নাজিয়া আরমান

4.3
(22)

জীবনে আমি অনেক বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি। মাঝে মাঝে এমন অদ্ভুত ঘটনা আমার সাথে ঘটেছে যা এখনও আমাকে অস্বস্তিতে ফেলে। তবে এর আগে কেউ কোন দিন আমাকে অন্যের বয়ফ্রেন্ড বা প্রেমিকা বলে ডাকে নি। আমার যে প্রেমিকা ছিল না ব্যাপারটা সেই সেই রকম না। দুতিনটা প্রেম আমি নিজেও করেছি। তবে আমার তাদের চাহিদা আর যোগ্যতা মিলে নি। তাই সম্পর্ক খুব বেশি দিন টিকে থাকতে পারে নি।
যাইহোক সেদিকে না যাই। কাজ কর্ম নিয়ে আমি নিজের মাঝেই ব্যস্ত থাকি। কাজের ফাঁকে সময় পেলে বন্ধু বা কলিগদের সাথে বিকেল বা সন্ধ্যার সময় আড্ডা দেই। ছুটির দিনগুলো সাধারনত বাসা থেকে একদমই বের হই না। সারা সপ্তাহ কাজ কর্ম করে আবার ছুটির দিনও বাইরে বের হতে ইচ্ছে করে না। এমন আবেই দিন চলে যাচ্ছিল এমন সময় ঘটনা ঘটল। অফিস কলিগদের সাথে বসে গল্প করছিলাম তখন অপেক্ষাকৃত কম বয়সী একটা ছেলে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ভাইয়া একটা কথা বলি?
ছেলেটা নতুন অফিসে জয়েন করেছে। অন্য ডিপার্টমেন্টে আছে। আমার সাথে খুব একটা দেখা হয় না। আমি বললাম, হ্যা বল।
-আপনার গার্লফ্রেন্ড কি নাজিয়া আরমান?
-এ? কে?
-নাজিয়া আরমান আপনার গার্লফ্রেন্ড?
-কার নাম বল মিয়া? আমিই চিনি না।
-সত্যিই আপনি নাজিয়াকে চিনেন না?
-না রে ভাই। কে এইটা?
-মডেল। টিকটক করে ! মিউজিক ভিডিও করছে অনেকগুলো। ফ্যাশন ইনফ্লুয়েন্সার !
-হইছে! না রে ভাই আমি কোন নাজিয়া ফাজিয়ারে চিনি না। আর আপাতত আমার কোন গার্লফ্রেন্ড নাই। বাসা থেকে বিয়ের জন্য মেয়ে দেখছে।

তবে ছেলেটা আমার কথায় যেন ঠিক বিশ্বাস করল না। সে নিজের মোবাইল বের করল। তারপর কিছু সময় টেপাটেপি করে আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। এই দেখেন এটা আপনি না?
আমি মোবাইলটা হাতে নিয়ে কিছু সময় ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। একটা গাড়ির ভেতরে এদুইজন ছেলে মেয়ে বসে আছে। মেয়েটা ড্রাইভিং সিটে আর ছেলেটা সেলফি তুলছে। আমি ছেলেটার মুখের দিকে কিছু সময় তাকিয়ে রইলাম। সত্যি বলতে কি ছেলেটার চেহারা আসলেই অনেকটা আমার মত। আমার মুখে কোন দাড়িগোফ নেই। এই ছেলেটার ইস্টাইলিস দাড়ি রেখেছে। যদি আমি এর মত দাড়ি রাখি তাহলে নিশ্চিত আমিও এই ছেলেটার মত দেখতে হবে। আর আজকে আমার মুখে দুদিনের শেভ না করা দাড়ি রয়েছে। এই কারণেই আমাকে অনেকটাই এই ছেলেটার মত মনে হচ্ছে।
আমি মোবাইলটা ফেরত দিতে দিতে বলল, হ্যা অনেকটা আমার মতই দেখতে তবে এটা আমি নই। আমি কোন দিন এই মেয়েকে দেখি নি। আজকেই প্রথম এর নাম শুনলাম।

আমি ভেবেছিলাম ঘটনা এখানেই শেষ হবে। তবে ঘটনা এখানে শেষ হল না। আমাদের কোম্পানী একটা নতুন প্রোডাক্ট লঞ্চের জন্য একজন মডেলকে ঠিক করা হল। এবং এই মডেল আর কেউ নয় সেই নাজিয়া আরমান। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম সেদিনের কথা। আমি হয়তো সেদিকে যেতামও না। কারণ মার্কেটিং আমার ডিপার্টমেন্টও না। তবে যেদিন নাজিয়া আমাদের অফিসে এসে হাজির হল সেদিনই আমাকে মার্কেটিং এর জমির ভাইয়ের কাছে যাওয়ার দরকার পড়ল। আমি নাজিয়াকে দেখি নি বরং নাজিয়া আমাকে দেখতে পেল।
কেউ যখন আপনার দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকবে তখন আপনি সেটা টের পাবেন। আমিও টের পেলাম। আমার চোখ মেয়েটার দিকে গেল। সে তখন সত্যিই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি অনুভব করছিলাম আমি যত সময় জমির ভাইয়ের কাছে ছিলাম তত সময় মেয়েটা আমার দিকেই তাকিয়ে ছিল।
এরপর কয়েকদিন নাজিয়া আমাদের অফিসে যাওয়া আসা করল তবে আমার সাথে তার সরাসরি আর দেখা হল না। তবে সে অফিসে এলে আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম ঠিকই। অফিসের কর্মী বিশেষ করে পুরুষ কর্মীদের ভেতরে একটা চাঞ্চল্য দেখা দিত।
আমার অবশ্য সেদিকে যাওয়ার কোন উপায় ছিল না কাজের কারণে।স তবে আমি না গেলেও সেই মেয়ে নামে নাজিয়া আরমান ঠিকই আমার কাছে এসে হাজির হল একদিন। আমার সাথে তখনও নাজিয়ার একবারও কথা হয় নি। আমাদের সেই বিজ্ঞাপন বানানোর কাজ ততদিনে শেষ হয়ে গেছে। আবার যদি নতুন করে বিজ্ঞাপন না বানানো হয় তবে নাজিয়ার আর আসার দরকার নেই আমাদের অফিসে। এমনই এক সময়ে নাজিয়া আমার সাথে যোগাযোগ করল। আমার হোয়াটসএপে সে নক দিল। আমার নম্বর সে কোথায় পেয়েছে জানি না তবে কদিন যেহেতু অফিসে যাতায়াত করছে তাই আমার নম্বর যোগার করা তার জন্য খুব একটা কঠিন হওয়ার কথা না।
আমি অবশ্য প্রথমে ঠিক চিনতে পারি নি। ছবি দেখে তারপর চিনেছি।
-কেমন আছেন ভাইয়া?
-জ্বী ভাল। আপনি কেমন আছেন?
-ভাল। চিনতে পেরেছেন আমি কেন?
-জ্বী আপনাকে না চেনার কোন কারণ নেই।
যদিও এই কথাটা মিথ্যা। তাকে আসলে চেনারই কোন কারণ নেই।
-আপনাদের অফিসে তো অনেক কয়বার গেলাম। আপনার সাথে কথাই হল না।
-আসলে আমার ডিপার্টমেন্টই আলাদা। আমি আইটিতে কাজ করি তো। তাই দরকার ছাড়া বাইরে যাওয়া হয় না।
আমি এই বলে চুপ করে গেলাম। আসলে এই মেয়েটা আমাকে ঠিক কারণে নক দিয়েছে সেটা আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। আমার সাথে মেয়েটার আসলে কাজ কী? আমাকে সে কেন ফোন দিয়েছে? আমার চেহারা তার প্রেমিকের মত খানিকটা এই জন্য?
দেখলাম নাজিয়াই নানান কথা বলতে শুরু করলো। আমাদের অফিসটা তার বেশ পছন্দ হয়েছে, আমাদের অফিসের সবাই খুব ভাল, খুব ফ্রেন্ডলি। আবারু সে আমাদের সাথে কাজ করতে চায় ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি কেবল হ্যা হু করে গেলাম। কারণ আমার আসলে আর কিছু বলার ছিল না। তবে এই কথা আমি অবশ্যই অস্বীকার করবো না যে মনের ভেতরে একটু সুড়সুড়ি জাগছিল। কেন জাগছিল সেটা অনুমান করাটা কঠিন না।
এরপর প্রায় দিনই নাজিয়া আমাকে ফোন দিতে লাগল। টুকটাক কথা হতে লাগল। তারপর একদিন জানালো যে সে খুব বিপদে পড়েছে। একটা কন্টেন্ট বানিয়েছে কিন্তু তার পিসির হার্ডডিস্ক নাকি কাজ করছে না। এখন যদি সেটা হারিয়ে যায় তাহলে পুরো কাজটাই বিফলে চলে যাবে। আমি তাকে সাহায্য করতে পারব কিনা। সে জানালো তার বাসা আমাদের অফিসের কাছেই। অফিস থেকে যাওয়ার পথে যদি একবার তার বাসা হয়ে যাই!
একবার মনে হল যে বলি আমি কোনো মেকানিক না। আপনি এই কাজের জন্য কোন মেকানিকের খোজ করেন। কিন্তু কেন জানি বললাম না। জানালাম যে অফিসের পরে আমি একবার ঢু মেরে যাব।

দুই
আমি নাজিয়াকে মেকাপ সুন্দরী মনে করেছিলা, এখনকার দিনে যেটা হয়ে থাকে। মেকাপ দিয়ে নিজেকে আকর্ষনীয় করে তোলে সবাই। কিন্তু নাজিয়ার বাসায় গিয়ে আমার সেই ভুল ভাঙ্গল। মেয়েটা আসলেই দেখতে সুন্দর। নিজের বাসায় নাজিয়া একেবারেই কোন প্রকার প্রসাধনী ছাড়া ছিল সাধারণ একটা কালো ঢোলা টিশার্ট কালো লেগিংস পরে ছিল। সত্যি বলতে এই প্রথম নাজিয়ার প্রতি আমার একটা আকর্ষণ তৈরি হল। আমি আগ্রহ নিয়ে তার পিসি চেক করে দিলাম। হার্ডডিস্ক পাচ্ছে না। সিপিউটা খুলে একটু চেক করতেই দেখা গেল মাদারবোর্ডের সাথে হার্ডডিস্কের ক্যাবেল লুজ হয়ে গেছে। সেটা ঠিকমত সেট করলেই আবার পিসি চালু হয়ে গেল।
নাজিয়া অনেকটা বাচ্চা মেয়ের মত করেই খুশি হয়ে উঠল। আমি কাজ শেষ করে চলে আসতে চাইলে কিছুতেই আমাকে আসতে দিল না। রাতের খাবার খেয়ে একেবারে আসতে হল। এরপর থেকে আমাদের মধ্যে আসলেই যোগাযোগ বাড়তে লাগল। ফোনে প্রতিদিন কথা হতে লাগল। তারপর প্রতিদিন থেকে প্রায় প্রতি ঘন্টায় আমাদের মেসেজ আদান প্রদান শুরু হল এবং প্রায়ই দিনই আমাদের দেখা হতে লাগল।
আমার মনে অবশ্য মাঝে মাঝে এই প্রশ্ন জাগত যে মেয়েটার আগে যে বয়ফ্রেন্ডটা ছিল সে কই গেল?
তার সাথে কি ব্রেক আপ হয়ে গেছে এই কারণে আমার সাথে যোগাযোগ করছে?
ব্রেকআপ অবশ্যই হয়েছে কারণ নাজিয়া আমাদের এই দেখা সাক্ষাত কিন্তু সে মোটেই লুকিয়ে করছে না। সে নিজের ফেসবুক ইনস্টাগ্রামে আমার সাথে তোলা ছবি কিংবা সেলফি আপলোড দিয়ে চলেছে। মানুষজন সেটা দেখছে ঠিকই।
এভাবের সম্পর্ক চলতে লাগল। আমি নাজিয়ার আরও একটু কাছে চলে এলাম। একদিন আমি তার আগের বয়ফ্রেন্ডের কথা জানতে চাইলাম। আমার প্রশ্ন শুনে নাজিয়া একটু গম্ভীর হয়ে গেল বটে। মনে হল যে এই প্রশ্ন করাটা সম্ভবত ঠিক হয় নি। তবে নিজেকে সামলে নিলে নাজিয়া বলল, তুমি হয়তো ভাবছো যে সুমনের চেহারা অনেকটাই তোমার মত, তাই আমি তোমার কাছে এসেছি, তাই না?
আমার মনে যে এমন চিন্তা আসে নি সেটা বলব না । আমার সত্যিই মনে হয়েছে আমার চেহারা তার আগের বয়ফ্রেন্ডের মত বলেই নাজিয়া আমার কাছে এসেছে।
নাজিয়া বলল, আসলে কথাটা অস্বীকার করলে মিথ্যা বলা হবে। সেদিন তোমাদের অফিসে তোমাকে দেখে আমি সত্যিই চমকে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল যেন আমি সুমনকেই দেখছি। তারপর আস্তে আস্তে তোমার ব্যাপারে জানতে শুরু করি। বিশেষ তুমি যে আমাকে একদমই পাত্তা দিলে না এটাই আমাকে আরও তোমার দিকে বেশি আকর্ষীত করল। আমি আসলে সব সময়ে ছেলেদের আকর্ষণ পেয়ে অভ্যস্ত। কেউ আমাকে পাত্তা দেয় না এটা আমার একদম সত্য হয় না।
-তার মানে সবার মত আমি যদি তোমার কাছে যেতাম তাহলে তুমি আমাকে পাত্তা দিতে না।
নাজিয়া হেসে বলল, একদম দিতাম না।
-বুঝলাম। তা তোমার সেই সুমনের সাথে ঠিক কী কারণে ব্রেকআপ হল?
-হি চিটেড।
-রিয়্যালী?
-হুম।

আমি আর বেশি কিছু জানতে চাইলাম না। নাজিয়ার সাথে আমার দিন দিন সম্পর্ক ভাল হতে লাগল। আমার তখন মনে হল এবার নাজিয়ার ব্যাপারটা বাসায় জানানো দরকার। বাসায় আমার জন্য মেয়ে দেখছে অনেকদিন থেকেই। নাজিয়ার কথা নিজ থেকেই তাদের জানানো দরকার মনে হল। যদিও নাজিয়াকে আমার মা পছন্দ করবে কিনা সেটা একটা চিন্তা ব্যাপার। তবে আমি মাকে রাজি করাতে পারব বলে মনে হল।
কিন্তু বাসায় বলার আগেই আবারও একয়া ঘটনা ঘটলো।

সেদিন অফিস থেকে বের হতে যাবো, এমন সময়ে গেটের কাছে একটা মেয়ে আমাকে ডাক দিল আমার নাম ধরে। আমি তাকিয়ে দেখি একটা অপরিচিত মেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি এই মেয়েটাকে এর আগে কোন দিন দেখেছি বলে মনে পড়ল না। তবে মেয়েটা যেভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে তাতে কোন সন্দেহ নেই যে মেয়েটা আমাকে চেনে। আমি মেয়েটার সামনে গিয়ে দাড়ালাম।
-আআকে ডাকছেন?
-জ্বী। আপনার সাথে কিছু কথা বলা যাবে?
আমি মেয়েটার দিকে ভাল করে তাকালাম। সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে মনে হল। অন্তত পোশাক পরিচ্ছদ দেখে তাই মনে হল। আমি বললাম, জ্বী বলুন।
মেয়েটা একটু ইতস্তর করে বলল, আপনি নাজিয়া আরমান থেকে সাবধানে থাকবেন!

আমি খানিকটা চমকে উঠলাম। তারপর ভাল করে তাকালাম মেয়েটার দিকে। এই মেয়ে নাজিয়াকে কিভাবে চেনে? তারপরই মনে হল যে তাকে চিনতেই পারে। এটা তো অস্বাভাবিক না। আর নাজিয়ার প্রোফাইল থেকে ছবি দেখে আমাকেও চিনতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই মেয়ে আমার কাছে এসে হাজির হল কেন?
-আমি আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না।
মেয়েটা কিছুটা থেমে বলল, আপনি সুমনের কথা জানেন?
সুমনের নামটা শুনতেই আমি কিছুটা সতর্ক হয়ে উঠলাম। নাজিয়ার সাথে ঐদিনের পরে সুমনের ব্যাপারে আর কোন কথা হয় নি। মেয়েটি বলল, নাজিয়া সুমনকে খুন করেছে। তারপর কারো যেন সন্দেহ না হয় তাই আপনার সাথে প্রেম করছে। আপনাদের দুজনের চেহারা যেহেতু এক তাই সবাই ভাবছে আপনি তার সেই আগের বয়ফ্রেন্ড।

আমি জীবনে এতো তীব্র ভাবে বিস্মিত হই নি। এই মেয়ে কী বলছে এসব? এই মেয়ের মাথা ঠিক আছে তো?
আমার মুখের দিকে তাকিয়েই সম্ভবত মেয়েটা বুঝতে পেরেছে আমি তার কথা বিশ্বাস করছি না। সে হাতের মোবাইলের স্ক্রিনটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। সেখানে একটা ছবি রয়েছে। এবং এই ছবিতে একজন পুরুষ একজন নারীকে দেখা যাচ্ছে কিছুটা ঘনিষ্ঠ হয়ে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে আছে। ছবির মেয়েটা আর আমার সামনে দাঁড়ানো মেয়েটা একই জন। আর ছবির ছেলেটার চেহারা আমার মত। তার মানে এই ছেলে সুমন। আমার বিস্ময় আরও বাড়ল। মেয়েটা বলল, সুমনের সাথে আমার প্রেম চলছিল। সুমন নাজিয়ার কাছ থেকে আমার কাছে আসতে চাইছিল। এটাই সে সহ্য করতে পারে নি। তার মত এতো সুন্দর সফল একজনকে ছেড়ে আমার মত সাধারণ একজনের কাছে কেউ কিভাবে আসতে পারে এটাই সে সহ্য করতে পারে নি। তাই ……
-আপনি কি নিশ্চিত ? আনে সুমন যে মারা গেছে বা নাজিয়া ওকে মেরে ফেলেছে?
-না আমার কাছে কোন প্রমান নেই। কিন্তু এটা ছাড়া আর কিছু হতেই পারে না। সুমন এভাবে গায়েব হয়ে যেতে পারে না। আমাকে না জানিয়ে কোথাও চলে যেতে পারে না।
-তা সুমনের বাবা মা পরিবার?
-কেউ নেই ওর। ও আসলে গায়েব হয়ে গেলে কারো কিছু যায় আসে না। এই সুযোগই নিয়েছে নাজিয়া।

মেয়েটা কিছু সময় থামল। তারপর বলল, আমার কথা আপনার বিশ্বাস করার দরকার নেই। আপনি যখন নাজিয়ার আরমানের বাসায় যাবেন তখন একটু খোজ করে দেখবেন যে একটা আইফোন পান কিনা ! আইফোন টেন। ওটা সুমনের ফোন। ফোনটা যদি আপনি খুজে পান তাহলে নিশ্চিত সুমনকে নাজিয়া মেরে ফেলেছে। ফোনের পাসকোড হচ্ছে ৫৫৬৯। ঐ ফোনে আমার ফিঙ্গার আর আমার ফেসলক দেওয়া। তাই নাজিয়া চাইলেও সেটা খুলতে পারবে না। ওর গায়েব হয়ে যাওয়ার কদিন আগেই সুমন এটা করেছিল। সম্ভবত আগে থেকেই টের পেয়েছিল। যদি আপনি ফোনটা খুজে পান তাহলে আমার ধারণা সত্যি হবে।
মেয়েটা আর দাড়াল না। আমি অফিস গেটে বিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম কেবল।

তিন
আমি নাজিয়ার সাথে আগের মতই আচরণ করে চললাম। তবে একটা ব্যাপার আমার কাছে পরিস্কার হয়ে গেল। নাজিয়ার আগের প্রেমিক সুমন এবং আমি যে আলাদা মানুষ এই কথাটা নাজিয়া সবার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখছে। তার ফ্যান ফলোয়াররা যারা আছে সবাই এখনও মনে করছে আমিই তার আগের সেই বয়ফ্রেন্ড। এই ব্যাপারটা আমার মনে আরও সন্দেহের উদ্রেক বাড়াল। একদিন এই কথা আমি যখন নাজিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম তখন দেখতে খুব অল্প সময়ের জন্য আমি খেয়াল করলাম যে নাজিয়ার চোখে আগুণ দেখা দিল। তবে সেটা মিলিয়ে গেল সাথে সাথে। সে নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল, কী দরকার বল এটা সবাইকে জানানো! যে যা ভাবে ভাবুক!
আমার একবার ইচ্ছে করলো যে এই ব্যাপারটা আরও টেনে লম্বা করি কিন্তু নিজেকে সামনে নিলাম। আমার সেই মেয়েটার কথা আবার মনে পড়ল। আমাকে এখন সুমনের ফোনটা খুজে বের করতে হবে। যদি আমি ওটা খুজে পাই তাহলে ঐ মেয়েটার কথা সত্যি হবে। আর আমাকে অবশ্যই নাজিয়ার কাছ থেকে দুরে যেতে হবে!!

সময় সুযোগ একদিন ঠিক চলে এল। নাজিয়ার নিজেস্ব একটা ফ্ল্যাট ছিল। সে তার পরিবারের সাথে থাকত না। আমি এই ফ্ল্যাটেই আসা যাওয়া করতাম। এই ফ্ল্যাটের একটা চাবিও ছিল আমার কাছে। একদিন নাজিয়া স্যুটিংয়ের জন্য গাজিপুর গিয়েছিল। আমি জানতাম এমন স্যুটিংগুলো পুরো দিন ধরেই হয়। আমাকে সে রাতেই জানিয়েছিল যে কালকে সারাদিন সে ব্যস্ত থাকবে। আমি ইচ্ছে করলে সন্ধ্যার পরে তার সাথে দেখা করতে পারি। আমার যেন এই সুযোগটাই দরকার ছিল। আমি সেদিন অফিস থেকে একটু আগে আগেই বের হয়ে গেলাম। তারপর সোজা হাজির হলাম নাজিয়ার ফ্ল্যাটে। তারপর আস্তে আস্তে খুজতে শুরু করলাম। সত্যি বলতে কি খুব বেশি খুজতে হল না। আইফোন টেনটা আমি নাজিয়ার ওয়্যারড্রোফের একেবার এনিচের তাকে খুজে পেলাম। একটু চার্জ দিতেই সেটা চালুও হয়ে গেল। আমি কাঁপা কাঁপা হাতে সেই মেয়েটার বলা ফোনের পিন প্রবেশ করালাম।
ফোনটা আনলোক হয়ে গেল। আমি ফোনের ভেতরে ঢুকেই প্রথমে কন্ট্রাক্ট লিস্টে গেলাম। খুব বেশি মানুষের নাম নেই। আমি নিশ্চিত যযে নাজিয়ার কাছে থাকা অবস্থায় সুমন কোন ভাবেই মেয়েটার নাম দিয়ে নম্বরটা সেভ করবে না। নিজের ফোন বের করে আমি নম্বরটা বের করলাম। সেদিন মেয়েটা আমাকে তার নম্বর দিয়েছিল। সেটা সুমনের ফোন দিয়ে ডায়াল করতেই ‘অফিস’ নাম ভেসে উঠল। রিং হওয়ার কয়েক মুহুর্তের ভেতরেই ওপাশ থেকে সেটা রিসিভ হল!
ওপাশ থেকে একটা কন্ঠে শুনতে পেলাম আমি, সুমন!
ফাঁকা আর ফ্যাঁকাশে কন্ঠ।
-না আমি রিয়াদ। আপনার কথামত আমি ফোনটা খুজে পেয়েছি। আমি…
আমি আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলাম কিন্তু তার আগেই কেউ আমার পেছন হেকে আমার মাথায় আঘাত করল। আমার সামনে সব কিছু ঝাপসা হয়ে এল!
আমি জ্ঞান হারানোর আগে নাজিয়ার চেহারাটা কেবল দেখতে পেলাম। আর কিছু আমার মনে নেই।

চার
এরপরে আসলে কী হয়েছে সেটা আমার ঠিক মনে নেই। আমার জ্ঞান ফেরে প্রায় দুইদিন পরে। পরে জেনেছি যে মাথায় আঘাতের পরেও আমার শরীরে এক ধরনের চেতনা নাশক ঔষধ দেওয়া হয়েছিল। পরে পুলিশ আমাকে উদ্ধার করে গাজিপুরের একটা ফার্ম হাউজ থেকে। আমার মাথায় আঘাতের সময়ে আমি সুমনের প্রেমিকা জেনির সাথে কথা বলছিলাম। এই কথা বলার ব্যাপারটাই আমার জীবন রক্ষা করে।
জেনি অবশ্য সেই সময়েই পুলিশে খবর দেয় নি। জেনির আসল লক্ষ্য ছিল যে আমাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয় সেটা দেখা। আগের লাশটা যেখানে পুতে রাখা হয়েছে পরেরটাও সেখানেই রাখা হবে এটা একটা স্বাভাবিক চিন্তা। তবে এর ভেতরে নাজিয়া আমাকে মেরে ফেলতে পারত। জেনির কাছে অবশ্য আমার মৃত্যুর থেকে সুমনকে খুজে পাওয়াটাই বেশি মুখ্য ছিল। অবশ্য পরে আমাকে জেনি বলেছিল যে সে ভেবেই নিয়েছে তখনই আমাকে মেরে ফেলা হয়েছে। আমাকে বাঁচানোর কোন সুযোগ নেই। তাই এই সুমনের লাশ খুজে পেতে চাইছিল।

নাজিয়া কিভাবে আমাকে গাড়িতে তুলেছে সেটা আমি জেনেছি পরে। ওর ম্যানেজার দিলিপ বড়ুয়া এই কাজে সাহায্য করেছে। সুমনের বেলাতেও ঠিক এই কাজই করেছিল সে। এবং পরে আরও জানতে পারলাম যে এই দিলিপ বড়ুয়ার বুদ্ধিতেই নাজিয়া আমার সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল।
জেনি ওদের গাড়ির পিছু নেয়। তারপর সেই গাজিপুরের ফার্ম হাউজে গিয়ে হাজির হয়। তারপর সে পুলিশে খবর দেয়। পুলিশ প্রথমে আমাকে উদ্ধার করে এবং পরে পেছনের বাগানের মাটি খুজে একটা পচে যাওয়া লাশ খুজে পায়।

পরিশিষ্টঃ
আমার সুস্থ হতে আরও কয়েকদিন সুযোগ লেগেছিল। জেনি এর ভেতরে কয়েকবার আমার সাথে এসে দেখা করে গেছে। আর এদিকে নাজিয়ার কেস চলছে। তবে জেনি আমাকে জানাল যে নাজিয়া সম্ভবত পার পেয়ে যেতা পারে। তার ক্ষমতাধর এক মামা আছে। সে সব দোষ ঐ ম্যানেজারের উপর দেওয়ার চেষ্টায় আছে। অবশ্য এমনটা হলে অবাক হব না।
আমি বাসায় জানিয়ে দিয়েছি যে সামনের আরও এক বছর যেন তারা বিয়ের নাম না নেয়। আবারও মেয়েদের উপর বিশ্বাস আনতে আমার কিছুটা সময় আগবে।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.3 / 5. Vote count: 22

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →