কে তুমি!

4.5
(20)

নীলা আর আমি একই অফিসে চাকরি না করলেও আমাদের অফিস আসলে একই বিল্ডিংয়ে। প্রথমে কেবল লিফটে নামতে উঠতে আমাদের দেখা হত। আমি তখনো নীলার নাম জানি না। পরে জেনেছি ওর নাম। নিয়ম করে আমি ঠিক যে সময়ে অফিসে আসতাম, যে সময়ে লিফটে উঠতাম নীলাও ঠিক একই সময়ে গিয়ে এসে হাজির হত। এমন অনেকবার হয়েছে যে আমরা একই সময়ে বিল্ডিংয়ের গেটে রিক্সা থেকে নেমেছি। প্রথম প্রথম ব্যাপারটা খেয়াল না করলেও এক সময়ে আমি ব্যাপারটা খেয়াল করা শুরু করলাম। এরপরে আমি যখন অফিস থেকে বের হতাম তখনো আমাদের লিফটে দেখা হত। আমার অফিসের উপরের বিল্ডিংয়ে নীলার অফিস ছিল। আমি অফিস থেকে বাসায় যাওয়ার জন্য যখন লিফটে উঠতাম তখন নীলাকে দেখতে পেতাম। নীলাও একই সময়ে নামছে। একদিন আমি পরীক্ষা করার জন্য অফিস থেকে একটু দেরি করে বের হলাম। দেখি নীলা সেই লিফটে আছে। আরেকদিন বের হলাম একটু আগে আগে। এবং সেদিনো নীলা লিফটের ভেতরে ছিল। আমার বেশ ইচ্ছে করতো নীলাকে বলতে এসব কথা কিন্তু আমি বলতে সাহস করি নি। আমার মনে হয়েছে যে এই কথা বললে নীলা হয়তো বিশ্বাস করবে না। সে ভাববে যে আমি তার সাথে ফ্লার্ট করার জন্য মিথ্যে বানিয়ে বলছি।
এরপর এক সময়ে আমি আবিস্কার করলাম যে লাঞ্চ আওয়ারে ছাদের ক্যাফেটরিয়াতেও আমাদের নিয়মিত দেখা হচ্ছে। আমি সাধারণত ক্যাফেটরিয়ে গেলে আমার সাথে করে একটা বই নিয়ে যাই। লাঞ্চ আওয়ারের পুরো সময়টা আমি বই পড়ি আর কফি সাথে হালকা কিছু খাই। এইভাবেই সময় কাটে তাই আমি নীলাকে প্রথমে দেখতে পাই নি। তবে একদিন একটু অন্য ঘটনা ঘটল। সেদিন আমাদের বিল্ডিংয়ের কোনো একটা ফ্লোরে একটা বিদেশী সেমিনার ছিল। অনেক মানুষ এসেছিল। আমি ক্যাফেটোরিয়াতে বসার জায়গা পাচ্ছিলাম না। এদিক ওদিক তাকিয়ে ফাঁকা স্থান খুজছিলাম আর তখনই নীলাকে দেখতে পেলাম। একটা ডাবল টেবিল নিয়ে বসেছে। সামনের সিটটা ফাঁকা। আমি কফির কাপটা নিয়ে দ্বিধাভরা পায়ে টেবিলটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তারপর ফাঁকা চেয়ারটা দেখিয়ে বললাম, এখানে কেউ বসেছে?
নীলা চোখ তুলে তাকাল। আমাকে দেখে সে চমকে গেল একটু। আর তখনই আমার মনে হল যে এই মেয়ে আমাকে চেনে। এবং বেশ ভাল করে চেনে। অবশ্য তারপরেই আমার মনে হল যে আমাদের যেমন ভাবে প্রতিদিনই দেখা যাচ্ছে সেখানে আমাকে চেনারই কথা। তবে নীলার চোখের দৃষ্টি দেখে আমার মনে হল যে নীলার এই প্রতিক্রিয়া যেন আরো কিছু বেশি ছিল। আমার কেন জানি মনে হল যে আমি যেমন করে নীলাকে খেয়াল করেছি, নীলাও আমাকে ঠিক একই ভাবে খেয়াল করে এসেছে। এমনটা ভাবার আসলে কোন কারণ নেই তবুও কেন জানি এমনটাই মনে হল!
নীলা আমার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময়। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, কেউ নেই। বসুন।
আমি একটু ধন্যবাদ দিয়ে চেয়ার টেনে বসলাম। তবে আজকে আর বইটা খুলে বসলাম না। আজকে ক্যাফেতে প্রচুর ভীড়। আওয়াজ হচ্ছে অনেক। এর ভেতরে বই পড়ে আরাম পাওয়া যাবে না। একবার মনে হয়েছিল যে কফিটা নিয়ে আমি অফিসে ফিরে যাই, সেখানে বসেই বই পড়া যাবে তবে এটা ভাল দেখাবে না। কারো চোখে পড়লে সেটা নিয়ে কথা হবে। যতই লাঞ্চ আওয়ার হোক না কেন অফিসে বসে কাজ না করে বই পড়া কেউ পছন্দ করে না।
নীলা আমার বইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, আজকে আপনার বই পড়া একটু টাফ হয়ে যাবে, তাই না?
এইবার আমি একটু অবাকই হলাম। তারপর বুঝতে পারলাম যে আমি যে ধারণা করেছিলাম সেটা ভুল নয়। আমি যেমন নীলাকে খেয়াল করি নীলাও আমাকে খেয়াল করেছে। নয়তো আমি যে এখানে বই পড়ি এটা তার জানার কথা নয়। আমি একটু হেসে বললাম, হ্যা তা ঠিক বলছেন। সেদিন আমার সত্যি বলতে কি বইয়ের দিকে চোখ গেল না। আমি নীলার দিকে তাকিয়ে কথা বলতে লাগলাম, এমন কি চারিপাশে যে এতো মানুষের আওয়াজ সেটার দিকেও খেয়াল রইলো না। লাঞ্চ আওয়ারটা কিভাবে চলে গেল বুঝতেই পারলাম না।
এরপর থেকে আমাদের আরও যোগাযোগ বেড়ে গেল। লিফটে দেখা হলেই হাসি মুখে কথা হতে লাগল, দুপুরে এক সাথে খাওয়া এবং মাঝে অফিস শেষ করে এদিক ওদিক ঘুরাও শুরু হল। ছুটির দিনে এক সাথে মুভিও দেখতে লাগলাম। সময় আমি ভাবতে শুরু করেছি যে নীলাকে নিয়ে সামনে এগোনো যায় তখনই আমার চোখের সামনে নীলার অন্য একটা ইনস্টাগ্রাম আইডি এসে হাজির হল।
আমি যখন ইনস্টাগ্রামের ছবিটা নীলার দিকে বাড়িয়ে দিলাম তখন নীলা কিছু সময় সেটার দিকে তাকিয়ে রইলো। তবে ওর চোখ দেখেই আমি বুঝতে পারলাম যে সে অবাক হয় নি। মোবাইলের স্ক্রিন থেকে এবার আমার দিকে চোখ তুলে তাকাল। তারপর বলল, আমি নিজেই তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম। তবে…
আমি চুপ রইলাম। নীলার দিককার কথাটা আমি শুনতে চাই। নীলা বলল, ও আমার জমজ বোন প্রোমি!
একটু বিস্মিত হলাম। আমি এটা আশা করি নি। নীলা নিজের পরিবার সম্পর্কে খুব বেশি কথা বলত না। আমিও ইচ্ছে করে শুনতেও চাই নি। ভেবেছি যে ও নিজ থেকে যেদিন বলবে সেদিনই চলবে। নীলা নিজের মোবাইলে একটা ছবি বের করে দিল। নীলার ইয়াং বয়সের ছবি। ক্লাস টেন কিংবা ইন্টারের ছবি হবে। সেখানে দুজন একই চেহারার নীলাকে দেখা যাচ্ছে। তবে নীলা আর প্রোমির পোশাকে বেশ ভাল রকমের পার্থক্য দেখতে পেলাম। নীলা একটা সেলোয়ার কামিজ পরে আছে তবে প্রোমি পরণে একটা মিনি স্কার্ট, উপরে ক্রপটপ।
আমি ইনস্টাগ্রামের আইডির ছবিগুলোর কথা মনে হল। প্রোমির এই ইনস্টাগ্রামে বেশ কিছু ছবি রয়েছে। এই ছবিগুলো বেশ খোলামেলা ভাবে তোলা। কিছু কিছু ছবি রয়েছে যেখানে প্রোমির শরীরে নামমাত্র পোশাক রয়েছে। আমি চেহারা দেখে তীব্র অবাক হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম এটা বুঝি নীলারই আইডি।
আমি নীলার দিকে তাকিয়ে দেখি ও অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। ওর মুখে লজ্জার একটা লাল আফা ফুটে উঠেছে। আমি বললাম, বাসায় জানে এসব কথা?
-হ্যা জানে। প্রোমির উপরে বাবা মায়ের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। একবার বাবা খুব রাগ করেছিল তখন প্রোমি সুইসাইড এটেম্পট নিয়েছিল। তারপর থেকে বাবা মাও কিছু বলে না আর!
আমি এটা নিয়ে আর কথা বলা সমীচীন হবে বলে মনে হল না। এরপর নীলা প্রোমির ব্যাপারে আমাকে অনেক কথাই বলত। সত্যি বলতে কি আমি একটু অবাক হয়েছিলাম এই ভেবে যে প্রোমির কথা নীলা আমাকে আগে বলে নি। নিজের জমজ বোনের কথা সে আমাকে আগে বলে নি, এই ব্যাপারটা আমার কাছে একটু যেন অস্বাভাবিক মনে হল। তবে এটা নিয়ে আমি আর অন্য কিছু চিন্তা করলাম না।
প্রোমির সাথে আমার দেখা হল আরও মাস খানেক পরে। সেদিন ছিল শনিবার, নীলার সাথে বসুন্ধরাতে মুভি দেখার একটা পরিকল্পনা ছিল। নীলাই মুভির টিকেট কেটেছিল। আমি নির্দিষ্ট সময়ে হাজির হয়েছি। আমি নীলাকে একটা মেসেজ করে দিলাম যে আমি চলে এসেছি। নীলা সিন করল মেসেজটা তবে কোন উত্তর দিল না। আমার মনে হল যে ও হয়তো কাছেই চলে এসেছে। তাই আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম।
মিনিট পাঁচেক পরেই নীলাকে আমি দেখতে পেলাম। তবে প্রথম দেখাতেই আমি চমকে গেলাম। বিশেষ করে নীলার পোশাক দেখে আমি চমকে গেলাম। আমি এতোদিন যতবার নীলাকে দেখেছি নীলা সব সময়ই সেলোয়ার কামিজ পরেছে, মাঝে মাঝে কুর্তির সাথে জিন্স পরেছে তবে সেটা টাইট জিন্স না। কিন্তু আজকে নীলা পরেছে লেগিংসের সাথে একটা শর্ট কামিজ পরেছে। তবে পোশাকটা এমন ভাবে ওর শরীরের সাথে লেপ্টে আছে যে সেটা আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হল না। মানে নীলাকে আমি কখনই এমন পোশাক পরতে দেখি নি।
আরেকটু কাছে আসতেই ওর মুখে মেকাপ দেখতে পেলাম। বেশ ভাল রকমের সাজগোজ করেছে সে। এটাও আমার কাছে একেবারে নতুন মনে হল। নীলা কখনই সাজে না খুব একটা। হালকা প্রসাধনী, সাথে ঠোটে হালকা লিপস্টিক। এটাই তার মেকাপ। তাহলে আজকে এতো সাজলো কেন?
যখন সে আরেকটু কাছে এল তখনই আমার মনে হল যে এই মেয়েটি নীলা নয়। সে নীলার জমজ বোন প্রোমি!
আমার সামনে এসে দাড়াতেই প্রোমি বলল, চল মুভি দেখা যাক।
আমি উঠলাম না। বসেই রইলাম। আমাকে বসে থাকতে দেখে প্রোমি হেসে ফেলল। তারপর বলল, ধরে ফেলেছো, তাই না?
আমি বললাম, নীলা কোথায়?
-ওর একটু শরীর খারাপ। রাত থেকে জ্বর। তাই আমি প্রোক্সি দিতে এলাম।
এই বলে প্রোমি আবার হাসল। তবে আমি হাসলাম না।
প্রোমি বলল, আরে টিকিট তো কাঁটা হয়েছে। আমরা মুভি না দেখলে সেটা নষ্ট হবে। চল দেখে ফেলি!
আমি কিছু বলতেই যাচ্ছিলাম তখনই দেখলাম প্রোমি মেসেজ পাঠিয়েছে। সেখানে লেখা, ‘সরি, আমার শরীরটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল। তোমাকে মানা করতাম তখনই প্রোমি বলল সে যাবে। টিকিট তো কেটেই ফেলেছি তাই মুভিটা দেখ। যদি প্রোমির সাথে না দেখতে চাও ওকে বল তাহলে চলে আসবে। কোন সমস্যা নেই। তবে আমার বোনটার ভাল। ওর পোশাক দেখে ওকে জাজ করো না প্লিজ।’
আমি একবার মেসেজের দিকে আরেকবার প্রোমির দিকে তাকালাম। মেকাপ আর পোশাকের দিকটা বাদ দিয়ে নীলার সাথে প্রোমির সাথে পার্থক্য নেই। আমি বলল, চল মুভি দেখা যাক।
মুভি দেখতে আমার একটু অস্বস্তিই লাগছিল। বিশেষ করে প্রোমি আমার সাথে এমন ভাবে কথা বলছিল যেন আমি তার কতদিনের চেনা! আমি যথাসম্ভব নিজেকে সংযত করেই রাখলাম। মুভি শেষ করে আমি দ্রুত কেটে পড়তে চাইলাম তবে প্রোমি আমাকে ছাড়ল না। রাতের খাবার খেয়ে তারপর বাসায় আসতে হল।
পরের দিন অফিসে গিয়ে নীলার সাথে দেখা হল। সে আমাকে আগের দিনের জন্য সরি বলল। আর ধন্যবাদ দিল আমি প্রোমিকে সহ্য করেছি বলে। আমি উত্তরে একটু হাসলাম কেবল। তারপর বললাম যে প্রোমির সাথে সময় ভাল কেটেছে।
-আচ্ছা আমাকে ভুলে গেলে প্রোমিকে পেয়ে!
-আরে কী যে বল! আমি কথাটা বললাম কারণ প্রোমি আর তুমি বলতে গেলে একই রকম। কেবল পোশাকের কারণে আলাদা মনে হয়। গতদিন যদি সে তোমার মত পোশাক পরে আসতো, আমি তো চিনতেই পারতাম না।
-হয়েছে হয়েছে!
আমি ওকে বিদায় দিয়ে অফিসের দিকে হাটা দিলাম। তবে আমার কেন জানি মনে হল যে প্রোমি আমার জীবন থেকে এতো সহজে চলে যাবে না। এবং কদিন পরে তাই হল। আবারও প্রোমি এসে হাজির হল আমার সামনে, একেবারে আমার বাসার সামনে। তবে এইদিন তার পোশাক একটু ভাল ছিল। কুর্তি আর জিন্স পরেছিল। তবে জিন্সটা বেশ টাইট। এটা না পরলে আমি ওকে নীলা বলেই ধরে নিতাম। আমি যখন ওর সাথে বের হতে চাইলাম না ও তখন অনেকটা রেগে গেল। বলল যে আমাকে সে নীলার সাথে আর মিশতে দিবে না।
পরের দিন অফিসে নীলাকে বললাম ব্যাপারটা। ও আমার কাছে সরি বলল। আর বলল যে ব্যাপারটা সে দেখবে। আমি যেন কিছু মনে না করি। কিন্তু প্রোমি বারবার আসতে লাগল। এখানে সেখানেই আমি প্রোমিকে দেখতে শুরু করলাম। রাত বিরাতে সে আমার বাসায় এসে হাজিত হত। আমি বেশ বিরক্ত হলাম। একদিন সে খুব সাহসী কান্ড করে বসল। আমাকে সে সিড়ির ভেতরে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করল। আমি যখন তাকে হাত দিয়ে সরিয়ে দিতে গেলাম তখন সে জোদ দেখাল। আমার কাছে জিজ্ঞেস করল, নীলার ভেতরে কী আছে যা আমার নেই। একই তো সব!
-এক হলেই তো হয় না? তুমি কিন্তু সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছো? তুমি এখনই এখান থেকে চলে যাবে নয়তো ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিব। দারোয়ানকে বলে দিবো যাতে তুমি আর আমার বাসায় ঢুকতে পারবে না।
তারপর অনেকটা জোর করেই ওকে বের করে দিলাম বাসা থেকে। আমার কাছে পুরো ব্যাপারটা খুব ঝামেলার মনে হল। নীলাকে আমি পছন্দ করি। সেও আমাকে পছন্দ করে কোন সন্দেহ নেই। যদিও আমরা একে অন্যকে ভালোবাসি মুখ ফুটে বলি নি তবে আমাদের দুইজনের আচরণে সেটা পরিস্কার।
প্রোমি যাওয়ার পরে রাতের বেলা নীলার ফোন এসে হাজির হল। রাত তখন একটার মত বাজে। নীলা ফোন করেই আমার সাথে রাগারাগি করল। তারপর জানতে চাইল যে আমি প্রোমির সাথে খারাপ ব্যবহার কেন করেছি। আমি তাকে পুরো ব্যাপারটা বোঝানোর চেষ্টা করলাম তবে সে শুনলোই না। শেষে আমারও মেজাজটা খারাপ হল। ফোন রেখে দিলাম।
তবে পরের সকাল হতেই মেজাজ ঠান্ডা হয়ে এল। আমি ঠিক করলাম যে কলে নয় বরং সকালে নীলাকে সরাসরি ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলব। তবে পরের দিন সকালে নীলা অফিসে এল না। আমি কয়েকবার ফোন করলাম বটে তবে কাজ হল না। ফোনটা বন্ধ। কী হল বুঝতে পারছিলাম না।
ফোন এল দুপুরবেলা। তবে নীলার না, এমন কি প্রোমিরও না। ফোন এল নীলার বাবার। সে আমাকে একটা হাসপাতালে ঠিকানা দিল। জানাল যে কাল রাতে নীলা রাগ করে নিজের হাতের ছুরি চালিয়েছে। অনেকটা রক্ত বের হয়ে গিয়েছে। ভাগ্য ক্রমে তখন নীলার বাবা পানি খেতে উঠেছিলেন। তাই সময় মত হাসপাতালে নিতে পেরেছেন। আমি যদি পারি তাহলে যেন হাসপাতালে ওকে দেখে যাই একটু।
আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। তার মানে আমার সাথে রাগারাগি করেই সে কাজটা করেছে। আমি তখনই হাসপাতালের দিকে রওয়ানা দিলাম। তবে আমার তখনও বড় ধাক্কা খাওয়ার বাকি ছিল।
আমি যখন প্রোমির ব্যাপার বলে আমার দিকটা ব্যাখ্যা করতে চাইলাম তখন নীলার বাবা আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন কিছুটা সময়। তারপর তিনি আমাকে যা বললেন তাতে আমার পায়ের মাটি কেঁপে উঠল। তিনি জানালেন যে নীলার বোন প্রোমি ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার সময়ে আত্মহত্যা করে মারা গেছে।

দুই
হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা নীলার দিকে আমি দেখতে লাগলাম। নীলার বাবা জানালো যে শরীর থেকে রক্ত বের হয়ে গেলেও সময় মত হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে ওকে। এখন নীলা আশংঙ্কা মুক্ত। তবে শরীর খুব দুর্বল তার।
আমার বিস্ময় তখনও কাটছে না। আমি নীলার বাবার কথাটা কেন জানি হজম করতে পারছি না। প্রোমি যদি মারাই গিয়ে থাকে তবে প্রোমি বেশে আমার কাছে যে এসেছিল সে কে?
নীলার বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার মনে সম্ভবত অনেক প্রশ্ন কাজ দেখা দিয়েছে, তাই না?
-এটাই কি স্বাভাবিক না?
-আমি জানি। যখন নীলা তোমার কথা আমাদের জানালো তখন থেকেই আমি জানি যে এমন প্রোমির ব্যাপারটা তোমার সামনে আসবেই।
এই কথা বলে নীলার বাবা বেশ কিছুটা সময় চুপ করে রইলেন। মনে মনে কিছুটা গুছিয়ে নিচ্ছেন সব। তারপর তিনি বলা শুরু করলেন, নীলা আর প্রোমির ভেতরের বন্ডটা খুব বেশি ছিল ছোট বেলা থেকেই। বোনদের ভেতরে যে মিলটা থাকে । আর জমজবোন হওয়ার কারণে এটা ছিল আরও শক্ত। তবে অবাক করার ব্যাপার কি জানো বাবা? ওদের স্বভাব কিন্তু একেবারে আলাদা ছিল। নীলা যেমন শান্ত নম্র প্রোমি ঠিক সেই রকমই চঞ্চল, কিছু উগ্রও বটে। দিন দিন তাদের দুইবোনের আচরনের পার্থক্য বাড়ছিলই। তবে এতে কিন্তু দুই বোনের ভেতরে ভালোবাসার সম্পর্কে কমতি ঘটে নি। নীলাকে নিয়ে আমাদের কোন দিন কোন চিন্তা করতে হয় নি তবে প্রোমিকে নিয়ে আমাদের অভিযোগের শেষ ছিল না। ওর মা প্রোমিকে সব সময় বকাবকি করতো। এতে এক সময়ে প্রোমির মনে হল যে এই পরিবারে নীলা ছাড়া আর কেউ তাকে ভালোবাসে না। তবে ইন্টারে পড়ার সময়ে প্রোমির একটা ভয়ংকর কাজ করেছিল।
আমি বললাম, কী ভয়ংকর কাজ?
আমি দেখলাম নীলার বাবা একটু যেন ইতস্তর করছেন। প্রোমির করা সেই ভয়ংকর কাজটা আসলে কী সেটা তিনি আমাকে বলতে চান না। আমিও আর দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করলাম না। নীলার বাবা আবারো বলতে শুরু করলেন, সেদিন আমিও আমার মেজাজটা হারিয়ে ফেলেছিলা। আমি ওকে একটা চড় বসিয়ে দিয়েছিলাম। আমি আসলে তখন ভাবি নি যে প্রোমি সেই ভয়ংকর কাজটা করে ফেলবে। সকালে যখন উঠি তখন সব শেষ। নীলাই প্রথমে আবিস্কার করেছিল প্রোমির নিথর দেহটা।
-এরপর?
-এরপর আর কি! শোক কাটিয়ে আমরা আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে শুরু করলাম আস্তে আস্তে। নিশ্চয়ই জানো যে মানুষের সব শোকই আস্তে ধীরে সহ্য হয়ে যায়। আমাদের যখন মনে হল যে আবার সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে আসছে তখনই একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম। নীলার ভেতরে পরিবর্তন। একদিন নীলা একদম প্রোমির মত পোশাক পরে বের হল! তুমি নিশ্চয়ই নীলার পোশাক পরাটা দেখেছো। আমরা দুজনে ওর দিকে তাকিয়েই থ। নীলা ঠিক নীলা নয়, প্রোমির মত আচরণ করছে। সত্যি বলতে কিছু সময়ের জন্য আমার নিজেরও ওকে প্রোমিই মনে হয়েছিল। আমি কেন জানি বাঁধা দেই নি। মানা করি নি। একটা সময়ে এসে প্রোমি নিয়মিত আসতে লাগল। কোন কোনো দিন সকালে আবার বিকালে! ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হল। ডাক্তার বল ডুয়োল পার্সোনালিটি ডিসওর্ডার। ও নিজের বোনের মৃত্যকে মেনেই নিতে পারে নি। লম্বা সময়ে চিকিৎসা চলল । এক সময়ে আমরাও মেনে নিলাম। প্রোমি আমাদের মাঝেই রয়ে গেল।
-তারপর থেকে এভাবেই আছে?
-হ্যা। ওদের দুইজনের জন্য আলাদা ঘর আছে। প্রথম প্রথম ঘন ঘন এলেও এক সময়ে এটা কমে যায়। মাসে এক দুইবার আসতে থাকে প্রোমি। চিকিৎসা চলছে। প্রোমি যাতে কম কম আসে সেটার জন্য থেরাপিও চলে। তবে তোমার সাথে দেখা হওয়ার পরে প্রোমির আসা আবারও বেড়েছে। সম্ভবত নীলার থেকে প্রোমি তোমাকে বেশি পছন্দ করেছে।
আমার মনে তখন একটা প্রশ্ন উদয় হল। আমি বললাম, আচ্ছা নীলা যে এখানে এসেছে, সে কি নীলা হিসাবে নাকি প্রোমি হিসাবে? মানে নিজের হাট কাটার সময়ে সে কে ছিল?
-প্রোমি ছিল। আমি রাতে পানি খেয়ে উঠে দেখি প্রোমির ঘরে আলো জ্বলছে। মূলত এটা দেখেই আমার সন্দেহ হয়। ওদের দুজনের জন্য আলাদা দুইটা ঘর। তবে রাতের বেলা প্রোমি আসে না বললেই চলে। প্রোমির ঘরটা রাতে বন্ধই থাকে। কিন্তু গতকাল আমি দেখলাম রাতে ঐ ঘরটাতে আলো জ্বলছে। সেটা দেখেই সন্দেহ হল। ঘরে যখন ঢুকলাম তখন দেখি এই অবস্থা!
আমার বুঝতে মোটেই কষ্ট হল না যে আমার কাছ থেকে ঐ রকম আচরণ পেয়েই প্রোমির সত্ত্বা এই কাজটা করেছে। নিজেকে কেন জানি অপরাধী মনে হল।
নীলার জ্ঞান ফিরল বিকেল বেলা। নিজেকে হাসপাতালে দেখে ও কিছুটা বিভ্রান্ত হল। সম্ভবত মনে করে পারছে না যে কেন এখানে সে এসেছে। ওর বাবা ওকে বললে অফিসে যাওয়ার সময়ে সে এক্সিডেন্ট করেছে। নীলা মনে করার চেষ্টা করল বটে তবে মনে করতে পারল না। আমি বললাম, এখন এসব থাকুক। ওসব ভাবতে হবে না। তুমি এখন বিদপ মুক্ত এটাই বড় কথা।

পরিশিষ্ট
নীলার সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরতে আরও দুইদিন লাগল। আমি এই দুইদিন ছুটি নিয়ে ওর হাসপাতালেই ছিলাম। আমার পাশে থাকাটা নীলার ভাল লাগছিল। আমার নিজেরও ভাল লাগছিল।
হাসপাতাল থেকে ফেরার পর আমাদের সম্পর্ক আরও গভীর হয়ে উঠল। আমরা আরও ঘনঘন মেলা মেশা করতে থাকলাম। মাস ছয়েক পার হয়ে গেল দেখতে দেখতে। এরপরে প্রোমির সত্ত্বা একবারও দেখা দেয় নি। নীলার বাবার সাথেও আমি নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি। সে জানালো যে হাসপাতাল থেকে ফেরার পর নীলার ভেতরে প্রোমি আর ফিরে আসে নি। সে ডাক্তারের সাথে কথা বলেছে। ডাক্তার ব্যাখ্যায় বলেছে যে সম্ভবত প্রোমির সত্ত্বার শেষ স্মৃতি ছিল সে সুইসাইড করছে। এই কারণেই সম্ভবত আর সে ফিরে আসে নি। সে ধরেই নিয়েছে সে মারা গেছে যা নীলার অবচেতন মনে বসে গেছে। সে মারা গেছে। এইজন্যই সে আর ফিরে আসে নি।

ফেসবুকের অর্গানিক রিচ কমে যাওয়ার কারনে অনেক পোস্ট সবার হোম পেইজে যাচ্ছে না। সরাসরি গল্পের লিংক পেতে আমার হোয়াটসএপ বা টেলিগ্রামে যুক্ত হতে পারেন। এছাড়া যাদের এসব নেই তারা ফেসবুক ব্রডকাস্ট চ্যানেলেও জয়েন হতে পারেন।

অপু তানভীরের নতুন অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে

বইটি সংগ্রহ করতে পারেন ওয়েবসাইট বা ফেসবুকে থেকে।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.5 / 5. Vote count: 20

No votes so far! Be the first to rate this post.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →

2 Comments on “কে তুমি!”

  1. নীলা ও প্রোমির চরিত্রের মাধ্যমে মানসিক জটিলতা এবং ভালোবাসার দ্বন্দ্ব খুব সূক্ষ্মভাবে ফুটে উঠেছে। আপনার লেখাগুলোতে নতুন কিছু পরিবর্তন বুঝতে পারছি। নতুন গল্পগুলো একটু অন্য ধাঁচের, ঠিক আগের মত না। তবে এই পরিবর্তনটাও ভালো লাগছে।

    নতুন গল্পের অপেক্ষায় রইলাম।

    1. বুড়ো হচ্ছি চিন্তা ভাবনা আগের মত আর থাকবে না। কিছু পরিবর্তন আসা স্বাভাবিক। পরিবর্তন ভালর দিকে যাচ্ছে দেখে ভাল লাগল।
      দেখা যাক সামনে কী লেখা যায়!একটা জাপানিজ আর্বান লেজেন্ড নিয়ে একটা গল্প লেখার ইচ্ছে আছে।

Comments are closed.