রীতুকে আমি কি ভালোবাসতাম?
এই প্রশ্নটার উত্তর আমি জানি না। অথবা হয়তো আমি ইচ্ছে করেই এই প্রশ্নটার উত্তর জানতে চাই না। কারণ প্রশ্নটার উত্তর হ্যা বা না যাই আসুক সেটা আমার নিজের জন্য ভাল হবে না। নিজের মৃত বন্ধুর প্রেমিকাকে ভালোবাসা কি কোন ভাল কথা? আমি জানি না। নাইম যদি বেঁচে থাকত তাহলে এতোদিনে তারা ঘর সংসার শুরু করে ফেলত। হয়তো দেখা যেত তাদের একটা বাবুও হয়ে যেত।
তবে রীতু এখনও বিয়ে করে নি। আমিও বিয়ে করি নি। আমি কোন দিন ভাবি নি যে রীতুর সাথে আমার আবার দেখা হবে। অর্নাস শেষ করে আমার কী মনে হল আমি আর মাস্টার্স করলাম না। বাবার সুপাশিরে একটা কোম্পানীতে ঢুকে গেলাম। চার বছর চাকরি করার পরে কী মনে হল চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে মাস্টার্স করতে ইচ্ছে হল। আইবিএর ইভিনিং কোর্সে কিভাবে যে চান্স পেয়ে গেলাম সেটা আমার জানা নেই। ওরিয়েনটেশনের দিনই আমি আবার রীতুকে দেখতে পেলাম। প্রায় সাত বছর পরে ! তারপরেও ওকে আমি প্রথম দেখাতেই চিনতে পারলাম । এবং রীতুও আমাকে চিনতে পারল। মনের ভেতরে একটা ক্ষীণ সম্ভবণা ছিল যে হয়তো ওরিয়েন্টেশন ক্লাস শেষ করে রীতু দ্রুত বের হয়ে যাবে। আমার সাথে দেখা কিংবা কথা বলবে না।
নাইমের মৃত্যুর পরে অদ্ভুত ভাবে রীতু আমার সাথে একটা দিনও কথা বলে নি। অবশ্য এমন না যে আমার সাথে সে সব সময় খুব কথা বলত তবে দেখা হলে হাই হ্যালো সব সময় করত। কিন্তু নাইম যখন সুইসাইড করল তখন থেকে রীতু আমার দিকে এমন ভাবে তাকাত যেন আমাকে সে চেনেই না। নাইম কেন সুইসাইড করেছিল সেই কারণটা আমরা কেউ নিশ্চত ভাবে না বলতে পারও কিছুটা আঁচ তো সবাই করতে পেরেছিল । আমি আরও ভাল করেই সেটা বুঝতে পেরেছিলাম।
যেদিন নাইম সুইসাইড করে সেদিন সন্ধ্যা থেকে আমি ওদের বাসাতেই ছিলাম। আমাদের পরের দিনই হায়ারম্যাথ পরীক্ষা ছিল। আমাদের দুইজনের বাসা প্রায় কাছাকাছি। দুটো বাড়ি পরেই। হাই স্কুল আর কলেজ আমি আর নাইম এক সাথেই বড় হয়েছি। ওর বাবা স্থানীয় পিডিবির ইঞ্জিনিয়ার আর আমার বাবা ছিলেন জেলার সিভিল সার্জন। আমাদের সরকারী কোয়াটার গুলো পাশাপাশি ছিল একদম।
সেদিন আমরা ওর রুমে বসেই অংক করছিলাম। এমন সময় ওর বাবা মায়ের ঘর থেকে তুমুল ঝগড়ার আওয়াজ শুনতে পেলাম। এমন সব কুৎসিত কথা ভেসে আসতে লাগল যে আমার কান গরম হয়ে এল। এক সময় নাইম নিজেই আমাকে বাসায় চলে যেতে বলল। আমি ওকে তখন বলেছিলাম যে আমাদের বাসায় গিয়ে চল অংক করি। কেন জানি নাইম রাজি হল না। বলল যে এখন ওর মাথায় আর কিছু ঢুকবে না। আমি যেন বাসায় চলে আছি।
আমি আর কথা না বাড়িয়ে বাসায় চলে এলাম। আমাকে ঐদিন নাইম দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এল। আমি গেট দিয়ে যখন বের হচ্ছিলাম তখনও দেখি সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর দরজা বন্ধ করে দিল। ব্যাস সেটাই ছিল নাইমের সাথে আমার শেষ দেখা । সম্ভবত আমিই ছিলাম শেষ জন যার সাথে নাইমের দেখা হয়েছে। পরে শুনেছিলাম ঝগড়া শেষে তার বাবা নাকি বাসা থেকে বের হয়ে গিয়েছিল আর মা দরজা বন্ধ করে শুয়ে ছিল। সেই দরজা সে একেবারে খুলেছিল সকালে। তাই নাইমকে তারা আর কেউ দেখে নি।
ওরিয়েন্টেশন ক্লাস শেষ করে যখন রীতু নিজেই আমার দিকে এগিয়ে এল আমি একটু অবাকই হলাম। আমার দিকে তাকিয়ে রীতু বলল, কেমন আছো?
-ভাল।
একটু হাসার চেষ্টা করলাম। রীতুকে এভাবে সামনা সামনি দেখে সত্যিই ভাল লাগল । ও আমার সাথে যে নিজ থেকে এগিয়ে এসে কথা বলল এতে যেমন আমি অবাক হলাম ঠিক তেমনি ভাবে আমার ভীষণ ভাল লাগল। তার তখনই আমার মনে পড়ল যে রীতুকে আমি সেই সময়েই অসম্ভব পছন্দ করতাম। ভালও সম্ভবত বাসতাম। কিন্তু আমার আগে নাইম রীতুকে ভালবেসেছিল। তাই আমাকে বাধ্য হয়েই পিছিয়ে আসতে হয়েছিল । অবশ্য আমি যেমন মুখচোরা স্বভাবের ছিলাম তাতে আমি কোন দিন রীতুর মন জয় করতে পারতাম বলে মনে হয় না। রীতুর সাথে পরিচয় হওয়ার কোন চান্সও সম্ভবত আমার ছিল না। নাইমের কারণেই এমনটা হয়েছিল।
সেদিন রীতুর সাথে আমার আর কথা হল না। ও জানালো যে ওর অফিসে একটু কাজ রয়েছে। ছুটির দিনেও ওর নাকি মাঝে মাঝে অফিস থাকে। আমার কাছে কেন জানি মনে হল আমার কাছ থেকে ও চলে যেতেই এই কথাটা বলল। তবে আমার মোবাইল নম্বর সে ঠিকই নিল। এবং রাতের বেলা আমাকে খানিকটা অবাক করে দিয়েই আমাকে ফোন করল। সেদিন ও আমার সাথে অনেক কথা বলল।
সপ্তাহে দুইদিন আমাদের ক্লাস ছিল। শুক্র আর শনিবার। একেবারে সকাল দশটা থেকে বিকাল পর্যন্ত। এই পুরোটা সময় রীতু আমার পাশেই বসে থাকত। আমরা পাশাপাশি বসে ক্লাস করতাম দুপুরে একসাথে লাঞ্চ করতাম । সত্যি বলতে কি পড়াশোনা এতো আনন্দের আমার কাছে কোন কালেই ছিল না তবে রীতুর পাশে বসে ক্লাস করতে আমার ভাল লাগত।
মাস তিন এভাবেই আমাদের দিন কেটে গেল। একদিন রীতু এসে আমাকে জানাল যে ওদের অফিসের এইচআরের পোস্ট ফাঁকা হয়েছে। আমি সেই পোস্টে চাকরি করতে চাই কিনা। সেখানে নাকি বেতন একটু কম তবে এই এমবিএ শেষ করলে বেতন বাড়বে। আমি যদিও তখনও চাকরি করার কথা কিছু ভাবছিলাম না তবে রীতুর অফিসে চাকরি করার সুযোগ আমি হাতছাড়া করতে চাইলাম না। সাথে সাথেই রাজি হয়ে গেলাম। নিয়ম রক্ষার জন্য আমার একটা ইন্টারভিউ নেওয়া হল। এবং আমি সত্যিই চাকরিটা হয়ে গেল।
চাকরিতে জয়েন করে দেখি আমার আর রীতুর ডেস্ক একেবারে পাশাপাশি। আমাকে আর পায় কে! আগে তো কেবল সপ্তাহে দুইদিন আমি রীতুর সাথে সময় কাটাতাম এখন সপ্তাহে সাত দিনই আমরা পাশাপাশি সময় কাটাতে লাগলাম।
আরো মাস দুয়েক পরের কথা। সেদিন আমাদের ক্লাস শেষ করতে করতে সন্ধ্যা পার হয়ে গেল। রীতু হঠাৎ করে আমাকে ওর বাসা পর্যন্ত যেতে অনুরোধ করল। এমনটা সে আগে কোন দিন করে নি। আমি এতে একটু অবাক হলাম বটে তবে সাথে সাথেই রাজি হয়ে গেলাম। রীতু লালমাটিয়াতে একটা ছোট বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে। আমি জানি সে আর তার এক কোন এক বান্ধবী এই বাসায় থাকে। আমি বাসা পর্যন্ত আসার পরে সে আমাকে আরও অবাক করে দিয়ে উপরে যেতে বলল।
ফ্লাটে ঢুকে বুঝলাম সেখানে কেউ নেই। পুরো ফ্লাটে এখন আমি আর রীতু। প্রথমে মনে হল যে হয়তো রীতুর সেই ফ্লাটমেট বাইরে রয়েছে। এখনই চলে আসবে। তবে একটু রীতু আমাকে জানাল যে বাসায় সে একা। তার ফ্ল্যাট মেট গ্রামে গিয়েছে। বাসায় একা থাকতে ইচ্ছে করছিল না বলেই সে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে।
আমি রীতুকে এতোটা দিন কেবল মাত্র বাইরে থেকেই দেখে এসেছি। আমরা যখন বাইরে বের হই তখন বাইরের মানুষের সামন একটা অন্য রকম আবরণ দিয়ে আমাদের সব কিছু ঢেকে রাখি। আমাদের চাল চলন পোশাক পরিচ্ছদ সব কিছুতেই সেই আবরণ থাকে। কিন্তু আমরা যখন নিজেদের বাসায় থাকি তখন সে আবরণ থাকে না। আমি এই প্রথমবারের মত রীতুকে একদম আবরণ ছাড়া দেখলাম। একটু পরে সেই পোশাক বদলে এল। একটু ছাই রংয়ের ঢোলা টিশার্ট আর কালো লেগিংস । আম্মি সোফার উপরে বসেছিলাম। রীতু একটু পরেই দুই কাপ কফি নিয়ে এসে বসল। সোফার উপরে সে একেবারে পা তুলে বসল। ঠিক যেমন ভাবে আমরা ঘরের মানুষদের সাথে কথা বলি, তাদের সামনে যেমন ভাবে আচরণ করি রীতুর আচরণে আমি ঠিক সেটাই খুজে পেলাম । প্রথমে আমার মনের ভেতরে একটু অস্বস্তি লাগলেও একটু পরে আমার সব কিছু কেমন যেন স্বাভাবিক মনে হতে লাগল ।
সামনে যদিও টিভি চলছি তবে আমাদের কারোই নজর টিভির দিকে ছিল না। এক পর্যায়ে রীতু বলল, আমি তোমার উপরে রেগে ছিলাম। অনেক বেশি।
একটু অবাক হয়েই বললাম, আমার উপরে রেগে ছিলে? কেন?
রীতু কিছু সময় শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল টিভির দিকে। তারপর বলল, আমি সেদিন জানতাম যে তোমরা এক সাথে অংক করবে। তুমি হয়তো জানো না যে প্রায় রাতেই নাইম আমার সাথে দেখা করতে আসত। এই ধর রাত বারোটা একটার দিকে। সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ত তখন সে আমার ঘরের জানালার কাছে এসে হাজির হত। ঘন্টা খানেক আমরা গল্প করতাম তারপর সে চলে যেত। এটাই আমাদের রুটিন ছিল।
আমি এই গল্প জানতাম। নাইম নিজেই আমাকে বলেছে।
-সেদিনও আমাদের দেখা করার কথা ছিল। কিন্তু নাইম আমাকে আগেই জানিয়েছিল যে আমি যেন অপেক্ষা না করি। আজকে সে তোমার সাথে পরীক্ষার অংক করবে। পরদিন আমি যখন সংবাদটা জানতে পারলাম তখন আমার কী মনে হয়েছিল জানো? মনে হয়েছিল যে তোমার তো ওর সাথে থাকার কথা ছিল, তুমি কেন ছিলে না? যদি তুমি থাকতে তাহলে আজকে ও এই কাজ করতো না।
আমি রীতুর দিকে তাকিয়ে দেখলাম ওর চোখের পানি কেমন যেন টলমল করছে। নাইম মারা গেছে সেই কত বছর হয়ে গেছে। আট বছরের বেশি। তারপরেও এই মেয়েটা এখনও নাইমকে মনে রেখেছে এইভাবে। আমি বুঝতে পারলাম যে রীতু তারপর আমার প্রতি কেন এমন শীতল আচরণ করেছিল। সত্যি বলতে কি সেদিনের আমার চলে আসা নিয়ে আমার নিজের ভেতরেও একটা অপরাধবোধ কাজ করেছে সব সময়। আমার মনে হয়েছে আমি যদি একটু জোর দিতাম, ওকে জোর করে আমাদের বাসায় নিয়ে আসতাম তাহলে আজকে হয়তো নাইম বেঁচে থাকত । আমাদের সবার জীবন বুঝি তাহলে অন্য রকম হয়ে যেত।
নাইমের বাবা মায়ের সম্পর্ক ভাল ছিল না। এই খবর আমাদের কাছে অজানা ছিল না। এই নিয়ে নাইমের মনে একটা তীব্র দুঃখবোধ কাজ করতো সব সময়। তার বারবার কেবল মনে হতে যে অন্য সবার বাবা মায়ের মত তার বাবা মাও কেন এক সাথে মিলে মিশে থাকতে পারে না। নাইমের এই সিদ্ধান্ত যে এক দিনের নেওয়া নয় সেটাও আমার বুঝতে কষ্ট হয় নি।
রীতু বলল, আসলে আমার তখন রাগ করার দরকার ছিল নাইমের উপরে। সে কেন এভাবে আমাকে একা রেখে চলে গেল কিন্তু আমি তার উপরে রাগ করতে পারছিলাম না। কারো উপরে তো রাগ গিয়ে পড়া দরকার ছিল। তাই তোমাকে বেঁছে নিয়েছিলাম। আমার সব রাগ আগে তোমার উপরে গিয়ে পড়েছিল।
আমি এবার সেই কারণটা বুঝতে পারলাম। আমার মনে সেই কথাটা প্রায়ই আসতো তখন। রীতু আমার উপরে কোন কারণে রেগে আছে। অথচ আমি তখন সেই কারণটা বুঝতে পারি নি। এখন আমার কাছে ব্যাপারটা পরিস্কার হয়েছে।
রীতু বলল, তুমি জানো নাইমের সাথে আমার ভাব কেন হয়েছিল?
-কেন?
-ওর সাথে আমার একটা মিল ছিল।
-কোন দিকটা?
রীতু একটু থামল। তারপর বলল, আমার বাবা মাও ঠিক ওর বাবা মায়ের মত ছিল। তারা বিবাহিত জীবনে অখুশী ছিল। আমাকে প্রতিনিয়ত কী শুনতে হত জানো?
কিছু সময় নিরবতা। আমি কোন উত্তর দিলাম না। দেখতে পেলাম আবারও সেই টিভির দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। আমার কাছে মনে হল যেন ও আমার চোখের দিকে তাকাতে চাইছে না। রীতু বলল, আমাকে প্রতিনিয়ত শুনতে হত যে আমার কারণে তারা একে অন্যের কাছ থেকে আলাদা হয়ে যেতে পারছে না। আমার সব সময় মনে হত যে আমি যদি না থাকতাম তাহলেই বুঝি আমার বাবা মা আলাদা হয়ে শান্তিতে থাকতে পারতেন। আমার অন্য সবাইকে খুব হিংসে হত। কিন্তু যখন আমি নাইমের ব্যাপারটা জানতে পারলাম, ওর বাবা মায়ের ব্যাপারটা আমার কানে এল তখন ওকে কেন জানি আপন মনে হয়েছিল। আমরা দুইজন দুজনকে কাছে টেনে পেয়েছিলাম। স্ট্রেস রিলিফ বলতে পারো। আমি জানি না ওকে আমি কতখানি ভালবাসতাম তবে সে আমার একটা শান্তির জায়গা ছিল। তারপর ঐদিন সেও আমাকে ছেড়ে চলে গেল।
ঘরে আবারও নিরবতা নেমে এল। আমি সত্যিই বুঝতে পারলাম না যে আমার এই খানে কী বলা উচিৎ। আমার মাথার ভেতরে তখন কী চলল আমি জানি না তবে আমি কাপটা টিটেবিলের উপরে নামিয়ে রেখে রীতুর কাছে গিয়ে বসলাম। আমি নিশ্চিত না যে আমি কী করছি। হয়তো রীতু আমার এই আচরণে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। তবে এই কাজটা আমার ভেতর থেকে আপনা আপনিই হল। আমি রীতুর পাশে বসে ওর হাত ধরলাম। একটা ভয় অবশ্য ছিল যে রীতু আমার হাত ছাড়িয়ে নিবে। তবে সে নিল না।
-আমি আজকে তোমাকে আমার বাসায় কেন নিয়ে এলাম জানো?
-কেন?
-কদিন থেকে নিমিলা বাসায় নেই। আমি যখন বাসায় একা থাকি তখন আমার ভেতরে সুইসাইডাল চিন্তা আসে বারবার। গত দুইদিনে রাতে কতবার যে আমার এই চিন্তা এসেছে তার কোন ঠিক নেই। আজকে মনে হল যে যদি আমি একা থাকি তাহলে আজকে সত্যি সত্যিই কিছু করে ফেলব। কিন্তু আমি এতোটা সাহসী নই। হলে কবেই এই কাজটা করে ফেলতাম। নাইমের মারা যাওয়ার পরেই ওর বাবা মায়ের মধ্যেকার ঝগড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
অবাক করার ব্যাপার সত্যিই ছিল এটা। নাইমের মারা যাওয়ার পরে সত্যিই নাইমের বাবা মা আর ঝগড়া করেন নি। ওর মা কেমন যেন নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিলেন। রীতু আবার বলল, আমার বারবার মনে হত যে আমি যদি মারা যাই তাহলে বুঝি আমার বাবা মাও আর ঝগড়া করবে না।
আমার মাঝে কী হল যে আমি বলতে পারব না । আমি এবার রীতুকে জড়িয়ে ধরলাম। ওর মাথাটা একেবারে আমার বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরলাম আলতো করে। রীতু আমাকে বাঁধা তো দিলোই না বরং নিজেকে যেন আমার বুকের সাথে আরো গভীর ভাবে মিশিয়ে দিল। আমি বললাম, খবরদার এই সব কথা বলবে না। তোমার কোনো দোষ নেই এসবে।
এই বলে আমি ওকে এবার সত্যি জড়িয়ে ধরলাম। আমার মনে হল যেন রীতুও আমাকে জড়িয়ে ধরে আরও একটু শান্তি একটু আশ্রয় খোজার চেষ্টা করছে। কত সময় আমরা এভাবে আমি ওকে জড়িয়ে ধরে ছিলাম সেটা আমি নিজেও জানি না। রীতু অনেকটা সময় আমার বুকের মাঝে নিজেকে কিছু সময় লুকিয়ে রাখল। তারপর সেখান থেকেই বলল,
আমি সেই শুরু থেকেই জানি যে তুমি আমাকে পছন্দ কর। নাইমও জানতো
-কী নাইমও জানতো? আমি কোন দিন ওকে বলি নি।
-পুরুষ মানুষ চাইলেও তাদের ভালোবাসার ব্যাপারটা লুকিয়ে রাখতে পারে না। একটা মেয়ে চাইলে সারা জীবন পারে । নাইম আমাকে একদিন বলেছিল যে যদি আমাদের কোন কারণে বিয়ে না হয় তাহলে আমি যেন তোমাকে বিয়ে করি। তুমি ছেলে ভাল।
-তাই বুঝি?
-হ্যা। নাইম তোমাকে অনেক পছন্দ করত। ও প্রায়ই বলত যে বাসায় যখন অশান্তি লাগত তোমাদের বাসায় চলে যেত ।
নাইম প্রায় দিনই আমাদের বাসায় আসত। আমরা স্কুল কলেজ আর পড়াশুনা বাদ দিয়েও অনেকটা সময় এক সাথে কাটাতাম। আমার মাঝে এই অপরাধবোধটা তাই সত্যিই অনেক বেশি ছিল। সেদিন যদি ওকে জোর করে আমার বাসায় নিয়ে আসতাম তাহলে আজকে হয়তো ও জীবিত থাকত।
তারপরের ঘটনা সহজেই অনুমান করা যায়।
রীতুর সাথে আমার প্রেম শুরু হয়ে গেল। আমার মনে একটু ভয় অবশ্য ছিল যে হয়তো রীতু পরের দিন বলবে যে রাতে সে একটু আবেগে ভেসে গিয়েছিল। আমি যেন কিছু মনে না করি। তবে সেটা সে বলে নি। সপ্তাহে সাতটা দিনই আমরা লম্বা সময় ধরেই একে অন্যের আশেপাশে থাকতাম। একটা সময়ে আমাদের অফিসেও ব্যাপারটা বেশ ভাল ভাবেই জেনে গেল। তারা আগে থেকেই জানতো যে আমরা স্কুল কলেজের সময় থেকেই একে অন্যকে চিনি। তাই এমন কিছু যে হতে পারে সেটা তাদের আগে থেকেই ধারণা ছিল।
রীতু অবশ্য এখনও আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয় নি। ওর মনে এখনও এই ভয়টা কাজ করে যে হয়তো বিয়ে পরে আমাদের জীবনটাও ওর বাবা মায়ের মত হবে। আমি ওকে অনেক ভাবেই বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে এমন কিছু হওয়ার সম্ভবনা নেই। তবে এখনও পুরোপুরি আশ্বস্ত হতে পারে নি। তবে আমি আশাবাদি যে একদিন সে ঠিকই আমার উপরে ভরশা করতে পারবে আর আমরা সেদিনই বিয়ে করে ফেলব। সেই দিনটির জন্য আমরা অপেক্ষা করছি। আপনারাও অপেক্ষা করুন।
ফেসবুকের অর্গানিক রিচ কমে যাওয়ার কারনে অনেক পোস্ট সবার হোম পেইজে যাচ্ছে না। সরাসরি গল্পের লিংক পেতে আমার হোয়াটসএপ বা টেলিগ্রামে যুক্ত হতে পারেন। এছাড়া যাদের এসব নেই তারা ফেসবুক ব্রডকাস্ট চ্যানেলেও জয়েন হতে পারেন।
Discover more from অপু তানভীর
Subscribe to get the latest posts sent to your email.