নওরিনের মন খারাপ

4.8
(82)

পুরো বিকেলটা নওরিন নিজের ঘরে শুয়ে কাটালো । এর মাঝে একবার নওরিনের মা রেবেকা তার মেয়ের শরীরে হাত দিয়ে তাপ মাত্রা দেখে এসেছে । প্রথমে ভেবেছিলো হয়তো তার শরীর খারাপ । কিন্তু শরীর ঠিকই রয়েছে মেয়েটার । তাহলে মেয়েটা এমন নিশ্চুপ হয়ে কেন আছে? রেবেকা একটু চিন্তিত হলেন । মেয়ের সাথে তার বন্ধুর মত সম্পর্ক । এতোদিন যা হয়েছে নওরিন সব সময় তার সাথে সব কিছু নিয়ে খোলা খুলি আলোচনা করেছে । তাহলে আজকে এমন কি হল যে মেয়েটা একদম চুপ হয়ে গেল ? গত দুই দিন থেকেই রেবেকা লক্ষ্য করছে মেয়েটা এমন করছে । কি এমন হয়েছে ?

রেবেকা ঠিক করলো আরও একটা দিন দেখবে । দেখবে যে নওরিন নিজ থেকেই তাকে সব কিছু বলে কিনা । যদি না বলে তাহলে নিজেই জিজ্ঞেস করবে । তবে আরও একটা দিন অপেক্ষা করতে হল না । ঐদিন রাতেই নওরিন রাতের খাবারের পর তার মাকে বলল, ঘুমুবার আগে একটু আমার ঘরে আসবে ? তোমাকে কয়েকটা কথা বলতাম ।
তারপর আর কিছু না বলে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল । রেবেকা স্বামীর দিকে তাকিয়ে দেখলেন সে কিছু খেয়াল করলো না । দেখলো তার স্বামী ব্যাপারটা খেয়াল করে নি । মনে মনে একটু নিশ্চিন্ত হলেন । স্বামীকে এসবের ভেতরে সে ডাকতে চান না । যদি সমস্যা হাত থেকে ছুটে যায় তাহলে স্বামীর সাহায্য নিবেন তিনি ।

কাজ কর্ম শেষ করে মেয়ের ঘরে গিয়ে হাজির হলেন । নওরিন তখন নিজের খাটের উপরে চুপ করে বসে আছে । চেহারাতে একটা বিষণ্ণ দৃষ্টি । মেয়ের সামনে বসলো সে । তারপর বলল, কী হয়েছে ? বল আমাকে ?
নওরিন মায়ের দিকে তাকালো । তারপর বলল, আম্মু আমি একটা অন্যায় করে ফেলেছি ।
-কী অন্যায় ?
-তুমি বলেছিলে না যে আমি যেন হুট হাট করে কোন সম্পর্কে না জড়াই ! আমার লক্ষ্যও তেমনই ছিল যে পড়াশুনা করা অবস্থায় আমি কোন সম্পর্কে জড়াবো না । কিন্তু ….

লাইণ গুলো বলে নওরিন কিছু সময়ের জন্য চুপ করে রইলো । রেবেকা ঠিক বুঝতে পারছেন না কি বলবেন ! মেয়েকে তিনি সব স্বাধীনতা দিয়েছেন । সেই সাথে নৈতিক শিক্ষাটাও । ছেলেদের সাথে মেলামেশা করতে মানা করেন নি । তবে বুঝিয়েছেন অল্প বয়সের আবেগ গুলোকে প্রশ্রয় দিলে সেটা পরে গিয়ে কেবল ঝামেলাই ডেকে আনে । নওরিন সেই মোতাবেক কাজও করছিলো । ওর কয়েকটা ছেলে বন্ধু আছে । ওরা প্রায়ই বাসায় আসে । আড্ডা চলে । মাঝে মাঝে রেবেকাও তাদের সাথে গিয়ে যোগ দেন । সবাইকে তিনি চেনেন । তারা কেবল বন্ধুই । এতো দিন তো সব ভালই ছিল । হঠাৎ কি হল আবার !

নওরিন বলল, কদিন আগে আমার ব্রাইডাল ফটোশ্যুট ছিল । জানোই তো !
রেবেকা মাথা নাড়ালো । নওরিনের পড়া লেখার পাশা পাশি মাঝে মধ্যে ফটোশ্যুট করে স্টিল প্রিন্ট মিডিয়ার জন্য । তেমন একটা ফটোশ্যুটে গিয়েছিলো কদিন আগে । ছবি গুলো কদিন আগে ফেসবুকে দিয়ে ও । দারুন হয়েছে । তিনি নিজেও দেখেছেন । এতো চমৎকার বউ সেজেসে নওরিন রেবেকার ইচ্ছে করছিলো এখনই ওকে বিয়ে দিয়ে দিক । নওরিন আবার বলা শুরু করলো, আমাদের ক্লাসে অপু নামের একটা ছেলে আছে । আমাকে অনেক আগে থেকেই পছন্দ করে । আমি ব্যাপারটা জানি এবং ওকে বুঝিয়ে বলেছি যে আমি কোন ভাবেই কোন সম্পর্কে জড়াবো না । সে বুঝেছে এবং আমাকে কোনদিন ডিস্টার্ব করে নি । আমার ফেসবুকে এড রয়েছে । কোন আমাকে একটা মেসেজ পর্যন্ত পাঠায় নি । কিন্তু গত পরশু মানে যেদিন আমি ছবি গুলো আপলোড দেই ফেসবুকে তার পরের দিন হঠাৎ আমাকে ডাক দিলো কথা বলার জন্য । ক্লাস মেট হিসাবে সে আমার সাথে কথা বলতেই পারে । আমি গেলাম কথা বলতে ।

নওরিন একটু থামলো । কি যেন ভাবলো কয়েক মুহুর্ত । তারপর আবার বলল, আমার দিকে তাকিয়ে ছিল বেশ কিছু সময় । তারপর অপু বলল, নওরিন তোমার বিয়ের ফটোশ্যুট দেখলাম । জানো কাল সারা রাত আমি একটা মুহুর্ত চোখের পাতা এক করতে পারি নি । বারবার কেবল মনে হচ্ছিলো যে তোমার কোন একদিন এই ভাবে বিয়ে হয়ে যাবে অন্য কারো সাথে ! এই ভাবনা মনে আসতেই কি এক তীব্র কষ্ট আমি অনুভব করেছি আমি তোমাকে বলে বোঝাত পারবো না !

আমি কেবল অবাক হয়ে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম । অপুর এসপ্রেশন দেখছিলাম । ছেলেটার যে নিজের উপর নিয়ন্ত্রন নেই সেটা আমি বুঝতে পারছিলাম অথচ ওকে যতদিন ধরে চিনি একেবারে ধীর স্থির একটা ছেলে । অপু আবার বলল, আমি বলছি না আমার সাথে প্রেম কর কিংবা সম্পর্ক কর । কেবল এই অনার্সের বাকি সময়টাতে প্লিজ বিয়ে কর না । অনার্স শেষ হোক তখন আমি অন্য কোথাও চলে যাবো । চোখের আড়ালে । আমাকে তখন ফেসবুক সহ সব স্থান থেকে ব্লক করে দিও । কিংবা আমিই দেব । তোমার সাথে যোগাযোগ আছে এমন কারো সাথে আমি নিজ থেকে যোগাযোগ বন্ধ করে দিবো যাতে কোন দিন আমাকে তোমার ঐ বিয়ের ছবি দেখতে না হয়। অন্য কারো সাথে তোমার বিয়ে হচ্ছে এই ছবি দেখে আমি সহ্য করতে পারবো না । আমি সত্যিই সহ্য করতে পাবো না। এই কাজ টুকু কি আমার জন্য করবে ! প্লিজ !

রেবেকা খেয়াল করে দেখলেন নওরিনের চোখ দিয়ে পানি বের হয়েছে । নওরিন না থেমে আবার বলল, আম্মু কথা গুলো বলার সময় অপুর কন্ঠে যে কি একটা আকুলতা ছিল সেটা আমি তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না । ওর চোখে পানি টলমল করছিলো । আমি এতো বড় ধাক্কা কখনও খাই নি । এতো তীব্র ভাবে আমি সত্যিই কিছু উপলব্ধি করি নি ।
এই বলে নওরিন রেবেকা জড়িয়ে ধরলো । তারপর হুহু করে কেঁদে উঠলো । কাঁদতে কাঁদতেই বলল, আম্মু আমি কিছুতেই আমার মন থেকে অপুকে বের করতে পারছি না । কিছুতেই না । আমার কী করবো আম্মু !!

রেবেকা মেয়ের পিঠে হাত দিতে আদর করতে লাগলেন । তারপর বলল, কাঁদিন না । শান্ত হয়ে ঘুমা । আমরা এটা নিয়ে পরে ভাববো । এই যে আমাকে বলেছিস ভাল লাগবে আশা করি । এখন ঘুম দে ।

নওরিনকে বিছানায় শুইয়ে রেবেকা ঘর থেকে বের হয়ে গেল । তার মাথায় তখন অন্য কিছু চলছে !

দুই
অনেক সময় ধরে কলিং বেলা বাজছে । নওরিন একটু অবাক হল । দরজা কেউ খুলছে না কেন? কাজের মেয়েটা গেল কোথায়? তার মাই বা কোথায় ? ঘুমাচ্ছে নাকি ?

নওরিন উঠে গিয়ে সদর দরজা খুলে দিল । সাথে সাথেই একটু চমকালো । অপু দাড়িয়ে সামনে !
মুখ দিয়ে একটা শব্দ বের হয়ে এল ।
-তুমি ? এখানে?
অপুকে একটু বিব্রত দেখালো । তারপর বলল, তোমার আম্মু ফোন করে আসতে বলল।
নওরিন যেন আকাশ থেকে পড়লো । আম্মু !
-হ্যা আমি আসতে বলেছি ।

পেছনে তাকিয়ে দেখে রেবেকা দাড়িয়ে । রেবেকা বলল, কই এসো অপু ! বাসা চিনতে অসুবিধা হয় নি তো !
-জি না !
-আই গেস তুমি আমাদের বাসা অনেক আগে থেকেই চিনো?
অপু কিছু বলল না । কেবল মাথা নাড়ালো ।

নওরিন তখনও ঠিক বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে । তবে অপুকে সামনে দেখে কেন জানি ওর আনন্দ হচ্ছে । খুশি লাগছে খুব ।

তিন জন বসার ঘরে বসলো । রেবেকাই কথা শুরু করলো ।

-দেখো আমি জানি মানুষের মনকে ধরে বেঁধে রাখার কোন উপায় নেই । যত শাসনই করা হোক না কেন । আমি আমার মেয়েকে একটা অনুরোধ করেছিলাম সেটা সে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে আমি জানি । কিন্তু সফল হয় নি ।

নওরিন চট করে একবার মায়ের দিকে আরেকবার অপুর দিকে তাকালো । রেবেকা আবারও বলল, আমি বাঁধা দিচ্ছি না । কেবল আমি চাই আমার মেয়ে যেন নিরাপদ থাকুক । এবং তুমিও । বুঝতে পারছো তো আমি কী বলতে চাইছি?
দুজনেই মাথা নাড়লো ।
-দুজনেই একে অন্যের সাথে মিশো । আমার আপত্তি নেই । বন্ধুর মত কিংবা বন্ধুর থেকে একটু বেশি কিছু । তবে দুজন এমন কোন কাজ করবে যেটা আমাদের দুই পরিবারের সম্মান কে আঘাত করে কিংবা তোমার ক্ষতি হয় । বুঝতে পেরেছো ?
-জি ! বুঝতে পারছি ।
-তোমরা কথা বলবে, গল্প করবে, ঘুরতেও যাবে । এক সাথে পড়াশুনাও করবে । সেটাতে সমস্যা নেই কিন্তু নো সেক্স বিফোর মেরেজ !
নওরিন সাথে সাথে চিৎকার করে উঠলো, আম্মু !!!!! কী বলছো এসব ।
অপুর নাক কাল গরম হয়ে উঠলো !
রেবেকা বলল, তোমাদের দুজনের যে আবেগ আমি দেখছি সেটাতে ঐদিকে যাবে না কোন নিশ্চয়তা নেই । তাই আগে থেকে সাবধান করে দিলাম । মনে থাকে যেন ! তোমরা বসে গল্প করে আমি দেখি তোমাদের কি খাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারি ।

রেবেকা উঠে চলে গেলে অপু আর নওরিন বসে রইলো খানিকটা সময় । অপু বলল, তোমার আম্মুকে অনুমতি দিলেন প্রেম করার?
-জি না প্রেম করার অনুমতি দেয় নি । বন্ধুত্ব করার অনুমতি দিয়েছে ।

নওরিন হাসলো । এই কদিন পরে এই প্রথম ও যেন একটু শান্তমত নিঃশ্বাস নিল । কি যে আনন্দ হচ্ছে ওর । সামনে বসা এই ছেলেটার সাথে এই ভাবে সব কিছু শুরু হবে সেটা সে কোন দিন ভাবতেও পারে নি ।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.8 / 5. Vote count: 82

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

2 Comments on “নওরিনের মন খারাপ”

  1. আমার ও এমন একটা অনুমতি দরকার খুব..একা থাকা টাফ?

Comments are closed.