নাদিয়া আইরিন

oputanvir
4.7
(85)

-আরে শ্লা তলে তলে এতো দুর !

আমি সাদির কথার আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারলাম না । না বুঝতে পেরে বললাম, কি বলছিস?
সাদি আবার বলল, ঢং করিস না । সব কিছু ধরা পড়ে গিয়েছে আবার ঢং করতেছো !
-আরে বাবা কি হয়েছে বলবি তো ? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না ।
-তোর যে তলে তলে নাদিয়া আইরিনের সাথে প্রেম চলে এইটা কোন দিন স্বীকার করোস নাই । এতো বড় দাও মারলি কিভাবে বলতো দেখি?
নাদিয়ার নাম টা শুনতেই আমি একটু চমকে গেলাম । কি ব্যাপার, এই নাম সাদি জানলো কিভাবে ! নাদিয়ার নাম জানাটা সমস্যা না । সমস্যা হচ্ছে আমার সাথে তার পরিচয় এটা কিভাবে জানলো সে ? এমন তো হওয়ার কথা না । আমি কোন মতে বললাম, কি বলছিস তুই? কোথায় নাদিয়া আইরিন আর কোথায় আমি !
সাদি আমাকে বলল, শুনো বেটা #$% । আমার সাথে এতো ঢং করবি না । ওর ফেসবুক পেইজে গিয়ে দেখ । তোর চেহারা যদিও পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে না তবে যারা তোকে চেনে তারা ঠিকই চিনে ফেলবে এটা তুই ।

আমি ফোন রেখে ফেসবুক ওপেন করলাম এবং বুকের ভেতরে এসে একটা ধাক্কা লাগলো । নাদিয়া আমার সাথে তোলা একটা ছবি আপলোড দিয়েছে । তবে আমার চেহারা বোঝা যাচ্ছে না । তবে সাদি সত্যিই বলেছে যে আমাকে যারা ভাল করে চেনে তারা ঠিকই চিনতে পারবে । আমি সাথে সাথে নাদিয়াকে ফোন দিলাম । রিং বাজার সাথে সাথে ফোন ধরলো ও । যেন ফোনটা হাতে নিয়েই ছিল ও । আমি বললাম, এসব কি?
-কি মানে কি? তোমাকে আসতে বললাম আসলে না কেন?
-আমি মিটিং এ ছিলাম ।
-গুলি মারো তোমার মিটিংয়ের । আমি ডেকেছি মানে আসতে হবে। এরপর যদি এইরকম হয় তাহলে ঐ ছবিটা আছে না ঐ যে তোমার খালি গা ….
আমার শরীর কেঁপে উঠলো । নাদিয়ার সাথে আমার বেশ কিছু ছবি রয়েছে । এমন কিছু ছবি আছে যারা মানুষের সামনে প্রকাশ হলে আমার নাদিয়ার দুজনেরই খবর আছে । কিন্তু নাদিয়ার কি সেই ভয় আছে ! সে কি এসবে কিছু ভয় পায় !
নাদিয়া বলল, বুঝতে পেরেছো তো কোন ছবির কথা বলছি । সেই ছবি পোস্ট করবো । সাবধান । কালকে অফিস বন্ধ । সোজা বাসায় আসবে ।
-বিকেলে আসি ।
-না সকালে ! সকালে সকালে সকালে !
-আমি বুঝলাম এর সাথে তর্ক করে লাভ নেই । ও যখন বলেছে সকালে আসতে হবে তখন সকালেই । নয়তো আবার কি করবে কে জানে ! আমি বললাম, আচ্ছা বাবা সকালে । সকালে আসবো । ঠিক আছে ।
-গুড বয় । এখন ঘুম দাও । গুড নাইট !

নাদিয়াকে চেনে না এমন মানুষ বুঝি খুব কমই আছে । আমিও তাকে চিনতাম আগে থেকেই । কিন্তু কোনদিন ভাবতে পারি নি যে এই মেয়ের সাথে আমার একদিন ভাব হয়ে যাবে । কিভাবে যে হয়ে গেল সেটা আমি নিজেও জানি না ।
নাদিয়াকে বলা যায় অনলাইন সেলিব্রেটি । তার প্রতিটা স্টাটাসে হাজার হাজার লাইক পরে । আর কত যে কমেন্ট আসে তার কোন সীমা নেই। সেই সাথে তার লেখার হাতও বেশ চমৎকার । যে কোন বিষয় নিয়ে নাদিয়া চমৎকার লেখালেখি করতে পারে । বই মেলাতে কয়েকটা বই বের হয়েছে এবং সেগুলো বেস্ট সেলারও হয়েছে । কিন্তু এসব ছাড়াও তার অন্য যে প্রধান পরিচয় রয়েছে সেটা হচ্ছে সে একটি বে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা । আমার সাথে তার পরিচয় ঠিক এখানেই । আমি সেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ইভিনিং এমবিএ করেছি এবং নাদিয়া সেখানে আমার ক্লাস নিত । সেখান থেকেই ওর সাথে আমার সরাসরি পরিচয় ।

সেদিনের ঘটনা আমার পরিস্কার মনে রয়েছে । ক্লাস শেষ করে সেদিন বের হতে হতে বেশ রাতই রয়েছে যায় । আমার এক প্রোফেসরের সাথে একটা টপিক নিয়ে কিছু কথা ছিল । সেটা শেষ করে সিড়ি দিয়ে একতলা নিচে নামতেই নাদিয়াকে দেখতে পেলাম । রাত হয়ে যাওয়ার কারণে ছাত্রদের ব্যবহার করার লিফট বন্ধ হয়ে গেছে । সুতরাং সিড়ি দিয়েই নামতে হল । এক তলা নামতেই নাদিয়াকে দেখতে পেলাম । নিজের কেবিনের সামনে একটা বারান্দা । সেই বারান্দার রেলিং ধরে দাড়িয়ে রয়েছে । একটা পা তুলে রেখেছে একটা প্লাস্টিকের চেয়ারের উপরে । প্রতিটি অফিসের সামনে পিয়নদের বসার জন্য একটা চেয়ার থাকে । এটা সেই চেয়ার । নাদিয়ার হাতে জলন্ত সিগারেট !
পুরো করিডোরটা অন্ধকার । কেবল তার অফিসে আলো জ্বলছে । সেই আলোতে নাদিয়াকে দেখা যাচ্ছে । সে আপন মনে সিগরেট টানছে । আমার নিঃশব্দে কেটে পরার জন্য পা বাড়ালাম তখনই অদ্ভুত কান্ডটা ঘটতে দেখলাম । দেখলাম পাশের চেহারে সে দুই পা তুলে উঠে দাড়ালো । তারপর একটা একটা পা দিল রেলিংয়ের উপরে । আমার মোটেই বুঝতে কষ্ট হল না কি হতে যাচ্ছে ।
নাদিয়া সুইসাইড করতে যাচ্ছে !
ও মাই গড !
আমার মাথায় আর অন্য কিছু এল না । আমি ব্যাগ রেখে সিনেমার নায়কদের মত দৌড় দিলাম নাদিয়াকে বাঁচাতে ।

কিন্তু সিনেমার মত কিছুই ঘটলো না । আমি এতোই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম আর বারান্দাটা একটু অন্ধকার হওয়ার কারণে ছোট ফুলের টবটা আমার চোখ পড়লো না ঠিক মত । সেটাতে পা বেঁধে হুড়মুড় করে পড়লাম নাদিয়ার সামনে । হাটুতে বেশ ভাল ব্যাথা পেলাম । যখন মাথা তুলে তাকিয়েছি দেখি নাদিয়া আমার দিকে খানিকটা অবাক আর বিরক্তমাখা চোখে তাকিয়ে রয়েছে ।
বলল, এভাবে দৌড়ানোর মানে কী?
-না মানে আপানকে দেখছিলাম যে ….
-ভাবলেন যে আমি ঝাপ দিবো? আমি নিজে ফেসবুকে এতো এতো মোটিভেশনাল স্পিচ দিয়ে আমি নিজেই সুইসাইড করবো এমনটা ভাবছিলেন ?
-আসলে …..
-বেশি স্মার্ট নেস দেখাতে যাবেন না কোথাও । তাহলে এমন করে হুড়মুড় করে পড়বেন । বুঝেছেন?
-জি !

আমি প্যান্টের ধুলা ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে দাড়ালাম । ঘুরে চলে যাচ্ছিলাম তখন নাদিয়া ডাক দিল । আমি ঘুরে দাড়ালাম । নাদিয়া বলল, আপনার প্যান্ট ছিড়ে গিয়েছে । কেটেও গিয়েছে দেখা যাচ্ছে । অফিসে আসুন । স্যাভলন লাগিয়ে দিচ্ছি ।
-না ঠিক আছে । খুব একটা সমস্যা নেই ।
-সমস্যা নেই বুঝলাম । আসুন !

আমার জন্য অপেক্ষা না করে সে নিজের অফিসের ঢুকে পড়লো । আমি বাধ্য হয়ে তার পিছু পিছু তার অফিসে ঢুকলাম । একটু পরে দেখি সে নিজেই যত্ন করে আমার ছেলা অংশে স্যাভলন লাগিয়ে দিল । এবং ঘটনা এখানেই থেমে থাকলো না । সে নিজের গাড়িতে করে আমাকে আমার বাসার সামনে । এই ছিল আমাদের মাঝে সরাসরি পরিচয় হওয়ার প্রথম দিন ।
আমি ভেবেছিলাম হয় এই ঘটনা এখানেই শেষ হয়ে যাবে । তবে সেখানে শেষ হল না ।

আমি খুব ভাল করেই জানতাম যে নাদিয়া আইরিন আর আমার রাস্তা একেবারে আলাদা । কোন ভাবে সেটা একে অন্যের দিকে মিশ খাওয়ার মত না । খাওয়ার কথাও না । আমি তেমনটা ভেবেই পরদিন অফিসের পরে ক্লাস করতে হাজির হলাম । ক্লাস শেষ করে যথারীতি বের হতে যাবো তখন একজন পিয়ন এসে আমাকে বলে গেল যে আমাকে নাকি নাদিয়া ম্যাম তার অফিসে দেখা করতে বলেছে । একটু অবাক লাগলো । নাদিয়া আইরিনের ক্লাস আমাদের সপ্তাহে একদিন । আজকে তার ক্লাস ছিল না । তাই আজকে তার সাথে দেখা হয় নি ।

আমি আস্তে ধীরে তার অফিসের সামনে গিয়ে হাজির হলাম । সে নিজের ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে কী যেন করছিলো । আমাকে আসতে দেখে সেটা বন্ধ করলো । তারপর বলল, আসুন। বসুন !
আমি রুমের ভেতরে ঢুকলাম । আমাদের ক্লাসের বেশির ভাগ স্টুডেন্টই আমার মত সবাই অফিসগামী । এবং প্রায় সবাই নাদিয়া আইরিনের চেয়ে বয়সে বড় কিংবা সম বসয়ী । তবে এই ব্যাপারটা নাদিয়াকে মোটেও অস্বস্তিতে ফেলে না । বরং এটা যেন সে বেশ উপভোগ করে । এবং পুরো ক্লাস তার নিয়ন্ত্রনে থাকে বেশ ভাল ভাবেই । সব সময় চোখে একটা কর্তৃত্বের ভাব লেগেই থাকে । ঠিক এখন যেমনটা লেগে রয়েছে । আমার কেন জানি মনে হল যে আমাকে সে ডেকে এনেছে গতকালকের জন্য ধমক দিতে । আমি তার সামনে একটু শান্ত হয়ে বসলাম । সে আমার দিকে একভাবে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে বলল, মিস্টার অপু হাসান !
-জি বলুন ।
-আপনার পায়ের কী অবস্থা ? ব্যাথা আছে?
-একটু । তবে সমস্যা নেই । জলদিই সেরে যাবে ।
-কালকে ওভাবে কেন দৌড় দিলেন শুনি? সত্যিই ভেবেছিলেন যে আমি লাফ দিবো?

আমি একটু অস্বস্তিতে পড়লাম । আমার গতকাল সত্যই এমনটাই মনে হয়েছিলো । বললাম, আসলে আমি সত্যিই ভেবেছিলাম যে আপনি লাফ দিতে যাচ্ছেন । ওভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে আমার আসলে সেটাই মনে হল ।
-তারপর কী মনে হল? নায়কের মত আমাকে রক্ষা করে ফেলবেন । তাই তো ! তারপর আমাদের মাঝে প্রেম হবে ভালোবাসা হবে ?
আমি একটু অস্বস্তিতে পড়লাম । তারপর বললাম, আসলে ওটাতো ভাবি নি । তবে রক্ষা করতে চেয়েছিলাম । এটা সত্যি ।

নাদিয়া বেশ কিছুটা সময় আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো । তারপর আমাকে খানিকটা অবাক করে দিয়ে বলল, আমি সত্যি সত্যিই গতকাল লাফ দিতে যাচ্ছিলাম । আপনি না আসলে হয়তো লাফ দিয়েও ফেলতাম !
-সেকি !
-হ্যা ।
-কেন ?
-জানি না । কেন জানি নিজের উপরে আর নিয়ন্ত্রন থাকে না । কী যে করি কখন করি সে সব আমার আয়ত্ত্বের বাইরে চলে যায় মাঝে মাঝে । কালকে অনেকটা সময় এসব নিয়ে ভাবছিলাম । তারপর মনে হল এই জীবন আর রাখবো না । অবশ্য এটা নিয়ে আমি অনেক দিন ধরেই ভাবছিলাম ।
-এসব কী বলছেন আপনি ? আপনাকে কত মানুষ ফলো করে জানেন?
-জানি । কিন্তু আমি কী করবো ?
আমি বললাম, এক কাজ করুন । সব কিছু থেকে একেবারে ছুটি নিন । সব কিছু থেকে । কয়েক দিনের জন্য কোথা থেকে ঘুরে আসুন । নিজের ফোনটা বন্ধ রাখুন । কোন প্লান না । কেবল মনে যা আসবে তাই করুন । দেখবেন আবার সব কিছু ঠিক লাগছে ।
নাদিয়া হাসলো । তারপর বলল, আমার কথা আমাকেই শোনাচ্ছেন ?
-অনেক টা ।
-তাহলে চলুন আপনিও ।
-কী ?
-বললাম চলুন আপনিও । দেখুন আমার সব ঝামেলা সব কালকেই শেষ হয়ে যেত । কিন্তু আপনার কারণে হয় নি । তাই আপনার একটা দায় দায়িত্ব রয়েছে এর পেছনে !
-মানে কী ? কি বলছেন এসব ? আরে আমি কীভাবে যাবো ?

নাদিয়া কোন কথা না বলে আমার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে বলল, শুনুন । কোন কথা শুনতে চাই না । এই সেমিস্টারে আমার কোর্স আছে আপনার । যদি সেখানে ভাল মার্ক পেতে চান তাহলে আজকে রাতেই আপনি আমার সাথে বের হবে । আর কোন আর্গুমেন্ট শুনতে চাই না । এখন রাত আট টা বাজে । আমি ঠিক সাড়ে এগারোটার সময় আপনার বাসা থেকে আপনাকে পিক করে নিবো ।

আমি জীবনে এতো অবাক হয়েছি কিনা আমি জানি না । আমি এই পরিস্থিতিতে কোন দিন পড়বো সেটা আমি কোন দিন ভাবি নি । বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলাম । হিসাব করে দেখলাম আমি অনেক দিন বাইরে বের হয় নি, কোথাও ঘুরতে যাই নি । কাজ কর্ম আর পড়াশুনা নিয়ে এতো ব্যস্ত ছিলাম যে ঘুরাঘুরির কথা আসলে মনেই আসে নি । আর প্লান করে আমি কোন দিন কোথাও যেতে পারি নি কোন দিন । কোন না কোন সমস্যা ঠিকই সামনে চলে আসতো সব সময় । আজকে এই উছিলাতে যদি যাওয়া হয় তাহলে হোক ।

বাসা এসে দ্রুত ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম । তারপর অফিসে বসের কাছে একটা ছুটির ইমেল পাঠালাম । যদিও একটু মিথ্যা কথা লিখতে হল ইমেলেই তবুও লিখলাম ! ঠিক করলাম যে আর ইমেল খুলে দেখবো না । ইমেল বস সকালে অফিসে যাওয়ার আগে সম্ভবত দেখবে না । সুতরাং যতক্ষণে সে দেখবে ততক্ষণে আমি অন্য কোথাও থাকবো । বাসায় জানিয়ে দিলাম যে কয়েকদিনের জন্য একটু বাইরে যাচ্ছি ফোনে নাও পেতে পারো ।

সাড়ে এগাড়োটার সময় নাদিয়া ঠিকই আমার বাসায় সামনে এসে হাজির হল । আমি ওর গাড়িতে উঠতেই আমার কাছ থেকে ফোন নিয়ে নিল । তারপর সেটা সুইচ অফ করে দিয়ে একটা বক্সের ভেতরে রেখে দিল । দেখলাম সেখানে ওর নিজের ফোনটা আগে থেকেই রয়েছে । আমার দিকে তাকিয়ে বলল, যদি আমরা কোন বিপদে না পড়ি তাহলে এই ফোন ঢাকার আসার আগে আর সুইচ অন হবে না ! ওকে ?
আমি বললাম ওকে !

যদি সব কিছু আমার কাছে কেমন যেন মনে হচ্ছে । আমার এখনও ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না যে আমি নাদিয়া আইরিনের সাথে কোথাও বেড়াতে যাচ্ছি । আমার আসলে কোন ভাবেই এই মেয়েটার সাথে এখন গাড়িতে করে যাওয়ার কথা না । কিন্তু ঠিক ঠিক বেড়াতে যাচ্ছি । কোথায় যে যাচ্ছি সেই ব্যাপারে যদিও আমি নিজেও জানি না ।
গাড়ি চলতে শুরু করেছে । আমি নাদিয়াকে বললাম, আমরা তাহলে কোথায় যাচ্ছি?
নাদিয়া সামনে দিকে তাকিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে । আমার দিকে একটু তাকিয়ে আবার সামনের দিকে তাকালো । তারপর বলল, জানি না ।
-জানি না মানে কী?
-তুমি খুব মানে কী মানে কী কর ! এতো মানে জেনে কী হবে শুনি?

আমি তখন আবিস্কার করলাম যে নাদিয়া আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছে । এই মেয়ে এতো ফার্স্ট হবে কেন সব কিছুতে ?
আমিও তুমিতে নেমে আসবো ? নাকি আপনি চালিয়ে যাবো?
আমার মনের কথা যেন নাদিয়া সাথে সাথেই বুঝে গেল । একটু হেসে বলল, তুমি আমাকে তুমি করে বল । সামনের কটা দিন যেহেতু আমরা এক সাথে যাচ্ছি তাই আমাদের মাঝে আপনি টাপনি ডাকা ভাল দেখায় না । তুমিই ভাল । চল দেখা যাক সামনে আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে ।

গাড়ি ছুটে চলল অজানার উদ্দেশ্যে । নাদিয়া গাড়িতে মৃদু শব্দে গান চালিয়ে দিল। আমার দিকে তাকিয়ে নাদিয়া বলল, জানো আমার এই ভাবে অজানার উদ্দেশ্যে বের হওয়ার শখ ছিল অনেক দিনের । কিন্তু কোন দিন বের হতে পারি নি । জীবনের প্রতি এমন একটা বিতৃষ্ণা চলে এসেছিলো যে কী বলবো । এমন কিভাবে হয়ে গেলাম আমি নিজেও জানি না ।
-কেন এল এমন বিতৃষ্ণা?
-জানি না ।
আমি বুঝতে অসুবিধা হল না যে নাদিয়া কিছু একটা লুকাতে চাইছে । আমার কাছে বলতে চাইছে না । আমার কেন জানি মনে হল এর ভেতরে প্রেম ঘটিত কোন ব্যাপার আছে । কদিন আগে অবশ্য ভাসাভাসা ভাবে শুনতে পেয়েছিলাম যে কোন ক্রিকেটারের সাথে নাকি নাদিয়ার কিছু একটা চলছে । দেশ বরেন্য বিখ্যাত প্লেয়ার সে । হয়তো তাদের ভেতরে কোন সমস্যা হয়েছে । এমন কিছু হতে পারে । অবশ্য এসব নিয়ে আমার এতো চিন্তা না করলেও চলবে । যদি নাদিয়া কোন দিন বলতে চায় তাহলে বলতে পারে । না বলতে চাইলে না বলবে । আমার এতো চিন্তা করার কোন দরকার নেই ।

হঠাৎ নাদিয়া বলল, তোমার খবর বল শুনি?
-আমার খবর বলতে?
-তোমার প্রেমিকা কিংবা বউ?
-বউ ? না আমি এখনও বিয়ে করি নি ।
-সে কি ! কেন বিয়ে কর নি শুনি? ভাল চাকরি করছো? বিয়ের বয়স তো হয়ে গেছে । তাহলে বিয়ে না করার কারণ শুনি?
-আসলে এমন কোন কারণ নেই । মনের মত মানুষ এখনও পাই নি ।
নাদিয়া আমার দিকে না তাকিয়ে বলল, অপু হাসান মনের মানুষ খুজে পাওয়া সম্ভব না । বুঝতে পেরেছ? এই জগতে কেউ কারো মনের মত হয় না । সবাই আলাদা । বিয়ে করতে হলে কিছু কম্প্রমাইজ করতেই হবে । কিছু ছাড় দিতেই হবে !
-তা তুমি এখনও বিয়ে করো নি কেন শুনি?
প্রশ্নটা টা শুনে নাদিয়া কিছু সময় যেন চুপ করে রইলো । আমার মনে হল যে এই প্রশ্নটা করা একেবারে ঠিক হয় নি । তবে দেখলাম নাদিয়া সামলে নিল । আমাকে বলল, আমি বিয়ে করি নি কারণ আমি করতে পারি নি । বিয়ে করতে চেয়েছিলাম ।
-তারপর ?
-তারপর আর কি । ছেলে পালিয়েছে ।
-মানে কি?
-আবারও মানে কি !
এই বলে নাদিয়া হাসলো । গাড়িটা নির্জন রাস্তার এক পাশে দাড় করালো । ততক্ষনে খেয়াল করলাম যে আমরা অজানা একটা স্থানে চলে এসেছি । কোথায় চলে এসেছি আমি সেটা চিনতে পারলাম না ।
নাদিয়া গাড়ি থেকে নেমে পড়লো । আমিও ভয়ে ভয়ে নেমে পড়লাম। জায়গাটা কেমন হবে ঠিক বুঝতে পারছি না ।
নাদিয়া গাড়ির সাথেই হেলান দিয়ে দাড়ালো । আমি ওর পাশে গিয়ে দাড়ালাম । আশে পাশে বেশ ভাল করে চোখ বুলাতে লাগলাম । সব দিকে কেমন নির্জন হয়ে আছে ।

নাদিয়া বলল, জায়গাটা কী নির্জন । তাই না ?
-হুম । কী যেন বলছিলে?
-ও হ্যা । বিয়ে । আসলে আমিও বিয়ে করতে চেয়েছিলাম ।
-তারপর?
-তারপর সে পালিয়ে গেল । পালিয়ে গেল বলতে বিয়ে করতে চাইলো না ।

আমি কারণ টা জিজ্ঞসে করবো কিনা ভাবছি এমন সময়ে নাদিয়া আবারও বলতে শুরু করলো, তোমরা পুরুষরা খুব ভন্ড হও !
আমি মানে কি বলতে গিয়েও সামলে নিলাম । নাদিয়া বলল, তোমরা মুখে বল এক কথা আর ভেতরে অন্য কথা । এই যে সারা দিন নারী স্বাধীনতার কথা বল অথচ নিজের বউয়ের বেলায় চাও যে বউ একেবারে বাধ্যগত হবে, বাইরে কাজ করতে পারবে না, স্বামীর মুখের উপর কথা বলতে পারবে না । তোমরা আসলে বউ চাও না দাসী চাও, যে তোমার মনের মত হবে ! তুমিও তো বলল যে মনের মত কাউকে পাচ্ছো না বলে বিয়ে করতে পারছো না !

আমি প্রতিবাদ করে বলল, এটা মোটেও বলি নি । মনের মত কাউকে না পাওয়া মানে তুমি যেটা বলছো সেটা মোটেও না !
-আচ্ছা ? তো শুনি তোমার মনের মত মেয়ে কেমন ?
-শুনো আমি সারা জীবন কোন দিন ভাবি নি যে আমার বউ কথা মত উঠবে বসবে ! কোনদিনও না । বিয়ের পরে বউ কী করবে সেটা একান্তই তার নিজের সিদ্ধান্ত হবে । সে চাইলে চাকরি করবে নয়তো না । এটার ব্যাপার আমার কোন সে নেই । আমি যা বলবো সেটাও তাকে শুনতে বাধ্য হতে হবে না । সে ঠিক সেটা করবে ঠিক তেমনি ভাবে সে যা বলবে সেটাই আমাকে শুনতে হবে এমনও না । দুজন মিলে সমাধান হবে । যদি একান্তই সমাধান করা সম্ভব না হয় তাহলে আলাদা হয়ে যেতে হবে । ব্যাস এই হচ্ছে আমার চাওয়া । আর মনের মত মেয়ে বলতে আমি বুঝিয়েছে যার সাথে কথা বলে আমি শান্তি পাই, যার সাথে কথা বলার সময় যেন কখনও কথা হারিয়ে না যায় ! এটাই কেবল আমার চাওয়া ছিল । আর কিছু না !

গাড়ির হেড লাইটের আলোতে চারিদিকটা একটু আলোকিত হয়ে আছে । সেই আলোতেই দেখতে পেলাম নাদিয়া আমার দিকে অর্থপূর্ন চোখে তাকিয়ে আছে । আমি আবার বললাম, বিয়ে বল কিংবা সম্পর্ক বল, দুই উদ্দেশ্যেই আমি কয়েকটা মেয়ের সাথে মিশেছি । বিশ্বাস কর কয়েক সপ্তাহ পরেই এমন হয়েছে যে তাদের সাথে বলার মত আমি আর কোন কথা খুজে পাচ্ছি না । এমন মেয়ের সাথে কিভাবে সারা জীবন সংসার করবো ? না, আমি তাদেরকে মোটেই দোষ দিচ্ছি না । তারা কেবল আমার মনের মত নয় এবং আমিও তাদের মনের মত নই । এই যা !

নাদিয়া আমার দিকে আরও কিছু সময় তাকিয়ে রইলো । তারপর বলল, যাকে পছন্দ ছিল সে প্রথম প্রথম খুব বলতো সে সে বউ হিসাবে আমাকে চায় আমি যা করি সেসব তার খুব পছন্দ । যখন বিয়ের কথা শুরু হল তখন সে বলতে লাগলো চাকরি করলে কিভাবে সংসার হবে বাচ্চা কাচ্চা কে দেখবে ! তারপর এক সময় আমার উপর খবরদারী করা শুরু করলো । আমি যা করবো সেটা তার পছন্দ হতে হবে, নয়তো সেটা করা যাবে না এই ছিল তার বক্তব্য ! এটাই নাকি হয়ে আসছে । এটাই নাকি নিয়ম ! নিয়ম মাই ফুট !
আমি বললাম, আসলে তাকে দোষ দিয়েও লাভ নেই । সে সারা জীবন এই দেখে এসেছে তার আশে পাশে । তারা বাবা দাদারা একই ভাবে তাদের বউদের সাথে এমন আচরণ করে এসেছে ।
-সে দেখে এসেছে বলে নিজে কিছু ভাববে না? কোনটা সঠিক কোনটা বেঠিক চিন্তা করবে না? একজন মানুষ কেন অন্য একজনের এপ্রুভাল নিয়ে তারপর কাজ করতে হবে ?
আমি নাদিয়ার গলার উত্তাপ বুঝতে পারছিলাম । বললাম, আচ্ছা বাদ দাও এই কথা । যে চলে গেছে তাকে নিয়ে আর চিন্তা করে লাভ নেই ।
-আসলে বলতে চাই না । সে চলে গেছে এই নিয়ে আমার মনের ভেতরে কোন দুঃখ নেই । বরং আমি খুশি । কিন্তু আমার নিজের পরিবার এটা বুঝতে পারে নি । তাদের বক্তব্য যে দোষ নাকি আমারই । আমারই সব কিছু মেনে নেওয়া দরকার ছিল । আত্মীয় স্বজন সবাই । এতো ভাল পাত্র আমি কেন হাত ছাড়া করলাম । এমন কি ব্রেকাপের পর আমার বাবা মা তাদের বাসায় পর্যন্ত গিয়েছিলো ! নিজেকে কী যে ছোট মনে হয়েছিলো ! মেয়ে হওয়ার জন্য ঘৃণা ধরে গিয়েছিলো । সেদিন বাড়ি ছেড়ে চলে আসি আমি ।
-এখন একা থাকো ?
-হ্যা । কিন্তু তবুও চারপাশের কথা বার্তা কী ঠেকানোর উপায় আছে ! আমাকে তারা একটু একা থাকতেও দেয় না । একটু শান্তিতে থাকতে দেয় না ! মাঝে মাঝে সব কিছু অসহ্য হয়ে ওঠে ।

আমরা দুজন কিছু সময় চুপ করে রইলাম । রাতের নির্জনতা উপভোগ করতে থাকলাম । এক সময় নাদিয়া বলল, চল যাওয়া যাক ।
গাড়িতে উঠে গাড়িটা স্টার্ট দিতে গিয়েই বাঁধলো বিপত্তি । গাড়ি আর চালু হয় না । বেশ কিছু সময় গুতাগুতি করেও কোন লাভ হল না । নাদিয়া খানিকটা অবাক হয়েই বলল, আমার গাড়িটা তো এমন করে না কখনও ? আজকে হঠাৎ এমন কেন করছে ?
-হয়তো আমাদের এক সাথে যেতে দিতে নারাজ? আমাকে হয়তো পছন্দ করছে না তোমার গাড়ি?
-আচ্ছা । এমনটাই হয়েছে । হয়তো গাড়ির মনের মত নও তুমি !

এই বলে হাসতে শুরু করলো । আমিও ওর হাসিতে যোগ দিলাম । আমি তারপর বললাম, এবার কি ফোনটা ওপেন করার অনুমুতি পাবো?
-নোপ !
-মানে কি?
-আবারও মানে কি? শোন আজকের রাতে আমরা ফোন চালু করবো না । ইমাজিন যে এটা ১৯৮০ সাল । তখন হলে আমরা কী করতাম শুনি?
-ইমাজিন করার কোন দরকার নেই । এট যেহেতু ২০২১ আমাদের কাছে উপায় রয়েছে । ফোন করে সাহায্য নিয়ে আসি ।
নাদিয়া বলল, নো ফোন । আগেই বলেছি ! কোন ফোন না ।
আমি খানিকটা অসহায়ের মত নাদিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম । এই মেয়ের জেদের সাথে আমি কোন ভাবেই পারবো না । আমি বললাম, তো এখন কী করবো শুনি?
-চল বাইরে বের হই । দেখি কোথাও সাহায্য পাওয়া যায় কিনা !
-তুমি সত্যিই সিরিয়াস?
-হ্যা । চল সামনে যাই তো আগে । যদি একেবারেই কিছু না হয় তাহলে আবার ফিরে আসবো এখানে । আর মোবাইল রয়েছে বক্সের ভেতরে । সেটা লক করা পিন নম্বর দিয়ে । পিন নম্বর কেবল আমি জানি । । সুতরাং আমার ইচ্ছাই সব !
বুঝলাম যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই ।

গাড়ি থেকে বের হলাম দুজন । তারপর হাটা শুরু করলাম । কোন দিকে যে যাচ্ছি সেটা আমার কোন ধারণা নেই । আমরা গাড়ি নিয়ে বের হয়েছি ঘন্টা দুয়েক হবে । গাজীপুর চৌরাস্তা পার হয়েছিলো এই টুকু আমার মনে আছে । তারপর নাদিয়া কোন দিকে যে গাড়ি নিয়েছে সেটা আমার মোটেও খেয়াল ছিল না । ওর সাথে কথা বলছিলাম । রাস্তার দিকে মনযোগ দিতে পারি নি । এতো নির্জন রাস্তায় কোথায় আছে সেটা আমি নিজেও জানি না । নাদিয়া কোন দিকে গাড়ি নিয়ে গেছে কে জানে !

কত সময় হাটার পরে হঠাৎই আমরা আবিস্কার করলাম যে আমরা এমন একটা জায়গাতে চলে এসেছি যেখানে মাঝ দিয়ে সোজা একটা রাস্তা চলে গেছে এবং দুই পাশে পানি । একটু মনে করতেই আমি জায়গাটা চিনে ফেললাম । অনেক দিন আগে আমি এই এলাকাতে এসেছিলাম । গাজিপুরের জয়দেবপুরের পরে কোন একটা স্থান । বর্ষা কালে এখানে এমন ভাবে পানি জমে । আমরা সেই রাস্তাতেই চলে এসেছি । এতো সময় ধরে আমরা কেবল গাজিপুর এসেছি ! একবার মনে হল নাদিয়াকে বলি তারপর মনে হল থাকুক । কী দরকার বলার । মনের ভেররে একটু আগে যে সংঙ্কাটা কাজ করছিলো সেটা আপাতত চলে গেল । আমি এখন জানি যে আমরা কোথায় রয়েছি । সুতরাং ভয় পেই ।

নাদিয়া চারিদিক তাকাতে তাকাতে রাস্তার ধারে ঠিক পানির পাশেই বসে পড়লো । আমাকেও বসতে হল ওর পাশেই । আমরা দুজনে সামনের দিকে তাকিয়ে রয়েছি । আমি আসলে কিছুই ভাবছি না । সব কিছু কেমন স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে । আমার মনে হতে লাগলো নাদিয়া আসলে আমার প্রেমিকা । রাতের বেলা ওকে নিয়ে আমি ঘুরতে বের হয়েছি । তারপর এই চমৎকার স্থানে এসে পৌছেছি ।
হঠাৎ নাদিয়া বলল, এই এই ওটা কী?
আমি সামনে তাকিয়ে দেখলো অনেক দুরে পানির উপরে আলোর মত কী যেন দেখা যাচ্ছে ! আমি একভাবে বেশ কিছুটা সময় সেদিকে তাকিয়ে থাকার পরে ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম । অনেক গুলো জোনাক পোকা এক সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে । সেটাই এতো দুর থেকে মনে হচ্ছে যেন কোন অয়বয় একসাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে যেন । আমি সেটা বুঝতে পেরে নাদিয়া বললাম, আসলে এমন জলাশয়ের ভেতরে অনেক মানুষ মারা যায় ডুবে । তখন সেই মানুষের আত্মা গুলো রাতের বেলা এইভাবে এখানে ঘুরে বেড়ায় ।
-ভাল হবে না বলে দিচ্ছি ।

নাদিয়ার কন্ঠে কেমন যেন একটা বাচ্চা সুলভ রাগ টের পেলাম । তবে সেই সাথে নাদিয়া আমার দিকে একটু এগিয়ে এল বটে । আমি নাদিয়ার শরীরের গন্ধ পেলাম খুব কাছ থেকে । এই রাতের বেলা ও খানিকটা ভয়ই পেয়েছে । আমি এবার ওকে অভয় দিয়ে বললাম যেন ও মোটেই ভয় না পায় । আমি রয়েছি ওকে রক্ষা করার জন্য ।

আমাদের চোখ তখন সেই আলোর দিকেই রয়েছে । সেটা এক মোটে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরে বেড়াচ্ছে । আমরা সেটা দেখছি । দেখলাম আস্তে আস্তে সেটা একেবারে আমাদের কাছে চলে এল । নাদিয়া সেটার দিকে একভাবে বেশ কিছু সময় তাকিয়ে থেকে বলল, কী সুন্দর !
-হুম । এই সুন্দর দেখেই তুমি ভয়ে মরে যাচ্ছিলে !
-মোটেই মরে যাচ্ছিলাম না । আমি কেবল জানতে চেয়েছিলাম যে ওটা কী ! শুনো নাদিয়া আইরিন এতো সহজে ভয় পায় না বুঝেছো !
-বুঝলাম । নাদিয়া আইরিন বড় সাহসী !

আমরা আবারও খানিকটা সময় চুপ করে রইলাম । আসলে আমরা প্রকৃতির এই সৌন্দর্য দেখছিলাম এক সাথে । রাতের অন্ধকারের ভেতরে আমরা অচেনা একস্থানে বসে রয়েছি । দুই পাশে পানি আর পানি । মাঝ দিয়ে চলে গেছে একটা রাস্তা । আমরা বসে রয়েছে । একে অন্যকে খুব ভাল করে চিনিও না যেন । তবুও কী অদ্ভুত ভাবেই না আমরা এক সাথে হয়ে এখানে বসে রয়েছি । ব্যাপারটা কিন্তু মন্দ না ।
এক সময় নাদিয়া হঠাৎ বলল, রায়হান আকিবকে চেন না?
-কোন রায়হান আকিব ! ঐ যে ক্রিকেটার । সাবিকের পরেই যাকে সেরা অলরাইন্ডার ধরা হয় ?
-হ্যা ।
-হ্যা কেন চিনবো না!
-ও আমার বয়ফ্রেন্ড ছিল !
-তাই নাকি? কিন্তু ওর তো…..।

কথাটা বলতে গিয়েই থেমে গেলাম । রায়হান আকিবের মাস ছয়ের আগে বিয়ে হয়ে গেছে । বিশাল আয়োজন করে বিয়ে হয়েছে ।
নাদিয়া বলল, আমার সাথেই ওর বিয়ে হওয়ার কথা ছিল । সব কিছু ঠিকঠাক চলছিলো । ওর সাথে আমার পরিচয় হয় একটা ফাংশনে । নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ক একটা সেমিনারে ও গেস্ট স্পিকার ছিল । জানো এতো চমৎকার ভাবে কিছু কথা বলল নারী জাগরন আর উন্নয়ন সম্পর্কে ! আমার স্পিচ শেষ হতেই নিজ থেকে এগিয়ে এসে কথা বলল। তারপর …..
-তারপর?
-তারপর আর কী ! যা হয় তাই । আমাদের মাঝে প্রেম হল । এরপর যখন বিয়ের ব্যাপারটা আসতে শুরু করলো তখন ওর সেই ডোমিনেটিং ব্যাপারটা আস্তে আস্তে চোখের সামনে আসতে শুরু করলো । এটা করা যাবে না ওটা করা যাবে না । তার মন মত চলতে হবে । ওখানে যেতে হলে তার অনুমুতি লাগবে । নিজেকে আমি তবুও বলদে নিয়ে আসছিলাম । কিন্তু এক সময়ে বলে যে চাকরি করাও যাবে না । ইউনিভার্সিটিতে চাকরি করলে সন্ধ্যার পরে ক্লাস থাকবে । বাসায় পৌছাতে রাত হবে । এটা সে মেনে নিতে পারবে না । জানো একবার কী ইচ্ছে হয়েছিলো !
-কী?
-ইচ্ছে হয়েছিলো যে এই মুখে সে নারী উন্নয়নের কথা বলে অথচ বউ চায় নিজের কথায় উঠবে বসবে এমন । এই ব্যাপারটা সবার সামনে নিয়ে আসি । পুরুষেরা নারী উন্নয়ন কেবল ঘরের বাইরেই দেখতে চায় । নিজ ঘরে তারা নারীকে কেবল নারী হিসাবে দেখতে পছন্দ করে । মানুষ হিসাবে না ।
-আরে আরে ! এখানে আবার পুরুষ কে নিয়ে কথা বলছো কেন ! সব পুরুষ এমন না মোটেই । অন্তত আমি তো নই ই ।
-হয়েছে ! তুমিও আসলে সেই একই দলে । আমার সামনে ঢং করছো !
-তোমার সামনে ঢং করে আমার কী লাভ শুনি? তুমি তো আর আমার প্রেমিকা না । নাকি ! আমি তো আর তোমাকে ইম্প্রেস করতে চাইছি না যে আমাকে মিথ্যা বলতে হবে ! শুনো আমি যেমনটা ফিল করে সেটা আমি তোমাকে আগেই বলেছি । এবং আমি সেমনই মনে করি । বুঝতে পেরেছো কি?
-বুঝলাম ।

আমাদের মাঝে আর বেশি কথা হল না । আমাদের চোখ আবারও সেই জোনাক আলোর দিকে চলে গেল । আরও কয়েকটা ঘুরে বেড়াচ্ছে পানির উপরে । নাদিয়া সেই দিকেই তাকিয়ে রইলো । ও এখনও আমার সেই কাছেই বসে রয়েছে । হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার কাধে হেলান দিল । মৃদু স্বরে বলল, একটা হেলান দিলাম ! আরাম করে দেখি ব্যাপারটা !

এইভাবেই সময় কেটে গেল । এক সময় অনুভব করলাম নাদিয়া ঘুমিয়ে পরেছে । ওর নিঃশ্বাসের আওয়াজ ঘন হয়ে এসেছে । রাতের অন্ধকার হলেও খেয়াল করে দেখলাম আকাশ থেকে একটু যেন আলো বের হয়ে এসেছে । সেই আলোতে নাদিয়ার মুখটা বেশ ভাল ভাবেই আমি দেখতে পাচ্ছিলাম । এতো চমৎকার লাগলো সেটা । আমি সেই দিকেই একভাবে তাকিয়ে রইলাম কেবল । অন্য কিছু আমার মনে আর রইলো না ।
এভাবে আমিও কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম একটু সেটা আমার নিজেরও মনে নেই । সকালে বলা পাশ দিয়ে একটা ট্রাক যাওয়ার আওয়াজে দুজনের ঘুম ভাঙ্গলো । দুজনই খানিকটা অপ্রস্তুত হলাম এভাবে রাস্তার পাশে ঘুমিয়ে পরার জন্য । উঠে পড়লাম । এভাবে এখানে এক সাথে ঘুমিয়ে পড়বো কোন দিন ভাবি নি । নাদিয়া আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো কেবল । তারপর পানিতে হাত মুখ ধুয়ে আমরা গাড়ির দিকে রওয়ানা দিলাম ।

এবার অবশ্য মোবাইল বের করতে দিল সে । আমি মোবাইল নিয়ে আশে পাশে মেকানিক খুজে নিয়ে এলাম । আমাদের অবশ্য ট্যুরে যাওয়া হল না । তবে আমাদের মাঝে কিছু একটা তৈরি হয়ে গেল ঠিকই।

এরপর থেকে নাদিয়ার সাথে আমার একটা আলাদা ভাব হয়ে গেল। প্রায় দিনই আমরা এভাবে এক সাথে বের হয়ে গেলাম । যেদিকে চোখ যায় আসলে সেদিকে । কোন ঠিক ঠাকানা ছিল না । এক সময়ে অনুভব করতে পারলাম যে আমরা দুজন দুজনের কাছে সব কিছু শেয়ার করছি । সব কিছু বলছি । আমাদের একে অন্যের সাথে কথা বলতে ভাল লাগছে । সকল কাজের ফাঁকেও আমরা একে অন্যের খোজ খবর নিতে মোটেই ভুলছি না । তারপর ঘটলো সেই ঘটনাটা ।

সেদিন নাদিয়ার সাথে ঘুরতে গিয়েছি । এবার গিয়েছি ঢাকার বাইরে । প্রতি বৃহস্পতিবারই আমরা বের হয়ে যেতাম । সেদিন গিয়েছি সিলেট । তখনও আমাদের প্রেম শুরু হয় নি । হোটেলে উঠলেও আমরা দুইটা রুম নিতাম সব সময় । সেদিন সকালে হোটেলে চেক ইন করতে গিয়ে আমি যখনই দুইটা রুম নিতে যাবো নাদিয়া এগিয়ে এসে বলল, একটা ডাবল রুম প্লিজ !
আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম । নাদিয়া মুখ স্বাভাবিক রেখে এমন ভাবে রিসিপশনের দিকে তাকিয়ে কথা বলল যেন এটা খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার । চাবি হাতে নিয়ে ওর আমার হাত ধরলো । এমন একটা ভাব ধরলো যেন আমি ওর প্রেমিকও না, সরাসরি হাসব্যান্ড ! আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না ।

পরে গিয়ে বুঝতে পারলাম । কোন একটা ন্যাশনাল লিগ চলছিলো । সিলেটে কয়েকটা ম্যাচ হবে । সেই ম্যাচ খেলতে এসেছে খেলোয়াররা এবং তারা আমাদের সাথে এই একই হোটেলেই উঠেছে। এই খেলোয়ারদের ভেতরে নাদিয়ার এক্স বয়ফ্রেন্ড রয়েছে । সে সকালে নাস্তা খেতে লবিতেই বসে ছিল । আমাদের দেখছিলো ।

আসল ঘটনা ঘটলো পরদিন রাতের বেলা । হোটেলের পাশেই চমৎকার একটা বাগান মত রয়েছে । আমরা আর নাদিয়া রাতের বেলা সেখানেই ঘুরছিলাম । এমন সময় রায়হান সাহেব এসে হাজির আমাদের সামনে । নাদিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, কেমন আছো?
-নাদিয়া একটু থমকে গেলেও সামলে নিলো সাথে সাথেই । এমন একটা ভাব করে বলল যেন রায়হানকে দেখেই নি আগে । ওকে এই প্রথম দেখে অবাক হচ্ছে । বলল, আরে তুমি এখানে ?
-হ্যা । আমাদের লীগ চলছে!
-ও আচ্ছা । এখন আর এসব লিগ ফিগের খেয়াল থাকে না । তা তুমি কোন দলের হয়ে যেন খেলতে !

দেখলাম রায়হান সাহেব একটু যেন অপমানিত বোধ করছে । বিশেষ করে তার মত বিখ্যাত প্লেয়ার কোন টিমের হয়ে খেলছে সেটা না জানা মানে হচ্ছে তাকে অপমান করা । আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাকে বলেছিলাম না একটা ছেলের কথা । ইনিই হচ্ছে সেই ।
-ও আচ্ছা আচ্ছা । ক্রিকেট খেলে বলেছিলে !
আমিও এমন একটা ভাব করলাম যে রায়হানকে যেন আমি ঠিক মত চিনিই না । আমি সেটাকে আরেকটু বাড়িয়ে দিতে রায়হানের দিকে তাকিয়ে বললাম, আসলে আামর খেয়ালর বিষয়ে আগ্রহ একদম কম । কোন খেলারই দেখা হয় না একদম ।
নাদিয়া এবার আরও একটু টিটকারি মেরে বলল, তা তোমার বউ রান্না করে খাওয়াচ্ছে তো ঠিকঠাক !

দেখলাম রায়হান সাহেব আর বেশি সময় দাড়ালো না । ওখান থেকে চলে গেল । সে চলে যাওয়ার পরপরই নাদিয়া এমন হাসতে লাগলো । সাথে আমিও যোগ দিলাম হাসিতে । সেই দিন রাতেই আসলে আমাদের মাঝে প্রথম অঘটন টা ঘটলো । হোটেলের বিছানাটা বড় । আমরা মাঝে একটা বড় কোলবালিশ দিয়ে ঘুমাতাম । রাতে শুয়েছি এমন সময় নাদিয়া আমাকে বলল, তোমার কী মন খারাপ হয়েছে?
-কেন ? মন খারাপ কেন হবে?
-না এই যে তোমাকে ব্যবহার করলাম রায়হানকে টিজ করার জন্য !
-আরে না । আমার বরং মজাই লাগলো ।
-একটা কথা বললে কী বিশ্বাস করবে?
-বল?
-আমি রায়হানকে মুছে ফেলার জন্য কখনই তোমার সাথে মিশি নি । তোমার সাথে মিশেছি কারণ আমার মিশতে ভাল লেগেছে । তোমার সাথে কথা বলতে ভাল লাগে আমার । সময় কাটাতে ভাল লাগে !
-আামরও তাই । এই জন্যই মিশি !

এরপর অনুভব করলাম নাদিয়া মাঝের কোল বালিশ সরিয়ে আমার কাছে চলে এল । একেবারে আমার কাছে । আমার বুকের ভেতরে কেমন যেন করে উঠলো । নাদিয়া এবার আরও কাছে উঠে এসে আমার ঠোঁটে চুমু খেল। একবার । দুইবার । তারপর…..

পরদিন সকালে আমাদের বিছানাকন্ডি যাওয়ার কথা ছিল । কিন্তু আমরা গেলাম না । হোটেলের ভেতরেই রয়ে গেলাম । দুজন দুজনকে তখন আরও কাছে পাওয়া শুরু করেছি । এই আকর্ষণ সব আকর্ষণ বেশি ।
এরপর থেকেই আমাদের প্রেম যেন চরমে উঠল । যদিও তখনও সেটা গোপনেই রয়ে গেল । যদিও খানিকটা কানা ঘুষা শোনা যেতে লাগলো নাদিয়ার নতুন বয়ফ্রেন্ড সম্পর্কে । কিন্তু সেটা যে কে কেউ বলতে পারলো না । কিন্তু এখন সেটা অনেকেই জানে । অন্তত আমার পরিচিত রা তো জানেই । যদিও আমি মুখে স্বীকার করি নি এখনও ।

আমি নাদিয়ার কথা মত যথারীতি ওর বাসায় গিয়ে হাজির হলাম । আমি ঘরে ঢুকতেই ও আমার দিকে ওর ট্যাবলেট টা এগিয়ে দিল । সেখানে একটা নিউজ শেয়ার করা । শিরোনাম টা হচ্ছে, বিখ্যাত অলরাউন্টের নামে নারী নির্যাতনের মামলা । আগাম জামিনের আবেদন !

নাদিয়া আমার একদম কাছে এসে বসলো । তারপর বলল, সেদিন তুমি যদি আমাকে না বাঁচাতে তাহলে একজন অযোগ্য আর খারাপ মানুষের জন্য আমি নিজেকে শেষ করে দিতাম । থ্যাংঙ্কস টু ইউ !
বললাম, শুধু খালি মুখে থ্যাংঙ্কস ?
-আর কী চাও শুনি?
-তুমি জানো আমি কী চাই ।
নাদিয়া একটু হাসলো । তারপর চোখ পাকিয়ে বলল, এসব হবে না আর । কালকে আসতে বলেছিলাম, যদি আসতে পেতে । এখন আর না । এবার একেবারে বিয়ে পরে । আর না ।
-মানে কী ?
-মানে এই ই !

আমি কিছু বলতে যাবো তখনই দেখলাম বন্ধু সাদির ফোন এসে হাজির । ফোন ধরতেই সাদি বলল, তুই শালা সত্যি একটা চিজ !
-আবার কী হল !
-আবার বলিস আবার কী হল ! নাদিয়াকে কিভাবে পটিয়ে ফেললি বল তো !
-মানে কি?
-আরে বেটা তোর ছবি সে পোস্ট করেছে নিজের পেইজে । এবার ভাল করে দেখ । আর কত লুকাবি বন্ধুদের কাছ থেকে !

আমি ফোন রেখে ফেসবুকে ঢুকলাম । দেখি সত্যি সত্যি নাদিয়া আমার আর ওর একটা ফেসফি পোস্ট করেছে । দুতিন মাস আগে । বান্দরবান গিয়েছিলাম। জাদিপাই ঝর্ণার সামনে আমার গালে একটা চুমু খাওয়া অবস্থাতেই ছবিটা তুলেছিলাম। সেটা পোস্ট করে দিয়েছে । আমি নাদিয়ার দিকে তাকালাম ।
নাদিয়া বলল, হোয়াট ? আর কতদিন লুকিয়ে রাখবো শুনি !
-আমাকে জানাবে তো একবার নাকি?
-না । আমার ইচ্ছে । আমার ইচ্ছে । আমার ইচ্ছে !


আমি কী বলবো খুজে পেলাম না । অবশ্য রাগ করার কোন কারণ নেই আসলে । কেনই বা করবো । এবার বিয়েটা করে ফেলাই উত্তম । বিয়ের বয়স তো পার হয়ে যাচ্ছে ।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.7 / 5. Vote count: 85

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

2 Comments on “নাদিয়া আইরিন”

Comments are closed.