দ্য ওয়েটিং ক্যাফে

4.4
(15)

ঢাকায় আমি বেশ কয়েক বছর হল নিয়মিত সাইকেল চালাই। বলা যায় যে সব জায়গাতেই আমি সাইকেল নিয়ে যাই। একবার তো বিয়ে বাড়িতে আমি সাইকেল চালিয়ে গিয়েছিলাম। সবাই সেবার বেশ হাসাহাসি করেছিল আমাকে নিয়ে। তাদের বক্তব্য ছিল যে আমি যখন নিজে বিয়ে করব তখনও আমি সাইকেলে চড়েই যাবো বিয়ে করতে। সত্যি বলতে কি এই আইডিয়াটা আমার একেবারে খারাপ লাগে নি।
এখন সাথে সাইকেল থাকে বলে বাসায় একটু রাত করে ফেরা যায়। আগে তো দশটার আগেই বাসায় ফেরার একটা তাড়া ছিল কারণ দশটার পরে ঠিক বাস পাওয়া যায় না। তখন অনেকগুলো টাকা খরচ করে বাসায় আসতে হয় তবে এখন সেই ভয় নেই। সাইকেল থাকার কারণে নিশ্চিন্তে বাসায় ফেরা যায়। আজকেও তেমন ভাবে একটু রাত করেই বাসায় ফিরছি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সময়টা এগারটা পার হয়ে গেছে।
আমার সাধারণত এতো রাত হয় না। আজকে কেন যে এতো রাত হয়ে গেল সেটা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। রাত দশটা পার হলেই ঢাকার রাস্তা বদলাতে শুরু করে। তখন সাইকেল চালিয়ে বেশ আনন্দ পাওয়া যায়। এই কারণে আমি সব সময় একটু দেরি করে বাসার জন্য বের হই। তবে আজকে একটু বেশিই দেরি হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। আমি যখন ২৭ নম্বরের রাস্তাটা পার হলাম তখন অবাক হয়ে খেয়াল করলাম যে রাস্তায় কোন গাড়ি নেই। এই সময়ে পাব্লিক বাস বন্ধ হয়ে যায়। তবে বাইক রিক্সা আর প্রাইভেট কার রাস্তায় থাকে ঠিকই। তবে আজকে মনে হচ্ছে কেউ নেই। আমার সেই করোনার সময়ের কথা মনে পড়ে গেল। আমি তখন প্রায়ই রাতের বেলা বের হলাম সাইকেল নিয়ে। সেই সময়েও এমন ভাবে পুরো রাস্তা ফাঁকা থাকত। কিন্তু আজকে এমন লাগছে কেন?
আমি সাইকেলের গতি কমিয়ে দিলাম। চারিদিকে নজর ফেলতে ফেলতে এগিয়ে যাচ্ছি। এই রাস্তাটা আমার খুব পরিচিত। বিগত পনের-ষোল বছর আমি নিয়মিত ভাবে এই রাস্তা দিয়ে যাওয়া আসা করে নি অথচ আজকে এই রাস্তাটা আমার কাছে কেমন যেন অপরিচিত মনে হচ্ছে। সারি সারি ল্যাম্পপোস্টের রংটা একটু নীল মনে হল। আমি সত্যিই অবাক হয়ে গেলাম। কারণ ঢাকার এই রাস্তায় নিয়ন বাতি এখন আর দেখা যায় না বললেই চলে। সব রাস্তায় এলইডি আলো জ্বলে। পুরো রাস্তা ফঁকফকা আলোয় আলোকিত হয়ে থাকে। কিন্তু আজকেই এই আলো যেন আমার কাছে নিলাভ মনে হল। এছাড়া কেমন কুয়াশা ছেঁয়ে আছে।
এখন কি শীতকাল?
আমি একটু মনে করার চেষ্টা করলাম। নাহ! এখন তো শীতকাল হওয়ার কথা না। যদিও আমার স্পষ্ট মনে পড়ল না যে এটা আসলেই শীতকাল কিনা। এটাও আমাকে বেশ অবাক করল। আমার কেন মনে পড়ছে না যে এটা শীতকাল কিনা!
আমি সিটি হাসপালাতের কাছে এসেই আমি সাইকেলের গতি একেবারে কমিয়ে দিলাম। গলির দিকে তাকিয়ে মনের ভেতরে একটা দ্বিধা কাজ করতে লাগল। বিশেষ করে গলিটা একেবারে ভুতুড়ে মনে হচ্ছে আমার কাছে। আমার এই গলির ভেতরে ঢুকতে কেন জানি সাহস হল না। আমি ঠিক করলাম যে বাসস্ট্যান্ড দিয়েই আমি বাসায় ফিরব। আমি সোজা সাইকেল চালিয়ে গেলাম।
আমার মনের ভেতরে এবার একটা দ্বিধা কাজ করতে শুরু করেছে। আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না যে আমার সাথে কী হচ্ছে! আমার কাছে মনে হচ্ছে যেন আমি অন্য একটা জগতে চলে এসেছি। এই জগত আমার পরিচিত মনে হচ্ছে আবার অপরিচিত মনে হচ্ছে। একই রাস্তা, একই বিল্ডিং, সব কিছু আগের মতই আছে কিন্তু তারপরেও মনে হচ্ছে কিছুই যেন আগের মত নেই।
আমি যখন বাসস্ট্যান্ডে পৌছালাম তখন আরও একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার আমার চোখে পড়ল। পুরো বাসস্ট্যান্ডটা বন্ধ। কেউ নেই কোথাও। একটা আলো জ্বলছে না। আল্লাক করিম মসজিদ মার্কেটা যেন ভুতুরে বিল্ডিং হয়ে গেছে। এটা একেবারে অসম্ভব একটা ব্যাপার। এ বিল্ডিংটা সব সময় জমজমাট থাকে। রাত বারোটা একটার আগে কখনই বন্ধ হয় না। এমন কি বন্ধ হওয়ার পরেও সামনের অনেকগুলো হকারের দোকান খোলা থাকে। এই রাস্তা দিয়ে ঘাটারচরে ট্রাক যায়। সারারাত ধরেই এই রাস্তায় যান চলাচল করে অথচ এখন আমার মনে হচ্ছে যেন ই রাস্তা দিয়ে বহুদিন কেউ আসে নি।
এবার সত্যিই আমার ভয় করতে শুরু করল। মনে হল যে নিশ্চিত ভাবেই এখানে কোন না কোন সমস্যা আছে। আমি এখানে কেন চলে এলাম? কিভাবে এলাম? এটা আমার পরিচিত কোন জায়গা নয়। আমি দ্রুত সাইকেলের প্যাডেল চালিয়ে আমার বাসার দিকে রওয়ানা দিলাম। যদিও আমি নিশ্চিত জানি না যে আমি যেখানে পৌছাব সেটা আদৌও আমার নিজের বাসা হবে কিনা ! তবুও আমি সাইকেল প্যাডেল ঘোরাতেই লাগলাম।
হাউজিংয়ের ভেতরে ঢুকেও সব কিছু একই রকম দেখতে পেলাম। কোথাও কেউ নেই। পুরো হাউজিংটা যেন মৃত্যুপুরি হয়ে আছে। কেউ নেই কোথাও। কোন ঘরে আলো জ্বলছে না। আমি যখন নিজের বিল্ডিংয়ের সামনে এলাম তখনও সেই একই ব্যাপার। আমি গেটের সামনে এসে দেখি সেটা বন্ধ। ভেতরে দেখার চেষ্টা করলাম তবে কোন কাজ হল না। ভেতরে কাউকে দেখতে পেলাম না। কয়েকবার দারোয়ান মামার নাম ধরে ডাক দিয়েও কোন লাভ হল না। কী করব সত্যিই আমি বুঝতে পারছি না। কেউ যে আমার ডাকে আসবে সেটা আমি স্পষ্টই বুঝতে পারছিলাম।
আমি আমার সামনের বিল্ডিংগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলাম হতাশ চোখে। কোন বিল্ডিংয়ে কোন আলো নেই। এটা কী হচ্ছে আমার সাথে?
আমি সাইকেল ঘুরিয়ে নিলাম। যদিও জানি না আমি কোন দিকে যাচ্ছি তারপরেও এখানে এভাবে বসে থাকার কোন মানেই নেই। আমি যখন আমার বিল্ডিংয়ের গলি থেকে বের হয়ে এলাম তখনই আলোটা চোখে পড়ল। আমি দ্রুত এগিয়ে গেলাম সেদিকে। আলোওয়ালা বিল্ডিংয়ের সামনে এসে থামলাম। পুরো অন্ধকার জগতের মধ্যে এটাই একটা আলোর দিশারী মনে হল আমার কাছে।
এটা একটা ক্যাফে। আলোকিত সাইনবোর্ডে নাম দেখা যাচ্ছে দ্য ওয়েটিং ক্যাফে! কাঁচের দরজা দিয়ে ভেতরটা দেখা যাচ্ছে। তবে সেখানে কোন কাস্টমার আমি দেখতে পেলাম না। কাউন্টারের ওপাশেও কাউকে দেখা যাচ্ছে না। আচ্ছা, এখানে কি এই ক্যাফেটা ছিল? নাহ! আমার এই হাউজিং এই রকম কোনো ক্যাফে আছে বলে আমার মনে নেই। তাহলে?
অবশ্য এখন এসব চিন্তার সময় নেই। আলো যেহেতু দেখা যাচ্ছে ভেতরে কেউ থাকলেও থাকতে পারে। আমি সাইকেলটা দাড় করিয়ে ভেতরে ঢুকতে যাবো তখনই একটা হর্নশুনে চমকে উঠলাম। পেছনে তাকিয়ে দেখি একটা কালো রংয়ের গাড়ি প্রাইভেট আমার ঠিক পেছনে এসে থেমেছে। তবে সেটা থেকে কোন আলো জ্বলছে না। গাড়ি থেকে একজন মেয়ে নেমে এল।
মেয়েটা আমার দিকে ভীত চোখে তাকিয়ে বলল, এই যে শুনছেন?
আমি মেয়েটাকে ভাল করে দেখলাম। মেয়েটার পরণে একটা সাদা টিশার্ট আর কালো প্যান্ট। মেয়েটার চোখে মুখে ভীত ভাব রয়েছে। আমার দিকে তাকিয়ে মেয়েটা আবার বলল, এটা কোন জায়গা?
আমার মনে হল আমি নিজের এলাকার নামটা বলি তবে বললাম না। এটা যে আমার চিরায়িত ঢাকা শহরের কোন এলাকা নয় সেটা আমার বুঝতে আর বাকি নেই। আমি বললাম, এটা কোন এলাকা এটা আমি জানি না। দেখতে আমার এলাকার মত হলেও এটা আসলে সেটা নয়।
মেয়েটা বলল, আমার বাসা ধানমণ্ডি ছয় এ। কিন্তু সেখানে কেউ নেই, কিছু নেই। আমি এতো সময়ে এদিক ওদিক গাড়ি চালাচ্ছিলাম, তখনই আপনাকে দেখতে পেলাম দুর থেকে। আমি দ্রুত গাড়ি চালিয়ে এলাম তাই।
আমি পুরো ব্যাপারটা আসলে বোঝার চেষ্টা করছি কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার মাথায় স্বাভাবিক কোন ব্যাপার আসছে না।
আমি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললাম, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আমাদের এই ক্যাফের ভেতরে ঢোকা উচিত?
মেয়েটা আমার কথা শুনে একবার ক্যাফের দিকে তাকাল। তারপর আমার দিকে তাকাল। বলল, এখানে ঢোকা কি নিরাপদ হবে?
-জানি না। নিরাপদ কিনা সেটা ঢুকলেই আমরা টের পাব। আর এটা ছাড়া মনে হয় আমাদের হাতে আর কোন অপশন নেই। আমি নিশ্চয়ই আপনার বাড়িতে ঢুকতে পারেন নি। গেট বন্ধ ছিল। তাই না?
মেয়েটা উত্তর দিল না। তবে তার চেহারার ভাব তদেখে আমার বুঝতে কষ্ট হল না যে আমার অনুমান সত্য। আমি মেয়েটার জন্য অপেক্ষা করলাম না আর। মেয়েটা যদি না আসতে না চায় তবে না আসবে। আমার মনে হল যে এই ক্যাফের ঢুকলেই কোনো না কোন উত্তর খুজে পাওয়া যাবে।
আমি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। ভেতরে ঢুকতেই একটা চমৎকার সুগন্ধ আমার নেকে এসে লাগল। মনে হল যেন একটা সুন্দর পরিবেশের ভেতরে চলে এসেছি। আমি ক্যাফের চারিদিকটা ভাল করে দেখে নিলাম। ঘরটা একেবারে উজ্জ্বল আলোকিত হয়ে আছে। বাইরে কোথাও কোনো আলো নেই আর এই ভেতরে মনে হচ্ছে সব কিছু একেবারে জীবন্ত। মোট ছয়টা ছোট টেবিল রাখা। কিন্তু কেবল একটা টেবিলের সাথে একটা মাত্র চেয়ার রয়েছে। আর কোন টেবিলে কোন চেয়ার নেই। ব্যাপারটা আমার কাছে একটু অদ্ভুত মনে হল!
আমি মুখ দিয়ে ‘কেউ আছেন’ বলতে যাবো, ঠিক তখনই কাউন্টার থেকে একজন মাথা তুলে তাকাল। মাঝ বয়সী এক ভদ্রলোক। সামনে একটা এপ্রোন পরা রয়েছে। সেখানে দোকানের নাম আর লোগো আঁকা। এপ্রোনের পেছনে একটা নীল রংয়ের টিশার্ট। নিচে কী পরা সেটা অবশ্য দেখা যাচ্ছে না। সে আমার দিকে একভাবে কিছু সময় তাকিয়ে রইলো। আমার কেন জানি একটু অস্বস্তি লাগল।
আমি আবার যখন মুখ খুলে লোকটাকে কিছু বলতে যাবো তখন পেছনে দরজা খোলার আওয়াজ শুনতে পেলাম। মেয়েটা দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাঁসল। আমি আবার যখন কাউন্টারের লোকটার দিকে তাকিয়ে বলতে যাবো, তখন সেই লোকটার চোখের দিকে আমার চোখ গেল। তার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি বুঝতে পারলাম যে লোকটা যেন একটু অবাক হয়েছে।
আমি যখন প্রথম ঢুকেছিলাম সে আমার দিকে খানিকটা নিরুৎবেগ চোখে তাকিয়েছিল তবে মেয়েটাকে আমার পেছে আসতে দেখে একটু যেন সে অবাক হয়েছে। তবে সে সামলে নিল। আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, আরে দুজন এক সাথে! এমনটা স্বাধারণত হয় না। যাই হোক, বসে পড়ুন। আমি কফি দিচ্ছি।
-আসলে আমি……
-আগে কফিতে একটা চুমুক দিন তারপর আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হবে।
আমার কফি খাওয়ার কোনো ইচ্ছে ছিল না। আমি ঠিক কফি পছন্দও করি না। পোড়া পোড়া এই জিনিস কে খায়! কিন্তু আমার কাছে কেন জানি মনে হল এখানে আমার ইচ্ছে বা মতামতের কোন দাম নেই। এই লোক আমার প্রশ্নের জবাব দিবে না। তার থেকে বরং কফির জন্য অপেক্ষা করা যাক।
কিন্তু যখন টেবিলের দিকে তাকালাম তখনই আবার মনে হল যে বসার জন্য তো একটাই মাত্র চেয়ার। আর আমরা মানুষ দুইজন। তাহলে একজন বসবে কোথায়?
কিন্তু তবে সেই সমস্যার সমাধান হয়ে গেল জলদিই। দেখতে পেলাম যে লোকটা একটা চেয়ার নিয়ে টেবিলের ওপাশে রাখল। চেয়ার যদি থাকেই তবে এখানে না রেখে ভেতরে কেন রেখেছিল?
আমরা দুজনে মুখোমুখি বসলাম। সে আমার মত এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছে। আমি এতো সময় পরে মেয়েটার দিকে একটু ভাল করে তাকানোর সুযোগ পেলাম। মেয়েটা দেখতে বেশ চমৎকার। চোখদুটো কালো গভীর! সেখানে এখন একটা অদ্ভুত উৎকন্ঠা দেখা যাচ্ছে। সে জানে না যে এখন কী চলছে এখানে আর কেনই বা চলছে।
মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার কি কিছু মনে আছে? মানে কিভাবে এখানে এলেন?
আমি মেয়েটির কথা শুনে কিছু সময় ভাবার চেষ্টা করলাম। তারপরেই অবাক হয়ে খেয়াল করে দেখলাম যে খুব পেছনের ঘটনা আমার মনে নেই। আমি রাতের বেলা সাইকেল চালাচ্ছি, কেবল এই ঘটনাই আমার মনে আছে। আর কিছুই আমার মনে নেই। না মানে অন্য স্বাভাবিক ব্যাপারগুলো আমার ঠিকই মনে আছে, আমার বাসা কোথায় আর আমি কোথায় কাজ করি আমার পরিবারে কে কে আছে এসব মনে আছে কিন্তু এখানে ঠিক কিভাবে এলাম সেটা ঠিক আমার মনে নেই। এই ব্যাপারে আমার একটা কথাও ঠিক মনে পড়ছে না। আমি কেবল সাইকেল চালাতে শুরু করেছি এই কথাটা মনে পড়ছে। মনে হচ্ছে যেন আমি যেন এভাবেই প্রতিদিন সাইকেল চালিয়ে বাড়ি যাই। আজকের দিনে অন্য কোন কিছুই হয় নি।
মেয়েটি আমার মনের ভাব দেখেই সম্ভবত বুঝতে পারল যে আমার আসলে কিছু মনে নেই। মেয়েটি বলল, আমার না কিছুই মনে নেই। সত্যিই কিছু মনে নেই। আমি গাড়ি চালাতে পছন্দ করি। প্রতিদিনই আমি গাড়ি চালাই। বিশেষ করে রাতের বেলা। আজকেও তেমন ভাবেই আমি বের হয়েছিলাম। প্রথম কিছু সময় আমি ঠিক বুঝতেই পারি নি ব্যাপার। তারপর এক সময়ে আবিস্কার করি যে ব্যাপারটা অন্য রকম লাগছে। কাউকে আমি দেখতে পাচ্ছি না। চারিদিকে যেন কেউ নেই, আমি একলা রয়েছে। তারপর হঠাৎ করেই আমি আপনাকে দেখতে পেলাম দূর থেকে। আপনি সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছেন। তখনই গাড়ি ঘুরিয়ে আপনার দিকে এগিয়ে এলাম। যদিও আপনাকে দেখেছিলাম অনেক দূর থেকে। মাঝে আপনাকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। তারপর থেকে এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে আবারও আপনাকে পেয়ে গেলাম এখানে।
আমি কী বলব ঠিক বুঝতে পারছি না। আমার কাছে পুরো ব্যাপারটা কেমন একটা ধোঁয়াশার মনে হচ্ছে। আমার কাছে মনে হচ্ছে যেন আমি স্বপ্ন দেখছি। তবে স্বপ্ন এতোটা বাস্তব হয় না। মেয়েটা এবার বলল, বাই দ্য ওয়ে আমার নাম অরিন। অরিন রহমান। আপনি?
এই বলেই সে নিজের হাত বাড়িয়ে দিল আমার দিকে। আমি আমার নাম বলে সেই হাতটা ধরলাম। অরিনের হাত ধরার সাথে সাথে আমি অদ্ভুত একটা অনুভূতি অনুভব করলাম। এতো সময়ে সব কিছুই আমার কাছে কেমন যেন প্রাণহীন আর ঠান্ডা মনে হচ্ছিল। আমি সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে ছিলাম, নিজের বাড়ির গেট ধরলাম যখন তখন আমার কাছে কেন জানি সব কিছু একেবারে ঠান্ডা আর প্রাণহীন মনে হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল যেন এগুলো কোন জীবিত পৃথিবীর হতে পারে না। কিন্তু এখন মেয়েটির হাত ধরতে পেরেই আমি প্রথম অনুভব করলাম যে এই জগতটা আসলে প্রাণহীন নয়। অরিনের দিকে তাকিয়ে মনে হল যে অরিনও ঠিক একই রকম অনুভব করছে। অরিন হাত ছেড়ে দিল না। হাতটা ধরেই রাখল। আমারও কেন জানি হাতটা ধরে রাখতে বেশ ভাল লাগছিল। কিছু সময় আমরা একে অন্যের হাত ধরে রাখলাম।
কেন জানি না তবে কেন জানি আমার ভাল লাগছিল! এই পরিচিত জায়গার মত অপরিচিত স্থানে অপরিচিত এক মেয়ের হাত ধরে থাকতে আমার ভাল লাগছিল। মনে হচ্ছিল যে আমার একটা শান্তির জায়গা রয়েছে।
কত সময়ে আমরা একে অন্যের হাত ধরে বসে ছিলাম সেটা মনে নেই। তবে এক সময়ে আমাদের তন্ময় ভাঙ্গল। তাকিয়ে দেখি আমাদের সামনে ক্যাফের লোকটা এসে দাঁড়িয়েছে। তার হাতে দুই কাপ কফি। সে কফির কাফ দুটো আমাদের সামনে রাখল। তার চোখের দৃষ্টি আমাদের ধরা হাতের দিকে।
আমরা দুজনের হাত সরিয়ে নিলাম। আমাদের দিকে তাকিয়ে লোকটা বলল, এই কফিটা খান তাহলেই অনেক প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাবেন। আমাকে বাড়তি করে কিছুই বলতে হবে না।
অরিনকে দেখলাম আমার দিকে তাকাতে। ওর চোখে একটা অদ্ভুত দৃষ্টি আমি দেখতে পেলাম। সে যেন এই কফিটা খেতে ভয় পাচ্ছে। অবশ্য আমিও যে ভয় পাচ্ছি না সেটা বলব না। তবে এছাড়া আসল সত্য জানার আর কোন উপায় নেই আমাদের সামনে।
আমি কফির কাপে চুমুক দিলাম। সাথে সাথেই একটা ধাক্কার মত খেলাম যেন। এক ধাক্কায় আমি অন্য এক জায়গায় হাজির হলাম। ঠিক তখনই আমার মনে পড়ল। রাতের বেলা বাসায় ফিরছিলাম। সায়েন্সল্যাব থেকে মিরপুর রোডের দিকে যাওয়ার সময়েই মোড়ের কাছে আমার সাইকেলের সাথে একটা ট্রাকের ধাক্কা লাগে। সেই ধাক্কাতেই আমি ছিটকে গিয়ে পড়ি রাস্তার একপাশে। এই টুকু পর্যন্ত আমার জ্ঞান ছিল।
আমি কি মারা গেছি?
আমি কফির কাপ থেকে মুখ সরিয়ে অরিনের দিকে তাকালাম। অরিনও চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। তারও সম্ভবত মনে পড়েছে। সেও কি আমার মত? আমরা দুজনেই কি মারা গেছি?
অরিনকে কিছু জিজ্ঞেস করতে হল না। সে নিজ থেকে বলল, সায়েন্সল্যাব মোড়ে একটা ট্রাক আমার গাড়িটাকে ধাক্কা দেয়। তারপর আমার আর কিছু মনে নেই।
আমি বললাম, আমার সাইকেলেও ট্রাকের ধাক্কা লেগেছিল। আমরা কি মরে গেছি?
অরিন কোন কথা বলল না। আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। ওর চোখে ভয় দেখতে পাচ্ছি কেবল। আমি হঠাৎ কেমন যেন শূন্য অনুভব করলাম। তাহলে কি সত্যিই মরে গেছি আমি?
-না আপনারা মারা যান নি।
কন্ঠটা পেল কাউন্টার থেকে। আমরা দুজনেই সেদিকে তাকালাম। লোকটা ভবলেশ চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, মানে এখনও মারা যান নি।
-এখনও মারা যাই নি?
অরিন জানতে চাইল।
-হ্যা। এখনও মারা যান নি। আপনারা জন্ম মৃত্যুর মাঝের এক জগতে আছেন। এখান থেকে আপনারা যে কোন দিকেই যেতে পারেন। মৃত্যুর দিকে বা জীবনের দিকে। এখানে বসে অপেক্ষা করতে হবে।
আমি কিছ সময় স্তব্ধ হয়ে রইলাম কেবল। আমার কিছু বিশ্বাস হচ্ছিল না। আমি বুঝতে পারছিলাম না আমার সাথে কি হচ্ছে! আমি কি তাহলে সত্যিই মারা যাবো?
লোকটা বলল, এখানে আপনাদের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই।
আমি ক্যাফে থেকে বের হয়ে এলাম। বাইরে তাকিয়ে যতদুর আমার চোখ যায় আমার কেবল মনে হল যে আমার সত্যিই অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই নেই।

দুই
আমি সাইকেল চালাতে পছন্দ করি। রাতের বেলা সাইকেল চালাতে আমার সব থেকে ভাল লাগে। ঢাকা শহরে ফাঁকা রাস্তায় সাইকেল চালানোর মজাই আলাদা। আমি দ্রুত সাইকেলের প্যাডেল চালাই।
আমার আগের সাইকেল চালানোর স্বভাব ছিল তবে এখন সেটা বেড়েছে আরও বহুগুনে। যখন আমি ঐ জগতে ছিলাম তখন দিনের পর দিন আমি সেই অন্ধকার পথে সাইকেল চালিয়েছি। মাঝে মাঝে অরিন আমার সাইকেলের রডে উঠে বসত। সত্যি বলতে আমাদের সময় অপেক্ষার সময়টা কেটেছে বেশ অনেক ভাল।
তারপর একদিন অরিন হারিয়ে গেল। আমি আর অরিনের খোজ পেলাম না। ক্যাফের সেই লোকটা আমাকে সেদিন বলেছিল যে অরিনের অপেক্ষার দিন শেষ। আমি যখন জানতে চাইলাম যে সে কোন দিকে গেছে, জীবনের দিকে নাকি মৃত্যুর দিকে, ক্যাফের লোকটা বলল যে সে বলতে পারবে না। তার পক্ষে এটা জানা সম্ভব না।
তারপর একদিন আমারও অপেক্ষার শেষ হল। আমি চোখ মেলে তাকালাম।
তারপর আমার সুস্থ হতে আরও মাছ ছয়েক লাগল। তারপর আবারও আমি আপন মনে সাইকেল চালাতে শুরু করি।
আমি অরিনকে খোজার চেষ্টা করেছি। তবে কোন খোজ বের করতে পারি নি। আমি সেই দিনের এক্সিডেন্টের খোজ বের করার চেষ্টা করেছি। আমাকে ভর্তি করা হয়েছিল ঢাকা মেডিকেলে। সেই মেয়েটাকেও প্রথমে ঢাকা মেকিকেলে নিয়ে আসা হলেও পরে তাকে স্কোয়ারে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর অবশ্য আমি আর কোন খোজ পাই নি। আমি জানিও না অরিনের নামের সেই মেয়েটা সেই ওয়েটিং ক্যাফে থেকে কোন দিকে গিয়েছে?
আমি এই প্রশ্নের উত্তর জানি না।

পরিশিষ্ট

আমার এখনও সেই ওয়েটিং ক্যাফের কথা প্রায়ই মনে পড়ে। তবে যতই দিন যেতে থাকে আমার মনে হয় যে এই ব্যাপারটা আসলে সত্য না। ঐ রকম কোনো ক্যাফে আসলে নেই, থাকার কথাও না। আমি স্বপ্ন দেখেছি কেবল। এই সবের পেছনে আসলে কোন বাস্তবতা নেই। তবে সেই দিন সে ট্রাক আমার আগে অরিনকে ধাক্কা দিয়েছিল। সেখান থেকে পালানোর সময়ে সে আমাকেও ধাক্কা দেয়। অরিনকে আমি কোন দিন দেখি নি। তাহলে আমার ঐ স্বপ্নে মেয়েটাকে আমি দেখলাম কিভাবে? এই প্রশ্নের কোন জবাব আমার কাছে নেই।

এই গল্পটার মূল থিম সামু ব্লগের কাছের মানুষ এর একটা লেখা কল্প-গল্প : মধ্যরাতের চায়ের দোকান অনুপ্রাণীত।

ফেসবুকের অর্গানিক রিচ কমে যাওয়ার কারনে অনেক পোস্ট সবার হোম পেইজে যাচ্ছে না। সরাসরি গল্পের লিংক পেতে আমার হোয়াটসএপ বা টেলিগ্রামে যুক্ত হতে পারেন। এছাড়া যাদের এসব নেই তারা ফেসবুক ব্রডকাস্ট চ্যানেলেও জয়েন হতে পারেন।

অপু তানভীরের নতুন অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে

বইটি সংগ্রহ করতে পারেন ওয়েবসাইট বা ফেসবুকে থেকে।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.4 / 5. Vote count: 15

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →