নওরিনের চোখ তখন আবিরের দিকে । আজকে ওদের ক্লাস আর কলেজের বড় ভাইদের ভেতরে ম্যাচ হচ্ছে । যদিও ওর পাশে বসে থাকা সব ছেলে মেয়ে গুলোই ওদের ক্লাসকে সমর্থন করছে নওরিনের সমর্থন কলেজের বড় ভাইদের দিকে । কারণ সেখানে আবির খেলছে । আবিরই এখন ব্যাট করছে । এশ ভাল ক্রিকেট খেলে সে । বেশ কয়েকটা মেরেছে এর ভেতরেই। যদিও নওরিন চিৎকার করতে পারছে না । যদি করে তাহলে ওর পাশের মেয়েরা ওকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে। যদিও সাদিয়া জানে ব্যাপারটা । সাদিয়া বসে আছে ওর পাশে বসে আছে । আবির একটা একটা করে রান নিচ্ছে আর সাদিয়া ওকে গুতো দিচ্ছে । নওরিনের অবশ্য খারাপ লাগছে না ।
খেলা শেষ হল । নওরিনদের ক্লাস হেরে গেল চার উইকেটে । যদিও নওরিন বাইরে থেকে মুখ ভার করে রাখল তবে মনে মনে ওর খুব মজা লাগছে । বেশ কয়েকবার আবির ফিরে তাকাল ওদের দিকে । ওকেই যে দেখছে সেটা বলে দিতে হল না । স্কুল শেষ করে যখন বাসার দিকে রওয়ানা দিল তখন টের পেল যে আবির ঠিক ওর পেছন পেছন আসছে ।
অন্য দিন সে রিক্সা নিয়েই বাড়ির দিকে যায় তবে আজকে নিল না । আস্তে আস্তে হাটতে লাগল । নওরিন ঠিক জানে ঠিক কোন স্থানে আসলেই আবির একেবারে ওর সামনে চলে আসবে ।
-কী ব্যাপার এতো জোড়ে কেন হাটছো?
-আস্তে কেন হাটব?
-রাগ করেছো?
-কেন রাগ করবো?
-এই যে তোমাদের ক্লাসকে গো হারা হারালাম !
-ইস আমার গো হারা ! মাত্র চার উইকেটে । আর বড় হয়ে এটা হতে পারে । আরেকটু হলে তো হেরেই যেতেন । আগ্যিস সুমন ক্যাচটা মিস করেছিল। নয়তো …
নওরিন বাক্যটা শেষ করতে পারলো না । তার আগেই আজকে আবির একদম ওর কাছে চলে এল । তারপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওর ঠোঁটে চুমু খেল । নওরিন সত্যিই ভাবে নি যে আবিরের এতো সাহস হবে । এই স্থানে এসে আবির বড়জোড় হাত ধরে কিন্তু আজকে একেবারে চুমু !
একটু জোড়ে করেই সরিয়ে দিল!
আবির যেন অবাক হল। তারপর বলল, কী হল এটা?
-কী হল মানে? আপনার সাহস তো কম না! এমনটা আর করবেন না কখনও?
-কেন করব না?
-আমি বলেছি তাই।
-এখন থেকে অনুমুতি নিতে হবে?
-হ্যা হবে ।
-ওকে ফাইন আর আসব না ।
শেষ লাইনটা যেন একটু কঠিন কন্ঠেই বলল। তারপর একটু জোড় কদমেই হেটে গেল সে । নওরিন দাঁড়িয়ে পড়ল । বুঝতে পারল না আবির রাগ কেন করল ? এভাবে চুমু খায় নাকি কেউ ? যতই নির্জন রাস্তা হোক মানুষ জন তো চলে আসতে পারে। তখন ? আর মেয়ে ও কি একটু এমন করতে পারে না?
তাই বলে এভাবে রাগ করতে হবে !
নওরিন দেখল আবির আর ফিরেই তাকাল না । হন হন করে চলে গেল ।
বাসায় ফিরে নওরিনের মন আরও খারাপ হল । কান্না আসতে লাগল । ভেবেছিল আজকে পুরো রাস্তাটা গল্প করতে করতে আসবে কিন্তু এভাবে সামান্য ব্যাপার নিতেই যে এমন হয়ে যাবে সেটা ভাবতেই পারে নি । পুরো বিকেল তারপর রার নওরিন মন খারাপ করে রইলো । পরের দুই দিন আবিরের সাথে ওর দেখাই হল না । কলেজে দেখা হল বটে তবে আবির এমন ভান করল যেন ওকে চেনেই না । এমন কী ছুটির পর ফেরার সময়েও দেখা হল না । আবির অন্য পথ দিয়ে বাসায় গিয়েছে ।
শেষে দুইদিন পরে নওরিন সাহস করে নিজের বের হল । রাত তখন প্রায় বারোটা । আবিরদের বাসা ওদের বাসা থেকে খুব বেশি দূরে না । হাসপাতাল কলোনিতে থাকে না ওরা । নওরিনদের বাসার কাছেই । আস্তে করে বের হয়ে এল বাসা থেকে । তারপর আবিরদের বাসার সামনে গিয়ে হাজির হল। নওরিন দেখল আবিরের ঘরের আলো তখনও জ্বলছে । তার মানে এখনও জেগে আছে সে !
একটা ছোট ইট সে মারল জানলায় । প্রথম ঢিলটা অবশ্য জায়গা মত লাগল না । পরেরটা কাজ হল । আবিরকে জানালার কাছে আসতে দেখল এবং ওকে দেখতে আবিরের চোখে বিস্ময়টাও চোখে পড়ল ওর । আবির কিছু সময় পরেই বের হয়ে এল । ওর সামনে এসে বলল, এতো রাতে এখানে কী?
-আপনি আমার উপরে রাগ করেছেন?
-কই না তো !
-হ্যা আমি জানি রাগ করেছেন । ঐদিন ওভাবে কেন আপনি চুমু খেলেন ! আমি কী একটু রাগ করতে পারি না । ওভাবে চলে গেলেন !
আবির কিছু সময় তাকিয়ে রইলো নওরিনের দিকে । মেয়েটার সাহস দেখে একটু অবাকই হয়েছে। এতো রাতে মেয়েটা এভাবে এখানে আসবে সেটা ও ভাবতেই পারে নি । সেই সাথে এটাও মনে হল যে ঐদিন আসলে ওমন করে রাগ করে চলে আসা মোটেই উচিৎ হয় নি । মেয়েটা ঐ রকম প্রতিক্রিয়া দেখাবে সেটাই স্বাভাবিক ।
আবির বলল, রাগ করে নেই।
-আমি জানি রাগ করে আছেন।
-কী করলে প্রমান হবে যে রাগ করেনেই?
-আমাকে চুমু খান একটা !
আবির হাসল । বলল, খুব দুষ্টু হয়েছে!
অবশ্য এই সুযোগ সে ছাড়ল না । নওরিনকে গভীর ভাবে চুমু খেল। তারপর নিজেই ওকে বাসায় পৌছে দিল ।
তবে নওরিন তখনও জানে না যে ওদেরকে বাসার ভেতর থেকে একজন খেয়াল করছে । পুরো দৃশ্যটাই সে দেখেছে ।
পরের দিন নওরিন যখন স্কুল থেকে বাসায় এল এখন অবাক হয়ে দেখল ওদের বসার ঘরে দুইজন বসে রয়েছে । সামনা সামনা না দেখা হলেও এদের দুইজনকেই সে খুব ভাল করেই চেনে । এটা আবিরের বাবা আর মা।
ও ঘরে ঢুকতেই আবিরের মা বলল, আপনার মেয়ে এসেছে । ওকে জিজ্ঞেস করেন । কাল রাতে আমাদের বাসায় গিয়েছিল কিনা ! আমি এই টুকু মেয়ের সাহস দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি ।
নওরিনের মা তখন এসে কষে ওর গালে একটা চড় মারল । আবিরের মা আরও কয়েকটা কথা শুনিয়ে তারপর সেখান থেকে চলে গেল ।
কয়েকদিন নওরিনের স্কুলে যাওয়া হল না । তবে এক সময়ে আবারও স্কুলে গিয়ে হাজির হল সে । আবিরের মা ওদের বাসায় গিয়েছিল সত্য আর বাইরের কাউকে বলে নি ব্যাপারটা । তাই সেটা বাইরে জানা জানি হয় নি ।
দুইদিন পরে আবিরের মায়ের সাথে ওর আবার দেখা হল । সে স্কুলের গেটে অপেক্ষা করছিল । নওরিনের সাথেই কথা বলার জন্য । নওরিন কাছে আসতেই ওকে একটু আড়ালে নিয়ে গেল। তারপর বলল, শোন মেয়ে আমার ছেলে কখনই আমার অবাধ্য হবে না । বুঝতে পেরেছো কি ! তাই এরপর থেকে তুমি ওর পেছনে আসবে । ওর সাথে দেখা করার চেষ্টা করবে না । যে কয়টা দিন এখানে আছি আমি মোটেই চাই না ও তোমার সাথে দেখা করুক । আমি তোমাকে কখনই আমার ছেলের বউ হিসাবে মেনে নিব না । ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছো ! তোমাকে হয়তো আমি মেনেও নিতাম কিন্তু তোমার ফ্যামিলির দিকে তাকিয়ে দেখেছ তুমি? আমার ছেলে কখনই ঐ বাড়িতে বিয়ে করবে না !
নওরিনের মনে হচ্ছিল যেন একেবারে মাটির সাথে মিশে যায় । ওর বাবা মা খুব বেশি পড়াশোনা জানে না । ওদেরকিছু জমিজমা আছে আড়ত আছে । কিন্তু খুব বেশি শিক্ষিত না । অন্য দিকে আবিরের বাবা জেলার সিভিল সার্জন । আর আবিরের মা মহিলা অধিদপ্তরে চাকরি করে । দুইজনের বিসিএস ক্যাডার ।
নওরিনের চোখ দিয়ে টপটপ করে কেবল পানি বের হয়ে এল । ওকে ওখানেই রেখে আবিরের মা চলে গেল ।
নিজেকে নওরিন বুঝেছিল যে আবিরের মা ঠিকই বলেছিলেন । আবিরের পরিবারের সাথে সত্যিই ওদের পরিবার কোন ভাবেই যায় না । মেশে না । নিজেকে সে আটকে রেখেছিল । কিন্তু কয়েকদিন পরেই যখন জানতে পারলো আবির ঢাকা চলে যাচ্ছে তখন শেষ বারের মত আর দেখা না করে থাকতে পারল না । স্টেশনে দৌড়ে গিয়েছিল । যখন স্টেশনে হাজির হল তখন আবিরকে দেখতে পেল । আবিরও দেখতে পেয়েছিল ওকে । তবে ওর মায়ের কারণে কাছে আসতে পারল না । নওরিন কেবল দুর থেকেই দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে ।
যখন ট্রেন এল নওরিনের ইচ্ছে হচ্ছিল দৌড়ে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে একবার । আবির ট্রেনে উঠে আবারও দরজার কাছে এল । ওর দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল ।
যখন ট্রেনটা একটু নড়ল তখন নওরিনের পুরো শরীরে যেমন একটা তীব্র কষ্টের অনুভূতি জেগে উঠল । আস্তে আস্তে সেও পা চালাতে লাগল । এক সময় দৌড়াতে শুরু করল ট্রেনের পেছনে ।
আবির চোখের দিকে সে তাকিয়ে দেখল সেখান থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে ।
একেবারে প্লাটফর্মের শেষ অংশ পর্যন্ত দৌড়ে গেল নওরিন । ট্রেনটাকে চোখের আড়ালে চলে যেতে দেখল ।
###
নওরিন অনুভব করল কিছু একটা ওর কোল ঘেষে নড়াচড়া করছে । একটু চমকে উঠল তবে সাথে সাথেই বুঝল সেটা কী !
আবিরের বেড়াল । বেড়ালটার নাম আবির রেখেছে নওরিন । ওর নামের সাথে মিলিয়ে ।
রাতের বেলা যখন ওর বাসায় এসে হাজির হল তখন মনে মনে সত্যিই ভয়ে ছিল যে হয়তো বাসায় দেখতে পাবে যে ওর একটা বউ রয়েছে । তার বদলে ছিল এই বেড়ালটা । নওরিন নামের বেড়াল ।
রাতে ঘুম একটা কথা হয় নি আর । দীর্ঘ জার্নির কারণে ক্লান্ত ছিল খুব । অল্প কিছু মুখে দিয়েই শুয়ে পড়েছিল। আর এখন বিছানার ভেতরে দেখতে পাচ্ছে নওরিন ওর গা ঘেসে নড়াচড়া করছে ।
-ঘুম ভাঙ্গল ?
নওরিন দেখল আবির ওর বিছানার পাশে এসে দাড়িয়েছে । এখনও নওরিনের ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না ও আবিরের বাসায় রয়েছে ।
-হুম ।
-নওরিন দেখি তোমাকে খুব পছন্দ করেছে ।
নওরিন বেড়ালটার দিকে তাকাল । একটা বাদামী আর সাদা মিলিয়ে মিক্স ব্রিডের বেড়াল । একেবারে ওর শরীরে ঘেষে শুয়ে আছে।
আবির বলল, শোন আজকে বাইরে যেতে হবে না । আগামী দুইজন তুষারের কারণে ক্যাম্পাস বন্ধ । তোমার ব্যাপারে আমি কথা বলেছিল ।
-থ্যাঙ্কিউ ।
-চা খাবে নাকি কফি? আর বাসায় ফোন করেছো কাল?
-এয়ারপোর্টে পৌছেই জানিয়েছিলাম । আর বলেছিলাম যে ওয়াইফাইয়ের ভেতরে না আসা পর্যন্ত আর কথা হবে না ।
-এখন জানাতে পার। ওখানে এখন রাত ।
বাসার কথা মনে হতেই ফোনটা বের করল নওরিন । বেশ কয়েকটা মেসেজ এসেছে একটা নম্বর থেকে । নম্বরটা ওর হবু বর রাহাতের ।
চলবে…