আসফিমা

oputanvir
4.6
(62)

আমার ইচ্ছে হল কষে একটা চড় মারি মেয়েটার মুখে । সে আমার দিকে তাকাচ্ছে না । মুখের হিজাবটা পুরো মুখটাকে ঢেকে রেখেছে একেবারে । কেবল চোখ দেখা যাচ্ছে । আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে নিলাম । তারপর কেবিন থেকে বের হয়ে এলাম । দেখতে পেলাম মেয়েটার বাবা করিডোরে দাড়িয়ে রয়েছে বিমর্ষ মুখে । আমাকে কেবিন থেকে বের হতে দেখেই এগিয়ে এলেন । তারপর বললেন, বাবা একজন মেয়ে ডাক্তার ছিল না?
আমি বললাম, জ্বী মেয়ে ডাক্তার একজন আছেন । ডাক্তার সুলতানা । তাকে আমি ফোন দিয়েছিলাম । সে ছুটিতে আছে । সেই আপনার মেয়ের কথা আমাকে জানালো । আপনার মেয়ের এপেন্ডিক্স ব্লাষ্ট করেছে পেটের ভেতরে । এখন দ্রুত সম্ভব তার অপারেশন করতে হবে । অথচ আপনার মেয়ে বলছে কোন পুরুষ ডাক্তারের কাছে অপারেশন করাবে না । আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম । মানুষ ধর্ম পালন করে তাই বলে এমন এক্সট্রিম সিচ্যুয়েশনে এমন আচরণ কেন করবে?

দেখলাম ভদ্রলোক কেমন অসহায় হয়ে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে । কিছু সময় পরে বললেন, যদি সদরে নিয়ে যাই !
-আপনি বলছেন অনেক সময় ধরেই ব্যাথা তার মানে এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে । আর সদরে নিয়ে যাবেন যে সেখানে আমি মেয়ে ডাক্তার পাবেন তার নিশ্চয়তা কী ! আমাদের সদর হাসপাতালে বর্তমানে একজন মেয়ে ডাক্তার আছে তাও সে মেডিসিনের । অপারেশন করবে না । যে কয়জন সার্জন আছেন সবাই ছেলে । সেখানে নিয়ে গেলেও পুরুষ ডাক্তারই আসবে । বুঝতে পারছেন ব্যাপারটা? আমাদের এই উপজেলা স্বাস্থ কম্প্লেক্সটা যথেষ্ঠ ভাল । এখানেই অপারেশন সম্ভব ।

আমি কিছু সময় চুপ থেকে বললাম, মেয়েটা মারা যাবে । প্লিজ কিছু করেন ।

কিন্তু কিছুই হল না । মেয়েটাকে কেউ রাজিই করাতে পারলো না । একবার ইচ্ছে হল ইঞ্জেকশন দিয়ে মেয়েটাকে অজ্ঞান করে তারপর অপারেশ করাই কিন্তু এটা করা যাবে না । মেয়েটা সাবালিকা । তার ইচ্ছের বিরুদ্ধের কিছু করা যাবে না ।

গ্রামের দিকে মানুষের ধর্মের প্রতি আলাদা একটা টান থাকে । এরা ধর্ম ভীরু হয় জানি তবে এমন ভাবে আমি ধর্ম পালন করতে কাউকে দেখি নি । এই মেয়ে কোন পরপুরুষের সামনে যাবে না । আমি একজন পুরুষ ডাক্তার তাই আমি অপারেশন করতে গেলে তার শরীরে হাত দিতে হবে এটা সে কোন ভাবেই হতে দিবে না । এই রুগী আমার ছিলও না অবশ্য । ডাক্তার সুলতানার পেসেন্ট । তিনি ছুটি নিয়ে গিয়েছেন ঢাকাতে । এখন পুরো স্বাস্থ্য কম্প্লেক্সে আমরা দুজন ডাক্তার রয়েছি । দুজনই ছেলে। এই সময়ে মেয়েটার এপেন্ডিক্স ব্লাস্ট করেছে । যদিও আমি পরীক্ষা করতে পারি নি তবে যা লক্ষ্যণ আর ডাক্তার সুলতানার সাথে কথা বলে বুঝলাম এটা ছাড়া অন্য কিছু নয় । খুব বেশি রিক্সের অপারেশন নয় তবে দেরি করলে অবস্থা ভয়বহ হতে পারে ।

আরো ঘন্টা খানেক পার হতেই মেয়েটার অবস্থা আরো খারাপ হয়ে গেল । আমার চোখের সামনে এমন ভাবে মেয়েটা মারা যাবে এটা কোন ভাবেই আমার সহ্য হল না । অথচ আমার কিছু করার নেই । জোর করে কিছু করতে গেলে হিতে আবার বিপরীত হতে পারে ।

আমি মেয়েটির বাবাকে বললাম, আপনার মেয়ের বিয়ে হয়েছে?
মেয়েটির বাবা সম্ভবত এই প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না । ঠিক যেন বুঝতে পারলেন না । আমি আবারও বললাম, আপনার মেয়ের বিয়ে হয়েছে ?
-না বাবা এখনও হয় নি ।
-ওকে আমি একজন ডাক্তার । বাবাও ডাক্তার আমার । ফ্যামিলি ভাল । আপনার মেয়েকে আমি এখনই বিয়ে করতে চাই । বিয়ে করলে তখন তার জন্য পরপুরুষ থাকবো না । রাইট ?

ভদ্রলোক অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে । সম্ভবত আমি যে এমন কিছু বলতে পারি সেটা সে ভাবতেই পারে নি । আমি আবার বললাম, আধাঘন্টার ভেতরে কাজি ডেকে নিয়ে আসেন । আর দেরি করা যাবে না । জলদি !

দেখলাম ভদ্রলোক নিজের ফোন বের করলেন । আমি দ্রুত ওয়ার্ডবয় আর নার্সকে বললাম অপারেশনের টেবিলে সাজাতে । বিয়ের পর সোজা তাকে ওটিতে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে । পারলে ওটিতেই কবুল বলব ।

বিশ মিনিটের মাথায় একজন কাজী এসে হাজির হল । তার ঠিক পনের মিনিট পরেই আমি কবুল বললাম ।

মেয়েটির চোখে কেবল তীব্র বিস্ময় দেখতে পাচ্ছিলাম আমি । সে নিজেও সম্ভবত ভাবতে পারে নি যে আমি এমন কিছু করতে পারি । আমার মনে একটা আশাংঙ্কা ছিল যে মেয়েটা হয়তো বেঁকে বসতে পারে তবে বসলো না । মেয়েটা চোখ বন্ধ করার আগে আমার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকালো । সেখানে বিস্ময় ভয়ের সাথে আমি অন্য কিছুও দেখতে পেলাম ।

অপরাশেন শেষ হল ভাল ভাবেই । আমি তাকে কেবিনে দিয়ে নিজেও রয়ে গেলাম । যদিও আমার এখন খুব একটা কিছু করার নেই । কোন ইমারজেন্সী হলেই দেখতে হবে । অফিসে বসে যখন ঠান্ডা মাথায় ব্যাপারটা চিন্তা করতে লাগলাম তখন মনে হল উত্তেজনার মাথায় বিয়েটা না করলেই কি হত না?
আমি যে বিয়ে করে ফেলেছি ব্যাপার ভাবতেই কেমন যেন লাগলো। আমার বাসায় যখন জানতে পারবে গ্রামের একটা মেয়েকে আমি বিয়ে করেছি তখন কী করবে কে জানে ! বাবা সব থেকে বেশি রাগ করবে । বাবার পছন্দের মেয়ের সাথে আমার বিয়ের কথা চলছিলো । একবার আমাদের দেখাও হয়েছে । মেয়েটার পড়াশোনা শেষ হলেই সম্ভবত বিয়ের দিকে যেতাম আমরা । এখন যে মাঝ থেকে বিয়ে করে ফেললাম ব্যাপারটা কেমন হল !

রাতের বেলা বাসায় ফেরার আগে আমি আরেকবার কেবিনে গিয়ে হাজির হলাম । মেয়েটার মা রয়েছে মেয়েটার পাশে । উনিও পর্দা করেন বেশ ভাল ভাবেই । মেয়েতো পর্দা করেই । আমি আগে কেবিনে ঢুকলেই যেমন জড়ষড় হয়ে যেতে দেখেছি এখন সেটা দেখলাম না । অবশ্য এখন সম্পর্ক একেবারে বদলে গেছে । আমি আমার সদ্য বিবাহিত বউয়ের বেডের কাছে গেলাম ।
এবং সেখানে গিয়েই একটা ছোট খাটো রকমের ধাক্কা খেলাম । আমি জেনেছি মেয়েটির নাম আসফিমা । আজকে যতবার আসফিমাকে দেখেছি ততবার তার মুখ ঢাকা ছিল । কেবল চোখ দেখা যাচ্ছিলো । কিন্তু এখন মেয়েটার মুখে হিজাব নেই । একটা ওড়ণা দিয়ে কেবল মাথায় কাপড় দেওয়া । একপাশে ঘন কালো চুল রেখে দেওয়া আছে । আমি কেবল তাকিয়ে রয়েছে আসফিমার মুখের দিকে । আমি এতো নিশ্পাপ মুখ এর আগে দেখেছি বলে মনে পড়ে না । কেন জানি আমি চোখ সরাতে পারলাম না । একভাবে তাকিয়ে রইলাম কেবল । কত সময় তাকিয়ে ছিলাম সেটা নিজেও জানি না আমার শাশুড়ির কথা শুনে তনয় ভাঙ্গলো । তিনি বললেন, বাবা বাসায় যাবে এখন?
-জ্বী ।
তারপর আসফিমার পালস চেক করলাম । মেয়েটা এখনও ঘুমাচ্ছে। কেন জানি আমার খুব ইচ্ছে হল টুল টেনে এখানে বসতে । কেন ইচ্ছে হল সেটা অবশ্য আমি নিজেও জানি না । ওর এখন ঘুমিয়ে থাকারই কথা । আমার এখানে কিছু করার নেই । বসে থাকার চিন্তাটা দমন করে আমি বের হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তই নিলাম ।

-রাতের খাবার খেয়েছো ?
-জ্বী খাবো বাসায় গিয়ে ।
-রান্না করে কে?
-রান্না না । এই তো বাসার পাশেই একটা হোটেল আছে । সেখান থেকেই খাই ।

দেখলাম শাশুড়ি আমার কথা শুনে অবাক হলেন । তবে কিছু বললেন না আর । দরজা দিয়ে বের হওয়ার আগে বললাম, কোন সমস্যা হলেই আমাকে ডাক দিবেন । তবে এখন চিন্তার কারণ নেই । নার্স রয়েছে । সেই সামলাতে পারবে ।

আমি বাসায় চলে এলাম । রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে কেবল বারবার আসফিমার চেহারাটা ঘুরপাক খেতে লাগলো মনের ভেতরে । অনেকটা সময় আমি কেবল সেটা নিয়েই ভাবলাম কেবল । ওকে ভাবতে ভাবতেই ঘুম চলে এল কখন নিজেও জানি না ।

দুই

আসফিমা দুইদিন পরে মোটামুটি একটু সুস্থ হয়ে উঠলো । সেদিন সকালে আমার ডিউটি ছিল না । আমি তবুও বিকেলে গিয়ে হাজির হলাম আসফিমাকে দেখতে । আমি ঘরে ঢুকতেই দেখলাম সে একটু সচকিত উঠলো । একটা তাড়াহুড়া ছিল নিজের পর্দা ঠিক করে নেওয়ার তবে আমার দিকে চোখ পরতেই সেটা করলো না । আজও মাথায় কাপড় দেওয়া তবে মুখ ঢাকা নেই । চেহারায় সৌম্য স্নিগ্ধ ভাবটা যেন আরো ফিরে এসেছে । এখন যতই সুস্থ হবে ততই এটা আরো বৃদ্ধি পাবে ।

আমি সামনে গিয়ে বসতেই বললাম, আজকে কেমন লাগছে?
আসফিমা মৃদু স্বরে বলল, ভাল !
-ব্যাথা আছে ?
-এখনও আছে । নড়তে গেলে বোঝা যায় । তবে আগের থেকে কম !
-ঠিক হয়ে যাবে । অপারেশনটা আরও আগে করার দরকার ছিল । যখন প্রথমবার এটা ধরা পড়ে তখনই। তাহলে এতো কষ্ট হত না । বুঝেছো !

আসফিমা উত্তর দিলো না । আর কী বলবো ঠিক খুজে পেলাম না । এখানে এসেছিলাম আইরিনের ব্যাপারে কথা বলতে কিন্তু কথাটা আমি ওকে কিভাবে বলব সেটা বুঝতে পারছি না । এখন হয়তো বলার দরকার নেই । আরো একটু ভাল হোক তখন বলা যাবে । আমার বাসায় এখনও জানে না আসফিমার ব্যাপারে। আমি জানিও না তারা কী রকম প্রতিক্রিয়া দেখাবে যখন জানবে যে তাদের ছেলে তাদের না জানিয়ে একা একা বিয়ে করে ফেলেছে ।

ছোট বেলা থেকে আমি সব সময় পরিবারের বাধ্য ছেলের মত বাবা মায়ের সকল হুকুম শুনে এসেছি । তারা যা বলেছে যেভাবে বলেছে সেই ভাবেই দিন পার করেছি । এমনকি তাদের পছন্দমত মেয়েকেও বিয়ে করতেই যাচ্ছিলাম যদি না মাঝ খান দিয়ে এই কাজটা না হয়ে যেত । আমি বললাম, আচ্ছা আমি তাহলে আসি । কেমন ? আমার আবার কাল ডিউটি !

আমি উঠতে যাচ্ছিলাম তখন আসফিমা বলল, শুনুন ।
আমি উঠলাম না । বললাম, কিছু বলবে?
-আমি এমন একটা কাজ কেন করলেন?
-এই রকম একটা কাজ বলতে?
-মানে আমাকে এই ভাবে বিয়েতে রাজি কেন হলেন?

আমি চট করে জবাব টা দিতে পারলাম না । আমি নিজেও এখনও ভেবে বের করতে পারি নি আসলে কেন আমি সেদিন ওমন করে আসফিমাকে কেন বিয়ে করতে চেয়েছিলাম । হয়তো কেবল ওকে রক্ষা করার একটা স্পিহা ছিল মনের ভেতরে । অন্য কোন কিছু তখন মাথায় আসেই নি আমার ।

আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, আমি জানি না ঠিক । আমার কেবল মনে হয়েছে কী করলে তুমি অপারেশনটা করতে রাজি হবে । এটা ছাড়া অন্য কোন ব্যাপারই মাথায় আসে নি ।
লাইন গুলো বলে কিছু সময় চুপ করে রইলাম । তারপর মনে হল যে আরো কিছু আমার বলার দরকার । বললাম, আসলে এমন ভাবেই আমাদের ভাগ্য লেখা ছিল ! এটা তো বিশ্বাস কর যে উপরওয়ালাই উপর থেকে মানুষের সঙ্গী ঠিক করে রাখেন । তাই না?
-হ্যা । আপনি যখন সেদিন আমাকে ওভাবে বিয়ে করতে চাইলেন সেদিন আরও আমার আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসটা আরো দৃঢ় হল । নয়তো কোন ভাবে কি আমার সাথে আপনার এভাবে দেখা হওয়া কিংবা এভাবে বিয়ে হওয়া সম্ভব ছিল বলেন!
-নাহ ! ছিল না !
-আপনি নামাজ পড়েন?
-এ্যা !

আমার উত্তর শুনে আসফিমা বুঝে গেল আমার নামাজের অবস্থা কেমন ! সে বলল, এসব চলবে না । এখন নিয়মিত নামাজ পড়তে হবে । অন্য কিছু আমি বলছি না যে আমার মত করে আপনাকে সব কিছু মানতে হবে কেবল চাই আপনি কখনও অবৈধ কোন কাজ করবেন না আর নামাজটা পড়বেন নিয়মিত । ঠিক আছে ?
আমি হাসলাম । তারপর বললাম, চেষ্টা করবো !

আমার তখনই মনে হল যে এখনই আসলে কথাটা বলে দেওয়া দরকার । এছাড়া যত সময় যাবে ততই সম্ভবত ব্যাপারটা জটিল হয়ে যাবে । আমি বললাম, একটা কথা তোমাকে বলার ছিল।
-জ্বী বলুন !
-আসলে এখানে পোস্টিং নিয়ে আসার আগে আমার বিয়ের কথা বার্তা চলছিল বাসা থেকে ।

আমার মুখে বিয়ের কথা শুনে আসফিমার মুখের ভাবটা কেমন যেন একটু মলিন হয়ে গেল । আমি বললাম, একটা মেয়ের সাথে সাথে আামর কথা হয়েছিলো । বাবার পছন্দের মেয়ে । তার কোন বন্ধুর মেয়ে । একদিন আমাদের দেখা হয়েছিলো । মোটামুটি ঠিক হয়েছিলো যে তার পড়াশোনা শেষ হলে আমাদের বিয়ে হবে !
-তারপর ?
-তার আর কোন পর নেই । ওটা মাস দুয়েক আগের কথা । এর ভেতরে মেয়েটির সাথে আমার আর কথা হয় নি । তারপরই তো এই ঘটনা ঘটলো !
-আপনার বাবা মা তাহলে কষ্ট পাবে খুব !
-আরে কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই । আমার জীবন ভর তাদের খুব বাধ্য ছেলে হয়েই থেকেছি আমি । একটু না হয় নিজের পছন্দের বিয়েটা করলাম । এটা নিয়ে টেনশন নেই । আমি আসলে যা বলতে চাইছিলাম যে আমাদের শুরুটা আসলে যেভাবেই হোক না কেন এরপরে আমাদের সব কিছু আমাদের মত করে হবে । ঠিক আছে?
এবার দেখলাম আসফিমার মুখে একটু হাসি ফুটলো । আমি এবার বললাম, আমি তাহলে আসি এখন?
-দাড়ান, আম্মু আপনার জন্য গরুর ভূনা মাংস করেছে । ওটা নিয়ে যান !
-আবার !
-হ্যা ।
-এই দুই দিনে প্রতিবেলাতে আমি কেবল মাংসই খাচ্ছি । বাতি ভরে ভরে উনি পাঠাচ্ছেন এতো মানুষ খেতে পারে !
দেখলাম আসফিমা হাসলো । বলল, এসব তো সবে শুরু । সামনে দেখবেন আরো কতকিছু আসে !

আসফিমার সাথে আামর বিয়ের পরে এই এক নতুন ঘটনা ঘটছে । হোটেলে খাওয়া দাওয়া করতাম সেটা বন্ধ হয়েছে । এখন নিয়মিত খাবার আসে আমার শ্বশুর বাড়ি থেকে । একটা ছেলে আছে, তার কাজ হচ্ছে সে টিফিট ক্যারিয়ারে করে আমার বাসায় খাবার নিয়ে আসে । আমাকে খাইয়ে সব ধুয়ে মুছে আবার চলে যায় ।

এছাড়া এই দুই দিনে আরেকটা ব্যাপারটা খেয়াল করলাম যে সবাই আমার প্রতি আচরণ কেমন বদলে গেছে । সবার মাঝেই একটা সমীহের ভাব । আগে ডাক্তার হিসাবে সবাই সম্মান করতো সেটা আলাদা একটা ব্যাপার ছিল কিন্তু এখন সেই সম্মানের সাথে সমীহের একটা ব্যাপার যুক্ত হয়েছে । আমি আগে টের পাই নি তবে খাবার নিয়ে আসা ছেলেটার কাছ থেকে যা জানলাম সেটা হচ্ছে আসফিমারা এই এলাকার জমিদার ছিল আগে । প্রচুর জায়গা সম্মত্তি রয়েছে । আসফিমা বড় মেয়ে । ওর একটা ছোট ভাই আছে । যদিও তাকে আমি এখনও দেখতে পাই নি । প্রথম দিন অবশ্য আমার মনে আছে একটা ছেলেকে দেখেছিলাম বারান্দায় তবে এই দুইদিনে আর দেখা হয় নি ।

পরের দিনই আসফিমাকে রিলিজ করে দেওয়া যেত তবে আমি আরো দুইদিন রেখে দিলাম ওকে । আসলে হাসপাতালে আছে বলেই আমার কাছাকাছি রয়েছে । এই কারণেই মনে হল যে আরো কিছু সময় থাকুক । যদি এখন ওদের বাসায় যাওয়া আমার জন্য কোন ব্যাপার না । যেতে হবেও নিয়মিত ।

আসফিমা বাসায় চলে যাওয়ার পরের দিন দুপুরের খাবার দিতে সেই ছেলেটা এল না । অন্য একজন আসলো । সেটা আসফিমার ছোট ভাই । আমার ঘরের দরজার সামনে দাড়িয়ে ছিল । একটু ইতস্তর করছিলো । আমি ডাক দিয়েই এগিয়ে এল । কে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম কিন্তু চিনে ফেললাম ।
-আব্বা আপনাকে আমার সাথে যেতে বলেছে !
-কোথায় ?
-আমাদের বাসায় । আজকে দুপুরের খানা ওখানে খাবেন !

আমি কোন কথা বললাম না । বাইকে শ্যালক মশাইকে বসিয়ে ওদের বাসার দিকে রওয়ানা দিলাম । যখন শ্বশুর বাড়ি পৌছালাম তখন পারতপক্ষেই মনে হল যে জমিদার বাড়িতেই এসে পৌছেছি । প্রথমবার শ্বশুর বাড়ি আসলাম হাতে করে কিছু নিয়ে আসার দরকার ছিল কিন্তু মনেই ছিল না । একটু লজ্জা লাগছিলো নিজের কাছেই ।

ব্যাপারটা সম্ভবত শ্বশুর মশাই টের পেলেন । হাসি মুখে বললেন এসব নিয়ে একদম না ভাবতে । এটা কোন দাওয়াত না । কেবল দুপুরে তাদের সাথে খাবারের জন্য ডাক দিয়েছে আমাকে । তবে পরের বার যখন আসবো তখন অবশ্যই মিষ্টি নিয়ে আসতে হবে ব্যাপারটা মাথার ভেতরে সেট করে নিলাম ।

খাবার টেবিলে যখন এলাম তখন আমার মোটেও মনে হল না এটা কোন সাধারণ খাবার টেবিল । কত পদের মাছ যে এখানে রয়েছে সেটা গুনে শেষ করতে পারলাম না । দেখলাম আসফিমা নিজেই বেড়ে দিচ্ছিলো । আমার কেন জানি দৃশ্যটা অনেক বেশি চমৎকার লাগলো । ভাবতেই ভাল লাগলো যে চোখের সামনের এই মেয়েটিই আমার জীবন সঙ্গী !
খাওয়ার সময়ই শ্বশুর মশাই কথাটা তুললেন। বললেন, তুমি চাইলে আমাদের বাসাতেই এসে থাকতে পারো, নাকি? আমাদের বাসায় এতো গুলো ঘর আর মানুষ তো নেই । তুমি তো এখন আমাদেরই ছেলে ! বাইরে কেন থাকবে ! ওখানে কে তোমাকে দেখা শোনা করবে ! একা একা থাকো কি খাওয়া দাওয়া কর । এর থেকে আমাদের এখানে এসে থাকো !
আমি একটু হেসে বললাম, তা সত্যি বলেছেন তবে আমি আসলে শ্বশুর বাড়ি এসে থাকতে চাই না । মানে যত কারণই হোক না কেন সবাই বলবে যে আমি ঘর জামাই হয়ে আছি । আর আমার সরকারি কোয়াটারটা কিন্তু অনেক বড়। অবশ্যই আপনাদের মত এতো বড় না । আসফিমা একটু কষ্ট হবে তবে আমার মনে হয় ও নিজেও পছন্দ করবে না যে ওর স্বামী ওর বাবার বাসায় থাকে !

আমি কথাটা বলেই আসফিমার দিকে তাকালাম । দেখি ও খানিকটা হাসি মুখ নিয়েই আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে । ওর মুখ দেখে মনে হল যে ও যেন চাইছিলো আমি ঠিক এই কথাটাই বলি ।

সব কিছুই যেমন স্মুথ ভাবে চলতে লাগলো । জীবনটা যেন একেবারে গল্পের মত সুন্দর হয়ে চলছে । কিন্তু গল্পের ছন্দ পতন হল কদিন পরেই । আমার বাসায় আমার বিয়ের কথা জেনে গেল কোন ভাবে । আমাকে ফোন না দিয়ে সরাসরি আমার বাসায় এসে হাজির হলেন তারা । আর সেদিন আসফিমা হাসপাতালে এসেছিলো আমার সাথে দেখা করতে । ও অবশ্য প্রতিদিনই আমার কাছে আসতে শুরু করেছে । বুঝতে পারছি যে ও নিজেও আমার সাথে থাকতে চাচ্ছে । তবে শরীর এখনও পুরোপুরি সুস্থ না হওয়ার জন্য ও বাবা ওকে আসতে দিচ্ছে না ।

আমি ওকে নিয়ে আমার বাসার দিকে রওয়ানা দিলাম । বাসায় প্রবেশের আগেই দারোয়ানের সাথে দেখা । সে জানালো যে আমার বাবা মা এসেছে । এর আগেও মা এসেছে কয়েকবার । তাই মাকে দারোয়ান বেশ ভাল করেই চেনে । তবে বাবা এই প্রথম এল । আসফিমা বলল, আমি তাহলে চলে যাই।
আমি ওর হাত ধরলাম । তারপর বললাম, যেহেতু বাবা এসেছে এভাবে তার মানে ওনারা জানেন তোমার কথা । এসো !

আসফিমার হাত ধরেই আমি দিকে রওয়ানা দিলাম । দরজা খোলাই ছিল । ভেতরে ঢুকতেই দেখলাম বাবা বসে রয়েছে সোফার উপরে । মা সম্ভবত ভেতরে । আমাদের একসাথে ভেতরে ঢুকতে দেখে বাবার মুখ আরো গম্ভীর হয়ে গেল । মাকে রান্নাঘর থেকে বের হতে দেখলাম । আমি তখনও আসফিমার হাত ছাড়ি নি ।

মায়ের প্রথম কথাটাই ছিল, তুই আমাদের না জানিয়ে বিয়ে করে ফেললি কিভাবে?
-মা এতো দুর থেকে এসেছো বিশ্রাম কর । এসব নিয়ে কথা পড়ে হবে !
আমার কথা শুনে বাবা বললেন, আমরা এখানে বিশ্রাম করতে আসি নি । তোর এতো বড় সাহস হল কিভাবে !

আমি কী বলবো খুজে পেলাম না । বাবা আবারও বললেন, আমার মান সম্মানের কথা একবারও মনে হল না ? তোর যে বিয়ে ঠিক করে রেখেছি সেটা খেয়াল নেই । কিভাবে তুই গ্রামের একটা মেয়েকে বিয়ে করলো । বিসিএস ক্যাডার তোকে এই জন্য বানিয়েছি আমি ?

আমি দেখতে পেলাম আসফিমার মাথাটা নিচু হয়ে গেছে । আমি বললাম, বাবা বিয়ে হয়েছে । এভাবেই হয়তো লেখা ছিল ।
-আমি জানি না বুঝি কিভাবে বিয়ে হয়েছে । এই বিয়ে আমি মানি না । আজই তুই এই মেয়েকে ডিভোর্স দিবি । এটা আমার হুকুম । তোর এখানে আর চাকরি করতে হবে না । আমার সাথে এখনই যাবি তুই ঢাকায় !

আমি আসফিমার হাতটা আরো একটু শক্ত করে ধরলাম । তারপর বললাম, বাবা আমি আসফিমার সাথেই সংসার করতে চাই । আমি ওকে কোন ভাবেই ডিভোর্স দেব না ।
-আর আমি যে কথা দিয়েছি !
-কথা দিয়েছেন কথা ফিরিয়ে নিন । এমন কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাই নি ।
-তুই এই গ্রামের মেয়েটার জন্য আমার সাথে তর্ক করছিস ?
-আপনি বারবার আমার স্ত্রীকে অপমান করছেন । আপনি ভুলে যাচ্ছেন যে আপনি আমারই ঘরে দাড়িয়ে আমার স্ত্রী সম্পর্কে বাজে কথা বলছেন । আপনি এখনই ওকে সরি বলবেন ।
-কী এতো বড় সাহস তোর ! দুদিন বিয়ে করেই বড় হয়ে গেছিস তুই !
-আমি অনেক আগেই বড় হয়েছি । আপনার সকল অন্যায় শাসন মুখ বুঝে সহ্য করেছি আমি কেবল আপনি বাবা বলেই । দয়া করে আপনি আসফিমাকে সরি বলুন ।

বাবার মুখটা লাল হয়ে গেল । সে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, রাহেলা এখনই চল এখান থেকে । এই বাসায় আর এক মুহুর্ত নয় ।

এই বলে বাবা ঘর থেকে বের হতে উদ্ধত হলেন । মা বলল, বাবু তোর বাবাকে থামা !
আমার কেন জানি হঠাৎ করেই হাসি চলে এল । বললাম, থামানোর কিছু নেই মা । এই এলাকা থেকে কোন ট্রেন নেই ঢাকার । সেটা কাল সকালে । আর বাসও সাতটার পরে বন্ধ হয়ে যায় । কোন হোটেল নেই । কিছুই নেই এই এলাকাতে । যদি বাবা রাগ করে চলে যায় সে কোথাও থাকতে পারবে না তাকে এখানেই ফিরে আসতে হবে !

মা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে । আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, তুমি চাইলে যেতে পারো বাবার সাথে । আবার এখানে থাকতে পারো ।
বাইরে থেকে আবার ডাক শুনতে পেলাম,

রাহেল চলে এসো !

মাকে দেখলাম ভয়ে ভয়ে বয়ে বাইরে বের হল । তবে ফিরে এল কিছু সময় পরেই । আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তোর বাবা চলে গেছেন !
-চিন্তা কর না । বেশি দুর সে যেতে পারবে না । ফিরে আসবেই । তুমি আসফিমাকে দেখো ।

এতো সময় পরে আমি আসফিমার হাত ছাড়লাম । দেখলাম ও মাকে সালাম করলো । তারপর নিজের মুখের কাপড় সরালো । আসফিমার মুখটা দেখার পরেই দেখলাম মায়ের মনটা উজ্জ্বল হয়ে গেল । আমি এটা জানতাম । আসফিমাকে দেখে কেউ অপছন্দ করতে পারবে না । মা বলল, বাহ, কী মিষ্টি তুমি মা ! এতো দিনে গাধাটা একটা ভাল কাজ করেছে মনে হচ্ছে!

রাতে খাওয়া দাওয়ার পরে একটু অবশ্য চিন্তা হল বাবার জন্য । বাবা কোথায় আছে কে জানে । দারোয়ানকে পাঠালাম রেলস্টেশন আর বাস স্ট্যান্ডে । সে ফিরে এল ঘন্টা খানেক পরে । জানালো যে সেখানে তার দেখা পায় নি সে । মা একটু চিন্তিত হল ।
আসফিমা বলল, বাবাকে ফোন দিই । উনি লোক লাগিয়ে খোজ নিতে পারবে !
-হ্যা তাই কর ।

আমি ফোন দেওয়ার আগেই দেখলাম আসফিমার ফোনে এসে হাজির হল । সে কিছু সময় কথা বলে রেখে দিল । তারপর আমার দিকে তাকিয়ে আসফিমা বলল, আমাদের বাসায় নিয়ে গেছেন ।
-আমার বাবা কে?
-হ্যা । উনি বাসস্ট্যান্ডে গিয়েছিলেন। সেখানেই দেখা হয়েছে ।
-তাহলে আর চিন্তা কী !
-বাবা বলেছেন সবাই যেন আমাদের বাসাতে যাই এখন ! মা সহ !

মাকে বললাম বাবা কোথায় আছেন । সে একটু নিশ্চিন্ত হল । তারপর আমরা সবাই মিলে চললাম আমার শ্বশুর বাড়ি । বৈঠক খানাতে ঢুকতেই দেখলাম শ্বশুর মশাইয়ের সাথে বাবা খোশ গল্প করছেন । আমাদের দেখেও না দেখার ভান করে রইলেন । আমি এইবার অবশ্য আসফিমার হাত ধরে ছিলাম । ও সবার আগে ঢুকে বাবাকে সালাম করলো । দেখলাম বাবা রাগত মুখে রইলো না । পকেট থেকে দুটো এক হাজার নোট বের করে আসফিমার হাতে দিলেন । বললেন বেঁচে থাক !

আসফিমা আমার দিকে তাকাল । ওর চোখ দেখেই আমার মনে হল যে একটু আগে বাবার আচরণে ও যেমন কষ্ট পেয়েছিল এখন সেটা একদম চলে গেছে ।

আসফিমা মাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল । আমি বৈঠক খানাতেই বসলাম । বাবা বললেন, আমি শুনলাম তুমি কোন পরিস্থিতিতে বিয়ে করেছো । এটা আমাদের বলা যেত না?
-সুযোগ পেলাম কোথায়?
-বিয়ে করোছ এক মাসের বেশি হয়েছে । এর মাঝে সুযোগ পাও নি !

রাতে আবারও সেই বিশাল আয়োজন খাওয়া দাওয়ার । খাবার টেবিলে বাবা ঘোষনা দিলেন তার ছেলের বউকে আরো পড়াশোনা করতে হবে । কোন অবজেকশন তিনি শুনবেন না । অবশ্য আমিও ভাবছিলাম যে ঢাকাতে গিয়ে ওকে অনার্সে ভর্তি করিয়ে দিবো । হয়তো কো এডুকেশনে ভর্তি হবে না তবে গার্ল কলেজে ভর্তি হতে আপত্তি করবে না আশা করি ।

আজকে জনৈক আসফিমার জন্মদিন । তার জন্য রইলো জন্মদিনের শুভেচ্ছা ।

সকল গল্পের লিংক সরকারি পেতে হোয়াটসগ্রুপ অথবা টেলিগ্রামে জয়েন করুন । সকল গল্পের সূচিপত্র

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.6 / 5. Vote count: 62

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

One Comment on “আসফিমা”

  1. গল্পের প্রথম অংশটুকু এতটাই ভালো লেগেছে যে সকাল-বিকেল-রাত মিলিয়ে কেবল প্রথম অংশটাই তিনবার পড়েছি। গল্পটা অসাধারণ, তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না।

    সাথে বার্থডে গার্ল ‘আসফিমার’ জন্যে অনেক শুভকামনা।

Comments are closed.