শশীর নিজের মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছে করছে । বুকের ভেতরে একটা অচেনা অনুভূতি হচ্ছে । প্রিয় মানুষটিকে হারানোর ভয় ! অপুকে হারানোর ভয় ! অপুও কি অন্য ছেলে গুলোর মত হবে ! কী দরকার ছিল ওমন স্টাটাস লেখার । কোন কি দরকার ছিল । যদি এমন কিছু না লিখতো তাহলে আজকে জেরিনের চোখ অপুর উপর পড়তো না ! আর ওকে হারানোর ভয়ও পেতে হত না !
জেরিনকে ওদের ক্যাম্পাসের সবাই খুব ভাল করে চেনে । ওদের সাথে পড়ে আসছে । মেয়েটার ডাক্তারি পড়ার থেকে অন্য মেয়েদের প্রেমিকদের দিকে চোখ বেশি । অবশ্য জেরিনের ব্যাপারটা আলাদা । চোখ ধাঁধানো সুন্দরী বলতে যা বোঝায় জেরিন তাই । ওর সাথে একটু কথা বলার জন্য সিনিয়র জুনিয়ার সবাই কেমন মুখিয়ে থাকে । আর কেবল কী রূপ ! মেয়েটা নিশ্চিত ভাবেই মেধাবী নয়তো সরকারি তাও আবার স্যর সলিমুল্লাহতে পড়ছে । এবং জেরিনের বাবার অঢেল টাকা । প্রতিদিন গাড়িতে করে ক্যাম্পাসে আসে । এমন মেয়ের পেছনে ছেলেরা কেন ঘুরবে না ।
ঘুরুক সেটা নিয়ে কারো কোন সমস্যা নেই । কিন্তু জেরিনের স্বভাব হচ্ছে অন্যের বয়ফ্রেন্ড ছিনতাই করা । তার ওর একটা পছন্দের গান রয়েছে । আই ক্যান টেক ইরোর ম্যান ইফ আই ওয়ান্ট টু ! এমন করে কত মেয়ের বয়ফ্রেন্ডকে যে সে ছিনিয়ে নিয়েছে তার কোন ঠিক নেই । জেরিনের নিজের উপরে এই আত্মবিশ্বাস খুব প্রবল । সে চাইলে যে কারো সাথেই প্রেম করতে পারে । একবার ডাক দিলে যে কেউ ছুটে আসবে ওর দিকে । শশী জানতে পেরেছে জেরিনের চোখ এবার অপুর উপর পড়েছে । শশীর কারণেই এমনটা হয়েছে ।
সপ্তাহ খানেক আগের কথা । শশীর সেদিন ক্লাস ছিল না । দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে নিজের রুমে এসে শুয়ে ছিল । রুমমেট কোথায় যেন গিয়েছে । কী করবে ভাবছে এমন সময়ে অপুর ফোন এসে হাজির । দুপুর বেলা অপুর ফোন পেয়ে একটু অবাক হল । এই সময়ে সে অফিসে থাকে বেশির ভাগ সময়ে । ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো লাঞ্চ আওয়ার শেষ হয়েছে অনেক আগেই ।
ফোন রিসিভ করলো ।
-হ্যালো
-এই গেটের কাছে আসো তো ! জলদি !
এই বলে লাইনটা কেটে গেল । শশী একটু অবাক না হয়ে পারলো না । অপু সাধারনত আসার আগে ওকে ফোন দিয়ে আসে । গেটের সামনে মাঝে মধ্যে আসে দেখা করতে । ওর হল থেকে একটু দুরে একটা বাসায় থাকে ওর আরও একজন কলিগের সাথে ।
শশী দ্রুত নেমে এল । গেটের কাছে আসতেই দেখতে পেল অপুকে । ক্যাজুয়াল পোশাকেই দাড়িয়ে রয়েছে । ওকে দেখতেই হাতের ভেতরে থাকা একটা কাগজ বাড়িয়ে দিল ওর দিকে । তারপর বলল, কাসুন্দী দিয়ে বানানো আমের ভর্তা । একদম ফার্স্ট ক্লাস ! নাও ।
শশী বলল, অফিস নাই আজকে?
-আছে তো । সেখানেই যাচ্ছি । ক্লাইন্টের সাথে মিটিং ছিল বাইরে । সেই এই আম মাখানো খাওয়ালো । ভাবলাম যাওয়ার সময়ে তোমাকে দিয়ে যাই ।
হঠাৎ শশীর কি যে হল, চোখ কান্না আসতে চাইলো । অপুর এই রকম হুটহাট কান্ড গুলো ওর এতো ভাল লাগে । অন্যান্য প্রেমিকদের মত অপু সাথে সময় কাটানো হয় না কখনই । ওর নিজের পড়াশুনা রয়েছে । অন্য দিকে অপু নিজেও নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত । সপ্তাহে একদিন কি দুই দিন দেখা হয় ! কোথাও বের হওয়া । রাতে ফোনে কথা হয় অল্প ! এমন কি ওদের ভবিষ্যৎ কোন পরিকল্পনাও নেই । প্রেমের শুরুতেই অপু ওকে বলেছিলো যে কেবল শশীর সাথে কথা বলতে ভাল লাগে, নিজের অনুভূতি গুলো ভাগ করে নিতে ভাল লাগে আর একটা নিরাপদ অনুভূতি হয় এই জন্য কাছে আসা । এর মানে এই না যে ওর সাথেই জীবন কাটাতে হবে । একটা সময় পরে যখন একটা স্থায়ী সম্পর্কের দিকে যাওয়ার সময় হবে তখন অবশ্যই এই চিন্তা মাথায় আনতে হবে যে ওরা আসলেই এটা চায় কিনা । যদি দুজনেই মনে করে যে হ্যা সামনের দিন গুলোতে এক সাথে থাকা যাবে তাহলে সামনের দিকে হাটা যাবে । নয়তো আলোচনার মাধ্যমে কথা বলে দুজন দুদিকে চলে যাওয়া যাবে । এই ব্যাপারটা শশীর ভাল লেগেছে । কী দরকার কথা দিয়ে কথা না রাখতে না পারা ! শেষে অন্যের চোখে প্রতারক হয়ে যাওয়া । এর থেকে ভাল এখন যেমন চলছে তেমনই চলুক ।
শশী হাসি মুখে অপুকে বিদায় দিয়ে নিজের ঘরের দিকে দোড় দিল । যখন রুমে এসে হাজির হল তখন ওর চোখে মুখে একটা আনন্দের আভা ছড়িয়ে পড়ছে । এতো আনন্দ লাগছিলো । একটু আগেও দিনটা সাধারন ছিল অথচ এখন মনে হচ্ছে আজকের দিনটার মত অসাধারন দিন আর হতেই পারে না ।
এই অনুভূতিটাই নিজের ফেসবুকে ওয়ালে লিখেছিলো । লেখার টুকটাক হাত ভাল শশীর । সেই স্টাটাস কে জানি কপি করে ওদের মেডিক্যাল গ্রুপে পোস্ট করে ফেলল । অনেকের চোখেই পড়লো সেটা । এবং সেখান থেকেই জেরিনের চোখে পড়েছে । শশী ওর বান্ধবী লিনার কাছে শুনেছে গতদিনের এক আড্ডায় জেরিন নাকি তাচ্ছিলো করে বলেছে সব পুরুষই । অপুকে নাকি নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাতে ওর একদিনও লাগবে না । পাশ থেকে কে জানি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে এবং জেরিন সেটা গ্রহনও করে নিয়েছে । সাত দিনের ভেতরে অপু জেরিনের পেছন পেছন ঘুরবে ।
শশী এখন কি করবে? অপুকে সাবধান করবে?
একবার মনে হল অপুকে সে সাবধান করে দেয় । কিন্তু পরক্ষনেই মনে হল যে না, কেন করবে সাবধান ! যদি সে জেরিনের দিকে চলেই যায় তাহলে তো শশীর কোন দরকারই নেই ওকে থামানোর । এমন ভালোবাসার কি কোন মূল্য আছে !
চারদিন পরে ওদের দেখা হল । সন্ধ্যার সময় ওর শশীদের ক্যাম্পাসের কাঠাল তলাতে বসে বসে গল্প করছিলো । এমন সময়ে অপু বলল, তোমাদের ক্লাসে জেরিন নামে কেউ আছে নাকি?
নামটা শুনতেই কেমন যে করে উঠলো শশীর বুকটা । বলল, হ্যা । কেন !
-মেয়েটা কেমন বল তো ?
-কেন?
-না মানে এই চার দিনে মেয়েটার সাথে আমার ছয়বার দেখা হয়েছে । আমাদের অফিসে এসেছিলো একাউন্ট করতে । এতো গায়ে পড়া স্বভাব মেয়েটার !
শশী কি বলবে খুজে পেল না । অপুর দিকে তাকিয়ে দেখলো কেমন একটা বিরক্তি ভাব নিয়ে কথা গুলো বলল সে । শশীর কি এখন বলে দেওয়া উচিৎ অপুকে । জেরিন আসলে ওকে প্রেমে ফেলতে চাইছে ! না থাকুক । বলবে না সে । অপু যদি চলে যায় তবে যাবে । এই কথা ভাবতেই ওর চোখ গেল জেরিনের দিকে । মেয়েটা ওদের দিকে এগিয়ে আসছে ।
এখন কি করবে সে ! উঠে পড়বে অপুকে নিয়ে ! নাকি বসে থাকবে ।
কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই জেরিন এসে হাজির হল । অপুর দিকে তাকিয়ে বলল, অপু ভাইয়া আপনি এখানে?
শশী তাকিয়ে দেখলো অপুর চোখ সেই বিরক্তিটা যেন আরও বেড়ে গেছে । সে বলল, এই যে শশী ওর সাথে দেখা করতে এসেছি ।
-ওমা শশী তো আমার সাথেই পড়ে !
-হ্যা আমি জানতে পারলাম যে আপনি আর ও একই ব্যাচের ।
-তাহলে ভাইয়া আমাকে আপনি করে বলবেন না প্লিজ । তুমি করে বলুন ।
-না ঠিক আছে । আমি আসলে পরিচিত আর কাছের মানুষ ছাড়া সবাইকে আপনি করে বলি !
-আরে বাবা আমিও তো পরিচিত হয়ে গেলাম । গতদিন আপনার ব্যাংকে একাউন্ট খুললাম । লেনদেন করলাম । এখন দেখি আপনি শশীর পরিচিত । তার মানে আমারও পরিচিত । নয়তো কি?
শশী যে কি বলবে সেটাই বুঝতে পারছে না । নিজেকে কেমন যেন অসহায় লাগছে । অপুর ওর চেহারার দিকে তাকিয়েই সেটা বুঝতে পারলো । তারপর বলল, কই চল মার্কেট বন্ধ হয়ে যাবে তো ।
শশী কিছুই বুঝতে পারলো না । অপু আবার বলল, আরে বাবা বললে যে নিউমার্কেট যাওয়া লাগবে ! এলাম আর যাওয়ার নাম নেই ! চল চল এখন না লেগে দেরি হয়ে যাবে ।
পাশ থেকে জেরিন বলল, ভাইয়া আমার সাথে গাড়ি আছে চলুন আপনাদের নামিয়ে দেই।
-আরে না না । কোন দরকার নেই । আমরা চলে যাবো !
-না ভাই কোন কষ্ট হবে না ।
-আরে আপনি বুঝতে পারছেন না আপনার গাড়ি পুরান ঢাকার এ রাস্তা দিয়ে বের হবে না সহজে । দেরি হয়ে যাবে । আর শশী আমার সাথে রিক্সাতে চড়তে পছন্দ করে । বুঝতেই পারছেন সময় হয় না খুব একটা । চল শশী ।
শশী উঠলো । আর তখনই অপুর শশীর হাত ধরলো । একটু যেন কেঁতে উঠলো শশী । মানুষের সামনে অপু খুব একটা শশীর হাত ধরে না । যখন এক সাথে বসে গল্প করে কিংবা রিক্সাতে ওঠে তখন মাঝে মধ্যে হাত ধরে । লোক দেখানো ব্যাপারটা ওর ভেতরে একদমই নেই । তবে আজকে জেরিনের সামনে হাতটা ধরলো । শশীর একদম বুঝতে কষ্ট হল না যে জেরিনকে দেখানোর জন্যই কাজটা করলো সে ! ওকে বুঝিয়ে দিতে চাইলো যে ওর এখানে ভাত নেই ।
শশীর মুখে একটা তীর্যক হাসি দেখা গেল । সেটা জেরিনের জন্যই । শশীর কেন জানি বেশ ভাল লাগছে । নিজেও অপুর হাতটা ভাল ভাবে ধরলো। তারপর জেরিনের দিকে তাকিয়ে বলল, আচ্ছা জেরিন আমরা আসি ! কেমন !
এই বলে হাটা দিল !
রিক্সা করে ওদের নিউমার্কেট যাওয়ার কোন দরকার ছিল না । তবুও গেল । নীলক্ষেতের দোকান গুলোতে ঘুরে ঘুরে বেশ কয়েকটা বই কিনলো । পরে আবার যখন ওরা ফেরার পথ ধরলো তখন প্রায় দশটা বেজে গেছে । একটু পরেই হলের গেট বন্ধ হয়ে যাবে । রিক্সাটা যখন হলের গেটের কাছে পৌছিয়েছে তখনই শশী একটা কাজ করে ফেলল । রিক্সার হুড তোলা ছিল না তবে রাস্তায় ঐ স্থানটা একটু অন্ধকার মত । ল্যাম্পপোস্ট নেই । সেখানে আসতেই চট করেই অপুর গালে একটা চুমু খেয়ে ফেলল ।
আবার যখন রিক্সা আলোতে এল অপু অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে । এমন কাজ শশী ঠিক করে না ।
অপু বলল, কী ব্যাপার?
কিছু হয়ই নি এমন একটা ভাব করে শশী বলল, কেন পছন্দ হয় নি !
-এই জিনিস আবার কারো পছন্দ না হয় !
-তাহলে চুপ থাকো । নয়তো আর পাবে না !
গেটের কাছ থেকে অপু যখন ফেরৎ যাবে তখন শশীর অপুর হাত ধরে বলল, অপু, তোমাকে ভালোবাসি ।
অপু একটু হেসে বলল, আজকে কী হয়েছে বল দেখি ?
-আজকে আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি ।
-কি সিদ্ধান্ত ?
-আমি চাই আমাদের সম্পর্কটা স্থায়ী দিকে যাক !
-তাই?
-হুম ! তবে তুমি ভাবো । সময় নাও । তারপর আমাকে জানিও । আমি আমারটা বললাম ।
-আচ্ছা । আজকে আসি । আর আমিও ভালোবাসি !
অনেকটা সময় সে নিজের বিছানাতে শুয়ে রইলো । তারপর নিজের ফেসবুকে স্টাটাস লিখলো, ইউ শিওর বেইবি ইউ ক্যান টেক মাই ম্যান ? তারপর কয়েকটা হা হা হা ইমোজি !
শশী নিশ্চিত জানে যে এই স্ট্যাটাস জেরিন দেখবে । এটাই সে চায় । সব সময় সে জিততে পারবে না । অন্তত এই বেলাতে তো নয়ই । শশী এটা ভাল ভাবে জানে । সাত দিন কেন সাত বছরেও জেরিন কিছু করতে পারবে না । এই আত্মবিশ্বাস শশীর মাঝে চলে এসেছে ।