বছরের এই সময়টাতে সেন্ট মার্টিনের সমুদ্রের তীরে বেশ খানিকটা ভীড় থাকে । তবে বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারনে এখন এখানে ভীড় একটু কমই বলা চলা । তার উপর এই সকাল বেলা সমুদ্র তিরে লোকজন দেখা যায় না বললেই চলে ।
রাত্রীরও এখন এখানে থাকার কথা না । তার এখন নিজের বিছানায় ঘুমানোর কথা । কিন্তু সে এখানে, এই সমুদ্র পাড়ে দাড়িয়ে আছে। সে দাড়িয়ে আছে চুপচাপ।
সকালের সমুদ্রের বাতাসের ভিতরে একটা মন খারাপ করে দেওয়া ব্যাপার থাকে । রাত্রীরও মন খারাপ লাগছে তবে তার মন খারাপের কারন সকালেই সামুদ্রিক বাতাস নয়, বেশ খানিকটা দুরে সমুদ্রের দিকে মুখ করে দাড়িয়ে থাকা এক যুবক । যদিও তার মুখটা দেখে যাচ্ছে না তবুও রাত্রী জানে ঠিক তার মত করেই যুবক মন খারাপ করে বিষন্ন মুখে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে । হয়তো প্রতিদিনই দাড়িয়ে থাকে।
-আফা।
রাত্রী ফিলে তাকালো। লজের ছেলেটা এক হাতে এক গাছি ডাব নিয়ে তার সামনে দাড়িয়ে আছে হাসি মুখ। অন্য হাতে চকচক করে একটা দা।
ছেলেটার বলল
-আফা ডাব আনছি।
-আচ্ছা।
গত কাল রাতে রাত্রীকে একে সকাল বেলা ডাব আনতে বলেছিল । সকাল বেলা নাকি ডাব খেলে সারাদিন পেট আর কোন প্রকার সমস্যা হয় না। রাত্রীর এখানে আসার পরে একটু সমস্যা হচ্ছে এখানকার খাবারে। তাই ডাব আনার কথা বলেছিল ভুলু নামের এই ছেলেটাকে।
-এই খানেই কাইট্টা দিমু ?
-দাও।
দাও বলে আবারও সে সামনে দিকে ফিরে চাইলো । যুবক এখনও সমুদ্রের দিকেই তাকিয়ে আছে । এক ভাবে । কি দেখছে কে জানে ?
কি খুজছে সেখানে ?
রাত্রীর বড় জানতে ইচ্ছে হল।
-আফা নেন।
-ভুলু।
-জি আফা।
-ঐ লোকটা কে চেনো তুমি ?
হাত দিয়ে সমুদ্রের পাড়ে দাড়ানো যুবককে দেখালো রাত্রী।
ভুলু কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে দেখলো তাকে । তারপরেই তার মুখে একটা হাসি দেখা দিল।
-চিনমু না ক্যান ? হেতি আমাদির মাস্তার সাব। আমার ছোট বোইন ঐ ইস্কুলে পড়ে। খুব ভালা মানুষ।
-তাই ? কি নাম জানো ?
কিছু যেন মনে করার চেষ্টা করলো। তারপর বলল
-তা আফা। নাম জানি না। কেউ তারে নাম ধরে ডাকে না। মাস্টর ভাই বইলা ডাকে।
-আচ্ছা।
-আপনে কইলে তার নাম জাইনা আইতে পারি।
-না থাক । লাগবে না । উনি কেমন মানুষ ?
-খুব ভাল মানুষ। তবে একটু পাগলা কিসিমের।
-কেমন ?
-না দেখেন কত পড়া লেখা জানা মানুষ কিন্তু এইখানে পইড়া আছে । সারা দিন একা একা থাকে । সমুদ্রের পাড়ে একলা একলা হাটে।
-হয়তো সমুদ্র অনেক ভালবাসে।
-হেইডা হইলেও তো তো হইতো। তয় উনি সমুদুরে ডরায় ?
-কেন ? কিভাবে বুঝলে ?
-হে আজ পর্যন্ত একটা দিনেও পানিতে নামে নাই। পায়ে সমুদুরের পানিও লাগায় না।
কথাটা শুনে রাত্রীর মন টা আরও একটু বেশি খারাপ হয়ে গেল। কারণটা তার জানা। আশ্চর্য মানুষ কত দিন হয়ে গেল তবুও….
-আচ্ছা। তুমি যাও। লজে গিয়ে গিয়ে টাকা নিও । কেমন ?
-কুনো সমস্যা নাই আফা। আপনে যখন ইচ্ছা তখন টেকা দিয়েন। গরীবের টেকা আপনে মাইরা যাইবেন না।
ডাবটা হাতে নিয়ে রাত্রী আরও কিছুটা সময় যুবকের দিকে তাকিয়ে রইলো। মনটা যেন আরও একটু খারাপ হল তার।
দুই
-তাই তো বলি এতো সুন্দর মেয়ের এখনও বিয়ে হয় নি কেন ?
রহিমা আফরোজ আরও কিছুটা সময় রাগ গজগজ করতে থাকলো। এই নিয়ে সে কথাটা তিন বার বলল । খাবার টেবিলে কেউ কোন কথা বলছে না দেখে যেন আরও একটু বেশি রেগে গেল।
শাফায়েত চুপচাপ খাচ্ছিল। মায়ের কথাটা শুনে বলল
-মা থাক না। যা হওয়ার হয়েছে।
রহিমা আফরোজ আবার বলল
-যা হওয়ার হয়েছে মানে ? আরেকটু হলে আমাদের কত বড় ক্ষতি হয়ে যেত। ঐ মেয়ে আমাদের ঘরে এল আমরা কোথাও মুখ দেখাতে পারতাম?
-মা। থাক না। আর যা হয়েছে সেখানে মেয়েটার তো দোষ নেই।
-দোষ নেই? দোষ না থাকলে এমনিই হল? দুনিয়ার মানুষের সাথে তো হয় না। আর তার উপর উনারা আমাদের কাছে এইটা লুকালো কেন ? কেন ? যদি মেয়ে দোষীই না হবে তাহলে কেন লুকাবে?
শাফায়েত আর খেতে পারলো না। কেন জানি মায়ের মুখের কথাগুলো তার বুকে বাঁধছে। খাওয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। ছেলেকে আধ পেট খেয়ে উঠতে দেখতে রহিমা আফরোজ বলল
-কি হল ?
-খাওয়া শেষ মা।
রহিমা আফরোজ কিছু বুঝতে পারল না । তার চিরদিনের বাধ্য ছেলের আচরন তার কাছে কেমন যেন অচেনা মনে হতে লাগলো। এমন তো হওয়ার কথা না।
তিন
রাত্রী আরও কিছুটা সময় যুবকের দিকে তাকিয়ে রইলো। কত দিন তার সাথে দেখা হয় নি, অথচ মনে হচ্ছে যেন গত কালই তার সাথে কথা হয়েছে । হয়তো কারণটা এই যে সারাটা সময় যুবক রাত্রীর মনের ভেতরেই ছিল।
প্রতিদিন ঘুমানোর সময় রাত্রীর আর কিছু মনে পড়ুক না পড়ুক যুবকের কথা ঠিকই মনে পড়তো। আচ্ছা যুবকও কি তার কথা মনে করেই ঘুমাতে যেত। এখনও কি তার কথা মনে করে ? রাতে চোখ বোজার আগে তাকে নিয়ে ভাবে ?
ভাবে নিশ্চই! একবার কে যেন বলেছিল কোথায় পড়েছিল যে তুমি রাতে যার কথা মনে করে ঘুমাতে যাবে মনে রেখো সেই মানুষটিরও তোমার কথা ভেবেই ঘুমাতে যায়।
আরও কত কথা মনে আসছে এখন। রাত্রীর আরও নতুন করে কিছু ভাবার যুবক পেছন ফিরে এদিকে হাটা শুরু করলো ।
মুখটা সেই বিষন্ন। দেখলেই বোঝা যায়। অনেক দিন ছেলেটা প্রান খুলে হাসে না। মাথা নিচু করে হাটছে । অন্য কোন দিকে তাকাচ্ছে না। ইস! চেহারা কি হাল করেছে!
রাত্রীর একবার মনে হল যুবকের সমানে গিয়ে ওকে চমকে দেয় । নিশ্চয়ই যুবক ওকে এখানে আশা করে নি । সামনে গিয়ে দাড়ালে নিশ্চই খুব অবাক হবে!
খুশি হবে কি ?
নাকি মনটা আরও বেশি খারাপ হবে তার ?
শেষবার যখন তার সাথে রাত্রীর দেখা হয়েছিল রাত্রী যুবককে চড় মেয়েছিল। চড় খেয়ে কিছুটা সময় কোন কথা বলতে পারে নি সে । অফিসের ওয়েটিং রুমে তখন কেউ ছিল না তবুও তার চড়ের আওয়াজ বাইরের অনেকেই শুনতে পেয়েছিল। গার্ড ছুটে এসেছিল দরজা ঠেলে। যুবক কেবল অবাক হয়ে ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল। তারপর মাথা নিচু করে দরজা ঠেলে বেরিয়ে গিয়েছিল।
সেই সব কথা কি যুবকের মনে আছে ?
আছে তো অবশ্যই। না থেকে কি উপায় আছে?
চার
শাফায়েত অনেক সময় ধরে ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করছে । কেন সে এখানে এসেছে তার কাছে ঠিক পরিস্কার নয় । একবার কেবল মনে হয়েছে মেয়েটার সাথে তার দেখা করা দরকার । আরকবার মনে হয়েছে এভাবে অন্যার ভাবে বিয়েটা ভেঙ্গে দেওয়া তার পরিবারের কিছুতেই উচিৎ হয় নি । যেখানে দোষটা কিছুতেই মেয়াটর নিজের নয়।
তাহলে ? অপরাধ বোধ থেকে এখানে আসা ?
শাফায়েত নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারবে না। তার কেবল মনে হয়েছে মেয়েটার সাথে একবার দেখা করলে হয়তো তার ভাল লাগবে। কেন ভাল লাগবে সেই প্রশ্নের উত্তর তার জানা নেই । হয়তো সেটা জানার জন্যই এখানে আসা।
রাত্রী এল আর আধা ঘন্টা পরে । এতোক্ষণ ইচ্ছে করেই সে শাফায়েতের সাথে দেখা করে নি। ভেবেছিল বেশিক্ষণ অপেক্ষা করিয়ে রাখলে হয়তো একটা সময় চলে যাবে । কিন্তু যখন দেখলো শাফায়েত যাচ্ছে না তখন বাধ্য হয়ে ওয়েটিং রুমে এসে হাজির হল।
ওকে দেখে একটু উঠে দাড়িয়ে আবার বসে পড়লো। মুখে একটা বিষন্ন হাসি।
-আপনি ?
রাত্রীর ইচ্ছে ছিল যে খনিকটা রুক্ষ ব্যবহার করবে । কিন্তু ছেলেটার চেহারার দিকে তাকিয়ে কেন জানি একটু নমনীয় হয়ে এল। আবার বলল
-আপনি এখানে ?
-না মানে এখানে দিয়ে যাচ্ছিলাম । মনে হল আপনার সাথে দেখা করে যাই।
-কেন ? হঠাৎ আমার সাথে দেখা করতে ইচ্ছে হল কেন ?
রাত্রী ভেবেছিল শাফায়েত কথাটার জবাব দিতে পারবে না। কিন্তু শাফায়েত বলল
-জানি না। কেবল মনে হল আপনার সাথে দেখা করে যাই। গেলে হয়তো আমার ভাল লাগবে। আর আপনাকে জানানো প্রয়োজন কে সিদ্ধান্তটা আমার নয়। আমার পরিবারের। বিশেষ করে মায়ের।
-ডাজ ইট মেক এনি ডিফরেন্স ?
-হয়তো।
-শাফায়েত সাহেব। আমার এসবে অভ্যেস আছে। তবে মাঝে মাঝে কি ভাবি জানেন ?
-কি ?
-ভাবি যে কোন মানুষগুলো বেশি খারাপ ? আমাকে সেদিন ধরে নিয়ে যাওয়া ঐ চার জন মানুষ নাকি আপনাদের মত কোর্টটাই পরা মানুষগুলো যারা ভাবে যে আসলে দোষ মনে হয় আমারই।
-আমি ভাবি না।
রাত্রী হঠাৎ করেই হেসে উঠলো। বেশ জোরেই হাসলো যে শাফায়েত একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল। রাত্রী বলল
-শাফায়েত সাহেব, বাসায় যান। আমার এখানে কাজ আছে।
-আচ্ছা।
শাফায়েত উঠে দাড়ালো। দরজার কাছে গিয়ে ফিরে এল আবার।
-কিছু বলবেন ?
-না মানে, আমি যদি মাঝে মাঝে আপনার এখানে আসি আপনি কি বিরক্ত হবেন ?
রাত্রী কিছু সময় কোন কথা বলল না। তারপর বলল
-না । কিছু মনে করবো না।
-থেঙ্কুিউ।
পাঁচ
শাফায়েতের কেবল একবার চোখে চোখ পড়ছে । নিজের ভেতর একটা ধাক্কার মত খেল । মেয়েটা কেমন বড় বড় চোখ ওর দিকে তাকিয়ে আছে। আসে পাশে বাবা মা বড় মামা রয়েছে । সবাই খুব খুশি খুশি মুখে কথা বলছে । মেয়েকে টুকটাক কথা জিজ্ঞেস করছে । কেবল শাফায়েত নিজের ভেতর কেমন অস্বস্থি বোধ করছে । বারবার মেয়েটার দিকে তাকাতে ইচ্ছে করছে । কিন্তু বড়রা থাকার কারনে তাকাতে পারছে না । একটা লজ্জা কাজ কাজ করছে ওর ভেতরে।
রহিমা আফরোজ একটা মিষ্টি মুখে নিতে নিতে বলল
-দেখুন ভাই সাহেব, আমার এমনিতেই মিষ্টি খাওয়া নিষেধ কিন্তু রাত্রী মা-মানি দেখে একটা মিষ্টি মুখে নিয়ে নিলাম। এতো মিষ্টি চেহারার সামনে একটা মিষ্টি খাওয়াই যায়।
শাফায়েত মায়ের কথা শুনে বেশ অবাক হল । সারা জীবন সে মায়ের কড়া শাসনে বড় হয়েছে । তার মা যে এমন কথা বলতে পারে এটা শাফায়েত ভাবে নি । সব কিছু হচ্ছে মেয়েটার কারণে।
কি নাম যেন ?
রাত্রী।
রাত মানে তো অন্ধকার। না। এই মেয়ে কিছুতেই অন্ধকার হতে পারে না । বরং এই মেয়ের কাছে সব অন্ধকার দুর হয়ে যাবে। সব অন্ধকার দুর করে আলো বয়ে নিয়ে আসবে।
শাফায়েত ভেবেছিল তাদেরকে একা কথা বলতে দেবে । এখন তো মেয়েকে দেখতে গেলেই সবাই এটা করে । যখন কথা বলতে দেবে তখন মেয়েটাকে আরও ভাল করে দেখা যাবে।
কিন্তু সেদিক দিয়ে কেউ গেল না । এমন কি কেউ কিছু বলল না। যখন বাইরে বের হয়ে এল, বার কয়েক পিছনে ফিরে তাকিয়েও মেয়েটির দেখা পেল না সে। একটু যেন হতাশ হল মনে মনে । শাফায়েত তখন জানে না দোতালার এক কোনা থেকে রাত্রী তার দিকে তাকিয়ে আছে । নিজের মনেই একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল সে । সে খুব ভাল করেই জানে এখানে তার বিয়ে হবে না। কোন না কোন ভাবে সব কিছু তাদের কানে যাবে। রাত্রীর ছেলেটাকে বেশ পছন্দ হয়েছিল । বিশেষ করে লাজুক লাজুক চেহারা তার বেশ ভাল লেগেছিল।
ছয়
-আপনার বাসায় জানে আপনি এখানে আসেন ?
-নাহ।
-তাহলে ? যখন জানবে তখন ?
-জানি না।
ওরা দুজন একটা রিক্সা করে নিউমার্কেটের দিকে যাচ্ছে । সেদিন পর প্রায় মাসখানেক কেটে গেছে । শাফায়েত প্রায় প্রতিদিনই রাত্রীর অফিসে এসে হাজির হয়েছে । ওর সাথে টুকটাক কথা বলতে । কোন কোন সময় কেবল চুপ করে তাকিয়ে থেকেছে । রাত্রী কেবল অবাক হয়ে দেখেছে এই ছেলে তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে । ছেলেটার প্রেমে পরেছে, নয়তো কোন কারণে কিছুতেই তাকে মন থেকে বের করতে পারছে না ।
অন্য দিকে তার জীবনে তার বাবা মা আবার খুব গুরুত্বপূর্ন একটা অংশ । তাই তাদের উপেক্ষা করে কিছু বলতেও পারছে না ।
-এখানে এভাবে আপনার আমার সাথে ঘোরাঘুরি টা ঠিক হচ্ছে না।
-কেন ?
-কেন আপনি বুঝতে পারছেন না ?
-আমি বুঝতে চাচ্ছি না।
-দেখুন আপনি বাচ্চা না। বাচ্চাদের মত কথা বলাটা ঠিক না।
শাফায়েত কিছুটা সময় রাত্রীর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল
-তাহলে আপনি কী করছেন ? আপনিও তো আমার সাথে রিক্সায় ঘুরছেন ?
রাত্রী কোন জবাব দিতে পারলো না। দুজনেই কিছু সময় কোন কথা বলল না । চাুপচাপ রিক্সা এগিয়ে চলল ।
শাফায়েত বলল
-আপনি সমুদ্র ভালবাসেন ?
-হঠাৎ ? এই কথা কেন ?
-পছন্দ করেন কি না বলেন ?
-হ্যা। সবাই পছন্দ করে।
-আমি আগে পছন্দ করতাম না। একবার কলেজ ক্যাম্পাস থেকে কক্সবাজার বেড়াতে গেলাম। সমুদ্রের পানিতে গোসল করে কঠিন জ্বর বেঁধে গেল । তারপর থেকে সমুদ্র একেবারে পছন্দ না । কিন্তু…..
-কিন্তু ?
-কিন্তু কদিন থেকে একটা স্বপ্ন প্রায়ই দেখছি। আমি সমুদ্রের পাড়ে হাটছি একটা মেয়ের হাত ধরে। আমার প্যান্ট গুটানো। মেয়েটারও। মেয়েটা বারবার আমাকে বলছে এই তোমার ঠান্ডা লাগবে। উঠে পড়। এখনই উঠে পড় বলছি।
কিন্তু আমি উঠছি না। মেয়েটির হাত ধরে বলছি তোমার হাত ধরে হাটার জন্য আমার নিউমোনিয়া হয়, আমি যদি মারাও যাই তাতেও আমার কোন দুঃখ নেই।
এই টুকু বলে শাফায়েত চুপ করে রইলো কিছু টা সময়। দম নিয়ে আবার বলল
-তারপর থেকে আমি সারাদিন সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকি।
-কিভাবে ?
-ভিডিও দেখি টিভিতে পিসিতে। কি যে অদ্ভুত সুন্দর লাগে।
কথা বলতে বলতে শাফায়েত যেন সেই সমুদ্র দেখতে পাচ্ছে এমন একটা ভাব করলো।
রাত্রী আবার নিজের মনে একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল । তারপর বলল
-কবে থেকে এই স্বপ্নটা দেখা শুরু করেছেন ? আমাকে দেখতে যাওয়ার পর থেকে ?
-হুম।
-মেয়েটা কি আমি ?
-হুম।
-আপনার এই স্বপ্নটা যে কোন দিন পূরন হবে না আপনি জানেন না ?
এবার শাফায়েত দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল
-হুম। জানি।
আবার কেউ কোন কথা খুজে পেল না । দীর্ঘক্ষণ কেবল নিরবতা । দুজনের কেউ লক্ষ্য করলো না রহিমা আফরোজ তাদের এক সাথে রিক্সায় ওঠাটা নিউমার্কেটের তিন তলার উপর থেকে লক্ষ্য করছেন ।
সাত
-আপনি আর আসবেন না এখানে ?
-কিন্তু ?
-কোন কিন্তু না। আপনারা মা ছেলে মিলে পেয়েছেন কি আমাকে ? একজন এসে আমাকে অপমান করে যাবেন আরেকজন এসে ভালবাসা দেখাবেন। আমি আর নিতে পারছি না।
রাত্রী নিজেকে ঠিক মত নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না । দুপুরবেলা রহিমা আফরোজের কথাগুলো কানে বাজছে । নিজেকে এতো ছোট তার এর আগে কোন দিন মনে হয় নি।
-রাত্রী শুনো। একটু শোনো।
এই বলে শাফায়েত রাত্রী হাত ধরতে গেল।
-ছাড়ুন আমাকে ?
-প্লিজ শোন।
শাফায়েত আরও শক্ত করে রাত্রীকে ধরার চেষ্টা করলো। রাত্রীর যেন রাগটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল। সে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সোজা শাফায়েতের গালে চড় বসিয়ে দিল। এতো জোরে যেন বাইরে থেকে গার্ড ছুটে এল। কিছু হয়েছে কি না এইটা দেখার জন্য।
শাফায়েত কিছুক্ষণ কোন কথাই বলতে পারলো না। রাত্রীও কিছুটা বিহব্বল হয়ে গেল। সে নিজেও ভাবে নি যে এমন কিছু সে করে বসবে!
বাসায় এসে সাফায়েত জীবনের প্রথম বারের মত মায়ের খুব চিৎকার চেঁচামিচি করলো। টেবিলের উপরে রাখা কাঁচের থালা বাসন ভাঙ্গলো । সব থেকে বড় কাজটা করলো রাতের বেলা । যত ঘুমের ঔষধ ছিল সবগুলো একেবারে খেয়ে ফেলল ।
হাসপাতালে নিয়ে যমে মানুষে টানার মত অবস্থা। যখন আর দুদিন পরে যখন চোখ মেলে তাকালো প্রথমে রাত্রীকে খুজলো তার চোখ দুটো। কিন্তু সবাই সেখানে থাকলেও রাত্রী ছিল না । নিদারুণ এক অভিমান জমা হল রাত্রীর জন্য। মেয়েটা একটা বারও ওকে দেখতে এল না। সামনে থাকা অন্য কাউকে যেন তার চোখেই পড়লো না।
তারপর শাফায়েতের জীবনটাই যেন বদলে গেল কেমন করে । সুস্থ হয়ে চাকরি ছেলে দিল। সব কিছু ছেড়ে দিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরি করতে করতে এসে হাজির হল সেন্ট মার্টিনে। মনে হল এখানে লম্বা সময়ে কাটিয়ে দেওয়া যায়।
আট
প্রতিদিনের মত আজকেও শাফায়েতের সকালের সমুদ্র দর্শণ শেষ হল সে সব সময় মাথা নিচু করে হাটে । চারিপাশে এতো কিছু দেখার আছে তবুও যেন তার কিছু দেখতে ইচ্ছে করে না ।
অনেক টাই হাপিয়ে উঠেছে সে । নতুন কোন জায়গায় যাওয়ার সময় হয়েছে তার । আর এখানে থাকতে ভাল লাগছে না । তবে শাফায়েত ঠিক জানে না আর কোথায় গেলে তার ভাল লাগবে কোনথায় গেলে তার মন বসবে।
এমন কোন জায়গা কি আছে ?
-এই যে সাহেব ?
হঠাৎ একটা বড় ধরনের অনুভুতি যেন শাফায়েতের বুকের ভেতর দিয়ে ঢুকে বেরিয়ে গেল । এতো বড় ধা্ক্কা সে অনেক দিন খায় নি। নিচু মাথা উপরে তুলে সামনে তাকিয়ে দেখে ডাব হাতে রাত্রী তার সামনে দাড়িয়ে আছে ।
শরীরটা যেন একটু অবশ হয়ে এল । মনে হল ঠিক মত দেখছে না সে । নিশ্চয়ই ভুল দেখছে। এখানে তার কোন ভাবেই আশা সম্ভব না।
কোন ভাবেই না।
কোন মতে কেবল বলল
-আপনি ?
-যাক, মনে রেখেছেন দেখছি।
কোন কথা না বলে কিছুটা সময় শাফায়েত কেবল তাকিয়ে রইলো সামনে দাড়ানো মেয়েটার দিকে । মনে না রেখে কি উপায় আছে?১ তাকে কি ভোলা যায়?
পরিশিষ্টঃ
সমুদ্রের পাড়ে তারা হাটে নি । কেবল চুপ চাপ বসে ছিল । কতক্ষণ সেটার হিসেব দুজনের কেউ বলতে পারবে না । পুরানো কিছু কথা সেই ঘোরাঘুরি আর রাতে জেগে থেকে কত স্বপ্ন দেখাটা যেন হুট করেই ফিরে এল।
শাফায়েত বলল
-বিয়ে করেন নি ?
-নাহ। আর আগ্রহ হয় নি। আর……..
-আর ?
-আর কাউকে মনে ধরে নি বলতে পারেন।
কিছু সময় চুপ করে থেকে রাত্রী কথাটা বলল ।
-তা ছাড়া আমার নামটার মত আমার জীবনটাও রাতের অন্ধকারে ভর্তি। সেখানে আলো আসবে না। থাকুক না জীবন টা যেভাবে চলছে চলুক।
শাফায়েত কোন কথা বলল না। কেবল চেয়ে রইলো দুরে সমুদ্রের দিকে। সেও এখন মেনে নিয়েছে । চলছে চলুক যেভাবে যেদিকে নিয়ে যায় জীবন।
গল্পটা প্রায় দশ বছর আগের লেখা। পুরানো একটা গল্প খুজতে গিয়ে পেলাম। মনে হল এই গল্পটা সাইটে আপলোড দেওয়া যাক। আর কদিন থেকে আমি একটু কাজ কর্ম নিয়ে ব্যস্ত। তাই নতুন গল্প লেখা হচ্ছে না। কাজ শেষ হলে আবারও গল্প লেখায় মনযোগ দিব।
ফেসবুকের অর্গানিক রিচ কমে যাওয়ার কারনে অনেক পোস্ট সবার হোম পেইজে যাচ্ছে না। সরাসরি গল্পের লিংক পেতে আমার হোয়াটসএপ বা টেলিগ্রামে যুক্ত হতে পারেন। এছাড়া যাদের এসব নেই তারা ফেসবুক ব্রডকাস্ট চ্যানেলেও জয়েন হতে পারেন।
সরাসরি মেসেজ পাঠাতে চিঠি.মি এপ ব্যবহার করুন।
Discover more from অপু তানভীর
Subscribe to get the latest posts sent to your email.