কাছে আসবে না । সাদমানের মনে এখনও সেই ভয়টা রয়েই গিয়েছে যে যদি আবারও তিতিক্ষা কান্না করে ওর আচরনে ।
সেদিন সন্ধ্যা থেকে খুব বৃষ্টি হচ্ছিলো । তিতিক্ষা নিজের জন্য এক কাপ কফি বানিয়ে বসেছিলো । একটু একটু বই পড়ছিলো আর কফিতে চুমুক দিচ্ছিলো । তবে ওর মন বসছিলো না কোন দিকে । কেন জানি বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করছিলো খুব । ওর ইচ্ছেটা পূরন করতেই বুঝি একটু পরে সাদমান এসে হাজির হল বাসায় । বৃষ্টিতে একেবারে ভিজে গেছে । দরজা থেকেই অফিসের ব্যাগ মোবাইল আর মানিব্যাগটা তিতক্ষার হাতে দিয়ে বলল, আমি একটু আসছি !
-কোথায় যাচ্ছো?
-ছাদে । ভিজেই ও গেছি আরও একটু ভিজি !
এই বলে দ্রুত ছাদের দিকে চলে গেল । তিতিক্ষার মনটা খারাপ হল একটু । কেন সাদমান একটু বলতে পারতো না যে চল আমরা একটু এক সাথে ভিজি ! না, সে একাই চলে গেল ভিজতে !
মন খারাপ করে দরজা বন্ধ করতে যাবে তখনই দেখতে পেল সাদমান আবারও এসে হাজির হয়েছে । তিতিক্ষার দিকে তাকিয়ে বলল, আসলে কথাটা বলবো কিনা ভাবছি ! তুমি ভিজবে আমার সাথে?
তিতিক্ষার মুখে হাসি দেখা গেল । বলল, আসছি । তুমি যাও !
পুরো ছাদে আর কেউ নেই । সম্ভবত সন্ধ্যা বেলা বলেই হয়তো কেউ আসে নি । তিতিক্ষা ছাদে নামতেই একেবারে ভিজে গেল । সাদমান তখন ছাদের মাঝে । একটু একটু বিদ্যুৎ চমৎকাচ্ছে মাঝে মধ্যে সেটাতেও ওকে দেখা যাচ্ছে । তিতিক্ষা আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল ওর দিকে । তারপর হাত ধরলো ওর । বলল, বেশি ভিজবো না ।
-আচ্ছা ।
-সাদমান!
-হুম !
তিতিক্ষা প্রথমে কি বলবে খুজে পেল না । তারপর একটা জোরে দম নিয়ে বলল, আই এম হ্যাপি যে তোমার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে ! তুমি এই কটা দিনে আমার সাথে যেরকম আচরন করেছে, আমাকে যেভাবে বুঝেছো অন্য কেউ হলে কেউ বুঝতো না ! থ্যাংঙ্কিউ !
সাদমান হাসলো । তারপর বলল, শুনে খুশি হলাম !
তিতিক্ষা বলল, আমার অনেক দিনের ইচ্ছে …..
-কী ইচ্ছে ?
-অনেক দিনের ইচ্ছে যে বৃষ্টির ভেতরে প্রিয় মানুষটিকে চুমু খাবো ! ঐ যে আশিকি টু মুভিতে যেমন হয় !
সাদমান হঠাৎ চুপ করে দাড়িয়ে পড়লো । একভাবে কিছু সময় তাকিয়ে রইলো তিতিক্ষার দিকে । তারপর একেবারে তিতিক্ষার কাছে চলে এল । মুখোমুখো ! বলল, এবার আবার কাঁদবে না তো !
তিতিক্ষার ঠোঁট একটু কেঁপে উঠলো । তারপর বলল, কাঁদবো না, ভয়ও পাবো না !
আর কোন কথা হল না ওদের মাঝে । কথা বলার দরকারও পড়লো না ।
তারপর ঐদিন রাতে কি হয়েছিলো সেটা আর আপনাদের বলে দেওয়ার প্রয়োজন নেই । আপনারা বুদ্ধিমান পাঠক !
আজকের গল্প এখানেই শেষ । তবে এই গল্প বিশ্বাস করার কোন মানে নেই । এই সব গল্প সত্যি হয় না । এই সব মিথ্যা গল্প !
বিলিভ ইট অর নট আপনার মিথ্যে গল্পগুলোই অসহ্য রকমের সুন্দর।