নিশি খুব স্বাভাবিক ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তাই নাকি? তা কেন না করবো শুনি?
আমি নিজেকে কোন মতে সামলে নিতে নিতে বললাম, কি বলতে চাচ্ছিস? জানা নেই শোনা নেই একজন তোকে বিয়ে করতে চাইবে আর তুই রাজি হয়ে যাবি?
নিশি একটু হেসে বলল, সে কি রে, তোর না কাজিন । তুই নিজেও তো জাহিদের গল্প করেছিস আমার কাছে । তোর কাজিন, এই টুকুই তো যথেষ্ঠ ! দেখ ছেলে ভাল । ভাল চাকরি করে । তোর কাজিন । আর কি চাই?
আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম কেবল । দুনিয়ায় শালা সব মেয়েই এমন? ভাল চাকরি আছে বলেই বিয়ে করে ফেলতে হবে? আমি বললাম, না তুই ওকে বিয়ে করবি না?
-কেন করবো না? কোন সমস্যা আছে ? শারীরিক কোন সমস্যা? চরিত্রের দোষ?
আমি মিথ্যে বলতে পারলাম না । জাহিদ ভাইয়ের আসলেই কোন দোষ নেই । ছেলে হিসাবে দেখতে শুনতে সব দিক দিয়েই ভাল । আমি বললাম, না সে সব না।
-তাহলে কী সমস্যা? আমি কেন না করবো শুনি?
আমার সত্যই রাগ হল প্রচন্ড । মনে হল জাহান্নামে যাক সব । যে মেয়ে এতোদিনও আমার মনের কথা বোঝে নি কিংবা বোঝার চেষ্টা করে নি সেই মেয়ে কোন দিন বুঝবেও না । যা করে ফেলুক বিয়ে জাহিদ ভাই কে ! কিন্তু পরক্ষণেই আমার মনে হল জাহিদ ভাইকে বিয়ে করলে নিশি সব সময় আমার চোখের সামনে থাকবে । আমাদের আর জাহিদ ভাইদের বাড়ি কাছাকাছি । সম্পর্কে সে আমার চাচাতো ভাই । আমাদের পরিবারে মিল মহব্বদ দারুন । নিশির যদি অন্য বিয়ে হয়ে যায় সেটা আমার কাছে মেনে নিতে কষ্ট হবে কিন্তু চোখের সামনে নিশির পাশে অন্য কাউকে আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারবো না ।
আমি বলল, কারণ …..
বলতে গিয়ে আটকে গেলাম আমি । নিশি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, বল কী কারণ?
-কারণ আমি তোকে ভালোবাসি ….
এক টানে কথাটা বলেই আমার মনে হল কী সর্বনাশ ! নিশি আমাকে অনেক আগেই বলেছিলো যে বন্ধুত্বের মাঝে এই সব প্রেম ভালোবাসা ওর একদম পছন্দ না । আমারও এসব পছন্দ ছিল না । কিন্তু এক সময়ে আমি ঠিক ঠিক নিশির প্রেমে পড়ে গেলাম । কিন্তু নিশির বন্ধুত্ব হারানোর ভয়ে আমি কোন দিন ওকে বলতেই পারি নি ভালোবাসার কথা । কিন্তু চোখের সামনে নিশিকে অন্য কাউকে হতে দেখে আমি চুপ করে থাকতে পারলাম না । কথাটা বলেই দিলাম ।
তবে মনে হল যে এখানে আর দাড়িয়ে থাকা মোটেই সমীচিন হবে না । নিশির রেগে যেতে পারে এবং আমাকে মারতে আসতে পারে । আমি আবারও বললাম কথাটা ।
-নিশি তোমাকে আমি ভালোবাসি । আমার চোখের সামনে তোকে অন্য কারো হতে দেখাটা সম্ভব না । কোন ভাবেই না ।
এই বলে আমি পেছনে ঘুরে হাটা দিলাম । একবার মনে ক্ষিণ আশা ছিল যে নিশি হয়তো পেছন থেকে আমার নাম ধরে ডাক দিবে কিন্তু দিল না । আমি পেছনে ফিরে তাকানোর সাহস পেলাম না কেন জানি । মনে হল যে পেছন ফিরে তাকালেই দেখবো যে নিশি ঘুরে চলে গেছে । আমার দিকে সে তাকিয়ে নেই । এটা আমাকে কষ্ট দিবে অনেক ।
আমি হাটতে হাটতে ক্যাম্পাসের একেবারে শেষ প্রান্তে চলে এলাম । এটা আমার একটা পছন্দের জায়গা । যখন খুব একটা লাগে আমি এখানে চলে আসি প্রায়ই । একা একা বসে থাকি । কত কী ভাবি । বেশির ভাগই নিশি কে নিয়ে । এই জায়গাটার নাম আসলে আমি দিয়েছি নিশি জোন । নিশিকে নিয়ে ভাবার স্থান । নিশিজোনে এসে নিশিকে নিয়ে সুখের কথা ভাবতে আমার ভাল লাগে । আমার মন এতে করে ভাল হয়ে যায় !
আমি আসলে কবে নিশির প্রেমে পড়লাম ?
সময়টা আমার স্পষ্ট মনে আছে । আমার থার্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষার পরে ঠিক হল যে সবাই মিলে আমরা সেন্টমার্টিন যাবো । নিশি সহ আরও অনেক মেয়ে ছিল আমাদের সাথে । দুটো দিন সেখানে কীভাবে কেটে গেল আমরা টের পেলাম না । সেদিনই প্রথম আমি নিশিকে দেখতে পেলাম । নিশি সেদিন হালকা নীল রংয়ের একটা সেলোয়ার কামিজ পরেছিলো । কপালে একটা ছোট্ট টিপ । চুপ গুলো ছাড়া । সমুদ্রের পাড়ে আমি যখন ওকে দেখলাম তখন সত্য বলতে কী এতো জোড়ে ধাক্কা খেলাম যে নিজেই অবাক হয়ে গেলাম । এতো অস্বস্থি লাগলো এমন একটা ভাবনা শুরু হওয়াতে । কিন্তু সেই সাথেে একটা ভালো লাগার অনুভূতিও ছিল । সেদিন নিশির পাশেই আমি হাটছিলাম । হাটতে হাটতে অনেক দুরে চলে গেলাম দুজনে । আমাদের গ্রুপ থেকে অনেক দুরে । ও আমার সাথে কত কথা বলছিলো । আমি কেবল ওকে দেখছিলাম । সত্যি বলতে কী আমার একটা সময়ে এতো ভাল লাগছিলো । বার বার কেবল ওর হাত ধরতে ইচ্ছে করছিলো ।
একটা সময়ে আমরা ক্লান্ত হয়ে সী চেয়ারে বসে পড়লাম । একটা চেয়ারেই দুজন পাশাপাশি সমুদ্র দেখছিলাম । পাশাপাশি সিটে বসেই আমরা এসেছি। ওর শরীরের সাথে আমার শরীরের স্পর্শ নতুন না, কিন্তু সেদিনের সেই স্পর্শ অন্য রকম ছিল । আমি সেটার অনুভূতি কোন ভাবেই বোঝাতে পারবো না । ফেরার পথে ওর হাত ধরতে এতো ইচ্ছে করছিলো কিন্তু লজ্জায় বলতে পারি নি ।
সেন্ট মার্টিন থেকে ফিরে এসে বুঝতে পারলাম যে নিশির উপরে সত্যিই পড়েছি ভালভাবে । এখান থেকে এতো সহজে উঠতে পারছি না আর । তবে বলতেও সাহস পাচ্ছি না । সারা দিন ওকে নিয়ে কত চিন্তা করি কত কিছু ভাবি । নিশি জোন বানিয়ে ফেললাম এখানে । এখানে বসে বসে ওকে নিয়ে কত কিছু চিন্তা করি । কল্পনাকে তো কিছু বলি ওকে কিন্তু বাস্তবে কিছুই বলতে পারি না ।
তবুও সব কিছু ঠিকই ছিল । ইচ্ছে ছিল যে পড়া লেখা শেষ করে চাকরি হলে ওকে একবার বলেই ফেলবো কথাটা । সব কিছু ঠিকঠাক চলছিলো । এভাবে বছর বছর পার হয়ে গেল । অনার্স শেষ করে মাস্টার্সের অর্ধেকটা পার কারলাম । আর একটা সেমিস্টার শেষ করলেই পড়াশুনা শেষ । অবশ্য এরই ভেতরে চাকরির জন্য পড়াশুনা শুরু করে দিয়েছি । দুই এক জায়গাতে পরীক্ষাও দিয়েছি । কিন্তু ঝামেলা বেঁধে গেল বড় আপুর বিয়েতে ।
যথারীতি নিশিকে দাওয়াত দিয়েছি । বিয়ের সব কিছু হয়েছে ভাল ভাবেই । নিশি বেশ সেজে গুজে এসেছে । বাড়ির সবারই নিশিকে পছন্দ হয়েছে । কিন্তু ঘটনা যে এভাবে ঘটে যাবে সেটা আমি ভাবতেও পারি নাই । জাহিদ ভাইয়ের মা মানে চাচির নাকি নিশিকে মনে ধরেছে । সে এখন নিশিকে বউ বানাতে চায় । নিশিও নাকি রাজি !
কী সর্বনাশের কথা !
সত্যিই যদি নিশির সাথে জাহিদ ভাইয়ের বিয়ে হয় তাহলে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো । এই বাড়িতে আমি কোন দিন ফিরে আসবো না ।
আমি মন খারাপ করে নিশি জোনে বসে আছি । একটা সময় সূর্যডুবে গেল । অন্ধকারের ভেতরেও আমি বসেই রইলাম একভাবে । মনে হল যে এখানেই বসে থাকি । আর যাবো না কোথাও ….
দুই
গাধাটা শেষ পর্যন্ত বলল তাহলে !
মনে মনে হাসলাম কেবল ! এতো অস্থিরতা দেখে আমার মনেই হচ্ছিলো যে আজকেই বলে ফেলবে । এবং বলেও ফেলেছে । তার মানে বুদ্ধিতে কাজ হয়েছে । আমি অপুর চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম একভাবে । আমি জানি ওর এখন আমার দিকে ফিরে তাকাতে খুব ইচ্ছে করছে কিন্তু ভয়ে তাকাতে পারছে না । ওর মনে একটা ভয় কাজ করছে যে যদি ও ফিরে তাকায় এবং আমাকে না দেখতে পায় তাহলে খুব কষ্ট পাবে । সেই কষ্ট ও পেতে চায় না ।
আমি ঠিক সেদিনই টের পেয়েছিলাম যেদিন অপু আমার প্রেমে পড়েছিলো । সমুদ্রে সেদিন ও যেভাবে আমার দিকে তাকিয়েছিলো সেদিনই আমি ওর চোখের দৃষ্টি পড়ে ফেলেছিলাম । তারপর থেকে ওর আচরন কেমন বদলে গেল । আমার বারবার মনে হত গাধাটা কেন বলছে না নিজের মনের কথা । এই রকম কয়েকবার হয়েছে আমরা কত কাছাকাছি চলে এসেছি অথচ শেষ মুহুর্তে অপু নিজেকে সামলে নিয়েছে । বলে নি মনের কথা । অবশ্য এর জন্য ওকে দোষ দেওয়া চলে না মোটেও । আমিই তো প্রথমে ওকে বলেছিলাম যে আমি এই সব প্রেম ভালোবাসা পছন্দ করি না বন্ধুত্বের মাঝে । এই ভয়েই বেচারা বলে নি কোন কথা ।
এক সময়ে আমার নিজের কাছেই মনে হল যে আমি নিজেই ওকে বলে দিই । বলে দিই যে ওর মনের কথা আমি বুঝতে পেরেছি এবং আমি রাগ করি নি । কিন্তু কেমন একটা দ্বিধার করণে বলতে পারলাম না । তবে মাথায় একটা বুদ্ধি এল ঠিকই । এমন কিছু আমাকে করতে হবে যাতে অপু নিজ থেকে আমাকে নিজের মনের কথা বলে ।
কিভবে কাজটা করবো তখনই এভাবে সুযোগটা চলে আসবে সেটা ভাবতে পারি নি । অপুর বড় বোনের বিয়েতে গিয়ে হাজির হলাম । সময় টা চমৎকার কাটলো । অপুর মা সাথে আমি ঘনিষ্ঠ ভাবে কথা বললাম। তাকে একটু বেশি সম্মান দেখালাম । আমি তার আচরন দেখেই বুঝতে পারছিলাম যে আমাকে তার মনে ধরেছে । কিন্তু আরও একজনের যে আমাকে মনে ধরেছে সেটা বুঝতে পারলাম পরের সপ্তাহে । অপুর বড় চাচী কিভাবে যেন আমাদের বাসায় চলে এসেছেন নিজের ছেলের জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে । প্রথমে মনে হল তখনই মানা করে দিই কিন্তু তারপরই মনে হল এর থেকে ভাল সুযোগ আর আসবে না । তাই কোন কথা না বলে চুপ রইলাম । এবং ফল স্বরূপ আজকে অপু ঠিকই আমাকে বলে দিলো ভালোবাসি ! কিন্তু গাধাটা এখন যাবে কোথায়?
যাক যেখানে ইচ্ছে । আপাতত আমি জানি আমাকে কোথায় যেতে হবে !
তিন
আসমা বেগম নিশিকে দেখে একটু অবাকই হলেন । এখন প্রায় বিকেল । অপু এখনও ক্যাম্পাস থেকে ফিরে আসে নি । নিশি কেন এসেছে ?
আসমা বেগম বললেন, কী ব্যাপার নিশি ! অপু তো বাসায় আসে নি এখনো!
নিশি একটু হাসলো । তারপর বলল, আমি জানি । আপনার ছেলে পালিয়ে গিয়েছে !
-মানে !
-মানে হচ্ছে আপনার ছেলে আমাকে ভালোবাসি বলে দৌড় মেরেছে ! ভয়ে …
নিশি আবারও একটু হাসলো । আসমা বেগম তাকিয়ে রইলেন নিশির দিকে । এখনও ঠিক যে বুঝতে পারছেন না সব কিছু । নিশি বলল, গাধাটা একবার বলতো যে যে নিশি তুই আর কাউকে বিয়ে করিস না, আমি তোকে বিয়ে করবো তা না । সে শুধু বলে যে বিয়ে না করতে । পরে যখন সাহস করে বলল তারপর ঘুরে দৌড় দিল । কি বাহারী সাহস আমার !
আসমা বেগম একটু সময়ে নিয়ে বুঝতে পারলেন । সাথে সাথেই তার মন ভাল হয়ে গেল । নিশিকে প্রথম দেখাতেই তার পছন্দ হয়েছিলো । মনে মনে ঠিক করেছিলেন যে অপুর সাথে এব্যাপারে কথা বলবেন । কিন্তু তার আগেই অপুর বড় চাচী যে এমন কিছু করে ফেলবে সেটা তিনি বুঝতে পারেন নি । মনে মনে একটু আফসোস হয়েছিলো তারও । জাহিদ ইতিমধ্যে চাকরি পেয়ে গেছে । পাত্র হিসাবে অপুর থেকে এগিয়ে সে । মেয়ের বাবারা জাহিদকেই পছন্দ করবে । আর এই ব্যাপার নিয়ে তিনি আর কিছু করতে চান নি পাছে সম্পর্কে কোন চিড় ধরে । কিন্তু এখন যখন মেয়ে নিজেই অপুকে পছন্দ করেছে সেখানে অন্য কারো কিছু করার নেই ।
নিশি এবার আসমা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল, আন্টি আমি অন্য কাউকে বিয়ে করতে চাই না ।
-কোন চিন্তা কর না মা । তোমার পছন্দের জায়গাতেই তোমার বিয়ে হবে ! কিন্তু গাধাটা কোথায় ?
-জানি না । মনে হয় ক্যাম্পাসেই আছে ।
-আগে সে আসুক । আগে সে বলবে যে এতো বড় ব্যাপারটা সে এতোদিন কেন লুকিয়েছে ! তারপর অন্য কিছু !
অপু ফিরলো আরও ঘন্টা খানেক পরে । অপুর বাবাও ততক্ষণে ফিরে এসেছে । অপু যখন ঘরে ঢুকলো দেখলো নিশি বসার ঘরে বসে ওর আব্বার সাথে গল্প করছে আর সন্ধ্যার নাস্তা খাচ্ছে । অপুর কেবল মনে হল যেন ও ভুল দেখছে । নিশির এখানে থাকার কথা না তো ।
ও কি নিশি জোনে ঘুমিয়ে পড়েছে । ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে ! নিজের হাতে চিমটি কেটে দেখলো স্বপ্ন দেখছে কিনা ! ব্যাথা পেল সে । তার মানে স্বপ্ন দেখছে না ।
ওকে দেখে নিশি চিৎকার করে বলল, আন্টি আপনার ছেলে এসেছে । তাকে খেতে দেন ।
রান্না ঘর থেকে আসমা বেগম চিৎকার করে বললেন, কোন খাওয়া নেই । আগে সে জবাব দিবে তারপর খাওয়া !
অপু আসলে কিছুই বুঝতে পারছে না । তবে ওর মন বলছে ভয়ানক কিছু ঘটে গেছে । ভয়ানক আনন্দের কিছু ! খারাপ কিছু ঘটার আগে মানুষের মন কেমন যেন করে ঠিক তেমনি ভাল কিছু ঘটার আগেই মানুষ সেটা টের পেয়ে যায় । নিশির চোখের দিকে তাকিয়েই অপু সেটা বুঝে ফেলল সাথে সাথেই ।
নিশিজোনে আর একা একা তাকে যেতে হবে না । বাস্তবেই নিশিজোন সে তৈরি করে নিবে এবার । সেখানে সকল কল্পনা বাস্তব হয়ে ধরা দিবে।
গল্প পড়া হলে ভোট দিন প্লিজ যাতে আমি বুঝতে পারি কতজন গল্প পড়ছে ।
Discover more from অপু তানভীর
Subscribe to get the latest posts sent to your email.
এত সুন্দর গল্পের ভোট দিবনা! এটা কোন কথা!?