সাদা রংয়ের কুকুরটাকে কেমন জানি বেমানান লাগছে ! ঢাকার রাস্তায় থাকবে দল বেধে নেড়ি কুকুর । কিন্তু এখানে তার বদলে রয়েছে একটা চকচকে বিদেশী কুকর ।
শুনেছি এসব বিদেশী কুকুরের বিভিন্ন প্রজাতি থাকে ।
এটা কি প্রজাতির কুকুর কে জানে ? নাম জানতে ইচ্ছা করছে !
কিন্তু আসে পাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না যে তাকে জিজ্ঞেস করবো ! আচ্ছা একটা কাজ করা যাক ! কুকুরটা একটা ছবি তুলে নিয়ে যাই ! নিহিন নিশ্চই বলতে পারবে । ওর আবার সব বিষয়েই জ্ঞান আছে । আর না হলে ও গোলাপী রংয়ের ল্যাপটপটা তো আছেই । ঠিকই খোজ বের করে ফেলবে ।
আমি আমার মোবাইলটা বের করলাম । ছবিতে তুলতে যাবো ঠিক তখনই কুকুরটা হাটা শুরুর করলো !
আরে !
এই ব্যাটা দাড়া !
আমি কুকুরের পেছনে হাটা দিলাম !
দাড়া বেটা ! ফাজিল ! লজ্জা পালাচ্ছিস ক্যান ? ভয় নাই তোর ছবি নেট এ ছাড়বো না !
তবুও কুকুরটা দাড়ালো না ! বেটার নিশ্চয়ই ক্যামেরা ভীতি আছে !
আরে আমি কখন থেকে বেটা বেটা করে যাচ্ছি ! এটা নিশ্চই মেয়ে কুকুর । আমার বেটা ডাকাতে মনে কষ্ট পেয়েছে । তাই চলে যাচ্ছে ।
এই যে মিস !
মিস কুকুর !
একটু দাড়াও হে সুন্দরী !
-এক্সকিউজ মি !
এই সেরেছে ! কুকুর আমাকে বলছে এক্সকিউজ মি !!!
বিদেশী কুকুর তো ইংরেজি জানতেই পারে ।
আমি কুকুর দিকে তাকিয়ে বললাম
-জি বলুন !
-পিছনে তাকান !
কি ব্যপারা কুকুর আবার পেছনে তাকাতে কয় কেন ? আমি পিছনে ঘরে তাকিয়ে দেখি একটা মেয়ে দাড়িয়ে !
সাদা পরী !
মেয়েটার পরনে সাদা রংয়ের একটা সাদা কামিজ । এখন কার মত লং কামজ না । স্বাভাভিক সাইজের কামিজ ! সাথে ধবধবে সাদা লেগিংস ! আর সাদা ওড়না দিয়ে মাথায় কাপড় দেওয়া !
আমি কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলাম মেয়েটার দিকে ! এমন সুন্দর মেয়ে বহুদিন দেখি নাই !
যদিও এই অবস্থায় লুলামী করা ঠিক না । তবুও লুল পাবলিক তো সুযোগ পেলেই লুলামী করবে !
নিহিন যদি দেখে !!!
মেয়েটিকে বললাম
-আপনি কিছু বলছেন আমাকে ?
-জি !
-বলুন !
-আপনি আমার টিনি কে জ্বালাতন করছেন কেন ?
-আমি জ্বালাতন করছি মানে ? দেখুন আমি খুব ভালা কিসিমের পুলা ! আমি কেন আপনার টিনিকে জ্বালাতন করবো ! আর ভাল কথা টিনি টা কে ?
-ঐ যে !
মেয়েটি কুকুর টির দিকে হাত ইশারা করে দেখালো !
-ও আচ্ছা !
-জি !
-না আসলে আমি ওকে জ্বালাতন করছি না ! একটা ছবি তোলার চেষ্ট করছিল । ঢাকার রাস্তায় নেড়ি কুকুর ছাড়া আর কিছু দেখা যয় না তো ! তাই আর কি !
মেয়েটি কিছু আমাকে আর কিছু বলল না ! তার কুকুরের দিকে তাকিয়ে বলল
-আসো টিনি ! এগিয়ে এসো !
আমি খানিকটা আশ্চর্য হয়ে দেখলাম আসলেই টিনি হেলতে দুলতে তার মহিলা মনিবের দিকে এগিয়ে চলছে !
বাহ ! ভাল তো !
আমি বললাম
-বাহ ! আপনার টিনি তো আপনার কথা শুনে !
-কেন শুনবে না ?
-আচ্ছা ! আপনার কুকুরের নাম টিনি ! তা টিনিট মালিকের নাম কি ?
মেয়েটি আমার দিকে সরু চোখে তাকালো !
-কেন জানতে চানছেন ? আর কেনই বা বলবো ?
-না মানে ? একটা কথা আছে মৃত্যু পথ যাত্রীর সব ইচ্ছা পুরন করতে ! আপনার নাম না জানলে জীবনে একটা অপূর্নতা থেকে যাবে !
মেয়েটি আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বলল
-আর ইউ ট্রাইয়িং টু …….
মেয়েটি তার বাক্য শেষ করত পারলো না ! তারট আগেই আমার মাথায় কেমন একটা চক্কর দিয়ে উঠলো !
নাহ ! ইদানিং বড় ঘন ঘন হার্ডডিস্ক ক্রাস করতেছে । সময় ঘনিয়ে আসছে ! সময় ঘনিয়ে আসছে !
সাদা পরী চোখের সামনে কেমন ঝপছা হয়ে এল ! জ্ঞান হারানোর আগে কেবল একজনের পায়ের আওয়াজ পেলাম । আমি জানি কে আমার দিকে এগিয়ে আসছে ।
চোখ মেলে দেখি নিহিন আমার দিকে তাকিয়ে আছে ! চোখ ফোলা ! কেঁদেছে নিশ্চয়ই ! এই বেকুব মেয়েটাকে নিয়ে আর পারা গেল না । এতো কান্না কাটির কি আছে ?
আমি বললাম
-হাই !
নিহিন কোন কথা বলল না ! আমার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষন ! আমি আবার বললাম
-কি হল ? এমন ভাবে তাকিয়ে আছিস কেন ? ভেবেছিলি মরে গেছি ? আবার জীবিত হয়ে তোকে জ্বালাতে এসেছি !
-দেখ ফালতু কথা বলবি না ! মাইর খাবি !
-দে কিছু তো খেতে দে ! খিদা লাগছে !
-সত্যি খিদে লেগেছে !
-হুম !
নিহিনের ভিতর কেমন একটা চাঞ্চল্য দেখা গেল ।
-আমি এখনই কিছু নিয়ে আসছি ! কি খাবি বল ?
-আপাতত একটা চুম দিতে পারিস !
-থাপ্পর খাবি !
নিহিনের মুখে হাসি ফুটেছে ! আমার জ্বালাতন আর দুষ্টুমীতে সব থেকে বেশি নিহিন মজা পায় । সেই প্রথম থেকেই ! নিহিন বাইরে চলে গেল !
আমি হাপাতালের বেডে উঠে বসলাম ।
ঘরের চারিদিকে তাকাতেই আমার মনটা ভাল হয়ে গেল । আসলে হাসপাতাল যে এমন সুন্দর হতে পারে আমার ধারনা ছিল না । ঠিক হাসপাতাল না ! প্রাইভেট ক্লিনিক !
ভাগ্যভাল যে এটা নিহিনদের ক্লিনিক ! তা না হলে আমার মত ছা-পোষা মানুষের পক্ষে এখানে একদিন থাকাটা কল্পনা করা যায় না !
আমি এসির জোরটা বাড়িয়ে দিয়ে পুরানো দিনের কথা ভাবতে থাকি !
এই তো কদিন আগেই হঠাৎ করেই যেন আমার রোগটা ধরা পড়লো ! কি একটা নাম বলল যেন !
মনেও নাই ! কেবল একটাই সমস্যা । কম্পিউটারের হার্ড ডিস্ক যেমন করে ক্রাস করে আমার মাথার ভিতরেও তেমন করে ক্রাস হচ্ছে । কিছু ক্যামিক্যাল রিয়েকশন গোলমাল বেঁধে গেছে মনে হয় !
আমি প্রথম যে ডাক্তারের কাছে গিয়ে ছিলাম তিনি বেশ কিছু টেষ্ট করতে দিয়েছিলাম ! নিহিনদের ক্লিনিক আছে সাথে ডায়গনেষ্টিক সেন্টার আছে । ভাবলাম ওদের ওখান থেকে করালে মনে হয় একটু কম লাগবে ! ছা-পোষা মানুষ । টিউসনী করে দিন যায় ! বাবা একজন রিটায়ার্ড পারসন ! তার কাছ থেকে কিছু চাওয়া মানে তাকে খানিকটা বিপদে ফেলা । এমনিতেই আমাকে নিয়ে চাচা চাচীদের কাছে বেশ বিপদেই আছেন তিনি ! তাই নিজের টাকা দিয়েই সব কিছু করতে হয় !
নিহিনকে বলতেই ও সব ব্যবস্থা করে দিল ! ওর বড় ভাই একজন ডাক্তার । ওদের ওখানেই আমার চেক-আপের ব্যবস্থা করে দিল ।
দুদিন পরে যখন ওর বড় ভাইয়ের কাছে গেলাম রিপোর্ট নিয়ে । তিনি আমার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর হয়ে গেলেন । আমাকে বললেন
-তুমি একাই এসেছ ?
-জি !
ভাইয়া আসলেই একটু চুপ করে গিয়েছিলেন । তখনই আমার মনে হল কিছু একটা হয়েছে ! ভয়ংকর কিছু !
তিনি বললেন
-তোমার এরকম কবে থেকে শুরু হয়েছে ?
-এই ভার্সিটির শুরুর দিক থেকে !
-তখন চেক-আপ কর নাই ?
-না মানে এতো গুরুত্ব দেই নাই । মনে করেছিলাম ঠিক হয়ে যাবে ! এমনি হচ্ছে !
-আশ্চর্য এতো অবহেলার কোন মানে আছে ?
ভাইয়া আর কিছু না বলে চুপ করে রইলেন । কিছু যেন বলতে গিয়েও বলতে পারছেন না ! আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল আমি আর বেশি দিন বাঁচবো না । এরকম মনে হবার কোন কারন নাই । তবুও আমার ঠিক এমনটাই মনেহল ! আমি বললাম
-আমার হাতে কদিন সময় আছে । প্লিজ বলেন ভাইয়া ।
ভাইয়ার মুখের ভাবটা একটু পরিবর্তন হল ! আসলে আমার কেন জানি মনে হয় তার চেহারার উপর থেকে একটা বোঝা সরে গেল । আমাকে নিশ্চই কিভাবে কথাটা বলবেন এটা ঠিক মত বুঝতে পারছিলেন না । আমি বলাতে একটু হালকা হলেন !
তবুও অনেকক্ষন চুপ থাকার পর ভাইয়া বললেন
-তোমার মাথার ভিতরকার গ্রন্থিগুলো কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছে আস্তে আস্তে । যে ক্যামিক্যাল গুলো মাথাকে সচল রাখার জন্য জরুরী সেগুলো বের হচ্ছে না ঠিক মত । খুব বেশি দিন নেই আর ।
কেন জানি কান্না এল না । মা থাকলে হয়তো খবরটা শুনে খুব কাঁদত । এখন যেহেতু নাই কেঁ আর কাঁদবে আমার জন্য?
বাবা একটু কাঁদবে !
জোয়ান ছেলে তার আগেই মরে যাচ্ছে এটা তো যে কোন বাবার জন্যই কষ্টের ।
আর কে কাঁদবে ? চাচা চাচীরা ? মামা মামী ?
মায়ের চলে যাওয়ার পরে তাদের চেহারাও দেখি কোন দিন । এখন দেখলে হয়তো চিনবোও না ।
নিহিন ?
এই মেয়েটা কাঁদবে খুব । কাছের মানুষ বলতে এই মেয়েটাই তো আছে ! আমার ধরে কাছে বলতে এই মেয়েটাই আমার সব কিছু !
আমি ভাইয়াকে বললাম
-নিহিনকে কিছু বলবেন না প্লিজ । ও খুব কান্না কাটি করবে !
-আচ্ছা ।
আমি রিপোর্ট গুলো ভাইয়ার কেবিনে রেখেই বের হয়ে এলাম । কি হবে আর এসব রেখে ।
ঐ দিন সন্ধ্যায় নিহিনের ফোন । একবার মনে হল না ধরি কিন্তু পরে মনে হল ধরি ।
-কোথায় তুই ?
-এই তো হাটছি ।
-কোথায় হাটছিস ?
-এই তো ।
-মিন্টু রোডে ?
-হুম !
নিহিন ভাল করেই জানতো আমার মন ভাল থাকলে বা খারাপ হলে আমি এই খানে আসি । সন্ধ্যার কিছু পরে নিহিন আসলো । আমি তখন বড় কাঠ গোলাপের তলায় বসেছিলাম । নিহিনকে আসতে দেখছিলাম । আজকে ও গাড়ি নিয়ে আসে নাই ।
হঠাৎ ও কেন যেন দৌড়াতে শুরু করলো । আমি উঠে দাড়ালাম ! যেন কত দিন পরে আমার সাথে ওর দেখা হচ্ছে এমন কিছু । বাংলা সিনেমায় দেখা যায় না যেমন করে নায়িকা নায়কের দিকে দৌড়ে আসছে ওমন করে । বলা নেই কওয়া নেই আমাকে এসে জড়িয়ে ধরলো । আসলে মন খারাপ ছিল । নিহিনের জড়িয়ে ধরাটা কেন জানি ভাল লাগলো ।
কিছুক্ষন পরেই আবিষ্কার করলাম নিহিন কাঁদছে । প্রথমে একটু ফোঁপানো । তারপর আস্তে আস্তে ফোঁপানো বাড়তেই থাকলো । আমি ওকে জড়িয়ে ধরে রাখলাম ।
-এই নে । কেক । তোর পছন্দের । আর এই কলাটা খাবি ।
-উহু কলা খাবো না । তুই জানিস আমি কলা পছন্দ করি না একদম ।
-না করলেও খেতে হবে । কোন কথা হবে না ।
নিহিনের জোর দেখে ভাল লাগে । ইদানিং আমার উপর ও ভাল জোর খাটাচ্ছে ।
-জানিস আজকে একটা মেয়েকে দেখেছি ।
-কি ? মেয়ে ?
-টিনি নামে একটা কুকুর আছে তার ।
-তো ? কুকুর আছে দেখেই পাগল হয়ে গেলি ?
-আরে না । মেয়েটা দারুন দেখতে ! আর মেয়েটা দারুন একটা পোষাক পরে ছিল । একদম সাদা । সাদা …
নিহিন আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল
-আচ্ছা ঠিক আছে । আপনার পছন্দের কথা আমি জানি । আর বলতে হবে না । আশ্চর্য আমি বুঝি নি কি আছে ঐ পোষাকে ! লুল কোথাকার !
-কি লুল ? আমি লুল ?
-লুল নয়তো কি ?
-যেখানেই যাস লুলামী শুরু !
-শোন তুই তো কোন দিন পরিস নাই তাই তুই বুঝতে পারবি না । পরলে বুঝতি ।
নিহিনের যাওয়ার সময় হয়ে গেছে । ও আমার কপালে ছোট্ট একটা চুম খেয়ে চলে গেল । যাওয়ার আগে বলল
-আজকে আর বের হওয়ার দরকার নাই । আর যদি খুব বের হতে ইচ্ছা করে তবে অবশ্যই হামিদ কে নিয়ে যাবি ।
-আচ্ছা ।
হামিদ নিহিনের ড্রাইভারের নাম । এখন অবশ্য সে আমার ড্রাইভার । ইদানিং খুব ঘন ঘন মাথার ভেতর চক্কর দিয়ে ওঠে । বাইরে বের হলে কোথায় মাথা ঘুরে পড়ে থাকবো তাই নিহিনের এই সাবধানতা ।
ঐ সন্ধ্যার পর দিনই নিহিন একপ্রকার জোর করেই আমাকে ওদের ক্লিনিকে ভর্তি করিয়ে দিল । কোন কথাই শুনলো না আমার । কেবিনে বসে থাকতে থাকতে যখন বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিলাম তখনই বের হতে চাইতাম । নিহিন কিছুতেই আমাকে বের হতে দিবে না । শেষে ড্রাইভারের সঙ্গে নেওয়া সাপেক্ষে আমাকে যেতে দিতে সম্মত হল । আমি রাস্তায় হাটাহাটি করি হামিদ একটা নির্দিষ্ট দুরুত্ব রেখে আমাকে ফলো করে । নিজেকে কেমন ভিআইপি ভিআইপি লাগে ।
আমার একটা সময় মনে হত আমার বাঁচা মরা নিয়ে বাবা আর নিহিন ছাড়া আর কারই তেমন কোন মাথা ব্যাথা নাই । কেউ হয়তো আমাকে দেখতেও আসবে না কোন দিন । কিন্তু এই ক্লিনিকে ভর্তি হবার পর থেকেই একে একে সবাই আসতে লাগলো ।
এমন কত গুলো লোক আছে যাদেরকে আমি চিনিও না ।
আশ্চর্য !
বাবা আসতেন প্রতিদিন দুপুরে কিছু পরে । এসে চুপচাপ বসে থাকতেন আমার বেডের পাশের চেয়ারটাতে । মুখে একটা অপরাধীর ভাব থাকতো । জোয়ান ছেলে চোখের সামনে মরে যাচ্ছে । তিনি কিছু করতে পারছেন না এই জন্য হয় তো নিজেকে অপরাধী ভাবছেন !
যখন আমার বয়স আট বছর তখন আমার বাবা আর মায়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় । তখন থেকেই দেখতাম বাবার ভিতর কেমন একটা অপরাধীর ভাব । আমি সামনে আসলেই তার অপরাধী ভাবটা বেড়ে যেত । মায়ের চলে যাওয়াটায় তিনি হয়তো নিজেকে দোষী ভাবতেন ।
বেশির ভাগ সময়েই বাবা যখন আসতেন আমি তখন ঘুমিয়ে থাকতাম । ঘুম থেকে উঠে দেখতাম বাবা বসে আছে । চুপচাপ । মুখে সেই অপরাধীর ভাব নিয়ে ।
প্রথম যেদিন এসে হাজির হল আমি অবাক হয়ে বললাম
-আপনি কোথা থেকে খোজ পেলেন ?
বাবা শান্ত গলায় বললেন
-তোর বন্ধু খবর দিয়েছে । বাইরে কি গরম পরেছে দেখেছিস ? এখানে আসতে আসতে একদম ঘেমে গেছি ।
তারপর এসির দিকে তাকিয়ে বলল
-কি রে ঐ কি চালু হয় ?
-হবে না কেন ?
-দেখি একটু চালা দেখি ।
-এসি চালুই আছে । বুঝতে পারছেন না ?
-তাই নাকি ?
এই বলে বোকার মত হেসে ফেললেন । এসি চালু আছে কি নেই এটা বুঝতে না পারাটা যেন খুব বোকামীর কাজ । নিহিনকে পরে জিজ্ঞেস করলাম
-বাবাকে কেন খবর দিয়েছিস ?
-এমনি ।
-এমনি মানে কি ?
-দেখ । তুই তার একমাত্র ছেলে । এইটুকু অধিকার নিশ্চই তার আছে ।
আমি কিছু বলতে পারলাম না । আসলে আমি বাবাকে জানাতে চাই নি একদিন হুট করে শুনবেন আমি মরে গেছি তাই ভাল ।
আস্তে আস্তে আমার বন্ধুবান্ধব আত্মীয় স্বজন সবাই দেখা করতে এল । কোথা থেকে খোজ পেল কে জানে ? বড় চাচা এলেন একদিন । মাটির হাড়ির একহাড়ি রসগোল্লা নিয়ে । এমন একটা ভাব যেন রোগী দেখতে আসেন নি বেয়াই বাড়ি এসেছেন । অবশ্য বড় চাচা সব সময়ই আমাকে খুব আদর করতাম ।
বাবা মেঝ ছেলে হলেও আমিই ছিলাম বংশের বড় ছেলে । কিন্তু বছর পাঁচেক আগে চাচার সাথে একটা বিষয় নিয়ে আমার কথা কাটাকাটি হয় । তারপর থেকেই তার সাথে আমার কথা বলা বন্ধ ছিল । তার বাসায় যাওয়াও বন্ধ ছিল ! আমি তার কথা অমান্য করেছিলাম । আমি ভেবেছিলাম তিনি হয়তো আমার সাথে দেখা করতেই আসবে না । কিন্তু এলেন । চাচা জানতেন আমি রসগোল্লা খুব পছন্দ করি ।
চাচা সব সময়েই খুব হইচই করতেন । কোন কিছু একটু দেরি হলেই তার সহ্য হত না । আমার রুমে আসার আগে কি একটা কারনে রিসিপ্টশনে তাকে আটকিয়েছিল । একটু যেন দেরী হচ্ছিল । তাতেই বড় চাচা চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দেন । শেষে নিহিন গিয়ে তাকে শান্ত করে নিয়ে আসেন । কেবিনে ঢুকেই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন
-কি রে ব্যাটা ? আসিস কেমন ?
-ভাল আছি । আপনি ভাল আছেন ?
-এই তো ভাল আছি ।
এই বলে একটা শান্তির হাসি দিলেন । একটু আগে যে তিনি হইচই করে পুরো ক্লিনিক মাথায় তুলেছেন এটা যেন মনেই নেই তার । আমাকে মিষ্টির হাড়ি এগিয়ে দিয়ে বললেন
-নে ব্যাটা । একদম কালীপদোর খাটি রসগোল্লা । দাড়িয়ে থেকে বানিয়ে নিয়ে এসেছি । একটা খেলে জীবনেই ভুলবি না আর ।
আমি রসগোল্লার হাড়িটা হাতে নিলাম ।
-তোর আবার মিষ্টি খাওয়াতে বারন নাই তো ।
-না । না । কোন মানা নাই । শেষ সময়ে আবার কি এতো বিধি নিষেধ ।
দেখলাম চাচার মুখ গম্ভীর হয়ে গেল মুহুর্তের ভিতর । দুরে দাড়িয়ে থাকা নিহিনের চেহারাও কেমন কালো হয়ে গেছে । আমি পরিবেশ হালকা করার জন্য বললাম
-নিলুমার কি খবর ? ও এখন কোন ক্লাসে উঠেছে ।
এই নিলুমার সাথেই চাচা আমাকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন । চাচার নিজের কোন ছেলে ছিল না তাই চেয়েছিলেন বংশের ছেলেই তার বংশের হাল ধরুক । তখন অবশ্য নিলুমা খুব ছোট । স্কুলে পড়ে । আমি রাজি হই নাই !
চাচা বললেন
-এই তো আছে । এবার বিএ ভর্তি হয়েছে । মূর্খ মেয়ে তো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে নাই । তুই ই বল আমার কি অতো টাকা আছে যে প্রাইভেটে পড়াবো । তাই বিএ তে ভর্তি করিয়েছি ।
এই কথা বলতে বলতে বড়চাচা বাচ্চাদের মত কেঁদে ফেললেন ।
সেদিন নিহিন যখন আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল সেদিন মনে হয়েছিল হয়তো একটু তাড়াতাড়িই চলে যাচ্ছি ।
বাবার অপরাধীর মত মুখটা যখন দেখি তখনও মনে হয় যেন বাবার সাথে আর কটাদিন থাকা দরকার ছিল ।
আজ বড় চাচাকে এভাবে কাঁদতে দেখে মনে হল সত্যি আর কটাদিন এই প্রিয় মানুষ গুলোর মাঝে বেঁচে থাকাটা খারাপ হত না ।
আমি উঠে গিয়ে চাচাকে জড়িয়ে ধরলাম । চাচা যেন আরো জোরে কেঁদে উঠলেন । আমার চোখও ভিজে উঠল । দুরে দাড়িয়ে থাকা নিহিনের চোখ দিয়েও তখন পানি পরছে ।
দিন আস্তে আস্তে কাটতে লাগল । বলা চলে আমি মৃত্যুর দিকে একপা একপা করে এগিয়ে যেতে লাগলাম । প্রথমে ব্যাথাটা দুতিন দিন পর পর হত । কিন্তু দিন যত এগোতে থাকলো ব্যাথাটা ঘন ঘন দেখা দিতে লাগলো । কোন কোন সময় দিনে দুই বার । এরই মাঝে নিহিন আর একটা কাজ করে বসল । সকালবেলা নাস্তা করে টিভি দেখছি । মাথার ভিতর একটা ব্যাথা অনুভর করছি । বুঝতে পারছি খুব জলদিই আবার হার্ড ডিস্ক ক্রাস করবে ।
এমন সময় একটা ছয় সাত বছরের পিচ্চি মেয়ে আমার কেবিনে ঢুকলো । মেয়েটার চেহারা আসলেই মিষ্টি । হয়তো অন্য কারো কেবিনে এসেছিল । আমার এখানে চলে এসেছে । আমি মেয়েটি বললাম
-কি নাম তোমার বাবু ?
মেয়েটি মিষ্টি করে বলল
-আমার নাম অনি ! তোমার নাম কি ?
-অনি ? বাহ ! আমার নাম অপু ! আমার বোন হলে তার নাম অনি রাখতাম ! বুঝছ ?
-হুম !
-ও তোমার বোনই !
কথাটা বলল নিহিন ! আমি খানিক অবাক হয়ে বলল
-কি বলছো ?
-ও তোমার ছোট বোন ?
আমি অবাক হয়ে একবার অনির চেহারা দিকে তাকিয়ে রইলাম ! আর একবার নিহিনের দিকে ! আমি যেন কিছু বুঝতেই পারছি না । ঠিক তখনই নিহিনের পেছন থেকে এক জন মাঝ বয়সী মহিলা এগিয়ে এল ।
প্রায় ১৮ বছর পর মহিলাকে আমি দেখছি কিন্তু আমার চিনতে একটুও অসুবিধা হল না ! এ হল আমার মা !
যে আমার বাবা কে ছেড়ে চলে গিয়েছিল কেবল এই কারনে যে সে তখন ঠিক মত উপার্জন করতে পারত না বলে ! আমার কথা বিন্দু মাত্র না ভেবে সে চলে গিয়েছিল !
আমি কেবল একটা অদম্য ক্রোধ নিজের ভিতর অনুভব করলাম নিজের ভিতরে।
-নিহিন ওনাকে চলে যেতে বল !
-অপু শোন !
-দেখ তোর সব কথা আমি শুনি তার মানে এই না যে তুই যা ইচ্ছা তাই করবি !
নিহিন আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করার চেষ্টা করলেও আবার বললাম
-এখন যদি এই মহিলা এখান থেকে না আমি চলে যাবো ! আর কোন দিন আসবো না !
আমি আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলাম ঠিক তখনই আমার মাথার ব্যাথা শুরু হল ! চোখের সামনে সব কিছু কেমন যেন ঝাপসা হয়ে উঠলো মুহুর্তের ভিতরই ! আমার আর কিছু মনে নাই !
যখন আবার ঘুম ভাঙ্গল দেখি বাবা আবার সেই অপরাধীর মত করে বসে আছে ।
আমার ঘুম ভাঙ্গা দেখে নিহিন কে ডাক দিলেন !
নিহিন আমার কাছে এসে বলল
-তুই তো ভয়ই পাইয়ে দিয়েছিলি ! এভাবে কেউ রেগে যায় ?
আমি কিছু বললাম না ।
বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-এতো কেন রেগে যাস ? নে এটা নে !
বাবা আমার দিকে একটা আই ফোন টাইপের কিছু এগিয়ে দিল !
হাতে নিয়ে দেখলাম আরে সত্যি তো এটা আই ফোন !
আমি অবাক হয়ে বললাম
-কি সবন্যাস ! এই আইফোন আপনি কোথায় পেলেন ?
-তুই একবার চেয়েছিলি !
-কবে ?
-ঐ যে যখন ভার্সিটির প্রথম ভর্তি হয়েছিলি !
আমি অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলাম । বাবাকে কেন জানি একটু অপরিচিত মনে হচ্ছে !
সত্যি আমি যখন ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিলাম তখন বাবা কাছে একটা টাচ ফোন চেয়ে ছিলাম । তবে সেটা আই ফোন না অবশ্যই !
বাবা তখন দিতে পারে নাই !
-আপনি এটা কেন কিনেছেন ? এতো টাকা আপনি কোথায় পেলেন ?
বাবা কিছু না বলে চুপ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো !
-আপনি আপনার পেনশনের টাকা নষ্ট করেছেন তাই না ?
বাবা এবার একটু হাসলেন !
-তোকে তো কিছু দিতে পারি নি কোন দিন ! এটা নে !
আমার চোখ কেন জানি আবার ভিজে উঠল ! আমি চোখের পানি আটকানোর চেষ্টা করলাম না !
বাবা বলল
-আমি যাই ! আমার একটু কাজ আছে !
-আচ্ছা ! কালকে আবার আসবেন !
-একটা কথা বলব ?
-বলেন !
-তোর মায়ের উপর রাগ রাখিস না ! তখন আমার অবস্থা ভাল ছিল না । যে কোন মেয়ে তো চাইবে একটু সুখে থাকতে ! তুই রাগ রাখিস না !
বাবা দাড়ালেন না আর !
নিহিন মনে হয় বাইরেই দাড়িয়ে ছিল । বাবা বের হতেই ঘরে ঘুকলো !
-আই ফোন !
-হুম ! দেখ ! এখন আমারও আই ফোন আছে !
-হুম ! এখন তোর বাবা কাছে কথাটা বলা যায় !
-কোন কথাটা ?
-একসময় বলতাম চৌধুরী সাহেব আপনার মেয়ে আইফোন চালায় আমি আমি মাইফোন চালাই ! তাই বলে কি আমার প্রেম ছোট করে দেখবেন ?
-আর এখন ?
-আর এখন বলব আপনার মেয়েও আইফোন চালায় আমিও আই ফোন চালাই ! হা হা হা হা !!
-আহা !! আই ফোন দেখেই চৌধুরী সাহেব রাজী হয়ে যাবে ?
-যাবে তো ! এই শোন না ?
-কি ?
-তুই আজকে আমার সাথে বের হবি ! সন্ধ্যার সময় !
-কোথায় ?
-মিন্টু রোডে ! ওখানে তোর হাত ধরে হাটবো ! হাটবি ?
নিহিন কিছু বলল না !
-আর !
-আর ?
-আমার ঐ পছন্দের পোষাকটা পরবি !
-জি না ! পরবো না ! এমনি যেতে পারি ! আমি ঐ জিনিস কোন দিন পরবো না !!
সন্ধ্যা এখনও হয় নাই পুরোপুরি ! সূর্যের লাল আলো নিভে যায় নি !
মিন্টু রোডে আমি হাটছি ! আমার পাশে নিহিন ! লাল আলো নিহিনের সাদা সেলোয়ার কামিজের উপরে কেমন একটা অন্য রকম একটা আভা সৃষ্টি করছে ।
নিহিন যদিও বলেছিল যে পরবে না কিন্তু আমার পছন্দের পোষাক পরেই ও আমার পাশে হাটছে ! আমার হাত ধরে !
কেন জানি নিহিনের সাথে আরো কয়টা দিন বেশি বাঁচতে ইচ্ছা করছে ! নিয়তির কাছে বড় বেশি অসহায় মনে হচ্ছে নিজেকে !
আমরা হাটছি ! রাত নামছে !! সিমেন্টের জঙ্গলে রাত নামছে !!
One Comment on “আমার মৃত্যু বেলার গল্প”
Comments are closed.
গল্পটা যতোবার পড়েছি,কেমন যেন আমার খুব কষ্ট লাগে। ভেঙ্গেচুরে যাওয়া টাইপ কষ্ট। মনে হয় আমার সাথেই এমন হচ্ছে।আমিই এই গল্পের অপু। যদিও আমি সম্পুর্ন সুস্থ একজন মানুষ।