শশীর গল্প

4.9
(75)

শশীর নিজের মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছে করছে । বুকের ভেতরে একটা অচেনা অনুভূতি হচ্ছে । প্রিয় মানুষটিকে হারানোর ভয় ! অপুকে হারানোর ভয় ! অপুও কি অন্য ছেলে গুলোর মত হবে ! কী দরকার ছিল ওমন স্টাটাস লেখার । কোন কি দরকার ছিল । যদি এমন কিছু না লিখতো তাহলে আজকে জেরিনের চোখ অপুর উপর পড়তো না ! আর ওকে হারানোর ভয়ও পেতে হত না !

জেরিনকে ওদের ক্যাম্পাসের সবাই খুব ভাল করে চেনে । ওদের সাথে পড়ে আসছে । মেয়েটার ডাক্তারি পড়ার থেকে অন্য মেয়েদের প্রেমিকদের দিকে চোখ বেশি । অবশ্য জেরিনের ব্যাপারটা আলাদা । চোখ ধাঁধানো সুন্দরী বলতে যা বোঝায় জেরিন তাই । ওর সাথে একটু কথা বলার জন্য সিনিয়র জুনিয়ার সবাই কেমন মুখিয়ে থাকে । আর কেবল কী রূপ ! মেয়েটা নিশ্চিত ভাবেই মেধাবী নয়তো সরকারি তাও আবার স্যর সলিমুল্লাহতে পড়ছে । এবং জেরিনের বাবার অঢেল টাকা । প্রতিদিন গাড়িতে করে ক্যাম্পাসে আসে । এমন মেয়ের পেছনে ছেলেরা কেন ঘুরবে না ।
ঘুরুক সেটা নিয়ে কারো কোন সমস্যা নেই । কিন্তু জেরিনের স্বভাব হচ্ছে অন্যের বয়ফ্রেন্ড ছিনতাই করা । তার ওর একটা পছন্দের গান রয়েছে । আই ক্যান টেক ইরোর ম্যান ইফ আই ওয়ান্ট টু ! এমন করে কত মেয়ের বয়ফ্রেন্ডকে যে সে ছিনিয়ে নিয়েছে তার কোন ঠিক নেই । জেরিনের নিজের উপরে এই আত্মবিশ্বাস খুব প্রবল । সে চাইলে যে কারো সাথেই প্রেম করতে পারে । একবার ডাক দিলে যে কেউ ছুটে আসবে ওর দিকে । শশী জানতে পেরেছে জেরিনের চোখ এবার অপুর উপর পড়েছে । শশীর কারণেই এমনটা হয়েছে ।

সপ্তাহ খানেক আগের কথা । শশীর সেদিন ক্লাস ছিল না । দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে নিজের রুমে এসে শুয়ে ছিল । রুমমেট কোথায় যেন গিয়েছে । কী করবে ভাবছে এমন সময়ে অপুর ফোন এসে হাজির । দুপুর বেলা অপুর ফোন পেয়ে একটু অবাক হল । এই সময়ে সে অফিসে থাকে বেশির ভাগ সময়ে । ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো লাঞ্চ আওয়ার শেষ হয়েছে অনেক আগেই ।

ফোন রিসিভ করলো ।
-হ্যালো
-এই গেটের কাছে আসো তো ! জলদি !

এই বলে লাইনটা কেটে গেল । শশী একটু অবাক না হয়ে পারলো না । অপু সাধারনত আসার আগে ওকে ফোন দিয়ে আসে । গেটের সামনে মাঝে মধ্যে আসে দেখা করতে । ওর হল থেকে একটু দুরে একটা বাসায় থাকে ওর আরও একজন কলিগের সাথে ।

শশী দ্রুত নেমে এল । গেটের কাছে আসতেই দেখতে পেল অপুকে । ক্যাজুয়াল পোশাকেই দাড়িয়ে রয়েছে । ওকে দেখতেই হাতের ভেতরে থাকা একটা কাগজ বাড়িয়ে দিল ওর দিকে । তারপর বলল, কাসুন্দী দিয়ে বানানো আমের ভর্তা । একদম ফার্স্ট ক্লাস ! নাও ।
শশী বলল, অফিস নাই আজকে?
-আছে তো । সেখানেই যাচ্ছি । ক্লাইন্টের সাথে মিটিং ছিল বাইরে । সেই এই আম মাখানো খাওয়ালো । ভাবলাম যাওয়ার সময়ে তোমাকে দিয়ে যাই ।

হঠাৎ শশীর কি যে হল, চোখ কান্না আসতে চাইলো । অপুর এই রকম হুটহাট কান্ড গুলো ওর এতো ভাল লাগে । অন্যান্য প্রেমিকদের মত অপু সাথে সময় কাটানো হয় না কখনই । ওর নিজের পড়াশুনা রয়েছে । অন্য দিকে অপু নিজেও নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত । সপ্তাহে একদিন কি দুই দিন দেখা হয় ! কোথাও বের হওয়া । রাতে ফোনে কথা হয় অল্প ! এমন কি ওদের ভবিষ্যৎ কোন পরিকল্পনাও নেই । প্রেমের শুরুতেই অপু ওকে বলেছিলো যে কেবল শশীর সাথে কথা বলতে ভাল লাগে, নিজের অনুভূতি গুলো ভাগ করে নিতে ভাল লাগে আর একটা নিরাপদ অনুভূতি হয় এই জন্য কাছে আসা । এর মানে এই না যে ওর সাথেই জীবন কাটাতে হবে । একটা সময় পরে যখন একটা স্থায়ী সম্পর্কের দিকে যাওয়ার সময় হবে তখন অবশ্যই এই চিন্তা মাথায় আনতে হবে যে ওরা আসলেই এটা চায় কিনা । যদি দুজনেই মনে করে যে হ্যা সামনের দিন গুলোতে এক সাথে থাকা যাবে তাহলে সামনের দিকে হাটা যাবে । নয়তো আলোচনার মাধ্যমে কথা বলে দুজন দুদিকে চলে যাওয়া যাবে । এই ব্যাপারটা শশীর ভাল লেগেছে । কী দরকার কথা দিয়ে কথা না রাখতে না পারা ! শেষে অন্যের চোখে প্রতারক হয়ে যাওয়া । এর থেকে ভাল এখন যেমন চলছে তেমনই চলুক ।

শশী হাসি মুখে অপুকে বিদায় দিয়ে নিজের ঘরের দিকে দোড় দিল । যখন রুমে এসে হাজির হল তখন ওর চোখে মুখে একটা আনন্দের আভা ছড়িয়ে পড়ছে । এতো আনন্দ লাগছিলো । একটু আগেও দিনটা সাধারন ছিল অথচ এখন মনে হচ্ছে আজকের দিনটার মত অসাধারন দিন আর হতেই পারে না ।

এই অনুভূতিটাই নিজের ফেসবুকে ওয়ালে লিখেছিলো । লেখার টুকটাক হাত ভাল শশীর । সেই স্টাটাস কে জানি কপি করে ওদের মেডিক্যাল গ্রুপে পোস্ট করে ফেলল । অনেকের চোখেই পড়লো সেটা । এবং সেখান থেকেই জেরিনের চোখে পড়েছে । শশী ওর বান্ধবী লিনার কাছে শুনেছে গতদিনের এক আড্ডায় জেরিন নাকি তাচ্ছিলো করে বলেছে সব পুরুষই । অপুকে নাকি নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাতে ওর একদিনও লাগবে না । পাশ থেকে কে জানি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে এবং জেরিন সেটা গ্রহনও করে নিয়েছে । সাত দিনের ভেতরে অপু জেরিনের পেছন পেছন ঘুরবে ।

শশী এখন কি করবে? অপুকে সাবধান করবে?
একবার মনে হল অপুকে সে সাবধান করে দেয় । কিন্তু পরক্ষনেই মনে হল যে না, কেন করবে সাবধান ! যদি সে জেরিনের দিকে চলেই যায় তাহলে তো শশীর কোন দরকারই নেই ওকে থামানোর । এমন ভালোবাসার কি কোন মূল্য আছে !

চারদিন পরে ওদের দেখা হল । সন্ধ্যার সময় ওর শশীদের ক্যাম্পাসের কাঠাল তলাতে বসে বসে গল্প করছিলো । এমন সময়ে অপু বলল, তোমাদের ক্লাসে জেরিন নামে কেউ আছে নাকি?
নামটা শুনতেই কেমন যে করে উঠলো শশীর বুকটা । বলল, হ্যা । কেন !
-মেয়েটা কেমন বল তো ?
-কেন?
-না মানে এই চার দিনে মেয়েটার সাথে আমার ছয়বার দেখা হয়েছে । আমাদের অফিসে এসেছিলো একাউন্ট করতে । এতো গায়ে পড়া স্বভাব মেয়েটার !
শশী কি বলবে খুজে পেল না । অপুর দিকে তাকিয়ে দেখলো কেমন একটা বিরক্তি ভাব নিয়ে কথা গুলো বলল সে । শশীর কি এখন বলে দেওয়া উচিৎ অপুকে । জেরিন আসলে ওকে প্রেমে ফেলতে চাইছে ! না থাকুক । বলবে না সে । অপু যদি চলে যায় তবে যাবে । এই কথা ভাবতেই ওর চোখ গেল জেরিনের দিকে । মেয়েটা ওদের দিকে এগিয়ে আসছে ।
এখন কি করবে সে ! উঠে পড়বে অপুকে নিয়ে ! নাকি বসে থাকবে ।

কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই জেরিন এসে হাজির হল । অপুর দিকে তাকিয়ে বলল, অপু ভাইয়া আপনি এখানে?
শশী তাকিয়ে দেখলো অপুর চোখ সেই বিরক্তিটা যেন আরও বেড়ে গেছে । সে বলল, এই যে শশী ওর সাথে দেখা করতে এসেছি ।
-ওমা শশী তো আমার সাথেই পড়ে !
-হ্যা আমি জানতে পারলাম যে আপনি আর ও একই ব্যাচের ।
-তাহলে ভাইয়া আমাকে আপনি করে বলবেন না প্লিজ । তুমি করে বলুন ।
-না ঠিক আছে । আমি আসলে পরিচিত আর কাছের মানুষ ছাড়া সবাইকে আপনি করে বলি !
-আরে বাবা আমিও তো পরিচিত হয়ে গেলাম । গতদিন আপনার ব্যাংকে একাউন্ট খুললাম । লেনদেন করলাম । এখন দেখি আপনি শশীর পরিচিত । তার মানে আমারও পরিচিত । নয়তো কি?

শশী যে কি বলবে সেটাই বুঝতে পারছে না । নিজেকে কেমন যেন অসহায় লাগছে । অপুর ওর চেহারার দিকে তাকিয়েই সেটা বুঝতে পারলো । তারপর বলল, কই চল মার্কেট বন্ধ হয়ে যাবে তো ।
শশী কিছুই বুঝতে পারলো না । অপু আবার বলল, আরে বাবা বললে যে নিউমার্কেট যাওয়া লাগবে ! এলাম আর যাওয়ার নাম নেই ! চল চল এখন না লেগে দেরি হয়ে যাবে ।
পাশ থেকে জেরিন বলল, ভাইয়া আমার সাথে গাড়ি আছে চলুন আপনাদের নামিয়ে দেই।
-আরে না না । কোন দরকার নেই । আমরা চলে যাবো !
-না ভাই কোন কষ্ট হবে না ।
-আরে আপনি বুঝতে পারছেন না আপনার গাড়ি পুরান ঢাকার এ রাস্তা দিয়ে বের হবে না সহজে । দেরি হয়ে যাবে । আর শশী আমার সাথে রিক্সাতে চড়তে পছন্দ করে । বুঝতেই পারছেন সময় হয় না খুব একটা । চল শশী ।
শশী উঠলো । আর তখনই অপুর শশীর হাত ধরলো । একটু যেন কেঁতে উঠলো শশী । মানুষের সামনে অপু খুব একটা শশীর হাত ধরে না । যখন এক সাথে বসে গল্প করে কিংবা রিক্সাতে ওঠে তখন মাঝে মধ্যে হাত ধরে । লোক দেখানো ব্যাপারটা ওর ভেতরে একদমই নেই । তবে আজকে জেরিনের সামনে হাতটা ধরলো । শশীর একদম বুঝতে কষ্ট হল না যে জেরিনকে দেখানোর জন্যই কাজটা করলো সে ! ওকে বুঝিয়ে দিতে চাইলো যে ওর এখানে ভাত নেই ।

শশীর মুখে একটা তীর্যক হাসি দেখা গেল । সেটা জেরিনের জন্যই । শশীর কেন জানি বেশ ভাল লাগছে । নিজেও অপুর হাতটা ভাল ভাবে ধরলো। তারপর জেরিনের দিকে তাকিয়ে বলল, আচ্ছা জেরিন আমরা আসি ! কেমন !

এই বলে হাটা দিল !

রিক্সা করে ওদের নিউমার্কেট যাওয়ার কোন দরকার ছিল না । তবুও গেল । নীলক্ষেতের দোকান গুলোতে ঘুরে ঘুরে বেশ কয়েকটা বই কিনলো । পরে আবার যখন ওরা ফেরার পথ ধরলো তখন প্রায় দশটা বেজে গেছে । একটু পরেই হলের গেট বন্ধ হয়ে যাবে । রিক্সাটা যখন হলের গেটের কাছে পৌছিয়েছে তখনই শশী একটা কাজ করে ফেলল । রিক্সার হুড তোলা ছিল না তবে রাস্তায় ঐ স্থানটা একটু অন্ধকার মত । ল্যাম্পপোস্ট নেই । সেখানে আসতেই চট করেই অপুর গালে একটা চুমু খেয়ে ফেলল ।
আবার যখন রিক্সা আলোতে এল অপু অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে । এমন কাজ শশী ঠিক করে না ।
অপু বলল, কী ব্যাপার?
কিছু হয়ই নি এমন একটা ভাব করে শশী বলল, কেন পছন্দ হয় নি !
-এই জিনিস আবার কারো পছন্দ না হয় !
-তাহলে চুপ থাকো । নয়তো আর পাবে না !

গেটের কাছ থেকে অপু যখন ফেরৎ যাবে তখন শশীর অপুর হাত ধরে বলল, অপু, তোমাকে ভালোবাসি ।
অপু একটু হেসে বলল, আজকে কী হয়েছে বল দেখি ?
-আজকে আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি ।
-কি সিদ্ধান্ত ?
-আমি চাই আমাদের সম্পর্কটা স্থায়ী দিকে যাক !
-তাই?
-হুম ! তবে তুমি ভাবো । সময় নাও । তারপর আমাকে জানিও । আমি আমারটা বললাম ।
-আচ্ছা । আজকে আসি । আর আমিও ভালোবাসি !

অনেকটা সময় সে নিজের বিছানাতে শুয়ে রইলো । তারপর নিজের ফেসবুকে স্টাটাস লিখলো, ইউ শিওর বেইবি ইউ ক্যান টেক মাই ম্যান ? তারপর কয়েকটা হা হা হা ইমোজি !

শশী নিশ্চিত জানে যে এই স্ট্যাটাস জেরিন দেখবে । এটাই সে চায় । সব সময় সে জিততে পারবে না । অন্তত এই বেলাতে তো নয়ই । শশী এটা ভাল ভাবে জানে । সাত দিন কেন সাত বছরেও জেরিন কিছু করতে পারবে না । এই আত্মবিশ্বাস শশীর মাঝে চলে এসেছে ।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.9 / 5. Vote count: 75

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →