নওরিনের মন খারাপ

4.8
(85)

পুরো বিকেলটা নওরিন নিজের ঘরে শুয়ে কাটালো । এর মাঝে একবার নওরিনের মা রেবেকা তার মেয়ের শরীরে হাত দিয়ে তাপ মাত্রা দেখে এসেছে । প্রথমে ভেবেছিলো হয়তো তার শরীর খারাপ । কিন্তু শরীর ঠিকই রয়েছে মেয়েটার । তাহলে মেয়েটা এমন নিশ্চুপ হয়ে কেন আছে? রেবেকা একটু চিন্তিত হলেন । মেয়ের সাথে তার বন্ধুর মত সম্পর্ক । এতোদিন যা হয়েছে নওরিন সব সময় তার সাথে সব কিছু নিয়ে খোলা খুলি আলোচনা করেছে । তাহলে আজকে এমন কি হল যে মেয়েটা একদম চুপ হয়ে গেল ? গত দুই দিন থেকেই রেবেকা লক্ষ্য করছে মেয়েটা এমন করছে । কি এমন হয়েছে ?

রেবেকা ঠিক করলো আরও একটা দিন দেখবে । দেখবে যে নওরিন নিজ থেকেই তাকে সব কিছু বলে কিনা । যদি না বলে তাহলে নিজেই জিজ্ঞেস করবে । তবে আরও একটা দিন অপেক্ষা করতে হল না । ঐদিন রাতেই নওরিন রাতের খাবারের পর তার মাকে বলল, ঘুমুবার আগে একটু আমার ঘরে আসবে ? তোমাকে কয়েকটা কথা বলতাম ।
তারপর আর কিছু না বলে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল । রেবেকা স্বামীর দিকে তাকিয়ে দেখলেন সে কিছু খেয়াল করলো না । দেখলো তার স্বামী ব্যাপারটা খেয়াল করে নি । মনে মনে একটু নিশ্চিন্ত হলেন । স্বামীকে এসবের ভেতরে সে ডাকতে চান না । যদি সমস্যা হাত থেকে ছুটে যায় তাহলে স্বামীর সাহায্য নিবেন তিনি ।

কাজ কর্ম শেষ করে মেয়ের ঘরে গিয়ে হাজির হলেন । নওরিন তখন নিজের খাটের উপরে চুপ করে বসে আছে । চেহারাতে একটা বিষণ্ণ দৃষ্টি । মেয়ের সামনে বসলো সে । তারপর বলল, কী হয়েছে ? বল আমাকে ?
নওরিন মায়ের দিকে তাকালো । তারপর বলল, আম্মু আমি একটা অন্যায় করে ফেলেছি ।
-কী অন্যায় ?
-তুমি বলেছিলে না যে আমি যেন হুট হাট করে কোন সম্পর্কে না জড়াই ! আমার লক্ষ্যও তেমনই ছিল যে পড়াশুনা করা অবস্থায় আমি কোন সম্পর্কে জড়াবো না । কিন্তু ….

লাইণ গুলো বলে নওরিন কিছু সময়ের জন্য চুপ করে রইলো । রেবেকা ঠিক বুঝতে পারছেন না কি বলবেন ! মেয়েকে তিনি সব স্বাধীনতা দিয়েছেন । সেই সাথে নৈতিক শিক্ষাটাও । ছেলেদের সাথে মেলামেশা করতে মানা করেন নি । তবে বুঝিয়েছেন অল্প বয়সের আবেগ গুলোকে প্রশ্রয় দিলে সেটা পরে গিয়ে কেবল ঝামেলাই ডেকে আনে । নওরিন সেই মোতাবেক কাজও করছিলো । ওর কয়েকটা ছেলে বন্ধু আছে । ওরা প্রায়ই বাসায় আসে । আড্ডা চলে । মাঝে মাঝে রেবেকাও তাদের সাথে গিয়ে যোগ দেন । সবাইকে তিনি চেনেন । তারা কেবল বন্ধুই । এতো দিন তো সব ভালই ছিল । হঠাৎ কি হল আবার !

নওরিন বলল, কদিন আগে আমার ব্রাইডাল ফটোশ্যুট ছিল । জানোই তো !
রেবেকা মাথা নাড়ালো । নওরিনের পড়া লেখার পাশা পাশি মাঝে মধ্যে ফটোশ্যুট করে স্টিল প্রিন্ট মিডিয়ার জন্য । তেমন একটা ফটোশ্যুটে গিয়েছিলো কদিন আগে । ছবি গুলো কদিন আগে ফেসবুকে দিয়ে ও । দারুন হয়েছে । তিনি নিজেও দেখেছেন । এতো চমৎকার বউ সেজেসে নওরিন রেবেকার ইচ্ছে করছিলো এখনই ওকে বিয়ে দিয়ে দিক । নওরিন আবার বলা শুরু করলো, আমাদের ক্লাসে অপু নামের একটা ছেলে আছে । আমাকে অনেক আগে থেকেই পছন্দ করে । আমি ব্যাপারটা জানি এবং ওকে বুঝিয়ে বলেছি যে আমি কোন ভাবেই কোন সম্পর্কে জড়াবো না । সে বুঝেছে এবং আমাকে কোনদিন ডিস্টার্ব করে নি । আমার ফেসবুকে এড রয়েছে । কোন আমাকে একটা মেসেজ পর্যন্ত পাঠায় নি । কিন্তু গত পরশু মানে যেদিন আমি ছবি গুলো আপলোড দেই ফেসবুকে তার পরের দিন হঠাৎ আমাকে ডাক দিলো কথা বলার জন্য । ক্লাস মেট হিসাবে সে আমার সাথে কথা বলতেই পারে । আমি গেলাম কথা বলতে ।

নওরিন একটু থামলো । কি যেন ভাবলো কয়েক মুহুর্ত । তারপর আবার বলল, আমার দিকে তাকিয়ে ছিল বেশ কিছু সময় । তারপর অপু বলল, নওরিন তোমার বিয়ের ফটোশ্যুট দেখলাম । জানো কাল সারা রাত আমি একটা মুহুর্ত চোখের পাতা এক করতে পারি নি । বারবার কেবল মনে হচ্ছিলো যে তোমার কোন একদিন এই ভাবে বিয়ে হয়ে যাবে অন্য কারো সাথে ! এই ভাবনা মনে আসতেই কি এক তীব্র কষ্ট আমি অনুভব করেছি আমি তোমাকে বলে বোঝাত পারবো না !

আমি কেবল অবাক হয়ে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম । অপুর এসপ্রেশন দেখছিলাম । ছেলেটার যে নিজের উপর নিয়ন্ত্রন নেই সেটা আমি বুঝতে পারছিলাম অথচ ওকে যতদিন ধরে চিনি একেবারে ধীর স্থির একটা ছেলে । অপু আবার বলল, আমি বলছি না আমার সাথে প্রেম কর কিংবা সম্পর্ক কর । কেবল এই অনার্সের বাকি সময়টাতে প্লিজ বিয়ে কর না । অনার্স শেষ হোক তখন আমি অন্য কোথাও চলে যাবো । চোখের আড়ালে । আমাকে তখন ফেসবুক সহ সব স্থান থেকে ব্লক করে দিও । কিংবা আমিই দেব । তোমার সাথে যোগাযোগ আছে এমন কারো সাথে আমি নিজ থেকে যোগাযোগ বন্ধ করে দিবো যাতে কোন দিন আমাকে তোমার ঐ বিয়ের ছবি দেখতে না হয়। অন্য কারো সাথে তোমার বিয়ে হচ্ছে এই ছবি দেখে আমি সহ্য করতে পারবো না । আমি সত্যিই সহ্য করতে পাবো না। এই কাজ টুকু কি আমার জন্য করবে ! প্লিজ !

রেবেকা খেয়াল করে দেখলেন নওরিনের চোখ দিয়ে পানি বের হয়েছে । নওরিন না থেমে আবার বলল, আম্মু কথা গুলো বলার সময় অপুর কন্ঠে যে কি একটা আকুলতা ছিল সেটা আমি তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না । ওর চোখে পানি টলমল করছিলো । আমি এতো বড় ধাক্কা কখনও খাই নি । এতো তীব্র ভাবে আমি সত্যিই কিছু উপলব্ধি করি নি ।
এই বলে নওরিন রেবেকা জড়িয়ে ধরলো । তারপর হুহু করে কেঁদে উঠলো । কাঁদতে কাঁদতেই বলল, আম্মু আমি কিছুতেই আমার মন থেকে অপুকে বের করতে পারছি না । কিছুতেই না । আমার কী করবো আম্মু !!

রেবেকা মেয়ের পিঠে হাত দিতে আদর করতে লাগলেন । তারপর বলল, কাঁদিন না । শান্ত হয়ে ঘুমা । আমরা এটা নিয়ে পরে ভাববো । এই যে আমাকে বলেছিস ভাল লাগবে আশা করি । এখন ঘুম দে ।

নওরিনকে বিছানায় শুইয়ে রেবেকা ঘর থেকে বের হয়ে গেল । তার মাথায় তখন অন্য কিছু চলছে !

দুই
অনেক সময় ধরে কলিং বেলা বাজছে । নওরিন একটু অবাক হল । দরজা কেউ খুলছে না কেন? কাজের মেয়েটা গেল কোথায়? তার মাই বা কোথায় ? ঘুমাচ্ছে নাকি ?

নওরিন উঠে গিয়ে সদর দরজা খুলে দিল । সাথে সাথেই একটু চমকালো । অপু দাড়িয়ে সামনে !
মুখ দিয়ে একটা শব্দ বের হয়ে এল ।
-তুমি ? এখানে?
অপুকে একটু বিব্রত দেখালো । তারপর বলল, তোমার আম্মু ফোন করে আসতে বলল।
নওরিন যেন আকাশ থেকে পড়লো । আম্মু !
-হ্যা আমি আসতে বলেছি ।

পেছনে তাকিয়ে দেখে রেবেকা দাড়িয়ে । রেবেকা বলল, কই এসো অপু ! বাসা চিনতে অসুবিধা হয় নি তো !
-জি না !
-আই গেস তুমি আমাদের বাসা অনেক আগে থেকেই চিনো?
অপু কিছু বলল না । কেবল মাথা নাড়ালো ।

নওরিন তখনও ঠিক বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে । তবে অপুকে সামনে দেখে কেন জানি ওর আনন্দ হচ্ছে । খুশি লাগছে খুব ।

তিন জন বসার ঘরে বসলো । রেবেকাই কথা শুরু করলো ।

-দেখো আমি জানি মানুষের মনকে ধরে বেঁধে রাখার কোন উপায় নেই । যত শাসনই করা হোক না কেন । আমি আমার মেয়েকে একটা অনুরোধ করেছিলাম সেটা সে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে আমি জানি । কিন্তু সফল হয় নি ।

নওরিন চট করে একবার মায়ের দিকে আরেকবার অপুর দিকে তাকালো । রেবেকা আবারও বলল, আমি বাঁধা দিচ্ছি না । কেবল আমি চাই আমার মেয়ে যেন নিরাপদ থাকুক । এবং তুমিও । বুঝতে পারছো তো আমি কী বলতে চাইছি?
দুজনেই মাথা নাড়লো ।
-দুজনেই একে অন্যের সাথে মিশো । আমার আপত্তি নেই । বন্ধুর মত কিংবা বন্ধুর থেকে একটু বেশি কিছু । তবে দুজন এমন কোন কাজ করবে যেটা আমাদের দুই পরিবারের সম্মান কে আঘাত করে কিংবা তোমার ক্ষতি হয় । বুঝতে পেরেছো ?
-জি ! বুঝতে পারছি ।
-তোমরা কথা বলবে, গল্প করবে, ঘুরতেও যাবে । এক সাথে পড়াশুনাও করবে । সেটাতে সমস্যা নেই কিন্তু নো সেক্স বিফোর মেরেজ !
নওরিন সাথে সাথে চিৎকার করে উঠলো, আম্মু !!!!! কী বলছো এসব ।
অপুর নাক কাল গরম হয়ে উঠলো !
রেবেকা বলল, তোমাদের দুজনের যে আবেগ আমি দেখছি সেটাতে ঐদিকে যাবে না কোন নিশ্চয়তা নেই । তাই আগে থেকে সাবধান করে দিলাম । মনে থাকে যেন ! তোমরা বসে গল্প করে আমি দেখি তোমাদের কি খাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারি ।

রেবেকা উঠে চলে গেলে অপু আর নওরিন বসে রইলো খানিকটা সময় । অপু বলল, তোমার আম্মুকে অনুমতি দিলেন প্রেম করার?
-জি না প্রেম করার অনুমতি দেয় নি । বন্ধুত্ব করার অনুমতি দিয়েছে ।

নওরিন হাসলো । এই কদিন পরে এই প্রথম ও যেন একটু শান্তমত নিঃশ্বাস নিল । কি যে আনন্দ হচ্ছে ওর । সামনে বসা এই ছেলেটার সাথে এই ভাবে সব কিছু শুরু হবে সেটা সে কোন দিন ভাবতেও পারে নি ।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.8 / 5. Vote count: 85

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

2 Comments on “নওরিনের মন খারাপ”

  1. আমার ও এমন একটা অনুমতি দরকার খুব..একা থাকা টাফ😥

Comments are closed.