কার কাছ থেকে একবার শুনেছিলাম যে এখন আর মানুষের সাথে মানুষের বিয়ে হয় না। বিয়ে হয় ক্যারিয়ারের সাথে সৌন্দর্যের। কথাটা আমার কাছে বরাবরই সত্য মনে হয়ে এসেছে। আমার ক্লাসমেট সজিবের একটা মেয়ের সাথে দীর্ঘদিনের প্রেম ছিল। পুরো ক্যাম্পাসের সময়টাই মেয়েটা সজিবের সাথেই ঘুরেছে, চুটিয়ে প্রেম করেছে কিন্তু সজিব ভাল একটা চাকরি জোগার করতে পারে নি তখন মেয়েটা অন্য একটা ছেলেকে বিয়ে করে সংসার শুরু করেছে। এমনই আসলে হয়ে আসছে। এই যে শশীর সাথে আমার বিয়ে হয়েছে, আমার একটা ভাল মানের চাকরি আছে বলেই তো হয়েছে। এই শশী আমার প্রতি ভাল প্রেম ভালোবাসা দেখাচ্ছে সেটাও তো এই ভাল চাকরির কারণে। আজকে যদি আমার চাকরিটা চলে যায় তাহলে সে আমার প্রতি এই যত্নবান হবে? এতো ভালবাসা দেখাবে?
কিন্তু জগতের নিয়মটাই বুঝি এমনই। আমিও মেনে নিয়েছি এটাই। এভাবেই সংসার শুরু করেছি।
সত্যি বলতে কি জীবনটা একেবারে খারাপও না। আমি শশীকে পছন্দ করি। বউ হিসাবে সে চমৎকার । যদিও একেবারে ট্রিপিক্যাল বাঙালী বউদের মত না। তবে ভাল। সে আমার খেয়াল রাখে, আমার যত্ন নেয় । আমিও স্বামী হিসাবে যা করতে পারি সেটাই করি। আমার এই আচরণেও তাকে সন্তুষ্টই মনে হয়। অন্তত এই ছয় মাসে তাকে আমি অভিযোগ করতে দেখি নি। সকালে আমি দুজনেই একই সাথে ঘুম থেকে উঠি। অফিসে যাওয়ার দিন আমরা সকালে নাস্তা বানাই না। কফি খাই। সাথে পাউরুটি কিংবা কেক। এটাই আমাদের সকালের নাস্তা হয়। আমি স্কুল কলেজ জীবন থেকেই এই নাস্তা করেই আসছি। তাই আমার খুব একটা সমস্যা হয় না। তবে যেদিন আমাদের অফিস থাকে না সেদিন শশী নাস্তা তৈরি করে আমার জন্য। সত্যি বলতে কি বাসায় তৈরি সে নাস্তা খেতে আমার ভাল লাগে। সকালে নাস্তা খেয়ে আমরা দুজনেই অফিস যাই । আমার আর ওর অফিস একই পথে পড়ে। আমি ওকে নামিয়ে দিয়ে আমার অফিস ধরি। এরপর বাসায় ফিরিও মোটামুটি একই সাথে যদি ওর আজ বেশি না থাকে। দুজনের সরকারী চাকরি করার কারণে অফিসের বাইরে আমাদের কাজের চাপ থাকে না।
প্রায়ই দিনই আমরা অফিস থেকে ফেরার পথে একদিক ওদিক যাই। বৃহস্পতিবার হলে আমরা মুভি বা নাটক দেখতে যাই তারপর একেবারে রাতের খাবার খেয়ে বাসায় ফিরি। অন্যান্য দিন হলে বাসায় এসে দুজন মিলে রান্না করি। রান্না মূলত শশীই করে, আমি ওকে সাহায্য করি।
এভাবেই আমাদের বিয়ের মাস ছয়েক পার হয়ে যায়। সত্যি বলতে জীবন আগে যেমন ছিল তেমনই আছে। খুব একটা বড় পরিবর্তন আসে নি। শশীর সাথে জীবন ভাল কাটছিল। তবে একটা ব্যাপার আমি সব সময়ই মিস করতাম সেটা হচ্ছে আমার প্রাইভেসী। আমার জীবনে এখন আমার প্রাইভেসী বলে কিছু নেই। আমি যা জানি আমার বউও তাই জানে, আমি যা দেখি আমার বউও তাই দেখে। এইভাবে ভাল মন্দ নিয়ে আমার জীবন এগিয়ে যাচ্ছিল।
ছয় মাসের মাথায় শশী একদিন জানালো যে তার অফিস থেকে সব মেয়েদেরকে ইন্ডিয়া পাঠাচ্ছে ট্রেনিংয়ের জন্য। মাসখানের জন্য। সেও যেতে ইচ্ছুক। আমি কোন আপত্তি করবো কিনা। আমি এক কথায় বললাম আমার কেন আপত্তি থাকবে। আমার তখন কেন জানি মনে হল যে এক মাসে যদি সে দুরে থাকে এই সময়টা আমি আমার প্রাইভেসী আবার ফিরে যাবো। অন্তত এক মাসের জন্য আমার সেই শান্তির জীবন ফিরে আসবে। যদিও আমার বাসার লোকজন এই কথা শুনে একেওটু অখুশি হল। শশী যে বিয়ের পরে চাকরি করে এতেই আমার মায়ের মুখ একটু বেজার থাকে। আমি অবশ্য সেদিকে খুব একটা কান দেই না, এবারও দিলাম না।
শশীকে আমি এয়ারপোর্টে এগিয়ে দিয়ে এলাম। আমি একেবারে ইমিগ্রেশন পর্যন্ত যাওয়ার একটা পাসও যোগার করে ফেললাম। ওর জিনিসপত্র নিয়ে ওর সাথে একেবারে ইমিগ্রেশনের গেট পর্যন্ত এগিয়ে গেলাম। যখন শশী ইমিগ্রেশনের গেটের কাছে গিয়ে আমার দিকে ফিরে তাকাল তখন আমি অবাক হয়ে খেয়াল করলাম ওর মুখটা কেমন ভার হয়ে গেছে। চোখ যেন ছলছল করছে।
আমি সত্যিই অবাক হলাম। শশী কি আমার কাছ থেকে দুরে যাওয়ার জন্য মন খারাপ করছে?
আমার দিকে তাকিয়েই ও হাত নাড়ল। আমি একটু হাসার চেষ্টা করে হাত নাড়লাম। আমার বুকের ভেতরে কেমন যেন একটা শূন্যতা অনুভব হল। এই অনুভূতি আমার নিজের কাছেই অচেনা মনে হল।
একেবারে চোখের আড়াল চলে যাওয়া পর্যন্ত আমি শশীর দিকে তাকিয়েই রইলাম।
মনে হয়েছিল যে বাসায় ফিরেই সব কিছু আগের মত হয়ে যাবে। কিন্তু আমি পদে পদে শশীর শূন্যতা উপলব্ধি করতে পারছিলাম। যদিও ওর সাথে আমি প্রায় ঘন্টার ঘন্টায় যোগাযোগ হতে লাগল। সে কোথায় নামছে, কী করছে কী খাচ্ছে সে সব কিছুই আমাকে হোয়াটসএপ করতে লাগল। কিন্তু এতো কিছু জেনেও আমার কেন জানি মন ভরছিল না। আমি শশীর উপস্থিতি প্রবল ভাবে অনুভব করতে শুরু করলাম। পুরো মাসটা আমার খুব বাজে ভাবে কাটল। যদিও আমি শশীকে কিছুই জানালাম না । ২৭ দিনের মাথায় শশী আমাকে জানালো যে ওদের ট্রেনিং শেষ হয়ে গেছে। ও সেদিনই ব্যাক করবে। ওর বাকি কলিগ রা আরও দিন সাতেক পরে আসবে। ওদের নাকি একটু ঘোরাঘুরি করার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে শশী একা একাই ফিরে আসবে। আমি ওকে বললাম যে সেও যেন ঘুরেই আসে। তবে শশী আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, ওরা তাজমহল দেখতে যাবে আর শশী ঠিক করে রেখেছে যে তাজমহল সে একা একা দেখবে না। আমার সাথে দেখবে। আর ওর এতো দিন আমাকে রেখে ভাল লাগছে না।
শশীর প্লেন আসার কথা ছিল দুপুর বারোটার দিকে। আমি অফিস থেকে ছুটি নিয়ে দশটার ভেতরেই হাজির হয়ে গেলাম। আমি যখন এয়ারপোর্টে হাজির হলাম তখন শশী সবে মাত্র প্লেনে উঠেছে। মানে হচ্ছে এখনও আড়াই ঘন্টার মত সময় লাগবে। আমি এয়ারপোর্টের ভেতরে ঢুকে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
শশী আমাকে বলেছিল যে আমার আসার দরকার নেই। সরাসরি বাসায় চলে যেতে পারবে। তবে আমার কেন জানি মন সায় দেয় নি । মনে হয়েছে যে যখন সে এয়ারপোর্টে নামবে তখনই যেন আমি তাকে দেখতে পাই।
প্রায় তিন ঘন্টা পরে সে এসে হাজির হল। ইমিগ্রেশনের দরজার দিয়ে বের হয়ে এল। আমাকে দেখতে পেল একটু পরেই। আর তখনই আমার জীবনের সব থেকে বিস্ময়কর ঘন্টার সম্মুখীন হলাম। শশী আমার দিকে খানিকটা দৌড়ে এল। কাছে আসতেই দেখলাম ওর চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে গেছে। মানুষ জনের সামনেই ও আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমাদের বিয়ের পর এই প্রথমবারের মত আমি শশীর প্রতি একটা তীব্র ভালবাসা অনুভব করলাম। আসলে এই প্রথম বললে হয়তো ভুল হবে। ভালবাসাটা আমাদের মাঝে সব সময়ই ছিল। চোখের সামনে ছিল বিধা আমরা কেউ সেটা পুরোপুরি ভাবে সেটাকে উপলব্ধি করতে পারি নি। যখন শশী আমার কাছ থেকে দুরে গেছে তখনই কেবল সেটা আমরা বুঝতে পেরেছি। ভালবাসা বিরহেই সব থেকে ভাল উপলব্ধি করা যায়।
ওকে নিয়ে বাসায় ফেরার সময় মনে মনে পরিকল্পনা করলাম যে ওকে তাজমহলে যাওয়াটাই এখন আমার সব থেকে বড় কাজ। আমার সাথে তাজমহল দেখবে বলেই ও এতো কাছে গিয়েও তাজমহল দেখে নি। অন্য সব কিছু বাদ দিয়ে আমার এখন এই ব্যবস্থাই করতে হবে।