মিমিকে আমি চিনি অনেক দিন থেকেই। স্কুল জীবনে আমরা এক সাথে পড়াশোনা করেছি। ওর বাবা ছিলেন সরকারি অফিসার। বদলির চাকরি ছিল। তাই প্রায়ই বদলী হতেন। মিমিরা আমাদের এলাকাতে থাকতে আসে যখন মিমি ক্লাস এইটে পড়ে। শান্ত স্বভাব আর চুপচাপ গোছের একটা মেয়ে একদিন আমাদের ক্লাসে এসে হাজির হল। আমাদের সবার চোখ গিয়ে পড়ল মিমির উপর। নতুন কেউ ক্লাসে এসে হাজির হলে স্বাভাবিক ভাবেই সবার চোখ তার উপরে পড়বে। আমাদের পুরো ক্লাসের চোখ মিমির উপরে গিয়ে স্থির হল। মিমির পুরো ক্লাসে একবার চোখ বুলিয়ে তারপর আমার উপরে এসে দৃষ্টি নিবব্ধ করল। মিমির চোখের ভেতরে কিছু ছিল সেটা আমার পুরো শরীরকে কাঁপিয়ে দিল। আমি চোখ সরিয়ে নিলাম। তবে আবারও ওর দিকে তাকাতে বাধ্য হলাম। আমার মনে হচ্ছিল যে মিমির দিকে না তাকালে বুঝি আমি মারা যাব। এটা এক অদ্ভুত অনুভূতি ছিল।
আমি যখন আবারও মিমির দিকে ফিরে তাকালাম তখন দেখি মিমি তখনও আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। ওর চোখে একটা অদ্ভুত হাসি।
মিমি এমন একজন মেয়ে ছিল যাকে প্রথম দেখাতেই সবাই পছন্দ করবে। এই মেয়ে যে বড় হলে আগুন সুন্দরী হবে সেই ব্যাপারে কারো কোনো সন্দেহ ছিল না। আমাদের ক্লাসের প্লে বয়গুলো মিমির সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করতে লাগল তবে মিমি কারো সাথেই ঠিকঠাক কথা বার্তা বলত না। কেবল আমি ছাড়া। সে আমার সাথে ঠিকই কথা বলত। আমার সাথে তার কথা বলার কোনো কারণ ছিল না। আমি কোন দিক দিয়েই অন্যান্য ছেলেদের সাথে পেরে উঠব না। চেহারা মেধা কিংবা বাপের টাকা, কোনটাই আমার ছিল না। তারপরেও মিমির সাথে আমার ভাব হল। এর একটা কারণ হতে পারে যে মিমির বাবার মত আমার বাবাও সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। এই কারণেই হয়তো সে আমার সাথে কথা বলত। এছাড়া আসলে আর কোন কারণ ছিল না।
মিমি যখন ক্লাস নাইনে উঠল তখন ছেলেদের পাল পড়ে গেল তার উপর। আগে তো কেবল উপরের ক্লাসের বড় ভাইরা আসছিল এখন শহরের অন্যান্য স্কুল কলেজের ছেলেরাও মিমির পেছনে ঘুরঘুর করতে লাগল। বিশেষ করে যখন কোচিং থেকে ফিরতাম তখন মিমি মাঝে মাঝে রিক্সায় না এসে আমার পাশাপাশি হেটে আসতো। তখন আমি এইগুলো বেশ ভাল করেই খেয়াল করতাম। মিমি আমার সাথে কেবল কথা বলব বলে আমাকে ছেলেরা ঠিক দেখতে পারত না। আমার থেকে দুরে দুরে থাকত। আবার অনেকেই আমার সাথে ভাব জমাত আমার মাধ্যমে মিমির সাথে দেখা করবে বলে।
ক্লাস টেনের মাঝামাঝি উঠেই মিমির বাবার বদলির নির্দেশ এল। মিমির বাবা ওদের রেখেই কর্মক্ষেত্রে চলে গেল। তারপর থেকেই মিমির উপরে জ্বালাতন বুঝি একটু বেড়েই গেল। তবে আমি খেয়াল করে দেখতাম যে মিমি সেই শান্ত স্বভাবেই দিন পার করছে। ওর মুখে কখনই কোনো চিন্তার ছাপ দেখতে পেতাম না। অন্য মেয়েদের পেছনে ছেলে লাগলে সেই মেয়ে তো বটেই তার পুরো পরিবারের লোকজন চিন্তায় মরে যায় সেখানে মিমির কোন চিন্তাই ছিল না।
তবে ব্যাপারটা আরেকটু ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াল যখন আমাদের এলাকার এসপির ভাতিজা মিমির পেছনে পড়ল। তখন আমার মনে হল এবার মিমির একটা বিপদ হবেই। আমি ওকে সাবধান করলাম। তবে মিমি কেবল হাসল আমার দিকে তাকিয়ে। ওর চোখের দৃষ্টি আমাকে বলে দিল যে সে মোটেই ভীত নয়।
মিমিদের সরকারি কোয়াটার আর আমাদের কোয়াটার কাছাকাছি ছিল। তাই স্কুলে যাওয়া আসা আমাদের এক সাথেই করা হত। মাঝে মাঝে মিমি আমাদের বাসায় এসে হাজির হত। মায়ের সাথে মিমির কেন জানি বেশ ভাব হয়ে গেল। শান্ত স্বভাবের মেয়েদের সবাই পছন্দ করে। আমিও কয়েকবার মিমিদের বাসায় গিয়েছি। মিমির মা মিমির মত সুন্দরী। তবে সে কেন জানি খুব বেশি নির্জিব। একদমই কথা বলেন না। আমার দিকে শান্ত ভাবে একবার তাকিয়ে আবার নিজের কাজে মন দিতেন। আমি যতবার মিমিদের বাসায় যেতাম, প্রতিবারই দেখতে পেতাম যে ওদের বাসার সামনে বা রাস্তার দিকে কেউ না কেউ দাঁড়িয়ে আছেই।
দেখতে দেখতে আমাদের এসএসসি পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল। আমি পড়াশোনা নিয়ে এতোই ব্যস্ত হয়ে গেলাম যে অন্য দিকে তাকানোর কোন সুযোগই ছিল না। তবে প্রতিদিন পরীক্ষা শেষ করে মিমির সাথে দেখা হত ঠিকই। আসার পথে আমাদের মাঝে কথাও হত বেশ। মিমি আমার সাথে কত ধরনের কথা যে বলত তার ঠিক নেই। মাঝে মাঝে সে তার অদ্ভুত স্বপ্নের কথা জানাত। এভাবেই আমাদের দিনটা কেটে যাচ্ছিল।
তবে একেবারে শেষ পরীক্ষার দিন একটা ভয়ংকর ঘটনা ঘটল। আমাদের পরীক্ষার কেন্দ্র আর আমাদের বাসায় ভেতরে একটু দুরত্ব ছিল। পরীক্ষার হলে যাওয়ার জন্য বাবা নিজের অফিসের গাড়িতে করে আমাকে আর মিমিকে পৌছে দিতেন। তবে আসার সময়ে আমাদের রিক্সা করে আসতে হত। এতে অবশ্য আমার কোন সমস্যা ছিল না। মিমিরও কোন সমস্যা ছিল না। শেষ পরীক্ষার দিন সবাই আমরা আড্ডা দিচ্ছিলাম। সেই সময়ে আমি মিমিকে দেখলাম। সে আমাকে ডাক দিল। তার দিকে এগিয়ে যেতেই সে জানালো যে সে একটু নিউ মার্কেটে যাবে, আমি সাথে যাবো কিনা। আমার আপত্তি করার প্রশ্নই আসে না। ওর সাথে ঘুরতে পারাটাও আমার জন্য আনন্দের ছিল।
আমরা রিক্সা নিয়ে বের হলাম। নিউমার্কেটে কেনাকাটা শেষ করে বার্গার খেয়ে তারপর ফেরার পথ ধরলাম। প্রথমে রিক্সা নিলেও তিন রাস্তার মোড়ে এসে মিমি রিক্সা থেকে নেমে পড়ল। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আমাদের বাসাটা এখনও কিছুটা দুরে। মিমি রিক্সা ছেড়ে দিয়ে হাটতে শুরু করল। আমিও মিমির পাশাপাশি হাটতে লাগলাম। হাটতে হাটতে আরেকটা মোড়ে এসে আমরা থামলাম।
এবার মিমি আমাকে চলে যেতে বলল। আমি একটু অবাক হলাম। তখন মিমি আমাকে জানাল যে ও একজনের সাথে দেখা করবে! আমি যখন তার সাথে আসতে চাইলাম তখন মিমি হেসে বলল এতো কষ্ট করতে হবে না। সে নাকি রাতে এখানেই থাকবে। আমার বুঝতে কষ্ট হচ্ছিল না যে মিমি আসলে আমাকে এখন তার সাথে রাখতে চাইছে না। আমার যে একটু কষ্ট হল না সেটা বলব না। আমার মনে হল যে মিমি বুঝি অন্য কারো সাথে দেখা করতে যাচ্ছে। অন্য কোন ছেলেকে সে পছন্দ করে। যদিও মিমি আমাকে কোন দিন মুখ ফুটে বলে নি যে সে আমাকে পছন্দ করে । মিমি যেন আমার মনের কথাই টের পেয়ে গেল। সে এবার অদ্ভুত একটা কাজ করল। অন্তত এই কাজ যে সে করবে এমন একটা চিন্তা আমার মাথায় কোনো দিন আসে নি। আমার একেবারে কাছে চলে এল। তারপর আমাকে গালে একটা চুমু খেল। আমি এতোটাই অবাক হয়ে গেলাম যে কোন কথাই বলতে পারলাম না। সে আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, তুমি যা ভাবছো সেটা না। আমি অন্য কাউকে পছন্দ করি না। আমাকে একটা কাজ করতে হবে। ঠিক আছে। তোমার সামনে কাজটা হবে না। বুঝতে পেরেছো?
আমি মাথা ঝাকালাম। আমার মাথা যেন হ্যাঙ্ক হয়ে গেছে। মিমি যে আমাকে চুমু খেতে পারে এই ভাবনাটা আমার মাথায় ঢুকছেই না। আমি ভাবতেই পারছি না। মনের ভেতরে তীব্র এক আনন্দ কাজ করছে।
মিমি একটু হাসল আবার। তারপর আমাকে রেখেই হাটা দিল। তবে মিমি যেদিকে হাটা দিল সেদিকটাতে আসলে কিছু নেই। এদিকটায় বনজঙ্গল রয়েছে। বিরান ভূমি রয়েছে। একটা শ্মশান রয়েছে। সনাতন ধর্মের কেউ মারা গেলে তাদের পোড়াতে হলে এই রাস্তায় যায়। এছাড়া মানুষজন খুব একটা যায় না। কিছু সময় রিক্সার জন্য দাঁড়িয়ে থেকে হাটা শুরু করব ঠিক তখনই আমি মিরাজকে দেখতে পেলাম। মিরাজ হচ্ছে আমাদের এলাকার এসপির ভাতিজা। সে বাইক নিয়ে মিমি যে রাস্তায় গেছে সে রাস্তা দিকে গেল।
আমার মনের ভেতরে একটু কু ডেকে উঠল। আমার একবার ইচ্ছে করল যে ওদের পেছনে আমিও সেই রাস্তায় ঢুকি, হয়তো মিমির কোন বিপদ হবে কিন্তু কেন জানি ঢুকলাম না। আমার মনে হল আমার কানের কাছে কেউ যেন আমাকে বলল যে আমি যেন এখান থেকে দ্রুত চলে যাই। আমার এখানে থাকা উচিৎ হবে না। কেন এমন একটা অনুভূতি আমার হল সেটা আমি জানি না। আমি বাসার দিকে হাটা দিলাম।
আমার মনের ভেতরে একটা অস্বস্তি কাজ করছিল। মিমির জন্য একটা চিন্তা হচ্ছিল। মিমি যে পথে গেছে মিরাজও সেই পথেই গেছে। পথের মধ্যে মিমিকে একা পেয়ে যদি মিরাজ কিছু করে। ঐদিকে তো মানুষজন একজন নেই। আমার আসলে মিরাজের পেছনে যাওয়া দরকার ছিল।
ঘটনাটা জানাজানি হল আরও দুইদিন পরে। মিরাজের লাশ পাওয়া গেছে সেই এলাকাতে। ঐ এলাকাতে মানুষজনের আনাগোনা নেই। মানুষ সেখানে যায় না বললেই চলে। পুরো জেলার সনাতন ধর্মের মানুষদের পোড়ানো হয় সেখানে। ব্যাস এই পর্যন্তই। গতকাল একজন মারা গিয়েছিল। তাকে পোড়াতে নিয়ে যাওয়ার সময়ই রাস্তার পাশে একটা বাইক দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লোকজন। তাদের ভেতরেই একজন বাইকটা চিনতে পারে। সেই পরে মিরাজের বাসায় খবর দেয়। মিরাজ দুইদিন ধরে বাসায় আসে নি। তার ফোনও বন্ধ। তাই বাইকের খোজ পেয়েই বাড়ির লোকজন সেখানে গিয়ে হাজির হয়। একটু খোজ খবর করতেই জঙ্গলের ভেতরে মিরাজকে পড়ে থাকতে দেখে তারা। প্রথমে তারা ভেবেছিল যে হয়তো মদ খেয়ে মাতাল হয়ে বেহুদ হয়ে পড়ে আছে তবে একটু ভাল করে পরীক্ষা করতেই তারা আবিস্কার করে যে মিরাজের দেহে প্রাণ নেই। পুলিশ আগেই এসে হাজির। এসপি সাহেব নিজে গিয়েছেন। ফরেন্সিক জানালো যে মিরাজের দেহে কোনো রক্ত নেই। কিন্তু সেই রক্ত কিভাবে বের করে নেওয়া হয়েছে সেটাও তারা ঠিক বুঝতে পারছে না। রক্তের অভাবেই মিরাজ মারা গেছে।
পুরো শহরে হুলস্থুল পড়ে গেল। মিজারের চাচা জেলার এসপি। মিরাজের খুনের রহস্য বের করতে উঠে পড়ে লাগল তবে আশ্চর্যজনক ভাবে কেউ কোন খবর দিতে পারল না। কেউ জানেই না কিভাবে কী হয়েছে।
আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না। আমি জানি সেদিন মিরাজ গিয়েছিল ঐদিকে। আমি ওকে যেতে দেখেছিলাম। অবশ্য মিরাজকে বাইকে এদিকে আসতে অনেকেই দেখেছিল তবে আমি যা জানি, আমি যা দেখেছি তা কেউ জানে না। আমি মিমিকে ঐদিকে যেতে দেখেছিলাম। আর কেউ ব্যাপারটা জানে না। আমি যদি এখন এই কথা পুলিশকে জানাই তবে নিশ্চিত পুলিশ মিমিকে ধরে নিয়ে যাবে, অন্তত জিজ্ঞাসাবাদ তো করবেই। আমি মোটেই এটা করতে চাইলাম না।
অবশ্য এরপর মিমিরা আর বেশি সময় আর ওখানে থাকে নি। ওর বাবার কাছে চলে গিয়েছিল। যাওয়ার আগে শেষবারের মত মিমি আমার সাথে দেখা করেছিল। আমাকে জানাল যে সে আমার প্রতি কৃতজ্ঞ সেদিনের কথা আমি কাউকে বলি নি। এই কথা আমি কাউকে বললে হয়তো তার উপরে অনেক ঝামেলা এসে পড়ত।
তারপর মিমি প্রথমবারের মত আমাকে জড়িয়ে ধরল। গতবার আমার গালে চুমু খেলেও এবার সে আমার ঠোটে চুমু খেল। তারপর বলল, আমাকে মনে রাখবে তো?
আমি বললাম, রাখবো।
-ভুলে যেও না কেমন? আমরা একবার কাউকে ভালবাসলে আর কখনো তাকে ভুলি না। তোমাকেও ভুলব না।
আমি বললাম, আমাদের আর যোগাযোগ হবে না? তোমাকে চিঠি লিখব আমি। তোমার বাবার অফিসে ফোন করব।
মিমি একটু চুপ করে থেকে বলল, আমি এমন একটা কাজ করেছি যেটা আমার করা ঠিক হয় নি। তাই এখান থেকে চলে যেতে হবে। এখানকার কিছুর সাথে যোগাযোগ রাখা চলবে না।
মিমি কথা শুনে আমি কিছু বুঝতে পারলাম না। বললাম, কী করেছো?
-কী করেছি সেটা জানতে চেও না। সব কিছু জানতে নেই।
আমার খুব ইচ্ছে করল মিমিকে প্রশ্নটা করার যে মিরাজ হত্যায় তার কোন প্রকার হাত আছে কিনা কিন্তু আমি প্রশ্নটা করলাম না। আমার মনে ভয় ছিল যে সে হয়তো বলবে তার হাত ছিল। তার চেয়ে বরং আমি এটা বিশ্বাস করে নিলাম যে মিমির হাত থাকতেই পারে না। কোন ভাবেই এটা আসলে সম্ভব না। মিমির মত একজন সাধারণ মেয়ের পক্ষে আসলে মিরাজের মত কাউকে মেরে ফেলা কোন ভাবেই সম্ভব না। আর এছাড়া আরেকটা ব্যাপার আমাদের কারো মাথাতেই ঠিক ঢোকে নি। মিরাজ যে আসলে কিভাবে মারা গেছে সেটা কেউ বুঝতেই পারে নি।
পত্রিকা পড়ে যা জানতে পেরেছি তা হচ্ছে মিরাজ মারা গেছে রক্ত শূন্যতার কারণে। তার শরীর থেকে সবটুকু রক্ত বের করে নেওয়া হয়েছে তবে কিভাবে সেই কাজটা করা হয়েছে সেটা ডাক্তাররা ধরতে পারে নি। এটাই সব থেকে বড় সমস্যা। কোন সমাধান হল না মিরাজ হত্যা কেসের। অবশ্য এর পরে এই রকম আর কোন খুনও হল না আমাদের জেলাতে।
মিমিরা সেই দিন রাতেই চলে গেল।
দুই
তারপর অনেকগুলো বছর কেটে গেল। কলেজ পাশ করার পরে আমি ঢাকাতে এলাম পড়াশোনার জন্য। আমার মনে একটা ক্ষীণ আশা ছিল যে ঢাকাতে থাকাকালীন সময়ে মিমির সাথে আমার কোন না কোন ভাবে দেখা হবে। মিমি পড়াশোনাতে খুবই ভাল ছিল। তাই আশা করেছিলাম যে মিমি হয়তো ঢাকা মেডিকেলে কিংবা বুয়েটে পড়াশোনা করবে। নয়তো ঢাবির ভাল কোনো বিষয় নিয়ে পড়বে। এই আশা নিয়েই আমি এই ক্যাম্পাসে কত ঘুরে বেরিয়েছি তার ঠিক নেই কিন্তু মিমির দেখা আমি পাই নি আর। এক সময়ে আমার মনে হল যে মিমির সাথে আর আমার কোন দিন দেখা হবে না। আমার সাথে মিমির আবারও দেখা হল। এমন জায়গায় মিমির সাথে আমার দেখা হল যেটা আমি আশা করি নি।
পড়াশাওনা শেষ করে আমি একটা সরকারি চাকরিতে ঢুকে গেলাম। তবে প্রথম পোস্টিংটা হল বাংলাদেশের একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলে। অবশ্য আমার তাতে খুব একটা আপত্তি ছিল না। ঢাকার মত বড় শহর গুলোতে আমার দম বন্ধ মত লাগে। আমিও চাইছিলাম যেন আমার কাজের ক্ষেত্র কোন ছোট শহরের হয়, যেন এখানে ঝামেলা কম হয়।
আমার চাকরির প্রথম পোস্টিং ছিল সাতক্ষীরা জেলায়। সুন্দরবনের কাছাকাছি একটা জায়গায়। নির্জন শান্ত মফশ্বল শহর। এখানে আমি নিশ্চিন্তে কিছুদিন কাটিয়ে দিতে পারব ভাবলাম। এখানে আসার সপ্তাহ খানেক পরে আমি আমি মিমিকে দেখতে পেলাম। মিমি এখানকার সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার! আমি একটা কাজে হাসপাতালে গিয়ে হাজির হয়েছিলাম আর সেখানেই মিমিকে দেখতে পেলাম। ঘর আলো করে সে বসে আছে। আমার প্রথম কয়েক মুহুর্ত যেন বিশ্বাস হল না যে মিমি আমার সামনে ! এতোগুলো বছর পরে সে এভাবে আমার সামনে এসে হাজির হবে! আমি প্রথমে কী বলব খুজেই পেলাম না। কেবল অবাক চোখে মিমির দিকে তাকিয়ে রইলাম। মিমি আগের থেকে আরও বেশি সুন্দর হয়েছে। আমি ওকে এক দেখাতেই চিনে ফেললাম। তবে আমার মনে সন্দেহ ছিল হয়তো মিমি আমাকে চিনতে পারবে না। তবে সেই সন্দেহ দূর হয়ে গেল যখন সে আমার দিকে তাকাল। কয়েক মুহুর্ত তারপরেই ওর মুখে হাসি ফুটে উঠল। সে আমাকে চিনতে পেরেছে। এতোগুলো বছর পরেও সে আমাকে প্রথম দেখাতেই চিনতে পারল?
এসেছিলাম অফিসের কাজে কিন্তু আর অফিসে ফেরৎ যাওয়া হল না। মিমি কিছুতেই আমাকে যেতে দিল না। দুপুর হয়েছে তখন। লাঞ্চের সময়। আমাকে নিয়ে সোজা সে তার নিজের কোয়াটায়ে হাজির হল। এতোগুলো বছর পরে ওর আন্তরিকতা দেখে আমি সত্যিই অবাক হয়ে গেলাম। দুপুরের খাবার খেতে খেতে অনেক কথা হল। মিমি জানালো যে এখানে সে পোস্টিং নিয়ে এসেছে মাত্রই। সদ্য বিসিএসে দিয়ে ঢুকেছে। শুরুটা এখান থেকেই। আমিও জানালাম যে আমার চাকরি জীবন শুরু এই অঞ্চল থেকেই।
সত্যিই বলতে কি এরপরেই মিমির সাথে আমার ভাব ভালোবাসা গড়ে উঠল। আমি ভেবেছিলাম ছোট বেলার সেই পছন্দের কথা মিমি বুঝি মনে রাখে নি। মনে না রাখাই স্বাভাবিক কিন্তু সে আমাকে ভুল প্রমাণিত করল। প্রায় দিনই তার ডিউটি শেষ হলে সে আমার অফিসে এসে হাজির হত, বিকেলে আমরা শহরের এদিক ওদিক ঘুরতে যেতাম। এছাড়া আরও একটা কাজ হত। মিমির সপ্তাহে তিনদিন নাইট ডিউটি থাকত। এই নাইট ডিউটিতে আমি ওর কেবিনে গিয়ে হাজির হতাম। আধা ঘন্টা পরপর সে একবার পুরো হাসপাতালে রাউন্ড দিয়ে আসতো আর বাকি সময়টা আমরা কেবিনে বসে গল্প করতাম। সারারাত আমাদের এই গল্প চলত। কত রকমের কথা যে আমাদের বলার ছিল তার কোন ঠিক ছিল না।
একদিন মিমিকে আমি তার পছন্দের কথা বললাম। সে এখনও আমাকে মনে রেখেছে দেখে আমি অবাক হয়েছি, এই ব্যাপারটা তাকে জানালাম। মিমি তখন বলল, আমি তোমাকে বলেছিলাম না যে আমরা একবার কাউকে ভালবাসলে তাকে আর ভুলি না।
আমরা বলতে কি ও ওরা মানে মেয়েরা বুঝেছিল? এভাবে স্পেসিফিক ভাবে আমরা বলতে ও কী বুঝাল?
আমি জানতে চেয়েছিলাম আমরা বলতে?
মিমি আমার কথা জবাব দিল না। তার বদলে বলল, সব কিছু জানতে নেই।
সব কিছু ভাল ভাবেই চলছিল তখনই একটা ঝামেলা এসে হাজির হল। একদিন আমি অফিস থেকে বের হয়ে বাসার দিকে যাচ্ছি এমন সময় কয়েকজন লোক আমাকে ঘিরে ঘরল। আমার মনে একটা ভয় এসে জড় হল। প্রথমে মনে হয়েছিল আমি বুঝি ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছি তবে একটু পরেই বুঝতে পারলাম যে তারা ছিনতাই করবে না। তারা আমাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে একটা নির্জন জায়গাতে নিয়ে গিয়ে হাজির করল। আমি ভয়ে ভয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলাম। এখনও সন্ধ্যা হতে অনেক বাকি। জায়গা অবশ্য একেবারে নির্জন নয়। এটা একটা বাগান মনে হল। অনেক বড় বড় গাছ পালা রয়েছে। কিছু ফলের গাছও আমি চিনতে পারছি। বাগান থেকে আমি দুরের রাস্তাও দেখতে পাচ্ছি। সেখানে মানুষজনের চলাচলও চোখে পড়ছে আমার। আমার মনে একটা চিন্তা এসে হাজির হল যে এরা আমাকে মেরে ফেলবে না। মেরে ফেললে এই জায়গাতে নিয়ে আসতো না। অন্য কোথাও নিয়ে যেত। এরা যে সরকারি দলের লোকটা সেটা আমি বুঝতে পারলাম। নয়তো এতো সাহস কারো হত না। এভাবে প্রকাশ্যে কাউকে তুলে নিয়ে আসাটা মুখের কথা না। আমাকে কে তুলে নিয়ে এল সেটা আমি টের পেলাম কিছু পরেই। একটা কালো রংয়ের গাড়ি এসে থামল আমার সামনে। আমি দেখলাম গাড়িতে একজন সাদা পাঞ্জাবি পরা লোক নামল। লোকই বলব। বয়স চল্লিশের বেশি হবে। মুখে একটু স্টাইলিশ দাড়ি রয়েছে। আমি অবাক হয়ে দেখলাম এই মানুষ আর কেউ নয়, আমাদের জেলার সংসদ সদস্য। ফারাজ করিম।
এই লোক আমার কাছে কী চায়?
ফারাজ করিম আমার কাছে আসতেই দেখলাম বাকিরা একটু দুরে চলে গেল। তারা মনিবের কথা শুনতে চায় না কিংবা মনিব কী কথা বলবে সেটা শোনার অনুমতি তাদের নেই। আমি আসলে কী বলব বুঝতেই পারছিলাম না। আমার কোন ধারণাই ছিল না যে আমাকে এখানে কেন আনা হয়েছে?
আমার মাধ্যমে আমার অফিসের কোন অবৈধ সুবিধা নিবে? আমি জানি না। এছাড়া আর কোন কি কারণ আছে?
কিন্তু ফারাজ করিম যে কথাটা প্রথমে বলল সেটা শুনে আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। সে বলল, আপনি নওরিন আফরোজকে কিভাবে চিনেন?
নওরিন আফরোজ?
তারপরেই আমি বুঝতে পারলাম এই লোক কার কথা বলছে এবং আমাকে ঠিক কেন এখানে আনা হয়েছে। নওরিন আফরোজ হচ্ছে মিমির ফরমাল নাম।
চলবে…..