শয়তানের ভোজ

4.5
(13)

শুরুর আগের কথা 

মেয়েটা দৌড়াচ্ছে । কতক্ষন ধরে দৌড়াচ্ছে সে বলতে পারবে না । কদিন থেকেই কে কেবল পালিয়েই বেড়াচ্ছে । কার কাছে যাবে কিংবা কাকে সে ঠিক মত বিশ্বাস করতে পারে সেই কথা সে জানে না । এক লোকালয় পার হয়ে অন্য লোকালয়ে চলে এসেছে । দিন পর হয়ে গেছে । সময় জ্ঞান তার অনেক আগেই চলে গেছে । কেবল সে জানে রাত হচ্ছে, সে একটু থামছে বিশ্রামের জন্য আবার রাত থাকতে থাকতে থাকতে আবারও বেরিয়ে পরছে । 

এই কদিনে তার খাওয়া দাওয়ার কোন ঠিক নেই । চেষ্টা করছে মানুষজন এড়িয়ে সামনে এগিয়ে চলতে । কারন খুব ভাল করেই জানে তার পেছনে ঠিক ঠিক মানুষ আসছে । সে যত মানুষের সাথে দেখা করবে কিংবা যত বেশি মানুষ তাকে দেখতে তারা তত বেশি তার কথা জেনে যাবে । তাই খাওয়া দাওয়ার জন্য কোথাও থামছে না । খেত খামার থেকে কিছু চুরি করে নিচ্ছে । প্রথম বারের মত করতে বেশ কষ্ট হচ্ছিলো কিন্তু সেটা না করে উপায় নেই । প্রয়োজন মানুষকে অনেক কিছু শেখায় । মেয়েটিকেও এই কদিনে অনেক কিছু শিখিয়েছে । কিন্তু এই শেখাটা তাকে কতক্ষন টিকিয়ে রাখতে পারবে সেটা সে জানে না ।

কেবল মনে হচ্ছে এখন তাকে সামনে দৌড়াতে হবে । তার পেছনে ছুটে আসা মানুষ গুলোর হাত থেকে বাঁচার জন্য তাকে যত দুরে পারা যায় তত দুরে চলে যেতে হবে । কোন ভাবেই তাদের হাতে ধরা পরা চলবে না !
কিন্তু মেয়েটা শেষ পর্যন্ত ধরা পরেই গেল । চারজন শক্ত সমর্থ্য মানুষ যখন তাকে চারিদিক থেকে ঘিরে ধরলো তখন প্রথমে অবিশ্বাস তারপর হতাশা তাকে পেয়ে বসলো । একদিন এই সময় আসবে সে জানতো কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি চলে আসবে সে ভাবতে পারে নি । কিন্তু তার জন্য আরও অন্য কিছু অপেক্ষা করছিলো ।

সেখানে রাতের বেলা ঘুমিয়েছিল সেখানেই ধরা পরে যায় লোক গুলোর কাছে । সে বিশ্রামের জন্য থাকলেও তার পেছনে ছুটে আসা মানুষ গুলো কোন বিশ্রাম নেয় নি। তাই একটু একটু করে তারা এগিয়ে এসেছে তার কাছে । 
পরাজিত সৈনিকের মত করে তাদের হাতে সমর্পন করার সময় মেয়েটি দেখতে পেল রাতের আধার ভেদ করে একজন তাদের দিকে এগিয়ে আসছে । সেই লোকটা কে দেখে চারজন মানুষই যেন আরও একটু টানটান হয়ে দাড়ালো । স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছে এই লোকটাই তাদের নেতা । এই মানুষটাই হয়তো এসবের পেছনে রয়েছে ।

লোকটা আরও একটু এগিয়ে এল । অস্পষ্ট চাঁদের আলোতে মেয়েটির চোখ যখন পড়লো মেয়েটি সাথে সাথে তাকে চিনতে পারলো । তাকে না চেনার কোন কথা নয় । কিন্তু সেটা চেনার পরপরই মেয়েটির চেহারায় একটা তীব্র বিস্ময় দেখা দিল । কালো মোচের নিচে হাসিটার দিকে তাকিয়ে থেকে অবাক বিশ্ময়ে মেয়েটি বলল
-আপনি ?
লোকটা যেন মেয়েটির বিস্মিত ভাব দেখে আরও মজা পেল । হাসির মাত্রটা আরও বেড়ে গেল সাথে সাথে। 
মেয়েটি আবারও বলল
-আপনি !
মুহুর্ত পরেই লোকটির হাসি থেমে গেল । সেখানে দেখা গেল একটা কঠিন মুখোভাব । গম্ভীর কন্ঠে বলল
-তোমার পালানোর জায়গা নেই । তুমি খুব ভাল করেই জানো ! শুধু শুধু আমাদের কষ্ট দিলে । অথচ চাইলেই এটা বেদনাবীহিন একটা প্রক্রিয়া হতে পারতো কিন্তু তুমি আমার কথা না শুনে ঐ ডায়নিটার কথা শুনেছো । তোমাকে সে নিরাপত্তা দিতে পারে নি । পারবেও না । আমার কাছে তোমাকে আসতেই হত । এটা তোমার নিয়তি !

মেয়েটি তখনও তাকিয়ে আছে লোকটার দিকে । তার এখন সামনে দাড়ানো মানুষটার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না । এমন টা হতে পারে না । লোকটা আর কিছু বলল না । সোজা আবার যেদিক দিয়ে এসেছিলো সেদিকে হাটা দিল । মেয়েটি তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো । চিৎকার করে একটা শব্দ বলতে তার খুব ইচ্ছে করছে । কিন্তু যখনই সে লোকটাকে ডাকতে যাবো তখনই ভারী কিছু দিয়ে তার পেছন থেকে তার মাথায় আঘাত করলো কেউ । মেয়েটি জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো ।



এক
—–
 

আবন্তি আরেকবার সামনের দিকে তাকালো । সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে । এখনও পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে আসে নি । তবে টুপ করে অন্ধকার নামবে যে কোন সময় । শীতের সময়টাই এমন । দিন গুলো একদম ছোট ছোট ছোট যে কখন যে দিনের আলো শেষ হয়ে যায় সেটা বোঝা মুশকিল ।

আবন্তির গাড়িটা আরেকটু সামনে এগোলেই পাওয়া যাবে । কারপার্কিং টা এদিকেই । কিন্তু আবন্তির মন ওকে বারবার সাবধান করে দিচ্ছে যেন ঐ দিকে না যেতে । বারবার মনে হচ্ছে এসবের থেকে যত দুরে পারো চলে যাও । সামনেই তার জন্য কঠিন বিপদ অপেক্ষা করছে ।
এসবের শুরু আজকে কদিন থেকেই । একটা অপরিচিত নাম্বারে তার নাম্বারে একটা ছোট মেসেজ এসে হাজির ।
আবন্তি তুমি কঠিন বিপদের মধ্যে আছো
কেবল এই একটা লাইন । আর কোন কথা লেখা নেই । একটু পরেই সে একই নাম্বারে ফোন করে কিন্তু ফোন বন্ধ । কেউ তার সাথে মশকরা করেছে মনে করে সে আর কিছু করলো না । তবে একটু যে চিন্তা হল তা না । কারন ওর নাম্বার কারো কাছে নেই, এমন কি ওর ক্লাসের কারো কাছেই এই নাম্বার নেই । এমন কি ওর কোন বন্ধুবান্ধবের কাছেও না ! আরও ভাল করে বলতে গেলে বন্ধু বলতে যা বোঝায় এমন কেউ কোন দিন আবন্তির ছিল না ।

অদ্ভুত কারনেই ওর বাবার কড়া নির্দেশ যেন কোন মানুষকে ওর নাম্বারটা না দেওয়া হয় । ক্লাসের যে কোন প্রয়োজনে ওদের ম্যানেজারের নাম্বাটা দেওয়া । কারো সাথে পরিচয় হোক সেটা আবন্তির বাবা মোটেই পছন্দ করে না । ছোট বেলা থেকেই ওর কোন বন্ধু ছিল না । ওর বাবার কাছেই কতবার মার খেতে হয়েছে কেবল ক্লাসে অন্য কারো সাথে কথা বলার জন্য । কিছু জানতে চাইলে ওর বাবা কেবল বলতো যে তাদের বংশের মেয়েদের বাইরে বের হওয়া নিষেধ । তবুও তিনি তাকে ঘরের ভেতর বন্দী করে রাখেন নি বরং তাকে বাইরে যেতে দিয়েছেন । কিন্তু সে যদি এরকম কাজ করতেও থাকে তাহলে তিনি তার স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিবেন । তারপর থেকে আবন্তি ক্লাসে মানুষের সাথে মেশা বন্ধ করে দেয় । গাড়িতে করে স্কুলে যেত আবার ফিরে আসতো । মাঝে মাঝে গাড়িতে করেই ঘুরে বেড়াতো । ড্রাইভারকে বলা ছিল যাতে করে সে সেখানে যেতে চায় তাকে যেন সেখানে নিয়ে যাওয়া হয় কিন্তু কোন ভাবেই যেন একা একা কোথাও না যায় !

আবন্তি তাই করতো । মাঝে মাঝেই গাড়িতে করে ঘুরে বেড়াতো । বাসায় এসে বাবার দিকে ভয়ে ভয়ে তাকাতো যেদিন একটু বেশি দেরি হয়ে যেত তবে তার বাবা কিছু বলতো না । আরেকটা কাজ করে আবন্তির সময় কারতো সেটা হচ্ছে বই পড়ে । বাইরে বের হতে না দিলেও ওদের বিশাল বড় একটা লাইব্রেরী আছে । আবন্তির বেশির ভাগ সময়ই কাটেই এই লাইব্রেরী থেকে বই নিয়ে পড়েই । তাই যখনই ওর নাম্বার যখন অপরিচিত কারো থেকে মেসেজ আসলো তখন একটু অবাকই হয়েছিলো । বার কয়েক ফোন দিয়েও মেসেজ দাতাকে পাওয়া যেত না । তবে মেসেজটা সে রাখে নি । মুছে ফেলেছে । কারন ওর ফোন ওর বাবা নিয়মিত চেক করতো । বাবার হাতে ধরা পরলে হয়তো ফোনটা ওর হাত ছাড়া হয়ে যাবে!

আজকে মেসেজটা আসার পররপই আবন্তি সেই নাম্বার কল করলো । এবং আশ্চার্য ভাবে আবিস্কার করলো যে আজকে ঠিকই ফোন ঢুকেছে । কয়েক সেকেন্ড পরে ফোনটা রিসিভও হল ।
-হ্যালো !
ওপাশ থেকে কোন আওয়াজ হল না ।
আবন্তি আবারও বলল
-হ্যালো?
-আবন্তি ?
ফ্যাকাশে কন্ঠের কেউ বলে উঠলো ওপাশ থেকে, মহিলার কন্ঠ । আওয়াজ শুনে মনে হল তার বয়স বেশ ভালই হবে । আবন্তি আবারও বলল
-হ্যালো !
-আমার কথা মন দিয়ে শুনো !
-তার আগে আপনি বলেন আপনি কে ?
-আমি তোমার ভাল চাই । তোমাকে বাঁচাতে চাই ।
-কে আপনি ?
-শুনো আমি কে সেটা তুমি এখন চিনবে না । কেবল তোমাকে বলি তোমাকে এখনই ওখান থেকে পালাতে হবে ।
-আপনি কি বলছেন এসব ? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না । আর আমি কেন পালাবো ?
-তুমি বুঝতে পারছো না তুমি কি রকম বিপদের ভেতরে আছো । তোমার আসে পাশের কাউকে তুমি বিশ্বাস করতে পারো না মনে রেখো কাউকে না । তোমার সামনে কঠিন বিপদ । কঠিন বিপদ ।

ব্যস এই লাইন গুলো বলেই ফোনের লাইনটা কেটে গেল । ফোন রেখে আবন্তি কিছু সময় কি করবে তাও বুঝতে পারছিলো না । ফোনের ওপাসে ভদ্রমহিলার কথা বিশ্বাস করার কোন কারন নেই তবুও কেন যেন তার কথাটা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছিলো । সেমিনার লাইব্রেরীতে বসে রইলো অনেক টা সময় । এক সময় লক্ষ্য করলো যে দিনের আলো প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে । বাসায় ফেরা দরকার ।
ড্রাইভারকে বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েও কোন উত্তর পেল না । এমনটা সাধারনত হয় না । তাহলে আজকে কি ঘুমিয়ে গেল ড্রাইভার ! লাইব্রেরী থেকে উঠে হাটা দিল ওদের ভার্সিটির কার পার্কিংয়ের দিকে ।

এই কার পার্কিং এলাকাটা একেবারে ভার্সিটির এক পাশে । এমনিতেই এইখানে লোকজন খুব একটা আসে না । এখনও শীতের সন্ধ্যা এখন দুর দুরান্তে কাউকে দেখা গেল না । একেবারে শেষ মাথায় ওর গাড়িটা রয়েছে দাড়িয়ে । আর একটা সাদা রংয়ের গাড়ি দেখা যাচ্ছে । আর কোন গাড়ি নেই । তবে একটা বাইক রয়েছে কালো রংয়ের । আবন্তি জানে বাইকটা কার ! ওদের ক্লাসের সাব্বিরের বাইক । যদিও কোন দিন ওদের মধ্যে কথা হয় নি তবুও সাব্বির সম্পর্কে ও কয়েকটা কথা জানে । মাঝে মাঝে গাড়ির গাছে আসতে গিয়ে সাব্বিরের সাথে দেখা হয়ে যায় ।

আবন্তি আরও একটু এগিয়ে এল ওর গাড়ির দিকে, ড্রাইভারকে গাড়ির সামনেই বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে । লোকটাকে প্রায়ই এমন করে বসে থাকতে দেখে একভাবে । মাঝে মাঝে মনে হয় এভাবে বসে বসে হয়তো ঘুমায় কিন্তু আবন্তি যখনই কাছে যায় দেখে এক ভাবে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে । ওর দরজার কাছে আসতেই দরজা খুলে বের হয়ে আসে ।
দরজা খুলে দেয় । আজকেও ড্রাইভার করে ওভাবেই বসে থাকতে দেখলো । কিন্তু যখনই গাড়ির খুব কাছে চলে এসেছে ঠিক সেই সময়েই একটা অদ্ভুদ দৃশ্য দেখলো । তখনই মনে হল ফোনের ওপাশের ঐ মহিলার কথা ওর অবশ্যই শোনার দরকার ছিল । ওর পালানোর দরকার দরকার ছিল ফোন পাওয়ার পরপরই । আবন্তি দেখলো অন্যান্য দিনের মত আজকেও ড্রাইভার গাড়ির সামনের সিটে বসে আছে তবে আজকে তার ঘাড়টা একটা কাত করা । গলার এক পাশে গভীর ক্ষত হয়ে আছে । সেখানে থেকে রক্ত ঝড়ছে । ড্রাইভারের গলা যে খুব আগে কাটা হয় নি সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে ।

এই সন্ধ্যার আলোতেও রক্তের ফোয়ারা চিনতে আবন্তিরর মোটেও কষ্ট হল হল না । একটা তীব্র চিৎকার বের হতে গিয়েও বের হল না । যেই ওদের ড্রাইভারকে খুন করেছে সে নিশ্চয় কেবল ড্রাইভারকে খুন করার জন্য আসে নি, সামান্য ড্রাইভারকে কেউ খুন করতে কেন আসবে ? এসেছে ওকে মারার কিংবা ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য । ওর এখনই এখান থেকে পালানো দরকার, যে কোন ভাবেই ক্যাম্পাসের লোকজনের সামনে যেতে পারলেই তারা ওকে কিছু করতে পারবে না । এখনই পালানো দরকার !
এই চিন্তা করেই আবন্তি ঘুরে দাড়ালো এবং তখনই বুঝলো ওর দেরি হয়ে গেছে । এই নির্জন পার্কিং এলাকায় আসা উচিৎ হয় নি ।
ড্রাইভার যখনই ফোন ধরে নি তখনই ওর বুঝে যাওয়া উচিৎ ছিল ।
আবন্তি দেখলো দুজন লোক ওর দিকে এগিয়ে আসছে । একজনের হাতের বড় ছুড়িটা চিনতে আবন্তির মোটেও কষ্ট হল না । এটা দিয়েই নিশ্চয়ই একটু আগে ড্রাইভার কে ওরা হত্যা করেছে । এখন ওর পালা । মেঘলা একটা একটা চিৎকার দিতে চাইলো কিন্তু গলা দিয়ে একটা আওয়াজও বের হল না । কেবল নিজের পরিনতির দিকে তাকিয়ে রইলো । ছুরি হাতে লোক দুটো ওর প্রায় কাছে পৌছে গেছে ।


দুই
—-


লোক দুটোর একজন একটু বেশি লম্বা আর স্বাস্থ্যবান । সেই আগে এসে আবন্তির মুখ চেপে ধরলো । তারপর এমন ভাবে সামনে এগিয়ে ধরলো যেন ওর গলাটা সামনের দিকে একটু এগিয়ে থাকে । আবন্তির বুঝতে কষ্ট হল না যে ওর দিন শেষ হয়ে এসেছে । ফোনের ঐ মহিলা ঠিকই বলেছিলেন । ওর সামনে কঠিন বিপদ । এবং সেই বিপদের ভেতরে ও ইচ্ছে করে এসে ধরা দিয়েছে ।
তুলনা মূলক খাটো লোকটার হাতে ছুরিটা ধরা । সেটা নিয়ে লোকটা আবন্তির দিকে এগিয়ে এল । তারপর মুখটা বিকৃত করে বলল
-আজকে এই পৃথিবী থেকে এক শয়তানের মৃত্যু হবে । তার রাজত্ব শেষ হবে ।
আবন্তি কোন কথা বলতে পারলো না । ও কেবল চোখ বড় বড় করে বড় ছুরিটার দিকে দিকে আছে । ও পশু পাখি জবাই একদম দেখতে পারে না । টিভিতে এমন কিছু হলে সে টিভিট চ্যানেল পাল্টিয়ে দেয় । বইয়ে এমন বর্ণনা থাকলে সেটা পড়ে না । আর আজকে ওর নিজের সাথেই এমন হচ্ছে ।
কিন্তু ওর অপরাধ কি ?
কি এমন করেছে ও ! কারো সাথে ও কোন দিন মেশেই নি যে কারো উপর কোন অন্যায় করবে সে ! তাহলে এই লোক গুলো তাকে মারতে চায় কেন ?
-জামি কাজ শেষ কর ! এখানে থাকা নিরাপদ না । 
লম্বা লোকটা বলল । 
জামি নামের লোকটা ছুরি নিয়ে আরও একটু এগিয়ে এল আর ঠিক তখনও ধপ করে আওয়াজ হল । মনে হল অন কিছুর সাথে কিছু একটা জোরে ধাক্কা খেয়েছে ।

আবন্তি দেখল জামি নামের লোকটা ঠিক ওর সামনেই মুখ থুবড়ে পড়ে গেল । লম্বা লোকটা অবাক হয়ে কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে রইলো সঙ্গীর দিকে । এই ফাঁকে আবন্তির দেহকে একটু ঢিল দিয়ে ফেলল । ঠিক এই সুযোগটাই আবন্তির দরকার ছিল । নিজেকে ছাড়িয়ে সোজা সামনের দিকে দৌড় দিল । আবন্তিকে ধরতে যাবে ঠিক তখনই একটা মাঝারি সাইজের ইট তার মাথায় এসে লাগলো । সাথে সাথেই তার মাথাটা টা দুলে উঠলো ।
আবন্তি তাকিয়ে দেখলো ওর ক্লাসের সাব্বির সামনে দাড়িয়ে । খুব দ্রুত ওর কাছে এসে ওর হাত ধরলো । তারপর বলল
-চল । আমাকে এখনই এখান থেকে সরে পড়তে হবে !
-আমার ড্রাইভার …..
-যে গেছে সে গেছে । তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে !

আবন্তি কিছু বুঝতে পারছিলো না । তবে সাব্বিরের কথা বার্তা কেমন যেন লাগলো ওর কাছে ! আবন্তিকে নিয়ে প্রায় জোর করেই সাব্বির নিজের বাইকে উঠে পড়লো । তারপর বাইক এক টানে দিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে এল ।
আবন্তি তখনও নিজেকে সুস্থির করতে পারে নি । তবে বাইকের পেছনে বসে থাকতে থাকতে ওর নিজেকে খানিকটা সামলে নিল । যখন মাথাটা একটু ঠান্ডা হয়ে এল তখন প্রথম যে কথাটা মাথায় এল সেটা হল ও ওদের বাসার রাস্তায় নেই । অন্য কোন অচেনা পথে এগোচ্ছে ।
সাব্বিরকে বলল
-আমরা কোথায় যাচ্ছি ?
-নিরাপদ জায়গাতে ?
-আমাদের বাসায় চল । ওখানে সব থেকে নিরাপদ !
-ভুল । ওটা তোমার জন্য সব থেকে বিপদের জায়গা !
-মানে ? কি বলছো এসব ?
-ঠিক বলছি । তোমাকে সাবধান করা হয়েছিল । মনে নেই ? কিন্তু তুমি শোন নাই !
আবন্তির বুঝতে কষ্ট হল না যে ওকে যে ফোন করতো সাব্বির তাকে চেনে । কিন্তু কিভাবে ? আর মানুষ ওকে মারতে কেন চায় ? ওর বাবা একজন ক্ষমতাবান মানুষ এটা আবন্তি খুব ভাল করে জানে । বাবার উপর প্রতিশোধ নিতে কি কেউ তাকে খুন করতে চাচ্ছে ? এটা ছাড়া আর কোন ব্যাখ্যা নেই ওর কাছে । কিন্তু সাব্বির কেন বলছে যে ওর নিজের বাসা ওর কাছে সব থেকে বিপদের জায়গা ?
এমনটা বলার পেছনে কারন নি ?
-তুমি কি বলছো ? আমার বাবার বাসা কেন আমার জন্য বিপদের জায়গা হবে ?
-আবন্তি বিশ্বাস কর, তোমার জন্য বিপদের জায়গা অনেক গুলো আছে তবে সব থেকে বড় বিপদটা তোমার নিজের বাসায়, এবং সেটা তোমার বাবার কায়সার আহমেদের কাছ থেকে !
বাইকের গতি আরও একটু বেড়েছে । বাইকটা মুন্সি গঙ্গের ভেতরে ঢুকে পড়েছে । আবন্তি দেখলো একটা বড় পাচিল ঘেরা বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়লো । গেট দিয়ে ঢুকতেই সাব্বির গেটের দারোয়ানকে বলল গেট বন্ধ করে দিতে । আর কয়েকজন ছুটে এল আসে পাশ থেকে । ওদের সাথে সাব্বির কি যে বলল । ওর সাব্বিরের কাছ থেকে নির্দেশনা পেয়ে যে যার কাজে চলে গেল । সাব্বির ওর দিকে তাকিয়ে বলল
-তোমার ফোনটা কোথায় ?
আবন্তি বলল ব্যাগের ভেতরে ছিল । ব্যাগটা তো পার্কিং লটে ফেলে এসেছি ।
-গুড ! চল ভেতরে । 
-সাব্বির আমি তোমাকে ঠিম মত চিনিও না । তুমি বলছো আমার বাবা আমার জন্য সব থেকে বেশি বিপদ জনক । একটু আগে আমার ড্রাইভার কে বা কারা খুন করেছে । আমি কিছু বুঝতে পারছি না । আমাকে তুমি পুলিশের কাছে না নিয়ে গিয়ে এখানে নিয়ে এসেছো । আমি কাকে বিশ্বাস করবো ?
সাব্বির বলল
-বিশ্বাস কর আমি তোমার ক্ষতি করবো না । ইনফ্যাক্ট তোমাকে বাঁচানোই আমার মিশন । এই জন্যই আমি তোমার ক্যাম্পাসে ভর্তি হয়েছি । তোমাকে চোখে চোখে রাখার জন্য !
আবন্তি খানিকটা অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে রইলো সাব্বিরের দিকে । 
-আমাকে খুলে বলবে এখানে কি হচ্ছে ?
-তোমাকে সব খুলে বলা হবে !
আবন্তি ঘুরে বাড়ির সদর দরজার দিকে তাকালো । সেখানে একটা নারী মুর্তি এসে থেমেছে । স্পষ্ট চেহারা দেখা যাচ্ছে না তবে তার বেশ বয়স যে হয়েছে সেটা বুঝতে আবন্তির কষ্ট হল না । আর সেই সাথে এও মনে হল আজকে সকালে সে যার সাথে কথা বলেছে সেটা এই বৃদ্ধ মহিলা ছাড়া আর কেউ নন !
বৃদ্ধ মহিলা বললেন
-সাব্বির আবন্তিকে ভেতরে নিয়ে এস । আজকে ওর উপর দিয়ে অনেক ধকল গেছে । কিছু খেয়ে ও বিশ্রাম নিক । আজকের রাতটা ওর জন্য অনেক লম্বা রাত হবে । অনেক কথা ওর জানার আছে !
আবন্তি কিছু বলতে গিয়েও বলল না । বৃদ্ধ মহিলার কন্ঠে ছিল একটা আছে যেটা উপেক্ষা করার উপায় নেই । চুপচাপ তার নির্দেশ মেনে নিল ওরা । তারপর তার পেছন পেছন ঘরে প্রবেশ করলো ।



তিন
—–


লোকটা জীবনে এতো ভয় এর আগে কোন দিন পায় নি । সামনে শান্ত ভাবে বসে থাকা মানুষটার শীতল চোখ যেন তার বুকের ভেতরটা ছিড়ে ফেলতে চাইছে । কায়েস আহমেদ শান্ত কন্ঠে বললেন
-যখন কবিরকে মেরে ফেলা হল, তখন তুমি কোথায় ছিলে ?

কায়েস আহমেদের কন্ঠ শুনে সে আবারও নিজের ভয়টা আঁচ করতে পারলো । আজকে সে ঠিক ঠিক বুঝতে পারলো কেন সবাই কায়েক আহমেদ কে এতো ভয় পায় । ভয়ের চোটে সে ঠিক মত কথাই বলতে পারছে না । বারবার মনে হচ্ছে এখন থেকে পালিয়ে যেতে । কিন্তু খুব ভাল করেই জানে পালিয়ে সে খুব দুরে যেতে পারবে না । তাকে ঠিকই খুজে বের করা হবে । 

তাকে একটা কাজ দেওয়া হয়েছিলো । সেই জন্য মাসে মাসে ভাল পরিমান টাকাও পেত । এতো দিন সে কোন ভাবেই বুঝতে পারে নি কেন এই সামান্য কাজের জন্য তাকে এতো টাকা দেওয়া হচ্ছে । কোন ঝামেলা ছিল না । বাইকে করে কেবল কায়েস আহমেদের মেয়ে যেখানে যেখানে যায় সেখানে সেখানে যাওয়া । তার বিপদ হলে তাকে বাঁচানো । গত তিন বছর ধরেই সে এই কাজটা করছে । কোন দিন কোন সমস্যা হয় নি । প্রথম প্রথম সে খুব সজাগ থাকলেও আস্তে সেখানে ঢিলেমী দেখা দেয় । কোন কোন দিন সে গাড়ির পেছনে যেতও না । 

কিন্তু খুব ঝামেলার কিছু হয়ে গেছে । আবন্তি অর্থ্যাৎ কায়েস আহমেদের মেয়েকে কেউ তুলে নিয়ে গেছে । কবিরের গলা কেটে নিয়ে গেছে তাকে । সে এখনও বেঁচে আছে কি না সেটা এখনও সে জানে না । কেউ জানে না । 
কায়েস আহমেদ আবার বলল
-কোথায় ছিলে তুমি ?
-আমি চা খেতে গিয়েছিলাম ।

কথাটা বলা মাত্রই একটা কিছু খুব জোরে লোকটার বুকে আঘাত করলো । লোকটা সেই ধাক্কার খেয়ে সোজা পেছনের দেওয়ালে গিয়ে পড়লো ছিটকে । মৃত্যুর আগে কেবল অবাক হয়ে দেখলো কায়েস আহমেদ নিজের জায়গা ছেড়ে একদম নড়ে নি । কেবল হাতটা দিয়ে কিছুকে ধাক্কা মারার মত করে রেখেছে । অবাক চোখেই লোকটা নিজের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো । 



কায়েক আহমেদ তীব্র ঘৃণার চোখে লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছু সময় । ইচ্ছে করছে আবারও তাকে জীবিত করে আবারও তাকে মেয়ে ফেলে । যে অপরাধ সে করেছে তার জন্য তাকে একবার শাস্তি দিয়ে মন শান্ত হবে না । বারবার খুন করতে মন চাইছে তাকে । 

কয়েক মিনিট পরে আর একজন লোক এসে কায়েস আহমেদকে নিচু স্বরে কিছু বলল । কায়েস আহমেদ বললেন
-ঠিক আছে তাকে বসতে বল । আর এটা পরিস্কার কর ! 
লোকটা মাথা সামান্য কাত করে সম্মতি জানিয়ে চলে বাইরে । বাইরে উত্তরা থানার ওসি সাহেব এসে অপেক্ষা করছে । 


চার
—-


আবন্তি কিছুটা সময় বৃদ্ধ মহিলার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো । বৃদ্ধার নাম গুলসানারা খাতুন । একটু আগে বলা কথাটা তার ঠিক হজম করতে কষ্ট হচ্ছে । মনে হচ্ছে মহিলা কোন ভাবেই সত্য বলতে পারেন না । কিংবা এটা হতে পারে না কোন ভাবেই হতে পারেন না । 
গুলসানারা বললেন
-কি বিশ্বাস হচ্ছে না ?
চোখে কেমন একটা ঠান্ডা আভা ! দেখে বোঝার কোন উপায় নেই যেন সে মিথ্যা বলছে । আবন্তি বলল
-কিন্তু আপনি কিভাবে আমার বোন হন ? এটা কোন ভাবেই সম্ভব না !
-কারন আমি অনেক বেশি বৃদ্ধ আর তোমার বাবা মানে আমাদের বাবা খুব ইয়াং এখনও, এই জন্য ?
-অবশ্যই ! 

আবন্তি একটু আগে রাতের খাবার খেয়েছে । তবে সাব্বিরের কাছ থেকে শুনেছে এখানে নাকি থাকা যাবে না । এই জায়গাটার খোজ তারা পেয়েও যেতে পারে । ওকে আরও দুইতিন দিন পালিয়ে থাকতে হবে । এ কয় দিন পালিয়ে থাকতে পারলেই আর কোন সমস্যা হবার কথা না । তার জীবনের আর কো সংঙ্কা নেই । 

আবন্তি এদের কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না । কিন্তু আবার না বিশ্বাস না করেও পারছে না । নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে সাব্বির ওকে বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছে । চাইলেই সে সেখানেই ওকে মেরে ফেলতে পারতো । কিংবা ওদের হাতে তুলে দিয়ে চলেআসতো পারতো । কিন্তু সেটা সে করে নি । বরং তাকে বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছে ।

আচ্ছা এদের কি অন্য কোন ইচ্ছে আছে ? আবন্তি আরও কিছুটা সময় ওদের উপর বিশ্বাস রাখার কথা ভাবলো । আগে ওকে সব কিছু শুনতে হবে । কি হচ্ছে কিংবা ওর কিসের বিপদ এসব ওকে জানতে হবে ! তারপর কোন সিদ্ধান্ত নিতে হবে ! 

তখনই গুলসানারা নামের সেই রহস্যময় বৃদ্ধ মহিলাটা ওকে জানালো সে সম্পর্কে ওর বোন হয় । প্রথমে ভেবেছিলো হয়তো কোন আত্বীয় হবে । ও খুশিই হয়েছিল । কারন ওর বাবা ওকে কোন আত্বীয় স্বজনের সাথে মিশতে দেয় না । এমনি কি ও জানেও না ওর কোন আত্মীয় আছে কি না । কিন্তু যখন জানতে পারলো গুলসানা ওর বাবার অর্থ্যাৎ কায়েস আহমেদের মেয়ে তখন ওর চোখ গুলো বড় বড় হয়ে গিয়েছিল । কেবল অবিশ্বাস ভরা চোখে তাকিয়ে রইলো বৃদ্ধার দিকে । 

গুলসানারা বললেন
-হ্যা । আমরা একই বাবার সন্তান । 
-কিন্তু …..
-তোমার বাবার কত বয়স হবে বলে তোমার মনে হয় ?
-এই চল্লিশ পয়তাল্লিশ । আর আপনার কম করেও হলেও ৬৫/৭০ হবে । 
-আমার বয়স ৭৬ বছর !
-তাহলে আপনি কিভাবে বলেন যে আপনি আমার বাবার মেয়ে । দিস ইজ ইনসেইন !
-আমি বলছি । তাহলেই বুঝতে পারবে ! তার আগে আমার কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দেও । তুমি নিশ্চয়ই এখনও পাক পবিত্র আছো, তাই না ?
-মানে ? আপনি কি বলতে চাইছেন বুঝি নি ?
-তোমাকে কোন ছেলে এখন স্পর্শ করে নি । তাই না ?
-হ্যা ।
-এবং এটার ব্যাপারে তোমার বাবার খুব সজাগ, তাই নয় কি ?
-হ্যা । কিন্তু …….
-তোমার কি একবারও মনে হয় নি তোমার বাবা একটু অস্বাভাবিক ভাবেই এটা নিয়ে চিন্তিত তোমাকে নিয়ে । অন্য বাবাদের মত না !

আবন্তি কিছু বলতে গিয়েও বলল না । এটা সত্যিই যে স্বাভাবিক জীবন তার কোন কালেই ছিল না । কিন্তু তাই বলে !! নাহ এটা হতে পারে না ! 

গুলসানারা বলল
-তোমার বাবা মুলাকের অনুসারী !
-মুলাক ! 

সাব্বির এতো সময় পাশে চুপ করে বসে ছিল । একটা ল্যাপটপ কি যেন করছিল । ল্যাপটপ টা আবন্তির দিকে বাড়িয়ে দিল । সেখানে মুলাককে নিয়ে একটা আর্টিকেল লেখা । আবন্তি কোন কথা না বলে চুপচাপ পড়তে লাগলো । পড়া শেষ করে ওর মাথাটা খানিকটা ঝিমঝিম করতে লাগলো । এমন কিছু যে হতে পারে কিংবা আছে এই পৃথিবীতে ওর ধারনার বাইরে ছিল । 

অনেক অপদেবতার মতই মুলাকের অনুসারী আছে এই পৃথিবীতে । তবে সংখ্যাতে তা অনেক কম । মুলাক তার অনুসারীদের অনন্ত যৌবন দান করে এবং শারীরিক শক্তি দান করে তবে সেটার জন্য তাদের কিছু কাজ করতে হবে । মুলাককে খুশি করতে হয় । এবং সেটা করতে হয় নিজেদের কন্যা সন্তানকে তার নামে বলি দেওয়া মাধ্যমে । প্রতি ২১-২৪ বছর পরপর নির্দিষ্ট একটা সময়ে মুলাক এই পৃথিবীতে নেমে আসে । তখনই সে তাদের অনুসারীদের কাছে স্যাকরিফাইস চায় । স্যাকরিফাইস মানে হচ্ছে অনুসারিদের ভার্জিন কন্যা সন্তান । যার বয়স ১৮-২১ এর ভেতরে হতে হবে । যারা সেটা দিতে পারে তাদেরকে সে নতুন করে শক্তি দেয় এবং যারা পারে না তাদেরকে দেওয়া শক্তি কেড়ে নেয় । এ বছর মুলাকের এই পৃথিবীতে নেমে আসার সময় হয়ে গেছে । এবং সেটা আজ থেকে এক দিন পরে । 

আবন্তি কি বলবে কিছু বুঝতে পারলো না । কেবল অবাক হয়ে একবার সাব্বিরের দিকে আরেকবার বৃদ্ধা মহিলার দিকে তাকিয়ে রইলো । গুনশানারা বললেন
-আমিও ঠিক তোমার মত অবস্থায় ছিলাম । আমাকে ঠিক তোমার মত সাবধানেই মানুষ করা হচ্ছিলো । এখন যেমন তুমি বাইরে যেতে পারছো আমার সেই অনুমুতিটুকুও ছিল না । আমাকে সারাদিন বাসার ভেতরেই থাকতে হত । সেই সময় আমাদের বাড়ির ঠিক পাশেই একটা বড় মাঠ ছিল । খেলার মাঠ না, ফসলের মাঠ । সেখানে একটা ছেলের কাজ করতে আসতো প্রতিদিন । তার সাথে আমার চোখাচোখি হত । একটা সময় বুঝতে পারলাম আমার ছেলেটাকে অসম্ভব ভাল লাগতে শুরু করেছে । সেই ছেলেটাই সাহস করে মাঝে মাঝেই আমাদের বাসার ভেতরে ঢুকে আমার সাথে দেখা করতো যখন বাবা বাসায় থাকতো না । এবং এক বৃষ্টির রাতে ছেলেটা আমার ঘরে ঢুকে পরে । তারপর যা হবার তাই হয় । আমি তখনও জানি না যে এই ঘটনার কারনে আমি প্রাণে বেঁচে যাই । ঘটনা আমি লুকিয়ে রাখতে চাইলেও বাবা কিভাবে যেন সেটা জেনে যায় । কারো চোখে পড়ে গিয়েছিল । আমাকে বাদ দিয়ে তখন আমার ছোট বোন কে বেছে নেওয়া হয় ! সেই ছোট বোনকে আমি কোন দিন দেখিও নি । অন্য কোথাও ছিল সে । আমাকে এবং আমার মাকে বাসা থেকে বের করে দেওয়া হয় । আমি কিংবা আমার মা আর কোন দিন তার দেখা পায় নি । আমি কোন দিন কিছু জানতে পারে নি ।


এই কথা গুলো বলে গুলসানারা কিছু সময় চুপ করে রইলেন । তারপর আবার বলা শুরু করলেন 
-তারপর অনেক দিন তার কোন খোজ পায় নি আমি । এরপরই “রোহার মেচালী” দলের লোক জনের সাথে আমার দেখা হয় । আরও ভাল করে বললে তারাই আমাকে খুজে নেয় । আমার কাছ থেকে অনেক কথা শোনে এবং আমাকে আমার বাবার আসল সত্যটা জানায় । তোমার মত আমিও অবিশ্বাস করেছিলাম তারপর বিশ্বাস করতে বাধ্য হই । “রোহার মেচালী” দলের লোকজনদের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে মুলাক এবং তার অনুসারীদের ধ্বংশ করা । কিন্তু অনুসারীরা যারা শক্তি এবং অমরত্ব পেয়েছে তাদেরকে কোন ভাবেই ঘায়েল করা সম্ভব না । এক মাত্র উপায় হচ্ছে তাদের এই স্যাকরিফাইসের রিচুয়্যালকে ব্যর্থ করে দেওয়া । তাহলেই তারা শক্তিহীন হয়ে পড়বে ! 
-এই জন্যই কি আমাকে মারতে এসেছিলো ওরা ?

-হ্যা । তোমার বাবা প্রতিবারই খুব সাবধান থাকতেন । প্রতিবার মুলাকের চলে যাওয়ার পরপরই সে দুই তিনটা করে বিয়ে করে রাখতো । যাতে আমার মত যদি একটা হাত ছাড়া হয়ে যায় কিংবা কেউ যদি মারা পরে তাহলে যেন অন্য কাউকে দিয়ে কাজ চালানো যায় । কিন্তু এবার তার কপাল খারাপ !
-কি রকম ?
-এইবার সে বেশ কয়েকটা মেয়ের সংস্পর্সে এসেছে । তার বেশ কয়েকটা সন্তানও হয়েছে তবে সবাই ছেলে । এক মাত্র মেয়ে তুমি । তাই সে তোমার ব্যাপারে এতো কেয়ারফুল ! কারন তোমাকে যদি সে সময় মত কাছে না পায় তাহলে তার কিছুই করার থাকবে না ! 

আবন্তি আর কোন কথা না বলে চুপ করে বসে রইলো । সে আর কিছু বলার মত কোন কিছু খুজে পাচ্ছে না । ঠিক মত কিছু বিশ্বাসও করতে পারছে না আবার অবিশ্বাসও করতে পারছে না । এরা যা বলছে সেটা কোন ভাবেই বিশ্বাস করার মত না কিন্তু তাকে যে হত্যা চেষ্টা করা হয়েছে সেটা তো আর মিথ্যা না । আর পুরোটা জীবন ধরে তার বাবা তাকে যেভাকে কড়া নজরদারীর ভেতরে রেখেছে সেটারও ব্যাখ্যাও এই গল্প দিয়ে বুঝা যায় । 

আর ওরা যদি মিথ্যা বলে তাহলেও খুব বেশি কিছু যায় আসে না । একটা কথা যে পরিস্কার যে ওর বাবার কাছ থেকে যদি ওর বিপদের আশংকা থাকেও সেটা দুদিনের ভেতরেই কেটে যাবে তখন সে মুক্ত হয়ে যাবে । এখন এদের কাছ থেকে অন্য কোথাও যাওয়া মানে হচ্ছে বিপদে পরা । এক তো সেই গলাকাটা গ্রুপ যারা ওকে মারতে চায় অন্যটা ওর বাবা যে ওকে দুদিন পরে কোন শয়তানের উদ্দেশ্য বলি দিবে । এর থেকে এখানে থাকাই ভাল । আবন্তি এখানে থাকারই সিদ্ধান্ত নিল । 

ঠিক তখনই বাইরে গুলির আওয়াজ হল ! আবন্তি তাকিয়ে দেখে সাব্বির উঠে দাড়িয়ে পড়েছে ততক্ষনে !


পাঁচ
—-


মোটে এগারোজন মানুষ পুরো বাড়িটাকে ঘিরে ফেলেছে । কায়েস আহমেদ গাড়িতে বসে আছেন । সব কিছু ব্যবস্থা করা হয়েছে । গোলাগুলির আওয়াজ হলেও এখানকার পুলিশ ঘন্টাখানেকের আগে এখানে আসবে না । সেরকমই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে । 
প্রথমে যখন আবন্তিকে নিয়ে যাওয়া হয় কায়েস আহমেদের মাথা ঠিক মত কাজ করছিলো না । তিনি তখনও জানেন না যে আবন্তি বেঁচে আছে কি মারা গেছে । তার কোন ধারনাও ছিল না তাকে কোথায় নিচে যাওয়া হতে পারে । ঠিক তখনই আশার আলো দেখতে পেলেন । 

ক্রাইম সিনে আবন্তির হ্যান্ড ব্যাগ পাওয়া যায় সেখানে তার মোবাইলটাও ছিল । সেই মোবাইলেই একটা অপরিচিত নাম্বার পাওয়া যায় যেটা ওকে ফোন করেছিলো বিকেলে । সেই ফোনের সুত্র ধরেই এই বাসার খোজে পাওয়া গেছে । উত্তরা থানার ওসি খুব সাহায্য করেছে । অবশ্য এর জন্য সে বড় রকমের পুরস্কারও পেয়েছে । সে নিজে ফোর্স পাঠাতে চেয়েছিলো কিন্তু সেটার আর দরকার হবে না বলে দিয়েছে । এখানে এটা নিজে দেখবে । 

তাই তো নিজের দলের সব থেকে দক্ষ ১২ জনকে নিয়ে আনা হয়েছে এই বাড়ির সামনে । একজন তার পাশে বসে আছে । হাতে একটা ওয়াকিটকি । কায়েস আহমেদের দিকে তাকিয়ে বলল
-স্যার আমরা রেডি !
-সবাইকে সাবধান করে দাও আবন্তির গায়ে যেন একটু আচড়ও না পড়ে । ঠিক আছে । আর কার কি হল সেটা দেখার দরকার নেই । 
-ওকে স্যার ! 

তারপর লোকটা ওয়াকিটকি বাড়ি আক্রমনের নির্দেশ দিল ! 



পুরো বাসাটা যেন যুদ্ধ ক্ষেত্রে পরিনত হয়েছে । কত সময় ধরে গোলাগুলি হচ্ছে সেটা আবন্তি নিজেও জানে না । তবে ওর মনে হচ্ছে অনন্ত কাল ধরে এই ঘরে বন্দী আছে । ঘরটা এই বাড়ির নিচে অবস্থিত । গুলসানারা খাতুন তাদেরকে এখানে নামিয়ে রেখে উপর থেকে আটকে রেখেছেন । তারাও ভেতর থেকে দরজাটা আটকে রেখেছে । বেস মজবুত দরজা । খুলতে সময় লাগবে ।

আবন্তি সাব্বিরের দিকে তাকিয়ে বলল
-আমরা ধরা পরে যাবো তাই না ?
সাব্বির কোন কথা বলল না । ওর মুখটা কেমন গম্ভীর হয়ে গেছে । কিছু যেন ভাবছে । তারপর হঠাৎ করেই আবন্তির দিকে তাকালো । এমন ভাবে তাকালো যে আবন্তি সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গেল । সাব্বির বলল
-তুমি কি জানো আমি তোমার উপর সেই এক বছর ধরে লক্ষ্য রাখছি ! তার আগে অন্য কেউ রাখতো !
আবন্তি মাথা নাড়ালো । 
সাব্বির বলল
-আমাদের আসল উদ্দেশ্য কোন দিনই তোমাকে বাঁচানো ছিল না । আমাদের আসল উদ্দেশ্য ছিল কেবল তোমার বাবাকে ধ্বংস করা । কিন্তু তোমাকে যখন বাবার পাঠানো লোক গুলো মেরে ফেলতে যাচ্ছিলো তখন আমি সেটা দেখতে পারি নি । তাই তোমাকে বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছি ।
আবন্তি কি বলবে খুজে পেল না । 
-এমন কি গুলসানারা খাতুনও জানে না যে আমি “রোহার মেচালী” দলের অনুসারী । আমার বাবা আসলে দলটার প্রধান !
-তুমি কি আমাকে এখন মেরে ফেলবে ?
-আমার তাই উচিৎ ! তোমার বাবা কতটা যে ভয়ংকর সেটা তুমি কোন দিন হয়তো জানতে পারবে না । এবং তুমি বেঁচে থাকা মানে তোমার বাবাকে আরও শক্তি শালী করে তোলা । একটা পর্যায়ে এমন হবে যে সে যা চাইবে তাই করতে পারবে । তাকে কেউ থামাতে পারবে না ! 

এই বলে সাব্বির ওর কাছে এল । ওর হাত দুটো শক্ত করে চেপে ধরলো ! সাব্বির বলল
-আমি যা করতে যাচ্ছি সেটা সবার ভালর জন্য । আশা করি তুমি বুঝতে পারছো ! 

আবন্তি কিছুটা সময় নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো কিন্তু কোন লাভ হল না । সাব্বিরের শক্তি অনেক বেশি । সে কেবল অসহায় ভাবে তাকিয়ে রইলো সাব্বিরের দিকে । 



পুরো বাসাটা কায়েস আহেমেদের নিয়ন্ত্রনে চলে এসেছে । যদিও প্রয়োজের থেকে একটু বেশি সময় লেগেছে । ভেতর থেকে এভাবে প্রতিরোধ করা হবে সেটা কায়েস আহমেদ ভাবতেও পারে নি । তবে এখন নিয়ন্ত্রনে চলে এসেছে । সেটা কোন বিষয় নয় তিনি অবাক হয়ে সামনের বসা বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে আছেন । কয়েক মুহুর্ত লাগলো তার চিনতে । তারপর অবাক হয়ে বলল
-গুলসানারা ?
-চিনতে পেরেছেন তাহলে ?
কায়েস আহমেদ একটু হাসলো । তারপর বলল
-তোমাকে কিভাবে না চিনি ! এখন সোজাসুজি বল আবন্তি কোথায় ? আমি কোন বয়স্ক মানুষের উপর হাত তুলতে চাই না ! 
-বয়স্ক !!! 
গুলসানারা ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠলো । 
-দুইশ বছরের বুড় আমাকে বলে বয়স্ক !!!!!

তারপর হাসতেই থাকলো । কায়েস আহমেদ নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রনে রাখলেন । কোন কারন নেই তবুও তিনি গুলসানারা দিকে এগিয়ে গেলেন না । অবশ্য যাওয়ার প্রয়োজনও পড়লো না । তার আগেই একজন এসে বলল যে তারা একটা বেজমেন্টের দরজা খুজে পেয়েছেন । ভেতর থেকে আটকানো । 

কায়েস আহমেদ সেখানে গেলেন । সামনে দাড়িয়ে থাকা সৈনিকটা বলল যে তারা অনেক সময় ধরে চেষ্টা করছে তবে খুলতে পারে নি । দরজাটা বেশ মজবুত । 

কায়েস আহমেদ এগিয়ে গেল । তারপর দরজার সামনে গিয়ে হাত রাখলো । দুজন সৈনিক কেবল অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো যে দরজার উপর কেউ যেন আছড়ে পড়লো । বড় গাছের গুড়ি দিয়ে দরজায় আঘাত করলে দরজা যেমন ভেঙ্গে যেত ঠিক সেই ভাবেই দরজাটা ভেঙ্গে গেল । 

ভেতরে ঢুকতেই কায়েস আহমেদ দেখলে একপাশে আবন্তি চুপ করে বসে আছে । মুখে ভয় নিয়ে । তার থেকে একটু দুরে আরেকটা ছেলে । ছেলেটার হাতে একটা ছুরি ! ছেলেটাকে উঠে দাড়াতে দেখেই কায়েস আহমেদ আবারও নিজের অদৃশ্য শক্তি দিয়ে ছেলেটাকে দেওয়ালের সাথে চেপে ধরলো । তারপর বলল
-আবন্তি ! তুমি ঠিক আছো ?
-হ্যা বাবা !
-গুড । আর কোন ভয় নেই । বাবা তোমাকে নিতে এসেছে । 

তখনও সাব্বিরকে দেওয়ালের সাথে চেপে ধরেই রেখেছেন তিনি । কিভাবে কাজটা করছেন সেটা ঘরে থাকা অন্য কেউ জানে না কিংবা বুঝতে পারছে না । কেবল বুঝতে পারছে সামনে দাড়ানো মানুষটা স্বাধারন কিংবা স্বাভাবিক কেউ নয় । 
আবন্তি তখন বলল
-বাবা ওকে ছেড়ে দিন প্লিজ । ও না থাকলে হয়তো আমি এখন বেঁচে থাকতাম না । ক্যাম্পাসে যখন আমার উপর হামলা হয় তখন ও ই আমাকে ওদের হাত থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে আসে । 

কায়েস আহমেদ আরও কিছুটা সময় আবন্তির দিকে তাকিয়ে রইলো । বোঝার চেষ্টা করছে তার মেয়ে সত্যি কথা বলছে কি না । অবশ্য এখন আর সমস্যা নেই । সামনের এই ছোকড়ার কোন মূল্য নেই তার কাছে । আবন্তি ঠিক আছে সেটাই তার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ন । কায়েস আহমেদ সাব্বিরকে ছেড়ে দিল । তারপর আর কোন কথা না বলে আবন্তিকে নিয়ে উপরে চলে এল । 



ছয়


আবন্তি নিজের কাছেই কেবল বলছিল যে ও যা যা জেনে এসেছে তার সব যেন মিথ্যা হয় । ঠিক আছে ও ঠিক স্বাভাবিক জীবন পায় নি । ওর বাবা ওকে একটু বেশি নজরদারীতে রেখেছে কিন্তু তাই বলে এটা কোন ভাবেই সত্য হতে পারে না । কিন্তু বাসায় আসার পর থেকে যখন ওকে নিজের ঘরে আটকে রাখা হল তখন ওর মনে হল ওরা যা যা বলেছে সব সত্যি । পরের সারা দিন ওকে ঘর থেকে একটা বারও বের হতে দেওয়া হল না । চিৎকার চেঁচামিচি করলো কিছু সময় ধরে তবে সেটাতে কোন লাভ হল না । কিছু সময় পরে সেটাও বন্ধ করে দিল । নিজের বিছানায় বসে রইলো চুপ করে । ওর আর কিছু করার নেই । 

পরের দিন ওর বাবা দরজা খুলে যখন ওর রুমে এল তখন আবন্তির শরীরটা বেশ দুর্বল । আগের দিনের ধকল সেই সাথে সারা দিন ও কিছুই খাই নি । ওর বাবার দিকে তাকিয়ে বলল
-ওরা যা যা আমাকে বলেছে সবই সত্যি ?
প্রথমে কায়েস আহমেদ কোন কথা বললেন না । কঠিন চোখে তাকিয়ে রইলো কেবল । আবন্তি বলল
-অন্তত এটা জানার অধিকার আমার আছে ? পুরো জীবনে আপনি আমাকে নিজের মত করে একটা দিনও চলতে দেন নি এটা বলেন অন্তত !
-হ্যা সত্যি !
-আপনার বয়স কত ?
-হিসাব করি না অনেক দিন । দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় আমার বয়স ১১২ বছর ছিল । তারপর আর হিসাব করা হয় নি ।

আবন্তি আর কোন কথা বলল না । কায়েস আহমেদ বলল
-রেডি হয়ে নাও । গোসল সেরে নাও । আমি চাই না শেষ কয়েকটা মুহুর্ত তোমার উপর আমি জোর জবর্দস্তি করি । সেটাতে তোমার কোন লাভ হবে না । 

দরজাটা আবারও বন্ধ হয়ে গেল । আবন্তির কান্না আসা উচিৎ কিন্তু আবন্তির কান্না এল না । বরং অন্য রকম একটা অনুভুতি হতে লাগলো । সাব্বিরের কথা মনে হল । মনে মনে দোয়া করলো ছেলেটার কথা যেন ঠিক হয় ! এতো সময় ও ওকে যা যা বলেছে সব ঠিক হয়েছে এটাও যেন ঠিক হয় । 



সাত
—-


আবন্তিকে একটা কালো বেদীর উপর শুইয়ে রাখা হয়েছে । তার কোন জ্ঞান নেই । অচেতন হয়ে পড়ে আছে সে । তার হাতের দুটো শরীরের দুদিকে রাখা । তার হাত দুটো যেখানে রাখা হয়েছে সেখান থেকে সরু ড্রেনের চলে গিয়েছে ওর পায়ের কাছে । সেখানে গিয়ে মিশেছে ড্রেন দুটো । আবন্তির দুই হাতের রগ কেটে দেওয়া হয়েছে । সেখানে থেকে রক্ত ড্রেন দিয়ে গড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে পায়ের কাছের বড় গর্তটাতে । ঠিক ঐ পায়ের কাছেই একটা বড় মুর্তি রাখা হয়েছে । মূর্তিটা মুলাকের । শরীরটা মানুষের আকৃতি হলেও লম্বাতে সেটা ১০/১১ ফুট । শরীরও ঠিক তেমনটা মোটা । মাথাটা অনেকটা মহিষের মত তবে নাকের কাছে একটা লম্বা শিং আছে । 

কায়েস আহমেদ সেই কখন থেকে মন্ত্র পড়েই যাচ্ছে । ঘরটা আবন্তিদের বাসার নিচে অবস্থিত । কম করেও হলেও চার তলা লম্বা । ঘরের চার কোনে মশালের আলো জলছে । আর মৃদ্যু স্বরে ঢোলের আওয়া হচ্ছে যদিও পুরো ঘরের ভেতরে তিনি ছাড়া আর কেউ নেই । স্পিকারে আওয়াজটা আগে থেকেই রেকর্ড করা রয়েছে । 

কায়েস আহমেদ জানে খুব জলদি মুলাকের মুর্তিতে জান ফিরে পাবে । মুর্তিটা নড়াচড়া করে সামনে শোয়ানোআবন্তিকে দেখতে পাবে । তারপর তার হাতের কাটা থেকে গড়িয়ে পড়া রক্তের স্বাদ নিবে । সব শেষে সব টুকু রক্ত শুসে নিয়ে সন্তুষ্টির চোখে তাকাবে কায়েস আহমেদের দিকে । 

হঠাৎ ঘরটা কেঁপে উঠলো । এক সাথে চারটা মশালই নিভে গেল । কায়েজ আহমেদ মন্ত্র পড়েই চলেছেন । তিনি জানেন মুলাক চলে এসেছে । তিনি মুলাকের উপস্থিতি ঠিক টের পাচ্ছে । পুরো শরীরে একটা আলাদা উত্তেজনা কাজ করছে । ঢোলের আওয়াজ যেন আস্তে আস্তে বাড়তে লাগলো সেই সাথে কায়েস আহমেদের মন্ত্র পড়ার আওয়াজও ।

এরপরে আরও বিশ বছর তাকে আবার নতুন করে যৌবন আর শক্তি দেওয়া হবে । আরও ক্ষমতা তার হাতের মুঠোই চলে আসবে ! 
তিনি আস্তে আস্তে সব থেকে শক্তি শালী হয়ে উঠবেন । 

কিন্তু হঠাৎ মনে হল কিছু একটা সমস্যা হয়েছে । 
কিছু একটা ঠিক নেই যেই । আগুন টা আবারও জ্বলে উঠলো । 
মানে মুলাক চলে গেছে ! 
কায়েজ আহমেদ অবাক হয়ে দেখলেন মুলাক তার সামনে পরিবেশিত বলিটা গ্রহন করে নি । আবন্তি সেই আগের মতই আছে । 
কিন্তু এমনটা হওয়ার কথা না । আবন্তির এখানে থাকার কথা না । 

কি হল !!

হঠাৎই কায়েস আহমেদ নিজের ভেতরে কাঁপন অনুভব করলেন । শক্তিহীন অনুভব করছেন !
এমনটা কেন হল ?
কেমন করে হল !
তিনি তো সব ঠিকই করেছিলেন ? 
তাহলে ?

তিনি সিড়ির দিকে দৌড় দিলেন । তার সারা শরীরে কাঁপন ধরে গেছে । কিন্তু সিড়ির কাছে পৌছাতে পারলেন না । তার আগেই পড়ে গেলেন । তার শরীরের মসৃন ভাবটা দুর হয়ে আস্তে আস্তে বৃদ্ধ মানুষের মত হয়ে যেতে লাগলো । শরীরের পুষ্ট মাংসের জায়গার স্থান নিতে শুরু করলো ভাজ পরা চামড়া । দেখতে দেখতে ৪৫ বছরের মানুষের জাগয়ায় তিনি পরিনত হলেন ১৮৩ বছরের একজন মানুষ ! 

মুলাক তাক যা যা দিয়েছিলো সব কিছু নিয়ে গেছে ! 


আট
—-



আবন্তি চোখ মেলে দেখলে সে হাসপাতালের বেডে শুয়ে হাতে । তার হাতের সাদা ব্যান্ড-এইড বাঁধা । কিছু মনে করতে চেষ্টা করলো কিন্তু কিছু মনে করতে পারলো না । সামনে তাকিয়ে দেখে গুলসানারা বসে আছে । 
-কেমন লাগছে এখন ?
-ভাল । আমি এখানে কেমন করে ?
-সাব্বির তোমাকে এখানে এনেছে । ওরা ঐদিন রাতেই তোমার বাবার বাসা আক্রমন করে । ভেবেছিল খুব কঠিন যুদ্ধ হবে কিন্তু আশ্চর্য ভাবে কোন প্রতিকুলতার মুখোমুখি ওদের হতে হয় নি । তখন বাসা কেবল মাত্র দুজন গার্ড ছিলো । অনেক কষ্টে নিচের ঘরটা খুজে পেয়েছে ।
-তারপর ?
-ওখানে গিয়ে দেখে তুমি একটা বেদীর উপর শুয়ে আছো । তোমার থেকে রক্ত পড়ছে । অনেক খানি রক্ত বের হয়ে গেছিলো । আর কিছু দেরি হলে হয়তো তোমাকে বাচানো যেত না ! 

আবন্তি কিছু না বলে একটু হাসার চেষ্টা করলো । 
গুলসানারা বলল
-ওরা তোমার বাবার লাশ পেয়েছে । সে নাকি মরার আগে একদম কুচকে গিয়েছিলো । দেখে মনে হচ্ছিলো নাকি দুতিনশ বছরের কোন বুড়ো মরে পড়ে আছে ! 

আবন্তি কিছু বলল না ।
-তুমি অবাক হও নি ?
-না !
-তার মানে তুমি জানতে যে যে মারা যাবে ?
-জানতাম ।
-কিভাবে ?

আবন্তি এই কথার জবাব না দিয়ে কেমন চোখে তাকালো ! গুলসানারা কেমন বিভ্রান্ত দেখালো । সে কিছুই বুঝতে পারছে না । আবন্তিকে চুপ করে থাকতে দেখে গুলসানারা আবার বলল
-কি হয়েছিলো এমন ? 

এই কথারও জবাব না দিয়ে আবন্তি কেবল হাসলো । ওর মাথায় তখন অন্য কিছু খেলছে । অন্য এক সময় চলে গেছে ও । ও ঠিক ঠিক জানে কেন মুলাক ওর বাবাকে ত্যাগ করে চলে গেছে । সঠিক সময়ে একটা সঠিক কাজই ওর জীবন বাঁচিয়েছে ! 


(সমাপ্ত)  

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.5 / 5. Vote count: 13

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

One Comment on “শয়তানের ভোজ”

  1. আবন্তি পবিত্র ছিল না। তাই মুলাক বলি গ্রহণ করে নি যার ফলে কায়েস আহমেদ মারা যায়।

Comments are closed.