বর বদল

4.7
(77)

পিয়ন যখন নায়রার কার্ডটা আমাকে দেখালো আমি একটু অবাক হলাম । ডাক্তার নায়রা হাসান ! এমবিবিএস । যদিও ফেসবুক আর ইনস্টাগ্রামে ওর ছবি দেখি নিয়মিত । খুব শীঘ্রই বিয়ে হতে চলেছে ওর । এই সময়ে ও এখানে কেন ? এই সময়ে আমার সাথে দেখা করতে এসেছে ।

আমি পিয়নকে বললাম নায়রাকে কেবিনে নিয়ে আসার জন্য । মিনিট খানেক পরেই নায়রাকে কেবিনে ঢুকতে দেখলাম ।

আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো । আমার কেন জানি ওর হাসি দেখে বেশ ভাল লাগলো । নায়না মেয়েটাই এমন । ও যখন আশে পাশে থাকে তখন মন এমনি এমনিই ভাল হয়ে যায় । অনেক দিন পরে নায়রাকে দেখতে পেলাম । আগে একটা সময় ছিল যে প্রায় প্রতিদিনই নায়রার সাথে দেখা হত । নায়রা ক্লাস শেষ করে আসতো আমার অফিসে । পরে গল্প করতাম, এক সাথে ডিনার করতাম তারপর আরও অনেক কিছু ।

আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, হেই কি খবর ! অনেক দিন পরে দেখা হল !
-হুম ! প্রায় দুই বছর !
-হ্যা । ফেসবুকে ছবি দেখলাম । তোমার হবু বর চমৎকার দেখতে ।

কথাটা বলতেই দেখলাম নায়রার মুখ কেমন যেন কালো হয়ে গেল । আমার দিকে তাকিয়ে বলল, বিয়েটা ভেঙ্গে গেছে !
-কি !
-হ্যা ।
-কিভাবে ? কেন ?
-সেই ব্যাপারেই কথা বলতে এসেছি ।

আমি প্রথমে ঠিক বুঝতে পারলাম না । নায়রার বিয়ে ভেঙ্গে গেছে এবং নায়রা আমার সাথে কথা বলতে এসেছে । আমি সত্যি এর কোন অর্থ বুঝতে পারলাম না । আমি বললাম, আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না । তোমার বিয়ে ভেঙ্গেছে । আই এম সরি ফর দ্যাট । কিন্তু এর জন্য আমার সাথে কথা মানে …

নায়রা বলল, মানে হচ্ছে সায়েমকে কেউ আমাদের ভিডিও দেখিয়েছে ।
-আমাদের ভিডিও মানে ?
-আমাদের ভিডিও মানে বুঝতে পারছো না ?

নায়রার ইংঙ্গিতটা বুঝতে পেরে আমার চোখ বড় বড় হয়ে গেল । প্রথম কিছু সময় লাগলো আমার কথাটা হজম করতে । নায়রা বলছে কি ! কি সর্বনাশের কথা ! আমি কোন মতে বললাম, কি বলছো এসব ?
-হ্যা । সায়েমকে কেউ আমাদের ভিডিও দেখিয়েছে । তোমার চেহারা দেখা যাচ্ছে না সেখানে কিন্তু আমার চেহারা দেখা যাচ্ছে । আর তুমি তো জানো আমি কেমন শব্দ করতাম । যারা চেনে আমাকে তারা চিনে ফেলবে !!
আমি বললাম, এবং তুমি মনে কর কাজটা আমি করেছি?
-নয়তো আর ক?
-তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে ! আমি কেন করবো কাজটা শুনি? আমার কি স্বার্থ ? তোমার কি মনে নেই যে আমাদের সব কিছু কিভাবে শুরু হয়েছিলো আর শেষ কিভাবে হয়েছিলো । তখনই তো আমি তোমাকে ঠেকাতে পারতাম ।
-জানি না আমি কিছু । আমি কিছু জানি না । কিছু ভাবতে পারছি না আমি !
-বিশ্বাস কর আমি কিছু করি নি । আমি কোন দিন ভিডিও করি নি । বিশ্বাস কর ।

নায়রা আমার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে রইলো । বোঝার চেষ্টা করলো যে আমি মিথ্যা বলছি কি না । একটা সময়ে মনে হল যেন ও আমাকে বিশ্বাস করেছে । আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তাহলে কে করলো কাজটা ! সায়েমের সাথে বিয়ে ভেঙ্গেছে বুঝলাম । গেল সেটা । কিন্তু নতুন কারো সাথে বিয়ে ঠিক হলে সেটাও যে ভাঙ্গবে না সেটার নিশ্চয়তা কি !
-বিশ্বাস কর আমার কাছে কোন ভিডিও নেই । মানে ঐ রকম কিছু নেই । তোমার কিছু ছবি এখনও আছে । তবে ভিডিও নেই ।
-বাবা খুব আপসেট হয়ে গেছেন ।

আমি কি বলবো বুঝতে পারলাম না । মেয়ের ভিডিও বের হয়েছে এবং সেটা তার হবু বরকে পাঠানো হয়েছে এই খবর যে কোন বাবাই আপসেট হবে । কিন্তু এখানে আমার কি করার আছে । হ্যা এটা সত্য এই ঘটনার সাথে আমি জড়িতো যে কোন ভাবে কিন্তু আমার তো কোন দোষ নেই ।

নায়রা চলে গেল । তবে বলে গেল যে একটা কিছ ভাবতে হবে আমাদের । এই সমস্যা থেকে বের হতে হবে । সেটা তো হবেই ।

বাসায় ফিরে ল্যাপটপ বের করলাম । নায়রার বেশ কিছু ছবি আমার কাছে রয়েছে । নানান ধরনের ছবি । ছবি গুলো দেখতে শুরু করলাম একের পর এক । হঠাৎই একটা ছবিতে এসে আটকে গেলাম । ছবিতে নায়রা ঘুমন্ত অবস্থায় রয়েছে । বিছানার উপুর হয়ে শুরু আছে । আমি পাশেই শুয়ে ছিলাম । চুপ গুলো পিঠের উপরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এক চোখ ঢেকে আছে চুলে । নায়রার শরীরে কিছু নেই । সকালের আলো এসে পড়েছে ওর শরীরে । আমি তখন তুলেছিলাম ছবিটা ।

আমার একে একে সব কিছু মনে পড়তে লাগলো । নায়রার সাথে আমার সম্পর্ক প্রায় তিন বছরের মত ছিল । আমি কি ওর প্রেমিক ছিলাম ? কি জানি ! তবে আমাদের মাঝে কিছু একটা ছিল । একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে প্রথম দেখা । তারপর বন্ধুত্ব । একসময় আমরা খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলাম । আমাদের মধ্যে সপ্তাহে প্রায় প্রতিদিনই দেখা হত । আর এমনও আছে যে কোন কোন সপ্তাহে প্রতিটি দিনই আমরা রাতে এক সাথে থাকতাম । একে অন্যের সঙ্গ ভাল লাগতো আমাদের খুব । আমি তখন সবে চাকরিতে ঢুকেছি । নিজের বাসা নিয়ে থাকি অন্য দিকে নায়রা মেডিকেলের থার্ড ইয়ার । ঢাকায় বাসা হওয়ার স্বস্ত্বেও হলে থাকতো । তাই খুব একটা সমস্যা হত না আমার বাসায় আসতে । আমাদের মাঝে কথাই ছিল যে কোন কমিটমেন্ট থাকবে না । যখন মনে হবে যে আর দুজন দুজনকে ভাললাগছে না তখন আলাদা হয়ে যাবো । আর ও জানতো যে ডাক্তারের সাথেই ওকে বিয়ে করতে হবে ।

কিন্তু আমাদের ভিডিও করলো কে ? এটাই তো আমি ঠিক বুঝতে পারছি না । সত্যি বলতে কি ওর সাথে যা কিছু হয়েছে সব হয়েছে আমার বাসাতেই । কখনও বেড রুম কখন ড্রয়িং রুম কিংবা ডাইনিং । বাথরুমে গোসলের সময়েও কয়েকবার আমাদের মাসে ইন্টারকোর্স হয়েছে । কখনই আমরা হোটেলে যাই নি । কয়েকবার অবশ্য নায়রাদের বাসাতেও গিয়েছি আমি যখন ওর বাবা মা থাকতো না । আমি কোন দিন ভিডিও করি নি । তাহলে ভিডিওটা করলো কে ? কিভাবে ? আমি এই প্রশ্নটার উত্তর খুজে পেলাম না ।

পরদিন অফিস শেষ করে বের হতেই দেখি নায়রা অফিসের সামনে দাড়িয়ে রয়েছে । আমাকে বের হতে দেখে এগিয়ে এল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কালকে বাবা খুব বেশি রাগারাগি করেছে।
-তারপর ?
-বলেছে বাসা থেকে বের হয়ে যেতে । আমার মুখ তিনি দেখতে চান না
-এখন?
-জানি না কি করবো !
আমি একটু ইতস্তঃ করে বললাম, আমার বাসায় যাবে? মানে যদি রাতে কোথাও যেতে না চাও !
-চল । আসলে এই জন্যই এসেছিলাম । মনে হচ্ছে বাসায় যাওয়া হবে না আর ।
-আচ্ছা বাসায় চল । তারপর দেখা যাক কি করা যায় ।

নায়রাকে বাসায় এনে নিজেই কফি বানিয়ে দিলাম ওকে । ঠিক আগে যেমন করে আমরা ব্যালকুনীতে বসে কফি খেতাম, বিকেলে গল্প করতাম সেই ভাবে গল্প করলাম । বললাম, ভিডিওটা কি বাইরে এসেছে ? আইমিন কোন সাইটে আপলোড হয়েছে?
-না ! সায়েম আমাকে দেখালো ভিডিও টা ।
-তারপর নিজেই ডিলিট করে দিল । বলল যে নামায় নি । এও বলল এটা দেখার পরে ওর পক্ষে আমাকে বিয়ে করা সম্ভব না । ওকে দোষ দেই না আমি ।
-তাহলে কি কেবল বিয়ে ভাঙ্গাই লক্ষ্য ছিল ।
-তাই তো মনে হচ্ছে ।
-তার মানে আবার বিয়ে ঠিক হলে আবারও ভিডিও পাঠাবে।
-হুম !

একটু চিন্তার ব্যাপার । আমি ওর মনযোগ অন্য দিকে নেওয়ার জন্য কথা বার্তা অন্য দিকে নিয়ে গেলাম । নানান কথা শুরু করলাম । একটা সময়ে খেয়াল করলাম যে গল্পের ভেতরে আমি নিজেও ঢুকে গেছি । ওর সাথে কথা বলতে ভাল লাগছে । কেন জানি মন ভাল হয়ে গেল অনেক । এমন কি দেখলাম নায়রার মনও ভাল হয়ে গেছে ।

এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠলো । আমি উঠে গিয়ে দরজা খুলতে দেখি এক মাঝ বয়সী ভদ্রলোক দাড়িয়ে । লোকটাকে কেমন যেন চেনা চেনা মনে হল । পরিচিত চেহারা । ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে বলল, নায়রা কোথায়?
সাথে সাথেই বুঝে গেলাম ইনি কে । নায়রার বাবা । চেহারা দেখেছি নায়রাদের দেওয়ালে, ছবিতে । সরাসরি কোন দিন দেখা হয় নি ।
পেছন থেকে নায়রার আওয়াজ পেলাম ।
-বাবা। তুমি এখানে?

নায়রার বাবা দেখলাম ঘরের ভেতরে ঢুকলো । তারপর আমার কলার চেপে ধরলো । এ
এই সেই শয়তান টা ! তুই পাঠিয়েছি ভিডিও ! বল !

আমি যে কি বলবো বুঝতেই পারলাম না । আমি যতই বলি না কেন যে আমি পাঠাই নি নায়রার বাবা বিশ্বাস করবে বলে মনে হয় না । তবে আমাকে কিছু বলতে হল না । দেখলাম নায়রা এগিয়ে এসে ওর বাবাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে । বলল, বাবা ওকে ছেড়ে দাও ।
-এটাকে আমি ছাড়বো না । এটাকে আমি পুলিশে দেব । এতো সাহস ওর !
-বাবা প্লিজ ছেড়ে দাও ।
-না ছাড়বো না । পুলিশে ফোন দিচ্ছি আমি এখনই ।
-বাবা প্লিজ ছেড়ে দাও ওকে । ও কিছু করে নি ।
-তুই কিভাবে জানিস ও করে নি ?
-কারণ ভিডিওটা আমি পাঠিয়েছি !

ঘরের ভেতরে যেন বোমা ফাঁটলো ! নায়রার বাবা তো অবাক হলেনই আমিও অবাক হয়ে গেলাম । এই মেয়ে বলে কি !!

নায়রার বাবা চলে গেলেন কিছু সময় পরে । নায়রা রয়ে গেল । আমি ওর বাবাকে বললাম যে আমি নায়রাকে বাসায় দিয়ে আসবো । কিছু সময় পরে আমি জানতে চাইলাম, এমন কাজ কেন করলে শুনি ?
-জানি না ।
-তুমি ভিডিও করেছিলে?
নায়রা হেসে ফেলল । বলল, হ্যা করেছিলাম । একবার না বেশ কয়েকবার ।
-সব গুলো এখনও রেখে দিয়েছো।
-হুম !
-বিয়ে কেন ভাঙ্গলে? তুমিই না বলেছিলো একজন ডাক্তার ছেলেকেই বিয়ে করবে। যতদুর জানি সায়েম সাহেব একদম তোমার চাহিদা অনুযায়ী একজন মানুস । ডাক্তার সরকারি চাকরি । সব কিছু রয়েছে ।
নায়রা কিছু সময় চুপ করে রইলো । তারপর বলল, আমিও তাই ভাবতাম । কিন্তু তারপর যখন সায়েমের সাথে মিশলাম বুঝতে পারলাম যে আমি হ্যাপি না । আমার কেবল তোমার আমার এক সাথে কাটানো সময় গুলোর কথা মনে পড়তো । কিছুতেই মাথা থেকে বের করতে পারতাম না এসব ! কিন্তু ঐদিকে আবার মাথা থেকে ঐ একটা শান্ত সুনিশ্চিত জীবনের কথাটাও বের করতে পারতাম না । কিন্তু যতই বিয়ের ডেট এগিয়ে আসতে লাগলো বুঝতে পারলাম না ঐ জীবন থেকে এই জীবনটাকে আমি মিস করছি বেশি । এবং কিছুতেই মন থেকে বের করতে পারছি না । যখন সিদ্ধান্ত নিলাম যে বিয়ে করবো না সায়েম কে তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে । ডেট পরে গেছে কার্ড ছেপে গেছে এমন কি কমিউনিটি হল ভাড়া নেওয়া হয়ে গেছে । শেষে এই বুদ্ধি বের করলাম ।

আমি কি বলবো খুজে পেলাম না । কেবল তাকিয়ে রইলাম নায়রার দিকে । তারপর বলল, তো এখন কি করবে ?
-জানি না কি করবো ! তোমাকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছি না আমি । বলছি না বিয়ে করতেই হবে । আমি জানি তুমি বিয়ের মত একটা ঝামেলা কাধে নিতে চাও না । স্বাধীন থাকতে চাও । তবে আমি চাই তোমার সাথে সময় কাটাতে …. আগের মত …..
-আগের মত? তোমার পরিবার?
-জানি না কিছু । এতো কিছু ভাবতে ভাল লাগছে না । আমি কেবল আমি কি চাই সেটা করলাম ! আর কিছু না !

কেন জানি নায়রাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করলো । এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম । তারপর ওর কপালে একটা ছোট্ট চুমু খেয়ে বললাম, কমিউনিটি হল যে ভাড়া করেছিলে সেটা কি ক্যান্সেল করে দিয়েছে তোমার বাবা ?
নায়রা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, জানি না তো না । বাবা জানে । কেন জানতে চাইছো?
-তোমার বাবাকে বল ক্যান্সেল না করতে । আর বিয়েট ডেট টাও একই থাকুক । কেবল বরের নামটা চেঞ্জ করে দিতে বল।
-তুমি নিশ্চিত ?
-হ্যা । বিয়ে ব্যাপারটা পছন্দ না হলেও তুমি তো পছন্দ । আর মুখে যতই স্বীকার না করি তোমার বিয়ে ভাঙ্গার পরে আমার সত্যিই ভাল লাগছিলো ।

তারপরই আর কি! নায়রার সাথে ঐ দিনই বিয়ে হয়ে গেল । একই কমিউনিটি সেন্টারে । অনেকে আমাকে ডাক্তার ভেবে ভুল করছিলো । বর যে বদলে গেছে অনেকে জানতেই পারলো না ।

গল্প টি হিন্দি সিনেমা লুডুর কাহিনী থেকে অনুপ্রাণিত

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.7 / 5. Vote count: 77

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

One Comment on “বর বদল”

Comments are closed.