নারী – দি বস

4.9
(65)

-নিকিতা ম্যাডাম আপনাকে ডেকেছে !


আমি চোখ তুলে পিয়নের দিকে তাকালাম । মনে হল যেন পিয়নের মুখটা একটু হাসি হাসি । নিকিতা ম্যাডামের ঘরে ডাক পড়েছে তার মানে আমাকে ছেঁচা দেওয়া হবে । আর কাউকে ছেঁচা দেওয়া হব এই জন্য এই বদ বেটার মুখ হাসি হাসি ! কেবল এই পিয়নই না, অফিসের অনেকের মুখই হাসি হাসি হয়ে যাবে এখন । সবাই কান পেতে রইবে ম্যাডামের রুমের দিকে যদিও কিছুই শোনা যাবে না । কারণ ম্যাডামের রুম সাউন্ডপ্রুফ ! তবে যখন কেউ ম্যাডামের রুম থেকে বের হয় তখন সবাই সেদিকে গভীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে। কেউ কেউ নাকি আবার ছবিও তুলে ! সব বদমাইশের দল !
আজকে আমার পালা । আমি মনে করার চেষ্টা করলাম কি এমন ভুল করেছি ! কিন্তু মনে করতে পারলাম না । এমন কি আমার অফিসে আসতে দেরিও হয় নি । তাহলে আমাকে এভাবে ডাক দেওয়া মানে কি ! আমি ঠিক ভেবে পেলাম না । তবুও মনে মনে কারণটা খুজতে খুজতে নিকিতা ম্যাডামের কেবিনের দিকে হাটা দিলাম
আমাদের অফিসের প্রধান একজন মেয়ে । নিকিতা চৌধুরী ! প্রায়ত আলী আজগর চৌধুরীর এক মাত্র মেয়ে । স্যার, অর্থ্যাৎ আলী আজগর চৌধুরী যখন বেঁচে ছিলেন তখনও অবস্থা এমন খারাপ ছিল না । যদিও তখন থেকে নিকিতা ম্যাডাম অফিসে নিয়মিত আসা যাওয়া শুরু করেছে কিন্তু মাথার উপর স্যার ছিলেন বলে আমরা খুব একটা চিন্তা করি নি । কিন্তু তিন মাস আগে স্যার মারা যাওয়ার পরে সব কিছু বদলে গেল । আমরা সবাই ভেবেছিলাম চৌধুরী স্যারের যাওয়ার পরে তার মেয়ে হয়তো এসব কিছু সামলাতে পারবে না । কিন্তু আমরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম যে নিকিতা তার বাবার থেকেও ভাল আর শক্ত হাতে অফিস সামলাচ্ছে । আর সেই সাথে আমাদের সবাই উপর বিশেষ করে পুরুষ কর্মীদের উপর একটা আলাদা ঝড় নেমে এসেছে ।
মেয়ে কর্মীদের অনেক ভুল ম্যাডাম দেখেও না দেখার ভান করেন কিন্তু কোন পুরুষ কর্মী যদি পান থেকে চুন ঘষে এবং সেটা যদি ম্যাডামের চোখ পড়ে তাহলেই তার খবর আছে । অনেকে চাকরি ছাড়ার কথা ভেবেছে কিন্তু ছেড়ে যায় নি । কারণ আচরন যেমনই হোক এই অফিসের স্যালারীর পরিমানটা অন্য যে কোন অফিস থেকে অনেক অনেক ভাল !
আমি ম্যাডামের রুমের দরজায় নক করলাম ।

-আসুন !

আমি ভয়ে ভয়ে রুমের ভেতরে ঢুকলাম । ঢুকেই যেন একটু চমকালাম । নিকিতা চৌধুরী বয়সে আমার সমানই হবে । কিংবা আমার আমার থেকেও একটু ছোট হবে । আমার খুব একটা দেখা হয় না তার সাথে । কিন্তু আজকে মেয়েটাকে যেন এতো বেশি সুন্দর লাগছে তবে চেহারাতে একটা কাঠিন্য ঠিকই ধরে রেখেছে । আমি সামনে গিয়ে দাড়াতে নিকিতা বলল-বসুন সাব্বির সাহেব !
আমি চুপচাপ বসে পড়লাম । একটু যেন চিন্তা লাগছে না সেটা না । তবে আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে আমার তেমন কোন ভুল নেই । আমার কাজ কর্মে আমি বেশ ভাল এবং দক্ষ !
নিকিতা বলল, আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে ?
আমি খানিকটা বিব্রত বোধ করলাম । অন্তত নিকিতার কাছ থেকে এই ধরনের প্রশ্ন আমি আশা করি নি । মোটেই না । আমি কোন মতে বললাম, জি ম্যাডাম ?

-গার্লফ্রেন্ড ?

কোন মতে বললাম, ছিল ।

-ছিল ? মানে এখন নেই ?

-জি, বিয়ে হয়ে গেছে ।

-নতুন কেউ ?

-জি না !

-বিয়ে করছেন না কেন ?

আমি আসলে কিছুই বুঝতে পারছি না । নিকিতা হঠাৎ এমন প্রশ্ন করা শুরু করলো কেন ? আমি বললাম, আসলে মা মেয়ে দেখছে …..

-ও !
নিকিতা কি যেন ভাবতে লাগলো । আমার নিজের কাছে কেমন যেন একটা অদ্ভুত অনুভুতি হতে লাগলো । আমি ঠিক বুঝতে পারবো না । এমন অদ্ভুত প্রশ্ন আমাকে করার মানে কি ? এমন কান্ড তো এর আগে কোন দিন হয় নি । নিকিতা ভাবা বন্ধ করে আমার দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলল, আমি ঠিক করেছি আপনাকে বিয়ে করবো । সামনের সপ্তাহেই আমাদের বিয়ে হবে !
আমার বুকের ভেতরে বাতাস আটকে গেল । ঠিক মত নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেলাম আমি । কি বলে এই মেয়ে ! মাথা ঠিক আছে তো ! আর এমন ভাবে বলছে যেন সে আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছে না বরং আমাকে কোন কাজের এসাইনমেন্ট দিচ্ছে ! আমি আপনাকে বিয়ে করবো ! বাহ !

একবার মনে হল বলি যে আমি আপনাকে বিয়ে করবো না । অফিসে এমনিতেই আপনার জন্য দৌড়ের উপর থাকি । বাসাতেও আপনার খবরদারি আমি কেমনে সহ্য করবো !কিন্তু কেন জানি বলতে পারলাম না । তবে আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে আমাদের বিয়ে হবে না । দরকার হলে আমি চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে যাবো ! নিকিতা বলল, আপনার মায়ের নাম্বার টা আমাকে দিন ! আমি উনার সাথে সরাসরি কথা বলবো !

এবার আমি একটু ভয় পেলাম । কারণ নিকিতা যদি মাকে বুঝিয়ে ফেলে তাহলে আমি একটু ঝামেলাতে পড়ে যাবো ! আমি কোন কথা না বলে মায়ের মোবাইল নাম্বারটা লিখে দিলাম ।
যখন বাইরে বের হয়ে এলাম তখন আমি বেশ ঘেমে গেছি । সবার যদিও কাজের ভান করে আছে তবে সবাই আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আছে । সবাই আমার চেহারার দিকে তাকিয়ে ভেবে নিয়েছে যে নিকিতা নিশ্চয়ই আমাকে খুব ঝাড়ি দিয়েছে । কিন্তু আসল খবর টা যদি তারা জানতো তাহলে তাদের মুখের ভাবটা কেমন হত আমি অনুমান করতে পারলাম না ।

তারপর সব কিছু কেমন জলদি জলদি ঘটতে লাগলো । পরের দিন মা গ্রাম থেকে ঢাকায় চলে এল আমার বাসায় । এবং ঠিক তার এক সপ্তাহ পরে নিকিতার সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেল । অনেকটা গোপনেই । আমার পরিচিত কয়েকজন আর নিকিতার বাসায় কয়েকজন মানুষ । ব্যাস আর কেউ না । মা আর নিকিতার মাকে দেখলাম বিয়ের দিন থেকেই খুব খোশ গল্প শুরু দিয়েছে । যেন কত দিনের পরিচিত বান্ধবী তারা !
আমি তখনও কিছু বুঝতে পারছিলাম না । কেমন করে হচ্ছে কি হচ্ছে আর কেনই বা হচ্ছে ! আমি এতো দিন ধরে ভাবতাম নিকিতা হয়তো কোন দিন বিয়েই করবে না । কোন একটা বিশেষ কারনে মেয়েটা হয়তো পুরুষদের কে ঘৃণা করে । তাই বিয়ে করবে না । অবশ্য তার বিয়ে করার দরকারও ছিল না । এতো বড় কোম্পানীর মালিক সে । কিন্তু এভাবে হঠাৎ করে আমাকে বিয়ে করতে চাইলো । এবং সেটা হয়েও গেল ।

তবে বিয়ের পর খুব একটা পরিবর্তন হল না । বিয়ের দিন নিকিতা ওর বাসাতেই রয়ে গেল । বলল যে এখনও যেহেতু অনুষ্ঠান হয় নি তাই এসবের দরকার নেই । যখন অনুষ্ঠান হবে তখন সব বিয়ের আচার অনুষ্ঠান হবে । আমাদের আর কিছু বলার ছিল না । যদি আমার মা আর নিকিতার মা একটু আপত্তি করছিলো তবে নিকিতার সামনে সেটা টিকলো না ।
বিয়ের দুদিন পরে আমি যখন অফিসে গিয়ে হাজির হলাম । ততক্ষনে সবাই জেনে গেছে যে আমার সাথে নিকিতার বিয়ে হয়ে গেছে । সবাই আমার দিকে কেমন অন্য চোখে তাকাতে লাগলো । নিকিতা আমার জন্য অন্য একটা কেবিন ঠিক করে রেখেছিলো। কোম্পানীতে একবারে এক লাফে আমি এএমডির পদে চলে গেলাম ! নিকিতার নিচে পোস্ট ! আমার কেন জানি ব্যাপারটা ভাল লাগলো না । আমি সেটা গ্রাহ্য না করে নিজের আগের পোস্টেই কাজ করতে লাগলাম ! দুপুরের দিকে নিকিতা নিজেই আমার ডেস্কের সামনে এসে হাজির !

-কি ব্যাপার তোমাকে ঐ ক্যাবিনে বসতে বলা হয়েছে !

-কেন ?

নিকিতা খানিকটা অবাক হয়ে তাকালো আমার দিকে । তার কথার উপর কেন বলার সাহস এই অফিসে আজও কারো হয় নি । অবশ্য আজকে আমার অবস্থান আগের মত নেই । নিকিতা কোন কথা না বলে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো । আমি বললাম, আমি যেখানে কাজ করছি সেখানেই ঠিক আছি । তোমার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে এটা নিশ্চয়ই এমন কোন যোগ্যতা নয় যে আমাকে একেবারে ঐ পদে নিয়ে যেতে হবে । আমাদের বিবাহিত জীবন যদিও সেটা থেকে থাকে তাহলে সেটা অফিসের বাইরে । ভেতরে না !
নিকিতা আমার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময় । তারপর নিজের ক্যাবিনের দিকে চলে গেল । আমি আসলে তখনও ঠিক বুঝতে পারছিলাম না নিকিতা আমাকে কেন নিয়ে করলো । কারনটা জানতে পারলাম আরও এক মাস পরে । নিকিতার বাবা অর্থ্যাৎ আমার প্রায়ত বস এবং শশুর মশাই মেয়ের এই পুরুষ বিদ্বেষী ভাবটার কথা জানতেন । তিনি এও জানতেন যে জীবদ্দশাতে যদি তিনি মেয়েকে বিয়ে দিতে না পারেন তার মারা যাওয়ার পরে নিকিতা কোন দিন বিয়ে করবে না । কোন বাপের জন্যই এটা কোন ভাল সংবাদ হতে পারে না । তাই তিনি একটা চমৎকার উইল করে রেখে গেলেন । সেটা বলা ছিল যে তার মারা যাওয়ার ১০০ দিনের মাথায় নিকিতাকে বিয়ে করতে হবে । নয়তো তার সমস্ত সম্পত্তির মালিকানা একটা ট্রাস্টের আন্ডারে চলে যাবে । সেখানে থেকে ওদের পরিবারের জন্য একটা টাকা বরাদ্ধ ঠিকই দেওয়া হবে তবে নিয়ন্ত্রন থাকবে সেই ট্রাস্টের হাতে ! যা নিকিতা মানতে পারে নি । তাই সে আমাকে বিয়ে করেছে ।
ব্যাপারটা জানার পর থেকে কেন জানি খুব মন খারাপ হয়ে গেল । কোন কারন নেই, তবুও মন খারাপ হল । এমন কিছুই হওয়াই স্বাভাবিক ছিল । নয়তো আমাকে বিয়ে করার কোন করণই ছিল না তার । কোন ভাবেই না ।
সব কিছু আবার আগের মতই চলতে লাগলো । নিকিতা যে আমার স্ত্রী এটা আমি ভুলেই গেলাম । আগের মত কাজ অফিস যেতাম অফিস থেকে আসতাম । মাঝে মাঝে শ্বশুর বাড়ি ডাক পড়তো । নিকিতার মা কেন জানি আমাকে বেশ পছন্দ করতেন । মাঝে মাঝে আমাকে ডেকে ভাল মন্দ খাওয়াতেন । বলতেন আমি যেন ওখানে শিফট হয়ে যাই । আমি মানা করতাম । বলতাম যে আমার ঘর জামাই হওয়ার কোন ইচ্ছে নেই । আমার শ্বশুর মশাইয়ের উইলে আরও লিখে গিয়েছিলেন যে বিয়ে অন্তত ৫ বছর টিকতে হবে । নয়তো সম্পত্তির অর্ধেক আমি পেয়ে যাবো । অবশ্য ৫ বছর পরে বিচ্ছেদ হলে কোন সমস্যা নেই । আমি জানতাম যে ঠিক ৫ বছর পরে নিকিতা আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে । আমরা আলাদা হয়ে যাবো !
আমি মাকে এসবের কিছুই বলি নি কোন দিন । বলার কিছু ছিল না । আর আমার কিছুই করারও ছিল না । আমি চাইলেও নিকিতার জীবনের প্রবেশ করতে পারবো না । আর নিকিতার কাছে আমি তার অফিসের কর্মী আর তার সম্পত্তি বাঁচানোর একটা হাতিয়ার ছাড়া আর কিছুই ছিলাম না । বিয়ের ছয়টা মাস এমন করেই চলে গেল ।
একদিন অফিস শেষ করে আমি পার্কের বসে আছি । নিজের জীবন নিয়ে ভাবছি । তখনই আমার একটা কিছু মনে পড়লো । আমার পুরো শরীরে যেন একটা ধাক্কার মত খেল । তখন কেবলই মনে হল যে আবারও পরিবর্তন হতে চলেছে !

দুই
-এই ড্রাইভার গাড়ি থামাও !

নিকিতা নিজের ল্যাপটপে কাজ করছিলো আমার কথা শুনে আমার দিকে চোখ তুলে তাকালো । চোখে একটা সুক্ষ বিরক্তি ! তবে সেটা বিস্ময়ে রূপান্তরিত হল যখন আমি হাত দিয়ে ওর ল্যাপটপটা বন্ধ করে দিলাম ।

-কি করছো তুমি ?

আমি হাত দিয়ে বাইরের দিকে দেখালাম ।

-বাইরের রেস্টুরেস্ট টা বেশ চমৎকার ! আসো তোমাকে ট্রিট দেই ।

-আবীদ ! আমি বাসায় যাবো !

-আহ ! চল না কেন ! আর আমার কিছু বলার ছিল তোমাকে ! শুনলে তোমার ভাল লাগবে ! চল !

অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও নিকিতা রেস্টুরেন্টে গিয়ে হাজির হল । খেতে লাগলাম আমরা চুপচাপ । নিকিতা মাঝে বলল, তোমার কি কথা ?

-খাও । বলছি ।
নিকিতা খাওয়া শেষ করে অপেক্ষা করতে লাগলো । আমি ওকে ওর বাবার উইলের একটা কপি ওর দিকে বাড়িয়ে দিলাম । গতকালকে আমি ওদের পারিবারিক উকিলের কাছ থেকে এটা জোগার করেছি । নিকিতা খানিকটা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো । তারপর বলল, এসবের মানে কি ?

-মানে তো জানো । তুমি আমার সাথে ঠিক বিয়ে কর নি । একটা বিজনেস ডিল করেছো নিজের সুবিধার জন্য । কিন্তু এটা করতে গিয়ে একটা বিরাট বড় ভুল করে ফেলেছো ।

-কি ?

-তুমি হয়তো ভাল লক্ষ্য করো নাই । তোমার আর আমার সংসারটা ৫ বছর টিকতে হবে এমন কথা লেখা আছে । যদি না টেকে তাহলে আমি তোমাদের ব্যবসার অর্ধেক মালিক হয়ে যাবো । তুমি তো এমনিতেই আমাকে ৫ বছরের মাথায় ডিভোর্স দিয়ে দিবে আমি জানি । তাহলে আমার জীবন যে এমন হল এটাতে আমি কি পেলাম !
নিকিতা সরু চোখে আমার দিকে তাকালো ! আমি বললাম, আমি জানি তুমি আমাকে কেন চুজ করেছো । আমাকে তুমি বেশ ভাল করে লক্ষ্য করেছো প্রস্তাব দেওয়ার আগে তাই না ? দেখেছো এতো সহজ সরল একটা ছেলে, যেমন ইচ্ছে তেমন নাচানো যাবো কিছু বলতে পারবে না !নিকিতা চুপ করে রইলো ! আমি বললাম,কিন্তু চুপ থাকার দিন শেষ !
নিকিতা এবার বলল, কি চাও তুমি ? কত টাকা চাও !

আমি খানিকটা হেসে বললাম, চাইবো কেন ? তোমাকে ডিভোর্স দিলেই আমি অর্ধেক পেয়ে যাচ্ছি !
আমি বুঝতে পারছিলাম নিকিতা রেগে যাচ্ছে । আমি বিন্দু মাত্র বিচলিত না হয়ে বললাম, তোমার সামনে দুটো পথ খোলা আছে ! এক. অর্ধেকটা তুমি আমাকে লিখে দাও ! ঝামেলা শেষ হয়ে যাক ! আর দুই, আজ থেকে আমার বউ হওয়ার চেষ্টা কর ! বাঙ্গালী নারীরা যেমন বউ হয়ে ঠিক তেমন ! চয়েজ তোমার !

তারপর থেকেই সব কিছু বদলে যেতে শুরু করলো । নিকিতা আক্ষরিক অর্থেই আমার বাসায় এসে থাকা শুরু করলো । অফিসে সে সবই থাকলো তবে বাসায় এসে সে আমার স্ত্রীর ভুমিকা পালন করতে শুরু করলো । প্রথম প্রথম বেশ অবাক হত যখন আমি ওকে নিয়ে এদিক ওদিক যেতাম কিংবা ওকে আমার জন্য পানি আনতে বলতাম কিংবা টেবিলে খাবার দিতে বলতাম ! কিন্তু একটা সময় আমি লক্ষ্য করলাম যে কাজ গুলো যে করছে । আসলেই করছে । দেখতে দেখতে তিন মাস আমাদের সংসার কেটে গেল । নিকিতা সাথে অফিসের পর যখন ঘুরতে বের হতাম অফিসের সবাই কেমন চোখে আমাদের দিকে তাকাতো । তারাও ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলো না নিকিতা এমন কিছু করতে পারে । এক শুক্রবারে আমি নিকিতার সাথে লেক পাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি । তখনই আমাদের অফিসের এক কর্মচারি আমাদের দেখে ফেলল । এমন অবাক সে হয়েছিলো সেটা ওর মুখ দেখেই বুঝতে পারছিলাম !
এতো কিছু হওয়ার পরেও আমি ওর ঠিক কাছে যেতে পারি নি । আমার সাথে স্বাভাবিক আচরন করলেও আমরা তখনও আলাদা ঘুমাতাম । একদিন আবারও মনটা বিদ্রোহ ঘোষনা করলো আমি ওর রুমে ঢুকে পড়লাম রাতে । ওর ঠোঁটে চুমু খাওয়ার জন্য আমার যেন তর আর সইছিলো না । তারপর হঠাৎ করেই আমি জীবনে প্রথমবারের মত আমি নিকিতার চেহারাতে একটা তীব্র আকঙ্ক দেখতে পেলাম । রাতে বেলা ওভাবে ওর ঘরে ঢুকে পড়ার ফলে ও ওভাবে ভয়ে পেয়ে যাবে আমি ভাবতেও পারি নি । নিকিতা শান্ত হয়ে তখনই গাড়ি নিয়ে ওদের বাসাতে চলে গেল ! আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না ।
কিন্তু আমার অবাক হওয়ার তখনও বাকি ছিল না । পরদিন বিকাল বেলা নিকিতা উকিলের মাধ্যমে আমাকে জানালো যে সে আর আমার সাথে আর থাকতে চায় না । এবং এই জন্য সে তার বাবার উইল অনুযায়ী ব্যবসায়ের অর্ধেক মালিকানা আমার নামে হস্তান্তর করতেও প্রস্তুত ! এতো কিছু হল কেবল আমি নিকিতাকে চুমু খেতে চেয়েছিলাম বলে !
আমার কেন জানি মনে হল এর ভেতরে অন্য কিছু আছে । অন্য কোন কাহিনী আছে । থাকতে বাধ্য ! কিন্তু কার কাছ থেকে জানতে পারবো আমি । আমি আমার শ্বাশুড়ির কাছে জানতে চাইলাম । প্রথমে সে মানা করলো বলল যে সে কিছু জানে না । তবে আমার চাপের কারনে সে স্বীকার করে নিল যে সে জানে । এটা নিকিতার বাবাও জানতো না । নিকিতা কেবল তার মাকে বলেছিলো ।
নিকিতা যখন ক্লাস এইটে পড়তো তখন নিকিতার একটা ছেলের সাথে খুব ভাব হয়ে যায় । তখন ওরা এতো বড়লোকও ছিল না । ওর বাবা সবে মাত্র ব্যাবসা শুরু করেছে । সারাদিন সেখানে ব্যস্ত । নিকিতা সেই ছেলের সাথে মাঝে মাঝে ঘুড়ে বেড়াতো । কিন্তু একদিন ছেলেটা অন্য রকম কিছু করে ফেলে । আসলে ছেলেটার মনেই অন্য রকম কিছু একটা ছিল । ওরা কয়েকজন বন্ধু মিলে নিকিতাকে ফুসলিয়ে একটা নির্জন জায়গাতে নিয়ে যায় ! সেদিন ….
আমি কিছু শুনতে চাইলাম না । নিকিতার মাকে থামিয়ে দিলাম ! এর পরে কি হয়েছে আর নিকিতাও কেমন এমন সেটাও আমি বুঝতে পারলাম । নিজের কাছে খানিকটা খারাপ লাগলো । ও তখন বাসাতেই ছিল । ওর রুমে যখন ঢুকলাম দেখি রকিং চেয়ারে বসে আছে চোখ বন্ধ করে । আমার শব্দ পেয়ে চোখ মেলে তাকালো !
আমি খাটের উপর বসতে বসতে বললাম, আসলে আমি তোমাকে সরি বলতে এসেছি কালকের ঘটনার জন্য । ওভাবে আমার তোমাকে চুমু খেতে চাওয়াটা ঠিক হয় নি । আসলে আমি জানতামও না কেন তুমি এমন আচরন কর ! কিন্তু জানার পর থেকে ……
নিকিতা আমার দিকে তাকিয়ে রইলো এক ভাবে ! ওর চোখে তীব্রতা আমি বুঝতে পারছিলাম । আমি আবারও বলল, তুমি পুরুষদের ঘৃণা কর সেটা তোমার জন্য জায়েজ ! আমি জানি ! আমি তোমার জায়গাতে থাকলে হয়তো এমনই কিছু করতাম ! আমি কেবল তোমার সাথে একটা স্বাভাবিক জীবন চেয়েছিলাম যেখানে ঘুম থেকে উঠেই আমি আমার প্রিয় মানুষটার মুখ দেখতে পাবো ! মান অভিমান ঝগড়া খুনশুটি সব থাকে যে সংসারে আর কিছু না !
কিছুটা সময় আমি চুপ করেই রইলাম ! তারপর বললাম, তোমার পাঠানো নোটিশে আমি সাইন করে দিবো । তবে তোমার বাবার উইল অনুযায়ী আমার অর্ধেকটা চাই না । আমি কেবল তোমাকে চেয়েছিলাম আমার জীবনে আর কিছু না !
তারপর আর কি বলবো আমি খুজে পেলাম না । কিছুটা সময় কেটে গেল কোন কথা না বলেই । আমার একটা সময় মনে হল যে আমার চলে যাওয়া উচিৎ । উঠে গিয়ে নিকিতার একদম কাছে বসলাম হাটু গেড়ে ! তারপর ওর হাত টা ধরে বললাম, আই উইস, আমি তোমাকে বোঝাতে পারতাম যে সবাই এক রকম না ! তারপর ঘর থেকে বের হয়ে এলাম !

তিন
নিকিতার কোম্পানী থেকে রিজাইন দিয়ে চলে এলাম । নতুন চাকরি খোজা বাদ দিয়ে কিছু দিন শুয়ে বসে কাটাতে লাগলাম । তবে নিকিতার কথা মনে পড়তে লাগলো । বিশেষ করে মাঝের কয়েকটা দিন খুব বেশি করে মনে পড়তে লাগলো । একদিন লুকিয়ে অফিসের মানে চলে গেলাম ওকে দেখার জন্য । নিজের পাগলামী দেখে নিজেরই হাসি আসলো । প্রথমদিন দেখা পেলাম না । ওর গাড়ির কাঁচ নামানো ছিল না । পরের দিন আবার গেলাম । তবে এক ঝলকের জন্য হলেও দেখতে পেলাম ওকে । পরের দিন কাঁচ নামানো ছিল । নিকিতা কেমন উদাস হয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল যখন গেট দিয়ে গাড়িটা ঢুকছিলো । এভাবে প্রায়ই দিনই আমি যেতাম ওকে দেখার জন্য । তারপর অন্য কাজে !
নিজেকে বোঝানোর জন্য চেষ্টা করতে লাগলাম যে এসব বাদ দিতে হবে । মেয়েটা এক সময় আমার বউ ছিল তবে এখন সে আমার কেউ হয় না । আমি কাগজে সই করে দিয়েছি । এতো দিনে সম্ভবত ডিভোর্স কার্যকরও হয়ে গেছে । নোটিশও চলে আসবে ! আমার আবার নতুন চাকরিও শুরু করতে হবে । নয়তো খাবো কি !
কিন্তু আমার আর চাকরি করা হল না । পরের দিন আগের অফিসের পিয়ন এসে হাজির । হাতে একটা সবুজ খাম ! আমার দিকে তাকিয়ে দিয়ে দাঁত বের করে হাসলো ! আমি বললাম, কে পাঠিয়েছে এটা ?

-ম্যাডাম পাঠাইছে !
ওর সামনেই খাম খুললাম । খাম খুলেই অবাক হলাম বেশ । সেখানে কেবল একটা মাত্র লাইন লেখা !

“কি ব্যাপার তোমার কি শরীর খারাপ ? কদিন থেকে গেট কাছে আর দাড়িয়ে থাকো না?”

আমি কিছুটা সময় অবাক হয়ে লাইনটার দিকে তাকিয়ে রইলাম । নিকিতা কিভাবে জানলো আমি ওকে দেখার জন্য দাড়িয়ে থাকতাম ! আর আমার শরীর খারাপ এটা জানানোর জন্য চিঠি লেখার দরকার ছিল কি ? আমাকে ফোন করলেই তো পারতো ? আমি মোবাইল বের করে তখনই নিকিতাকে ফোন দিলাম । এবং সাথে সাথেই কোথাও রিং বাজার ওয়াজ পেলাম । আওয়াজটা যে আমার ঘরের বাইরে থেকে আসছে সেটা বুঝতে খুব বেশি সময় লাগলো না । পিয়ন কেন হাসছিলো সেটা এখন বুঝতে পারলাম । তার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার ম্যাডামকে ডেকে নিয়ে আসো

এই কথার জন্যই বোধহয় পিয়ন অপেক্ষা করছিলো । দৌড়ে চলে গেল । তার কিছু সময় পরেই নিকিতা ঘরের ভেতরে ঢুকলো । মুখে সেই কাঠিন্য লেগেই আছে এখনও ! আমি বলল, বাইরে দাড়িয়ে দিলে কেন ? আর ফোন দিলেই জানা যেত যে আমার শরীর খারাপ কি না ! তার উপর আমি দাড়িয়ে থাকতাম সেটা তোমাকে কে বলল ?

নিকিতা স্বাভাবিক স্বরে বলল, থাকতে কি না বল ?

-আগে বল কিভাবে জানলে ?

-জেনেছি । ইচ্ছে থাকলেই জানা যায় !

-কেন ? কেন ইচ্ছে হল ?

-যে কারনে তুমি দাড়িয়ে থাকতে !
আমি কোন কথা বলতে পারলাম না । নিকিতা বলল, আমি জানি না কেন ? কিন্তু এই কদিন আমি তোমাকে মিস করেছি । ঐদিনের ঐ কথা গুলো কেন জানি আমার জন্য অনেক দরকার ছিল। আমি বিশ্বাস করি, বিশ্বাস করতে চাই যে সবাই এক না !
আমি নিকিতার কন্ঠে আকুলতা অনুভব করতে পারছিলাম । সেই সাথে ওর চোখ বলছে যেন ও আসলেই কথাটা বিশ্বাস করতে চায় । আমি উঠে গিয়ে ওর হাত ধরলাম । জড়িয়ে ধরার সাহস পেলাম না পাছে আবারও ও ঐদিনের মত ভয় পায় । তবে আমাকে ভুল প্রমানিত করে দিয়ে নিকিতা আমাকে জড়িয়ে ধরলো । তারপর বলল, একটু সময় লাগবে কিন্তু আমি পারবো ….

আমারও কেন জানি মনে হল নিকিতা পারবে । ও পারবে ওর এই ভয় কাটাতে । আমাকে জড়িয়ে ধরা অবস্থায়ই বলল, তবে আমার আরেকটা শর্ত আছে ?

-কি শর্ত ?

-অফিসের মত বাসাতেও কিন্তু আমি বস হব ! মনে থাকে যেন !
আমি কিছু বলতে গিয়েও বললাম না । হেসে ফেললাম । সে তো অনেক আগে থেকেই বস হয়ে আছে !

নিজের লেখা গল্পের ভেতরে এই গল্পটা আমার বেশ পছন্দের । ২০১৭ সালের নারী দিবসে এই গল্প লিখেছিলাম । কয়েক বছর হয়ে গেল । অথচ মনে হয় সেদিনই না লিখলাম!

গল্পের লিংক সরাসরি পেতে হোয়াটসএপ চ্যানেল, গ্রুপ বা টেলিগ্রাম চ্যানেলে জয়েন করতে পারেন।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 4.9 / 5. Vote count: 65

No votes so far! Be the first to rate this post.


Discover more from অপু তানভীর

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

About অপু তানভীর

আমি অতি ভাল একজন ছেলে।

View all posts by অপু তানভীর →