টুকরো গল্প ১.১

oputanvir
4.8
(69)

যুথির কেবল মনে হল যে এখন মিনার ওর উপর চিৎকার চেঁচামিচি শুরু করবে । অবশ্য এই ব্যাপারটা যে কারো সামনে আসলেই সে স্বাভাবিক ভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবেই । মিনারের স্থানে যদি যুথি নিজে থাকতো সেও কি প্রতিক্রিয়া দেখাতো না? অবশ্যও স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া দেখাতো । যদিও যুথি নিজের কাছে একদম পরিস্কার আছে । সে জানে সে কোন অন্যায় করে নি । কেবল সামিরের সাথে মাঝে মাঝে কথা বলেছে । আর কিছুই তাদের ভেতরে চলছে না ।

মিনার ভাতের নলাটা মুখে দিতে দিতে বলল, কত দিন ধরে কথা চলছে?
যুথি আসলে কি জবাব দিবে ঠিক বুঝতে পারলো না প্রথমে । তারপর মনে হল যে সত্যি কথাটাই বলে দেয় । মিথ্যা বলার কোন মানে নেই । যুথি বলল, বিয়ের কয়েক মাস পরে । আসলে সামির যখন বলল যে কেবল কথা বলতে চায় মাঝে মাঝে তাই আমি আর মানা করি নি । আগে তো আসলে বন্ধুই ছিলাম !

মুখের খাবার টুকু গিলে ফেলে এবার মিনার যুথির দিকে তাকালো শান্ত চোখে। তারপর বলল, তুমি যদি আমার স্থানে হতে তাহলে তোমার মনভাব কেমন হত?
-মিনার আমি কিন্তু কোন …
যুথিকে কথা শেষ করতে না দিয়ে মিনার বলল, আমি অন্য কিছু জানতে চাইছি না তোমার কাছে । আমি কেবল জানতে চাইছি যে তুমি যদি জানতে পারতে আমি বিয়ের পরেও আমার প্রাক্তন প্রেমিকার সাথে নিয়মিত কথা বলি, এই টা জানার পরে তোমার অনুভূতি কেমন হত?

যুথি চট করে কোন জবাব দিতে পারলো না । সত্যিই তো কেমন হত ?
ও কি সহজে মেনে নিতে পারতো?
মিনার আবার বলল, এটা আমাকে কষ্ট দিয়েছে যুথি । তুমি তার সাথে কেন কথা বল, সেটা সঠিক কি বেঠিক এসব আলাপে আমি যাবোই না । যা আমার কাছে সঠিক সেটা তোমার কাছে সঠিক নাও হতে পারে, আমি যেভাবে চিন্তা করি তুমিও সেভাবই ভাববে সেটা আমি বলছিও না, কিংবা আমি তোমার উপরে আমার কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়েও দেব না । সব কিছুর পরেও আমি কেবল তোমাকে বলি যে তার সাথে এই কথা বলাটা আমার কাছে একটা কষ্টের কারণ । এই ব্যাপারে তোমাকে আমার আর কিছুই বলার নেই ।

মিনার খাওয়া শেষ করে উঠে দাড়ালো । প্লেটটা নিয়ে চলে গেল রান্না ঘরে । যুথি কিছু সময় কেবল বসে রইলো । ভেবেছিলো যে মিনার হয়তো ঝগড়া করবে, চিৎকার চেঁচামিচি করবে । সেটা করলেই বরং ভাল হত । কিন্তু সেসবের কিছুই সে করলো না । কেবল চুপ করে জানিয়ে গেল যে যুথি এমন একটা কাজ করেছে সেটাতে কষ্ট পেয়েছে । এমন কি এটাও বলল না যে সামিরের সাথে কথা বলা বন্ধ করতে । কিছুই বলে নি ।

খাবার টেবিলে বসেই দেখতে পেল যে মিনার রান্নাঘর থেকে নিজের স্টাডি রুমে চলে গেল । মিনারের একটা ছোট স্টাডি রুম আছে । সেখানেই সব কাজ কর্ম সে করে । সেখানে যদিও কোন শোবার খাট নেই । রাতে ঘুমাতে হলে মিনারকে অবশ্যই শোবার ঘরে কিংবা গেস্ট রুমে যেতে হবে ।

যুথি শোবার ঘরে গিয়ে অনেক সময় আলো বন্ধ করে শুয়ে রইলো । কিন্তু একটা সময় অনুভব করলো যে ওর কোন ভাবেই ঘুম আসছে না । বারবার কেবল মিনারের চোখটা ভেসে উঠছে মনের মাঝে । কথা গুলো বলার সময় ওর চোখ গুলো কেমন কষ্টে ছিল । সেই দৃশ্যটা সে কোন ভাবেই নিজের মন থেকে দুর করতে পারছে না । এই অনুভূতিটা ওকে বড় অসহায় করে তুলছে ।

এমন সময় যুথি অনুভব করলো যে মিনার দরজা খুলে ভেতরে ঢুকছে । বিছানার উপরে উঠে আসাটাও অনুভব করলো বেশ ভাল ভাবে । তারও কিছু সময় পরে মিনার ওর দিকে এসে স্বাভাবিক ভাবে ওকে খানিকটা জড়িয়ে ধরলো । প্রতিদিন যেভাবে রাতে ঘুমায় সে । এমন একটা ভাব যেন সব কিছু স্বাভাবিক আছে । কোন সমস্যা নেই । এই ভাবনাটা যুতির মনের আরও একটু অস্বস্তির জন্ম দিল ! একজন মানুষ আপনাকে কষ্ট দিয়েছে তবুও তার সাথে আপনি কোন প্রকার রাগ কিংবা অভিমান না দেখিয়ে তার সাথে স্বাভাবিক আচরন করছেন । এই আচরণ যুথিকে আরও বেশি কষ্ট দিচ্ছে ।

দুই
-আমাদের আর কথা হবে না ?
-কেন ? কী হল আবার ?
-কিছু হয় নি । ম
-তোমার স্বামী কিছু বলেছে?

যুথি চট করে তাকালো সামিরের দিকে । তারপর বলল, মিনার জানে যে আমি তোমার সাথে আমি কথা বলি । তবে সে আমাকে কোন কিছু বলে নি । এমন কি আমাকে কথা বলতে নিষেধও করে নি ।
-তাহলে সমস্যা কি?
-সমস্যা হচ্ছে আমি যে তোমার সাথে কথা বলি এটা তাকে কষ্ট দিচ্ছে । তবুও সে আমাকে কিছু বলে নি, কিছু যে বলবে সনা সেটাও আমি জানি । কিন্তু আমি জেনে শুনে এটা আর করতে পারছি না । আমার কোন আচরনে আমার স্বামী কষ্ট পাচ্ছে সেটা আমি আর চালিয়ে নিতে আগ্রহী নই ।
-আর কথা বন্ধ করে দিলে আমি যে কষ্ট পাবো সেটা?

যুথির মাথায় হঠাৎ করেই রাগটা দেখা দিল । সামির এমন ভাবে কথা টা বলল যেন ওদের সাথে অন্য কিছু চলছে । যুথি বলল, তুমি কষ্ট পেলে আমার তাতে আসলে কি যায় আসে বল ? হু আর ইউ ? এক সময়ে আমাদের মাঝে কিছু ছিল কিন্তু সেটা এখন আর নেই । কিছু অবশিষ্ট নেই । বুঝতে পেরেছো কি? তুমি আমার জীবনে এখন কিছু মিন করো না । কিছু না !
-তাহলে কেন কথা শুরু করেছিলে?
-এটাই আমার ভুল ছিলো । তুমি আমার প্রেমিক হওয়ার আগে আমার বন্ধু ছিলে । সেই হিসাবেই তোমার অনুরোধে তোমার সাথে কথা বলতাম ! আর কিছু না ! নিজের কাছে আমি স্বচ্ছ ছিলাম যে আমি তোমার সাথে কেবল কথাই বলবো অন্য কিছু নয়, তাই কোন অপরাধবোধ আমার ভেতরে জাগেও নি । কিন্তু এটা আমি বুঝতে ভুল করেছিলাম যে আমার এই আচরন মিনারের কষ্টের কারণ হয়ে যাবে ! যাক অনেক কথা খরচ করলাম আর না ।
-না না তুমি আমার সাথে এটা করতে পারো না । আমি এটা মোটেই মেনে নিবো না !

যুথি কিছু সময় সামিরের দিকে তাকিয়ে রইলো । তার মুখের ভাবটা যুথির কাছে ঠিক যেন বিশ্বাস হচ্ছে না । এমন একটা ভাব করছে যেন যুথির ওর সাথে কতই না কমিটেড ছিল । কত কিছু কথা বার্তা দিয়েছিলো । এখন কথা না রেখে সরে যাচ্ছে । যুথি নিজের মেজাজটা যথা সম্ভব শান্ত করে বলল, সামির যথেষ্ঠ হয়েছে । আজকের পরে আমার সাথে আর যোগাযোগ করবে না । নয়তো সোজা পুলিশে রিপোর্ট করবো । বুঝেছো ?

পুলিশে রিপোর্টের ব্যাপারে কাজ হবে যুথি জানে । প্রথমবার যখন যুথির সাথে সামিরের ব্রেক আপ হয়, তখনও সামির ওকে বেশ ডিস্টার্ব করতো । বারবার ফোন দিতো । যুথির বড় মামা পুলিশের ডিআইডি । তাকে বলাতেই কাজ হয়েছিলো । তারপর অনেক দিন সামির ওর সাথে যোগাযোগ করে নি । যুথির আগেই বিয়ে করে ফেলেছিলো শুনেছিলো । যদিও সেই বিয়ে টেকে নি । তারপর কিছুদিন আগে সামির যখন ওকে আবার নক দিল, কেবল কথা বলার জন্য অনুরোধ করলো আর কিছু নয় তখন যুথির কেন জানি মনে হল যে সামান্য কথা বলাতে আর কি হবে । স্বাভাবিক হাই হ্যালোই কথা চলতো কেবল ! কিন্তু ব্যাপারটা যে এই ভাবে এমন দিকে চলে যাবে সেটা যুথি ভাবে নি । বিশেষ করে মিনার যে এভাবে কষ্ট পাবে সেটা ও মোটেও ভাবতে পারে নি । ওর ভাবা দরকার ছিল ! উচিৎ ছিল ওর দিকটা ভাবা !

যুথি হাসলো সামিরের কথা শুনে । তারপর বলল, তুমি জানো আমি কী করতে পারি !
সামির এবার বলল, আমি মিনার সাহেবের সাথে কথা বলব । বলব যে তোমার সাথে আমার কী চলছিল !
যুথির এবার সত্যিই মজা লাগলো । তারপর বলল, তুমি যার ইচ্ছে তার সাথে কথা বল । কেবল আমার সাথে যোগাযোগ করবে না । ঠিক আছে ? মিনারকে যা ইচ্ছে বলতে পারো । সেটা আমি সামলে নিবো !

আর বাক্য ব্যয় না করে যুথি সেখান থেকে হাটা দিল । রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে কিছু সময় ভাবলো যে কোন দিন যাবে । নিজের অফিসের দিকে না গিয়ে মিনারে অফিসের দিকে হাটা দিল । মিনার আর ওর অফিস খুব বেশি দুরে না । হেটে যেতে মিনিট ১৫ সময় লাগে ।

তিন
-স্যার আপনার ওয়াইফ এসেছে ?

মিনার ঘড়ির দিকে তাকালো । তখনও লাঞ্চ আওয়ার হয় নি । এই সময়ে হঠাৎ যুথি কেন এল? কোন বিপদ হল কি?
নিজের ডেস্ক ছেড়ে ওয়েটিং রুমের দিকে হাটা দিল দ্রুত ।
রুমে ঢুকতেই দেখতে পেল যুথি মুখ গোমড়া করে বসে আছে । ওকে দেখতেই উঠে দাড়ালো । কিছু সময় সেভাবেই তাকিয়ে রইলো ওর দিকে । তারপর মিনারকে খানিকটা অবাক করে দিয়েই ওর দিকে খানিকটা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো ওকে । এভাবে জড়িয়ে ধরার কারণ মিনার মোটেও বুঝতে পারলো না বটে তবে অনুভব করলো যে ওর মনটা হঠাৎ ভাল হয়ে গেছে । গত কয়েকদিন যাবৎ মনের ভেতরে যে গুমট ভাবটা ছিল সেটা গায়েব হয়ে গেছে এক নিমিষেই ।
মিনার বলল, আরে কি হয়েছে বলবে তো?

মিনার একটু দরজার দিকে তাকানোর চেষ্টা করলো । দরজাটা কেবল আলতো করে বন্ধ করা । এখন যে কেউ দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে পারে । এভাবে ঘরে ঢুকেই যদি দেখে একজন পুরুষ আর নারী এভাবে একে অন্যকে আলিঙ্গন করে আছে তাহলে সেটা পুরো অফিসে ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগবে না । সবার মুখে একটা মুখোরোচক সংবাদ হয়ে যাবে ।
মিনার বলল, আরে কেউ চলে আসবে?
যুথি মিনারকে না ছেড়ে দিয়েই বলল, চলে আসলে কি হবে? তুমি তো আর আমার মত অন্যায় কিছু করছো না । অন্য কারো সাথে লুকিয়ে কিছু করছো না ।

মিনার এবার একটু থেমে যুথির কপালে একটা ছোট চুমু খেল । তারপর বলল, আমি কখনই বলি নি তুমি অন্যায় কিছু করেছো !
-না বল নি। কিন্তু কষ্ট তো পেয়েছো ! আমার আচরণে ! আমার আচরণে …
-আচ্ছা বাবা ঠিক আছে । যা হয়েছে ! এখন এটা নিয়ে আর কিছু দরকার নেই ।

আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো তার আগেই দরজায় টোকা পড়লো । যুথি আস্তে করে মিনার কে ছেড়ে দিল । তবে মিনারের কাছ থেকে সরলো না । দরজা দিয়ে পিয়ন প্রবেশ করলো । মিনারের দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার কিছু নিয়ে আসবো কি?
মিনার কিছু বলার আগেই যুথি বলল, না না কিছু দরকার নেই । আমরা লাঞ্চের জন্য বের হব ।

পিয়ন চলে যেতেই মিনার বলল, তুমিই বললে যে বলল যে কেউ আসলেও কিছু যায় আসে না ।এখন ছেড়ে দিলে যে !
যুথি বলল, তুমি চাও যে সবার সামনে তোমাকে জড়িয়ে ধরি । শোন চাইলে আমি ঠিকই পারবো । দেখবা ? চল তোমাকে তোমার বসের সামনেই চুমু খাবো ! চল চল ..

এই বলে মিনারের হাত ধরে নিয়ে যেতে চাইলো । মিনার ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আরে বাবা আমি বিশ্বাস করছি । কোন সমস্যা নেই । তুমি পারবে !
-আজকে আর অফিসে আসতে হবে না । চল আজকে কোথাও যাই ।
-আরে তাই বললে হয় নাকি ! আজকে অনেক কাজ?
-আচ্ছা আমি আমার অফিস থেকে চলে আসতে পারলাম তুমি পারবে না !
-আরে বাবা….।
-কোন কথা শুনতে চাই না । যেতে হবে মানে হবে ! হবে হবে হবে !

মিনার হাসলো । যুথি খানিকটা পাগলামো শুরু করেছে । ওদের মাঝে যে মন মালিন্যটা শুরু হয়েছিলো সেটা শেষ হয়ে যেতেই যুথি যেন আরও একটু বেশি কাছে চলে এসেছে মিনারের । মিনার চাইলো না যুথির এই আচরনটা শেষ হোক । জীবনে এই ছেলে মানুষী আর পাগলামো গুলো দরকার আছে ।
মিনার বলল, আচ্ছা বাবা চল । তবে যদি চাকরি চলে যায় তাহলে আমাকে পরে কিছু বলতে পারবে না !
-কিছু বলবো না ! যাও কথা দিলাম !

ওরা দুজন খানিকটা চুপিচুপিই বের হল । মিনার জানে বস কোন ভাবেই ছুটি দিবে না আজকে । না দিক । জীবনের জন্য চাকরি । চাকরির জন্য জীবন নয় । আর ওর কাছে এখন যুথির থেকে গুরুত্বপূর্ন কোন কিছু নেই !

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.8 / 5. Vote count: 69

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

3 Comments on “টুকরো গল্প ১.১”

  1. I see a post in your Facebook page, Its related to this story.. 🙂

  2. ভাই টুকরো গল্পঃ বা টুকরো জীবন দৃশ্য এই গল্পের একটা আলাদা ফিল্ডার করলে ভালো হয়।এই গল্পঃ গুলো পড়তে ভালো লাগে।
    মাঝে মাঝে খুঁজে পেতেও সমস্যা হয়

Comments are closed.