ফারাজ করিম লোকটাকে মাঝবয়সী বলা যাবে না। অন্তত দেখতে তাকে মোটেই বুড়ো মনে হয় না। মুখে চাপদাড়িটা বেশ চমৎকার, নায়কদের মত। এটা তার বয়সকে বাড়ায় নি, বরং একটু যেন কমিয়ে দিয়েছে। সে আমার দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে। তবে সেই দৃষ্টিতে একটা ভয়ংকর একটা ব্যাপার আছে। সে আমাকে ঠিক পছন্দ করছে না।
-আপনাকে এখানে কেন ডেকে এনেছি সেটা কি আপনি জানেন?
আমি মনে মনে বললাম যে আপনি আমাকে ঠিক ডেকে আনেন নি, আপনি আমাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে এসেছেন। কিন্তু এই লাইনটা আমি বলতে পারলাম না। আমি কিছু না বলে ফারাজ করিমের দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে বলল, আপনি মিমিকে কিভাবে চিনেন?
এবার আমি বেশ খানিকটা অবাক হলাম। মিমির প্রসঙ্গটা যে এখানে আসবে সেতা আমি ভাবতেই পারি নি। আমি বললাম, আমরা এক সাথে স্কুলে পড়েছি।
-তারপর?
-এসএসসির পরে আর ওর সাথে দেখা নেই। আবার এই খানে এসে আমাদের দেখা হয়েছে।
আমার কথা শুনে ফারাজ করিম কিছু সময় আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। মনে হল যে সে আমার মুখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করছে, আমি সত্য বলছি কিনা বোঝার চেষ্টা করছে। তার চেহারা দেখে মনে হল সে আমার কথা বিশ্বাস করল না। সে বলল, মিমির সাথে আপনার এতো ঘনঘন দেখা হওয়াটা আমি পছন্দ করছি না।
আমার খুব বলতে ইচ্ছে হল যে তুমি পছন্দ না করলে আমি কী করব হে বাপু তবে কথাটা বলার উপায় ছিল না। আমি কোন কথা বললাম না। আসলে এখানে আমার কোন কথা বলা মানেই হচ্ছে বিপদ ডেকে আনা। ফারাজ করিমের কথা আমি জানি বেশ ভাল করেই। সে আবার বলল, আমি চাই আপনি এখান থেকে চলে যাবেন। ট্রান্সফারের ব্যবস্থা আমি করে দিব। কালকের ভেতরে ছুটি নিয়ে বাসায় যাবেন। আপনার নিজের জেলাতে পাঠানোর ব্যবস্থা আমি করছি।
আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে নিজের গাড়িতে গিয়ে উঠল। সে চলে যাওয়ার পরে দেখলাম আমাকে যারা নিয়ে এসেছিল তারাও গাড়ি নিয়ে চলে গেল। আমি একা দাঁড়িয়ে রইলাম। এভাবে এখানে ডেকে এনে হুমকি দেওয়ার কারণটা আমার কাছে পরিস্কার হয়ে এল। আমাকে এই জায়গা ছেড়ে চলে যেতে হবে।
কিন্তু মিমি!
মিমিকে ছেড়ে চলে যাবো?
মিমির প্রতি যে তীব্র আকর্ষণ সৃষ্টি হয়েছে সেটা আমি কিভাবে দূর করব? এখন আমার মিমির থেকে দুরে থাকা সম্ভব না। সত্যিই না। আর সত্যি বলতে মিমি নিজেও আমার প্রতি যেভাবে ভালোবাসা দেখিয়েছে, এর ফলে ওকে ছেড়ে কিভাবে যাবো?
আমার নিজের বাসায় পৌছাতে বেশ সময়ই লাগল। রাতের বেলা গোসল করে নিজের রুমে শুয়ে থাকলাম। মাথার ভেতরে নানান চিন্তা এসে ভর করতে লাগল। মিমির হাসিমাখা মুখ আমার চোখের সামনে ভাসতে লাগল বারবার। আমি কিভাবে ওকে ছেড়ে যাবো?
আচ্ছা ওকে কি সব কিছু খুলে বলব?
এমন হতে পারে আমি এখান থেকে চলে গেলাম। তারপর মিমি নিজেও বদলি হয়ে আমার জেলাতে বা আশে পাশের কোন জেলাতে চলে এল। মেয়েদের পোস্টিংয়ের ব্যাপারটা সহজ বলেই জানি। সে চেষ্টা করলে ব্যাপারটা সমাধান করতে পারবে বলে আশা করি। তাহলে ব্যাপারটা ভাল হবে। দেখি কাল মিমিকে এই ব্যাপারে বলতে হবে। ফারাজ করিমের ব্যাপারেও তাকে সাবধান করতে হবে!
এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুম চলে এসেছে সেতা আমি নিজেও জানি না। ঘুম ভাঙ্গল আমার ফোনের আওয়াজে। কোনো মতে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি রাত প্রায় একটার মত বাজে। তবে মোবাইল স্ক্রিনে মিমির নাম দেখে বেশ অবাক হলাম। সাথে সাথে অবশ্য মনে হল আজকে মিমির নাইট ডিউটি থাকতে পারে। সেই জন্যই আমাকে ফোন দিয়েছে। এমন ভাবে প্রায় রাতেই সে ফোন দেয়। আমিও তার হাসপাতালে যাই। আজকেও যাবো কিনা ভাবলাম।
আমি ফোনটা রিসিভ করতে পারলাম না। তার আগেই ফোনটা কেটে গেল। আমি কল ব্যাক করতে যাবো তার আগেই একটা মেসেজ এসে হাজির হল। ‘ওরা আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে।’
কিছু সময় নিরবতা। আমি কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না। দেখলাম মিমি আমার হোয়াটসএপে একটা লোকেশন শেয়ার পাঠিয়েছে। তার মানে ও যেখানে যেখানে যাবে আমি আমার ফোন থেকেই সেটা দেখতে পাব। আমি এতো অবাক হয়ে গেছি যে প্রথমে কিছু সময় বুঝতেই পারলাম না যে কী করবো! তবে এক সময়ে মনে হল যে আমার এখনই বের হতে হবে। আগে আমি মিমির কাছে তো পৌছাই!
আমি দ্রুত বের হয়ে গেলাম আমার বাইকটা নিয়ে। ফোনে দেখতে পাচ্ছিলাম যে মিমির লোকেশনটা আস্তে আস্তে নড়ছে। আমি সেটা বরাবরই এগিয়ে চললাম। শহরের একেবারে এক পাশে চলেছে রাস্তাটা। আমি মনের ভেতরে তীব্র একটা ভয় নিয়ে এগিয়ে চলেছি। আমার চোখ তখন মোবাইলের ট্রাকারের দিকে। একবার মনে হল যে পুলিশে ফোন করি। তারপরেই মনে হল যে পুলিশে ফোন করার আসলে কোন মানে নেই। মিমিকে ফারাজ করিমের লোকজনই তুলে নিয়ে গেছে। এটা জানার পরে ওরা কোন সাহায্যই করবে না। আবার ফারাজ করিম হয়তো তাদের জানিয়েই করেছে ব্যাপারটা।
নির্ধারিত জায়গাতে পৌছাতে মিনিট বিশেক সময় লাগল। আমি লোকেশনে আসতেই আমি বাড়িটা দেখতে পেলাম। এই বাড়িটা কার? আমি বাইকটা একপাশে সরিয়ে রেখে গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। গেটের ঠিক পরে একটা গাড়ি দাড় করানো। নিশ্চিত ভাবেই এই গাড়িতে করে মিমিকে নিয়ে আসা হয়েছে। আমি গাড়ির কাছে আসতেই দেখতে পেলাম সেখানে তবে গাড়ির ভেতরে কেউ নেই। আমি এবার একতলা বাড়িটার ভেরতে ঢুকে পড়লাম। আশ্চর্য ভাবে এই বাসায় কেউ নেই। বাড়িটা এমন নির্জন যে মনে হচ্ছে যেন এই বাড়িতে কোনো দিন কেউ ছিলই না। একবার মনে হল যে মিমির নাম ধরে ডাক দিই কিন্তু সেটা দিতে সাহস হল না। যখন আমি কোন দিকে যাবো, এটা নিয়ে দ্বিধায় ভুগছি তখনই আমি আওয়াটা শুনতে পেলাম। কেউ যেন গোঙাচ্ছে। ডান দিকের ঘরটা থেকে আসছে আওয়াজ। আমি ধীর পায়ে সেদিকে এগিয়ে গেলাম। তারপর দরজার নব ঘুরিয়ে যখন দরজাটা খুললাম তখন বুকের ভেতরে একটা তীব্র ধাক্কা এসে লাগল।
আমি এটা কী দেখছি! এমন কিছু সম্ভব!
আমি এই দৃশ্যটা কিভাবে বর্ণনা করব সেটা বুঝতে পারলাম না। ঘরটা অন্ধকার নয়। আলোকিত। তবে আলোটা কোন বাল্ব থেকে আসছে না। আলো আসছে ঐ অদ্ভুত প্রাণীটার শরীর থেকে। সেই আলোতে আমি দেখতে পেলাম যে ফারাজ করিমের দেহটা ভাবছে। আলোর রংয়ের প্রাণীটা দেখতে অনেকটা মানুষের মত বটে তবে মানুষ সেটা নয়। তার পুরো শরীর থেকে সুক্ষ শুড় বের হয়েছে অসংখ্য এবং সেই শুড় গিয়ে ফারাজ করিমের পুরো শরীরে গিয়ে বিঁধেছে। আমি কেবল সেদিকে কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে রইলাম সেদিকে। আমার এই রকম উপস্থিতিতে প্রাণী আমার দিকে ফিরে তাকাল কেবল। তবে কিছুই করল না। আমি স্থির হয়ে তাকিয়ে রইলাম। যেন আমি জমে গেছি। প্রাণীটা কিছু সময় আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর আবারও মুখ ঘুরিয়ে ফারাজ করিমের দিকে তাকাল। আমি দাঁড়িয়েই রইলাম কিছু সময়। তারপর ধীরে ধীরে পিছিয়ে এলাম। দরজাটা আবারো বন্ধ করে দিয়ে দৌড়ে বের হয়ে গেলাম বাড়িটা থেকে।
তবে একেবারে চলে যেতে পারলাম না। মোবাইলটা বের করে দেখতে পেলাম যে মিমির লোকেশনটা তখনও বাসার ভেতরেই। ওকে বার কয়েক ফোন দিলাম আমি। রিং হল তবে মিমি ফোন ধরল না। আমি বাড়িটা সামনের রাস্তায় অস্থির হয়ে আমি পায়চারি করতে শুরু করলাম। একবার মনে হল ভেতরে ঢুকি আবার কিন্তু যা দেখেছি আমি সেটার কারণে ভেতরে ঢুকতে সাহস হল না। আমি এখন কী করবো? আমার এখন কী করা উচিৎ? মিমি কোথায় আছে?
আমি একটু আগে যেটাকে দেখলাম সেটা আসলে কী? আমি কি ঠিক দেখেছি? নাকি ভুল দেখলাম! আমি কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। আমার মনের একটা অংশ আমাকে বলছিল যে এখনই এখান থেকে আমার চলে যাওয়া উচিৎ। পালিয়ে যাওয়া উচিৎ আবার মনের অন্য আরেকটা অংশ বলছে যে মিমিকে এখানে একলা রেখে আমার যাওয়া উচিৎ না।
কত সময় আমি বাড়ির সামনের রাস্তায় দাড়িয়েছিলাম সেটা আমি জানি না তবে হঠাৎ আমি বাড়ির গেটটা খোলার আওয়াজ শুনতে পেলাম। সেদিকে তাকিয়ে দেখতে পেলাম যে মিমি বের হয়ে এল। টলতে টলতে সে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। ওর পরনের পোশাকের দিকে তাকাতেই খেয়াল করে দেখলাম যে সেটার অবস্থা বেশ খারাপ। কয়েক স্থানে ছিড়ে গেছে। কয়েক জায়গাতে রক্ত লেগে রয়েছে। আমি দ্রুত ওর কাছে গিয়ে ওকে ধরলাম, তারপর বললাম, কী হয়েছে তোমার? কে এমন হাল করেছে?
মিমি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কিছু না। চল এখান থেকে!
-কিছু বল তো আগে!
-এখন সময় না। এখান থেকে চল প্লিজ!
আমি আর জোর দিলাম না। মিমি ফিরে এসেছে এটাই সব থেকে বড় কথা। মিমিকে ধরে তোলার চেষ্টা করলাম। তখনই অনুভব করলাম যে মিমির শরীরটা বেশ দূর্বল মনে হল। ও যেন ঠিক মত হাটতে পারছে না। আমি ওকে কোলে তুলে নিলাম। তারপর বাইকে বসিয়ে দিলাম। ওকে বললাম যেন আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখে। আমি কয়েকবার পেছনে ফিরে তাকালাম। আমার বারবার মনে হচ্ছিল যেন ওটা আমাদের পিছু নিয়ে আসছে। এখনই হয়তো আমাদের উপরে ঝাপিয়ে পড়বে।
বাসায় যখন পৌছালাম তখনও মিমির অবস্থায় বেশ নরম মনে হল। আমি ওর পুরো শরীর মুছে দিলাম। গায়ের ধুলা ময়লা রক্ত সব। একটা ব্যাপার খেয়াল হল যে ওর পোশাকে যে রক্ত লেগে আছে সেটা ওর শরীরের নয়। মানে ওর শরীরে কোন আঘাতের চিহ্ন আমি পেলাম না। পুরোটা সময় ওর চোখে কেমন একটা ঢুলুঢুলু ভাব। আমি ওকে বদলানোর জন্য আমার একটা টিশার্ট আর ট্রাইজার দিলাম। খানিকটা টলতে টলতেই ও পোশাক বদলাতে বাথরুমে ঢুকল। আমি বাইরে অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিন্তু যখন ভেতর থেকে পড়ে যাওয়ার আওয়াজ এল তখন দ্রুত আমি তেতরে ঢুকলাম। দেখলাম মিমি মেঝেতে পড়ে রয়েছে।
কাজটা ঠিক হবে কিনা জানি না তবুও কাজটা করলাম। নিজ থেকেই ওর পোশাক বদলে দিলাম। সত্যি বলতে কি মিমির এই দেহ পল্বব দেখে নিজেকে সংবরন করে রাখার মত কঠিন কাজ আর ছিল না।
রাতে ওকে শুইয়ে দিয়ে নিজের বিছানা শুতে শুয়ে ভোর হয়ে গেল। মাথার ভেতরে কতগুলো চিন্তা কাজ করছিল। কিছুতেই আমি প্রশ্নগুলোর উত্তর মিলাতে পারছিলাম না। কোথা থেকে কী হয়ে গেল! ওটা কী ছিল? আমি কী দেখলাম!
উত্তর অবশ্য পেতে খুব বেশি সময় লাগল না। সকালবেলা আমার একটু দেরি করে ঘুম ভাঙ্গল। ঘুম ভাঙ্গতেই দেখতে পেলাম খাবার টেবিলে সকালের নাস্তা তৈরি করা রয়েছে। সেখানে একটা ছোট চিরকুট। ‘‘তুমি আরাম করে ঘুমাচ্ছিলে তাই ঘুম ভাঙ্গাই নি। পরে কথা হবে।’’
সকালে অফিসে যেতে একটু দেরিই হল। তবে মুল ঝড়টা এল দুপুরে লাঞ্চ আওয়ারের পরে। আমাদের অফিসের রফিক ভাই জানালেন যে আমাদের জেলার এমপি সাহেব তার ফার্মহাউজে খুন হয়েছেন। চারিদিকে বিশাল গ্যাঞ্জাম অবস্থা। এই খবরটা পাওয়া মাত্রই আমার বুকের ভেতরে ধক করে উঠল। আমি এই ঘটনার সব কিছু আগে থেকেই জানি। আমি জানি ফারাজ করিম মারা গেছে। আমি সব জানি।
আমি মিমিকে কয়েকবার ফোন দেওয়ার চেষ্টা করলাম কিন্তু ফোন ঢুকল না। আমার মনের ভেতরে একটা ছটফট ভাব কাজ করতে থাকল। আমি মনের ভেতরে কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিলাম না। অফিস থেকে বাড়ি না গিয়ে আমি সোজা মিমির হাসপাতালে গিয়ে হাজির হলাম। সেখান থেকে একজন নার্স আমাকে জানাল যে মিমি আজকে হাসপাতালে আসে নি। গতকালকের ঘটনার পরে তার খোজ নেই।
আমি বললাম, গতকালকের ঘটনা বলতে?
নার্স বলল, আপনি জানেন না কিছু?
-না তো!
-গতকাল মিমি ম্যাডামের নাইট ডিউটি ছিল কিন্তু রাত বারোটার দিকে কয়েকজন লোক এসে হাজির হয় হাসপাতালে। ওরা ফারাজ করিমের লোক। তারা মিমিকে তাদের সাথে নিয়ে যায়।
আমি বললাম, আপনারা বাঁধা দেন নি?
-আমরা বাঁধা দিতে চেয়েছিলাম তবে ওদের মারমুখো ভাব দেখে মিমি ম্যাডামই নিজের ইচ্ছেতে তাদের সাথে যায়। বলে যায় তাকে নিয়ে যেন আমরা চিন্তা না করি।
-তারপর?
-তারপর ম্যাডামের আর কোনো খোজ নেই। এখন আবার ফারাজ করিম খুন হয়েছেন। আমার বেশ চিন্তা লাগছে। পুলিশ এসেছিলে একটু আগে। তারাও ম্যাডামের খোজ নিয়ে গেছে।
আমি অবশ্য গতকাল রাতের ঘটনা বললাম না। আমি যে সেখানে ছিলাম, আমিই মিমিকে আমার বাসাতে নিয়ে এসেছি এই খবর কেউ জানে না এখনও। আমি আসলে কী করবো ঠিক বুঝতে পারলাম না। মিমির ফোনে কয়েকবার ফোন দিলাম। কোন লাভ হল না। ফোনটা বন্ধই দেখাচ্ছে।
এমপি ফারাজ করিমের মৃত্যু নিয়ে অদ্ভুত সব তথ্য আসতে লাগল। সন্ধ্যার দিকে যে সংবাদ পাওয়া গেল তাতে আমার মনের ভেতরে অদ্ভুত একটা অনুভূতির জন্ম দিল। রিপোর্টে বলছে ফারাজ করিমের মৃত্য কিভাবে হয়েছে সেটা সঠিক ভাবে বলা যাচ্ছে না। তার শরীরের কোথাও কোন আঘাতের চিহ্ন নেই। তবে মনে হচ্ছে যেন পুরো শরীরে একফোটা রক্ত নেই। আমি চমকে উঠলাম। আমার কাছে পুরোব্যাপারটা পরিচিত মনে হল। এমন একটা ঘটনা আগেই ঘটেছে। ঠিক একই রকম ঘটনা আগেও ঘটেছে। আমি আবারও মিমিকে ফোন দিতে লাগলাম। কোন খোজ নেই।
তবে মিমির খোজ পাওয়া গেল। রাত আটটার দিকে পুলিশ আমাকে ফোন দিল। আমাকে যেতে বলল থানাতে। আমি কয়েকবার জিজ্ঞেস করলাম বটে তবে কোন উত্তর দিল না। বলল যে আমি থানাতে গেলেই সব উত্তর পাওয়া যাবে।
আমি সাড়ে আটটার ভেতরে থানাতে পৌছে গেলাম। থানাতে তখন অনেক ভিড়। মানুষের অভাব নেই। একজন সিপাহীর সাথে কথা বলে জানালাম যে আমাকে ওসি সাহেব আসতে বলেছেন। সেই সিপাহী ফাঁক গলে আমাকে থানার ওসির রুমে নিয়ে গেল। রুমে ঢুকতেই একটা চমক। সেখানে মিমি বসে আছে। আমি ঘরে ঢুকতেই দেখলাম মিমি উঠে দাঁড়াল। তারপর আমার দিকে ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। এমন একটা ভাব যেন আমাকে দেখে তার জানে প্রাণ ফিরে এসেছে। তবে আমার কাছে ব্যাপারটা একটু অভিনয়ই মনে হল!
আমি মিমিকে শান্তনা দেওয়ার ভাব করলাম। এক সময়ে মিমি যেন শান্ত হয়েছে এমন একটা ভাব করল। আমি ওসি সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললাম, কী ব্যাপার ওসি সাহেব, মিমিকে এখানে কেন এনেছেন?
ওসি সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ওনাকে আসলে এখানে আনা হয় নি।
-তাহলে?
-আমরা ওনাকে উদ্ধার করে পেয়েছি।
-উদ্ধার!
-এমপি সাহেবের কথা তো শুনেছেনই!
-জ্বী।
-গতকাল ঐ ফার্মহাউজের নিচের বেজমেন্ট থেকে আমরা ম্যাডামকে উদ্ধার করেছি। ওনাকে সম্ভবত এমপির লোকজন তুলে নিয়ে গিয়েছিল।
মিমিকে দেখলাম এবার ওসি সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলতে, এখন সম্ভবত বলছেন? ঐ বদমাইশটা আমাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছে এটা প্রমান করতে হবে!
ওসি সাহেব এবার নরম গলায় বলল, দেখুন মিস মিমি, একটু বোঝার চেষ্টা করুন। ফারাজ করিমের ব্যাপারটা নিয়ে আমরা এমনিতেই বড় ঝামেলাতে আছি। তারপর উপরে যদি আপনার ব্যাপারটা সামনে আসে তখন পুরো ব্যাপারটা গোলমেলে হয়ে যাবে।
-তার মানে আমাকে চুপ করে থাকতে হবে, তাই তো! এই আপনাদের ন্যায়?
-দেখুন যে অপরাধ করেছিল সে মারা গেছে, খুন হয়েছে! আর কী করবো বলুন!
আমি মিমির দিকে তাকিয়ে দেখলাম মিমি বেশ রাগত হয়ে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম, আপনি আসলে চাইছেন কী বলুন?
-দেখুন মিস মিমির যে ঐ বাড়িতে ছিল এটা কেউ জানেই না। আমরা ব্যাপারটা কোথাও লিখি নি। মিমি ম্যাডাম যদি এই ব্যাপারটা না তোলেন তবে সে যে ঐ বাড়িতে ছিল এটা কেউ জানবে না।
-তার মানে ঐ খুনের সাথে মিমির কোন সম্পর্ক থাকবে না, তাইতো?
-জ্বি।
-ওকে তাই করুন। মিমির নাম যেন না আসে। নাম আসলে বুঝতেই পারছেন সেটা ফারাজ করিমের রেপুটেশনের জন্য ভাল হবে না।
-আমাকেও আসলে এমন কথাই বলা হয়েছে।
-আচ্ছা তবে তাই হোক। আমি ওকে নিয়ে যাই তাহলে?
-হ্যা নিয়ে যান!
আমি এবার বললাম, আচ্ছা ফারাজ করিমের কী খবর? মানে ওনার মৃত্যুটা কিভাবে হয়েছে ?
-সত্যি বলতে কী আমাদের কাছে আইডিয়াই নেই। তার শরীরে কোন আঘাতের চিহ্ন নেই। কিভাবে তার শরীর থেকে সব রক্ত কেউ বের করে নিল সেটা বুঝতেই পারছি না।
আমি মিমিকে নিয়ে বের হয়ে এলাম থানা থেকে। ওসি সাহেব বুঝতে না পারলেও আমি ঠিক ঠিক বুঝতে পারছি যে কিভাবে ফারাজ করিবের শরীরের সব রক্ত করে নেওয়া হয়েছে। এমন কি সেই কয়েক বছর আগে মিরাজের শরীরের রক্তও কিভাবে বের করে নেওয়া হয়েছিল সেটাও আমি জানি। ওকে ওর বাসায় পৌছে দিলাম। আমি যখন চলে আসছিলাম তখন মিমি বলল, কিছু জানতে চাইবে না?
-নাহ! সব কিছু জানতে নেই।
মিমি আমার দিকে বেশ কিছু সময় তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, আমাকে ভয় করছে না?
-নাহ!
যদি আমার বুকের ভেতরে একটা ঢুকঢুক শব্দ হচ্ছে। আমি সেটা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। আমার কেন জানি মনে হল মিমিও সেটা শুনতে পাচ্ছে। মিমি আমার দিকে এগিয়ে একটু। তারপর আমার মুখের একদম কাছে এসে বলল, আমি তোমার বুকের ভেতরের লাফালাফি শুনতে পাচ্ছি। তবে আমি ধরে নিচ্ছি যে ভয়ে নয় বরং আমার কাছে আসার কারণে তোমার বুকের ভেতরটা লাফাচ্ছে। তবে তোমাকে একটা কথা জানিয়ে রাখি যে আমি কোনদিন কোন ভাল মানুষের ক্ষতি করি নি। করবো না।
কিছু সময় থাকলে সে। একটু পরে আবারও বলল, তারপরেও যদি তুমি আমার কাছ থেকে দুরে চলে যেতে চাও আমি তোমাকে বাধা দিবো না।
এই বলে সে আমাকে বিদায় দিল। আমার ভেতরে কী হল জানি না আমি এগিয়ে গেলাম ওর দিকে। তারপর ওকে জড়িয়ে ধরলাম। তারপরই ওর ঠোটে চুমু খেলাম। ওর ঠোটটা আমার কাছে আগের থেকেও বেশি নরম মনে হল যেন।
মিমি এই পৃথিবীর কোনো প্রাণী না। সে দুরের কোন গ্রহ থেকে এই পৃথিবী থেকে এসেছে। মানুষের রূপ ধরেই ওরা এখানে বসবাস করে আসছে অনেক বছর ধরে। এমনিতেই শান্তি প্রিয় প্রাণী ওরা তবে ওদের উপরে কেউ এগ্রিসিভ হলেই ওরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এই ভাবে প্রাণী দেহে নিজেদের শুড় ঢুকিয়ে তার শরীর থেকে সমসত রক্ত শুষে নেয়। সেই শুড় এতোটাই সুক্ষ যে খালি চোখে ধরা যায় না। তবে অধিক পরিমান রক্ত শুষে নিলে ওদের হে কিছুটা সময়ের জন্য বেসামাল হয়ে যায়। এই কারণেই সেইদিন আমাকে ডেকেছিল। ওর ভয় ছিল যে যদি এর ভেতরে ফারাজ করিমের কেউ চলে আসে তবে অবস্থা খারাপ হবে।
পরে আমি যখন ওকে বাসায় নিয়ে আসি তখন বেশ সুস্থ হয়ে যায়। তারপর মিমি চিন্তা করে দেখে যেন ও যে ফারাজ করিমের ফারাজ করিমের ফার্ম হাউজে ছিল সেটা লুকিয়ে রাখা যাবে না। তাই ভোরের সময়েই সে সেখানে গিয়ে হাজির হয়। আমার হাতের ছাপ সেই পরিস্কার করে দেয়। পরে নিজেকে বেজমেন্টে গিয়ে হাজির হয়। নিজের শুড় দিয়ে বাইরে থেকে দরজারটা আটকানোর ব্যবস্থা করে যেন দেখলে মনে হয় যে ওকে বাইরে থেকে আটকে রাখা হয়েছে।
আসলস সত্যটা জানার পরে প্রথম প্রথম মিমিকে আমার বেশ ভয়ই লাগতো তবে এক সময়ে সেই ভয় কেটে গেছে। আমার প্রেমিকা একজন এলিয়েন এটা তো দারুণ একটা ব্যাপার!